আহলে বায়তের উজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
কৃতঃ শান মাহামুদ রাজ।
______________________________
কারবালার ময়দানে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)র একমাত্র জীবিত পুত্র হযরত ইমাম জয়নুল আবেদিন (রাঃ)।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যুদ্ধে নামার আগমূহুর্তে তাবুতে এসে বোন জয়নব বিনতে হযরত ইমাম আলী (রাঃ)কে বলেছিলেনঃ বোন! আমি তোমার কাছে আমার শেষ আওলাদ আমানত রেখে গেলাম যার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত নবী বংশের পবিত্র রক্ত ধারা প্রবাহিত হবে।
এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)- হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রাঃ)কে বললেন! বাবা জয়নুল তোমার থেকে আমার বংশের সিলসিলা জারী থাকবে। সুবহানআল্লাহ - শান মাহামুদ রাজ।
-----------------------------------------------------

ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন রাসূল বংশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনেক সদগুণের আধার ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একাধারে প্রথম সারির তাবেয়ী, আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লামার সম্মানিত সদস্য ও পবিত্র ইমাম, মুজতাহিদ ও প্রখ্যাত হাদীসবিদ। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা সর্ম্পকে ইমাম যুহরী আলাইহির রহমাহ বলেন, সে সময় হাশেমী বংশে ইমাম জয়নুল আবেদীন আলী ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বুযুর্গ ও বড় ফকীহ আমি দেখিনি---_---
১= ইমাম যাহাবী আলাইহির রহমাহ বলেন, ইমাম জয়নুল আবেদীন আলী ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা ছিলেন অধিকতর নির্ভরযোগ্য ও অতীব বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি অনেক হাদীস শরীফ বর্ণনা করেছেন।

২= তিনি বেলায়তের সর্বোচ্চ সোপান ‘গাউছুল আযম’ পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন।

৩=বলাবাহুল্য, তিনি তদীয় পিতা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র খলীফা ছিলেন।৪ এছাড়াও খোদাভীতি, ইবাদত-বান্দেগী, ক্ষমাশীলতা, দানশীলতা, পরোপকারিতা ও উত্তম চরিত্রে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি মহা ব্যক্তিত্ব।

৪=নাম ও বংশ পরিচিতিঃ
তাঁর নাম আলী, উপনাম আবু মুহাম্মদ, আবু বকর, আবুল হাসান, আবুল হুসাইন।

৫=উপাধি জয়নুল আবেদীন ও সৈয়্যদুস সাজ্জাদ।

৬=তাঁর পিতার নাম সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যিনি হযরত খাতুনে জান্নাত ফাতেমা বিনতে রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আলী ইবনে আবি তালিব ইবনে আব্দুল মোত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা এর প্রাণপ্রিয় পুত্র।
৭ =যাঁরা বংশ পরম্পরায় হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের প্রথম পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর।
৮=তাঁর মাতার নাম শাহরবানু। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নাম মতান্তরে সালমাহ, গাযালাহ, সুলাফাহ, জিদ্দা ও বিররাহ।
৯=শাহরবানু হচ্ছেন পারস্যের শেষ সম্রাট ইয়াজদাযরিদের সুযোগ্য কন্যা। তাঁর বংশ তালিকা হচ্ছে শাহরবানু বিনতে ইয়াজদাযরিদ ইবনে (সম্রাট) খসরু পারভেজ ইবনে (সম্রাট) হরমুজ ইবনে (সম্রাট) নাওশীরওয়ান।
১০ =যাঁরা সবাই বংশ পরম্পরায় পারস্য (ইরান) সম্রাট ছিলেন। যারা বংশ পরম্পরায় হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম হয়ে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালামের দ্বিতীয় সন্তান হযরত ইসহাক  আলাইহিস সালাম এর বংশধর।

১১=শুভ জন্মক্ষণঃ
উপরিউক্ত সম্মানিত পিতা-মাতার ঘর আলোকিত করে ৩৬ হিজরি মতান্তরে ৩৮ হিজরীর ১৫ জমাদিউল আখের মতান্তরে, শাবান মাসের শুক্রবার রাতে পবিত্র মদীনাতুল মুনাওয়ারায় শুভ জন্ম গ্রহন করেন।

১২ =অন্য বর্ণনামতে তাঁর জন্ম সালটি ছিল ৩৩ হিজরী।

১৩=জ্ঞানচর্চাঃতিনি শৈশবকাল থেকে জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত সাহাবী ও তাবেয়ীগণের নিকট কুরআন, হাদিস,ফিকাহ ইত্যাদি বিষয় অধ্যয়ন করেন । তিনি হাদিস ও ফিকাহ বিষয়ে অগাধ জ্ঞানার্জন করে প্রখ্যাত হাদীসবিদ ও প্রথিতযশা ফিকাহবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পান সমকালীন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদগণ কর্তৃক। তাঁর ছিল অসংখ্য শিক্ষক ও ছাত্র।
শিক্ষকবৃন্দঃ
তাঁর অগণিত শ্ক্ষিক ছিলেন । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্বীয় পিতা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাফিয়্যাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত  উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবু রাফি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত মিসওয়ার বিন মাখরমাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত সায়িদ ইবনে মারজানাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আমর ইবনে উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত যাকওয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত যায়নাব বিনতে আবী সালমাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা প্রমুখ।

