বিষয়ের ধারাবাহিকের একটি অংশ
মুহাম্মাদ

পরিচিতি

ঈদে মিলাদুন্নবী (আরবি: مَوْلِدُ النَبِيِّ) হল তিনটি শব্দের সম্মিলিত রূপ। ঈদ, মিলাদ ও নবী - এই তিনটি শব্দ নিয়ে এটি গঠিত। আভিধানিক অর্থে ঈদ অর্থ খুশি, মিলাদ অর্থ জন্ম, নবী অর্থ বার্তাবাহক। পারিভাষিক অর্থে মহানবী সঃ এর দুনিয়াতে আবির্ভাবের আনন্দকে ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হয়।[1]



- "ঈদ অর্থ হচ্ছে খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা |"
- "মিলাদ অর্থ জন্মবৃত্তান্ত"
- "আন-নবী মানে আমাদের নবী  (ﷺ)"
"মীলাদের" তিনটি সাদৃশ্যপূর্ণ আরবি শব্দ রয়েছে -
১) ميلاد মীলাদ, ২) مولد মাওলিদ, ৩) مولود মাওলূদ |
আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থে,
ميلاد النبي বা " মীলাদুন্নবী" বলতে রাসূল পাক (ﷺ) উনার বিলাদত শরীফকেই বুঝায় |
আর পারিভাষিক বা ব্যাবহারিক অর্থে,
মীলাদুন্নবী বলতে হুজুর পাক (ﷺ) উনার বিলাদত শরীফ উপলক্ষে উনার ছানা-সিফাত আলোচনা করা, উনার প্রতি দুরুদ-সালাত-সালাম পাঠ করা, এবং উনার পবিত্রতম জীবনী মুবারকের সামগ্রিক বিষয়ের আলোচনা বুঝানো হয় !

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা নিয়ে পথভ্রষ্ট আহলুল বিদাহ এর মধ্য মতভেদ রয়েছে। তবে আহলুস-সুন্নাহর অনুসারীদের এই ব্যাপারে কোন ইখতেলাফ নেই।

 এই দিনটি যথাযথ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকে। এই দিনটিতে বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকে। ঢাকাসহ সারাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী পালিত হয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান হয়ে থাকে চট্টগ্রামে। সেখানে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়। সেটি আয়োজন করে থাকে বাংলাদেশ আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া ট্রাস্ট[2][3]

বিষয়ভিত্তিক আয়াত

এক নজরে, মিলাদুন্নবী (ﷺ) সম্পর্কিত বিষয়ভিত্তিক কিছু আয়াত :
  • আল-ইমরান ৮১, ১৬৪
  • আল-আম্বিয়া ১০৭
  • সূরা আহযাব ৫৬ (দুরুদ পড়ার হুকুম)
  • আল-মায়েদা ১৫, ২০ (মূসা আ. এর মিলাদ)
  • সূরা তওবা ৩৩, ১২৮
  • সূরা সাফ ৬,৮
  • জুমুয়া ২
  • বালাদ ১-২
  • আল-ইব্রাহীম ৫ (মূসা আ. এর মিলাদ), ২৮ (বুখারী শরীফে শানে নুযুল), ৩৪
  • সূরা নাহল ৮৩
  • আল-ইনশিরাহ ১-৪
  • ক্বাফ ২
  • আনফাল ৩৩
  • আদ-দ্বোহা ১১
  • আল-আরাফ ১৫৭
  • সূরা হিজর ১৭২
  • সূরা ফাতহ ৮,৯, ২৮
  • আন-নিসা ৫৯, ১৬৪, ১৭৫

ব্যুৎপত্তি

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর আবিষ্কারক হলেন আরবলের অধিপতি বাদশাহ মুজাফফর উদ্দিন কৌকুরী। ৬০৪ হিজরীতে তিনি সর্বপ্রথম এটি আবিষ্কার করেন।[4] তিনি প্রত্যেক বৎসর অত্যন্ত ঝাঁকজমকের সাথে এটি পালন করতেন। এর পেছনে তিনি তৎকালীন প্রায় তিন লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করতেন।[5] বাদশাহের এই রকম উদারতার কারণে একদল লোক তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।[6] তারপর থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে এটি পালিত হয়ে আসছে।

