তাবলীগের কিতাব ফাযায়েলে আমাল বর্ণিত হাদিসঃ
"যদি তিনি [হযরত মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله و سلم)] না হতেন, তাহলে (হে আদম!) তোমাকেও সৃষ্টি করা হতো না"।

ফাযায়েলে আমালে মুবারাক হাদীসটি উক্ত শিরোনাম (Title)-এ আছে।
হাদীসটি নিম্নরূপঃ
عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لما أذنب آدم صلى الله عليه وسلم الذنب الذي أذنه رفع رأسه إلى العرش فقال أسألك حق محمد ألا غفرت لي فأوحى الله إليه وما محمد ومن محمد فقال تبارك اسمك لما لما خلقتني رفعت رأسي إلى عرشك فإذا هو مكتوب لا إله إلا الله محمد رسول الله فعلمت أنه ليس أحد أعظم عندك قدرا ممن جعلت اسمه مع اسمك فأوحى الله عز وجل إليه يا آدم إنه آخر النبيين من ذريتك وإن أمته آخر الأمم من ذريتك ولولاه يا آدم ما خلقتك
অনুবাদঃ ইমামুল মুর্সালীন হযরত নবী কারিম (صلى الله عليه و آله و سلم) ইরশাদ করেছেন, হযরত আদম আঃ থেকে সে অনিচ্ছাকৃত পদস্খলন সংঘটিত হয়, [যার দরূন তাঁকে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়, তখন তিনি সর্বদা কাঁদতে ছিলেন। আর ইস্তেগফার করতে ছিলেন।] তখন তিনি একবার আসমানের দিকে মুখ করলেন, আর বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (صلى الله عليه و آله و سلم)এঁর ওসীলায় আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তখন অহী নাজীল হয়-মুহাম্মদ কে? [যার অসীলা দিয়ে তুমি দুআ করছো?] তখন তিনি বলেন-যখন আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তখন আমি আরশে লেখা দেখলাম- "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্"। তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, হযরত মুহাম্মদ (صلى الله عليه و آله و سلم)এঁর চেয়ে সর্বোচ্চতর ব্যক্তিত্ব কেউ নেই যার নাম আপনি স্বীয় নামের সাথে রেখেছেন।
তখন অহী নাজীল হল-তিনি সর্বশেষ নবী। তোমার সন্তানদের অন্তর্ভূক্ত হবে। যদি তিনি না হতেন, তাহলে তোমাকেও সৃষ্টি করা হতো না।
[সূত্রঃ ফাযায়েলে আমাল, ৪৯৭, উর্দু এডিশন।]

পর্যালোচনাঃ
এ হাদীসের উপর লা মাযহাবী-রাফাদানী-সাইনবোর্ডধারী ভূঁয়া আহলে হাদিস-ওয়াহাবীদের উত্থাপিত প্রথম প্রশ্ন-
এ রেওয়ায়েত তথা বর্ণনাটি দুর্বল। বরং মওজু তথা জাল।
এ হাদীসের উপর উত্থাপিত দ্বিতীয় প্রশ্ন-
এ হাদীসটি কুরআনে কারীমের বিপরীত। কারণ কুরআন দ্বারা প্রমাণিত যে, হযরত আদম আঃ কে আল্লাহ তাআলা কিছু বাক্য শিখিয়েছিলেন, যখন তিনি তা পড়েছেন, তখন আল্লাহ তাআলা তার তওবা কবুল করেছেন।
আল্লাহ তাআলার বাণী-
فَتَلَقَّىٰ آدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
٢:٣٧
অর্থাৎঃ অতঃপর হযরত আদম (আঃ) স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি (করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহা-ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু।
[সূরা বাকারা, আয়াত নং-৩৭।]
অথচ উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, আদম আঃ রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর ওসীলায় দুআ করেছেন, তারপর তাঁর তওবা কবুল হয়, তাহলেতো এ হাদীস কুরআনের বিপরীত। তাই এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়।

