হযরত মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর নাম মুবারক পাঠ বা শ্রবণ করত: বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখে লাগানোর হুকুম।
হাদীসের নামে জালিয়াতি বইয়ের ৩৬৬পৃষ্ঠায় এবং জুনায়েদ বাবু নগরী তদীয় প্রচলিত জাল হাদিস বইয়ের ১১৭পৃষ্ঠায় হযরত আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসুুলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم)এর নাম শুনে চুমু খাওয়ার হাদিসকে জাল প্রমাণ করার অনেক অপচেষ্টা চালিয়েছে।
বিভ্রান্তিকর আরেক পুস্তক প্রচলিত জাল হাদিস (যা মাওলানা মতিউর রহমান এর লিখিত) ১২২ পৃষ্ঠায় উক্ত হাদিসটিকে জাল বলে প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছে।
এ হাদিসটিকে ড. আহমদ আলী তার 'বিদআত' পুস্তকের প্রথম খণ্ডেও জাল প্রমাণ করতে অনেক অপচেষ্টা করেছে।
এ হাদিসটির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্যে বাংলা ভাষায় অনেক পুস্তক রচিত হয়েছে, তাদের সকলের নাম উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।
অর্থাৎঃ "হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল অত্যন্ত পাপী, যে ২০০বছর পর্যন্ত আল্লাহর নাফারমানি করেছে। যখন সে মৃত্যুবরণ করে মানুষেরা তাকে এমন স্থানে নিক্ষেপ করল, যেখানে আবর্জনা ফেলা হতো। তখন হযরত মুসা 'আলাইহিস সালাম এর প্রতি ওহী এলো যে, লোকটিকে ওখান থেকে তুলে যেন তার ভালভাবে জানাযার নামায পড়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত মুসা 'আলাইহিস সালাম এর প্রতি ওহী হলো যে, লোকটিকে ওখান থেকে তুলে যেন তার ভালভাবে জানাযার নামায পড়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত মুসা 'আলাইহিস সালাম আরজ করলেন, হে আল্লাহ্! বনী ইসরাঈল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, লোকটি ২০০ বছর পর্যন্ত তোমার নাফারমানি করেছিল। ইরশাদ হলো, হ্যাঁ, তবে তার একটি ভাল অভ্যাস ছিল। যখন সে তাওরাত শরীফ তেলাওয়াত করত, যতবার আমার হাবীব হযরত মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর নাম মুবারাক দেখত তখন সেটা ততবার চুম্বন করে চোখের উপর রাখত এবং তাঁর প্রতি দুরূদ পাঠ করত। এজন্যে আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি এবং সত্তর জন হুর স্ত্রী স্বরুপ তাকে দান করেছি।
সূত্রঃ
১/ ঈমাম আবু নঈম : হুলিয়াতুল আউলিয়া; ৩/১৪২পৃ.।
২/ আল্লামা বুরহানুদ্দীন হালভী : সিরাতে হালবিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৩।
৩/ হাফিযুল হাদিস জালালুদ্দীন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কুবরা, ১/৩০, হাদিস ৬৮, মাকতুত- তাওফিকহিয়্যাহ, বৈরুত।
৪/ আল্লামা দিয়ার বকরী : আল খামীস ফি আহওয়ালে আনফাসে নাফীস, ১/২৮২পৃ.।
৫/ আল্লামা আব্দুর রহমান ছাফুরী : নুযহাতুল মাযালিস, ২/১৪২পৃ.।
৬/ আল্লামা শফী উকাড়ভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি : জিকরুজ জামীল, ৩৫৪পৃ.।
উক্ত হাদীসের ব্যাপারে কোনো মুহাদ্দিস মন্তব্য করেন নি। মুহাদ্দিসিনে ক্বিরামের নীরবতা পালন থেকে বুঝা গেল হাদিসটি সহিহ্ বা বিশুদ্ধ, কারণ তার ব্যাপারে কোন মুহাদ্দিসের বিরোধীতা পাওয়া যায় নি।
এ ব্যাপারে হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) এঁর আমলঃ
বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (রহমাতুল্লহি আলাইহি) তাঁর উল্লেখযোগ্য তাফসীর তাফসীরে 'রুহুল বয়ানে' লিখেন,
অর্থাৎঃ "কাসাসুল আম্বিয়া কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) জান্নাতে অবস্থানকালে মহনবী হযরত মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর সাথে সাক্ষাতের জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অত:পর আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিকট ওহী প্রেরণ করেন যে, হে আদম! তিনি তোমার পৃষ্ঠ হতে শেষ যামানায় প্রকাশ হবেন। তা শুনার পর তিনি জান্নাতে অবস্থানকালে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা জানালেন। বিনিময়ে আল্লাহ্ তা'আলা ওহী প্রেরণ করলেন, যে নূরে মুহাম্মাদী (صلى الله عليه و آله وسلم)তোমার ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলীর মধ্যে স্থানান্তরিত করেছি, তখন সে অঙ্গ হতে তাসবীহ পাঠ আরম্ভ হলো। এজন্যেই এই আঙ্গুলকে তাসবীহ পাঠকারী আঙ্গুল বলা হয়। যেমন- 'রওযাতুল ফায়েক' কিতাবেও বর্ণিত আছে, অথবা আরেক বর্ণনায় রয়েছে, আল্লাহ্ তা'আলা আপন হাবীব (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর সৌন্দর্য প্রকাশ করলেন দুই বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর যেভাবে আয়নাতে দেখা যায়। তখন হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) দুই বৃদ্ধাঙ্গুলে চুম্বন করে স্বীয় চোখের উপর মালিশ করলেন। এটি দলীল হিসেবে প্রমানিত হলো যে, তাঁর সন্তানাদীর জন্যে। অতঃপর হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) এই ঘটনা হুযুর (صلى الله عليه و آله وسلم)কে জানালেন। হুযুর (صلى الله عليه و آله وسلم)বললেন, যেই ব্যক্তি আযানের মধ্যে আমার নাম মোবারক শুনে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করবে আর চোখে মালিশ করবে, সে কখনো অন্ধ হবে না।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বয়ান, ৭/২২৯, সুরা মায়েদা, আয়াত ৫৭ এর তাফসীর।
২/ আল্লামা আব্দুর রহমান ছাফুরী : নুযহাতুল মাযালিস, ২/৭৪পৃ.।
হযরত খিযির (আলাইহিস সালাম) কর্তৃক রাসুুল (صلى الله عليه و آله وسلم)এর নাম শুনে চুমু খাওয়ার আমল বর্ণিতঃ
অর্থাৎঃ ঈমাম আবু আব্বাস আহমদ বিন আবি বকর ইয়ামানী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ موجبات الرحمة و هزائم المغفرة এর মধ্যে হযরত খিযির (আলাইহিস সালাম) থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে 'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ' শুনে বলবে مرحبا بحبيبي وقوة عيني محمد بن عبد الله صلى الله عليه وسلم (মারহাবা বি হাবিবি ওয়া কুররাতো আইনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) অতঃপর স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখে লাগাবে, তাহলে তার চোখে কখনও ব্যথা হবে না এবং সে কোন দিন অন্ধ হবে না।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ঈমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ১/৩৮৩, হাদিস ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭০, হাদিস ২২৯৬।
৩/ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মওদ্বুআতুল কবীর, ১০৮ পৃ.।
