১১৪৩ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মস্থান ভারতের ঐতিহাসিক শহর পানিপথ। ওই শহরেরই বিজ্ঞ বিচারক ছিলেন তিনি। ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান রাদ্বিআলাহু আনহুর বংশধর। তাঁর মাযহাব ছিলো হানাফী এবং তরিকা ছিলো মোজাদ্দেদি। এই দুই নরের মহাসমুদ্র তাঁর বিশ্বাসে, আচরণে, কথায়, সিদ্ধান্তে, লেখনীতে বিকশিত হয়েছিলো বিস্ময়কর বিচ্ছুরণে । ধ্রুপদী আরবী ভাষায় দশ খন্ডে সমাপ্ত সুবৃহৎ কলেবরের তাফসীরে মাযহারী তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ । তিনি ছিলেন প্রায় তিরিশটি গ্রন্থের সফল রচয়িতা । তার মধ্যেতাফসীরে মাযহারীই তাঁর বৃহত্তম ও মহোত্তম কীর্তি ।

গ্রন্থটির নাম রেখেছেন তিনি তাঁর পীর-মোর্শেদের নামে। তিনি ছিলেন প্রকৃত আলেম ও আরেফ। তাঁর মধ্যে সমমাত্রায় একত্র হয়েছিলো রেওয়ায়েত (বর্ণনাক্রমিক বিদ্যা) দেরায়েত (বৃদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানানুশীলন) এবং ফেরাসাত (অন্তর্দৃষ্টি)। যাদের অন্তর অন্ধ, তারা তাঁর সম্যক মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারবেন না। বুঝতে পারবেন না কখনো, পীর-মোর্শেদের সাহচর্য ও তাওয়াজ্জোহ্ কতো মল্যবান। মোজাদ্দেদে আলফে সানি শায়েখ আহমদ ফারকী সেরহিন্দির সঙ্গে তাঁর আত্নিক পরম্পরা নেমে এসেছিলো তাঁর প্রিয় সন্তান খাজা মোহাম্মদ মাসুম, তাঁর সন্তান খাজা সাইফুদ্দিন, তাঁর খলিফা শায়েখ নূর মোহাম্মদ বদায়ুনী এবং তাঁর খলিফা শায়েখ মাযহারে শহীদ জানে জাঁনা’র মাধ্যমে(রহমাতুলাহি আ’লাইহিম আজ্বমাঈন)। এই তরিকাই শেষ দিকে মোজাদ্দেদিয়া তরিকা, প্রথম দিকে নক্শাবন্দিয়া তরিকা এবং পূর্বাপর সকল সময়ে নেসবতে সিদ্দিকী নামে খ্যাত । কেননা এই আধ্যাত্নিক প্রবাহের মলে রয়েছেন ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক ইবনে আবু কোহাফা রাদ্বিআলাহু আনহু ।

প্রভূত প্রতিভার অধিকারী এই কালজয়ী পুর€ষ সমগ্র কোরআন স্মৃতিবদ্ধ করেন তাঁর সাত বৎসর বয়ক্রমকালে। তারপর শুরু করেন অন্যান্য বিদ্যার চর্চা । তাঁর হাদিসশাস্ত্রের গুরু ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে খ্যাত হাদিসবেত্তা শায়েখ ওয়ালীউলাহ্ দেহলভী । তাঁর সন্তান শায়েখ আবদুল আজিজ দেহলভী ছিলেন তাঁর সতীর্থ ও সুহৃদ। প্রথমোক্ত জন বলতেন ‘ছানাউলাহ্কে ফেরেশতারাও সম্মান করে’। শেষোক্ত জন তাঁকে বলতেন ‘এযুগের বায়হাকী’। আর তাঁর প্রিয়তম পীর-মোর্শেদ তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন ‘পথের দিশারী’ (আলামুল হুদা)। তিনি আরো বলতেন

মহাবিচারের দিবসে কী নিয়ে এসেছো’ এমতো প্রশ্নের মুখোমুখি যদি হই, তবে আমি বলবো ‘ছানাউল্লাহ্‌কে’

প্রতিদিন এক মঞ্জিল কোরআন পাঠ করতেন তিনি । অতিরিক্ত নামাজ পাঠ করতেন একশত রাকাত । আজীবন এই-ই ছিলো তাঁর নিত্যকার অভ্যাস । এর সঙ্গে নিয়মিত সম্পžন্ন করতেন বিচারপ্রার্থীদের বিচার-মীমাংসার দায়িত্ব । এর পরে যে সময়টুকু পেতেন, তা ব্যয় করতেন জ্ঞানানুশীলনে ও গ্রন্থ রচনায়। এভাবে এক সময় অতীত হয়ে গেলো অনেক আলো এবং অনেক অন্ধকার। দিবসের। নিশীথের। মানব সমাজের উত্থান-পতনের । ভারতের সুদীর্ঘ কালের মুসলিম শাসন তখন অস্তমিতপ্রায়। সেই প্রহত প্রদোষকালে তিনি জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন এই অনির্বাণ বাতিঘরমহাজ্ঞানের এই অনন্য উপপল্লব, তাফসীরে মাযহারী । কাজ শেষে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন তাঁর পরম প্রিয়তম সখার কাছে ১২২৫ হিজরী সনের ১১ই রমজানে । আলাহ্পাক তাঁকে করুন মহাকল্যাণাধিকারী । আর আমাদেরকে করান ক্ষমায়িত, অনুকম্পায়িত ।

Top