ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ<br />#############################################<br />সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br />—————————————————————–<br />সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br />খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। #<br />بسم الله الرحمن الرحيم<br />কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী।<br /><br />নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ<br />——————————————————————————<br />তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় (বর্তমানে উজবেকিস্তান) জন্ম গ্রহণ করেন।<br /><br />তাঁর পিতা ইসমা’ঈল (রঃ) একজন মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ ব্যাক্তি ছিলেন। ইমাম মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রঃ) প্রমূখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনো হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেননি। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তার আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।<br /><br />শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ<br />——————————————————————————<br />শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন।<br /><br />শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন।<br /><br />অন্ধত্ব থেকে মুক্তি:<br />———————————————————————–<br />তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাহিসসালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।<br /><br />তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে। এরপর তিনি চাঁদের আলোতে লিখতে-পড়তে পারতেন। উল্লেখ্য, মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতেই তিনি ‘তারীখে কবীর’ নামক বৃহৎ কিতাবটি লিখেন।<br /><br />ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ<br />—————————————————————————<br />তিনি বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন,যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন।<br /><br />মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করে ফেলেন এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বুখারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম দাখিলী (রঃ)-এর হাদিস শিক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।<br />সে যুগের নিয়মানুসারে তার সহপাঠীরা খাতা কলম নিয়ে উস্তাদ থেকে শ্রুত হাদীস লিখে নিতেন, কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) খাতা কলম কিছুই সঙ্গে নিতেন না। তিনি মনোযোগের সাথে উস্তাদের বর্ণিত হাদীস শুনতেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বয়সে সকলের থেকে ছোট ছিলেন। সহপাঠীরা তাঁকে এই বলে ভৎসনা করত যে, খাতা কলম ছাড়া তুমি অনর্থক কেন এসে বস? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেনঃ তোমাদের লিখিত খাতা নিয়ে এস। এতদিন তোমরা যা লিখেছ তা আমি মুখস্থ শুনিয়ে দেই। কথামতো তারা খাতা নিয়ে বসল আর এত দিন শ্রুত কয়েক হাজার হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ) হুবহু ধারাবাহিক শুনিয়ে দিলেন। কথাও কোন ভুল করলেন না। বরং তাঁদের লেখার ভূল-ত্রুতি হয়েছিল, তারা তা সংশোধন করে নিল। বিস্ময়ে তারাও হতবাক হয়ে গেল। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারী (রঃ) এর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।<br /><br />১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন।<br /><br />জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ দঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।<br /><br />হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ<br />—————————————————————-<br />হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।<br /><br />ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ<br />—————————————————————–<br />ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বুখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন।<br /><br />একাধারে তিনি অনন্য ধীশক্তি, তত্ত্ব অনুধাবনশক্তি, ইজতেহাদ-ক্ষমতা, বর্ণনাশক্তি, উপকারিতা, প্রচ- খোদাভীতি, যুহ্দ, তাকওয়া, বিশ্লেষণশক্তি, উন্নত মানসিকতা, তীক্ষè দৃষ্টি, নানান পা-িত্য, কারামাত ও অলৌকতার অধিকারী ছিলেন। ইমাম ফারবরী রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন- আমি “সহীহ বুখারী” তে এমন একটি হাদীসও লিখিনি যা লিপিবদ্ধ করার পূর্বে আমি গোসল করিনি ও দুই রাকাআত নামায আদায় করিনি।<br /><br />ইমাম ইসমাঈলী রহ.বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী বহ.বলেছেন- আমি এই কিতাবে যে সকল হাদীস উল্লেখ করেছি তার সবগুলোই সহীহ। কিন্তু আমি যে পরিমাণ সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছি তার থেকে অধিক পরিমাণ সহীহ হাদীস লিখতে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এতে উল্লেখ করিনি।<br /><br />হাকেম আবূ আব্দুল্লাহ তার সরচিত গ্রন্থ “তারীখে নিসাপুর”-এ আহমদ ইবনে হামদূন থেকে সনদসহ বর্ণনা করে বলেন- একদা মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ রহ. বুখারী রহ. এর নিকট আসলেন এবং তিনি স্বীয় উস্তাদের দু’চোখের মাঝে চুমু খেলেন। আর বললেন- হে উস্তাদগণের উস্তাদ! হে মুহাদ্দিসীনে কেরামের সরদার! হে অসুস্থ হাদীসসমূহের চিকিৎসক! আপনি আমাকে সুযোগ দিন, আমি আপনার পদদয় চুম্বন করি।<br /><br />সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ<br />——————————————————<br />ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও দঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম দঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন। তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতেও এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন।<br /><br />তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীর মুবারকে মাছি বসছে। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানায়োট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়।<br /><br />সহীহ বুখারী সংকলনে সতর্কতা:<br />——————————————————–<br />কিতাবটি রচনার জন্য তিনি মদীনা মুনাওয়ারাকে নির্বাচন করলেন। মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লেখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন রাত পরিশ্রম করেন। সুক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দুই রাকআত নামায পড়েছেন, ইস্তেখারা করেছেন এবং সরাসরি রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে হাদিসটির সত্যতা যাচাই করে নিতেন।<br />তাই তাঁর অন্তরে যদি হাদীছটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীছটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না, যতক্ষননা নবিজীর ইশারা আসত। এরূপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের তুলনায় সারা মুসলিম জাহানে বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে।<br /><br />সমকালীন মুহাদ্দিছ ও হাদীছ বিশেষজ্ঞ পন্ডিতমন্ডলী এই মহাগ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিচার-বিবেচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন। সমগ্র উম্মত সর্বসম্মতভাবে এই গ্রন্থটিকে আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও নির্ভুল বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বুখারী শরীফে সর্বমোট সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস সংকলিত হয়েছে।<br /><br />মু’আল্লাক ও মুতাবা’আত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌছায় নয় হাজার বিরাশিতে। বুখারী শরীফ সংকলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর মুসলিম মনীষীগণ যেভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছেন আল্লাহ্র কালাম কুরআন মজীদ ছাড়া আর কোন গ্রন্থের প্রতি এরূপ ঝুঁকে পড়েন নি।<br /><br />একমাত্র ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে নব্বই হাজারেরও অধিক সংখ্যক লোক এ গ্রন্থের হাদীস শ্রবণ করেছে। তারপর প্রত্যেক যুগেই অসংখ্য হাদীস শিক্ষার্থী এ অধ্যয়ন করে আসছে। এ গ্রন্থের ভাষ্য পুস্তকের সংখ্যাও অগণিত। এ সব এর মধ্যে হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র) (জ. ৭৬২ হি. মৃ. ৮৫৫ হি. )-এর ফাতহুল বারী, ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (র.) এর ‘উমদাতুল-কারী ও আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ কাসতালানী (রঃ) (জ. ৮৫১ হি. মৃ. ৯২৩ হি. )-এর ‘ইরশাদুস-সারী’ সমধিক প্রসিদ্ধ। এঁরা তিনজনই মিসরের অধিবাসী ছিলেন।<br />তাঁর এবাদত-বন্দেী ও পরহেজগারীতাঃ হাদীছ চর্চায় সদা ব্যস্ত থাকলেও এবাদত বন্দেগীতে তিনি মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না।<br /><br />তিনি প্রতি বছর রামাযান মাসের প্রতিদিনের বেলায় একবার কুরআন খতম করতেন। আবার তারাবীর নামাযের পর প্রতি রাত্রিতে একবার খতম করতেন। একবার নফল সালাত আদায় কালে তাঁকে এক বিচ্ছু ষোল সতেরো বার দংশন করে, কিন্তু তিনি যে সুরা পাঠ করছিলেন তা সমাপ্ত না করে সালাত শেষ করেন নি।<br /><br />ইমাম বুখারীর সততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আবূ হাফস (রঃ) একবার তাঁর কাছে বহু মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাঠান। এক ব্যাবসায়ী তা পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা দিয়ে খরিদ করতে চাইলে তিনি বললেনঃ তুমি আজ চলে যাও, আমি চিন্তা করে দেখি। পরের দিন সকালে আরেক দল ব্যাবসায়ী এসে দশ হাজার দিরহাম মুনাফা দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ গতরাতে আমি একদল ব্যাবসায়ীকে দিবার নিয়্যাত করে ফলেছি; কাজেই আমি আমার নিয়্যাতের খেলাফ করতে চাই না। পরে তিনি তা পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার দিরহামের মুনাফায় দিয়ে দিলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমি জীবনে কোন দিন কারো গীবত শিকায়াত করিনি।<br /><br />ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও কঠিন পরীক্ষাঃ<br />———————————————————————<br />ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয়নি। বুখারার তৎকালীন আমীরের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমীর স্বীয় সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য ইমামের কাছে প্রস্তাব করলো। আমীর আরও প্রস্তাব করলো যে, তার সন্তানদের পড়ানোর জন্য ইমাম বুখারীকে রাজ দরবারে আসতে হবে।<br />কারণ সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে বসে আমীরের ছেলেদের পক্ষে সহীহ বুখারী পড়া সম্ভব নয়। ইমাম বুখারী তাঁর মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেঢ়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমীরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোতে ইলমে হাদীছের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে, আমি কখনও হাদীছের ইলমকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারবো না এবং এই মহান রত্মকে আমীর-উমারাদের দারস্থ করতে পারবো না।<br />আমীর যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীছের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তাঁর সন্তানদেরসহ আমার বাড়িতে ও মসজিদে উপস্থিত হন। এতে আমীর ইমামের প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য দুনিয়া পূজারী কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমীরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান।<br /><div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEirK0g_Q2apGr3DdsbZVLIrfpp6PpYPS2Rf4YIGEwX_g_nNH3fKuuRltAch0cEam9b7Kg6tZ-aSDOX70IxPOv0jrDDGJFsS1LswpySEUJGriVLogeDTSeKhgywCVARPb6TtcYVuotYKnPkW/s1600/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="300" data-original-width="630" height="152" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEirK0g_Q2apGr3DdsbZVLIrfpp6PpYPS2Rf4YIGEwX_g_nNH3fKuuRltAch0cEam9b7Kg6tZ-aSDOX70IxPOv0jrDDGJFsS1LswpySEUJGriVLogeDTSeKhgywCVARPb6TtcYVuotYKnPkW/s320-rw/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" width="320" /></a></div><br />ইমাম বুখারীর ইন্তিকাল:<br />————————————–<br />ইমাম বুখারী শেষ বয়সে অনুরূপ ফিতনা ও অবাঞ্চিত ঘটনাবলীতে পার্থিব জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। একদা তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের আল্লাহর নিকট এ বলে আবেদন জানান যে, “হে আল্লাহ্! এ সুবিশাল পৃথিবী আমার জন্য একান্তই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অতএব আপনি আমাকে আপনার নিকট তুলে নিন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইলমে হাদীছের এই খাদেম দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।<br /><br />ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওআল জুমু’আর দিন সালাতের কিছু পরে বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল শনিবার ঈদের রাতে ইশার সালাতের সময় সমরকন্দের নিকট খারতাংগ পল্লীতে ইনতিকাল করেন। ঈদের দিন যোহরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। তার বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম বাষট্টি বছর।<br /><br />খারতাংগ পল্লীতেই তাঁকে দাফন করা হয়।দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনভাবে তা নিবৃত করতে না পেরে শিশা ঢালাই করে দিয়ে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়।<br /><br />বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত:<br />———————————————-<br />আল্লাহ্র দরবারে বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত আলামত হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, আলেমগণ ও বুজুর্গানে দীন বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করে ফল লাভ করে আসছেন বলে। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (র) ‘তাদরিবুর রাবী নামক কিতাবে লিখেন: যে কোন বিপদে বুখারী পাঠ করা হলে ঐ বিপদ দূরীভুত হয় এবং কোন জাহাজে আরোহন করা গেলে তা কখনও ডুবে যায়না।( ‘তাদরিবুর রাবী-১/৯৬).<br /><br />ইমাম ইবনে কাছীর(র) বলেন: বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করলে বারী বর্ষিত হয়, এটা পরীক্ষিত।ইমাম সৈয়দ আছিল বলেন:“ বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে আমি নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য ১২০ (একশত বিশ) বার বুখারী শরীফ খতম করেছি, আর প্রতিবারই আমার উদ্দেশ্য পূরন হয়েছে।”( মিরকাত-১/৩০)<br /><br /></div>

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ ############################################# সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী —————————————————————– সহকারী ...