৪/ আল্লামা মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জাআল হক, ২/২৪৬পৃ.।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক রাসুুল (صلى الله عليه و آله وسلمএর নাম শুনে চুমু খাওয়ার আমল বর্ণিতঃ
অর্থাৎঃ "হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি মুয়াযযিনকে 'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ বলতে শুনলেন, তখন তিনিও তা বললেন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ে চুমু খেয়ে তা চোখে বুলিয়ে নিলেন। তা দেখে রাসুুল (صلى الله عليه و آله وسلمইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর ন্যায় আমল করবে, তার জন্যে আমার সুপারিশ বৈধ হয়ে গেল।"
সূত্রঃ
১/ ঈমাম আব্দুর রহমান সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ৩৮৩পৃ., হা/ ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৫৯, হা/ ২২৯৬।
৩/ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূ, ৩১২পৃ., হাদিস ৪৫৩।
৪/ আল্লামা ঈমাম তাহতাভী : মারাকিল ফালাহ, ১৬৫পৃ., কিতাবুল আযান।
৫/ আল্লামা শাওকানী : ফাওয়াহিদুল মওদ্বুআত, ১/৩৯পৃ.।
৬/ আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বয়ান, ৭/২২৯পৃ.।
৭/ আল্লামা তাহের পাটনী : তাযকিরাতুল মওদ্বুআত, ৩৪পৃ.।
৮/ আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি : লা আলীল মাসনূ আ, ১৬৮-১৭০পৃ.।
৯/ আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী : আসরারুল মারফূ আ, ১৮২পৃ.।
১০/ আহলে হাদিস নাসিরুদ্দিন আলবানী ওয়াহাবী : সিল..দ্বঈফাহ, ১/১০২পৃ., হাদিস ৭৩।
উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিসগণের মতামত পর্যালোচনাঃ
০১. ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহির অভিমতঃ
আল্লামা ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণিত হাদিসটি সংকলন করে বলেন, لايصح হাদিসটি সহিহ্ নয়'।
অত:পর তিনি আরো বলেন-
"السطح فى المرفوع كل هذا شيئ" انتهى
অর্থাৎঃ এ ব্যাপারে বর্ণিত কোন মরফূ হাদিসও সহীহ্ হিসেবে প্রমাণিত হয় নাই। এ ব্যাপারে আমি যতটুকু তাহক্বীক ও গবেষণা করেছি তাতে এটাই অনুধাবন করেছি যে,
فوق كل ذى علم عليم
অর্থাৎঃ প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তির চাইতে আরও বড় জ্ঞানী রয়েছেন।
সূত্রঃ
১/ ঈমাম আব্দুর রহমান সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ১৮২পৃ.।
২/ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসারুল মারফূ আ, ২৩৬পৃ.।
ঈমাম দায়লামী বর্ণিত মরফূ ব্যতীত হাদিসের গ্রন্থ সমূহে কোন মরফু হাদিসের সন্ধান পাওয়া যায় নি।
যখন মুহাদ্দেসীন কেরাম এতদসংক্রান্ত ব্যাপারে বর্ণিত মরফু হাদিসকে বিশুদ্ধ না হওয়ার হুকুম প্রদান করেছেন তখন এতে প্রমাণিত হয় যে, এটা হাদিসে মওকুফ হিসেবে সহিহ্।
সুতরাং ঈমাম দায়লামীর বর্ণিত হাদিস যদিও মরফু হিসেবে প্রমাণিত হয় নাই, এতে এটা বোঝা যায় না যে, হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট হতেও মওকুফ হিসেবে সহীহ্ প্রমাণিত নহে। এর উপর ভিত্তি করে আলেমকুলের শিরোমনি মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর প্রণীত কিতাব "মাওজুয়াতে কবির" এর ৬৪ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করেন,
"قلت واذا ثبت رفعه على الصديق فيكفى العمل به لقوله" عليه السلام" عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين"
