#গাউসুল_আযম
প্রশ্নঃ গাউসুল আযম, হাজত রওয়া, মুশকিল কুশা এ শব্দগুলোর অর্থ কি? আল্লাহ ব্যতীত এই বিশেষণগুলো আর কারো জন্য বলা কি অপরাধ হবে? আবদুল কাদের জিলানীকে কখন কেন গাউসুল আযম উপাধি দেয়া হয় ? জানালে উপকৃত হব।
উত্তরঃ ‘গাউসুল আযম’ অর্থ বড় সাহায্যকারী, ‘মুশকিল কুশা’ অর্থ বিপদ-আপদ দূরীভূতকারী, ‘হাজত রওয়া’ অর্থ অভাব বা প্রয়োজন পূরণকারী। আল্লাহ্ তা’আলার দানকৃত বিশেষ ক্ষমতাবলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা তথা প্রকৃত আউলিয়ায়ে কেরাম স্বীয় জাহেরী জীবদ্দশায় বা ইন্তিকালের পরেও তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থীদেরকে সাহায্য করতে, অভাব অভিযোগ পূরণ করতে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করতে সক্ষম বিধায় তাঁদেরকে এ সব উপাধি বা বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করা হয়।
আউলিয়ায়ে কেরামের জীবন এ ধরনের ঘটনায় পরিপূর্ণ। যাদের হৃদয়ে কপটতা এবং ঈমানের দূর্বলতা রয়েছে তারা ব্যতীত আউলিয়ায়ে কেরামের ওই সব কামালাত তথা কারামাতসমূহ কেউ অস্বীকার করে না। কারণ, আল্লাহ তা’আলার দানকৃত ক্ষমতা বলে মানুষের বিপদ আপদে সাহায্য করা, অভাব-অভিযোগ দূর করা, প্রয়োজন পূর্ণ করার ঘটনা আল্লাহর অলীগণের পবিত্র জীবনে বা ওফাতোত্তরকালে এমন অধিকসংখ্যক হারে সংগঠিত হয়েছে এবং এ সব ঘটনা এমন সব লোকেরা বর্ণনা করেছেন, যাঁদের বর্ণনায় বিশ্বাস স্থাপন করা একজন ঈমানদার লোকের জন্য অপরিহার্য। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া তাঁর ক্ষমতা ও দয়াপ্রাপ্ত আল্লাহর অলীগণের বেলায় এসব বিশেষণ বলা তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামান্তর। তা অপরাধ বা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নেই।
আর ‘গাউসুল আযম’ শব্দের অর্থ যদিও ‘বড় সাহায্যকারী’ কিন্তু এটা বেলায়তের সর্বোচ্চস্তরের নাম। এটাকে ‘গাউসিয়তে কুবরা’ও বলা হয়। প্রত্যেক যুগে ‘গাউসুল আযম’ পদে একজন অধিষ্ঠিত থাকেন। প্রত্যেক যুগে একজন গাউসুল আযমের দু’জন অধঃস্তন থাকেন। একজনের অবস্থান ডানে অন্যজনের বামে। এ ক্ষেত্রে বামে অবস্থানকারী ডানের চেয়ে উত্তম হয়ে থাকেন। কারণ, মানুষের ‘ক্বল্ব’র স্থান হলো বাম দিকে।
হযরত সিদ্দীক-ই-আকবর হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বামে অবস্থানকারী ছিলেন আর ফারূক্ব-ই-আযম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ডানে। হাবীবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উসিলায় উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘গাউসুল আযম’র পদ মর্যাদায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু লাভ করেন। হযরত ফারূক-ই-আযম ও হযরত উসমান গণী যুন্নূরাঈন রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর দু’জন অধঃস্তন নিযুক্ত হন। তাঁর ইন্তিকালের পর হযরত ফারূক-ই-আযম গাউসুল আযম’র মহান পদ লাভে ধন্য হন আর হযরত উসমান গণী ও হযরত মাওলা আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর অধঃস্তন নিযুক্ত হন। তার পর হযরত উসমান গণী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু গাউসিয়তের মার্যাদায় অভিষিক্ত হন। হযরত মাওলা আলী ও হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর দু’জন অধঃস্তন নিযুক্ত হন। তারপর হযরত মাওলা আলী কার্রমাল্লাহু ওয়াজহাহূ গাউসুল আযম পদ লাভ করেন। হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর অধঃস্তন নিযুক্ত হন। অতঃপর ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে হযরত ইমাম হাসান আসকারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত পর পর সকলেই আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতাবলে ‘গাউসুল আযম’ পদ লাভে ধন্য হন। ইমাম আসকারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে হযরত পীরানে পীর আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত যত জন এসেছেন তাঁরা সবাই ইমাম আসকারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নায়েব ছিলেন। তারপর হযরত পীরানে পীর শায়খ সায়্যিদ সুলতান আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বতন্ত্র ‘গাউসিয়ত-ই-কুবরা’ এর মহান পদে অধিষ্ঠিত হন। তাই তিনি ‘গাউসুল আযম’।
হযরত গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বেসালের পর ইমাম মাহ্দী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর আগমন পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ‘গাউস’ বা ‘কুতুব’ জন্ম গ্রহণ করেছেন ও করবেন তাঁরা সবাই হুজূর গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নায়েব বা প্রতিনিধি হবেন। সর্বশেষ ইমাম মাহ্দী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ‘গাউসিয়ত-ই-কুবরা তথা গাউসুল আযম’ এর মহা মর্যাদা দান করা হবে।
[মালফূযাতে আ’লা হযরত, ১ম খণ্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা এবং হযরত কাজী সানা উল্লাহ্ পানিপথী
রহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত: আস্সায়দুল মাসলুল, পৃষ্ঠা ৫২৭-৫২৮।]
সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, গাউসুল আযম এটা বেলায়তের সর্বোচ্চ পদ। এটাকে গাউসিয়তে কুবরা বা গাউসিয়তে উজমাও বলা হয়। এটা আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত উপাধি। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে করেন তাঁকে এ মহা বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেন। নেক আমলের দ্বারা এ মর্যাদা অর্জন করা যায় না। তাই প্রত্যেক যুগের সমস্ত গাউস, কুতুব, আবদাল বেলায়তের এ সব স্তরে পৌঁছতে গাউসুল আযম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ফুয়ূজাত ও বারাকাতের দিকে মুখাপেক্ষী।
যেমন আল্লামা আবদুল কাদির আরবুলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত ‘তাফরীহুল খাতির’ (تفريح الخاطر)কিতাবে উল্লেখ আছে যে, سيدنا عبد القادر الشيخ السيد عبد الاعظم لانه كلما ذكر الغوث فالمراد به هو رضى الله عنه لانه مخاطب من الحق به كذا ذكر فى الغوثية অর্থাৎ হযরত শায়খ সায়্যিদ আবদুল কাদির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর মহানবান্দা। কারণ, যখন ‘আল্ গাউস’ বলে স্মরণ করা হয় তখন তা দ্বারা শুধু তাঁকেই বুঝানো হয়। কারণ, তিনি এ উপাধি আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হন।
উক্ত গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, যখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কোন বান্দাকে ‘বেলায়ত’ বা অলী করতে চান তখন এ বলে নির্দেশ দেয়া হয় যে, ان ياخذوه بحضور المصفطى صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ তাঁকে হুজূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পেশ করা হোক। যখন তাঁকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পেশ করা হয় তখন হুজূর আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন خذوه الى ولدى لسيد عبد القادر يرى لياقته واستحقاقه بمنصب الولاية অর্থাৎ তাঁকে আমার প্রিয় আওলাদ আস্সায়্যিদ আবদুল কাদির এর কাছে