যদি কেউ এরূপ কোন পীরের নিকট বাইয়াত হয়ে থাকে তবে তার জন্য ফরয-ওয়াজিব হচ্ছে উক্ত পীরকে ছেড়ে দিয়ে একজন হক্বানী-রব্বানী পীর (মুর্শিদ) ছাহেব উনার নিকট বাইয়াত হওয়াঃ
↓
স্মরণযোগ্য যে, অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ইলমে তাছাউফ অর্জন করতে হলে এবং দায়িমী বা সার্বক্ষণিকভাবে মহান আল্লাহ্ পাক উনার যিকিরে মশগুল থাকার জন্য বা হুযূরী ক্বলব অর্জন করতঃ অন্ততপক্ষে বেলায়েতে আম হাছিল করতে হলে, অবশ্যই একজন কামিল পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে| কারণ কামিল পীর বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ব্যতীত ইলমে তাছাউফ অর্জন করার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ হুযূরী হাছিল করা বা বেলায়েতে আম হাছিল করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়|
তাই অনসরণীয় ইমাম, মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরামগণ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করতঃ রায় বা ফতওয়া দেন যে, ইছলাহ্ বা পরিশুদ্ধতা লাভ করা ও হুযূরী ক্বলব হাছিল করতঃ বেলায়েতে আম হাছিল করার জন্য একজন কামিল পীর বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয|
কেননা এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, ইলমে তাছাউফ অর্জন করার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ হুযূরী ক্বলব হাছিল করা তথা অন্ততপক্ষে বেলায়েতে আম হাছিল করা ফরয| এ ফরয ততক্ষণ পর্যন্ত আদায় করা সম্ভব হবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত না হবে| তাই বাইয়াত গ্রহণ করাও ফরয|
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে মাযহারীতে” উল্লেখ আছে যে,
كل ما يترتب عليه الاثر من الروض الاعيان فهو فرض عين.
অর্থঃ “যে কাজ বা আমল ব্যতীত ফরযসমূহ আদায় করা সম্ভব হয়না, ফরযগুলোকে আদায় করার জন্য সে কাজ বা আমল করাও ফরয|”
হানাফী মাযহাবের মশহুর ফিক্বাহের কিতাব “দুররুল মুখতারে” উল্লেখ আছে যে,
ما لا يتم به الفرض فهو فر ض.
অর্থঃ “যে আমল ব্যতীত কোন ফরয পূর্ণ হয়না, সে ফরয পূর্ণ করার জন্য ঐ আমল করাটাও ফরয|”
উল্লিখিত উছুলের ভিত্তিতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ফরয পরিমাণ ইলমে তাছাউফ যেহেতু অর্জন করা ফরয, আর তা যেহেতু কামিল মুর্শিদ বা পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব নয়, সেহেতু একজন কামিল মুর্শিদ অর্থাৎ যিনি সর্বদা মহান আল্লাহ্ পাক উনার যিকিরে মশগুল, উনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করাও ফরয|
শুধু তাই নয়, কামিল মুর্শিদের বা ওলী আল্লাহগণের ছুহবত লাভ করা বা উনাদেরকে অনুসরণ করার নির্দেশ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে| যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালাম পাকে সূরা তওবার ১১৯ নম্বর আয়াত শরীফে বলেন,
يايها الذين امنوا الله و كونوامع الصادقين.
অর্থঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ পাককে ভয় কর এবং ছদিক্বীন বা সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও|”
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ছদিক্বীন দ্বারা উনাদেরকেই বুঝানো হয়েছে, যাঁরা যাহির-বাতিন, ভিতর-বাহির, আমল-আখলাক, সীরত-ছূরত, ক্বওল-ফে’ল সর্বাবস্থায় সত্যের উপর কায়িম রয়েছেন| অর্থাৎ যাঁরা ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাছাউফে তাকমীলে (পূর্ণতায়) পৌঁছেছেন| এক কথায় যাঁরা মহান আল্লাহ্ পাক উনার মতে মত এবং মহান আল্লাহ্ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথে হয়েছেন এবং সর্বদা মহান আল্লাহ্ পাক উনার যিকিরে মশগুল অর্থাৎ যাঁরা কামিল পীর বা মুর্শিদ, উনাদেরকে বুঝানো হয়েছে|
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক আরো বলেন,
واصبر نفسك مع الذين يدعون ربهم با الغداوة والعشى يريدون وجهه.
