দীপ্ত সূর্যের গুপ্ত আলো
🖋 লিখেছেন - মাহদী গালিব বাংলাদেশ ( Mahdi Galib)
=========================================
১ম পর্বঃ-
আমরা দেখি কি দিয়ে? আলো দিয়ে। আলো যত উজ্জ্বল, দেখব তত বেশী। সবচে উজ্জ্বল কি? উত্তর, সূর্য। দুপুরের সূর্য। কিন্তু আমরা সূর্যকেই দেখতে পাই না। চোখে সয় না। মাধ্যম লাগে, চশমা লাগে। আজব না!
আজ এমনি সূর্যের কথা লিখব। একের পর এক। যাঁকে বুঝতে-দেখতেও মাধ্যম লাগে। এ মাধ্যমের নাম, বিবেক। যিনি সূর্যের মত প্রকাশিত। অবুও অদেখা। অযোগ্যতা আমাদের। তাঁকে পেয়েও পাই নি।
১৪ জুন ১৮৫৬। ২৮ অক্টোবর ১৯২১। ৬৫ বছর ৪ মাস, ১৫ দিন। ২৩,৮৭৭ : তেইশ হাজার আটশত সাতাত্তুর দিন।
গ্রন্থ সংখ্যা পনেরো শতাধিক। হিসেবের সুবিধায় ধরলাম দেড় হাজার। এবার 'দিন' এবং 'বই-সংখ্যা' ভাগ করি।
২৩,৮৭৭ ÷ ১,৫০০ = ১৫.৯১৮ (প্রায় ষোল দিন)।
থামুন। একটু ভুল হচ্ছে। আট বছরে তাঁর প্রথম বই। অতএব, আগের সাত বছর বাদ, ৬৫-৭। ফলাফল, ৫৭ বছর ৪ মাস ১৫ দিন । ২০,৮০৫ : বিশ হাজার আটশ পাঁচ দিন। লিপ ইয়ার ধরি নি। এবার ভাগ করি।
২০,৮০৫÷১,৫০০ = ১৩.৮৭ ( প্রায় চোদ্দ দিন) মানে চোদ্দ দিনে একটি বই লেখা হয়েছে।
আচ্ছা, দেড় হাজার বইয়ে মোট পাতা কত? তবে একদিনে কত পাতা লিখেছেন? ঘন্টায় কত? খোদার কসম জানি না। কল্পনাতেও আসে না।
ছোটতে রচনা পড়েছি। গরুর রচনা। 'কাউ ইজ আ ডোমেস্টিক এনিমেল'। আধ মাস যুঝেছি। মুখস্থ হয় নি। আর আধ মাসে একটা বই লেখা! মাসে দুইটা। থুক্কু! আটাশ দিনে।
সে বই কি রকম? না, 'আম পাতা জোড়া জোড়া' বই না। মহাকাশে কোটি নক্ষত্র। লক্ষ গ্রহ-উপগ্রহ। সব ছুটছে। প্রভাব রাখছে পৃথিবীতে। এইসব ছোটাছুটির হিসেব রাখে জ্যোতির্বিজ্ঞান। তিনি সেই আলোকবর্ষের হিসেব লিখেছেন।
সমাজবিজ্ঞান। আগে মানবিক বিভাগে ছিল। ক'বছর আগেই আলাদা হল। নতুন ফ্যাকাল্টি খুলল। অথচ তিনি শত বছর আগেই সমাজ বিজ্ঞানের ওপর লিখেছেন। জ্ঞানের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গণিতে দশের ওপর পাই নি। ম্যাট্রিকের টেস্টেও। একুব-বেকুবের সূত্র আজও বুঝি না। তিনি গণিতের সব শাখায় লিখেছেন। এমনকি প্রাইম নাম্বার নিয়েও। গণিত বিভাগের প্রধানও তাঁর থেকে সমাধান নিত।
আমি যাযাবর। জেলায়-থানায় ঘুরি। কত গাছ যে দেখি। প্রায় কিছুই চিনি না। বোটানির ছাত্রদের জিজ্ঞেস করি। তারাও জানে ন। অথচ তিনি গাছ-গাছরার ওপর বিশাল গ্রন্থ লিখে বসে আছেন। শত বছর আগেই। গাছ থেকে ওষুধ হয়। একে ভেষজবিদ্যা বলে। তিনি ভেষজবিদ্যাও লিখেছেন। 'হামদার্দ-বিশ্ববিদ্যালয়' তাঁর লেখার ওপর গবেষণা করেছে। স্বীকার করেছে তাঁর পাণ্ডিত্য।
