হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বিরূদ্ধবাদীদের কতিপয় আপত্তি ও মি. মওদুদী (চাঁদের বুড়ো দেলাঃ সাঈদীর পীর)।
হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সম্পর্কে এ পর্যন্ত যে সমস্ত অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তন্মধ্যে কতিপয় অভিযোগ এবং তার জবাব নিম্নে উপস্থাপিত হল –
১ম আপত্তি:
জামায়াতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা মিস্টার আবুল আলা মওদুদী শিয়া-রাফেযীদের ন্যায় সাহাবা-ই কেরামগণের সবচেয়ে বড় সমালোচক। তিনি তার বহুল বিতর্কিত خلافت وملوکیت (খেলাফত ও মুলূকিয়াত) নামক পুস্তিকায় হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে বিদ্‘আতী আখ্যা দিয়ে উল্লেখ করেন-
হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু স্বয়ং নিজে এবং তাঁর প্রাদেশিক গভর্নরগণ তাঁর আদেশক্রমে জুমু’আর খোতবায় মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে গালি দিত (নাঊযুবিল্লাহ)। এ ছাড়াও মসজিদে নববীতে মিম্বরে রাসূলের উপর দাঁড়িয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি তা’আলা ওয়াসাল্লাম’র প্রিয়জনদের গালি দিত”।
খন্ডন: এ ধরনের উক্তি শিয়া-রাফেজী ও আবুল আলা মওদুদীর পক্ষ থেকে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর প্রতি জঘন্য অপবাদের শামিল।
মিস্টার মওদুদী তার দাবীদার সমর্থনে তিনটি কিতাবের রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন : তাফসীরে তাবারী ৪র্থ খন্ড ১৮৮ পৃষ্ঠা,ইবনে আসির ৩য় খন্ড ২৩৪ পৃষ্ঠা,আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৯ম খন্ড ৮০ পৃষ্ঠা।
দেওবন্দী মাযহাবের অন্যতম পুরোধা ড. তকী ওসমানী সাহেব বলেছেন, আমি তার উল্লেখিত রেফারেন্সগুলো পর্যালোচনা করেছি গভীরভাবে । কিন্তু, কোথাও এ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি যে , তিনি (হযরত আ’মীরে মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) নিজে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে গালি-গালাজ করতেন।
[সূত্রঃ আমীরে মুয়াবিয়া আউর তারীখী হাক্বাইক্ব ৮১ পৃষ্ঠা।]
উপরন্তু ঐতিহাসিকগণের নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় দেখা যায়, হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সাথে মতভেদ থাকার পরও তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।
যেমন – হাফেজ ইবনে কাসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
لمّا جاء خبر قتل علی الی معاویۃ جعل یبکی فقالت لہ امراتہ اتبکیہ وقدقاتلتہ فقال ویحک انّک لاتدرین مافقد الناس من الفضل والفقہ والعلم-
অর্থাৎ, হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নিকট যখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছলো, তখন তিনি কান্না করতে লাগলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী বললেন, আপনি কি আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র শাহাদাতে ক্রন্দন করছেন? অথচ আপনি তাঁর সাথে লড়াই করেছেন। উত্তরে হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, তুমি নিশ্চয় জান না, আজ মানবসমাজ অসংখ্য কল্যাণ, ইলমে ফিক্বহ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছ।
[সূত্রঃ আল্ বিদায়া: ৮ম খন্ড, ১৩০পৃষ্ঠা।]
উল্লেখ্য, এখানে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে বলা হয়েছে যে, “আপনি তাঁর সাথে জীবনে অগণিত যুদ্ধ করেছেন।” কিন্তু তিনি এ কথা বলেননি যে, “আপনি তাঁকে অনেকবার গালিগালাজ করেছেন, সুতরাং আজকে তাঁর শাহাদাতের সংবাদে কেন ক্রন্দন করছেন?”