অর্থঃ “আপনি নিজেকে উনাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যাঁরা সকাল-সন্ধা উনাদের রবকে ডাকে উনার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য|”
-সূরা কাহাফ/২৮
মহান আল্লাহ্ পাক এ প্রসঙ্গে আরো বলেন,
واتبع سبيل من اناب الى
অর্থঃ “যে ব্যক্তি আমার দিকে রুজু হয়েছেন, উনার পথকে অনসরণ কর|”
-সূরা লোকমান/১৫
কামিল মুর্শিদের গুরুত্ব সম্পর্কে কালামুল্লাহ্ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,
من يهد الله فهو المهتد ومن يضلل فلن تجد له وليا مر شدا.
অর্থঃ “আল্লাহ্ পাক যাঁকে হিদায়েত দান করেন, সেই হিদায়েত পায়| আর যে ব্যক্তি গুমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে, সে কখনই কোন ওলীয়ে মুর্শিদ (কামিল পীর) পাবেনা|”
-সূরা কাহাফ/১৭
অর্থাৎ যারা কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হয় না তারা পথভ্রষ্ট| কারণ তখন তাদের পথ প্রদর্শক হয় শয়তান| তাই সুলতানুল আরিফীন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সাইয়্যিদুত্ ত্বাইফা হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ আরো অনেকেই বলেন যে,
من ليس له شيخ فشيخه شيطان.
অর্থঃ “যার কোন পীর বা মুর্শিদ নেই তার মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক হলো শয়তান|”
দলীল সমূহঃ-
✔ ক্বওলুল জামীল,
✔ নূরুন আলা নূর,
✔ তাছাউফ তত্ত্ব|
আর শায়খ বা পীর ছাহেবের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
الشيخ لقومه كالنبى فى امته
অর্থঃ “শায়খ (পীর ছাহেব) উনার ক্বওমের মধ্যে তদ্রুপ, যেরূপ নবী আলাইহিস সালাম উনার উম্মতের মধ্যে|”
দলীল সমূহঃ-
✔ দাইলামী,
✔ মাকতূবাত শরীফ|
অর্থাৎ নবী আলাইহিস্ সালাম উনার দ্বারা যেরূপ উম্মতের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সবক্ষেত্রে ইছলাহ্ লাভ হয়, সেরূপ শায়খ বা পীর ছাহেবের দ্বারা মুরীদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন সবক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়|
অতএব, নবী আলাইহিস সালাম উনার উম্মত না হয়ে যেরূপ হিদায়েত লাভ করা যায়না, তদ্রুপ কামিল মুর্শিদ বা পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত না হয়েও ইছলাহ বা পরিশুদ্ধ লাভ করা যায়না| বরং শয়তানী প্রবঞ্চনায় পড়ে গুমরাহীতে নিপতিত হওয়াই স্বাভাবিক|
আর একারণেই জগদ্বিখ্যাত আলিম, আলিমকুল শিরোমনি, শ্রেষ্ঠতম মাযহাব হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা, ইমামুল আইম্মা, ইমামুল আকবর, হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থঃ “(আমার জীবনে) যদি দু’টি বৎসর না হতো, তবে আবু নু’মান (আবূ হানীফা) ধ্বংস হয়ে যেত|”
দলীল সমূহঃ-
✔ সাইফুল মুকাল্লিদীন,
✔ ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া|
অর্থাৎ আমি আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি যদি আমার শায়খ বা পীর ছাহেব ইমাম বাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম জাফর ছাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বাইয়াত না হতাম, তবে (শয়তানী প্রবঞ্চনায়) ধ্বংস বা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম|
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, যে ব্যক্তি কোন কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত না হবে, তার পক্ষে শয়তানী প্রবঞ্চনা ও বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকা আদৌ সম্ভব নয়| কেননা পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত ক্বলবে যিকির জারি করা অসম্ভব| আর ক্বালবে যিকির জারি করা ব্যতীত শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়| তাই পরিশুদ্ধতা লাভ করার জন্য বা ক্বালবে যিকির জারি করার জন্য অবশ্যই একজন কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হতে হবে|
