✪ ফতোয়ায়ে আফ্রিকায় বর্ণিত একটি হাদীস নিয়ে ইমাম আ'লা হযরত (আলাইহির রাহমা) এর উপর আরোপিত অপবাদের জবাব ✪
☞ মুহাম্মদ তাহমিদ রায়হান।
     ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
     [exposedspy.wordpress.com]

ফতোয়ায়ে আফ্রিকা হল ইমাম আ'লা হযরত (আলাইহির রাহমা) রচিত প্রশ্নোত্তর সম্বলিত একটি প্রসিদ্ধ কিতাব। উক্ত কিতাবে ৬৩ নং প্রশ্নে জনৈক ব্যক্তি জানতে চেয়েছেন মানুষ যখন তার মায়ের উদরে জন্ম নেয় তখন ফিরিশতা কর্তৃক তার নাভীতে তারই কবরের কিছু মাটি ছিঁটিয়ে দেয়া হয়; যেখানে তার মৃত্যুর পর দাফন হয়। এতে প্রশ্নকারী বলতে চেয়েছে- স্বামী-স্ত্রী অন্ধকারে মিলিত হয় আর সম্তান গর্ভধারিত হওয়ার কোন সময় জানা নেই। এমতাবস্থায় কিভাবে মাটি মায়ের জরায়ুতে পৌঁছাতে পারে?

উত্তরে আ'লা হযরত সারগর্ভ আলোচনা করে লিখেছেন- এটা মহান আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত ফিরিশতাদের দ্বারাই হয়। প্রমাণ স্বরূপ তিনি সূরা ত্বো-হা শরীফের ৫৫ নং আয়াতে কারীমা—

 مِنۡہَا خَلَقۡنٰکُمۡ وَفِیۡہَا نُعِیۡدُکُمۡ وَمِنۡہَا نُخۡرِجُکُمۡ تَارَۃً اُخۡرٰی
☞ অর্থাৎ, আমি  যমীন  থেকেই  তোমাদেরকে সৃষ্টি  করেছি,সেটার   মধ্যেই  তোমাদেরকে  আবার নিয়ে যাবো এবং সেটা থেকে পুনরায় তোমাদেরকে বের করবো।

এর ব্যাখ্যায় ইমাম আ'লা হযরত (আলাইহির রাহমা) জামে তিরমিযী, খতিব বাগদাদীর “আল মুত্তাফাক্ব ওয়াল মুফতারাক্ব” এবং হাকেম তিরমিযী প্রমুখের কিতাব থেকে বেশ কয়েকটি হাদীস শরীফ লিপিবদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে একটি হাদীস হল- আল্লামা আবু বকর আহমদ ইবনে আলী খতীব আল বাগদাদী (রহ.) তার “আল মুত্তাফাক্ব ওয়াল মুফতারাক্ব” কিতাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন, হুযুর আক্বদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مامن مولود الا وفى سرته من تربته التى خلق منها حتى يدفن فيها وانا وابو بكر عمر خلقنا من تربه واحدة فيها ندفن .
☞ অর্থাৎ প্রত্যেক নবজাতকের নাভীতে তার কবরের মাটি থাকে, যেখানে তাকে দাফন করা হয়।  আমি আবু বকর ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা একই কবর থেকে সৃষ্ট এবং সে একই কবরেই আমরা দাফন হব।

☞ প্রথমত, বলতে হয়- এ হাদীস থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো নয়ই কোন মানুষের দেহ মাটি থেকে সৃষ্ট বলে প্রমাণিত হয় না। কবরের মাটি উল্লেখ থাকলেও রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে এটি প্রমাণিত সত্য যে নবীজীর কবরের স্থানেই তাঁর দেহ মুবারক সৃষ্টির উপাদান (নুর) সংরক্ষিত ছিল। সেই বিশেষ নুরের টুকরোটা যাকে ক্বলবুল আরদ্ব, জিয়াউল আরদ্ব, নুরুল আরদ্ব, বাহা-উল আরদ্ব,  আত্ব ত্বীনাতুশ শাহীরাহ ও বায়দ্বাউম্ মুনীরাহ্ ইত্যাদি অভিধায় বিভূষিত করা হয়েছে। অতএব, تربة দ্বারা কবর অর্থাৎ দাফনের স্থানকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাফনের স্থানে ছিল সংরক্ষিত নুর মুবারক আর এর নিকটবর্তী হওয়ার কারনে হযরত সিদ্দীকে আকবর ও ফারূকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুমা কেও من تربه واحدة মানে একই কবর বলা হয়েছে।

