ইসলামে নারীঃ-


================📝==================


নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি ওয়া নুসাল্লিম আ'লা রাসুলিহিল কারিম।আম্মা বা'দঃ-

মানুষ সামাজিক জীব, অন্যদিকে প্রকৃতির অংশ। তাই মানুষকে জীবন ধারণ, বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় বিধানই মেনে চলতে হবে। প্রাকৃতিক বিধান লঙ্ঘন করলে ধ্বংস অনিবার্য। আর সামাজিক বিধান ভঙ্গ করলে নেমে আসে বিপর্যয়। সামাজিক নিয়মগুলো প্রকৃতি থেকে মানুষের লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে ওঠে। বিধানসমূহের মধ্যে ধর্মীয় বিধানই শ্রেয়।


বহুপূর্ব থেকেই নারী অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। সবদিক দেশে তার অধিকার আদায়ে তার মর্যাদায় তার স্বাধীনতা ও তার ক্ষমতায়নে। ইসলাম পূর্ব-যুগে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত উপেক্ষিত ও শোচনীয়। সব ধরনের নৈরাজ্যের মাঝে বর্বরতা ও নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে নারী নির্যাতন। সমাজে নারীরা ছিল অপাঙ্ক্তেয়। তাদেরকে মানুষরূপেই ভাবা হতো না। নারীরা ছিল পুরুষের লালসার শিকার, ভোগের সামগ্রী, ভোগ্যপণ্য হিসাবে তাদেরকে ক্রয় বিক্রয় করা হতো।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর আবির্ভাবের সময় পৌত্তলিক আরবে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। হিন্দুরা নারীকে সব পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বলে ঘৃণা করত। ইহুদিরা নারীকে সব পাপের মূল হিসাবে জানত। খ্রিস্টানরা নারীকে নরকের কীট ও অকল্যাণের উৎস মনে করত। চীনে নারীদের দ্বারা লাঙল টানাতো। পাশের দেশ ভারতে হিন্দুরা নারীদের দাসীর মতো ব্যবহার করত এবং সতীদাহের মতো ঘৃণা প্রথা প্রচলিত ছিল। ঘোড়ার লোজের অগ্রভাগ নারীর চুল বেধে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম মান্যের ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে যাবতীয় অত্যাচার নির্যাতন ও অসমতা দূর করে। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়েছে।

মানব জাতির ঐসব ভয়াবহ নৈতিক, অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মুক্তির দিশারী ও শান্তির দূত হিসাবে ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে প্রেরণ করেছেন। নারীজাতির উপর অন্যায় অত্যাচার নির্যাতন শোচনীয় ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সমাজে নারী জাতির অবস্থান নিরূপণের জন্য পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন সূরা আননিসা। উক্ত সূরার প্রথমেই আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ জাতি, তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দু’জন থেকে অসংখ্য নরনারী পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

শুধু সূরা আন-নিসা নয়। পবিত্র আল কুরানের অনেক সূরায় নারীর অধিকার ও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। 


সূরা আন নিসার ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে তেমনি নারীরও অংশ রয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় বিভিন্নভাবে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীর মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি অধিকার দিয়েছেন। সূরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের পোশাক, তেমনি তোমরা তাদের পোশাক’।

সূরা আলে ইমরানের ১৯৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি তোমাদের কোনো কর্মী বা সহপাঠীর কাজ নষ্ট করি না। সে নারী হোক বা পুরুষ হোক। তোমরা পরস্পর এক। অন্য এক আয়াতে বলা হয়। ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার রমনীরা একে অপরের সহায়ক ও বন্ধু। তারা একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজের নিষেদ করবে।’ ইসলাম ধর্মে নারীর জীবনব্যবস্থা ও সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্ত্রী, কন্যা, মাতা ও ভগ্নী হিসাবে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা অধিকার ও স্বাধীনতার সঙ্গে সামগ্রিক সব বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও উৎসাহিত করেছে।

হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেন, বিশ্বে বহু অমূল্য সম্পদ রয়েছে। আর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে নেককার নারী। তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সদাচারণ করো।’ আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, ‘যে বিয়ে করে সে তার দীনের অর্ধেক পূর্ণ করে।’ ইসলাম নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে মা হিসাবে। মায়ের সম্মানের উপর এক সম্মান আছে, তাহলো আল্লাহর ইবাদত। মা হিসাবে ইসলাম নারীকে যে মহান মর্যাদায় আসীন করেছে, তার নজির নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহশ্ত। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার  স্ত্রীর নিকট উত্তম। ঐতিহাসিক হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, ভ্রাতৃগণ শ্রবণ করো ইসলামে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। নারীদের প্রতি তোমরা সদব্যবহার করবে। তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না।

ইসলাম ধর্ম প্রথম নারীর স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্বাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগ দখলের অখণ্ড অধিকার দিয়েছে নারীকে। মাবন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে অর্থনৈতিক অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কন্যা, স্ত্রী, বোন ও মাতা হিসেবে মুসলিম নারীর মিরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক পিতা ও স্বামী উভয়দিক থেকে উত্তরাধিকার লাভ করে তারা পেয়েছে মালিকানাস্বত্ব এবং তা স্বাধীনভাবে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার। ইসলাম নারীকে পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে মতামত প্রকাশ ও সমাজকল্যাণের যেকোনো কর্মকাণ্ডে নারীরা পুরুষের মতই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই মর্মে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যোগ্যতানুসারে নারীরা প্রধান বিচারপতির পদও অলঙ্কৃত করতে পারবে।


ইসলামে আরও উল্লেখ আছে, নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োগকৃত সম্পদ এবং লাভ একমাত্র তারই আওতাধীন। স্বামী কিংবা অভিভাবকদের এক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না। যদি না স্বেচ্ছায় তা দান না করে।

এ সম্পর্কে সূরা আন নিসার ৩২নং আয়াতে বলা হয়েছে, পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেবার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। একজন পুরুষের যেমন অধিকার আছে নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নেবার তেমনটি নারীর জন্যও রয়েছে। ইসলাম বলেছে, কোন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ দেয়া আইনগত অপরাধ। বিবাহ বিচ্ছেদ ও তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন স্বামী তার অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দেবার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি অত্যাচারী অযোগ্য অকর্মন্য স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একজন স্ত্রীরও তালাক দেবার অধিকার আছে। এইভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মর্যাদা ও পারিবারিক সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা লাভে সহায়তা করেছে ইসলাম। 


ইসলামের মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ‘নিসা’ অর্থাৎ ‘মহিলা’ শব্দটি ৫৭ বার এবং ‘ইমরাআহ’ অর্থাৎ ‘নারী’ শব্দটির ২৬ বার উল্লেখ হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘নিসা’ তথা ‘মহিলা’ শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্যসংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র বৃহৎ সূরাও রয়েছে। এ ছাড়া কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। দিয়েছে নারীর জান-মালের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান।