Read more »

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on"> ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ<br /> #############################################<br /> সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br /> —————————————————————–<br /> সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br /> খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। #<br /> بسم الله الرحمن الرحيم<br /> কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী।<br /> <br /> নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ<br /> ——————————————————————————<br /> তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় (বর্তমানে উজবেকিস্তান) জন্ম গ্রহণ করেন।<br /> <br /> তাঁর পিতা ইসমা’ঈল (রঃ) একজন মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ ব্যাক্তি ছিলেন। ইমাম মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রঃ) প্রমূখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনো হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেননি। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তার আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।<br /> <br /> শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ<br /> ——————————————————————————<br /> শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন।<br /> <br /> শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন।<br /> <br /> অন্ধত্ব থেকে মুক্তি:<br /> ———————————————————————–<br /> তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাহিসসালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।<br /> <br /> তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে। এরপর তিনি চাঁদের আলোতে লিখতে-পড়তে পারতেন। উল্লেখ্য, মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতেই তিনি ‘তারীখে কবীর’ নামক বৃহৎ কিতাবটি লিখেন।<br /> <br /> ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ<br /> —————————————————————————<br /> তিনি বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন,যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন।<br /> <br /> মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করে ফেলেন এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বুখারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম দাখিলী (রঃ)-এর হাদিস শিক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।<br /> সে যুগের নিয়মানুসারে তার সহপাঠীরা খাতা কলম নিয়ে উস্তাদ থেকে শ্রুত হাদীস লিখে নিতেন, কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) খাতা কলম কিছুই সঙ্গে নিতেন না। তিনি মনোযোগের সাথে উস্তাদের বর্ণিত হাদীস শুনতেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বয়সে সকলের থেকে ছোট ছিলেন। সহপাঠীরা তাঁকে এই বলে ভৎসনা করত যে, খাতা কলম ছাড়া তুমি অনর্থক কেন এসে বস? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেনঃ তোমাদের লিখিত খাতা নিয়ে এস। এতদিন তোমরা যা লিখেছ তা আমি মুখস্থ শুনিয়ে দেই। কথামতো তারা খাতা নিয়ে বসল আর এত দিন শ্রুত কয়েক হাজার হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ) হুবহু ধারাবাহিক শুনিয়ে দিলেন। কথাও কোন ভুল করলেন না। বরং তাঁদের লেখার ভূল-ত্রুতি হয়েছিল, তারা তা সংশোধন করে নিল। বিস্ময়ে তারাও হতবাক হয়ে গেল। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারী (রঃ) এর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।<br /> <br /> ১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন।<br /> <br /> জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ দঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।<br /> <br /> হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ<br /> —————————————————————-<br /> হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।<br /> <br /> ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ<br /> —————————————————————–<br /> ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বুখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন।<br /> <br /> একাধারে তিনি অনন্য ধীশক্তি, তত্ত্ব অনুধাবনশক্তি, ইজতেহাদ-ক্ষমতা, বর্ণনাশক্তি, উপকারিতা, প্রচ- খোদাভীতি, যুহ্দ, তাকওয়া, বিশ্লেষণশক্তি, উন্নত মানসিকতা, তীক্ষè দৃষ্টি, নানান পা-িত্য, কারামাত ও অলৌকতার অধিকারী ছিলেন। ইমাম ফারবরী রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন- আমি “সহীহ বুখারী” তে এমন একটি হাদীসও লিখিনি যা লিপিবদ্ধ করার পূর্বে আমি গোসল করিনি ও দুই রাকাআত নামায আদায় করিনি।<br /> <br /> ইমাম ইসমাঈলী রহ.বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী বহ.বলেছেন- আমি এই কিতাবে যে সকল হাদীস উল্লেখ করেছি তার সবগুলোই সহীহ। কিন্তু আমি যে পরিমাণ সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছি তার থেকে অধিক পরিমাণ সহীহ হাদীস লিখতে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এতে উল্লেখ করিনি।<br /> <br /> হাকেম আবূ আব্দুল্লাহ তার সরচিত গ্রন্থ “তারীখে নিসাপুর”-এ আহমদ ইবনে হামদূন থেকে সনদসহ বর্ণনা করে বলেন- একদা মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ রহ. বুখারী রহ. এর নিকট আসলেন এবং তিনি স্বীয় উস্তাদের দু’চোখের মাঝে চুমু খেলেন। আর বললেন- হে উস্তাদগণের উস্তাদ! হে মুহাদ্দিসীনে কেরামের সরদার! হে অসুস্থ হাদীসসমূহের চিকিৎসক! আপনি আমাকে সুযোগ দিন, আমি আপনার পদদয় চুম্বন করি।<br /> <br /> সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ<br /> ——————————————————<br /> ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও দঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম দঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন। তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতেও এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন।<br /> <br /> তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীর মুবারকে মাছি বসছে। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানায়োট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়।<br /> <br /> সহীহ বুখারী সংকলনে সতর্কতা:<br /> ——————————————————–<br /> কিতাবটি রচনার জন্য তিনি মদীনা মুনাওয়ারাকে নির্বাচন করলেন। মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লেখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন রাত পরিশ্রম করেন। সুক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দুই রাকআত নামায পড়েছেন, ইস্তেখারা করেছেন এবং সরাসরি রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে হাদিসটির সত্যতা যাচাই করে নিতেন।<br /> তাই তাঁর অন্তরে যদি হাদীছটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীছটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না, যতক্ষননা নবিজীর ইশারা আসত। এরূপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের তুলনায় সারা মুসলিম জাহানে বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে।<br /> <br /> সমকালীন মুহাদ্দিছ ও হাদীছ বিশেষজ্ঞ পন্ডিতমন্ডলী এই মহাগ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিচার-বিবেচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন। সমগ্র উম্মত সর্বসম্মতভাবে এই গ্রন্থটিকে আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও নির্ভুল বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বুখারী শরীফে সর্বমোট সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস সংকলিত হয়েছে।<br /> <br /> মু’আল্লাক ও মুতাবা’আত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌছায় নয় হাজার বিরাশিতে। বুখারী শরীফ সংকলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর মুসলিম মনীষীগণ যেভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছেন আল্লাহ্র কালাম কুরআন মজীদ ছাড়া আর কোন গ্রন্থের প্রতি এরূপ ঝুঁকে পড়েন নি।<br /> <br /> একমাত্র ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে নব্বই হাজারেরও অধিক সংখ্যক লোক এ গ্রন্থের হাদীস শ্রবণ করেছে। তারপর প্রত্যেক যুগেই অসংখ্য হাদীস শিক্ষার্থী এ অধ্যয়ন করে আসছে। এ গ্রন্থের ভাষ্য পুস্তকের সংখ্যাও অগণিত। এ সব এর মধ্যে হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র) (জ. ৭৬২ হি. মৃ. ৮৫৫ হি. )-এর ফাতহুল বারী, ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (র.) এর ‘উমদাতুল-কারী ও আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ কাসতালানী (রঃ) (জ. ৮৫১ হি. মৃ. ৯২৩ হি. )-এর ‘ইরশাদুস-সারী’ সমধিক প্রসিদ্ধ। এঁরা তিনজনই মিসরের অধিবাসী ছিলেন।<br /> তাঁর এবাদত-বন্দেী ও পরহেজগারীতাঃ হাদীছ চর্চায় সদা ব্যস্ত থাকলেও এবাদত বন্দেগীতে তিনি মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না।<br /> <br /> তিনি প্রতি বছর রামাযান মাসের প্রতিদিনের বেলায় একবার কুরআন খতম করতেন। আবার তারাবীর নামাযের পর প্রতি রাত্রিতে একবার খতম করতেন। একবার নফল সালাত আদায় কালে তাঁকে এক বিচ্ছু ষোল সতেরো বার দংশন করে, কিন্তু তিনি যে সুরা পাঠ করছিলেন তা সমাপ্ত না করে সালাত শেষ করেন নি।<br /> <br /> ইমাম বুখারীর সততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আবূ হাফস (রঃ) একবার তাঁর কাছে বহু মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাঠান। এক ব্যাবসায়ী তা পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা দিয়ে খরিদ করতে চাইলে তিনি বললেনঃ তুমি আজ চলে যাও, আমি চিন্তা করে দেখি। পরের দিন সকালে আরেক দল ব্যাবসায়ী এসে দশ হাজার দিরহাম মুনাফা দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ গতরাতে আমি একদল ব্যাবসায়ীকে দিবার নিয়্যাত করে ফলেছি; কাজেই আমি আমার নিয়্যাতের খেলাফ করতে চাই না। পরে তিনি তা পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার দিরহামের মুনাফায় দিয়ে দিলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমি জীবনে কোন দিন কারো গীবত শিকায়াত করিনি।<br /> <br /> ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও কঠিন পরীক্ষাঃ<br /> ———————————————————————<br /> ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয়নি। বুখারার তৎকালীন আমীরের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমীর স্বীয় সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য ইমামের কাছে প্রস্তাব করলো। আমীর আরও প্রস্তাব করলো যে, তার সন্তানদের পড়ানোর জন্য ইমাম বুখারীকে রাজ দরবারে আসতে হবে।<br /> কারণ সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে বসে আমীরের ছেলেদের পক্ষে সহীহ বুখারী পড়া সম্ভব নয়। ইমাম বুখারী তাঁর মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেঢ়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমীরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোতে ইলমে হাদীছের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে, আমি কখনও হাদীছের ইলমকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারবো না এবং এই মহান রত্মকে আমীর-উমারাদের দারস্থ করতে পারবো না।<br /> আমীর যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীছের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তাঁর সন্তানদেরসহ আমার বাড়িতে ও মসজিদে উপস্থিত হন। এতে আমীর ইমামের প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য দুনিয়া পূজারী কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমীরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান।<br /> <div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"> <a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhzJ_i2DQgLOdzoUM6xJZjP68kDiy7Mxbam89R8MKXwpO-X4qcJIEfJvMVsV2R50wVrsoQzNyAJ_b9qwxkEFHNjVevQQWkC2RfWS5y_VNooc5HMBdmQ1VWAL6hmqlMfm7EaKxi2Tp_-0Cag/s1600/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="300" data-original-width="630" height="152" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhzJ_i2DQgLOdzoUM6xJZjP68kDiy7Mxbam89R8MKXwpO-X4qcJIEfJvMVsV2R50wVrsoQzNyAJ_b9qwxkEFHNjVevQQWkC2RfWS5y_VNooc5HMBdmQ1VWAL6hmqlMfm7EaKxi2Tp_-0Cag/s320-rw/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" width="320" /></a></div> <br /> ইমাম বুখারীর ইন্তিকাল:<br /> ————————————–<br /> ইমাম বুখারী শেষ বয়সে অনুরূপ ফিতনা ও অবাঞ্চিত ঘটনাবলীতে পার্থিব জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। একদা তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের আল্লাহর নিকট এ বলে আবেদন জানান যে, “হে আল্লাহ্! এ সুবিশাল পৃথিবী আমার জন্য একান্তই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অতএব আপনি আমাকে আপনার নিকট তুলে নিন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইলমে হাদীছের এই খাদেম দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।<br /> <br /> ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওআল জুমু’আর দিন সালাতের কিছু পরে বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল শনিবার ঈদের রাতে ইশার সালাতের সময় সমরকন্দের নিকট খারতাংগ পল্লীতে ইনতিকাল করেন। ঈদের দিন যোহরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। তার বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম বাষট্টি বছর।<br /> <br /> খারতাংগ পল্লীতেই তাঁকে দাফন করা হয়।দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনভাবে তা নিবৃত করতে না পেরে শিশা ঢালাই করে দিয়ে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়।<br /> <br /> বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত:<br /> ———————————————-<br /> আল্লাহ্র দরবারে বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত আলামত হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, আলেমগণ ও বুজুর্গানে দীন বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করে ফল লাভ করে আসছেন বলে। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (র) ‘তাদরিবুর রাবী নামক কিতাবে লিখেন: যে কোন বিপদে বুখারী পাঠ করা হলে ঐ বিপদ দূরীভুত হয় এবং কোন জাহাজে আরোহন করা গেলে তা কখনও ডুবে যায়না।( ‘তাদরিবুর রাবী-১/৯৬).<br /> <br /> ইমাম ইবনে কাছীর(র) বলেন: বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করলে বারী বর্ষিত হয়, এটা পরীক্ষিত।ইমাম সৈয়দ আছিল বলেন:“ বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে আমি নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য ১২০ (একশত বিশ) বার বুখারী শরীফ খতম করেছি, আর প্রতিবারই আমার উদ্দেশ্য পূরন হয়েছে।”( মিরকাত-১/৩০)<br /> <br /></div>