আর তাই এ যাবত পৃথিবীতে যত ইমাম, মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ আগমণ করেছেন, উনাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন একজন পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হয়েছেন এবং উনাদের অনেকেই উনাদের স্ব স্ব কিতাবে পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করাকে ফরয বলেছেন| যেমন- গাউছুল আ’যম, মাহবুবে ছুবহানী, কুতুবে রব্বানী, ইমামুল আইম্মাহ হযরত বড় পীর আব্দুল কাদির জীলানী আলাইহিস সালাম ওয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব “সিররুল আসরারে” লিখেন,
ولذالك طلب اهل التلقين لحياة القلوب فرض
অর্থঃ “ক্বালব জিন্দা করার জন্য অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য “আহলে তালক্বীন” তালাশ করা বা কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয| অনুরূপ ফাতহুর রব্বানীতেও উল্লেখ আছে|”
তদ্রুপ হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্ব সমাদৃত কিতাব ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাতে’, কাইউমুযযামান হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী আলাইহিস সালাম ওয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘মাকতূবাত শরীফে’, আওলাদে রসূল, আশিকে নবী হযরত আহমদ কবীর রেফাঈ আলাইহিস সালাম ওয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ’ কিতাবে উল্লেখ করেন যে, “অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য বা ইলমে তাছাউফ অর্জন করার জন্য একজন কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হওয়া ফরয|” অনুরূপ তাফসীরে রূহুল বয়ান, রূহুল মায়ানী ও তাফসীরে কবীরে উল্লেখ আছে|
মূলতঃ কামিল মুর্শিদ বা পীর ছাহেব হলেন, অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ বেলায়েত হাছিল করে মহান আল্লাহ্ পাক উনার খাছ নৈকট্য লাভ করার এক বিশেষ ওয়াসীলাহ্ বা মাধ্যম| আর তাই মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ মুবারক করেন,
يا ايها الذين امنوا اتقوا الله وابتغوا اليه الو سيلة.
অর্থঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ পাককে ভয় কর এবং আল্লাহ্ পাক উনার নৈকট্য লাভ করার জন্য ওয়াসীলাহ তালাশ (গ্রহণ) কর|”
-সূরা মায়িদা/৩৫
এ আয়াত শরীফের তাফসীরে বা ব্যাখ্যায় “তাফসীরে রূহুল বয়ানে” উল্লেখ আছে যে,
الو صول لا يحصل الابالو سيلة وهى العلماء الحقيقة ومشائخ الطريفة.
অর্থঃ “ওয়াসীলাহ ব্যতীত আল্লাহ্ পাক উনার নৈকট্য লাভ করা যায়না| আর উক্ত ওয়াসীলাহ হচ্ছেন, হাক্বীক্বত ও তরীক্বতপন্থী আলিম বা মাশায়িখগণ অর্থাৎ কামিল মুর্শিদগণ|”
উপরোক্ত বিস্তারিত ও অকাট্য আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও হুযূরী ক্বালব অর্জন তথা কমপক্ষে বেলায়েতে আম হাছিল করার জন্য জরুরত আন্দাজ ইলমে তাছাউফ অর্জন করা যেরূপ ফরয তদ্রুপ একজন হক্বানী ও কামিল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হওয়াও ফরয|
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কামিল বা হক্বানী-রব্বানী পীর বা মুর্শিদ কে? কামিল বা হক্বানী-রব্বানী পীর বা মুর্শিদ-এর আলামত কি? মূলতঃ কামিল বা হক্বানী-রব্বানী পীর ছাহেব ও মুর্শিদ তিনিই যার অন্তরে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি রয়েছে| অর্থাৎ যিনি মহান আল্লাহ্ পাক উনার ভয়ে হারাম, নাজায়িয কাজ থেকে বিরত থাকেন| কেননা মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালাম পাকে ইরশাদ করেন-
انما يخشى الله من عباده العلماء
অর্থঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক উনার বান্দাদের মধ্য হতে শুধুমাত্র আলিমগণই আল্লাহ্ পাক উনাকে ভয় করেন|”