১৯১৭ সালে কম্যুনিস্টদের (বলশেভিক) নেতৃত্বে ঘটেছিল রুশ বিপ্লব। বিপ্লবীরা বিশেষভাবে নারীদের সমানাধিকারের কথা বলেন। নারীদের এরা গৃহকর্ম পরিহার করে বাইরে কলকারখানা ও রাষ্ট্রিক কাজে যোগ দিতে দেয় ব্যাপক উৎসাহ। কারণ, কম্যুনিস্টদের অন্যতম চিন্তাগুরু ফ্রেডারিক অ্যাঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘নারীস্বাধীনতার জন্য নারীদের গৃহকর্ম ছেড়ে বহির্বিশ্বে কাজে আসতে হবে।’ কিন্তু পরে কম্যুনিস্টদের মত বেশ কিছুটা বদলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়। অনেক মানুষ মারা যায়। সংকট দেখা দেয় জনশক্তির। এবার কম্যুনিস্টরা নারীদের মা হতে উৎসাহ দিতে আরম্ভ করে। নারীর আসল পরিচয়ই হল মাতৃত্বে। তারা পালন করবেন সন্তান। নইলে উন্নত স্বাস্থ্যবান কর্মনিপুণ জনশক্তির অভাব ঘুচবে না।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। শোনা যাচ্ছে, রাশিয়া ও তার সাথে যুক্ত থাকা ১৪টি রিপাবলিকের নারীরা এখন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন আরো গৃহমুখী; ঘরকন্না। গড়তে চাচ্ছেন সুখী পরিবার। আসলে ইসলামে দেয়া হয়েছে নারীর বিশেষ মূল্য। একসময় সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে মেয়ে জন্মালে তাকে জীবন্ত প্রথিত করা হত; কিন্তু ইসলামে এভাবে মেয়েশিশু নিধনকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কুরআনুল কারিমে এভাবে মেয়েশিশু নিধনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ঘৃণ্য পাপকাজ হিসেবে। সাধারণভাবে বলা হয়েছে- মেয়েশিশু জন্মালে মুখ কালো কোরো না (সূরা ১৬ : ৫৮,৫৯)। 

কুরআনে স্বামীকে স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্বের অধিকার দেয়া হয়েছে। কারণ, ইসলামি মতে স্বামী বাধ্য থাকে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণ দিতে। যেহেতু স্বামীর আয়ে সাধারণত সংসার চলে, তাই স্বামীকে দেয়া হয়েছে স্ত্রীর ওপর কিছুটা কর্তৃত্ব। পক্ষান্তরে কুরআন নারীদেরকে পৃথকভাবে সম্পত্তি রাখার অধিকারও দিয়েছে। সেই সম্পত্তি তার নিজের। সম্পত্তির আয়ও তার নিজের। এই আয়ের ওপর তার স্বামীর কোনো অধিকার নেই। 

ইসলাম নারীকে দিয়েছে স্বাধীনভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য করার বিশেষ অধিকার। তাই মেয়েরা যে অর্থনৈতিকভাবে কেবলই স্বামীনির্ভর, তা বলা চলে না। ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সৎকর্মকে। সৎকর্ম বা ভালো কাজ বলতে ইসলামে সেই সব কর্মকে বোঝানো হয়েছে, যা মানুষকে বাঁচতে ও সুখী হতে সাহায্য করে। কুরআনে আল্লাহ তায়া'লা বলেন, ‘ভালো কাজের জন্য নারী ও পুরুষ উভয়েই আল্লাহর কাছে সমভাবে পুরস্কৃত হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করবেন না’। ( সূরা ৩৩ : ৩৫)। অর্থাৎ নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্যকে কখনোই বড় করে দেখার চেষ্টা করা হয়নি।

ধু-ধু মরুভূমিতে যেমন বৃষ্টির পরশ ছাড়া সবুজের দেখা মেলে না, পৌরুষত্ত্বের অনন্ত ভূমিতেও তেমনি নারীর স্পর্শ ছাড়া জীবন তার পাখা মেলে না; ফসল ফলে না জীবন সাহারায়। শুষ্ক জমিনে সবুজের দেখা পেতে যেমন পানির প্রয়োজন, পুরুষের জীবনসায়াহ্নে পূর্ণতা পেতে তেমন প্রয়োজন নারীর সংস্পর্শ। নারী-পুরুষ একে অপরের সহযোগী ও সম্পূরক। তাইতো নারীবিহীন বেহেশতও ছিল শূন্য। যে কারণে আদম (আ.) এর বাম পাঁজরের হাড্ডি দিয়ে সৃষ্টি করা হল মা হাওয়াকে। অতঃপর তাকে পাঠানো হলো সঙ্গীহীন আদম (আ.) এর কাছে। 

