ইতিহাসের প্রথম শিক্ষিত বিজ্ঞানী নবী হজরত ইদ্রিস (আ.)

হজরত ইদ্রিস (আ.) এর নামে বহু উপকথা তফসিরের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। যে কারণে জনসাধারণে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। সেসব উপকথা পরে অধিকাংশই রূপকথায় রূপ নিয়েছে, কিছু অতিরঞ্জিত হয়ে গোনাহের পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ নবী ইদ্রিস (আ.) যে পৃথিবীতে বসবাসের নিমিত্তে অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা করেছিলেন, সে ব্যাপারে আমরা অনেকেই অজ্ঞ। ইদ্রিস (আ.) হজরত নুহ (আ.) এর আগের নবী ছিলেন, না পরের নবী ছিলেন- এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
অনেক সাহাবির মতে, তিনি নুহ (আ.) এর পরের নবী ছিলেন। আবার অনেক সাহাবি, ইতিহাসবিদ এবং তফসিরকাররা তাকে ইসলামের তৃতীয় নবী এবং হজরত আদম (আ.) এর তৃতীয় প্রজন্ম বলে মত প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীর প্রাথমিক পর্যায়ের মানুষ হিসেবে তিনিই ছিলেন ইতিহাসের প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকেই প্রথম অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা দেন।
তফসিরে কুরতুবি, ইবনে কাসির ও মাআরেফুল কোরআন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, হজরত ইদ্রিস (আ.) প্রথম মানব যাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণনাপদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তিনি গ্রহ-উপগ্রহের গতিবিধি লক্ষ্য ও সময় নির্ধারণ করার জন্য বেশ কিছু মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন বলেও জানা যায়। তিনিই সর্বপ্রথম মানব যিনি বস্ত্র সেলাই শিল্পের সূচনা করেন বলে বলা হয়। তার আগে মানুষ সাধারণত পোশাক হিসেবে জীবজন্তুর চামড়া ব্যবহার করত। ওজন ও পরিমাপের পদ্ধতি তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন।
তার আমলেই সর্বপ্রথম নগরসভ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি তার ব্যক্তিগত সংস্পর্শে রেখে বেশ কিছুসংখ্যক লোককে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন। তারাই বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে একেকটি শহর নির্মাণ করে। এভাবে তিনি বেঁচে থাকতেই ১৮৮টি শহর বা সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন। লোহা দ্বারা অস্ত্রশস্ত্র তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার ব্যবহার ইদ্রিস (আ.) এর আমল থেকেই শুরু হয়। তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে অস্ত্র নির্মাণ করে কাবিল গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। সর্বপ্রথম এসব নির্মাণগত উৎকর্ষ সাধনের কারণে তাকে ইতিহাসের প্রথম বিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে।
ইদ্রিস (আ.) এর বর্ণনা কোরআনের দুই স্থানে এসেছে : ‘আপনি এই কিতাবে ইদ্রিসের কথা আলোচনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও নবী। আমি তাকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করেছিলাম। (সূরা মরিয়াম : ৫৬-৫৭)। ‘এবং ইসমাঈল, ইদ্রিস ও জুুলকিফলের কথা স্মরণ করুন, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন সবরকারী।’ (সূরা আম্বিয়া : ৮৫)।