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ ############################################# সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী —————————————————————– সহ...

Read more »

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on"><br />ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ<br /><br />#############################################<br /><br />সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br /><br />—————————————————————–<br /><br />সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br /><br />খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। #<br /><br />بسم الله الرحمن الرحيم<br /><br />কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী।<br /><br /><br /><br />নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ<br /><br />——————————————————————————<br /><br />তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় (বর্তমানে উজবেকিস্তান) জন্ম গ্রহণ করেন।<br /><br /><br /><br />তাঁর পিতা ইসমা’ঈল (রঃ) একজন মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ ব্যাক্তি ছিলেন। ইমাম মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রঃ) প্রমূখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনো হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেননি। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তার আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।<br /><br /><br /><br />শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ<br /><br />——————————————————————————<br /><br />শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন।<br /><br /><br /><br />শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন।<br /><br /><br /><br />অন্ধত্ব থেকে মুক্তি:<br /><br />———————————————————————–<br /><br />তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাহিসসালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।<br /><br /><br /><br />তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে। এরপর তিনি চাঁদের আলোতে লিখতে-পড়তে পারতেন। উল্লেখ্য, মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতেই তিনি ‘তারীখে কবীর’ নামক বৃহৎ কিতাবটি লিখেন।<br /><br /><br /><br />ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ<br /><br />—————————————————————————<br /><br />তিনি বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন,যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন।<br /><br /><br /><br />মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করে ফেলেন এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বুখারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম দাখিলী (রঃ)-এর হাদিস শিক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।<br /><br />সে যুগের নিয়মানুসারে তার সহপাঠীরা খাতা কলম নিয়ে উস্তাদ থেকে শ্রুত হাদীস লিখে নিতেন, কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) খাতা কলম কিছুই সঙ্গে নিতেন না। তিনি মনোযোগের সাথে উস্তাদের বর্ণিত হাদীস শুনতেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বয়সে সকলের থেকে ছোট ছিলেন। সহপাঠীরা তাঁকে এই বলে ভৎসনা করত যে, খাতা কলম ছাড়া তুমি অনর্থক কেন এসে বস? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেনঃ তোমাদের লিখিত খাতা নিয়ে এস। এতদিন তোমরা যা লিখেছ তা আমি মুখস্থ শুনিয়ে দেই। কথামতো তারা খাতা নিয়ে বসল আর এত দিন শ্রুত কয়েক হাজার হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ) হুবহু ধারাবাহিক শুনিয়ে দিলেন। কথাও কোন ভুল করলেন না। বরং তাঁদের লেখার ভূল-ত্রুতি হয়েছিল, তারা তা সংশোধন করে নিল। বিস্ময়ে তারাও হতবাক হয়ে গেল। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারী (রঃ) এর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।<br /><br /><br /><br />১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন।<br /><br /><br /><br />জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ দঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।<br /><br /><br /><br />হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ<br /><br />—————————————————————-<br /><br />হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।<br /><br /><br /><br />ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ<br /><br />—————————————————————–<br /><br />ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বুখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন।<br /><br /><br /><br />একাধারে তিনি অনন্য ধীশক্তি, তত্ত্ব অনুধাবনশক্তি, ইজতেহাদ-ক্ষমতা, বর্ণনাশক্তি, উপকারিতা, প্রচ- খোদাভীতি, যুহ্দ, তাকওয়া, বিশ্লেষণশক্তি, উন্নত মানসিকতা, তীক্ষè দৃষ্টি, নানান পা-িত্য, কারামাত ও অলৌকতার অধিকারী ছিলেন। ইমাম ফারবরী রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন- আমি “সহীহ বুখারী” তে এমন একটি হাদীসও লিখিনি যা লিপিবদ্ধ করার পূর্বে আমি গোসল করিনি ও দুই রাকাআত নামায আদায় করিনি।<br /><br /><br /><br />ইমাম ইসমাঈলী রহ.বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী বহ.বলেছেন- আমি এই কিতাবে যে সকল হাদীস উল্লেখ করেছি তার সবগুলোই সহীহ। কিন্তু আমি যে পরিমাণ সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছি তার থেকে অধিক পরিমাণ সহীহ হাদীস লিখতে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এতে উল্লেখ করিনি।<br /><br /><br /><br />হাকেম আবূ আব্দুল্লাহ তার সরচিত গ্রন্থ “তারীখে নিসাপুর”-এ আহমদ ইবনে হামদূন থেকে সনদসহ বর্ণনা করে বলেন- একদা মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ রহ. বুখারী রহ. এর নিকট আসলেন এবং তিনি স্বীয় উস্তাদের দু’চোখের মাঝে চুমু খেলেন। আর বললেন- হে উস্তাদগণের উস্তাদ! হে মুহাদ্দিসীনে কেরামের সরদার! হে অসুস্থ হাদীসসমূহের চিকিৎসক! আপনি আমাকে সুযোগ দিন, আমি আপনার পদদয় চুম্বন করি।<br /><br /><br /><br />সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ<br /><br />——————————————————<br /><br />ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও দঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম দঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন। তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতেও এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন।<br /><br /><br /><br />তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীর মুবারকে মাছি বসছে। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানায়োট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়।<br /><br /><br /><br />সহীহ বুখারী সংকলনে সতর্কতা:<br /><br />——————————————————–<br /><br />কিতাবটি রচনার জন্য তিনি মদীনা মুনাওয়ারাকে নির্বাচন করলেন। মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লেখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন রাত পরিশ্রম করেন। সুক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দুই রাকআত নামায পড়েছেন, ইস্তেখারা করেছেন এবং সরাসরি রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে হাদিসটির সত্যতা যাচাই করে নিতেন।<br /><br />তাই তাঁর অন্তরে যদি হাদীছটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীছটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না, যতক্ষননা নবিজীর ইশারা আসত। এরূপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের তুলনায় সারা মুসলিম জাহানে বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে।<br /><br /><br /><br />সমকালীন মুহাদ্দিছ ও হাদীছ বিশেষজ্ঞ পন্ডিতমন্ডলী এই মহাগ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিচার-বিবেচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন। সমগ্র উম্মত সর্বসম্মতভাবে এই গ্রন্থটিকে আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও নির্ভুল বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বুখারী শরীফে সর্বমোট সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস সংকলিত হয়েছে।<br /><br /><br /><br />মু’আল্লাক ও মুতাবা’আত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌছায় নয় হাজার বিরাশিতে। বুখারী শরীফ সংকলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর মুসলিম মনীষীগণ যেভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছেন আল্লাহ্র কালাম কুরআন মজীদ ছাড়া আর কোন গ্রন্থের প্রতি এরূপ ঝুঁকে পড়েন নি।<br /><br /><br /><br />একমাত্র ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে নব্বই হাজারেরও অধিক সংখ্যক লোক এ গ্রন্থের হাদীস শ্রবণ করেছে। তারপর প্রত্যেক যুগেই অসংখ্য হাদীস শিক্ষার্থী এ অধ্যয়ন করে আসছে। এ গ্রন্থের ভাষ্য পুস্তকের সংখ্যাও অগণিত। এ সব এর মধ্যে হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র) (জ. ৭৬২ হি. মৃ. ৮৫৫ হি. )-এর ফাতহুল বারী, ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (র.) এর ‘উমদাতুল-কারী ও আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ কাসতালানী (রঃ) (জ. ৮৫১ হি. মৃ. ৯২৩ হি. )-এর ‘ইরশাদুস-সারী’ সমধিক প্রসিদ্ধ। এঁরা তিনজনই মিসরের অধিবাসী ছিলেন।<br /><br />তাঁর এবাদত-বন্দেী ও পরহেজগারীতাঃ হাদীছ চর্চায় সদা ব্যস্ত থাকলেও এবাদত বন্দেগীতে তিনি মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না।<br /><br /><br /><br />তিনি প্রতি বছর রামাযান মাসের প্রতিদিনের বেলায় একবার কুরআন খতম করতেন। আবার তারাবীর নামাযের পর প্রতি রাত্রিতে একবার খতম করতেন। একবার নফল সালাত আদায় কালে তাঁকে এক বিচ্ছু ষোল সতেরো বার দংশন করে, কিন্তু তিনি যে সুরা পাঠ করছিলেন তা সমাপ্ত না করে সালাত শেষ করেন নি।<br /><br /><br /><br />ইমাম বুখারীর সততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আবূ হাফস (রঃ) একবার তাঁর কাছে বহু মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাঠান। এক ব্যাবসায়ী তা পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা দিয়ে খরিদ করতে চাইলে তিনি বললেনঃ তুমি আজ চলে যাও, আমি চিন্তা করে দেখি। পরের দিন সকালে আরেক দল ব্যাবসায়ী এসে দশ হাজার দিরহাম মুনাফা দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ গতরাতে আমি একদল ব্যাবসায়ীকে দিবার নিয়্যাত করে ফলেছি; কাজেই আমি আমার নিয়্যাতের খেলাফ করতে চাই না। পরে তিনি তা পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার দিরহামের মুনাফায় দিয়ে দিলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমি জীবনে কোন দিন কারো গীবত শিকায়াত করিনি।<br /><br /><br /><br />ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও কঠিন পরীক্ষাঃ<br /><br />———————————————————————<br /><br />ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয়নি। বুখারার তৎকালীন আমীরের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমীর স্বীয় সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য ইমামের কাছে প্রস্তাব করলো। আমীর আরও প্রস্তাব করলো যে, তার সন্তানদের পড়ানোর জন্য ইমাম বুখারীকে রাজ দরবারে আসতে হবে।<br /><br />কারণ সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে বসে আমীরের ছেলেদের পক্ষে সহীহ বুখারী পড়া সম্ভব নয়। ইমাম বুখারী তাঁর মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেঢ়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমীরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোতে ইলমে হাদীছের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে, আমি কখনও হাদীছের ইলমকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারবো না এবং এই মহান রত্মকে আমীর-উমারাদের দারস্থ করতে পারবো না।<br /><br />আমীর যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীছের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তাঁর সন্তানদেরসহ আমার বাড়িতে ও মসজিদে উপস্থিত হন। এতে আমীর ইমামের প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য দুনিয়া পূজারী কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমীরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান।<br /><br /><div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"><br /><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiJeRPG-uAhlwXBRSANYrpU2UFXnkzHJ7VKrZzJtWNKF9Gm_lj2zkNp8rKXereeF9aqSWSjfn-xvq0dLvUv0o3kSUwh507oKLnVZW0Jf2iWsWmPydgKu_llm2A1rU63uDLFslUqeyp9SOCe/s1600/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="300" data-original-width="630" height="152" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiJeRPG-uAhlwXBRSANYrpU2UFXnkzHJ7VKrZzJtWNKF9Gm_lj2zkNp8rKXereeF9aqSWSjfn-xvq0dLvUv0o3kSUwh507oKLnVZW0Jf2iWsWmPydgKu_llm2A1rU63uDLFslUqeyp9SOCe/s320-rw/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" width="320" /></a></div><br /><br /><br />ইমাম বুখারীর ইন্তিকাল:<br /><br />————————————–<br /><br />ইমাম বুখারী শেষ বয়সে অনুরূপ ফিতনা ও অবাঞ্চিত ঘটনাবলীতে পার্থিব জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। একদা তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের আল্লাহর নিকট এ বলে আবেদন জানান যে, “হে আল্লাহ্! এ সুবিশাল পৃথিবী আমার জন্য একান্তই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অতএব আপনি আমাকে আপনার নিকট তুলে নিন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইলমে হাদীছের এই খাদেম দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।<br /><br /><br /><br />ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওআল জুমু’আর দিন সালাতের কিছু পরে বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল শনিবার ঈদের রাতে ইশার সালাতের সময় সমরকন্দের নিকট খারতাংগ পল্লীতে ইনতিকাল করেন। ঈদের দিন যোহরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। তার বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম বাষট্টি বছর।<br /><br /><br /><br />খারতাংগ পল্লীতেই তাঁকে দাফন করা হয়।দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনভাবে তা নিবৃত করতে না পেরে শিশা ঢালাই করে দিয়ে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়।<br /><br /><br /><br />বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত:<br /><br />———————————————-<br /><br />আল্লাহ্র দরবারে বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত আলামত হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, আলেমগণ ও বুজুর্গানে দীন বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করে ফল লাভ করে আসছেন বলে। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (র) ‘তাদরিবুর রাবী নামক কিতাবে লিখেন: যে কোন বিপদে বুখারী পাঠ করা হলে ঐ বিপদ দূরীভুত হয় এবং কোন জাহাজে আরোহন করা গেলে তা কখনও ডুবে যায়না।( ‘তাদরিবুর রাবী-১/৯৬).<br /><br /><br /><br />ইমাম ইবনে কাছীর(র) বলেন: বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করলে বারী বর্ষিত হয়, এটা পরীক্ষিত।ইমাম সৈয়দ আছিল বলেন:“ বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে আমি নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য ১২০ (একশত বিশ) বার বুখারী শরীফ খতম করেছি, আর প্রতিবারই আমার উদ্দেশ্য পূরন হয়েছে।”( মিরকাত-১/৩০)<br /><br /><br /></div><br />

