মহানবী (দ:) কি আইএস/আইসিস সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক করেছিলেন?
মূল: কাশেফ এন, চৌধুরী (পাকিস্তান)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
প্রকাশক: হাফিংটন পোস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গত সপ্তাহে (জুন ২০১৫’এর শেষ সপ্তাহে) আইএস/অাইসিস (ইসলামিক স্টেট) সন্ত্রাসীরা পৃথক পৃথক হামলায় তিউনিশিয়ার সমুদ্র সৈকতের পর্যটন এলাকায় ৩৯ জন পর্যটককে এবং কুয়েতের একটি শিয়া মসজিদে প্রায় ৩০ জন মুসুল্লীকে হত্যা করে [এই সময় অনুরূপ আরেক হামলায় ফ্রান্সেও কয়েকজনকে তারা হত্যা করে - অনুবাদক]। রমজান মাসে সহিংসতা বৃদ্ধির জন্যে আইএস/আইসিস-এর প্রতি সহানুভূতিশীল জঙ্গি জ্বেহাদী দলগুলোর প্রতি আইএস/আইসিস-এর আহ্বানের পরপরই এই হামলার ঘটনা ঘটে।
আইএস/অাইসিস তার সাথে দ্বিমত পোষণের দুঃসাহস প্রদর্শনকারী যে কাউকে নির্মূল করার এক নিঃশঙ্ক দৃঢ়সংকল্প এসব কর্মকাণ্ডে ব্যক্ত করেছে। এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা এয়াজিদী ও খৃষ্টানদের হত্যা করেছে, কিন্তু তাদের হাতে নিহত সংখ্যাগরিষ্ঠ-ই হলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ, যে মুসলমান জনগোষ্ঠী আইএস/আইসিস-এর বিরোধিতা করেন এবং তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। আইএস/আইসিস এমন কি সেসব সুন্নী আকীদা পোষণকারী আলেমকেও হত্যা করেছে, যাঁরা তাদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেননি; আর সেসব নারীকেও হত্যা করা হয়েছে যারা আইএস/আইসিস-এর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হননি।
ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে এমন সকল সন্ত্রাসীদলের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য সর্বজনীন। উদাহরণস্বরূপ, (আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে) তালেবানের হাতে নিহতদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। গত কয়েক বছরে শত শত শিয়া সম্প্রদায়ের লোককে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও আমি হারিয়েছি, যারা পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, এমন কি আমেরিকায়ও এ ধরনের হামলার শিকার হন।
কাজেই, ইসলাম ধর্মের কট্টর সমালোচকরা যখন একগুঁয়েভাবে আমাদের মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাসকে আমাদেরই নিপীড়ক/নির্যাতকদের (মানে আইএস/আইসিস-এর) সহিংস কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট দেখাতে চান, তখন আমরা তাদের এই সংবেদনহীনতার প্রতি সোচ্চার হই।
আমি অবশ্য অস্বীকার করি না যে ধর্মীয় উগ্রতায় উৎসাহদানের একটি অংশ প্রোথিত রয়েছে সংস্কারবাদী উগ্রপন্থীদের প্রদত্ত শাস্ত্রলিপির বিকৃত ব্যাখ্যার গভীরে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যাঁরা এই সমস্ত অপব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁদেরকে ‘অধার্মিক’ বা ‘নগণ্য তথা সংখ্যালঘু’ বলাটা অসততা ছাড়া কিছু নয়। [লিংক - http://blogs.tribune.com.pk/story/24440/i-disagree-with-sam-harris-and-bill-maher/]
কুরআন মজীদের একনিষ্ঠ অধ্যয়নে দেখা যায়, আইএস-এর মতো দলগুলো ইসলামী বিধিবিধানের সম্পূর্ণ খেলাফ মতবাদের অনুসারী। উদাহরণস্বরূপ, আল-কুরআনে একটি হত্যাকে সমগ্র মানবজাতির হত্যার সমতুল্য বলা হয়েছে (৫:৩২)। আর এই ঐশীগ্রন্থে পৃথিবীর বুকে জুলুম ও ফিতনাকে আরও জঘন্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে (২:২১৭)। এটি শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। বস্তুতঃ আল-কুরআন বিবেকের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের আহাদীস অধ্যয়ন করলেও দেখা যায়, তিনি এই পরবর্তী যুগে ধর্মীয় উগ্রতা বৃদ্ধির ব্যাপারে বিস্তারিত বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে আমাদের সতর্ক করেছিলেন।
চৌদ্দ’শ বছর আগে মহানবী (দ:) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পৃথিবীতে এমন এক সময় আসবে যখন ইসলাম ধর্ম হবে নাম-সর্বস্ব; কুরআন থাকবে শুধু বাক্যে; আর অনেক মসজিদ নির্মিত হবে ইমারতী শান-শওকতপূর্ণ, কিন্তু সেগুলো হবে হেদায়াতশূন্য [আরেক কথায়, গোমরাহীপূর্ণ; হোদায়াতের আলো না থাকলে গোমরাহীর অন্ধকার - অনুবাদক]। এই হাদীস মেশকাতুল মাসাবিহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। অর্থাৎ, আজকের এই শেষ জমানায় ইসলামের প্রকৃত আধ্যাত্মিক মর্মবাণী হারিয়ে যাবে, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে আনুষ্ঠানিকতায়। বিশ্বনবী (দ:) আরও ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এই সময়কার আলেম-উলেমাবর্গ পথভ্রষ্ট হবে এবং ফিতনা-ফ্যাসাদেরও উৎস হবে। কী সত্য তাঁর এ বাণী এই মর্মে যে মুসলিম বিশ্বের কিছু কিছু অংশে উগ্রপন্থী মোল্লা-মৌলভীরা মসজিদের মিম্বরের অপব্যবহার করে বিভক্তি ও হিংসা-বিদ্বেষ প্রচার করে বেড়াচ্ছে!