অর্থাৎঃ আমার অভিমত হলো, যখন এ হাদিসটি হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত মরফু হাদিস হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, অতএব এর উপর আমল করাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। কেননা মহানবী (صلى الله عليه و آله وسلمঘোষণা করেছেন- "আমার সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত আঁকড়ে ধরা তোমাদের জন্যে অবধারিত।"
অধিকন্তু, আমলের জন্যে সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়া অত্যাবশ্যক নহে, বরং হযরাকে মুহাদ্দেসীন কেরাম বর্ণনা করেন- আমলের ফজিলতের ক্ষেত্রে ('ফজিলত' অর্থ এমন কোন কাজ সম্পন্ন করা যা মাহাত্মপূর্ণ ও ফজিলত সম্বলিত এবং শরিয়ত- এর দৃষ্টিতে সেই কাজটি অন্য হাদিসের আলোকে নিষিদ্ধ নহে) জঈফ বা দুর্বল হাদিসের উপর আমল করা মুস্তাহাব।
প্রখ্যাত ও বিশুদ্ধ হাদীস বিশারদ হযরত ঈমাম ছাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর প্রণিত قول البديع (ক্বওলুল বদিঈ) নামক গ্রন্থের ১৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
অর্থাৎঃ "শায়খুল ইসলাম আবু জাকারিয়া আলহারাবী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর প্রণীত কিতাব "আল আজকার" এর মধ্যে বলেছেন- 'মুহাদ্দেসীনে কেরাম ও ওলামায়ে এজাম প্রমুখ উল্লেখ করেছেন যতক্ষণ পর্যন্ত কোন হাদীস 'মওজু' হিসেবে পরিণত হবে, 'কৃত্রিম' হিসেবে চিহ্নিত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত হাদীস দ্বারা আমল করা জায়েজ হবে। 'তারগীব' অর্থাৎ সৎকাজের জন্যে উৎসাহ প্রদান ও ফজিলতের ক্ষেত্রে জঈফ বা দুর্বল হাদিসের উপর আমল করা মুস্তাহাব ও বৈধ। কিন্তু শরীয়তের হুকুম-আহকাম তথা হালাল, হারাম, বেচা-কেনা, লেন-দেন, বিবাহ, তালাক ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমল করার জন্যে সহীহ্ ও হাসান হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হওয়া অপরিহার্য এবং কতিপয় বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করাও বাঞ্ছনীয়।"
উক্ত গ্রন্থের একই পৃষ্ঠায় অারও বিধৃত রয়েছে-
অর্থাৎঃ ঈমাম আহমদ রহমাতুল্লহি 'আলাইহি হতে বর্ণিত, সকল জঈফ বা দুর্বল হাদিসের উপর আমল করা যেতে পারে যদি এর বিপরীতে অন্য কোন হাদিস পাওয়া যায় এবং প্রথমোক্ত হাদিসটি যেন শেষোক্ত হাদিসটির সহিত টক্কর না লাগে।
ঈমাম আহমদ রহমাতুল্লহি 'আলাইহি এর অপর বর্ণনায় রয়েছে, তুলনামুলকভাবে জঈফ বা দুর্বল হাদীস সর্ব সাধারণের রায় ও বিবেকের চাইতে আমাদের নিকট অধিক প্রিয়।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, সুপরিচিত গবেষক হযরতুল আল্লামা ইবনে হাজম রহিমাহুল্লহ অনুরুপ উল্লেখ করে বলেন-
অর্থাৎঃ হানাফী মাযহাবের সকল ইমাম ও আলেমগণ এ বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ঈমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লহি 'আলাইহি এর নিকট তুলনামূলকভাবে জঈফ বা দুর্বল হাদীস সর্বসাধারণের অভিমত ও রায়ের চাইতে অধিক শ্রেয়।