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ ############################################# সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী —————————————————————– সহকারী ...

Read more »

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ<br />#############################################<br />সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br />—————————————————————–<br />সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br />খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। #<br />بسم الله الرحمن الرحيم<br />কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী।<br /><br />নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ<br />——————————————————————————<br />তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় (বর্তমানে উজবেকিস্তান) জন্ম গ্রহণ করেন।<br /><br />তাঁর পিতা ইসমা’ঈল (রঃ) একজন মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ ব্যাক্তি ছিলেন। ইমাম মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রঃ) প্রমূখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনো হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেননি। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তার আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।<br /><br />শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ<br />——————————————————————————<br />শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন।<br /><br />শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন।<br /><br />অন্ধত্ব থেকে মুক্তি:<br />———————————————————————–<br />তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাহিসসালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।<br /><br />তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে। এরপর তিনি চাঁদের আলোতে লিখতে-পড়তে পারতেন। উল্লেখ্য, মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতেই তিনি ‘তারীখে কবীর’ নামক বৃহৎ কিতাবটি লিখেন।<br /><br />ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ<br />—————————————————————————<br />তিনি বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন,যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন।<br /><br />মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করে ফেলেন এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বুখারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম দাখিলী (রঃ)-এর হাদিস শিক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।<br />সে যুগের নিয়মানুসারে তার সহপাঠীরা খাতা কলম নিয়ে উস্তাদ থেকে শ্রুত হাদীস লিখে নিতেন, কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) খাতা কলম কিছুই সঙ্গে নিতেন না। তিনি মনোযোগের সাথে উস্তাদের বর্ণিত হাদীস শুনতেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বয়সে সকলের থেকে ছোট ছিলেন। সহপাঠীরা তাঁকে এই বলে ভৎসনা করত যে, খাতা কলম ছাড়া তুমি অনর্থক কেন এসে বস? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেনঃ তোমাদের লিখিত খাতা নিয়ে এস। এতদিন তোমরা যা লিখেছ তা আমি মুখস্থ শুনিয়ে দেই। কথামতো তারা খাতা নিয়ে বসল আর এত দিন শ্রুত কয়েক হাজার হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ) হুবহু ধারাবাহিক শুনিয়ে দিলেন। কথাও কোন ভুল করলেন না। বরং তাঁদের লেখার ভূল-ত্রুতি হয়েছিল, তারা তা সংশোধন করে নিল। বিস্ময়ে তারাও হতবাক হয়ে গেল। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারী (রঃ) এর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।<br /><br />১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন।<br /><br />জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ দঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।<br /><br />হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ<br />—————————————————————-<br />হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।<br /><br />ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ<br />—————————————————————–<br />ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বুখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন।<br /><br />একাধারে তিনি অনন্য ধীশক্তি, তত্ত্ব অনুধাবনশক্তি, ইজতেহাদ-ক্ষমতা, বর্ণনাশক্তি, উপকারিতা, প্রচ- খোদাভীতি, যুহ্দ, তাকওয়া, বিশ্লেষণশক্তি, উন্নত মানসিকতা, তীক্ষè দৃষ্টি, নানান পা-িত্য, কারামাত ও অলৌকতার অধিকারী ছিলেন। ইমাম ফারবরী রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন- আমি “সহীহ বুখারী” তে এমন একটি হাদীসও লিখিনি যা লিপিবদ্ধ করার পূর্বে আমি গোসল করিনি ও দুই রাকাআত নামায আদায় করিনি।<br /><br />ইমাম ইসমাঈলী রহ.বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী বহ.বলেছেন- আমি এই কিতাবে যে সকল হাদীস উল্লেখ করেছি তার সবগুলোই সহীহ। কিন্তু আমি যে পরিমাণ সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছি তার থেকে অধিক পরিমাণ সহীহ হাদীস লিখতে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এতে উল্লেখ করিনি।<br /><br />হাকেম আবূ আব্দুল্লাহ তার সরচিত গ্রন্থ “তারীখে নিসাপুর”-এ আহমদ ইবনে হামদূন থেকে সনদসহ বর্ণনা করে বলেন- একদা মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ রহ. বুখারী রহ. এর নিকট আসলেন এবং তিনি স্বীয় উস্তাদের দু’চোখের মাঝে চুমু খেলেন। আর বললেন- হে উস্তাদগণের উস্তাদ! হে মুহাদ্দিসীনে কেরামের সরদার! হে অসুস্থ হাদীসসমূহের চিকিৎসক! আপনি আমাকে সুযোগ দিন, আমি আপনার পদদয় চুম্বন করি।<br /><br />সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ<br />——————————————————<br />ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও দঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম দঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন। তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতেও এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন।<br /><br />তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীর মুবারকে মাছি বসছে। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানায়োট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়।<br /><br />সহীহ বুখারী সংকলনে সতর্কতা:<br />——————————————————–<br />কিতাবটি রচনার জন্য তিনি মদীনা মুনাওয়ারাকে নির্বাচন করলেন। মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লেখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন রাত পরিশ্রম করেন। সুক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দুই রাকআত নামায পড়েছেন, ইস্তেখারা করেছেন এবং সরাসরি রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে হাদিসটির সত্যতা যাচাই করে নিতেন।<br />তাই তাঁর অন্তরে যদি হাদীছটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীছটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না, যতক্ষননা নবিজীর ইশারা আসত। এরূপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের তুলনায় সারা মুসলিম জাহানে বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে।<br /><br />সমকালীন মুহাদ্দিছ ও হাদীছ বিশেষজ্ঞ পন্ডিতমন্ডলী এই মহাগ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিচার-বিবেচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন। সমগ্র উম্মত সর্বসম্মতভাবে এই গ্রন্থটিকে আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও নির্ভুল বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বুখারী শরীফে সর্বমোট সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস সংকলিত হয়েছে।<br /><br />মু’আল্লাক ও মুতাবা’আত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌছায় নয় হাজার বিরাশিতে। বুখারী শরীফ সংকলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর মুসলিম মনীষীগণ যেভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছেন আল্লাহ্র কালাম কুরআন মজীদ ছাড়া আর কোন গ্রন্থের প্রতি এরূপ ঝুঁকে পড়েন নি।<br /><br />একমাত্র ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে নব্বই হাজারেরও অধিক সংখ্যক লোক এ গ্রন্থের হাদীস শ্রবণ করেছে। তারপর প্রত্যেক যুগেই অসংখ্য হাদীস শিক্ষার্থী এ অধ্যয়ন করে আসছে। এ গ্রন্থের ভাষ্য পুস্তকের সংখ্যাও অগণিত। এ সব এর মধ্যে হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র) (জ. ৭৬২ হি. মৃ. ৮৫৫ হি. )-এর ফাতহুল বারী, ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (র.) এর ‘উমদাতুল-কারী ও আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ কাসতালানী (রঃ) (জ. ৮৫১ হি. মৃ. ৯২৩ হি. )-এর ‘ইরশাদুস-সারী’ সমধিক প্রসিদ্ধ। এঁরা তিনজনই মিসরের অধিবাসী ছিলেন।<br />তাঁর এবাদত-বন্দেী ও পরহেজগারীতাঃ হাদীছ চর্চায় সদা ব্যস্ত থাকলেও এবাদত বন্দেগীতে তিনি মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না।<br /><br />তিনি প্রতি বছর রামাযান মাসের প্রতিদিনের বেলায় একবার কুরআন খতম করতেন। আবার তারাবীর নামাযের পর প্রতি রাত্রিতে একবার খতম করতেন। একবার নফল সালাত আদায় কালে তাঁকে এক বিচ্ছু ষোল সতেরো বার দংশন করে, কিন্তু তিনি যে সুরা পাঠ করছিলেন তা সমাপ্ত না করে সালাত শেষ করেন নি।<br /><br />ইমাম বুখারীর সততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আবূ হাফস (রঃ) একবার তাঁর কাছে বহু মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাঠান। এক ব্যাবসায়ী তা পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা দিয়ে খরিদ করতে চাইলে তিনি বললেনঃ তুমি আজ চলে যাও, আমি চিন্তা করে দেখি। পরের দিন সকালে আরেক দল ব্যাবসায়ী এসে দশ হাজার দিরহাম মুনাফা দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ গতরাতে আমি একদল ব্যাবসায়ীকে দিবার নিয়্যাত করে ফলেছি; কাজেই আমি আমার নিয়্যাতের খেলাফ করতে চাই না। পরে তিনি তা পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার দিরহামের মুনাফায় দিয়ে দিলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমি জীবনে কোন দিন কারো গীবত শিকায়াত করিনি।<br /><br />ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও কঠিন পরীক্ষাঃ<br />———————————————————————<br />ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয়নি। বুখারার তৎকালীন আমীরের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমীর স্বীয় সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য ইমামের কাছে প্রস্তাব করলো। আমীর আরও প্রস্তাব করলো যে, তার সন্তানদের পড়ানোর জন্য ইমাম বুখারীকে রাজ দরবারে আসতে হবে।<br />কারণ সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে বসে আমীরের ছেলেদের পক্ষে সহীহ বুখারী পড়া সম্ভব নয়। ইমাম বুখারী তাঁর মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেঢ়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমীরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোতে ইলমে হাদীছের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে, আমি কখনও হাদীছের ইলমকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারবো না এবং এই মহান রত্মকে আমীর-উমারাদের দারস্থ করতে পারবো না।<br />আমীর যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীছের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তাঁর সন্তানদেরসহ আমার বাড়িতে ও মসজিদে উপস্থিত হন। এতে আমীর ইমামের প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য দুনিয়া পূজারী কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমীরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান।<br /><div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiJeRPG-uAhlwXBRSANYrpU2UFXnkzHJ7VKrZzJtWNKF9Gm_lj2zkNp8rKXereeF9aqSWSjfn-xvq0dLvUv0o3kSUwh507oKLnVZW0Jf2iWsWmPydgKu_llm2A1rU63uDLFslUqeyp9SOCe/s1600/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="300" data-original-width="630" height="152" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiJeRPG-uAhlwXBRSANYrpU2UFXnkzHJ7VKrZzJtWNKF9Gm_lj2zkNp8rKXereeF9aqSWSjfn-xvq0dLvUv0o3kSUwh507oKLnVZW0Jf2iWsWmPydgKu_llm2A1rU63uDLFslUqeyp9SOCe/s320-rw/%25D8%25AA%25D9%2581%25D8%25B3%25D9%258A%25D8%25B1_%25D8%25B5%25D8%25AD%25D9%258A%25D8%25AD_%25D8%25A7%25D9%2584%25D8%25A8%25D8%25AE%25D8%25A7%25D8%25B1%25D9%258A+%25281%2529.jpg" width="320" /></a></div><br />ইমাম বুখারীর ইন্তিকাল:<br />————————————–<br />ইমাম বুখারী শেষ বয়সে অনুরূপ ফিতনা ও অবাঞ্চিত ঘটনাবলীতে পার্থিব জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। একদা তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের আল্লাহর নিকট এ বলে আবেদন জানান যে, “হে আল্লাহ্! এ সুবিশাল পৃথিবী আমার জন্য একান্তই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অতএব আপনি আমাকে আপনার নিকট তুলে নিন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইলমে হাদীছের এই খাদেম দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।<br /><br />ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওআল জুমু’আর দিন সালাতের কিছু পরে বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল শনিবার ঈদের রাতে ইশার সালাতের সময় সমরকন্দের নিকট খারতাংগ পল্লীতে ইনতিকাল করেন। ঈদের দিন যোহরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। তার বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম বাষট্টি বছর।<br /><br />খারতাংগ পল্লীতেই তাঁকে দাফন করা হয়।দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনভাবে তা নিবৃত করতে না পেরে শিশা ঢালাই করে দিয়ে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়।<br /><br />বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত:<br />———————————————-<br />আল্লাহ্র দরবারে বুখারী শরীফের মুকবুলিয়াত আলামত হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, আলেমগণ ও বুজুর্গানে দীন বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করে ফল লাভ করে আসছেন বলে। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (র) ‘তাদরিবুর রাবী নামক কিতাবে লিখেন: যে কোন বিপদে বুখারী পাঠ করা হলে ঐ বিপদ দূরীভুত হয় এবং কোন জাহাজে আরোহন করা গেলে তা কখনও ডুবে যায়না।( ‘তাদরিবুর রাবী-১/৯৬).<br /><br />ইমাম ইবনে কাছীর(র) বলেন: বুখারী শরীফ খতম করে দু’আ করলে বারী বর্ষিত হয়, এটা পরীক্ষিত।ইমাম সৈয়দ আছিল বলেন:“ বিভিন্ন সময়ে কঠিন সমস্যায় ও বিপদাপদে আমি নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য ১২০ (একশত বিশ) বার বুখারী শরীফ খতম করেছি, আর প্রতিবারই আমার উদ্দেশ্য পূরন হয়েছে।”( মিরকাত-১/৩০)<br /><br /></div>