১৩(ক)=ছাত্রবৃন্দঃতাঁর অসংখ্য ছাত্র ছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্বীয় পুত্র ইমাম আবু জাফর বাকির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত যাইদ আল মক্বতুল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ইমাম যুহরী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আমর বিন দিনার রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হাকাম বিন উতাইকা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত যাইদ বিন আসলাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ইয়াহইয়া বিন সায়িদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবুয যিনাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আলী বিন জুদয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত মুসলিম আল-বাত্বীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হাবিব ইবনে আবি সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আসিম বিন ওবাইদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আসিম বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ক্বা’ক্বা  বিন হাকিম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবুল আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হিশাম বিন উরওয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবুয্ যুবাইদ মক্কী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবু হাযিম আ’রাজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবদুল্লাহ বিন মুসলিম বিন হুরমুয রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত মুহাম্মাদ বিন ফুরাত তামিমী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু,হযরত মিনহাল বিন আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত তাউস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আবু সালমাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা প্রমুখ।

১৩(খ)=ইবাদত-বন্দেগীঃতিনি অত্যধিক ইবাদত বন্দেগী করতেন, মহান আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে অসংখ্য সাজদাহ প্রদান করেছেন। যে কারণে তাকে সাজ্জাদ বলা হত। আর সাজ্জাদ অর্থ অধিক সাজদাহ প্রদানকারী। একদা তিনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সময় শয়তান সর্পের আকৃতি ধারণ করে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়, যাতে তিনি ভয়ে নামাজ ভঙ্গ করেন। কিন্তু তিনি নামাজের মধ্যে আল্লাহর ধ্যানে এমনভাবে ডুবে গেলেন যে, নামাজ ভঙ্গ তো দূরের কথা সাপটির দিকে নজর পর্যন্ত দেননি। এতে সাপরুপী শয়তানটি নিরুপায় হয়ে তাঁর পায়ের আঙ্গুলে দংশন করলে তিনি অত্যন্ত যন্ত্রণা অনুভব করেন। কিন্তু এতেও তিনি নামাজ ভঙ্গ করলেন না। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁকে জানিয়ে দিলেন সাবধান এটি শয়তান। অতঃপর তিনি শয়তানটিকে ভর্ৎসনা করলেন এবং প্রহার করলেন। এরপর পুনরায় নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলহাম এলো, “আপনি জয়নুল আবেদীন অর্থাৎ ইবাদতপরায়ণ বান্দাগণের শোভা”।

১৪= তখন থেকে তিনি ইমাম জয়নুল আবেদীন নামে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি সর্বদা মহান আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কম্পিত থাকতেন। অযু করার পর তাঁর চেহেরা মুবারক হলুদ বর্ণ ধারণ করত এবং নামাজে দাঁড়ানোর পূর্বে মাওলায়ে হাক্বীকীর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকতেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, আপনারা কি জানেন না, আমি এখন কার সামনে দাঁড়াব এবং কার সাথে কথা বলব ?

১৫= নামাজে অনেক সময় তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি প্রতিদিন হাজার রাকয়াত নামাজ পড়তেন।
১৬= তিনি পবিত্রতা অর্জনের সময় কারো সাহায্য নেয়া পছন্দ করতেন না। তাহাজ্জুদের অযু করার জন্য কিছু পানি অন্যের চোখের আড়ালে রেখে দিতেন। তা দিয়ে অযু ও মিসওয়াক করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। তিনি কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ ছেড়ে দেননি। এমনকি সফরের সময়ও নয়।

১৭=দানশীলতাঃতিনি বড় দানবীর ছিলেন। দান-দক্ষিণায় তিনি ছিলেন এমন সিদ্ধহস্ত, যা রূপকথার গল্পসমূহকেও হার মানায়। এ প্রসঙ্গে অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল। যখন কোন ভিক্ষুক তাঁর নিকট আসত তখন তিনি তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতেন এবং বলতেন,  مرحبا بمن يحمل زادي إلى الآخرة  “আমার সম্পদ যে পরকাল পর্যন্ত পোঁছিয়ে দেয় তাকে স্বাগতম।