আল-কুরআন ও তফসীরের আলোকে প্রমাণিত

সর্বজন সমাদৃত বিখ্যাত তফসীরগ্রন্থ থেকে আয়াতের ব্যাখ্যা সংযুক্ত করা হল।
আয়াত ১
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
اللهم ربنا انزل علينا ماءدة من السماء تكون لنا عيدا لاولنا واخرنا
অর্থ : আয় আমাদের রব আল্লাহ পাক ! আমাদের জন্য আপনি আসমান হতে (বেহেশতী) খাদ্যসহ একটি খাঞ্চা নাযিল করুন | খাঞ্চা নাযিলের উপলক্ষটি অর্থাৎ যেদিন খাঞ্চা নাজিল হবে সেদিনটি আমাদের জন্য, আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ স্বরূপ হবে !"
(সূরা মায়িদা ১১৪)
ব্যখ্যা :
উক্ত আয়াত শরীফে কি বুঝা গেল ?
হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) উনার উম্মতের জন্য আসমান থেকে একটি খাঞ্চা ভর্তি খাবার চাইলেন, এবং এই নিয়মত পূর্ন খাবার নাযিল হওয়ার দিনটা উনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ হবে বললেন | এই খাদ্য সহ খাঞ্চা নাযিল হওয়ার দিন যদি ঈদের দিন হয়, তাহলে যার উসীলায় জগৎ সৃষ্টি, যিনি সমগ্র জগৎ এর নিয়মাত, সকল নিয়মতের মূল , নি'মাতুল কুবরা হুজুর পাক (ﷺ) উনার আগমনের দিন কি আনন্দ বা ঈদ হতে পারে না? খুশি করা যাবে না ?
অবশ্যই হুজুর পাক (ﷺ) উনার আগমনের দিন ইমানদারদের জন্য খুশির দিন আর শয়তানের কান্নার দিন।[1]
আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ করার হুকুম :
আয়াত ১ :
আল্লাহ পাক বলেন, اذكروا نعمة الله عليكم
অর্থ : তোমাদের যে নিয়ামত দেয়া হয়েছে, তোমরা সে নিয়ামতকে স্মরন করো !" (সূরা আল ইমরান ১০৩)
আয়াত ২ :
وأما بنعمة ربك فحدت
অর্থ : আপনার রবের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। (সূরা আদ-দ্বোহা ১১)
দুনিয়ার আল্লাহর নিয়ামতের শেষ নেই কিন্তু রাসূল (ﷺ) শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।
হাদিসে আছে, হযরত মুহম্মদ (ﷺ) হলেন, আল্লাহ পাকের নিয়ামত!" (বুখারী শরীফ ১/২২১)
আদেশ সূচক বাক্য দ্বারা ফরজ এবং ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়।
সকল ফিক্বাহের কিতাবে আছে-
الامر للوجوب
অর্থাৎ, আদেশ সূচক বাক্য দ্বারা ফরজ ওয়াজিব সাব্যস্ত হয় ! (বাদায়েউস সানায়ে)
দেখুন, আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- اقيموا الصلوة
অর্থ : তোমরা নামাজ আদায় করো।"
কুরআন শরীফের এই নির্দেশ সূচক বাক্য দ্বারা নামাজ ফরজ হয়েছে |
তদ্রুপ সূরা ইউনূছের ৫৮ আয়াতের فليفرحوا বা খুশি প্রকাশ করো এটা আদেশ সূচক বাক্য।
তাহলে এই দিকে খেয়াল করলে, এ আদেশের দ্বারা রাসুলের আগমনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনস্বরূপ আনন্দিত হওয়া উত্তম কাজ এটা বিশ্বাস করা অত্যাবশ্যক। আর পালন করা সুন্নত কিংবা নফল।
সুতরাং প্রশ্ন হল, সবচাইতে বড় নিয়ামত কি ? নির্ধিদ্বায় জবাব হবে "হুজুর পাক (ﷺ) !
রসূলুল্লাহ (ﷺ) মাহাত্ম্য বর্ণনার নির্দেশ :
إنا أرسلناك شاهدا ومبشر ونذير لتؤمنوا بالله و رسوله و تعزروه وتوقروه وتسبحوه بكرة وأصيلا
৪৮:৮ - নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাযির (উপস্থিত) নাযির (প্রত্যক্ষ সাক্ষীস্বরূপ), সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে;
৪৮:৯ - যাতে হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ্‌ ও তার রসূলের উপর ঈমান আনো এবং রসূলের মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহ্‌র পবিত্রতা ঘোষণা করো। (সূরা ফাতাহ ৮,৯)
নবীগণের মজলিশে পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে সর্বপ্রথম মিলাদুন্নবীর [ﷺ] আলোচনা (শানে নুযুল দেখতে পারেন) :
وإذ أخذ الله ميثاق النبيين لما اتيتكم من كتاب و حكمة ثم جاءكم رسول مصدق لما معكم لتؤمنن به ولتنصرنه قال أأقررتم وأخذتم علي ذلكك إصري قالوا أقررنا قال فاشهدوا وأنا معكم من الشاهدين