জান্নাতের প্রথম অতিথির শূন্যতা ঘুচে পূর্ণতা এল এই নারীর হাত ধরেই। নারীর সংস্পর্শেই। জগতের যা কিছু দান, তার অর্ধেকটা এই নারীরই অবদান। তাই ইসলামি আইন নারীকে সমানাধিকার নয়, সমমর্যাদা দিয়েছে। নারীকে যেখানে মানায়, সেখানেই তাকে রাখার বিধান দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম নারীকে দিয়েছে যথোচিত মর্যাদা; যথোপযুক্ত সম্মান। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘এই পার্থিব জগতের সবকিছুই আরাম আয়েশের সামান মাত্র। আর দুনিয়ার মধ্যে সর্বোত্তম সম্পদ হলো সতী-সাধ্বী স্ত্রী।’ (মুসলিম শরীফ : ১৪৬৭)। তিনি অন্য একটি হাদীসে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের দুনিয়ার ৩টি জিনিস আমার প্রিয়। নারী ও সুগন্ধি। আর নামাজ আমার চোখের শান্তি।’ (কানযুল উম্মা : ১৮৯১৩)


হাদীস সারবস্তু হল-


 পার্থিব জীবনে সর্বোৎকৃষ্ট নেয়ামত হলো সাধ্বী নারী।

ইসলাম নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেয় নাই। কারণ, এটা অযৌক্তিক। কৃত্রিম। কপট। বরং ইসলাম নারীকে দিয়েছে পুরুষের সমান মর্যাদা। সম্মান। প্রাপ্য। ইসলামি আইন নারী ও পুরুষকে দেখেছে একই চোখে; অভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। পুরুষকে পুরুষের জগতে যেভাবে দেয়া হয়েছে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা, নারীকেও তাদের নিজস্ব ভূবনে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দিয়েছে ইসলাম। নারীকে যেভাবে সতীত্ব রক্ষায় পর্দার বিধান মেনে চলার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তেমনিভাবে পুরুষকেও পরনারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নারীকে যেভাবে সতীত্ব রক্ষায় কঠোরতার সাথে বিধি বেঁধে দেয়া হয়েছে, তেমনিভাবে পুরুষের চরিত্র রক্ষায়ও একই নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছে। 

যদিও আমরা কেবল নারীকেই মাপি সতীত্বের মানদণ্ডে, পুরুষকে ঘুণাক্ষরেও ভাবা হয় না- পুরুষও হতে পারে অসচ্চরিত্র (সতীত্বহারা)- নিক্ষিপ্ত-পতিত! কিন্তু ইসলামের বিচারে সতীত্বের প্রশ্নে নারী-পুরুষ সকলেই সমান। নারীর মত পুরুষের জীবনেও চরিত্র বা সতীত্ব এক আকাঙ্ক্ষিত ও অনিবার্য গুণ। অসতী নারী যেমন সমাজের অপাংক্তেয়-পতিতা; সতীত্ব হারিয়ে নারী যেমন হয়ে পড়ে সমাজের গলিতাংশ, অস্পৃশ্য- ইসলামের বিচারে চরিত্রহারা পুরুষও তদ্রূপ অপাংক্তেয়- গলিত-পতিত! আর এই চরিত্র রক্ষার একমাত্র উপায় যেহেতু নারী এবং বৈধ বন্ধন- তাই রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘সতী নারী হলো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।’ আর সেই সতী নারীকে কাছে পাবার, তার পরশে সতীত্ব রক্ষার একমাত্র পথ বিবাহসেতুকে বলেছেন- ‘এটা আমার আদর্শ।’

তাইতো দেখি পুরুষ ছুটে যায় নারীর সকাশে। নারীর অস্তিত্বে খুঁজে ফিরে পার্থিব স্বার্থকতা। নারীর জীবন ধারণের ভার তুলে নেয় নিজের কাঁধে। সীমাহীন পরিশ্রম আর অগণ্য ঘানি টেনে টেনে সার হয় স্বতস্ফুর্ত মনে, উৎফুল্ল চিত্তে। তবুও সে সুখী। কারণ, তার জীবন সাহারায় সবুজের দেখা মিলেছে। তার বিরানভূমিতে সজীবতার আগমন ঘটেছে।