১৮ তিনি গোপনে সদক্বাহ করা বেশ পছন্দ করতেন। এজন্য তিনি রাতে সদক্বাহ করতেন। তিনি কখনো কখনো ছদ্মবেশে মানুষকে দান করতেন। হযরত মুহাম্মদ বিন ইসহাক (আলাইহির রহমাহ) বলেন, আমরা মদীনাবাসী অনেকেই জানতাম না আমাদের জীবিকা কোত্থেকে আসে। হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন(রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)’র ওফাতের পর আমাদের জীবিকা তথা রাতের ছদকাহ বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বুঝতে পারি যে, উপরিউক্ত ছদক্বাহসমুহ ইমাম জয়নুল আবেদীন (রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু)’র পক্ষ থেকে আসত।

১৯ তিনি ছদক্বাহ প্রদানের সময় অন্যের সাহায্য নিতেন না যাতে ছদক্বাহের গোপনীয়তা রক্ষা হয়। হযরত আমর বিন ছাবেত(আলাইহির রহমাহ) বর্ণনা করেন, হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন(রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)’র ওফাতের পর তাঁকে গোসল দেয়ার সময় তাঁর পিঠে কালো দাগ দেখা যায়। যেটা রাতে গোপনে ছদক্বাহ করার সময় আটা ইত্যাদির বস্তা বহনের দাগ।

২০ এভাবে তিনি ছদক্বাহ করতেন। আর অন্যকেও ছদক্বাহ করার পরামর্শ দিতেন। হযরত আবু হামজা (আলাইহির রহমাহ) বলেন, ইমাম জয়নুল আবেদীন রাতে আটার বস্তা নিজ কাঁধে বহন করে সদক্বাহ করতেন। তিনি বলতেন, إن صدقة السر تطفىء غضب الرب عز و جل  “গোপন সদক্বাহ আল্লাহ তায়ালার রাগকে প্রশমিত করে”।

২১=ক্ষমাশীলতাঃইমাম জয়নুল আবেদীন ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত ক্ষমাশীল ছিলেন। ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ প্রবাদটি তাঁর জীবনে সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল। কেউ তাঁকে কষ্ট দিলেও তিনি তাকে হাসিমুখে ক্ষমা করে দিতেন। তাঁর ক্ষমাপরায়নতার অনেক ঘটনা বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত আছে। তা থেকে কয়েকটি বিবৃত হলঃ

একদা জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে বললেন, অমুক ব্যক্তি আপনার সমালোচনা করছে। একথা শুনে তিনি বলেন, আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন। লোকটির নিকট পৌছে তিনি বলেন, আপনি যা কিছু আমার সর্ম্পকে বলেছেন, তা যদি আমার নিকট বিদ্যমান থাকে তাহলে আমি আল্লাহ তায়ালার সকাশে ক্ষমা চাই। আর যদি তা আমার মধ্যে বিদ্যমান না থাকে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন আপনাকে ক্ষমা করুক।

২২ =অনুরূপ, জনৈক ব্যক্তি তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে, তিনি বলেন, আমার শানে আপনি যা বলেছেন, তা যদি সত্য হয় আল্লাহ তায়ালা আমাকে ক্ষমা করুন। যদি অসত্য হয় আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ক্ষমা করুক। একথা শুনে লোকটি ইমাম সাহেবের  মাথায় চুম্বন করে বলেন, আমার জীবন আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম। আমি মিথ্যা বলেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। ইমাম সাহেব বললেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

২৩ =হযরত আব্দুল গফুর ইবনে কাসিম আলাইহির রহমাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদের বাইরে ছিলেন এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি তাঁকে গালি দিতে আরম্ভ করলে, তাঁর গোলামরা লোকটিকে আঘাত করতে উদ্যত হলে ইমাম সাহেব তাঁদের লক্ষ্য  করে  বললেন, তোমরা তাঁকে বলতে অবকাশ দাও এবং তিনি লোকটির কাছে গিয়ে বলেন, আমার ব্যাপারে আপনার যা বলার আছে বলে যান। এরপর তিনি তাঁর গায়ের কাপড় খুলে লোকটিকে দান করলেন এবং তাকে আরো এক হাজার দিরহাম দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এতে লোকটি লজ্জিত হল এবং বলল, أشهد أنك من أولاد الرسول “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি সত্যিই আওলাদে রাসূল।