ভাষা বড় অদ্ভুত। প্রতি তিন মাইলে ভাষা পালটায়। 'খাইছো' হয় 'খাইছুন'। একে বলে ধ্বনিতত্ব। তিনি এর ওপরেও লিখেছেন। তাঁর প্রথম বই আরবী ব্যাকরণে ওপর।
আমি কবিতা লিখি। কবিতার আইন আছে। অনুপ্রাস, অন্তমিল, স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত - আরো মেলা কিছু। অত জানি না, মানিও না। অত মানলে কবিতা লেখাই অসম্ভব। আমার অযোগ্যতা। আর তিনি এসব আইনের মাস্টার ছিলনে। এবং স্রষ্টাও ছিলনে। এ আইনকে বলে বালাগাত, অলংকরণশাস্ত্র।
সব কিছু ছাপিয়ে ছিল তাঁর ফতওয়া। আমাদের সমাজে 'ফতওয়া' শব্দটা ব্যাকডেটেড। খ্যাত-খ্যাত শুনায়। যদিও বিষয়টা বিপরীত। আম্মা বলেন, 'ভাল্লুকের হাতে কোদাল'। ভাল্লুকের হাত ছোট। কোদাল না ধরতে পারে। না কোপাতে পারে। হাস্যকর অবস্থা। ঠিক তেমনি মূর্খ (সম)কওমী সম্প্রদায় ফতওয়াকে বাজারে শব্দ বানিয়েছে।
ফতওয়া মানে আইন। মুফতি সাহেব ফতওয়া দেন। মুফতি মানে আইন নির্ধারক। আইন প্রণেতা না। এবার ভাবুন তো, সুপ্রিমকোর্টের জজ সাহেবের মর্যাদা। যেকোনো জজের মর্যাদা। তারা কি আমজনতা? আমাদের মত? আফসোসের বিষয়, ভাল্লুকের মতই এদেশে চামড়া-চান্দা তুলে খাওয়ারা বিষাক্ত ছত্রাকের মত মুফতি আর ফতওয়ার জন্ম দিচ্ছে।
তাঁর লিখা ফতওয়া গ্রন্থ 'ফওয়ায়ে রেজভিয়া'। মোট তিরিশ খণ্ড। প্রতি খণ্ড গড়ে ৭০০ পাতা। মোট একুশ হাজার পাতা। বিয়াল্লিশ হাজার পৃষ্ঠা। মানবজীবনের সব আছে এতে।
তাঁর ফতওয়া ছিল যুগান্তকারী। জেনে অবাক হবেন, আপনার মানিব্যাগে যে টাকার নোট, সেটা তাঁর বদৌলতেই পেয়েছেন। তাঁর বদৌলতেই এখনো ৯৯.৯০% মুসলিম উদার, মানবিক।
আল্লাহ বলেন : হে মানব জাতী, তোমরা বড়ই তাড়াহুড়ো। আমাদের ধৈর্য কম। তাই লেখা বাড়াচ্ছি না। আজকের সমাপীকা টানছি।
তিনি দুই ঘন্টা ঘুমাতেন। বাইশ ঘন্টা কাজ করতেন। বেশি সময় লেখালেখি। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? তাঁরও সংসার ছিল। আয়-রোজগার ছিল। এত লিখতেন কিভাবে? মাসে দুইটা বই। যার জন্য আলাদা ছাপাখানাই দেয়া হয়েছিল।
তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করা হল : আ'লা হযরত! এত কিভাবে লিখেন? তিনি হাসলেন। স্নিগ্ধ তাবাসসুম। বললেন, কলম দিয়ে লেখা হয়। তাই বলে কলম কি লিখতে পারে? না, যিনি কলম ধরেন তিনি লেখেন। জেনে রাখো, আমি আহমাদ রেযা একটি কলম মাত্র। আর আমাকে ধরে যিনি লিখছেন, তিনি বাগদাদ ওয়ালা। তিনি আমার গাউসে পাক!