নিয়ে যাও, তিনি তাঁর যোগ্যতা দেখেন এবং এও দেখেন যে, সে এ পদের উপযুক্ত কি না। হুকুম মত তাঁকে হযরত গাউসুল আযম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র খিদমতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ওই ব্যক্তিকে বেলায়তের উপযুক্ত দেখলে তাঁর নাম অলীদের দফতরে লিখে সীল মেরে দেন। তারপর তাঁকে হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত করা হয় আর হুজূর গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর লিখা মুতাবিক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নির্দেশ মত তাঁকে বেলায়তের পোশাক পরিধান করানো হয়, যা হুজূর গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহুঞ্চর পবিত্র হাত দিয়ে দান করা হয়। সে ওই পোশাক পরে নেন এবং অদৃশ্য ও দৃশ্য সকল জগতে তিনি আল্লাহর অলী হিসেবে মান্যবর ও গ্রহণীয় হয়ে যান। فهذه العهدة متعلقة بحضرة الغوث الى يوم القيامة وليس لاحد من الاولياء الكرام مماثلة ومشاركة مع الغوث فى هذا المقام ففى كل عصر وزمان تستفيض من حضرته الاقطاب والغوث وجميع الاولياء অর্থাৎ সুতরাং, এ মর্যাদায় কিয়ামত পর্যন্ত হযরত গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু অধিষ্ঠিত থাকবেন। এ মর্যাদায় কোন অলী তাঁর সমকক্ষ ও অংশীদার নেই। প্রত্যেক যুগের গাউসগণ, কুতুবগণ ও সমস্ত অলীআল্লাহ্ তাঁর থেকে কল্যাণ ও বরকত লাভ করতে থাকবেন।
[ইমাম আবদুল কাদির আরবুলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত ‘তাফরীহুল খাতির’ পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯ মিসর থেকে মুদ্রিত]
এদিকে ইঙ্গিত করে হযরত গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর স্বীয় এক কসীদায় এরশাদ করেছেন-
افلت شموس الاولين وشمسنا ابدًا على افق العلى لا تغرب
অর্থাৎ আমার পূর্ববর্তী সকল অলীগণের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে, কিন্তু বেলায়তের আকাশে আমি আবদুল কাদির জিলানীর সূর্য কখনো অস্তমিত হবে না। অর্থাৎ আমার গাউসিয়তের ফুয়ূজাত কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা জারী থাকবে।
[মাযহারে জামালে মোস্তফায়ী কৃত. সৈয়দ নাসিরুদ্দিন হাশেমী]
উল্লেখ্য যে, সাহায্যকারী, মুশকিল আসানকারী, বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণদানকারী অভাব মোচনকারী ও প্রয়োজন পূরণকারী হাকীকত বা প্রকৃত অর্থে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহূর বিশেষ গুণ- এ কথা চির সত্য। প্রত্যেক প্রকৃত ঈমানদারের আক্বীদা-বিশ্বাসও এরকমই। তবে আল্লাহর প্রিয় অলী ও বন্ধুগণ আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা বলে আল্লাহর খাস দয়ায় আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি তাঁরা ইন্তিকালের আগে ও পরে বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য করে থাকেন, বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণ দিয়ে থাকেন। প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন। এটা (مجاز �মাজায ) বা রূপক অর্থে ব্যবহৃত। যা কোরআন-সুন্নাহ ও শরীয়ত সমর্থিত। যেমন বর্তমানেও আরব বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যার জিম্মায় প্রবাসীরা কাজ-কর্ম ও চাকুরি ইত্যাদি করে থাকেন, তাকে কাফীল (كفيل) বলা হয় এটাও মাজায বা রূপক অর্থে। তদুপরি সহীহ বুখারী শরীফে হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু কতর্ৃৃক বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে মহান রব্বুল আলামীন এরশাদ করেন যে, আমার প্রিয় বান্দাগণ বেশি বেশি নফল এবাদতসমূহের মাধ্যমে যখন আমার প্রিয় পাত্র হয়ে যান- তখন আমি তাঁর হাত হয়ে যাই, যে হাত দিয়ে সে ধরে, আমি তার পা হয়ে যাই, যে পা দিয়ে সে চলাফেরা করে, আমি তাঁর কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শুনে এবং আমি তার চক্ষু হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে। -[মিশকাত ও সহীহ্ বোখঅরী, ২য় খন্ড.পৃ. ৯৬৩]