☞ সুতরাং, আ'লা হযরত তার ফতোয়ায় আফ্রিকায় খতিব বাগদাদীর বরাতে মানব সৃষ্টির ব্যাপারে আলোচনা প্রসঙ্গে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেন।

আ'লা হযরত উক্ত হাদীসটির বর্ণনাকারী নন বরং তিঁনি এটি খতিব আল বাগদাদী তাঁর আল মুত্তাফাক্ব ওয়াল মুফতারাক্ব কিতাবে বর্ণনা করেছেন আর আ'লা হযরত সেখান থেকে হাদীসটি সংকলন করেছেন।

☞ দ্বিতীয়ত, উক্ত হাদীসটি কোন পর্যায়ের হাদীস, এর উপর আমল করা যাবে কিনা, এটির গ্রহনযোগ্যতা আছে কিনা, উক্ত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণের রায় কি? উত্তর জানার পর বলা যাবে উক্ত হাদীসের উপরে আক্বীদা রাখা যাবে কি না....

✪✪ উক্ত হাদীস সম্পর্কে প্রখ্যাত মুহাদ্দীসগণের রায়ঃ

১) আল্লামা আবু বকর আহমদ ইবনে আলী খতিব আল বাগদাদী (রহ.) [ওফাত- ৪৬৩ হি.] বলেন—
غريب من حديث الثوري عن الشيباني لا أعلم يروي إلا من هذا الوجه-
☞ অর্থাৎ, হাদীসটি বর্ণনার দিক থেকে গরীব, ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ.) তিঁনি ইমাম শায়বানী (রহ.) হতে বর্ণনা ব্যতিত উক্ত হাদীসটি অন্য কোন বর্ণনাকারীর দ্বারা বর্ণিত বা অস্তিত্ব আছে বলে আমার জানা নাই। (তারীখে বাগদাদ, ৩\৩১৩-৩১৪; হাদীস নং- ৭৯৭)

আল্লামা খতিব আল বাগদাদী নিজেই হাদীসটি গরীব বলেছেন। উক্ত হাদীসটির অন্য কোন সনদের অস্তিত্ব নেই। আর কোন লোক যদি দাবী করে উক্ত হাদীসটির আরো সনদ রয়েছে তাহলে সে চরম মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত হবে। গরীব হাদীস কোন বিধান বা আহকামের জন্য গ্রহনযোগ্য নয়। তাই উক্ত হাদীসটি আমলগত নয়, আকীদাগত কারনেও গ্রহন করা যাবেনা। উল্লেখ যে, খতিব বাগদাদীর গ্রন্থ হতে তাফসীরে মাযহারী প্রণেতাও হাদীসটি সংকলন করেছেন।

২) ইমাম আবদুল রহমান ইবনে আলি ইবনে মুহাম্মদ আবুল ফারাস ইবনুল জাওযী (রহ.) [ওফাত- ৫৯৭ হি.] :—
☞ আল্লামা ইবনে যাওযী তাঁর 'কিতাবুল মওদ্বুয়াত' গ্রন্থে হাদীসটি জাল বা বানোয়াট বলেছেন। (কিতাবুল মওদ্বুয়াত, ১/৩২৮, দারূল ফিকর বৈরুত)

ইমাম ইবনে যাওযীর এই রায় গ্রহন করেছেন দেওবন্দী ওহাবীদের শ্রদ্ধাভাজন আলেম মুফতি শফি তার 'তাফসীরে মা'রিফুল কুরআন' (মহিউদ্দীন খাঁন অনুবাদিত ও সৌদী সরকার যেটি বিনামূল্যে বিতরন করে) এর ৮৫৬ পৃষ্ঠায়।
অপরদিকে, আহলে হাদীস লা-মাযহাবীদের শ্রদ্ধাভাজন আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার 'হাদীসের নামে জালিয়াতি' বইয়ের ২৬৮-২৬৯ পৃষ্ঠায় ইমাম ইবনে যাওযীর রায় গ্রহন করেছেন এবং তা উল্লেখ করেছেন।