ইদ্রিস (আ.) কে নিয়ে রূপকথা : ইদ্রিস (আ.) কে নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল উপকথার মধ্যে একটি হলো- আল্লাহর নবী ইদ্রিস (আ.) ছিলেন মালাকুল মউতের (আজরাঈল) বন্ধু। ইদ্রিস (আ.) তার কাছে জান্নাত-জাহান্নাম দেখানোর আবদার জানালেন। তিনি তাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে জাহান্নাম দেখালেন। জাহান্নাম দেখে ইদ্রিস (আ.) এত বেশি ভয় পেলেন যে, বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম হলেন। তখন মালাকুল মউত আপন ডানা দিয়ে তাকে আগলে নিলেন। তারপর তাকে জান্নাত দেখাতে নিয়ে গেলেন। জান্নাত দেখা শেষ হলে মালাকুল মউত বললেন, দেখা হয়েছে? এবার চলুন। তিনি বললেন, কোথায় যাব? বললেন, যেখান থেকে এসেছেন। তখন ইদ্রিস (আ.) বললেন, না, জান্নাতে প্রবেশ যখন করেছি, এখান থেকে আর বের হবো না। তখন মালাকুল মউতকে গায়েব থেকে বলা হলো, তুমি কি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাওনি? জান্নাতে একবার যে প্রবেশ করে সে আর বের হয় না বা তাকে আর বের করা হয় না। এরপর তিনি সেখানেই বসবাস করতে লাগলেন।
এ বর্ণনাটি ভিত্তিহীন। এ বর্ণনার সনদে ইবরাহিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে খালেদ আলমিসসিসি রয়েছে। ইমাম জাহাবি (রহ.) এ বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেন, এ ব্যক্তি একজন চরম মিথ্যাবাদী। হাকিম (রহ.) বলেছেন, তার বর্ণনাগুলো মওজু ও বানোয়াট। (সূত্র : মিজানুল ইতিদাল, তরজমা নং ১২৪; লিসানুল মিজান, তরজমা নং ১৭৮।)
ইদ্রিস (আ.) কে নিয়ে প্রাচ্যের দার্শনিকদের ভুল বিদ্যা : আল্লামা জামালুদ্দিন কাতফি (রহ.) তার রচিত ‘তারিখুল হুকামা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মুফাসসির ও ইতিহাসবিদরা যেসব কথা লিখেছেন সেগুলো খুবই প্রসিদ্ধ কথা। অবশ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা তার সম্পর্কে বিশেষভাবে যা কিছু বর্ণনা করেছেন তা-ই নিচে উদ্ধৃত করা হলো। হজরত ইদ্রিস (আ.) এর জন্মস্থান ও তার প্রতিপালিত হওয়ার স্থান কোথায় এবং তিনি নবুয়তপ্রাপ্তির আগে কার কাছ থেকে বিদ্যা অর্জন করেছেন এ সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মত বিভিন্ন। একদলের মতে, হজরত ইদ্রিস (আ.) এর নাম ছিল ‘হারমাসুল হারামিসা’। তিনি মিসরের ‘মানাফ’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রিকরা ‘হারমাস’কে ‘আরমিস’ বলে। আরমিস শব্দের অর্থ বুধ গ্রহ। (আরমিস অথবা হারমিস গ্রিসের একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। এ কারণেই তাকে আরমিস বলা হতো। গ্রিকরা আরমিস ও ইদ্রিসকে একই ব্যক্তি মনে করে। অথচ এটা একটি প্রকাশ্য ভুল। এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।)
অপর দল মনে করে, তার নাম গ্রিক ভাষায় ‘তিরমিস’; হিব্রু ভাষায় ‘খানুখ’ এবং আরবি ভাষায় ‘আখনুখ’। আর কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা তার নাম ইদ্রিস বলেছেন। আবার একই দল বলে, তার শিক্ষকের নাম ছিল ‘গুসা জাইমুন’ বা ‘আগুসা জাইমুন’ (মিসরি)। ‘গুসা জাইমুন’ সম্পর্কে এই দলের চেয়ে বেশি আর কিছুই বলে না যে, তিনি মিসরের অথবা গ্রিসের নবীদের (আলাইহিমুস সালাম) মধ্য থেকে একজন নবী ছিলেন কিনা। আবার এই দলই গুসা জাইমুনকে দ্বিতীয় ইদ্রিস এবং হজরত ইদ্রিস (আ.) কে তৃতীয় ইদ্রিস উপাধি দিয়ে থাকে। গুসা জাইমুন শব্দের অর্থ অত্যন্ত সৎকর্মপরায়ণ। তারা এটাও বলেন যে, হারমাস মিসর থেকে বের হয়ে গোটা ভূমন্ডল ভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণ করেছেন। এরপর তিনি মিসরে প্রত্যাবর্তন করলে ৮২ বছর বয়সে আল্লাহপাক তাকে নিজের সানি্নধ্যে উঠিয়ে নেন।
তৃতীয় আরেকটি দল বলে, ইদ্রিস (আ.) বাবেলে (ব্যাবিলনে) জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি প্রতিপালিত হন ও বেড়ে ওঠেন। প্রথম জীবনে তিনি হজরত শিশ বিন আদম (আ.) থেকে বিদ্যা অর্জন করেন। আকায়িদ শাস্ত্রের বিখ্যাত আলেম আল্লামা শাহারাস্তানি বলেন, আগুসা জাইমুন হজরত শিশ (আ.) এরই নাম। সূত্র : কাসাসুল কোরআন, তাফসিরে ইবনে কাসির, নবীদের কাহিনী

ú
Top