সুতরাং, উপরোক্ত বিশেষণসমূহ আল্লাহর প্রিয় বন্ধু তথা হক্কানী অলী, গাউস, কুতুব, আবদালের জন্য ব্যবহার করা শির্ক বা অবৈধ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। বরং এর উপর আপত্তি করাটা নিছক মুর্খতার নামান্তর। তবে এ জাতীয় বিশেষণ দ্বারা আউলিয়ায়ে কেরামকে ভূষিত করা হক্কানী আউলিয়া কেরামের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ কুদরাত বা ক্ষমতা ও দয়া প্রকাশই উদ্দেশ্য। যেহেতু আল্লাহর খাস বান্দাগণ আল্লাহর কুদরত ও মহিমার প্রকাশস্থল। তথা তাঁরা হলেন মাযহারে জামালে ইলাহী। সুতরাং এ জাতীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করে কোরআন হাদীস, তাফসীর, ফিক্ব্হ্-ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ পর্যালোচনা করার নিবেদন রইল। পরম করুণাময় সবাইকে প্রকৃত আউলিয়ায়ে কেরামের শান-মান বুঝার তাওফীক দান করুন।
[মসনবী শরীফ, কৃত: ইমাম জালালুদ্দীন রূমী ও মালফূজাতে আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইত্যাদি।]
উল্লেখ্য যে, যাকে তাকে গাউসূল আযম বলা আর কেউ না বললে তাকে গুন্ডাবাহিনী দ্বারা রক্তাক্ত করে দেয়া সম্পূর্ণ ভণ্ডামী এবং শরিয়ত তরিকতের নামে এক মহাকলঙ্ক। তাদের খপ্পর ও ষড়যন্ত্র হতে দুরে থাকার পরামর্শ রইল।
[সূত্র. যুগ-জিজ্ঞাসা, পৃ.২৩-২৭]
প্রশ্নঃ গাউসুল আযম, হাজত রওয়া, মুশকিল কুশা এ শব্দগুলোর অর্থ কি? আল্লাহ ব্যতীত এই বিশেষণগুলো আর কারো জন্য বলা কি অপরাধ হবে? আবদুল কাদের জিলানীকে কখন কেন গাউসুল আযম উপাধি দেয়া হয় ? জানালে উপকৃত হব।
উত্তরঃ ‘গাউসুল আযম’ অর্থ বড় সাহায্যকারী, ‘মুশকিল কুশা’ অর্থ বিপদ-আপদ দূরীভূতকারী, ‘হাজত রওয়া’ অর্থ অভাব বা প্রয়োজন পূরণকারী। আল্লাহ্ তা’আলার দানকৃত বিশেষ ক্ষমতাবলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা তথা প্রকৃত আউলিয়ায়ে কেরাম স্বীয় জাহেরী জীবদ্দশায় বা ইন্তিকালের পরেও তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থীদেরকে সাহায্য করতে, অভাব অভিযোগ পূরণ করতে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করতে সক্ষম বিধায় তাঁদেরকে এ সব উপাধি বা বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করা হয়।
আউলিয়ায়ে কেরামের জীবন এ ধরনের ঘটনায় পরিপূর্ণ। যাদের হৃদয়ে কপটতা এবং ঈমানের দূর্বলতা রয়েছে তারা ব্যতীত আউলিয়ায়ে কেরামের ওই সব কামালাত তথা কারামাতসমূহ কেউ অস্বীকার করে না। কারণ, আল্লাহ তা’আলার দানকৃত ক্ষমতা বলে মানুষের বিপদ আপদে সাহায্য করা, অভাব-অভিযোগ দূর করা, প্রয়োজন পূর্ণ করার ঘটনা আল্লাহর অলীগণের পবিত্র জীবনে বা ওফাতোত্তরকালে এমন অধিকসংখ্যক হারে সংগঠিত হয়েছে এবং এ সব ঘটনা এমন সব লোকেরা বর্ণনা করেছেন, যাঁদের বর্ণনায় বিশ্বাস স্থাপন করা একজন ঈমানদার লোকের জন্য অপরিহার্য। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া তাঁর ক্ষমতা ও দয়াপ্রাপ্ত আল্লাহর অলীগণের বেলায় এসব বিশেষণ বলা তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামান্তর। তা অপরাধ বা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নেই।