২৪=ব্যক্তিত্বঃযাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সন্তুষ্ট করেছেন, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজগতকে তাঁদের অনুগত করে দেন। উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দিল মালিকের রাজত্বকালে তাঁর ভাই গভর্নর হিশাম বিন আব্দিল মালিক হজ্ব পালন কালে হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতে চাইলে মানুষের ভিড়ের কারণে শত চেষ্টা করেও হাজরে আসওয়াদের নিকটেও যেতে সক্ষম হননি। পরিশেষে তাঁর জন্য একটি মিনার স্থাপন করা হলে তিনি তথায় বসেন। এমতাবস্থায় হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে এলে সকলে তাঁকে অত্যন্ত সম্মান দেখালেন এবং জায়গা করে দিলেন। এতে তিনি সহজেই হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে আসলেন। উক্ত ঘটনা দ্বারা আবারো প্রমাণিত হল যে, যিনি আল্লাহ তায়ালার হয়ে যান, প্রত্যেক কিছু তাঁর হয়ে যায়। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে জনৈক শামবাসী আমলা হিশাম বিন আব্দিল মালিককে জিজ্ঞেস করেলেন এ সুদর্শন ব্যক্তিটি কে? যারঁ জন্য সবাই সরে গেল এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করল। হিশাম না চেনার ভান করে বলেন আমি তাঁকে চিনি না। তখন সেখানে আরবের প্রখ্যাত কবি ফারাজদাক উপস্থিত ছিলেন। তিনি হিশামের কথার জবাবে বললেন, আমি তাঁকে চিনি। অতঃপর তিনি হযরত ইমামের প্রশংসায় অনেকগুলো ক্বাছিদা রচনা করে আবৃত্তি করে শোনালেন। ক্বাছিদার  এক পর্যায়ে তিনি বলেন- هذا الذي تعرف البطحاء وطأته والبيت يعرفه والحل والحرم  “(শুধু আমি তাঁকে চিনি তাই নয়) বরং এ মহান ব্যক্তিকে চেনেন মক্কা শরিফের হারাম,হিল ,বায়তুল্লাহ শরীফসহ সমতল ভূমিও” । হিশামের জন্য এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা। কারণ আওলাদে রাসুলের সম্মান দেখে প্রথমে তার অন্তরে প্রতিহিংসার বীজ জন্মেছে এবং কবিতায় ইমামের প্রশংসা শুনে কবি ফারাজদাককে বন্দী করার নির্দেশ দিয়ে প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ইমাম জয়নুল আবেদীন এ ঘটনা জেনে কবির জন্য মর্মাহত হন এবং বন্দী অবস্থায় কবির পারিবারিক অবস্থার প্রতি বিবেচনা করে কবির জন্য বার হাজার দিরহাম প্রেরণ করেন। কিন্তু কবি ফরাজদক সম্মানের সাথে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। কেননা কবির উদ্দেশ্য ছিল আওলাদে রাসূল-এর প্রতি মহব্বত প্রকাশ করে আল্লাহ তায়ালা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র সন্তুষ্টি অর্জন করা। কিন্তু ইমাম পুনঃরায় অনুরোধ করলে কবি তা গ্রহণ করেন।

২৫=কারবালা-যুদ্ধঃআল্লামা শাইখ আব্দুর রহমান চিশতী (আলাইহির রহমাহ)’র মতে কারবালা যুদ্ধের সময় ইমাম জয়নুল আবেদীন (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)’র বয়স ছিল তেইশ বছর।

২৬ কারবালার হুসাইনী কাফেলায় তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু মারাত্মক রোগ ও প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি রোগগ্রস্ত অবস্থায়ও হেলে দুলে স্বীয় পিতা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়ালহু তায়ালা আনহু’র সামনে এসে আরজ করলেন, আব্বাজান! আমাকেও যুদ্ধের জন্য বিদায় দিন। আমি যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করতে চাই। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পুত্রকে সান্ত্বনা দেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, হে জয়নুল আবেদীন! তোমাকেও যদি বিদায় দিই, তাইলে আমি ইমাম হুসাইনের সিলাসিলা কার মাধ্যমে জারী থাকবে? বেটা! তোমার মাধ্যমে আমার বংশীয় সিলাসিলা জারী থাকবে। আমি দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা তোমাকে জীবিত রাখুন এবং তোমার মাধ্যমে আমার বংশ ও সিলাসিলা জারী থাকুক। অতঃপর ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বাতেনী খেলাফত ও ইমামত প্রদান করেন এবং বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বাতেনী নেয়ামত ও ফুয়ুজাতে ভরপুর করে দেন। আর কিছু অসিয়তের পর ইরশাদ ফরমান, বেটা! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছার যদি সৌভাগ্য হয়, তাহলে সবার আগে আমাদের মহামান্য নানাজান সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র  রওজায়ে আক্বদাছে আমার নুরানী সালাম পেশ করবে এবং তোমার দেখা সমস্ত ঘটনা শুনাবে।

২৭ পরবর্তীতে ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার পিতা কর্তৃক অর্পিত সমস্ত দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। পরিশেষে মারাত্মক রোগ ও পিতার তুলে দেয়া দায়িত্বের জন্য তিনি লড়াইয়ে অংশ নিতে পারেননি। সে সুবাদে ইমাম জয়নুল আবেদীনের দ্বারা হুসাইনী তরীক্বা ও বংশধারা এখনো পৃথিবীতে জারী রয়েছে।