অর্থ: স্মরণ করুণ! যখন আল্লাহ পাক নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমি আপনাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো।  অতঃপর তশরীফ আনবেন একজন রসূল [মুহাম্মদ (ﷺ)] ! তিনি আপনাদের প্রদত্ত কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন। তখন আপনারা নিশ্চই উনার প্রতি ঈমান আনবেন এবং উনাকে (পেলে) সহযোগিতা করবেন ! মহান আল্লাহ বললেন, আপনারা কি এ অঙ্গীকার স্বীকার ও গ্রহণ করলেন? উনারা বললেন, হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করে নিলাম। তখন আল্লাহ পাক বললেন, তাহলে আপনারা সাক্ষী থাকুন এবং আমিও আপনাদের সাথে সাক্ষী রইলাম !" (সূরা আল ইমরান ৮১)
সূরা ছাফ ৬ : আয়াত :
আল্লাহ পাক বলেন,
قال عيسي ابن مريم يبني اسراءيا اني رسول الله اليكم مصدقا لما بين يدي من التورة و مبشرا برسول ياتي من بعدي اسمه احمد
অর্থ :হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, হে বনী ইসরাঈল ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি ! আমার পূর্ববর্তী তাওরাত শরীফের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদ দানকারী। যিনি আমার পরে আগমন করবেন, উনার নাম মুবারক হচ্ছে আহমদ (ﷺ) !" (সূরা ছফ ৬)
সূরা ছাফ ৬ : তফসীর :
উক্ত আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)  নিজেই নিজের মীলদ শরীফ বর্ননা করেন,
"আমি তোমাদেরকে আমার পূর্বের কিছু কথা জানাবো ! তা হলো :
- আমি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর দোয়া,
- আমি হযরত ঈসা (আঃ) তার জাতিকে দেয়া সুসংবাদ এবং
- "আমার আন্মাজানের (স্বপ্নে) দেখা সেই নূর যা ওনার দেহ থেকে বের হয়ে শাম দেশের প্রাসাদ সমুহকে আলোকিত করেছিল।"
তথ্যসূত্রঃ
★ ইমাম তাবারী : তফসীরে তাবারী : খ ১ : প ৫৫৬
★ ইমাম তাবারী : তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক : খ ১ : প ৪৫৮
★ ইমাম কুরতুবী : তফসীরে কুরতুবী : খ ২ : প ১৩১
★ ইমাম ইবনে কাসীর : তফসীরে ইবনে কাসীর : খ ৪ : প ৩৬০
★ ইমাম আবু লাইস সমরকানী : তফসীরে সমরকানী : খ ৩ : প ৪২১
★ ইমাম সূয়ূতী : তফসীরে দুররে মনসূর : খ ১ : প ৩৩৪
★ ইমাম আহমদ : মুসনাদে আহমদ খ ৪ : প ১২৭ : হাদিস ১৬৭০১
★ ইমাম বায়হাকী : দালায়েলুন নবুওয়াত : খন্ড ১ : পৃ ৮৩, প ১১০
★ ইমাম ইবনে ইসহাক : সিরাতুন নবী : খ ১ : প ২৮
★ ইমাম ইবনে হিশাম : সিরাতুন নবী : খ ১ : প ১৫৬
★ ইমাম ইবনে সা'দ : তাবাকাত আল কুবরা : খ ১ : প ১৫০
★ ইমাম ইবনে হিব্বান : সহীহ ইবনে হিব্বান : খ ৯ : প ১০৬
★ ইমাম বাগবী : মিশকাতুল মাসাবিহ : প ৫১৩
★ ইমাম হাকিম : মুস্তাদরেক আল হাকিম : খন্ড ২ : পৃ ৬০০ : হাদিস ৪১৭৫
★ ইমাম ইবনে জাওজী : আল ওয়াফা : প ৯১
★ ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী : মাজমাউল যাওয়াইদ : (৮:২২১/৪০৯)
★ ইমাম ইমাম হিন্দি : কাঞ্জুল উম্মাল : খ ১১ : প ১৭৩
★ ইমাম হালাভী : সিরাতে হালাভিয়্যাহ : খ ১ : প ৭৭
এই হাদিসটির বিভিন্ন রেওয়াতে বর্ণিত সুত্রঃ
১. হযরত কা'ব আল আহবার (রাঃ)
২. হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) এর মাতা শিফা বিনতে আমর ইবনে আউফ (রাঃ)
৩. হযরত ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রাঃ)
৪. হযরত মু'য়াজ বিন জাবাল (রাঃ)
৫. হযরত আবু উমামা (রাঃ)
৬. হযরত উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ)
৭. হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)
৮. হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)
৯. হযরত ইকরামা (রাঃ)

মিলাদুন্নবী (ﷺ) সম্পর্কিত কিতাব[7]

তথ্যসূত্র


  1. আল বালাগুল মুবিন,পৃষ্ঠা ৪,ইবনে সাখাবী রহঃ

  2. দুয়ালুল ইসলাম, শামসুদ্দিন যাহেরী রহঃ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১০৩

  3. রাহে সুন্নত, পৃষ্ঠা ১৬২, মালেক মিসরী
৬. মাদারিজুন নবুয়ত,আব্দুল হক মোহাদ্দেসে দেহলভী।
Top