#২য়_পর্বঃ-
অর্থনীতি, ইকোনোমিক্স। ভার্সিটির একটি সাবজেক্ট। অর্থনীতি ও মানুষ অবিচ্ছেদ্য। ফ্যাল কড়ি মাখ তেলের মত। কড়ি বা অর্থ নেই, তেলও নেই। ১৯৪০ থেকে অর্থনীতিকে একটি বিষয় বিবেচনা করা হল। এর আগে সভ্যতা জানতও না। অথচ, ১৯১২ সালে অর্থনীতির বই লিখেন ইমাম আ'লা হযরত। অর্থনীতিকে স্বতন্ত্র সংজ্ঞায়িত করেন। পশ্চিমাদেরও ২৮ বছর আগে। প্রবর্তন করেন যুগান্তকারী পলিসি।
অবশ্য, এডাম স্মিথ অনেক আগেই একটা বই লিখেন। 'ওয়েলথ অভ নেশন' নামে। সেটা মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর। যা খুলে দিয়েছিল পুঁজিবাদ ও সম্রাজ্যবাদীদের দরজা। মানুষের রক্তচোষা অধ্যায়। 'মুক্তবাজার অর্থনীতি', ফ্রিম্যাসন, 'নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' এবং ইজরাইল একসূতোয় গাঁথা। যার ঘোরতর বিরোধী আ'লা হযরত। একমাত্রও বলা যায়। সে এক বিশাল অধ্যায়। আরেকদিন বলব।
আ'লা হযরত চারটি সূত্র উপস্থাপন করেন।
(i) সঞ্চয় বা সেভিংস।
(ii) ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রণয়ন।
(iii) মুসলিম-মুসলিম বাণিজ্য।
(iv) ইসলামী বিজ্ঞানের প্রয়োগ।
সঞ্চয় বা সেভিংস :
ধরুন একশ টাকা আছে। ৮৫ টাকা খরচ করলেন। বাকি ১৫ টাকা জমাবেন। যা ধীরে ধীরে বড় হবে। কিস্তির পর কিস্তিতে। এক সময় সে অর্থ আপনি বিনিয়োগ করবেন। আপনার আর্থিক অবস্থা বদলাবে। কথাটা খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু শত বছর আগের কথা ভাবুন। মানুষ তো অর্থনীতিকেই চিনত না। সেভিংস তো দূর কি বাত। আজকের গরিব দেশগুলোর সঞ্চয় ৫-৮%। আর উন্নত দেশের ১৫% বা বেশি। তাহলে বুঝুন সঞ্চয় কিভাবে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৩৬ সাল। ইংল্যাণ্ডের লর্ড জে. এম কায়নেয 'থিওরি ওভ সেভিংস এণ্ড ইনভেস্টমেন্ট' প্রকাশ করে। যা হুবহু আ'লা হযরতের থিওরি। এজন্য বৃটিশরা তাকে 'লর্ড' উপাধিও দেয়। সম্মানিত করে।
এবার ভাবুন। কার বিয়ে কে পরে মালা! কার আবিষ্কার কে পায় পুরষ্কার।
আরেকটা কথা, আ'লা হযরত নাকি বৃটিশদের দালাল! যদি তাই হয়, তবে বৃটিশরা আ'লা হযরত কে কেন পুরষ্কৃত করল না? কেন এমন অবিচার? আফসোস! শত্রুরা মুসলিমের জ্ঞান কাজে লাগায়। আর আমরা তাঁকে চিনলামও না এখনো (আল্লাহ ন্যায় বিচারক)।
ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রণয়ন :
সে যুগে ব্যাংক ছিল হাতেগোনা। এর সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল না। আ'লা হযরত মুসলিমদের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। প্রথম সূত্র ছিল সঞ্চয়। এখন ব্যাংক না থাকলে মানুষ জমাবে কোথায়? বলে রাখি, বর্তমান ব্যাংক আর আ'লা হযরত এর ব্যাংকের ব্যাপক তফাত। যা সুদহীন। শরীয়া সমৃদ্ধ। অনেকটা নিরাপদ সিন্দুকের মত। মানুষ জমাবে, ব্যাংকে বেতন দিবে অর্থ রক্ষার জন্য।