এই হচ্ছে বর্তমান রাফাদানী ওয়াহাবীদের মোটের উপর দু'টি অভিযোগ।
এ দু’টি অভিযোগের জবাব নিম্নে দেয়া গেল।

উত্থাপিত ১ম অভিযোগের জবাবঃ
দাওয়াত ও তাবলীগের কিতাব ফাযায়েলে আমালে বর্ণিত এ বর্ণনাটি জাল। একথা আমরা কিছুতেই মানি না। তবে একথা মানি যে, এটা দুর্বল বর্ণনা, বর্ণনাকারী ব্যক্তিদের দূর্বলতার কারণে।
তবে এটা এমন দুর্বল হাদীস নয় যে, এটাকে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে দলিল হিসেবে পেশ করা যাবে না। বরং তা ফাযায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় (Acceptable) পর্যায়ের দুর্বল হাদীস।
নিম্ন বর্ণিত ওলামায়ে কেরাম উক্ত হাদীসটিকে দলিলযোগ্য বলে মত ব্যক্ত করেছেন-
০১-আল্লামা কাসতাল্লানী রহঃ : আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ-২/৫২৫,
০২-ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) : দালাইলুন নুবুওওয়াহ-৫/৪৮৯।
০৩-আল হাকিম-২/৬১৫।

তাহকীকঃ
______________
ইমাম তকী উদ্দীন সুবকী বলেন, হাদীসটি হাসান পর্যায়ের।
রেফারেন্সঃ
শিফা উস সাকাম-১২০
ইমাম হাকিম বলেন, হাদীসটি সহীহ।
রেফারেন্সঃ
আল মুসতাদরাক-২/৬১৫

ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ এর স্বীকৃতিঃ
_______________
যারা আজ এ অপপ্রচার করছে, সেই লা মাযহাবীদের শায়েখ ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ এই হাদীসটি তার কিতাবে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদি এটা ভিত্তিহীনই হতো, তবে কেন তিনি তা তার কিতাবে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন? তিনি কি জানতেন না, কোনটা সহীহ আর কোনটা বানোয়াট?
তিনি ‘যদি মুহাম্মাদ না হতেন, তবে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’-এ হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেন,
এ হাদীসটি পূর্বের কথাকে কথাকে শক্তিশালী করেছে।
রেফারেন্সঃ
মাজমু উল ফাতাওয়া- ২/১৫৯।
ভাবুন,
ভিত্তিহীন কোন কথা দিয়ে কি কোন কিছু শক্তিশালী করা যায়?

ইমাম ইবনু কাসীরের স্বীকৃতিঃ
________________________
ইমাম ইবনু কাসীর পরিস্কার বলেছেন, এই হাদীসটি মাওযু বা বানোয়াট নয়। এটা দ্বারা নির্দ্বিধায় দলীল প্রদান করা যাবে।
ইমাম ইবনু কাসীর বলেছেন, হাদীসের বর্ণনাকারী আব্দুর রাহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মিথ্যাবাদী নন। এবং এ হাদীসটি ও জাল নয়। বরং হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী। এমন হাদিস দ্বারা দলীল প্রদান করা যাবে নিঃসন্দেহে। দেখুন, আসসীরাহ- ১/১৯৫।
রেফারেন্সঃ
আস সীরাতুন নাবাওইয়্যাহ- ১/১৯৫

যেসব কিতাবে এ হাদীসটির সমর্থন বর্ণিতঃ
আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৫০২, আল মুজামুস সগীর লিত তাবরানী, হাদীস নং-৯৯২,
এছাড়া আরও রয়েছে ইমাম বায়হাকী রহঃ এঁর দালায়েলুন নাবায়িয়্যাহ সহ ইমাম আবু নুআইম রহঃ এঁর দালায়েলুন নাবায়িয়্যাহ, আদ দুরার কিতাবে ইবনে আসাকীর রহঃ, এবং রয়েছে মাযমাউজ যাওয়ায়েদ কিতাবে।
এ হাদীসের মূল বক্তব্যের উপর আরো দু’টি হাদীস রয়েছে। যথা-