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ

ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ ############################################# সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী —————————————————————– সহকারী ...

Read more »

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি<br />*******************************************<br />সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br />খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br />بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!<br /><br />অধঃপতনের যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পার্থিব লোভ-লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাদের ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র পদঙ্খলন ঘটাতে পারেনি; যারা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোনো দিন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন যারা পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যারা যালেম সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের অন্যতম।<br /><div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEihCmrsGIc3Ce7dzygGXPvmTBomzBPqk2wOjlQ-Nq2xOXPoMmPVJBrZKi4_aXTPN6zCn8jrkNpDnFJfMf4-3hcKEBqo5Ch-oJtkHyKluZM0yie1XaE5ns_P24pbJ58y-70O0sXM7LcQzh-Y/s1600/al_imam_abu_hanifa_al_noman_tomb_by_mq5-d5y4gzx-750x350.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="350" data-original-width="750" height="149" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEihCmrsGIc3Ce7dzygGXPvmTBomzBPqk2wOjlQ-Nq2xOXPoMmPVJBrZKi4_aXTPN6zCn8jrkNpDnFJfMf4-3hcKEBqo5Ch-oJtkHyKluZM0yie1XaE5ns_P24pbJ58y-70O0sXM7LcQzh-Y/s320-rw/al_imam_abu_hanifa_al_noman_tomb_by_mq5-d5y4gzx-750x350.jpg" width="320" /></a></div><br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্ম ও শিক্ষা:<br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৮০ হিজরি মোতাবেক ৭০২ খ্রিষ্টাব্দে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হলো নু’মান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। তাঁর বাল্যকালের ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তিনি ইমাম আযম নামেও সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুশগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধিশালী নগর কুফায় এসে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।<br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৪-১৫ বছর বয়সে একদিন যখন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তৎকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছ? উত্তরে তিনি অতি দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।’ ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আমি যেন তোমার মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। ভালো আলেমের নিকট তোমার লেখাপড়া শেখা উচিত।’<br /><br />ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উপদেশ ও অনুপ্রেরণায় ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম হামদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আতা ইবনে রবিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম জাফর সাদিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞান লাভের জন্য তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা এবং কুফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত আলেমগণের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন।<br /><br />বিভিন্ন স্থান থেকে হাদিসের অমূল্য রত্ন সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণীগুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু যাহরা)<br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাবেয়ী:<br /><br />কারো কারো মতে, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবি জীবিত ছিলেন। ১০২ হিজরিতে তিনি যখন মদিনা গমন করেন তখন মদিনায় দুজন সাহাবি হযরত সোলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের দর্শন লাভ করেন। তবে তাবেতাবেয়ী হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই।<br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শিক্ষকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁদের মাত্র একটি মধ্যস্থতা অবলম্বন করতে হতো। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিসসমূহ সম্পূর্ণ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ। ইমাম আবু হানীফা অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন- ১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৩ হিজরী) ২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৭ হিজরী) ৩) সহল ইবনে সাআদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৮ হিজরী) ৪) আবু তোফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১০ হিজরী) ৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৯ হিজরী) ৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৪ হিজরী) ৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৫ হিজরী) হাদিস শাস্ত্রের<br /><br />‘আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান (আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।<br /><br />শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ<br /><br />ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন।<br /><br />একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফার দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফার নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।<br /><br />মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধিক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞা ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।<br /><br />প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি:) চারবছর নয় মাস কাল ইমাম আবু হানীফা মক্কা শরীফে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানীফার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসিয়দের শাসন-ব্যবস্থা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখগণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ করে ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগনের সে আকাঙ্খা নস্যাত করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্থান মোটেও নিরাপদ ছিল না।<br /><br />শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকালে (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কাশরীফেই অবস্থান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেয যাহাবীর বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে যোগ দিতেন, অনুরূপ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।<br /><br />তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পা-িত্য:<br /><br />তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পা-িত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহশাস্ত্রেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামি আইনগুলোকে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফি মাযহাবের অনুসারী। ফিকাহশাস্ত্রে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম যুফার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম।<br /><br />ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতিঃ<br /><br />যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করতেন। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)<br /><br />ইবনে হাযম বলেন, আবু হানীফার সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হতো। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীর বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)<br /><br />শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী হারামাইন শরীফাইনে অবস্থানকালে কাশফযোগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অবগত করেছেন যে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)<br /><br />ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল কারাগারে বসেই ১২ লাখ ৯০ হাজারের অধিক মাসআলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।<br /><br />ইমাম সাহেবর তীক্ষ বুদ্ধি, ধী-শক্তি ও গভীর জ্ঞান:<br /><br />ইমাম সাহেব যেমন তীক্ষ বুদ্ধি অধিকারী ও ধী- শক্তি সম্পন্ন ছিলেন তেমনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা তা অনুমান করা সম্ভব হবে: ‘একদিন ইমাম আবু হানীফা কিরাত ও হাদীস বর্ননায় প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় কোন একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মতামত জিজ্ঞেস করা হল। জবাবে তিনি তার মতাতমত জানালেন। হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জিজ্ঞেস করলেন- এ দলীল তুমি কোথায় পেয়েছ? জবাবে ইমাম সাহেব বললেন, আপনিই তো আমাদেরকে এ হাদীস শুনিয়েছেন,।<br />এভাবে ইমাম সাহেব তারই বর্নণাকৃত আরও চারটি হাদীস শুনালেন। ইমাম আমাশ বললেন- যথেষ্ট হয়েছে, আর শুনাতে হবে না। আমি তোমাকে একশত দিনে যা শুনিয়েছি তুমি এক ঘন্টায় তা শুনিয়ে দিলে। আমার ধারনাও ছিল না যে তুমি এ হাদীসগুলোর উপর আমাল করে থাক। “সত্যিই তোমরা ফকীহরা হলে ডাক্তারতুল্য, আর আমরা হলাম ঔষধের দোকানদার।“ আর তুমি তো উভয় দিকই হাসীল করেছ (আল জাওয়াহের আল মুদিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৮৪)।<br /><br />‘ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর শাগরিদদেরকে যারা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হাফিযে হাদীস ফাযল ইবনি মূসা আস সিনানীকে জিজ্ঞাসা করা হল- ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে যারা অপবাদ গেয়ে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি বললেন- আসল ব্যাপার হল ইামাম আবু হানীফা তাদের সামনে এমন তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করেছেন যার সবটা তারা বুঝতে সক্ষম হয়নি। আর তিনি তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তারা ইমাম সাহেবের সাথে হিংসা আরম্ভ করেছেন’। ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন-‘হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন’।<br /><br />ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের সংগৃহীত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন- ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জনৈক উ¯তাদ ইয়াহইয়া ইবনি আদাম তাঁর সহীহ গ্রন্থে বলেন- ‘ইমাম আবু হানীফা নিজ শহরের সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন এবং তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জীবনের হাদীসগুলোর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল (অর্থাৎ বিভিন্নমুখী হাদীসগুলোর মধ্যে সর্বশেষ হাদীস কোনটি ছিল)। যার দ্বারা অন্যান্যগুলো রহিত সাব্য¯ত করা সহজ হয়।<br />মোটকথা ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের হাসিলকৃত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। এখানেই তিনি ক্ষন্ত হননি বরং তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা- মাদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল উলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফকীহদের কেন্দ্রস্থল ছিল, কাজেই এক কথায় বলা চলে যে- মক্কা- মাদীনা ছিল ইলমের মারকায। আর তার মত অসাধারণ ধী- শক্তি সম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর যাবত মক্কা- মাদীনার ইলম হাসিল করা নি:সন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়।<br /><br />এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হাজ্বব্রত পালন করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় (উকূদুল জামান, পৃ- ২২০)। প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা- মাদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন বলে বিভিন্ন লেখক মšতব্য করেছেন (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩, খইরতুল হিসান, পৃ- ২৩।) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনি ইউসূফ আস সালেহী ‘উকূদুল জামান গ্রন্থে দীর্ঘ ২৪ পৃষ্ঠায় ইমাম সাহেবের মাশায়েখদের একটা ফিরি¯ত পেশ করেছেন, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩- ৮৭)।<br /><br />আল্লামা আলী আল কারী, মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ’র বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের উর্দ্ধে হাদীস বর্ননা করেছেন। আর ‘আল আছার’ গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন’ (আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৭৩)। ইয়াহইয়া ইবনি নাসর বলেন- ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানীফার ঘরে প্রবেশ করি যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন- এগুলো সব হাদীসের কিতাব, এর মধ্যে সামান্য কিছুই আমি বর্ননা করেছি যেগুলো ফলপ্রদ’ (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদু জাওয়াহিরিল মুনীফাহ, ১, ৩১)।<br /><br />ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যদিও অন্যান্য মুহাদ্দীসদের মত হাদীস শিক্ষা দেয়ার জন্য কোন মাজলীস ছিল না, যেমন ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি করেছেন (মুআত্তা মালিক)। কিন্তু তাঁর শাগরিদগণ তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন কিতাব ও মুসনাদ সংকলন করেছেন যার সংখ্যা দশের উর্দ্ধে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হল- ইমাম আবু ইউসুফ রচিত ‘কিতাবুল আসার’, ইমাম মুহাম্মাদ রচিত ‘কিতাবুল আসার আল মারফুআহ’ ও ‘আল আসারুল মারফুআহ ওয়াল মাওকুফাহ’, মুসনাদুল হাসান ইবনি যিয়াদ আল লু-লুঈ, মুসনাদে হাম্মাদ ইবনি আবু হানীফা ইত্যাদি।<br /><br />ইমাম বোখারীর অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃতু- ২১৫ হিঃ) যাঁর সনদে ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অধিকাংশ ‘সুলাসিয়্যাত হাদীস’ বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফার ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন” (মানাক্বেবে ইমাম আযম রহ. ১/৯৫)<br /><br />আবার হাফিয মযযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “তিনি তাঁর কালের সবচেয়ে বড় আলিম ছিলেন” (তাহ্যীবুত তাহযীব-এর টিকা- ১০ম খন্ড, ৪৫২পৃ.) ইমাম আবু দাউদ বলেন, নিঃসন্দেহে আবু হানীফা ছিলেন একজন শেষ্ঠ ইমাম। (তাহজীব ১/৪৪৫) জরহ ও তাদিলের (সনদ পর্যালোচনা শাস্ত্র) অন্যতম ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন (মৃতু- ২৩৩হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি”- (তাহবীবুত্তাহজীব ৫/৬৩০) আলী ইবনে মাদানী (মৃতু- ২৩৪ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা হাদীস শাস্ত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন দোষক্রুটি ছিল না। (জামঈ বয়ানিল ইল্ম ২/১০৮৩)<br /><br />প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিয ইয়াহ্ইয়া বিন হারুন (মৃতু- ২০৬ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সত্যবাদী” (আহবারে আবু হানীফা ৩৬) আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-“ইমাম আবু হানীফার মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো”। ( তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১, পৃ: ৪৫০)<br /><br />একবার হযরত ইয়াহয়া ইবনে মুঈনকে প্রশ্ন করা হলো- হাদীসশাস্ত্রে আবু হানীফা কি আস্থাভাজন ব্যক্তি? সম্ভবতঃ প্রচ্ছন্ন সংশয় আঁচ করতে পেরে দৃপ্তকন্ঠে তিনি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! (মানাকিবুল ইমামমুল আ’যামি লিলমাওয়াফিক- খন্ড:১, পৃষ্ঠা ১৯২) ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফার পরিবারভুক্ত।(আছারুল ফিকহিল ইসলামী, পৃ: ২২৩) হাফেয যাহাবী তার কিতাবে ইমাম আবু হানিফাকে হাফেযে হাদীসের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। (তাযকিরাতুল হুফফায, পৃ: ১৬০) বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কোন ব্যক্তি অনুসরনীয় হওয়ার দিক থেকে ইমাম আযম আবু হানিফার চেয়ে অধিক যোগ্য নয়। কেননা আবু হানিফা ইমাম, খোদাভীরু, মুত্তাকী, আলেম ছিলেন। তীক্ষ্ম মেধা ও বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে ইলমকে এমনভাবে বিশ্লেষন করেছেন যে ইতিপূর্বে কেউ তা করতে পারে নি।(খাইরাতুল হিসান, লেখক: ইবনে হাজার হায়ছামী শাফেয়ী)<br /><br />তাঁর খোদাভীরুতা:<br /><br />তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার নামাযের ওযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এতে এটাই বোঝা যায় যে, তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদত, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। কতিপয় কর্মচারীর দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্য তিনি কর্মচারীদের সব সময় সতর্ক করতেন। একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, ‘ক্রেতার নিকট যখন এগুলো বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলো দেখিয়ে দেবে এবং এর মূল্য কম রাখবে।’ কিন্তু পরবর্তী কর্মচারীগণ ভুলক্রমে ক্রেতাকে কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেয়ে খুব ব্যথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেন এবং বিক্রীত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।<br /><br />তাঁর ইন্তিকাল:<br /><br />খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাঁকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয়। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তিকাল হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা ইন্তিকালের আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মনসূর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন ইন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রযয়োগে হত্যা করা হয়। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরিতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুত গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্তরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তাঁর জানাযায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী বিজরান কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।<br />وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله<br /><br /></div>

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ******************************************* সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী খতিব, মুসাফিরখানা...

Read more »