বৈবাহিক জীবনঃহযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র কন্যা হযরত উম্মে আব্দুল্লাহ্ ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা’র সাথে ইমাম জয়নুল আবেদীন আলী ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র পনেরজন পুত্রসন্তান ছিলেন। তাঁরা হলেনঃ হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম মুহাম্মদ বাকির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত উমর আল আশরাফ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত জায়েদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হুসাইন আল আছগর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, আলী ইবনু আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হাছান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হাছান আল আছগর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুর রহমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত মুহাম্মদ আল আছগর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত কাছিম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ঈসা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত সুলাইমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ আল আছগর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত দাউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ।তাঁর কন্যা সন্তান ছিলেন আট জন মতান্তরে সাতজন। তাঁরা হলেনঃ হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত উম্মে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত আবিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত উম্মে কুলছুম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত উলাইয়্যা বা আলিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত উম্মে জাফর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ও হযরত জয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা।

২৮=কারামতঃহযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র অসংখ্য কারামত রয়েছে। তা থেকে কয়েকটি নিম্নে পেশ করা হল।

এক. ইমাম নির্বাচন

ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র শাহাদাতের পর ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইমাম নির্বাচিত হন। এ ব্যাপারে তাঁর চাচা হযরত মুহাম্মদ ইবনে হানফিয়্যাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দ্বিমত পোষণ করলে, ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন- চাচাজান ! ইমামতের অধিক হক্বদার কে তা হজরে আসওয়াদ ফায়সালা করবে। আমরা তাকে জিজ্ঞেসা করব যাতে আমাদের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর তিনি রাজী হলে উভয়ে মিলে হজরে আসওয়াদের সমীপে গেলেন এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন বললেন, চাচাজান! আপনি হজরে আসওয়াদের সাথে কথা বলুন। তিনি কথা বললে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। অতঃপর ইমাম জয়নুল আবেদীন দু’হাত তুলে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সকাশে দোয়া করা আরম্ভ করলে, হজরে আসওয়াদ কথা বলা শুরু করে। অতঃপর তিনি হজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে বললেন, ঐ আল্লাহ পাকের শপথ, যিনি তাঁর বান্দাদের প্রতিশ্রুতি তোমার ওপর রেখেছেন। তুমি আমাদের বলে দাও ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর পর ইমামতের হক্বদার কে? সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় হাজরে আসওয়াদ বলে দিল, হে মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যাহ একথা তো সুস্পষ্ট ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পর ইমামত ও অসিয়তের হক্বদার হযরত জয়নুল আবেদীন আলী ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।

এ অলৌকিক ঘটনার পর ইমাম জয়নুল আবেদীনের প্রতি মুহাম্মদ ইবনু হানাফিয়্যার ভালবাসা ও বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পেল।

২৯= কারামাত দুই. প্রবল আগুনের মধ্যেও অক্ষত

তিনি যখন মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে মগ্ন হতেন, তাঁর কাছে তখন পার্থিব কোন কিছুর খবর থাকত না। তিনি তখন সকল কৃত্রিমতা পরিহার করে সম্পূর্ণ একাগ্রতা ও একনিষ্ঠাতার সাথে খোদার প্রেমে বিভোর হয়ে যেতেন। যার সুবাদে তিনি ফানাফিল্লাহ হয়ে বাক্বাবিল্লায় পোঁছে যেতেন। একদিন তিনি ঘরে নামাজরত অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় ঘরে আগুন লেগে যায়। চতুর্দিক থেকে চিৎকার করেও কেউ তাঁকে ঘর থেকে বের করতে পারেন নি। তিনি নামাজ অবস্থায় রয়ে গেলেন। পরে দেখা গেল সম্পূর্ণ ঘর জ্বলে গেলেও তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি। সাজদাহ অবস্থায় তাঁকে পাওয়া গেল। ঘর হতে বের না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেন, আখিরাতের আগুনের ভয়ে আমি বের হইনি।

