বংশ পরিচয়, শুভ জন্ম ও শৈশবঃঅনেক আগে দিল্লীর কোন এক সুলতান মোগল সম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে অবস্হিত দুর্গসমুহের যে দুর্গটি পুরাতন সিলেট জেলার (বর্তমান কাছাড় জেলার) বদরপুরের পুরান বাজারের কাছে নদীর তীরে অবস্হিত ছিল, সেই দুর্গের জন্য দিল্লীর অধিবাসী চারজন সম্ভ্রান্ত শেখ, সৈয়দ, মোগল ও পাঠান বংশীয় সামরিক কর্মকর্তা প্রেরণ করেন । অবশেষে তাঁদের পরবর্তী বংশধরেরা বদরপুর এলাকায় স্হায়ীভাবে বসতি স্হাপন করেন । তন্মধ্যে শেখ বংশীয় সামরিক কর্মকর্তার বংশধরেরা বদরপুরের বুন্দাশীল নামক গ্রামে স্হায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন । তাঁরাই কুতবুল আকতাব হযরত শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ)এর পুর্ববর্তী বংশধর । তাঁর পিতা এই খান্দানের একজন নামকরা লোক শাহ মুহাম্মদ বাছির ছিলেন । শৈশবেই তিনি পিতা মাতাকে হারান এবং তাঁর মামার তত্বাবধানে লালিত পালিত হন ।
শিক্ষাঃ তাঁহার প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ বাগবাড়ী নিবাসী মাওলানা ঞ্জীব আলী মরহুমের কাছে । প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর যথাক্রমে তিনি মাদ্রাসাই আলিয়া ফুল্বাড়ী ও মাদ্রাসাই আলিয়া কটকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর ভারতবর্ষের ইসলামী শিক্ষার অন্যত্ম প্রাণকেন্দ্র মাদ্রাসাই আলিয়া রাম্পুরে চলিয়া যান এবং সেখানে হযরত মাওলানা ফজলে হোক রামপুরী(র), আল্লামা আব্দুল হওকে খয়রাবাদী(র) ও সুনামধনয় মুহদ্দিস মাওলানা ইর্শাদ হুসেইন রামপুরী(র) প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের কাছে দওরায়ে হাদিছশ অন্যান্য বিষয়ে চুড়ান্ত শিক্ষা সমাপ্য করেন ।
বয়েত ও খিলাফতঃ বাল্যকাল হইতেই তাঁহার অন্তরে ধ্যান ধারণার প্রেরণা ও আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা পরিলক্ষিত হয় । তিনি মুর্শিদের সন্ধানের ছিলেন । তবে তিনি এই অনুসন্ধানে চেষ্ঠার চেয়ে আল্লাহর তরফ থেকে কোন ইঙ্গিত প্রাপ্তির উপর বেশী নির্ভরশীল ছিলেন । এই অনুসন্ধিৎসু মন লইয়া তিনি এক রাত্রিতে স্বপ্ন দেখিলেন হযরত মাওলানা হাফিজ আহমদ জৈনপুরী(র) তাঁহাকে আহবান করিতেছেন । তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কোনখানে আপনার সাক্ষাৎ পাব?” উওরে জৈনপুরী(র) বলিলেন কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর নামক স্হানে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করুন । স্বপ্ন দেখার একদিন পর হযরত বদরপুরী(র)চাঁদপুরে পৌছিলেন । এইদিকে কুতবুল ইর্শাদ হযরত মাওলানা জৌনপুরী(র) তিন দিন হইতে তাঁহার অপেক্ষা করিতে ছিলেন । তিনি খাদিমদিগগে বিশেশভাবে বলিয়া রাখিয়াছিলেন “যদি সিলেট হইতে কোন আলিম আসিয়া থাকেন তবে সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে পৌছাইয়া দিবে । বদপুরী সাহেব চাঁদপুর স্টেশনে গাড়ী হইতে নামার পর অনেকে প্রশ্ন করিলেন আপনার বাড়ি কোন জায়গায়? তিনি উত্তরে বলিলেন আমি সিলেট হইতে আসিয়াছি । তাহার উত্তর শুনিয়া বলিলেন হুযুর কিবলাহ তিন হইতে আপনার অপেক্ষায় আছেন । বদরপুরী ছাহেব তাহাদের কথায় বিস্মিত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন হুযুর কিবলাহ তো আমাকে তো আমাকে চিনেনই না তবে কার অপেক্ষা করিতেছেন?