-সূরা ফাতির/২৮
এ আয়াত শরীফের তাফসীর জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম, ইমামুল আইম্মাহ, ইমামুছ ছিদ্দীক্বীন, শায়খুল মুহাদ্দিছীন, ৩য় হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ হযরত আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি| তিনি এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন, “যাঁর ভিতর যত বেশি আল্লাহভীতি রয়েছে তিনি ততবড় আলিম|”
উক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে খুলাছায়” উল্লেখ আছে যে, (মূল ইবারত কমেন্ট বক্সে স্ক্রীন শর্ট দ্রষ্টব্য)
“উক্ত আয়াত শরীফে العلماء শব্দ দ্বারা কিতাবসমূহ পাঠকারী তথা (দাওরা বা টাইটেল পাশকারীদেরকে) বুঝানো হয়নি| বরং পবিত্র কুরআন শরীফে বর্ণিত “আলিম” তারাই, যাঁরা মহান আল্লাহ্ পাক উনার মহিমাময় জাত ও অসীম গৌরবময় ছিফাতসমূহকে ঈমান ও মা’রিফাতের নূরের আলোকে অবলোকন করেছেন| কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয়তম ছাহাবা আজমাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও (পরবর্তী) বিলায়েতপ্রাপ্ত ও মকবূল ওলীআল্লাহগণ কিতাবী তথা দাওরা বা টাইটেল পাশ আলিম ছিলেন না| তথাপিও উনারা সর্ব্বোচ্চ স্তরের উপকারী ইলমের অধিকারী ছিলেন| অর্থাৎ উনারাই কুরআন শরীফে বর্ণিত প্রকৃত আলিম ছিলেন|”
উল্লিখিত আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় বিখ্যাত আলিম, ইমামুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে কাছীর শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রসিদ্ধ “তাফসীরে ইবনে কাছীরে” উল্লেখ করেন-
عن ابن مسعود رضى الله تعالى عنه انه قال ليس العلم عن كثر الحديث ولكن العلم عن كثرة الخشية وقال احمد بن صالح المصرى عن ابن وهاب عن مالك قال ان العلم ليس لكثرة الرواية وانما العلم نور يجعله الله تعالى فى القلب.
অর্থঃ “হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, যে ব্যক্তি অধিক হাদীছ শরীফ জানে সে ব্যক্তি আলিম নয়| বরং যাঁর মধ্যে আল্লাহভীতি অধিক সে ব্যক্তিই আলিম| আর হযরত আহমদ বিন ছালিহ মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অধিক রেওয়ায়েত শিক্ষা করলেই আলিম হওয়া যায়না| মূলতঃ ইলম হচ্ছে নূর বা জ্যোতিস্বরূপ| আল্লাহ্ পাক তা আলিমের অন্তকরণে দান করেন|”
উক্ত “তাফসীরে ইবনে কাছীরে” উল্লিখিত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ আছে যে-
قال سفيان الثورى …. العلماء ثلاثة عالم باالله وعالم بامر الله وعالم بالله ليس بعالم بامرلله وعالم بامرالله ليس بعالم بالله. فالعالم بالله وبامر الله الذى يخشى الله تعالى ويعلم الحدود والفر ائض.
অর্থঃ হযরত ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আলিমগণ তিনভাগে বিভক্ত: (১) আলিম বিল্লাহ অর্থাৎ যাঁরা শুধু আল্লাহ্ পাককেই জানেন| কিন্তু উনার হুকুম-আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞ| (২) আলিম বিআমরিল্লাহ| অর্থাৎ যাঁরা শুধু হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জানেন| কিন্তু আল্লাহ্ পাক সম্পর্কে অজ্ঞ বা আল্লাহভীতি নেই| (৩) আলিম বিল্লাহ ওয়া বিআমরিল্লাহ| অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ্ পাক ও উনার শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও ফারায়িয সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত এবং আল্লাহ্ পাককে ভয় করেন| (উনারাই হাক্বীক্বী বা প্রকৃত আলিম)|
কামিল পীর বা মুর্শিদ তিনিই যিনি অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন| যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
ومن ارباب العلم قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء قال الطمع.