৩০= কারামত তিন. বন্দী অবস্থা থেকে অলৌকিকভাবে মুক্তি লাভ

ইমাম যুহরী আলাইহির রহমাহ বর্ণনা করেন, একদা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের নির্দেশে হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীনকে বন্দী করা হয়। আমি ইমাম সাহেবকে দেখার জন্য গেলাম। গিয়ে দেখি ইমাম সাহেব হাত-পায়ে লোহার শিকল দ্বারা বন্দী অবস্থায় আছেন। এ অবস্থা দেখে আমি কেঁদে ফেললাম এবং বললাম আপনার স্থানে যদি আমি হতাম এবং আপনি নিরাপদে থাকতেন তাহলেও ভাল হত, আমিও খুশি থাকতাম। একথা  শুনে ইমাম সাহেব বললেন- আপনি মনে করেছেন যে, আমি কষ্টে আছি। প্রকৃতপক্ষে তা নয়, কারণ আমি যদি চাই হাত-পায়ে কিছুই থাকবেনা। এ অবস্থায় আমি এজন্য রয়েছি যে, যাতে লোকেরা আমাকে দেখে পরকালের শাস্তির কথা স্মরণ করে। এ বলে তিনি তাঁর হাত-পায়ের শিকল খুলে ফেললেন এবং বললেন- হে যুহরী! আমি এই অবস্থায় আর বেশী সময় থাকবনা। কারারক্ষীরা বর্ণনা করল, আমরা না ঘুমিয়ে সারারাত তাঁকে পাহারা দিলাম। কিন্তু সকালে দেখি তিনি (ইমাম জয়নুল আবেদীন) কারাগারে নেই।  সেখানে আছে বরং তাঁকে পরানো শিকলগুলো। আমরা ইমাম সাহেবকে তালাশ করার জন্য মদীনা শরীফে গিয়েও তাঁকে খুঁজে পাইনি। ইমাম যুহরী আলাইহির রহমাহ বলেন- এ ঘটনা শুনে আমি বাদশাহ আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের কাছে গেলে বাদশাহ আমার কাছে ইমাম জয়নুল আবেদীনের কামালিয়্যাত সম্পর্কে জানতে চান। আমি আমার জ্ঞানানুযায়ী ইমাম সাহেব সম্বন্ধে বাদশাহের নিকট বর্ণনা করলাম। তা শুনে বাদশাহ আব্দুল মালিক বলেন- যেদিন ইমাম জয়নুল আবেদীন শামে (সিরিয়া) বন্দীশালা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, সেদিন তিনি আমার কাছে আসলেন এবং বললেন তোমার ও আমার মাঝে সমস্যাটা কি? আমি বললাম আপনি একটু অপেক্ষা করুন। তিনি বললেন- আমি এখানে অপেক্ষা করতে আসিনি। এ বলে তিনি চলে গেলেন। বাদশাহ বলেন মহান আল্লাহ তায়ালার কসম সেদিন তাঁর জালালিয়াত দেখে আমি অত্যন্ত ভয় পেয়ে ছিলাম।

৩১
পাঁচ.হরিণের অভিযোগ ও এর সমাধান

ইমাম জয়নুল আবেদীন তাঁর সাথীদের সাথে কোন ময়দানে উপবিষ্ট ছিলেন। হঠাৎ একটি হরিণ এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে পদাঘাত করে উচ্চস্বরে আওয়াজ করতে শুরু করল। উপস্থিত সকলে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর ! এ হরিণটি কি বলছে? তিনি বললেন- হরিণটি অভিযোগ করছে যে, জনৈক ব্যক্তি গতকাল তার বাচ্চা নিয়ে গেছে এবং তাকে দুধ পান করাতে পারেনি। ইমাম ঐ ব্যক্তিকে ডেকে এনে বললেন, এ হরিণটির বাচ্চা তুমি নিয়ে এসেছ। সে গতকাল থেকে তাকে দুধ পান করাতে পারেনি। তাই সে আমাকে অনুরোধ করেছে যে, আমি যাতে তোমার নিকট থেকে বাচ্চাটি নিয়ে তাকে দুধ পান করানোর সুযোগ দিই এবং সে দুধ পান করিয়ে চলে যাবে। ঐ ব্যক্তি বাচ্চাটি এনে দুধ পান করানোর জন্য তার মাকে দিল আর মা তার বাচ্চাকে দুধ পান করানোর পর পুনরায় ফিরিয়ে দিল। ইমাম ঔ ব্যাক্তিকে বাচ্চাটি ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানালে সে অনুমতি দেয়। তিনি হরিণ শাবকটিকে আজাদ করে দিলে হরিণটি উচ্চ আওয়াজ করে চলে যাচ্ছে। উপস্থিত সাথীরা জিজ্ঞেস করলেন হুজুর এটি কী বলছে? তিনি বললেন, সে তার ভাষায় বলছে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন।

৩১(ক)=অমূল্য বাণীঃ

ইমাম সাহেবের অমূল্য বাণীসমূহ থেকে কয়েকটি নিম্নে বিবৃত করা হল।

হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইরশাদ করেন যে, যাঁরা আল্লাহর ভয়ে ইবাদত করেন, তাঁদের ইবাদত প্রকৃত বান্দার ইবাদত। যাঁরা কোন কিছুর কামনায় ইবাদত করেন, তাঁদের ইবাদত ব্যবসায়ীদের ইবাদত। যাঁরা আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করার জন্য ইবাদত করেন, তাঁদের ইবাদত স্বাধীন ব্যক্তির ইবাদত।

৩২
তিনি আরো ইরশাদ করেন, আমি বিস্মিত হই সে অহংকারীদের জন্য,যারা এক ফোঁটা নাপাক পানি থেকে জন্মগ্রহণ করেছে। আর কাল পচে যাবে। তাঁদের প্রতি সবচেয়ে বেশি হতবাক হই যারা আল্লাহর সৃষ্টি জগতকে দেখেও আল্লাহ তায়ালাকে (অস্তিত্বের ব্যাপারে) সন্দেহ করে। আর তাকেও দেখে আশ্চর্যবোধ করি যে, পার্থিব জীবনের জন্য আমল করে, কিন্তু পরকালের জন্য কিছুই করে না।

