★দরসে হাদিসঃ
ইসলামে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক 
عَنْ ابى ذر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اخوانكم جعلهم الله تحت ايديكم فمن جَعَلَ الله اخاه تحت يديه فليطعمه ممَّا يأكل وليلبسه مِمَّا يَلْبَسْ وَلَا يَكلفه من العمل ما يغلبه فان كلفهُ مَا يغلبه فَلْيُعِنْهُ عَليه- (متفق عليه)
অনুবাদ: হযরত আবু যার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, তারা (অধীনস্থ ব্যক্তিবর্গ) তোমাদের ভাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ্ যার ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, সে তার ভাইকে যেন তাই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়। এবং তাকে যেন তাই পরিধান করায় যা সে নিজে পরিধান করে। তার সাধ্যের অতিরিক্ত যেন কোন কাজ তার উপর না চাপায়। একান্ত যদি সেই কাজ তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়। তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।
 [বুখারী ও মুসলিম শরীফ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি কল্যাণকর নির্দেশনা উম্মতের জন্য উপস্থাপন করেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন কল্যাণ ও সমৃদ্ধি অর্জনে শ্রমিক ও মালিকের গুরুত্ব ও অবদান অপরিহার্য। মালিকের পুঁজি বিনিয়োগ ও শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে দেশ ও রাষ্ট্র উন্নত সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়।

ইসলাম সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে এ দু’ শ্রেনির পারস্পরিক সম্পর্ককে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। যে সম্পর্কের অবনতি হলে দেশ রাষ্ট্র ও জাতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। জনগণের সুখ-শান্তি বিঘিœত হবে। ইসলামী বিধানের অনুসরনে শ্রমনীতি বাস্তবায়িত ও অনুসৃত হলে শ্রমিকের ও মালিকের মধ্যে দূরত্ব থাকবে না, অসন্তোষ থাকবে না, শ্রমিক তাঁর ন্যায্য পাওনা যথারীতি ভোগ করতে পারলে উন্নয়ন তরান্বিত হবে, মালিক উপকৃত হবে।
শ্রমিক তার হক্ব তথা অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তার ন্যায্য পাওনা পরিশোধে বিভিন্ন কুটকৌশলের আশ্রয় নিলে বিভিন্ন অজুহাত ও বাহানা করে মালিক যদি শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধে প্রতারণা ও মিথ্যাচার করে মালিকের প্রতি শ্রমিকের ঘৃণা ও ক্ষোভ, অসম্মান-অশ্রদ্ধা সৃষ্টি হবে। ফলশ্রুতিতে এক পর্যায়ে প্রকৃত পক্ষে মালিকই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। একজন ধিকৃত ও নিন্দিত লোক হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর সূদুর প্রসারী প্রভাব পড়বে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর। এজন্য শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শ্রমের মর্যাদা নিরূপণে মানবতার নবী মুক্তির দিশারী রাহমাতুল্লীল আলামীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন-
عن ابن عمر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اُعْطُوْ الاجيرا اجرَهُ قَبْلَ اَنْ يَجِفُّ عِرْقُهُ- (رواه ابن ماجه)
হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তাঁর পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।
[ইবনে মাযাহ্ শরীফ]

আল্ ক্বোরআনে শ্রমিকের প্রশংসা
মহাগ্রন্থ আল্ ক্বোরআনুল করীমের বিভিন্ন আয়াত ও প্রিয়নবীর অসংখ্য হাদীস শরীফে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। নি¤œ বর্ণিত আয়াতে বিশ্বস্ত সুদক্ষ শক্তিমান শ্রমিকের প্রশংসা করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
اِنَّ خَيْرَ مَنْ اَسْتَاجَرْتَ القوىّ الامين-
অর্থ: ‘‘নিশ্চয় সর্বোত্তম শ্রমিক সে-ই যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। [সূরা কাসাস] বর্ণিত আয়াতে শ্রমিকের দুটো গুণ বর্ণিত হয়েছে, এক. কর্ম সম্পাদনে শক্তিমান ও সুদক্ষ হবে এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হবে।
দুই. মালিকের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিশ্বাস আস্থাভাজন হওয়ার পরিচয় দেবে। অর্থাৎ অর্পিত দায়িত্বটি তার উপর একটি আমানত স্বরূপ তা যথাযথ আদায় করলে সময়সূচি অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হলে দায়িত্ব পালনে কোন প্রকার গোজামিল, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সময়ের অপব্যবহার বা অপচয় থেকে বিরত থেকে দায়িত্বের প্রতি পূর্ণমাত্রায় আন্তরিক হলে তিনি একজন বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন শ্রমিক হিসেবেই গণ্য হবেন।
যে শ্রমিক মালিকের প্রদত্ত দায়িত্ব উত্তমরূপে পালন করে হাদীস শরীফে তাঁর জন্য উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
اذا نصح العبد سيده واحسن عبادة ربه كان له اجره مرّتين-
অর্থাৎ কোন দাস (শ্রমিক) তার মুনীব প্রদত্ত দায়িত্ব উত্তমরূপে পালন করে এবং উত্তমরূপে তাঁর প্রভুর ইবাদত করে তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। [বুখারী শরীফ]