নারীর শিক্ষা


নারীদের তালিম তালবিয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আছে, ‘তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও (উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো)।’ হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ইলম শিক্ষা করা (জ্ঞানার্জন করা) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ (কর্তব্য)।’ (উম্মুস সহিহাঈন-ইবনে মাজাহ শরিফ)। তাই হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২ হাজার ২১০, যা সব সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।


নারীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা

একইভাবে আধ্যাত্মিক মহিমা অর্জনের ক্ষেত্রেও নারীর কর্তব্য রয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এ কথা সুনিশ্চিত, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম মুমিন, হুকুমের অনুগত, সত্যবাদী, সবরকারী, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকা দানকারী, রোজা পালনকারী, নিজেদের সম্ভ্রমের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী, আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত ও প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ (সূরা-২২ আহজাব, আয়াত: ৩৫)।

মা হিসেবে নারীর সম্মান

ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক লোক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমার মা’। ওই লোক জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। ওই লোক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবারও তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। (বুখারি)।

মহানবী (সা.)-এর জামানার বিখ্যাত এক ঘটনার কথা আমরা জানি। মায়ের সেবা করার কারণে হজরত ওয়াইস করনি (রা.) প্রিয় নবীর জামানায় থেকেও সাহাবি হতে পারেননি। একবার ওয়াইস করনি (রা.) নবীজির কাছে খবর পাঠালেন ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার সঙ্গে আমার দেখা করতে মন চায়; কিন্তু আমার মা অসুস্থ, এখন আমি কী করতে পারি?’ নবীজি (সা.) উত্তর পাঠালেন, ‘আমার কাছে আসতে হবে না। আমার সঙ্গে সাক্ষাতের চেয়ে তোমার মায়ের খেদমত করা বেশি জরুরি।’ নবীজি (সা.) তাঁর গায়ের একটি মোবারক জুব্বা ওয়াইস করনির জন্য রেখে যান। তিনি বলেন, মায়ের খেদমতের কারণে সে আমার কাছে আসতে পারেনি। আমার ইন্তেকালের পরে তাকে আমার এই জুব্বাটি উপহার দেবে। জুব্বাটি রেখে যান হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে। এবং প্রিয় নবী (সা.) বলেন, হে ওমর! ওয়াইস করনির কাছ থেকে তুমি দোয়া নিয়ো।

কন্যা হিসেবে নারীর সম্মান

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মেয়েশিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক।’ হাদিস শরিফে আরও আছে, ‘যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যাসন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যাসন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়।’

বোন হিসেবে নারীর সম্মান

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কারও যদি কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান থাকে আর তিনি যদি সন্তানদের জন্য কোনো কিছু নিয়ে আসেন, তবে প্রথমে তা মেয়ের হাতে দেবেন এবং মেয়ে বেছে নিয়ে তারপর তার ভাইকে দেবে।’ হাদিস শরিফে আছে, বোনকে সেবাযত্ন করলে আল্লাহ প্রাচুর্য দান করেন।

স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মান

ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক।’ (মুসলিম শরিফ)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে–ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। কোরআনে আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত ২২৮)।     

বিধবার অধিকার ও সম্মান

বিধবাদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যারা বিধবা নারীর ভরণ–পোষণের দায়িত্ব নেয়, তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজি ও সদা রোজা পালনকারী। (বুখারি ও মুসলিম)। 

নারীর প্রতি সম্মান পুরুষের ব্যক্তিত্বের প্রমাণ

রাসুলের একটি হাদিসে এসেছে, নারীকে সম্মান করার পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে। তিনটি বিষয় নবী করিম (সা.)-এর জীবনে লক্ষণীয় ছিল—এক. নামাজের প্রতি অনুরাগ; দুই. ফুলের প্রতি ভালোবাসা; তিন. নারীর প্রতি সম্মান। (বুখারি ও মুসলিম)।