৩৩
তিনি আরো ইরশাদ করেন, যে আল্লাহ তায়ালার বন্টনে সন্তুষ্ট, সেই বড় ধনী।

৩৪
তিনি আরো ইরশাদ করেন, কিয়ামত দিবসে অহবানকারী বলবেন, হে ধৈর্যধারণকারীগণ! তাঁরা দাঁড়াবেন এবং তাঁদের বলা হবে তোমরা কিসের ওপর ধৈর্যধারণ করেছ। তাঁরা উত্তরে বলবেন, আমরা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের আনুগত্যের উপর ধৈর্যধারণ করেছিলাম। এরপর তাঁদের বলা হবে। তোমরা সত্য বলেছ এবং জান্নাতে প্রবেশ কর।

৩৫
ইমাম বাক্বির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমার পিতা ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমাকে অসিয়ত করেছেন, তোমরা পাঁচ শ্রেণীর লোকের সংস্রবে যাবে না। আমি জানতে চাইলাম এরা কারা। জবাবে বলেন, এরা হল জঘন্য অপরাধী, কৃপণ, মিথ্যুক, জাহেল এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী।

৩৬
তিনি আরো ইরশাদ করেন, হে ইরাকবাসী! তোমরা আমাদের ইসলামকে ভালবাসার মত ভালবাস, মূর্তিকে ভালবাসার মত নয়,যা আমাদের জন্য লজ্জার কারণ হয়।

৩৬ক
পবিত্র ওফাত শরীফঃ
সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন আলী ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে, ৯৯ হিজরি সনের ১৪ই রবিউল আউয়াল মতান্তরে ১৮ মুহাররাম রাতে আল্লাহর প্রেমে ওফাত প্রাপ্ত হন এবং তাঁকে জান্নাতুল বাক্বী শরীফে সমাহিত করা হয়।

৩৭
উলামায়ে কিরামের মন্তব্যঃ

১.  ইমাম যুহরী আলাইহির রাহমাহ বলেন- وَمَا رَأَيْتُ أَحَداً كَانَ أَفْقَهَ مِنْهُ و لَمْ أُدْرِكْ مِنْ أَهْلِ البَيْتِ أَفَضْلَ مِنْ عَلِيِّ بنِ الحُسَيْنِ “আমি তার চেয়ে বড় ফিকহবিদ আর কাউকে দেখিনি। আহলে বায়তের মধ্যে হযরত আলী বিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে শ্রেষ্ঠতর আর কাউকে আমি পাইনি”।

২.  হযরত যাইদ বিন আসলাম আলাইহির রাহমাহ বলেন-مَا رَأَيْتُ فِيْهِم مِثْلَ عَلِيِّ بنِ الحُسَيْن “আহলে বায়তের মধ্যে হযরত আলী বিন হুসাইনের মত আমি কাউকে দেখিনি”।

৩.  ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-   لَمْ يَكُنْ فِي أَهْلِ البَيْتِ مِثْلُه “আহলে বায়তের মধ্যে তাঁর মত কেউ ছিল না”।

৪.  হযরত ইহ্ইয়া বিন সায়িদ আলাইহির রাহমাহ বলেন- َكَانَ أَفَضْلَ هَاشِمِيٍّ أَدْرَكْتُهُ “আমার পাওয়া হাশেমী বংশের ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতর”।

৫.  আল্লামা আবু বকর ইবনুল বারক্বী আলাইহির রাহমাহ বলেন- وَكَانَ أَفَضْلَ أَهْلِ زَمَانِهِ“তিনি ছিলেন তার সময়ের শ্রেষ্ঠতর ব্যক্তি”।

৬.  হযরত সায়িদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন- مَا رَأَيْتُ أَوْرَعَ مِنْهُ “আমি তাঁর চেয়ে পরহিজগার ব্যক্তি কাউকে দেখিনি”।

৭.  আল্লামা আবু হাযিম মাদানী আলাইহির রাহমাহ বলেন- مَا رَأَيْتُ هَاشِمِيّاً أَفْقَهَ مِنْ عَلِيِّ بنِ الحُسَيْنِ “আমি হযরত আলী বিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে শ্রেষ্ঠতর হাশেমী ফিকাহবিদ কাউকে দেখিনি”।

৮.  ইমাম যাহাবী আলাইহির রাহমাহ বলেন- كَانَ أَهْلاً لِلإِمَامَةِ العُظْمَى؛ لِشَرَفِهِ، وَسُؤْدَدِهِ، وَعِلْمِهِ، وَتَأَلُّهِهِ، وَكَمَالِ عَقْلِهِ “পরিপূর্ণ বুদ্ধি, উপযুক্ততা, জ্ঞান-গরিমা, নেতৃত্বের উপযুক্ততা, আর মর্যাদার কারণে তিনি ছিলেন ইমামতে কুবরার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব।”