শাফেয়ী মাযহাবের স্বনামধন্য আলেম আল্লামা নব্বী তাঁর কিতাব "তাকরীব" এর ১০৮ পৃষ্ঠায়, ঈমাম ইবনুল হাম্মাম স্বীয় গ্রন্থ 'ফাতহুল ক্বাদীর' - এর মধ্যে ইবনুল হাম্মামের যোগ্য শিষ্য আল্লামা হালবী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর প্রণীত 'শরহে মুনিয়া'- এর মধ্যে, ইবনুল আবেদীন রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর কিতাব 'রাদ্দুল মুখতার' - এর মধ্যে, হানাফী মাযহাবের কিতাব 'মওজুয়াতে কবীর'- এর মধ্যে এবং প্রখ্যাত হাদীস বিশেষজ্ঞ ইবনুল সালাহ রহমাতুল্লহি 'আলাইহি স্বীয় 'মুকাদ্দামায়' অনুরুপ লিপিবদ্ধ করেছেন।
মুফতী সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান রহমাতুল্লাহি 'আলাইহি স্বীয় উছুলে হাদিসের গ্রন্থ تعليقات بركتى(তালিকাতে বারকাতী) এর মধ্যে উপরোক্ত বিষয়ের উপর বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, অতএব যখন আমলের ফজিলতের ক্ষেত্রে জঈফ হাদিসের উপর আমল করা মুস্তাহাব বলে প্রমাণিত হলো তখন আযানের সময় হুজুর (صلى الله عليه و آله وسلم-এর নাম মোবারক শুনে চুম্বন করাও মুস্তাহাব বলে প্রতীয়মান হবে। কারণ এ ব্যাপারে একটি মাত্র মরফু হাদিস বর্ণিত আছে, যদিও ইহা জঈফ বা দুর্বল হউক না কেন এবং এ হাদিসে আমলের ফজিলতের কথাও বিধৃত রয়েছে।
এ ব্যাপারে মুফতী আমীমুল ইহসান রহমাতুল্লহি আলাইহির অভিমত হলোঃ
অবশ্যই আমার অভিমত হলো, উপরোক্ত হাদিসটি জঈফ বা দুর্বল। কেননা, আমাদের উক্তি لايصحবা সহীহ্ নহে এবং موضوع(জাল ও কৃত্রিম) হাদিস এর মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে।
আল্লামা ফাতনী তাঁর কিতাব 'মাজমায়ূর বিহার' এর মধ্যে অনুরুপ লিখেছেন।
তাই আমাদের ফোকাহায়ে কেরাম আযানের 'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্' শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় চুম্বন করাকে মুস্তাহাব ফতোয়া দিয়েছেন।
হযরতুল আল্লামা কাসতালনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর প্রণীত جامعالرموز(জামিউর রমুজ) নামক কিতাবের ৫৬ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করেছেন-
অর্থাৎঃ জেনে রেখ, আযানের সময় শাহাদাতে ছানিয়া অর্থাৎ 'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ' প্রথমবার শ্রবণ করতঃ 'সাল্লাল্লাহু 'আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলা এবং উক্ত শাহাদাতের বাক্য দ্বিতীয়বার শ্রবণ করতঃ 'কুররাতু আইনি বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলা মুস্তাহাব। অতঃপর বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় চুম্বন করে 'আল্লাহুম্মা মাততেয়নি বিসছাময়ে ওয়াল বাছরে'- বলা মুস্তাহাব। এরুপ আমলকারীকে রাসূলে পাক (صلى الله عليه و آله وسلمনিজে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাবেন।
'কানজুল ইবাদ' নামক কিতাবে অনুরুপ বর্ণনা করা হয়েছে।
রাদ্দুল মুখতার, ফতোয়ায়ে শামী, ৪১৩পৃৃষ্ঠা, ১ম খণ্ডে অনুরুপ বিধৃত হয়েছে।
আল্লামা ছাখাবী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি এর রচিত 'আল মাকাছেদুল হাসানা' নামক কিতাবের ১৮১পৃষ্ঠায় হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর সূত্রে একটি মওকুফ হাদিস উল্লেখ করেছে-