আর ‘গাউসুল আযম’ শব্দের অর্থ যদিও ‘বড় সাহায্যকারী’ কিন্তু এটা বেলায়তের সর্বোচ্চস্তরের নাম। এটাকে ‘গাউসিয়তে কুবরা’ও বলা হয়। প্রত্যেক যুগে ‘গাউসুল আযম’ পদে একজন অধিষ্ঠিত থাকেন। প্রত্যেক যুগে একজন গাউসুল আযমের দু’জন অধঃস্তন থাকেন। একজনের অবস্থান ডানে অন্যজনের বামে। এ ক্ষেত্রে বামে অবস্থানকারী ডানের চেয়ে উত্তম হয়ে থাকেন। কারণ, মানুষের ‘ক্বল্ব’র স্থান হলো বাম দিকে।
হযরত সিদ্দীক-ই-আকবর হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বামে অবস্থানকারী ছিলেন আর ফারূক্ব-ই-আযম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ডানে। হাবীবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উসিলায় উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘গাউসুল আযম’র পদ মর্যাদায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু লাভ করেন। হযরত ফারূক-ই-আযম ও হযরত উসমান গণী যুন্নূরাঈন রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর দু’জন অধঃস্তন নিযুক্ত হন। তাঁর ইন্তিকালের পর হযরত ফারূক-ই-আযম গাউসুল আযম’র মহান পদ লাভে ধন্য হন আর হযরত উসমান গণী ও হযরত মাওলা আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর অধঃস্তন নিযুক্ত হন। তার পর হযরত উসমান গণী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু গাউসিয়তের মার্যাদায় অভিষিক্ত হন। হযরত মাওলা আলী ও হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর দু’জন অধঃস্তন নিযুক্ত হন। তারপর হযরত মাওলা আলী কার্রমাল্লাহু ওয়াজহাহূ গাউসুল আযম পদ লাভ করেন। হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর অধঃস্তন নিযুক্ত হন। অতঃপর ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে হযরত ইমাম হাসান আসকারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত পর পর সকলেই আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতাবলে ‘গাউসুল আযম’ পদ লাভে ধন্য হন। ইমাম আসকারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে হযরত পীরানে পীর আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত যত জন এসেছেন তাঁরা সবাই ইমাম আসকারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নায়েব ছিলেন। তারপর হযরত পীরানে পীর শায়খ সায়্যিদ সুলতান আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বতন্ত্র ‘গাউসিয়ত-ই-কুবরা’ এর মহান পদে অধিষ্ঠিত হন। তাই তিনি ‘গাউসুল আযম’।
হযরত গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বেসালের পর ইমাম মাহ্দী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর আগমন পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ‘গাউস’ বা ‘কুতুব’ জন্ম গ্রহণ করেছেন ও করবেন তাঁরা সবাই হুজূর গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নায়েব বা প্রতিনিধি হবেন। সর্বশেষ ইমাম মাহ্দী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ‘গাউসিয়ত-ই-কুবরা তথা গাউসুল আযম’ এর মহা মর্যাদা দান করা হবে।
[মালফূযাতে আ’লা হযরত, ১ম খণ্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা এবং হযরত কাজী সানা উল্লাহ্ পানিপথী
রহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত: আস্সায়দুল মাসলুল, পৃষ্ঠা ৫২৭-৫২৮।]
সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, গাউসুল আযম এটা বেলায়তের সর্বোচ্চ পদ। এটাকে গাউসিয়তে কুবরা বা গাউসিয়তে উজমাও বলা হয়। এটা আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত উপাধি। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে করেন তাঁকে এ মহা বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেন। নেক আমলের দ্বারা এ মর্যাদা অর্জন করা যায় না। তাই প্রত্যেক যুগের সমস্ত গাউস, কুতুব, আবদাল বেলায়তের এ সব স্তরে পৌঁছতে গাউসুল আযম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ফুয়ূজাত ও বারাকাতের দিকে মুখাপেক্ষী।
যেমন আল্লামা আবদুল কাদির আরবুলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত ‘তাফরীহুল খাতির’ (تفريح الخاطر)কিতাবে উল্লেখ আছে যে, سيدنا عبد القادر الشيخ السيد عبد الاعظم لانه كلما ذكر الغوث فالمراد به هو رضى الله عنه لانه مخاطب من الحق به كذا ذكر فى الغوثية অর্থাৎ হযরত শায়খ সায়্যিদ আবদুল কাদির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর মহানবান্দা। কারণ, যখন ‘আল্ গাউস’ বলে স্মরণ করা হয় তখন তা দ্বারা শুধু তাঁকেই বুঝানো হয়। কারণ, তিনি এ উপাধি আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হন।
উক্ত গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, যখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কোন বান্দাকে ‘বেলায়ত’ বা অলী করতে চান তখন এ বলে নির্দেশ দেয়া হয় যে, ان ياخذوه بحضور المصفطى صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ তাঁকে হুজূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পেশ করা হোক। যখন তাঁকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পেশ করা হয় তখন হুজূর আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন خذوه الى ولدى لسيد عبد القادر يرى لياقته واستحقاقه بمنصب الولاية অর্থাৎ তাঁকে আমার প্রিয় আওলাদ আস্সায়্যিদ আবদুল কাদির এর কাছে নিয়ে যাও, তিনি তাঁর যোগ্যতা দেখেন এবং এও দেখেন যে, সে এ পদের উপযুক্ত কি না। হুকুম মত তাঁকে হযরত গাউসুল আযম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র খিদমতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ওই ব্যক্তিকে বেলায়তের উপযুক্ত দেখলে তাঁর নাম অলীদের দফতরে লিখে সীল মেরে দেন। তারপর তাঁকে হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত করা হয় আর হুজূর গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর লিখা মুতাবিক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নির্দেশ মত তাঁকে বেলায়তের পোশাক পরিধান করানো হয়, যা হুজূর গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহুঞ্চর পবিত্র হাত দিয়ে দান করা হয়। সে ওই পোশাক পরে নেন এবং অদৃশ্য ও দৃশ্য সকল জগতে তিনি আল্লাহর অলী হিসেবে মান্যবর ও গ্রহণীয় হয়ে যান। فهذه العهدة متعلقة بحضرة الغوث الى يوم القيامة وليس لاحد من الاولياء الكرام مماثلة ومشاركة مع الغوث فى هذا المقام ففى كل عصر وزمان تستفيض من حضرته الاقطاب والغوث وجميع الاولياء অর্থাৎ সুতরাং, এ মর্যাদায় কিয়ামত পর্যন্ত হযরত গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু অধিষ্ঠিত থাকবেন। এ মর্যাদায় কোন অলী তাঁর সমকক্ষ ও অংশীদার নেই। প্রত্যেক যুগের গাউসগণ, কুতুবগণ ও সমস্ত অলীআল্লাহ্ তাঁর থেকে কল্যাণ ও বরকত লাভ করতে থাকবেন।
[ইমাম আবদুল কাদির আরবুলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত ‘তাফরীহুল খাতির’ পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯ মিসর থেকে মুদ্রিত]
এদিকে ইঙ্গিত করে হযরত গাউসে পাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর স্বীয় এক কসীদায় এরশাদ করেছেন-
