*** দরসে হাদিস ***
ইসলামে হালাল উপার্জন ফরয =
عَنْ عبد الله بن مسعود رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة [رواه البيهقى]
অনুবাদ : হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হালাল রুজি উপার্জন করা ফরজের পর একটি ফরজ। [বায়হাকী শরীফ]
রাবী পরিচিতিঃ
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। তাঁর নাম আবদুল্লাহ্, উপনাম আবু আবদুর রহমান আল হুযালী, তিনি বনু হুযায়ল গোত্রের লোক। পিতার নাম মাসঊদ ইবনে গাফেল, মাতার নাম উম্মে আবদ, তিনি প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী মহামর্যাদাবান সাহাবী। মুসলমান হওয়ার দিক থেকে তিনি ষষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি বদর যুদ্ধসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি হযরত ফারুক আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আগে মুসলমান হন। প্রিয় রসূলের একনিষ্ঠ খাদিম ছিলেন, হুযূরের নালাইন শরীফ, জুতা মুবারক বহনকারী সাহাবী ছিলেন। সফরে হুযূরের বরকতময় মিসওয়াক ও পানির পাত্র বহনকারী ছিলেন। হযরত ফারুকে আযমের খিলাফতকালে তিনি কুফার বিচারপতি ও বায়তুল মালের তত্বাবধায়ক ছিলেন।
তিনি প্রথমে হাবশায় পরে মদীনায় হিজরত করেন। তিনিই প্রথম মক্কা শরীফে কাফিরদের সম্মুখে প্রকাশ্যে নির্ভয়ে কুরআন তিলাওয়াত করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের সব বিষয়ে তাঁকে অবগত হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এ কারণে তাঁকে ‘মহিবুস্ সির’ বা রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের গোপন বিষয়ক ধারক বলা হতো। দৈহিক দিক থেকে অত্যন্ত হালকা পাতলা দেহের অধিকারী ছিলেন, এতো অধিক লম্বা ছিলেন বসাবস্থায়ও সাধারণ মানুষের দাঁড়ানোর সমান দেখা যেতো। ৬০ বছরের অধিক হায়াত লাভ করেন। ৩২ হিজরি মোতাবেক ৬৫২ খিস্টাব্দে মদীনা তৈয়্যবায় ওফাতপ্রাপ্ত হন। জান্নাতুল বাক্বীতে তাঁকে দাফন করা হয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের বড় ফক্বীহ্ আলিম সাহাবী তিনিই ছিলেন। ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁকেই অনুসরণ করেন। তিনি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে ৮৪৬ টি হাদীস বর্ণনা করেন, তন্মধ্যে বোখারী ও মুসলিমে ৬৮টি। ইমাম বুখারী এককভাবে ২১টি, ইমাম মুসলিম ৩৫টি হাদীস স্ব-স্ব কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন। [সূত্র. মিরআতুল মানাজীহ্, ১ম খন্ড, পৃ. ৬৫]
প্রাসঙ্গিক আলোচনাঃ
মানব জাতির ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য ইসলাম অনুপম সুন্দর ও কল্যাণকর বিধান পেশ করেছে। এতে রয়েছে হালাল ও হারামের বিস্তারিত বিবরণ। যা অনুসরণ করা বা মেনে চলা একজন মু’মিন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
মানব জীবনে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ
কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ যেভাবে মানব জীবনে ইসলামী বিধানের অপরিহার্য বিষয়। তেমনিভাবে হালাল উপার্জনের বিষয়ও আবশ্যক। কুরআন সুন্নাহ্ তথা ইসলামী শরিয়তে হালাল উপার্জনের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হালাল রিযক্বের গুরুত্ব এতই বেশী যে, হালাল রুজি ছাড়া হারাম পন্থায় উপার্জিত অর্থ দ্বারা পুষ্ট দেহ নিয়ে কোন প্রকার ইবাদতই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
لاَيَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّى بالحرام
অর্থ: যেই শরীর হারাম খেয়ে পুষ্ট হয়েছে তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত দেহ জাহান্নামে যাবে।