عن عبد الله بن شقيق ؛ أن رجلا سأل النبي صلى الله عليه وسلم : متى كنت نبيا ؟ قال : كنت نبيا وآدم بين الروح والجسد (مصنف ابن ابى شيبة، كتاب المغازى، ما جاء في مبعث النبي صلى الله عليه وسلم، رقم الحديث-৩৭৭০৮)

অনুবাদঃ আব্দুল্লাহ বিন শাকিক থেকে বর্ণিত। রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم)কে এক লোক প্রশ্ন করলেন-আপনি কখন থেকে নবী? তিনি বললেন-আমি তখন থেকেই নবী যখন হযরত আদম আঃ রুহ ও শরীরের মাঝামাঝি ছিলেন। (অর্থাৎ তখনো সৃষ্টি হন নি।)
[সূত্রঃ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩৭৭০৮, মাশকিলুল আসার লিত তাহাবী, হাদীস নং-৫২২২, কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদীস নং-৩১৯১৭, জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-১৫৮৩৫।]

অপর একটি মুবারাক হাদিস থেকে জানা যায়ঃ

عن العرباض بن سارية الفزاري قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول : ( إني عند الله مكتوب بخاتم النبيين وإن آدم لمنجدل في طينته (صحيح ابن حبان، كتاب التاريخ، باب من صفته صلى الله عليه و سلم وأخباره، رقم الحديث-৬৪০৪)

অনুবাদঃ হযরত ইরবায বিন সারিয়্যা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-আমি রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم)কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন-নিশ্চয় আমি আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বশেষ নবী হিসেবে লিপিবদ্ধ ছিলাম তখন, যখন হযরত আদম আঃ মাটিতে মিশ্রিত ছিলেন।
[সূত্রঃ সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬৪০৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭১৬৩, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৪১৯৯, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-১৪৫৫, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩২২২, মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদীস নং-৫৭৫৯, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস নং-৬৩১।]
সুতরাং এ বর্ণনাটিকে জাল বলাটা বাড়াবাড়ি আর কিছু নয়।

উত্থাপিত ২য় অভিযোগের জবাবঃ
রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর হাদীস আল্লাহ তাআলার বাণীরই ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। আমরা কুরআনের ব্যাখ্যা সর্ব প্রথম রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর হাদীস দ্বারাই গ্রহণ করে থাকি।
কুরআনে কারীমে একথা রয়েছে যে, হযরত আদম আঃ কে কিছু কালিমা আল্লাহ তাআলা শিক্ষা দিয়েছেন, যা পড়ার দরূন তার তওবা কবুল হয়েছে। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হযরত আদম আঃ কে তওবার ওসীলা কালিমা শিক্ষা দেয়াটা ছিল একটি নেয়ামত। আর নেয়ামত সাধারণত কোন নেক আমলের কারণে পাওয়া যায়। হযরত আদম আঃ এর পাওয়া তওবার অসীলা সেসব কালিমা শিখতে পাওয়ার নেয়ামত কোন নেক আমলের কারণে পেয়েছিলেন? তা কুরআনে বর্ণিত নেই।
হাদীসের মাঝে সেই নেক আমলের কথাটি বর্ণনা করা হয়েছে। সেই নেক আমলটি হল, হযরত আদম আঃ রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم)এঁর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন।
সুতরাং এ হাদীসটি কুরআনে কারীমের বিপরীত অর্থবোধক রইল কিভাবে?
[সূত্রঃ শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ প্রণীত তাফসীরে ফাতহুল আজীজ-১/১৮৩।]
মহান আল্লাহ্ পাক সকলকে প্রিয় নবী করিম (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর শান-মান বুঝার ও তদানুযায়ী সতর্কতা অবলম্বনের তৌফীক নসীব করুন, আমীন।

Top