২য় আপত্তি:
একবার হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু স্বীয় কাঁধে ইয়াযিদকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে এরশাদ করলেন, “জাহান্নামীর উপর চড়ে জাহান্নামী যাচ্ছে।” এতে বুঝা যাচ্ছে যে, ইয়াযীদও দোযখী এবং(না’ঊযু বিল্লাহ) আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুও দোযখী। (সুম্মা না’ঊযু বিল্লাহ)
খন্ডন: এ আপত্তিটি একেবারেই ভীত্তিহীন।
জামে ইবনে আসীর, কিতাবুন নাহিয়া ইত্যাদী ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খেলাফতকালে জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র যুগে হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র কাঁধে ইয়াযীদের অবস্থান কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
[দেখুনঃ হযরত আমীরে মুয়াবিয়া: ৮১ পৃঃ।]
৩য় আপত্তি:
হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমরা মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বরের উপর দেখ, তখন তাকে হত্যা করে ফেল”। এ হাদিসটি ইমাম যাহাবী উদ্ধৃত করেছেন এবং বিশুদ্ধ বলেছেন। এতে বুঝা গেল যে, আমীর মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হত্যার উপযোগী ছিলেন।
খন্ডন: ‘মিথ্যাবাদীদের উপর খোদার অভিশাপ’ এটা বলা ছাড়া এ আপত্তির আর কী জবাব দেয়া যায়? কোন এক মিথ্যাবাদী হুজূরের নামে মিথ্যা বলেছে এবং অপবাদটা ইমাম যাহাবীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। সরকারে দু’জাহান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, “যে আমার ব্যাপারে জেনেশুনে মিথ্যা বলে সে যেন দোযখকে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়”। আল্লাহকে ভয় করা দরকার।
বস্তুত ইমাম যাহাবী রহ. তাদেরকে রদ (খণ্ডন) করার জন্যই এ জাল হদীসটি তাঁর ইতিহাসগ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন মাত্র। আর ওখানে সাথে সাথে এও বলে দিয়েছেন যে, “এটি মওযু (বানোয়াট) হাদীস, এর কোন ভিত্তি নেই”।
তদুপরি, হুযুরের এটা বলার কি প্রয়োজন ছিল? তিনি তো নিজেই ক্বতল (হত্যা) করতে পারতেন।
আর এটাও কিভাবে হতে পারে যে, সমস্ত সাহাবী, তাবেয়ীন ও আহলে বায়্ত এ হাদীস শুনলেন কিন্তু কেউ পাত্তা দিলেন না। বরং ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আমীর মু’আবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র পরে খিলাফত থেকে ইস্তেফা দিয়ে আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মিম্বরকে একেবারে খালি করে দিলেন এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ইল্ম ও আমলের প্রশংসা করলেন। তাকে দ্বীনের মুজতাহিদ আখ্যায়িত করলেন। তাঁদের কারো কাছেই কি এ হাদীসটি পৌঁছলনা? চৌদ্দশ বছর পরে এদের কাছে কিভাবে এই হাদীসটি পৌঁছে গেল?
এছাড়াও আরো অসংখ্য বিভ্রান্তিকর আপত্তি করা হয়েছে। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় তা এখানে আলোকপাত করা হল না।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ :
খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এবং আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল।
একদিন হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু দরবারে উপস্থিত সবাইকে বললেন, যে ব্যক্তি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র প্রশংসায় যথাযোগ্য কবিতা আবৃত্তি করবে, আমি তাকে প্রতিটি কবিতার বিনিময়ে হাজার দিনার দান করব।
উপস্থিত কবিগণ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শানে কবিতা আবৃত্তি করে প্রচুর পুরষ্কার লাভ করলেন। কিন্তু হযরত আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু প্রতিটি কবিতা ও ছন্দ শ্রবণ করার পর বলতেন- علیّ افضل منہ (আলীয়্যুন আফদ্বালু মিনহু) অর্থাৎ, “আলী এর চেয়েও অনেক উত্তম”। অতঃপর উক্ত মজলিসে আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র প্রশংসায় এমন একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, যা হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র নিকট পছন্দ হল, ফলে ঐ কবিতার বিনিময়ে উক্ত কবিকে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সাত হাজার দিনার পুরষ্কার প্রদান করলেন।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সিফ্ফীনের যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
ایھا الناس لا تکرہ امارۃ معاویۃ فانکم لوفقد تموہ رایتم الرؤس تنذر عن لواھلھا کانّما الحنظل-
অর্থাৎ, “হে লোক সকল! তোমরা আমীরে মুয়াবিয়ার শাসন এবং নেতৃত্বকে অপছন্দ করোনা”। যদি তোমরা তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দাও, তবে তোমরা দেখবে ধড় থেকে মাথা এমন ভাবে কেটে পড়েছে, যেভাবে হান্জল (এক প্রকারের তিক্ত ফল) গাছ থেকে পতিত হয়।
[সূত্রঃ আল-বিদায়া; ৮ম খন্ড, ১৩১ পৃঃ।]