যাহাই হোক তিনি জৈনপুরী সাহেবের খেদমতে উপস্হিত হইলেন । জৈনপুরী(র) তাঁহাকে তিনবার প্রশ্ন করিলেন, আপনি কি চান? বদরপুরী(র) তিনবারই উওরে বলিলেন আল্লাহ ও তাঁহার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্ঠি আমার কাম্য । তাহারপর জৈনপুরী(র) তাঁহাকে বয়েত করাইলেন । তাঁহাকে দুইদিনে দুইদিনে তরীকার ছবকসমুহ বাতাইয়া দিলেন এবং মকামে ফানা,বাকা, মাশাহেদা ইত্যাদি স্তর অতিক্রম করাইয়া দিলেন । তারপর খিলাফত নামা প্রদান করিলেন । তখন বদরপুরী তাঁহার কাছে কিছুদিন থাকার জন্য কাঁদিয়া কাঁদিয়া অনুনয় বিনয় আরম্ভ করিলেন । তখন পীরে কামিল হযরত মাওলানা হাফিজ আহমদ জৈনপুরী(র) জযবার মধ্যে আসিয়া বদরপুরী সাহেবের বুকে সজোরে স্বীয় আংটি দ্বারা চাপ প্রয়োগ করিয়া বলিলেন, আপনার খেদমতের আর প্রয়োজন নাই । ইনশাল্লাহ সবকিছু হইয়া যাইবে । তারপর বদরপুরী(র) জিজ্ঞাসা করিলেন, পুনরায় কোন জায়গায় যাইয়া সাক্ষাৎ করিব । তখন জৈনপুরী(র) বলিলেন আর দেখা হইবেনা । আল্লাহর নেক বান্দা্রা যাহা বলিয়া থাকেন ঠিকই বলিয়া থাকেন । কথাটা বাস্তবিকই সত্য । এই দিনেই তিনি বদরপুরী সাহেবকে বিদায় দিয়া ঢাকার পথে রওয়ানা হন এবং সফরেই ইন্তেকাল করেন ।
বদরপুরী সাহেব প্রায়ই বলিতেন, হযরত মাওলানা জৈনপুরী(র) আমার বুকে আংটি দ্বারা চাপ প্রয়োগের সময় যে উষ্ণতা অনুভব করিয়াছিলাম এখনও তাহা আছে।
এই উষ্ণতা তাঁহার মৃত্যুর পরও বাকি ছিল । তাঁহার বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মাহমুদুর রহমান সাহেব যিনি তাহাকে গোসল দিবার সময় উপস্হিত ছিলেন, বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাঁহাকে ইন্তেকালের প্রায় আঠারো ঘন্টা পর গোসল দেওয়া হয় । গোসলের সময় শরীরে হাত দিয়া দেখিলাম শরীর স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা কিন্তু বুক হইতে কোমর পর্যন্ত এত গরম যে, মনে হইতেছিল যেন জ্বর উঠিয়াছে ।
ইলমে দ্বীনের খেদমতঃ তিনি কাছাড় কাঠিগড়া মাদ্রাসা, আসামের জয়নগর মাদ্রাসা, ও মাদ্রাসাই আলিয়া বদরপুরে দীর্ঘ দিন নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনি শিক্ষাদানে মশগুল থাকেন । তিনি মাদ্রাসাই আলিয়া বদরপুর ও দারুল হাদিছের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । তাছাড়া অন্যান্য বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও স্হায়িত্ব তাঁহার উপর নির্ভর করত । তাঁহার আদেশে বহু মাদ্রাসা স্হাপন করা হয় ।
তাবলীগ ও ইর্শাদঃ তিনি হযরত মাওলানা জৈনপুরী সাহেবের খেদমত হইতে বিদায় লইয়া দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মানুষের কাছে স্হীয় রহস্য গোপন রাখার চেষ্ঠা করেন কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই মানুষের কাছে প্রকৃত বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে । দলে দলে লোক তাঁহার কাছে বয়েত করে এবং আধ্যত্নিক উন্নতি লাভ করিতে থাকে । তিনি আজীবন তাবলীগ ও হেদায়তের কাজে মশগুল থাকেন । সিলেট, কাছাড় ও নওয়াগাঁয়ও জেলার বহু লোক তাঁহার কাছে আধ্যাত্নিক দীক্ষা গ্রহণ করেন , তাছাড়া গোয়াল পাড়া ডিব্রোগড়, ডিগবই, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় তাঁহার বহু মুরীদ ছিলেন । উপরোক্ত অঞ্চলসমুহের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম তাঁহার ছিলছিলাভুক্ত ছিলেন । তাঁহার খলিফাগনের দ্বারা দ্বীনি খেদমত ও ছিলছিলার খেদমত জারী আছে । বাংলাদেশের খলিফাগণের মধ্যে তাঁহার জামাতা ও তাঁহার স্হলাভিষিক্ত খলিফা রঈছুল কুররা ও রঈছুল মুফাচ্ছিরীন জনাব মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেবের দ্বারা মানুষের হেদায়ত, ইলমে দ্বীন ও তরীকতের খেদমত, বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ইত্যাদি জারী আছে ।
আখলাকঃ তিনি সব প্রশংসনীয় গুণে গুণান্বিত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে পুর্ণ আদর্শবান ছিলেন । বিশেষতঃ দানশীলতা, মানুষের প্রতি করুণা প্রদর্শণ তাঁহার চরিত্রে প্রধান বৈশিষ্ঠ ছিল । তাই লোক তাঁহাকে হাতীম আখ্যা দিয়াছিল । পবিত্র কুরআনের সাথে তাঁহার অন্তর অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ছিল । তিনি শুদ্ধভাবে তাজবীদ মত কোরান শরীফ পাঠ করার বিশেষ তাগিদ করিতেন । দুরুদ ও অযীফার অভ্যাস কোন ডীন ছাড়িতেন না ।
শেষ বিদায়ঃ তিনি ১৩৬৩ বাংলার ৬ই মাঘ সোমবার দিন তাঁহার জন্মস্হান বুন্দাশীল বদরপুরে ইন্তেকাল করেন এবং নিজ মহল্লার মসজিদের পাশে সমাহিত হন । মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স ছিল ১০৪ বছর ।
ইন্তেকালের সঠিক তারিখঃ ১৩৭৭ হিজরীর জমাদিউস সানী মাসের ২৯ তারিখ ১৯৫৮ ইংরেজীর ১৯শে জানুয়ারী। আল্লাহপাক আমাদেরকে যেন এই মহান ওলীর আদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন, এবং উনার রুহানী ফয়েজ দান করেন-আমিন ।