হুযূর পূর নূর (দ:) আরও ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে আইএস/আইসিস-এর মতো সন্ত্রাসী দলগুলো ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসকে ‘হাইজ্যাক’ করতে চাইবে। তিনি বলেন, ফিতনার ওই যুগে “অল্পবয়সী তরুণদের একটি দলের আবির্ভাব হবে যারা চিন্তায় হবে অপরিপক্ক এবং বেওকুফ।” [মুসলিম শরীফের হাদীসের লিংক - http://sunnah.com/muslim/12/199] তারা সুন্দর সুন্দর কথা বলবে, কিন্তু জঘন্য সব কাজ করবে। তাদের নামায-রোযা এতো বেশি বেশি হবে যে (এমন কি প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মা) মুসলমানদের ’এবাদত/আমল’-কেও তার তুলনায় নগণ্য মনে হবে। মানুষদেরকে তারা আল-কুরআনের দিকে আহ্বান করবে, কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে এই ঐশীগ্রন্থের সাথে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতাই থাকবে না। কুরআন মজীদের মর্মবাণী তাদের কণ্ঠনালির নিচে প্রবিষ্ট হবে না (অর্থাৎ, অন্তরে প্রবিষ্ট হবে না)। এর মানে হলো, তারা আল-কুরঅানের বাণী উপলব্ধি করতে অক্ষম হবে; স্রেফ কিছু বেছে নেয়া বাণী উৎসারিত করা ব্যতিরেকে। মহানবী (দ:) এরপর এই সব লোকদেরকে “সৃষ্টিকুলে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি” বলে আখ্যায়িত করেন। [মুসলিম শরীফের হাদীসের লিংক - http://sunnah.com/muslim/12/206]
এই সতর্কবাণীর পাশাপাশি একে সমর্থন দেয়ার মতো আরেকটি রেওয়ায়াত মুসলিম শরীফের ‘কিতাবুল ফিতান’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে; তাতে ইসলামের ৪র্থ খলীফা হযরত আলী (ক:) বলেন, এই সকল লোকদের চুল বড় বড় হবে এবং তাদের হাতে থাকবে কালো পতাকা। তাদের অন্তর হবে ‘লোহার মতো কঠিন’; আর তারা হবে ‘আসহাব-উদ-দাওলাহ’ তথা একটি স্টেট/রাজ্যের সাথী। কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, আইএস/আইসিস নিজেদেরকে ইসলামিক স্টেট বা দাওলাহ বলে দাবি করে থাকে। এই রেওয়ায়াতে আরও বিবৃত হয় যে তারা তাদের ওয়াদা খেলাফ করবে, সত্য বলবে না এবং তাদের নাম হবে তাদের শহরের নামের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। আইএসআইএস-এর খলীফা আবূ বকর আল-বাগদাদীর নাম এখানে স্মর্তব্য।
রাসূলুল্লাহ (দ:) অত্যন্ত জোরালোভাবে ও কষ্ট করে এসব পাপ সংঘটনকারী সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে এদের বদমাইশি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছেন; আর তিনি এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন, “যে কেউ এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সে এদের চেয়ে আল্লাহর দৃষ্টিতে উত্তম।”
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে একটু ভাবুন। আইএস/আইসিস, তার সমর্থক বা ইসলামবিরোধী উগ্রপন্থীরা যখন ইসলামের নামে হত্যাকাণ্ড সংঘটন করে, আল-কুরআন অনুসরণের দাবি করে, কিংবা পবিত্র রমজান মাসকে সারা বিশ্বে নৈরাজ্য বিস্তারের অজুহাত হিসেবে অপব্যবহার করে, তখনি জানবেন মহানবী (দ:) আমাদেরকে এসব ভণ্ড লোক সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন এবং এদেরকে নির্মূল করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ-ও দিয়েছেন।
আইএস/আইসিস, তার সমর্থক ও ইসলামবিরোধী উগ্রপন্থীরাই এই বিষয়টি সম্পর্কে ভাবতে নারাজ। তারা চায় সারা বিশ্বকে এ কথা বোঝাতে যে আইএস/আইসিস বৈধ। কিন্তু বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ মানুষেরা এ বিষয়ে মহানবী (দ:)-এর আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা ও দিব্যদৃষ্টি সম্যক উপলব্ধি করেন এবং অজ্ঞতা ও উগ্রপন্থা উভয়ের বিরুদ্ধেই ঐক্যবদ্ধ থাকেন।
সমাপ্ত