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on"> ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি<br /> *******************************************<br /> সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br /> খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br /> بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!<br /> <br /> অধঃপতনের যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পার্থিব লোভ-লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাদের ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র পদঙ্খলন ঘটাতে পারেনি; যারা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোনো দিন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন যারা পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যারা যালেম সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের অন্যতম।<br /> <div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"> <a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh-8gTdNecSGbwmAshHNCiFOg1WLVevn-AmWyDcNFsZEUBMkQvHz017Eur14-p_pgNU73Gh855TAXpNAfWdfzBZjJZ0yCBjjMYJtn1K-SbGavCjyBgjmJjDerYjxH_8eQxT6DYDm2lJmqr_/s1600/al_imam_abu_hanifa_al_noman_tomb_by_mq5-d5y4gzx-750x350.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="350" data-original-width="750" height="149" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh-8gTdNecSGbwmAshHNCiFOg1WLVevn-AmWyDcNFsZEUBMkQvHz017Eur14-p_pgNU73Gh855TAXpNAfWdfzBZjJZ0yCBjjMYJtn1K-SbGavCjyBgjmJjDerYjxH_8eQxT6DYDm2lJmqr_/s320-rw/al_imam_abu_hanifa_al_noman_tomb_by_mq5-d5y4gzx-750x350.jpg" width="320" /></a></div> <br /> <br /> ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্ম ও শিক্ষা:<br /> <br /> ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৮০ হিজরি মোতাবেক ৭০২ খ্রিষ্টাব্দে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হলো নু’মান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। তাঁর বাল্যকালের ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তিনি ইমাম আযম নামেও সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুশগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধিশালী নগর কুফায় এসে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।<br /> <br /> ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৪-১৫ বছর বয়সে একদিন যখন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তৎকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছ? উত্তরে তিনি অতি দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।’ ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আমি যেন তোমার মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। ভালো আলেমের নিকট তোমার লেখাপড়া শেখা উচিত।’<br /> <br /> ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উপদেশ ও অনুপ্রেরণায় ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম হামদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আতা ইবনে রবিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম জাফর সাদিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞান লাভের জন্য তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা এবং কুফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত আলেমগণের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন।<br /> <br /> বিভিন্ন স্থান থেকে হাদিসের অমূল্য রত্ন সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণীগুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু যাহরা)<br /> <br /> ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাবেয়ী:<br /> <br /> কারো কারো মতে, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবি জীবিত ছিলেন। ১০২ হিজরিতে তিনি যখন মদিনা গমন করেন তখন মদিনায় দুজন সাহাবি হযরত সোলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের দর্শন লাভ করেন। তবে তাবেতাবেয়ী হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই।<br /> <br /> ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শিক্ষকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁদের মাত্র একটি মধ্যস্থতা অবলম্বন করতে হতো। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিসসমূহ সম্পূর্ণ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ। ইমাম আবু হানীফা অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন- ১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৩ হিজরী) ২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৭ হিজরী) ৩) সহল ইবনে সাআদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৮ হিজরী) ৪) আবু তোফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১০ হিজরী) ৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৯ হিজরী) ৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৪ হিজরী) ৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৫ হিজরী) হাদিস শাস্ত্রের<br /> <br /> ‘আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান (আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।<br /> <br /> শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ<br /> <br /> ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন।<br /> <br /> একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফার দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফার নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।<br /> <br /> মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধিক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞা ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।<br /> <br /> প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি:) চারবছর নয় মাস কাল ইমাম আবু হানীফা মক্কা শরীফে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানীফার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসিয়দের শাসন-ব্যবস্থা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখগণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ করে ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগনের সে আকাঙ্খা নস্যাত করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্থান মোটেও নিরাপদ ছিল না।<br /> <br /> শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকালে (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কাশরীফেই অবস্থান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেয যাহাবীর বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে যোগ দিতেন, অনুরূপ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।<br /> <br /> তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পা-িত্য:<br /> <br /> তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পা-িত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহশাস্ত্রেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামি আইনগুলোকে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফি মাযহাবের অনুসারী। ফিকাহশাস্ত্রে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম যুফার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম।<br /> <br /> ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতিঃ<br /> <br /> যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করতেন। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)<br /> <br /> ইবনে হাযম বলেন, আবু হানীফার সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হতো। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীর বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)<br /> <br /> শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী হারামাইন শরীফাইনে অবস্থানকালে কাশফযোগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অবগত করেছেন যে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)<br /> <br /> ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল কারাগারে বসেই ১২ লাখ ৯০ হাজারের অধিক মাসআলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।<br /> <br /> ইমাম সাহেবর তীক্ষ বুদ্ধি, ধী-শক্তি ও গভীর জ্ঞান:<br /> <br /> ইমাম সাহেব যেমন তীক্ষ বুদ্ধি অধিকারী ও ধী- শক্তি সম্পন্ন ছিলেন তেমনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা তা অনুমান করা সম্ভব হবে: ‘একদিন ইমাম আবু হানীফা কিরাত ও হাদীস বর্ননায় প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় কোন একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মতামত জিজ্ঞেস করা হল। জবাবে তিনি তার মতাতমত জানালেন। হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জিজ্ঞেস করলেন- এ দলীল তুমি কোথায় পেয়েছ? জবাবে ইমাম সাহেব বললেন, আপনিই তো আমাদেরকে এ হাদীস শুনিয়েছেন,।<br /> এভাবে ইমাম সাহেব তারই বর্নণাকৃত আরও চারটি হাদীস শুনালেন। ইমাম আমাশ বললেন- যথেষ্ট হয়েছে, আর শুনাতে হবে না। আমি তোমাকে একশত দিনে যা শুনিয়েছি তুমি এক ঘন্টায় তা শুনিয়ে দিলে। আমার ধারনাও ছিল না যে তুমি এ হাদীসগুলোর উপর আমাল করে থাক। “সত্যিই তোমরা ফকীহরা হলে ডাক্তারতুল্য, আর আমরা হলাম ঔষধের দোকানদার।“ আর তুমি তো উভয় দিকই হাসীল করেছ (আল জাওয়াহের আল মুদিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৮৪)।<br /> <br /> ‘ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর শাগরিদদেরকে যারা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হাফিযে হাদীস ফাযল ইবনি মূসা আস সিনানীকে জিজ্ঞাসা করা হল- ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে যারা অপবাদ গেয়ে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি বললেন- আসল ব্যাপার হল ইামাম আবু হানীফা তাদের সামনে এমন তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করেছেন যার সবটা তারা বুঝতে সক্ষম হয়নি। আর তিনি তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তারা ইমাম সাহেবের সাথে হিংসা আরম্ভ করেছেন’। ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন-‘হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন’।<br /> <br /> ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের সংগৃহীত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন- ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জনৈক উ¯তাদ ইয়াহইয়া ইবনি আদাম তাঁর সহীহ গ্রন্থে বলেন- ‘ইমাম আবু হানীফা নিজ শহরের সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন এবং তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জীবনের হাদীসগুলোর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল (অর্থাৎ বিভিন্নমুখী হাদীসগুলোর মধ্যে সর্বশেষ হাদীস কোনটি ছিল)। যার দ্বারা অন্যান্যগুলো রহিত সাব্য¯ত করা সহজ হয়।<br /> মোটকথা ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের হাসিলকৃত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। এখানেই তিনি ক্ষন্ত হননি বরং তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা- মাদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল উলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফকীহদের কেন্দ্রস্থল ছিল, কাজেই এক কথায় বলা চলে যে- মক্কা- মাদীনা ছিল ইলমের মারকায। আর তার মত অসাধারণ ধী- শক্তি সম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর যাবত মক্কা- মাদীনার ইলম হাসিল করা নি:সন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়।<br /> <br /> এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হাজ্বব্রত পালন করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় (উকূদুল জামান, পৃ- ২২০)। প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা- মাদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন বলে বিভিন্ন লেখক মšতব্য করেছেন (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩, খইরতুল হিসান, পৃ- ২৩।) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনি ইউসূফ আস সালেহী ‘উকূদুল জামান গ্রন্থে দীর্ঘ ২৪ পৃষ্ঠায় ইমাম সাহেবের মাশায়েখদের একটা ফিরি¯ত পেশ করেছেন, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩- ৮৭)।<br /> <br /> আল্লামা আলী আল কারী, মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ’র বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের উর্দ্ধে হাদীস বর্ননা করেছেন। আর ‘আল আছার’ গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন’ (আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৭৩)। ইয়াহইয়া ইবনি নাসর বলেন- ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানীফার ঘরে প্রবেশ করি যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন- এগুলো সব হাদীসের কিতাব, এর মধ্যে সামান্য কিছুই আমি বর্ননা করেছি যেগুলো ফলপ্রদ’ (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদু জাওয়াহিরিল মুনীফাহ, ১, ৩১)।<br /> <br /> ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যদিও অন্যান্য মুহাদ্দীসদের মত হাদীস শিক্ষা দেয়ার জন্য কোন মাজলীস ছিল না, যেমন ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি করেছেন (মুআত্তা মালিক)। কিন্তু তাঁর শাগরিদগণ তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন কিতাব ও মুসনাদ সংকলন করেছেন যার সংখ্যা দশের উর্দ্ধে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হল- ইমাম আবু ইউসুফ রচিত ‘কিতাবুল আসার’, ইমাম মুহাম্মাদ রচিত ‘কিতাবুল আসার আল মারফুআহ’ ও ‘আল আসারুল মারফুআহ ওয়াল মাওকুফাহ’, মুসনাদুল হাসান ইবনি যিয়াদ আল লু-লুঈ, মুসনাদে হাম্মাদ ইবনি আবু হানীফা ইত্যাদি।<br /> <br /> ইমাম বোখারীর অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃতু- ২১৫ হিঃ) যাঁর সনদে ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অধিকাংশ ‘সুলাসিয়্যাত হাদীস’ বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফার ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন” (মানাক্বেবে ইমাম আযম রহ. ১/৯৫)<br /> <br /> আবার হাফিয মযযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “তিনি তাঁর কালের সবচেয়ে বড় আলিম ছিলেন” (তাহ্যীবুত তাহযীব-এর টিকা- ১০ম খন্ড, ৪৫২পৃ.) ইমাম আবু দাউদ বলেন, নিঃসন্দেহে আবু হানীফা ছিলেন একজন শেষ্ঠ ইমাম। (তাহজীব ১/৪৪৫) জরহ ও তাদিলের (সনদ পর্যালোচনা শাস্ত্র) অন্যতম ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন (মৃতু- ২৩৩হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি”- (তাহবীবুত্তাহজীব ৫/৬৩০) আলী ইবনে মাদানী (মৃতু- ২৩৪ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা হাদীস শাস্ত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন দোষক্রুটি ছিল না। (জামঈ বয়ানিল ইল্ম ২/১০৮৩)<br /> <br /> প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিয ইয়াহ্ইয়া বিন হারুন (মৃতু- ২০৬ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সত্যবাদী” (আহবারে আবু হানীফা ৩৬) আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-“ইমাম আবু হানীফার মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো”। ( তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১, পৃ: ৪৫০)<br /> <br /> একবার হযরত ইয়াহয়া ইবনে মুঈনকে প্রশ্ন করা হলো- হাদীসশাস্ত্রে আবু হানীফা কি আস্থাভাজন ব্যক্তি? সম্ভবতঃ প্রচ্ছন্ন সংশয় আঁচ করতে পেরে দৃপ্তকন্ঠে তিনি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! (মানাকিবুল ইমামমুল আ’যামি লিলমাওয়াফিক- খন্ড:১, পৃষ্ঠা ১৯২) ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফার পরিবারভুক্ত।(আছারুল ফিকহিল ইসলামী, পৃ: ২২৩) হাফেয যাহাবী তার কিতাবে ইমাম আবু হানিফাকে হাফেযে হাদীসের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। (তাযকিরাতুল হুফফায, পৃ: ১৬০) বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কোন ব্যক্তি অনুসরনীয় হওয়ার দিক থেকে ইমাম আযম আবু হানিফার চেয়ে অধিক যোগ্য নয়। কেননা আবু হানিফা ইমাম, খোদাভীরু, মুত্তাকী, আলেম ছিলেন। তীক্ষ্ম মেধা ও বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে ইলমকে এমনভাবে বিশ্লেষন করেছেন যে ইতিপূর্বে কেউ তা করতে পারে নি।(খাইরাতুল হিসান, লেখক: ইবনে হাজার হায়ছামী শাফেয়ী)<br /> <br /> তাঁর খোদাভীরুতা:<br /> <br /> তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার নামাযের ওযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এতে এটাই বোঝা যায় যে, তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদত, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। কতিপয় কর্মচারীর দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্য তিনি কর্মচারীদের সব সময় সতর্ক করতেন। একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, ‘ক্রেতার নিকট যখন এগুলো বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলো দেখিয়ে দেবে এবং এর মূল্য কম রাখবে।’ কিন্তু পরবর্তী কর্মচারীগণ ভুলক্রমে ক্রেতাকে কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেয়ে খুব ব্যথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেন এবং বিক্রীত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।<br /> <br /> তাঁর ইন্তিকাল:<br /> <br /> খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাঁকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয়। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তিকাল হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা ইন্তিকালের আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মনসূর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন ইন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রযয়োগে হত্যা করা হয়। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরিতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুত গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্তরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তাঁর জানাযায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী বিজরান কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।<br /> وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله<br /> <br /></div>

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ******************************************* সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী খতিব, মুসাফির...

Read more »