অর্থঃ “(আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত কা’ব ইবনুল আহবার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন) আলিম বা ইলমের অধিকারী কে? তিনি উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযাযী আমল করেন| হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলিমদের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি উত্তরে বললেন, লোভ অর্থাৎ দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা|”
দলীল সমূহঃ-
✔ দারিমী,
✔ মিশকাত,
✔ মিরকাত,
✔ লুময়াত,
✔ আশয়াতুল লুময়াত,
✔ শরহুত ত্বীবী,
✔ তা’লীকুছ ছবীহ,
✔ মুযাহিরে হক্ব,
✔ মিরয়াতুল মানাজীহ|
বিশিষ্ট তাবিয়ী, আমীরুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত হযরত ইমাম হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলো- আলিম কে? তিনি জবাবে বলেন-
انما الفقيه الز اهد فى الدنيا وارغب الى الاخرة والبصير بذنبه والمداوم على عبادة ربه والورع الكاف عن اعراض المسلمين والعفيف عن امو الهم والناصح لجما عتهم.
অর্থঃ “ফক্বীহ্ বা আলিম হলেন ঐ ব্যক্তি, যিনি দুনিয়া হতে বিরাগ, পরকালের প্রতি ঝুঁকে আছেন, গুনাহের প্রতি সতর্ক, সর্বদা মহান আল্লাহ্ পাক উনার ইবাদতে মশগুল, পরহিযগার বা সুন্নতের পাবন্দ, মুসলমানের মান-সম্মান নষ্ট করেন না, তাদের সম্পদের প্রতি লোভ করেন না এবং উনার অধীনস্থদেরকে নছীহত করেন|”
উপরোক্ত দলীলভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মূলতঃ হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই-
(১) যিনি দ্বীন ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন,
(২) ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেছেন,
(৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন,
(৪) সুন্নতের পূর্ণ পায়রবী করেন,
(৫) হারাম-নাজায়িয ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হননা|
পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দৃষ্টিতে তিনিই হক্কানী পীর-মুর্শিদ বা নায়িবে নবী|
কাজেই হক্বানী পীর-মুর্শিদ নায়িবে নবী হওয়ার শর্তসমূহের মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে আক্বীদা বিশুদ্ধ থাকা| আর আক্বীদার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসে বর্ণিত হারামকে হারাম ও হালালকে হালাল বলা ও জানা| কেননা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম বলা ও জানা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত| কেননা কিতাবে স্পষ্টই উল্লেখ আছে যে,
استحلال المعصية كفر.
অর্থাৎ “গুনাহের কাজ বা হারামকে হালাল মনে করা কুফরী|”
দলীল-
✔ শরহে আক্বায়িদে নাসাফী|
স্মর্তব্য যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় ছবি তোলা হারাম| যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
ﻗﺎﻝ ﺣﺪﺛﻨﺎ ﺍﻻﻋﻤﺶ ﻋﻦ ﻣﺴﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﻛﻨﺎ ﻣﻊ ﻣﺴﺮﻭﻕ ﻓﻰ ﺩﺍﺭ ﻳﺴﺎﺭ ﺑﻦ ﻧﻤﻴﺮ ﻓﺮﺍﻯ ﻓﻰ ﺻﻔﺘﻪ ﺗﻤﺎﺛﻴﻞ ﻓﻘﺎﻝ ﺳﻤﻌﺖ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺎﻝ ﺳﻤﻌﺖ ﺍﻟﻨﺒﻰ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﻘﻮﻝ ﺍﻥ ﺍﺷﺪ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻋﺬﺍﺑﺎ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻤﺼﻮﺭﻭﻥ .
অর্থঃ- “হযরত আ’মাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মুসলিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মাসরুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর সঙ্গে ইয়াসার ইবনে নুমাইরের ঘরে ছিলাম, তিনি উনার ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি দেখতে পেলেন, অতঃপর বললেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহর নিকট শুনেছি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ্ পাক কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে|”
দলীল-
✔ পবিত্র বুখারী শরীফ ২য় জিঃ, পৃষ্ঠাঃ৮৮০|
عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه اخبره ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ان الذين يصنعون هذه الصور يعذبون يوم القيمة يقال لهم احيوا ما خلقتم.