আল্লাহর দরবারে ইবাদত কবুলের জন্য হালাল উপার্জন ও হালাল রুজি গ্রহণ শর্ত করা হয়েছে। একজন মু’মিন মুসলমানকে ঈমান ও ইসলামের দাবী অনুসারে জীবনের সর্বক্ষেত্রে হালাল তথা বৈধপন্থায় জীবন যাপন, হালাল পন্থা অনুসরণ, হালাল পণ্য গ্রহণ, হালাল রুজি ভক্ষণ, একান্ত অপরিহার্য। অন্যথায় হারাম উপায়ে উপার্জিত ধন সম্পদ দিয়ে গঠিত শারীরিক সুস্থতা, ইহকালীন সুখ শান্তি, উন্নতি প্রাচুর্যতা, বিলাসিতা যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক, তাকে পরকালীন ভয়াবহ করুণ পরিণতি ভোগ করতেই হবে। হারাম উপার্জন ও রুজি রোজগারের অপরাধে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের অগ্নিশিখায় প্রজ্জলিত হতে হবে।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن جابر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لايدخل الجنة لحم نبث من السحت وكل لحم نبت من السحت كانت النار اولى به [رواه احمد والبيهقى]
অর্থ: হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে মাংস হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, হারাম খাদ্যে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামের আগুনই উত্তম। [আহমদ ও বায়হাক্বী]
হারাম পানাহার শরীর নিয়ে ইবাদত কবুল হবে না
নিজেকে মুসলমান দাবী করে হালাল-হারামের মধ্যে পার্থক্য না করা, জেনে শুনে যত্রতত্র হারাম বস্তু আহার করা, হারামকে হালাল মনে করা জঘন্যতম অপরাধের শামিল যা সমুদয় আমল বিনষ্ট করবে এবং মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
প্রত্যেক সম্মানিত নবী-রসূল স্বীয় উম্মতদেরকে হারাম বস্তু পরিহার করা ও হালাল বস্তু গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশিত সম্মানিত নবী-রসূলগণ প্রদর্শিত মহান সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত নীতি আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণেই মানব জাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله طيب لا يقبل الا طيبًا وان الله امر المؤمنين بما امر به المرسلين فقال يا ايها الرسل كلوا من الطيبات واعملوا صلحًا وقال تعالى يا ايها الذين امنوا كلوا من طيبات مارزقنكم ثم ذكر الرجل يطيل الشغر اشعث اغبر يمدّ يديه الى السماء يا رب ومطعمه حرام ومشربه حرام وملبسه حرام وغذى بالحرام فانى يستجاب لذالك (رواه مسلم)
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ মুমীনদেরকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন, যা তিনি দিয়েছেন রসূলদেরকে। আল্লাহ্ বলেন, হে রসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে খাবার গ্রহণ করো এবং সৎকর্ম সম্পাদন করো।
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন, হে মু’মিনগণ, তোমাদের প্রতি আমার প্রদত্ত পবিত্র রিযক্ব ভক্ষণ করো,
অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তি প্রসঙ্গে উল্লেখ করলেন, যিনি দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ধুলিবালি অবস্থায় দু’হাত আসমানের দিকে উত্তোলন করে দুআ করে বলে হে আল্লাহ্! অথচ তার খাদ্য পানীয় ও পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই হারাম উপার্জনের এমনকি সে হারাম খাদ্য দ্বারাই জীবন ধারণ করেছে। সুতরাং তার দুআ কি করে কবুল হবে? [সহীহ্ মুসলিম]
উপার্জনে হালাল-হারাম বিবেচনা দরকার