শ্রমিকের মজুরী প্রদানে গড়িমসি করা অপরাধ 
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন তিন শ্রেণির মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহর দুশমন হবে। ঐ তিন শ্রেণির এক শ্রেণি হলো এমন ব্যক্তি যে শ্রমিকের মজুরী যথাযথ ভাবে প্রদান করেনা এরশাদ হয়েছে
رجل اساجر اجيرا فاستوفى منه ولم يعطه اجره – (رواه البخارى)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে নিজের কাজ পুরোপুরি আদায় করে নেয় কিন্তু শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেয়না।
[বুখারী শরীফ]

শ্রমিকের উপার্জন শ্রেষ্ঠ উপার্জন
এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা শ্রমিকের প্রতি অবহেলা করে তাদের পেশাকে তুচ্ছ মনে করে। তাদেরকে অবজ্ঞা ও অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। অথচ আল্লাহর প্রেরিত সকল সম্মানিত নবী ও রসূল আলায়হিমুস্ সলাম এক একজন উত্তম পেশা অবলম্বন করেছেন। নিজেদের দৈহিক-কায়িক শ্রম দিয়ে কঠোর মেহনত ও শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অবলম্বন করেন। বিনাশ্রমে কেউ কারো উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। ইহলৌকিক-পারলৌকিক উভয় জগতে মর্যাদাবান আল্লাহ্র প্রিয়ভাজন মর্যাদামন্ডিত নবী রাসূলের পদ মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পরও শ্রম দিয়ে দুনিয়ার বুকে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক অনুপম অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এরশাদ হয়েছে-
عن مقداد بن معديكرب رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما اكل احدٌ طعاما قط خيرًا من ان يَاكُلَ من عمل يديه وان نبىّ اللهِ اودَ كان يَاْكُلَ من عمل يد يه- (رواه البخارى)
অর্থাৎ হযরত মিকদাদ ইবনে মাদিকারব রািদ্বয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিজের হাতে উপার্জন করা খাবারের চেয়ে উত্তম খাবার তোমাদের কেউ কখনো খায় না। আল্লাহর নবী যহরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম নিজের হাতে উপার্জন করে খাবার খেতেন। [সহীহ বুখারী শরীফ]

সম্মানিত নবী-রাসূলগণের সকলে ছিলেন পরিশ্রমী ও শ্রমকর্মে নিয়োজিত আদর্শের মডেল।
হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম পৃথিবী পৃষ্টে সর্বপ্রথম কৃষিজীবি হিসেবে কৃষি কাজের সূচনা করেন।
হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম জাহাজ ও নৌকা শিল্প স্থাপনে একজন প্রাজ্ঞ প্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী সম্মানিত নবী হিসেবে তাঁর শিল্পকর্মের আলোচনা ক্বোরআনে আলোচিত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
واصنع الفلك باعببننا ووحينا-
‘‘আর আপনি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশ মোতাবেক একটি নৌকা নির্মাণ করুন। [সূরা হুদ: আয়াত- ৩৭] হযরত কাতাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বর্ণনা মতে আল্লাহর নির্দেশ মতে হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক নির্মিত নৌকার দৈর্ঘ ছিল তিনশত হাত আর প্রস্থ ছিল পঞ্চাশ হাত।
[সূত্র: আবুল ফিদা ইবনে কাছীর আল বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া]

আল্লামা ছাওরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র বর্ণনা মতে হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে নৌকার ভিতর ও বাইরে আল কাতরা দ্বারা প্রলেপ দেন। আল্লাহর নবীর এ শিল্প কর্মের নমুনা যা আজো বিশ্বব্যাপী অনুসৃত হচ্ছে।
শ্রমিকের উপর কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া অন্যায়
ইসলাম শ্রমিকের উপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়াকে অনুমোদন করে না, এ আচরণ নিতান্তই অমানবিক। তবে মালিক যদি শ্রমিকের অতিরিক্ত বাড়তি কাজের মূল্যায়ন করে থাকে সেক্ষেত্রে শ্রমিক তা সম্পাদনে আন্তরিক হওয়া উচিত। মহান আল্লাহ্ তাঁর নবী হযরত শুয়াইব আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক নিযুক্ত শ্রমিকের প্রতি তাঁর সদয় আচরণ ও সহানুভূতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা এভাবে ব্যক্ত করেছেন।
এরশাদ হয়েছে-
وما اريد ان اشق عليك ستجد نى ان شاء الله من الصالحين-
অর্থাৎ আমি আপনার উপর অহেতুক কর্মের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। আল্লাহ্র ইচ্ছায় আপনি আমাকে সৎ কর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। [আল্ ক্বোরআন: ২৮: ২৭]

দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, আজকের সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকের প্রতি কোন প্রকার মানবিকতা, মহানুভবতা, উদারতা না থাকায় আজ কলকারখানা শিল্প ইন্ডাস্ট্রি, গামেন্টর্স শিল্প সহ সকল সেক্টরে শ্রমিক ধর্মঘট, সড়কপথ রেলপথ, নৌপথ অবরোধ, ভাংচুর দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হামলা-মামলা, নৈরাজ্য দ্বন্দ সংঘাতসহ সব ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাবলী সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র। তাই আসুন ইসলামী আদর্শের অনুসরনে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক উন্নয়নে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
Top