افلت شموس الاولين وشمسنا ابدًا على افق العلى لا تغرب
অর্থাৎ আমার পূর্ববর্তী সকল অলীগণের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে, কিন্তু বেলায়তের আকাশে আমি আবদুল কাদির জিলানীর সূর্য কখনো অস্তমিত হবে না। অর্থাৎ আমার গাউসিয়তের ফুয়ূজাত কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা জারী থাকবে।
[মাযহারে জামালে মোস্তফায়ী কৃত. সৈয়দ নাসিরুদ্দিন হাশেমী]
উল্লেখ্য যে, সাহায্যকারী, মুশকিল আসানকারী, বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণদানকারী অভাব মোচনকারী ও প্রয়োজন পূরণকারী হাকীকত বা প্রকৃত অর্থে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহূর বিশেষ গুণ- এ কথা চির সত্য। প্রত্যেক প্রকৃত ঈমানদারের আক্বীদা-বিশ্বাসও এরকমই। তবে আল্লাহর প্রিয় অলী ও বন্ধুগণ আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা বলে আল্লাহর খাস দয়ায় আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি তাঁরা ইন্তিকালের আগে ও পরে বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য করে থাকেন, বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণ দিয়ে থাকেন। প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন। এটা (مجاز �মাজায ) বা রূপক অর্থে ব্যবহৃত। যা কোরআন-সুন্নাহ ও শরীয়ত সমর্থিত। যেমন বর্তমানেও আরব বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যার জিম্মায় প্রবাসীরা কাজ-কর্ম ও চাকুরি ইত্যাদি করে থাকেন, তাকে কাফীল (كفيل) বলা হয় এটাও মাজায বা রূপক অর্থে। তদুপরি সহীহ বুখারী শরীফে হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু কতর্ৃৃক বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে মহান রব্বুল আলামীন এরশাদ করেন যে, আমার প্রিয় বান্দাগণ বেশি বেশি নফল এবাদতসমূহের মাধ্যমে যখন আমার প্রিয় পাত্র হয়ে যান- তখন আমি তাঁর হাত হয়ে যাই, যে হাত দিয়ে সে ধরে, আমি তার পা হয়ে যাই, যে পা দিয়ে সে চলাফেরা করে, আমি তাঁর কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শুনে এবং আমি তার চক্ষু হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে। -[মিশকাত ও সহীহ্ বোখঅরী, ২য় খন্ড.পৃ. ৯৬৩]
সুতরাং, উপরোক্ত বিশেষণসমূহ আল্লাহর প্রিয় বন্ধু তথা হক্কানী অলী, গাউস, কুতুব, আবদালের জন্য ব্যবহার করা শির্ক বা অবৈধ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। বরং এর উপর আপত্তি করাটা নিছক মুর্খতার নামান্তর। তবে এ জাতীয় বিশেষণ দ্বারা আউলিয়ায়ে কেরামকে ভূষিত করা হক্কানী আউলিয়া কেরামের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ কুদরাত বা ক্ষমতা ও দয়া প্রকাশই উদ্দেশ্য। যেহেতু আল্লাহর খাস বান্দাগণ আল্লাহর কুদরত ও মহিমার প্রকাশস্থল। তথা তাঁরা হলেন মাযহারে জামালে ইলাহী। সুতরাং এ জাতীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করে কোরআন হাদীস, তাফসীর, ফিক্ব্হ্-ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ পর্যালোচনা করার নিবেদন রইল। পরম করুণাময় সবাইকে প্রকৃত আউলিয়ায়ে কেরামের শান-মান বুঝার তাওফীক দান করুন।
[মসনবী শরীফ, কৃত: ইমাম জালালুদ্দীন রূমী ও মালফূজাতে আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইত্যাদি।]
উল্লেখ্য যে, যাকে তাকে গাউসূল আযম বলা আর কেউ না বললে তাকে গুন্ডাবাহিনী দ্বারা রক্তাক্ত করে দেয়া সম্পূর্ণ ভণ্ডামী এবং শরিয়ত তরিকতের নামে এক মহাকলঙ্ক। তাদের খপ্পর ও ষড়যন্ত্র হতে দুরে থাকার পরামর্শ রইল।
[সূত্র. যুগ-জিজ্ঞাসা, পৃ.২৩-২৭]