আজকের সমাজ ব্যবস্থায়, নীতি-নৈতিকতা নির্বাসিত। কুরআন সুন্নাহ্ তথা ইসলামী শরীয়াহ্ মৌলিক নীতিমালা ও নির্দেশনা সর্বত্র আজ উপেক্ষিত, অভিশপ্ত শয়তানের প্ররোচনা আজ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কৃষক, শ্রমিক, আইনজীবি, পেশাজীবী ব্যবসায়ী ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক-ছাত্র, অভিভাবক, সকল শ্রেণির ও পেশার মানুষেরা ধর্মীয় বিধি-বিধান ও অনুশাসন প্রতিপালনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শয়তানি প্ররোচনায় প্রভাবিত। জীবন-জীবিকা অন্বেষণে, হালাল-হারামের পার্থক্য বিধানে চরম উদাসীন, খাও দাও ফুর্তি করো, ভোগবাদী নীতিতে বিশ্বাসী মুসলমানের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ত্যাগী, মহৎগুণ ও আদর্শ মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালনে অবহেলা, উদাসীনতা, ফাঁকি বাজির মানসিকতা, স্ব-স্ব কর্মস্থলে আগমন-প্রস্থানে নিয়মনীতি না মানার প্রবণতা, পেশাগত দায়িত্ব পালনে মিথ্যাচার, শটতা, কপটতা ইত্যাদি অসৎ প্রবণতা, মানব জীবনকে কলুষিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে অথচ অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ ও আর্থিক উপকারিতা গ্রহণ এসবই হারাম উপার্জনের নামান্তর। আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানব জাতির জীবন চলার পথে, যা কল্যাণকর তা গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। যা কিছু অপবিত্র, ক্ষতিকর, অকল্যাণকর তা বর্জন করা অপরিহার্য।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
سياتى زمان على الناس لايبالى المرء اخذ
من الحلال ام من الحرام
অর্থ: মানুষের নিকট এমন এক জমানা আসবে যখন তারা হালাল হারাম-বাছ-বিচার না করে উপার্জন করবে।
[বুখারী শরীফ]
হারাম উপার্জন জাহান্নামের পাথেয়
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে বান্দা হারাম সম্পদ উপার্জন করে, যদিও সে সাদকা করে তা কবুল করা হবে না। আর যদি ব্যয় করে তবে তাতেও কোন বরকত হবে না। আর যদি রেখে মারা যায় তা জাহান্নামে যাওয়ার পাথেয় হব। আল্লাহ্ তা‘আলা মন্দ (কাজ) দ্বারা মন্দকে মিঠিয়ে দেন না, হ্যাঁ ভাল কাজ দ্বারা মন্দকে মিঠিয়ে দেন, নিঃসন্দেহে নাপাকীকে নাপাকী দূরীভুত করতে পারে না। [মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৬৭২]
হারাম উপার্জনের অশুভ পরিণতি
হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রণীত মুকাশাফাতুল কুলুব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, মানুষের পেটে যখন হারাম লোকমা পড়ে তখন আসমান ও যমীনের সকল ফিরিশতা তার উপর লানত দিতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা তার পেটে থাকবে। আর যদি এ অবস্থায় মৃত্যু চলে আসে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
[মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃ. ১০]
হাদীস শরীফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, সবচেয়ে পবিত্র আহার তা, যা তুমি নিজের উপার্জন হতে আহার করো। [তিরমিযী, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৩৬৩]
প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলা পেশাজীবী মুসলমানদের ভালবাসেন। [মুজাম আওসাত, হাদীস ৮৯৩৪]
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ফত্ওয়ায়ে রজভীয়্যাহ্ ১৯তম খন্ডের ৪০৭ পৃষ্ঠায় উপার্জনে সতর্কতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কর্মচারী চাকুরিতে অলসতার সাথে কাজ করে তাহলে গুনাহ্গার হবে। কর্মচারীর অলসতা বা অনর্থক ছুটি কাটানোতে যদি মালিকের বা প্রতিষ্ঠানের কাজের ক্ষতি হয় কাজে যতটুকু পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে পরিমাণ টাকা বেতন থেকে কেটে নেবে। আল্লাহর নিকট তাওবা করবে। মালিকের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেবে। কর্মকর্তা, কর্মচারী কাজ কম করা সত্ত্বেও যদি পূর্ণ বেতন গ্রহণ করে গুনাহ্গার হবে। জাহান্নামের আযাবের হকদার হবে। আল্লাহ্ আমাদেরকে হালাল উপার্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।