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on"><br />ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি<br /><br />*******************************************<br /><br />সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী<br /><br />খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।<br /><br />بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!<br /><br /><br /><br />অধঃপতনের যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পার্থিব লোভ-লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাদের ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র পদঙ্খলন ঘটাতে পারেনি; যারা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোনো দিন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন যারা পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যারা যালেম সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের অন্যতম।<br /><br /><div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"><br /><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhlz8A-94HBnO-FTTwbzpnqRT2a5PFdB6qovmrvoPdTXL_2dmD117jibSe64Pu4P4nH66rQ10KkShbckr65vAbYO0I7i1dn4gQvN6iLE9UpaeHILGCagxHB4H9oNSuMW746JEfQV1cI7YLx/s1600/al_imam_abu_hanifa_al_noman_tomb_by_mq5-d5y4gzx-750x350.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="350" data-original-width="750" height="149" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhlz8A-94HBnO-FTTwbzpnqRT2a5PFdB6qovmrvoPdTXL_2dmD117jibSe64Pu4P4nH66rQ10KkShbckr65vAbYO0I7i1dn4gQvN6iLE9UpaeHILGCagxHB4H9oNSuMW746JEfQV1cI7YLx/s320-rw/al_imam_abu_hanifa_al_noman_tomb_by_mq5-d5y4gzx-750x350.jpg" width="320" /></a></div><br /><br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্ম ও শিক্ষা:<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৮০ হিজরি মোতাবেক ৭০২ খ্রিষ্টাব্দে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হলো নু’মান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। তাঁর বাল্যকালের ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তিনি ইমাম আযম নামেও সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুশগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধিশালী নগর কুফায় এসে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৪-১৫ বছর বয়সে একদিন যখন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তৎকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছ? উত্তরে তিনি অতি দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।’ ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আমি যেন তোমার মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। ভালো আলেমের নিকট তোমার লেখাপড়া শেখা উচিত।’<br /><br /><br /><br />ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উপদেশ ও অনুপ্রেরণায় ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম হামদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আতা ইবনে রবিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম জাফর সাদিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞান লাভের জন্য তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা এবং কুফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত আলেমগণের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন।<br /><br /><br /><br />বিভিন্ন স্থান থেকে হাদিসের অমূল্য রত্ন সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণীগুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু যাহরা)<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাবেয়ী:<br /><br /><br /><br />কারো কারো মতে, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবি জীবিত ছিলেন। ১০২ হিজরিতে তিনি যখন মদিনা গমন করেন তখন মদিনায় দুজন সাহাবি হযরত সোলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের দর্শন লাভ করেন। তবে তাবেতাবেয়ী হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই।<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শিক্ষকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁদের মাত্র একটি মধ্যস্থতা অবলম্বন করতে হতো। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিসসমূহ সম্পূর্ণ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ। ইমাম আবু হানীফা অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন- ১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৩ হিজরী) ২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৭ হিজরী) ৩) সহল ইবনে সাআদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৮ হিজরী) ৪) আবু তোফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১০ হিজরী) ৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৯ হিজরী) ৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৪ হিজরী) ৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৫ হিজরী) হাদিস শাস্ত্রের<br /><br /><br /><br />‘আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান (আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।<br /><br /><br /><br />শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ<br /><br /><br /><br />ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন।<br /><br /><br /><br />একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফার দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফার নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।<br /><br /><br /><br />মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধিক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞা ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।<br /><br /><br /><br />প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি:) চারবছর নয় মাস কাল ইমাম আবু হানীফা মক্কা শরীফে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানীফার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসিয়দের শাসন-ব্যবস্থা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখগণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ করে ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগনের সে আকাঙ্খা নস্যাত করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্থান মোটেও নিরাপদ ছিল না।<br /><br /><br /><br />শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকালে (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কাশরীফেই অবস্থান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেয যাহাবীর বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে যোগ দিতেন, অনুরূপ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।<br /><br /><br /><br />তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পা-িত্য:<br /><br /><br /><br />তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পা-িত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহশাস্ত্রেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামি আইনগুলোকে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফি মাযহাবের অনুসারী। ফিকাহশাস্ত্রে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম যুফার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম।<br /><br /><br /><br />ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতিঃ<br /><br /><br /><br />যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করতেন। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)<br /><br /><br /><br />ইবনে হাযম বলেন, আবু হানীফার সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হতো। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীর বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)<br /><br /><br /><br />শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী হারামাইন শরীফাইনে অবস্থানকালে কাশফযোগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অবগত করেছেন যে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল কারাগারে বসেই ১২ লাখ ৯০ হাজারের অধিক মাসআলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।<br /><br /><br /><br />ইমাম সাহেবর তীক্ষ বুদ্ধি, ধী-শক্তি ও গভীর জ্ঞান:<br /><br /><br /><br />ইমাম সাহেব যেমন তীক্ষ বুদ্ধি অধিকারী ও ধী- শক্তি সম্পন্ন ছিলেন তেমনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা তা অনুমান করা সম্ভব হবে: ‘একদিন ইমাম আবু হানীফা কিরাত ও হাদীস বর্ননায় প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় কোন একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মতামত জিজ্ঞেস করা হল। জবাবে তিনি তার মতাতমত জানালেন। হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জিজ্ঞেস করলেন- এ দলীল তুমি কোথায় পেয়েছ? জবাবে ইমাম সাহেব বললেন, আপনিই তো আমাদেরকে এ হাদীস শুনিয়েছেন,।<br /><br />এভাবে ইমাম সাহেব তারই বর্নণাকৃত আরও চারটি হাদীস শুনালেন। ইমাম আমাশ বললেন- যথেষ্ট হয়েছে, আর শুনাতে হবে না। আমি তোমাকে একশত দিনে যা শুনিয়েছি তুমি এক ঘন্টায় তা শুনিয়ে দিলে। আমার ধারনাও ছিল না যে তুমি এ হাদীসগুলোর উপর আমাল করে থাক। “সত্যিই তোমরা ফকীহরা হলে ডাক্তারতুল্য, আর আমরা হলাম ঔষধের দোকানদার।