যদি নারীকে সমানাধিকার দেয়া হয়, না দেয়া হয় সমমর্যাদা। তাহলে বাসের হেলপারি করতে দেখা যাবে মা-ভগ্নিদের। স্টেশন, মার্কেট বা রাস্তাঘাটে মোটের বোঝা মাথায় নিয়ে দৌড়াতে হবে মুসলিম মেয়েদের। শত কেজির বস্তা মাথায় করে লরি আর ট্রাকে মাল লোড-আনলোডের কাজ করতে হবে ললনাদের। আরো আরো এমন সব নিম্নমান ও পেশিশক্তির কাজ করতে হবে মা-বোনদের যা তাদের পক্ষে অসম্ভব; অনেক ক্ষেত্রে অপমানকর, বে-মানান। তাই, নারীকে পণ্য করা আর সমানাধিকারের নামে লাঞ্ছনা নয়, ইসলামি আইন মেনে নারীকে দিতে হবে সমমর্যাদা আর সঠিক প্রাপ্য।


কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান সমাজব্যবস্থা নারীদের ইসলামের চোখে যেমন দেখে না তেমনি নারীকে বাজারের পণ্য হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যে কর্তব্য তা পালন করা হচ্ছে না। তাকে তার অধিকার দিচ্ছে না। দিন দিন প্রতিযোগিতা দিয়ে বেড়ে চলছে আমাদের গণমাধ্যমের সংখ্যা।


 ইসলাম নারীকে সব ধরনের মর্যাদা যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে সংযত হওয়ার নির্দেশগুলো। কর্মক্ষেত্রে নারীর বাধা নেই ইসলামে, তবে সেখানে তাকে চলতে হবে পর্দার মাঝে। রাস্তাঘাটে নারীকে বিভিন্ন পণ্যের সাথে উপস্থাপন করছে। এমনভাবে করছে যেন পণ্যের গুরুত্বের সাথে নারীকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। যেখানে নারীর কোন প্রয়োজন নেই সেখানেও নারীকে দেখাচ্ছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক পোশাকের ব্যবস্থা করছে যা আমাদের মুসলিম নারীদের জন্য শোভা পায় না। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছে তবে পণ্য করেনি। বর্তমানে স্বাধীনতার নামে নারীকে পণ্যই বানাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো উপস্থাপক হিসাবে নারীকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। 


এটা নারীর জন্য ভাল। নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে কিন্তু তাই বলে সে উপস্থাপনায় নন মুসলিম দেশকে অনুকরণ করা নারীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া চাকরি করা যাবে না বলে অনেক নারীকে চাকরি হারাতে হয়, আবার অনেক নারী বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয় ইসলামের মর্যাদাকে ভুলে যেতে। নারীদের পর্দা নিয়ে কিছু বললেই বলা হয়, নারীকে নারী ঘরে তুলতে বলা হচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়। নারীকে কাজ করতে হবে তবে সেই ইসলামের পথ নির্দেশনা মেনে চলে। বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীর সাফল্য আসছে। তাই বলে নারীকে পণ্য হিসাবে ব্যবহারও বেড়ে চলছে। কিছু কিছু উচ্ছৃঙ্খল নারীদের জন্য পুরো নারী জাতিকে অপবাদ কাঁধে নিতে হচ্ছে। গণমাধ্যমে নারীর কর্মসংস্থান হবে তা যেমন দরকার তেমনি এর সাথে কাজে জড়িত সবাইকে ইসলামে নারীর মর্যাদা সম্পর্কে জানতে হবে। ইসলাম তো সম্মানের চেয়ে বেশি দিয়েছে। তবে নিজেদের জন্য কেন আমরা তা হারাবো।

ইসলাম নারীকে অনেক সম্মান দিয়েছে।।আর লিখলাম না।।লিখা এমনিতেই অনেক বড় হয়ে গেছে।।এখানেই সমাপ্ত।।

আবু নাঈম মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির


শিক্ষার্থী, 


জামেয়া আহমাদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা।।


Top