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যারা প্রাণীর ছবি তৈরী করবে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে| এবং তাদেরকে বলা হবে, যে ছবিগুলো তোমরা তৈরী করেছ, সেগুলোর মধ্যে প্রাণ দান কর|”
দলীল সমূহঃ-
✔ পবিত্র বুখারী শরীফ ২য় জিঃ, পৃঃ ৮৮০,
✔ মুসলিম শরীফ ২য় জিঃ, পৃঃ ২০১|
عن ابى معاوية رضى الله تعالى عنه ان من اشد اهل النار يوم القيمة عذابا المصورون.
অর্থঃ- হযরত আবূ মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত, “নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন দোযখবাসীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির কঠিন আজাব হবে, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে বা তোলে|”
দলীল-
✔ মুসলিম শরীফ ২য় জিঃ পৃঃ ২০১|
وهذه الاحاديث صريحة فى تحريم تصوير الحيو ان وانه غليظة التحريم ايضا فيه وما من لم يقصد بها العبادة ولمضاهاة فهو فاسق صاحب ذنب كبير.
“উক্ত হাদীছসমূহে প্রাণীর ছবি তৈরী করা বা মূর্তি নির্মাণ করা হারাম হওয়া সম্বন্ধে প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে| এটা তৈরী বা নির্মাণ করা জঘন্যতম পাপের কাজ ও হারামও বটে| উক্ত কিতাবে আরও আছে, যদি কেউ মূর্তি বা প্রাণীর ছবি পূজা বা সৃষ্টির অনুকরণের জন্য নাও বানায়ে থাকে তবুও সে ফাসেক হবে এবং কবীরাহ্ গুনাহে গুনাহগার হবে|”
দলীল সমূহঃ-
✔ শরহে মুসলিম লিন নববী,
✔ ফতওয়ায়ে ছিদ্দিকিয়াহ্, পৃঃ৩৭৮|
হক্কানী পীর-মুর্শিদ বা নাবিয়ে নবী হওয়ার আরেকটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে আমল বিশুদ্ধ থাকা| অর্থাৎ মাথার তালু থেকে পায়ের তালা পর্যন্ত তথা চলা-ফেরা, উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, কথা-বার্তা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, চাল-চলন, আমল-আখলাক ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস অনুযায়ী হওয়া বা করা| যিনি হক্কানী পীর-মুর্শিদ হবেন তিনি ফরয ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরক করা তো দূরের কথা কোন মুস্তাহবও ইচ্ছাকৃত তরক করবেন না|
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো হক্বানী-রব্বানী পীর ছাহেব বা মুর্শিদ উনার একটি অন্যতম আলামত হলো আমল বিশুদ্ধ থাকা অর্থাৎ, হারাম-নাজায়িয বা শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বেঁচে থাকা অর্থাৎ কোন হারাম কাজ করা তো দূরের কথা ইচ্ছাকৃত কোন মাকরূহ কাজও করবেন না | যদি তাই হয় তবে যে সকল পীর শরীয়তে বর্ণিত সুস্পষ্ট হারাম কাজে মশগুল অর্থাৎ ছবি তোলে, ভিডিও করে, টিভি দেখে, টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে তারা কি করে হক্বানী পীর-মুর্শিদ বা নায়িবে নবী হতে পারে এবং তাদের হাতে বাইয়াত হওয়া শুদ্ধ হতে পারে?
অতএব, যে পীর ছবি তোলে, ভিডিও করে, টিভি দেখে ও টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে সে হক্বানী পীর নয়| কাজেই এরূপ পীরের নিকট বাইয়াত হওয়া কস্মিনকালেও জায়িয নেই বরং হারাম| যদি কেউ এরূপ কোন পীরের নিকট বাইয়াত হয়ে থাকে তবে তার জন্য ফরয-ওয়াজিব হচ্ছে উক্ত পীরকে ছেড়ে দিয়ে একজন হক্বানী-রব্বানী পীর ছাহেব উনার নিকট বাইয়াত হওয়া|