এই ব্যাংকি ব্যবস্থার কারণে মানুষ সঞ্চয়মুখি হবে। বাড়বে অর্থের প্রবৃদ্ধি। অল্প পরিসরে বুঝানো কষ্টকর। মালিক আমাদের অনুমানের শক্তি দিক।
মুসলিম-মুসলিম বাণিজ্য :
এখানে বলা হয়, একজন মুসলিম শুধু মাত্র মুসলিমের সাথেই ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। এতে মুসলিমের অর্থ মুসলিমের কাছেই থাকবে।
এখন ভাবতে পারেন, আ'লা হযরত সংকীর্ণমনা। তিনি বাকিদের ঘৃণা করতেন।
থামুন! গভীরে যান, ডুব দিন। মুসলিমদের শোচনীয় অবস্থা তখন। উসমানীয়দের পতন হচ্ছে। ভারতে বৃটিশ লুটছে। ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। প্রশ্নটা ছিল মুসলিমদের অস্তিত্বের। বেঁচে থাকার। একটা উদাহরণ দেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ইউরোপে ভয়াবহ অবস্থা। মানুষ না খেয়ে মরে। তারা তখন 'ইউরোপীয় কমন মার্কেট' (E. M. C.) বানায়। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যেই ব্যবসা করত। বাকিদের সুযোগ ছিল না।
আজকে তাদের অবস্থা কোথায়? বিশ্বে সবচে উন্নত অঞ্চল। আফসোস! আ'লা হযরত এর থিওরি তারা ব্যবহার করে। আর আমরা তাঁকে ইংরেজপ্রেমী বানাই।
এছাড়াও আ'লা হযরত কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল, দেশ, রাষ্ট্রের কথা বলেন নি। সারাবিশ্বেই মুসলিম আছে। তাই তার থিওরি সারা বিশ্বেই প্রযোজ্য।
আর অমুসলিমদের সাথে ব্যবসা বন্ধ হলে মাদক ও অন্যান্য হারাম বস্তুও আসা বন্ধ হবে। সুরক্ষিত থাকবে মুসলিম উম্মাহ। কি চমৎকার পন্থা। 'ফেড্রিক লিস্ট' একজন প্রখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবিদ। তিনিও আ'লা হযরত এঁর এই নীতিকে স্বীকার করেছেন।
ইসলামী বিজ্ঞানের প্রয়োগ:
এ পয়েন্টা ভিন্ন। ভাবছেন অর্থনীতির সাথে এসবের কি সম্পর্ক। এখানে আ'লা হযরত এঁর অনন্যতা। যেখানে আমাদের চিন্তা শেষ। সেখানে তাঁর শুরু।
আ'লা হযরত চাইছিল মুসলিমরা শিক্ষিত হোক। যাতে আমরা সভ্যতার সাথে এগুতে পারি। শিক্ষার অনগ্রসর আমাদের ডুবাচ্ছিল।
যাকগে, মূল কথা এটা না। আ'লা হযরত এঁর ব্যাখ্যা ভিন্ন। আ'লা হযরত চাইছিলেন, অর্থনীতি বিষয়টি যেন ইসলামের মৌলিক একটি শাখায় পরিণত হয়। ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান যেন এতে সর্বোচ্চ প্রভাব রাখে। ফলে মুসলিমরা হবে অর্থনৈতিক সচেতন।
আজ কষ্ট হয়। সভ্যতা আজ পশ্চিমাদের। তারা যাই বকে, আমরা শিখি। নিজের ইতিহাসও আমরা জানি না।
এই ইতিহাসের এক অদেখা অধ্যায়ের নাম আ'লা হযরত ইমাম আহমাদ রেযা খান। তিনি ডাকছেন দু'হাত বাড়িয়ে। বলছেন তাঁকে আবিষ্কার করতে।
হে নতুন দিনের নব সেনানী!
ওঠ!
ফিরিয়ে আনো এই ব্যথিত সত্তার প্রাপ্য অধিকার,
বেরেলি থেকে সে তোমায় ডাকে বারবার!
লেখা চলতে থাকবে ইনশা আল্লাহ পর্বে পর্বে পোস্ট করতে থাকবো...