✪✪ ইমাম ইবনে যাওযীর রায়ের গ্রহনযোগ্যতাঃ
ইমাম ইবনে যাওযী হাদীস গ্রহনে কট্টোরপন্থী হলেও তার রায়ের ব্যাপারে কারন উল্লেখ করেছেন। এবং কারন হিসেবে তিনজন রাবীকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। ইবনে যাওযী (রহ.) বলেন-
محمد وأحمد مطعون فيهما وفيه مجهيل منهم أبو اليسع.—
☞ অর্থাৎ, উক্ত হাদীসে মুহাম্মদ মারূজী, আহমদ বিন সাইদ আখমিমী অভিযুক্ত বা দোষী, আবুল আল ইয়াস'আ মাযহূল তথা অপরিচিত। (কিতাব মওদ্বুয়াত, ১/৩২৮)

৩) হাদীসের তৃতীয় রাবী সম্পর্কে ইমাম যাহাবী বলেনঃ
فأبو اليسع لا يدري من هو، والسند بذلك مضطرب —
☞ অর্থাৎ, আবুল ইয়াস'আ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। আর হাদীসের সনদে ইজতেরাব বা বিশৃঙ্খলা (এলোমেলো) রয়েছে। (মিযানুল ইতিদাল: ৪/৫৮৯ পৃ. রাভী- ১০৭৪৮)

৪) ইমাম আবু হাতিম মুহাম্মদ ইবনে ফায়সাল আল তামিমি আল দারিমি ইবনে হিব্বান আল বুস্তী (রহ.) [ওফাত- ৩৫৪ হি.] বলেন-
كان يخالف الثقات في الرويت
☞ অর্থাৎ, তার সকল বর্ণনা বিশ্বস্ত রাবীর বিপরীত। (আল মাজরূহীন, ৮/১৮১; হাদীস- ১২০)

৫) ইমাম আবু হাতিম (রহ.) বলেন- “তিনি মাযহূল তথা অপরিচিত রাবী।”
(জারহ ওয়া তা'আদিল ২/৩৩৩ পৃ. ক্রমিক- ১২৬৪; মিযযী, তাহযীবুল কামাল ২/৩৫৯ পৃ. ক্রমিক ৩২২)

৬) ইমাম জালালউদ্দীন সুয়ুতী ও আল্লামা তাহির আল পাটনী বলেন - ضعيف جدا অর্থাৎ, অত্যন্ত দ্বঈফ।

☞ সুতরাং, বুঝা গেল উক্ত হাদীস দ্বারা কোনমতেই প্রমাণিত হয় না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির তৈরী।

✪ তৃতীয়ত, যারা এটি দ্বারা আ'লা হযরত (আলাইহির রাহমা) হুযুর ছরকারে কায়েনাত নুরে মুজাসসাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মাটির তৈরী বলেছেন এরূপ বলতে চায় তাদের উচিত ৬৩ নং মাসয়ালায় পূর্ববর্তী উত্তর অর্থাৎ ৬২ নং উত্তরটি ভালো করে দেখে নেয়া। এছাড়া মিথ্যাবাদীদের জেনে রাখা উচিত যে আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁ (আলাইহির রাহমা) স্বয়ং (১) ছিলাতুচ্ছফা ফী নূরীল মুস্তাফা, (২) নাফীউল ফাই আম্মান ইস্তানারা বি নূরীহি কুল্লু শাই, (৩) ক্বমরুত তামাম ফি নফয়িয্ যীল্লে আন্ সাইয়্যিল আনাম, (৪) হুদাল হায়রান ফি নফয়িল ফাইয়ে সাইয়্যিল আক্বওয়ান নামক ৪ টি অকাট্য দলিল ভিত্তিক কিতাব লিখে প্রমাণ করেছেন হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন নুরের সৃষ্টি,যার কারনে উনার ছায়া মুবারক ছিল না।

আল্লাহ বিরূদ্ধবাদীদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন...
Top