“ আর তুমি তো উভয় দিকই হাসীল করেছ (আল জাওয়াহের আল মুদিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৮৪)।<br /><br /><br /><br />‘ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর শাগরিদদেরকে যারা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হাফিযে হাদীস ফাযল ইবনি মূসা আস সিনানীকে জিজ্ঞাসা করা হল- ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে যারা অপবাদ গেয়ে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি বললেন- আসল ব্যাপার হল ইামাম আবু হানীফা তাদের সামনে এমন তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করেছেন যার সবটা তারা বুঝতে সক্ষম হয়নি। আর তিনি তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তারা ইমাম সাহেবের সাথে হিংসা আরম্ভ করেছেন’। ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন-‘হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন’।<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের সংগৃহীত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন- ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জনৈক উ¯তাদ ইয়াহইয়া ইবনি আদাম তাঁর সহীহ গ্রন্থে বলেন- ‘ইমাম আবু হানীফা নিজ শহরের সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন এবং তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জীবনের হাদীসগুলোর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল (অর্থাৎ বিভিন্নমুখী হাদীসগুলোর মধ্যে সর্বশেষ হাদীস কোনটি ছিল)। যার দ্বারা অন্যান্যগুলো রহিত সাব্য¯ত করা সহজ হয়।<br /><br />মোটকথা ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের হাসিলকৃত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। এখানেই তিনি ক্ষন্ত হননি বরং তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা- মাদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল উলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফকীহদের কেন্দ্রস্থল ছিল, কাজেই এক কথায় বলা চলে যে- মক্কা- মাদীনা ছিল ইলমের মারকায। আর তার মত অসাধারণ ধী- শক্তি সম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর যাবত মক্কা- মাদীনার ইলম হাসিল করা নি:সন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়।<br /><br /><br /><br />এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হাজ্বব্রত পালন করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় (উকূদুল জামান, পৃ- ২২০)। প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা- মাদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন বলে বিভিন্ন লেখক মšতব্য করেছেন (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩, খইরতুল হিসান, পৃ- ২৩।) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনি ইউসূফ আস সালেহী ‘উকূদুল জামান গ্রন্থে দীর্ঘ ২৪ পৃষ্ঠায় ইমাম সাহেবের মাশায়েখদের একটা ফিরি¯ত পেশ করেছেন, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩- ৮৭)।<br /><br /><br /><br />আল্লামা আলী আল কারী, মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ’র বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের উর্দ্ধে হাদীস বর্ননা করেছেন। আর ‘আল আছার’ গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন’ (আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৭৩)। ইয়াহইয়া ইবনি নাসর বলেন- ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানীফার ঘরে প্রবেশ করি যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন- এগুলো সব হাদীসের কিতাব, এর মধ্যে সামান্য কিছুই আমি বর্ননা করেছি যেগুলো ফলপ্রদ’ (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদু জাওয়াহিরিল মুনীফাহ, ১, ৩১)।<br /><br /><br /><br />ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যদিও অন্যান্য মুহাদ্দীসদের মত হাদীস শিক্ষা দেয়ার জন্য কোন মাজলীস ছিল না, যেমন ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি করেছেন (মুআত্তা মালিক)। কিন্তু তাঁর শাগরিদগণ তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন কিতাব ও মুসনাদ সংকলন করেছেন যার সংখ্যা দশের উর্দ্ধে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হল- ইমাম আবু ইউসুফ রচিত ‘কিতাবুল আসার’, ইমাম মুহাম্মাদ রচিত ‘কিতাবুল আসার আল মারফুআহ’ ও ‘আল আসারুল মারফুআহ ওয়াল মাওকুফাহ’, মুসনাদুল হাসান ইবনি যিয়াদ আল লু-লুঈ, মুসনাদে হাম্মাদ ইবনি আবু হানীফা ইত্যাদি।<br /><br /><br /><br />ইমাম বোখারীর অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃতু- ২১৫ হিঃ) যাঁর সনদে ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অধিকাংশ ‘সুলাসিয়্যাত হাদীস’ বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফার ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন” (মানাক্বেবে ইমাম আযম রহ. ১/৯৫)<br /><br /><br /><br />আবার হাফিয মযযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “তিনি তাঁর কালের সবচেয়ে বড় আলিম ছিলেন” (তাহ্যীবুত তাহযীব-এর টিকা- ১০ম খন্ড, ৪৫২পৃ.) ইমাম আবু দাউদ বলেন, নিঃসন্দেহে আবু হানীফা ছিলেন একজন শেষ্ঠ ইমাম। (তাহজীব ১/৪৪৫) জরহ ও তাদিলের (সনদ পর্যালোচনা শাস্ত্র) অন্যতম ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন (মৃতু- ২৩৩হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি”- (তাহবীবুত্তাহজীব ৫/৬৩০) আলী ইবনে মাদানী (মৃতু- ২৩৪ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা হাদীস শাস্ত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন দোষক্রুটি ছিল না। (জামঈ বয়ানিল ইল্ম ২/১০৮৩)<br /><br /><br /><br />প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিয ইয়াহ্ইয়া বিন হারুন (মৃতু- ২০৬ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সত্যবাদী” (আহবারে আবু হানীফা ৩৬) আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-“ইমাম আবু হানীফার মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো”। ( তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১, পৃ: ৪৫০)<br /><br /><br /><br />একবার হযরত ইয়াহয়া ইবনে মুঈনকে প্রশ্ন করা হলো- হাদীসশাস্ত্রে আবু হানীফা কি আস্থাভাজন ব্যক্তি? সম্ভবতঃ প্রচ্ছন্ন সংশয় আঁচ করতে পেরে দৃপ্তকন্ঠে তিনি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! (মানাকিবুল ইমামমুল আ’যামি লিলমাওয়াফিক- খন্ড:১, পৃষ্ঠা ১৯২) ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফার পরিবারভুক্ত।(আছারুল ফিকহিল ইসলামী, পৃ: ২২৩) হাফেয যাহাবী তার কিতাবে ইমাম আবু হানিফাকে হাফেযে হাদীসের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। (তাযকিরাতুল হুফফায, পৃ: ১৬০) বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কোন ব্যক্তি অনুসরনীয় হওয়ার দিক থেকে ইমাম আযম আবু হানিফার চেয়ে অধিক যোগ্য নয়। কেননা আবু হানিফা ইমাম, খোদাভীরু, মুত্তাকী, আলেম ছিলেন। তীক্ষ্ম মেধা ও বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে ইলমকে এমনভাবে বিশ্লেষন করেছেন যে ইতিপূর্বে কেউ তা করতে পারে নি।(খাইরাতুল হিসান, লেখক: ইবনে হাজার হায়ছামী শাফেয়ী)<br /><br /><br /><br />তাঁর খোদাভীরুতা:<br /><br /><br /><br />তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার নামাযের ওযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এতে এটাই বোঝা যায় যে, তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদত, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। কতিপয় কর্মচারীর দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্য তিনি কর্মচারীদের সব সময় সতর্ক করতেন। একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, ‘ক্রেতার নিকট যখন এগুলো বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলো দেখিয়ে দেবে এবং এর মূল্য কম রাখবে।’ কিন্তু পরবর্তী কর্মচারীগণ ভুলক্রমে ক্রেতাকে কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেয়ে খুব ব্যথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেন এবং বিক্রীত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।<br /><br /><br /><br />তাঁর ইন্তিকাল:<br /><br /><br /><br />খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাঁকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয়। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তিকাল হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা ইন্তিকালের আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মনসূর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন ইন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রযয়োগে হত্যা করা হয়। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরিতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুত গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্তরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তাঁর জানাযায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী বিজরান কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।<br /><br />وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله<br /><br /><br /></div><br />

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ******************************************* সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী খতিব, মুসাফিরখানা...

Read more »