৯.  ইমাম যাহাবী আরো বলেন-  َكَانَ عَلِيُّ بنُ الحُسَيْنِ ثِقَةً، مَأْمُوْناً، كَثِيْرَ الحَدِيْثِ، عَالِياً، رَفِيْعاً، وَرِعاً “হযরত আলী বিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা ছিলেন নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, অধিক হাদিছ বর্ণনাকারী , সুউচ্চ মর্যদাবান, খোদাভীরু”।

১০. আল্লামা ইয্লী আলাইহির রাহমাহ বলেন- عَلِيُّ بنُ الحُسَيْنِ مَدَنِيٌّ، تَابِعِيٌّ، ثِقَةٌ “হযরত আলী বিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হলেন মদীনার নির্ভরযোগ্য তাবেয়ী”।৩৮



তথ্য সূত্রঃ

১। হযরত আব্দুর রহমান ইবনুজ জাওজী, সিফাতুস সাফওয়া, দারুল মারিফাহ, বৈরুত, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৯ হিজরী, খ. ২য়, পৃ. ৯৯।

২। শামছুদ্দীন মুহাম্মদ আল যাহাবী, ছিয়ারু আলামিন নুবালা, মুয়াস্সাসাতুর রিসালা, বৈরুত, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৫ হিজরী, খ. ৪র্থ, পৃ. ৩৮৭।

৩। হযরত মোস্তাফা রেযাখান, মলফুজাতে আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযাখান, মুহাম্মদ আলী। ইসলামী কুতুব খানা, ৪র্থ সংস্কারণ, ২০০১ইং, ১ম ভাগ, পৃ. ১৪৩।

৪। হযরত আব্দুর রহমান,চৌহরভী, মুহাইয়্যেরুল উকুল ফী বয়ানে আওছাফে আক্বলিল উকুল মজমুয়ায়ে ছলাতুর রছুল (দ:),আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া, চট্টগ্রাম, ৩য় সংস্করণ ১৯৮২ইং, খ. ৩০তম, পৃ. ৪৪।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলভী, আল কাউলুল জমীল বা শরহে  শিফাঈল আলীল, প্রকাশনা ও তারিখ বিহীন, জসীম বুক ডিপো, মাটিয়া মহল জামে মসজিদ, দিল্লী , পৃ. ১৯৬।

৫। ইমাম বায়হাক্বী, লুবাবুল আনসাব ওয়াল আলক্বাব, প্রকাশনা ও তারিখ বিহীন, খ. ১ম ,পৃ. ১০৩। ইবনে সাদ, আত্ব-ত্বাবক্বাতুল কুবরা, দারু ছাদির, বৈরুত, তারিখ বিহীন, খ. ৫ম, পৃ. ২১১ ।

৬। আল্লামা আব্দুর রহমান জামী, শাওয়াহিদুন নুবুওয়্যাহ, ইসলামিক পাবলিকেশন, দিল্লী, তারিখ বিহীন পৃ. ৩১০-৩১১।

৭। ইমাম বায়হাক্বী, প্রাগুক্ত।

৮। কবি গোলাম মুস্তাফা, বিশ্বনবী, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০০৬ইং, ২১ তম সংস্করণ খন্ড ১ম পৃ. –   ৩১-৩১।

৯। ইমাম বায়হাক্বী, প্রাগুক্ত।

১০। হযরত আব্দুর রহমান চিশতী, মিরাতুল আছরার, মাকতাবায়ে জামে নূর, দিল্লী ১৪১৮ হিজরী, পৃ. ২০৭।

১১। ইমাম বায়হাক্বী, প্রাগুক্ত, খ. ১ম, পৃ. ২২।

১২। ইমাম যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, দারুল কুতুব আল আরবী, বৈরুত, ১৪০৭ হিজরী,১ম সংস্করণ, খ.৬ষ্ট, পৃ. ৪৩৮। হযরত আব্দুর রহমান চিশতী, প্রাগুক্ত।

১৩। আল্লামা আব্দুর রহমান জামী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৯।

১৩। শামছুদ্দীন মুহাম্মদ আল যাহাবী, ছিয়ারু আলামিন নুবালা, প্রাগুক্ত,খ.৪র্থ,পৃ.৩৮৭।

১৩। প্রাগুক্ত।

১৪। আল্লামা আব্দুর রহমান জামী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১০-৩১১।

১৫। হযরত আব্দুর রহমান ইবনুজ জাওজী, প্রাগক্ত, পৃ. ৯৩।

১৬। আল্লামা ইবনু কাছীর, আল বিদাইয়া ওয়ান নিহাইয়া, মাক
Top