অর্থাৎঃ খ্যাতিসম্পন্ন ফকীহ মুহাম্মদ বিন সাঈদ খাওলানী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন বিশিষ্ট ফকীহ অাবুল হাসান আলী বিন হাদিদ আল হুসাইনী আমাকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিশিষ্ট ফকীহুজ জাহেদ আমাকে হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, যে কেউ আযানের সময় মুয়াজ্জিনের শাহাদত বাক্য তথা 'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ' শ্রবণ করে 'মারহাবান বে-হাবিবি ওয়া কুররাতে আইনি মুহাম্মাদিবনে আবদিল্লাহে সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম'- এ দোয়া পাঠ করে অতঃপর স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় চুম্বন করে স্বীয় নয়নযুগল মসেহ করে, সে কখনো অন্ধত্বের শিকার হবে না এবং জীবনে কখনো তার চোখের মধ্যে কোন রকমের ব্যথা ও পীড়া হবে না।
হযরত মুহাদ্দসীনে কেরাম নিজেরাই আমলের ফজিলতের ক্ষেত্রে জঈফ বা দুর্বল হাদিসের উপর আমল করেছেন।
যেমন-
من حفظ على امتى اربعين حديثا الخ
এ হাদিসটি হাদিস বিশেষজ্ঞদের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে জঈফ বা দুর্বল বলে সাব্যস্ত, তবু এর উপর সকলের আমল রয়েছে।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, দেখুন ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি কী বললেন, আর প্রচলিত জাল হাদিস (মাওলানা মতিউর রহমান লিখিত) ১২২পৃষ্ঠায় চরম মিথ্যাবাদী লেখক লিখেছেন যে, ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি নাকি বলেছেন, "এটি প্রমানিত নয়"। দেখুন ঈমাম সাখাভীর নামে বাংলা ভাষায় কী ধরনের মিথ্যাচার করেছে। আর মি. আব্দুল্লাহ্ জাহাঙ্গীর তার বইয়ের ৩৬৬পৃষ্ঠায় বাংলায় কিছু ঈমামদের নাম দেখিয়ে হাদিসটিকে জাল বলে চালিয়ে দেবার অহেতুক অপচেষ্টা চালিয়েছে।
প্রিয় পাঠক, মুহাদ্দিসিনে ক্বিরামের তৈরি হাদিস শাস্ত্রে "হাদিসটি সহিহ্ নয়" বললে "হাসান" হাদিস বুঝায়।
এমনকি মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি বলেন,
لايصح لاينافي الحسن
অর্থাৎঃ "কোন মুহাদ্দিসের বক্তব্য হাদিসটি সহিহ্ নয়-তা দ্বারা হাদিসটি "হাসান" হওয়াতে কোন অসুবিধা থাকে না বা নিষেধ করে না।"
[সূত্রঃ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসারুল মারফূ আ, ২৩৬পৃ.।]
বুঝা গেল, হাদিসটি কমপক্ষে "হাসান" হাদিস যা দলীল হিসেবে দাঁড় করানোর গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন।
হাদিসটি সহিহ্ নয় বলতে মুহাদ্দিসিনে ক্বিরাম কি বুঝিয়ে থাকেন তা জানতে নিচের লিংকের প্রবন্ধটি পড়ার অনুরোধ রইলঃ
``হাদিসটি সহিহ্ নয়`` বলতে মুহাদ্দিসিনে ক্বিরাম কি বুঝিয়ে থাকেন!
https://mobile.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1697290543919717
_____________
০২. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহির অভিমতঃ
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর গ্রন্থে ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহির রায় পেশ করে সমাধানের কথা বলেন যে-
অর্থাৎঃ "আমার কথা হলো হাদিসটির সনদ যেহেতু হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত প্রসারিত (তথা মারফূ হিসেবে প্রমানিত), সেহেতু আমলের জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। কেননা হুজুর (صلى الله عليه و آله وسلمইরশাদ করেছেন, তোমরা আমার পর আমার সুন্নাত ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরো।"
সূত্রঃ
১/ ঈমাম আবু দাউদ : আস্ সুনান, হাদিস ৪৬০৭, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে।
২/ ঈমাম তিরমিযী : আস্ সুনান, হাদিস ২৬৭৬।
৩/ ঈমাম ইবনে মাজাহ : আস্ সুনান, হাদিস ৪২।
৪/ ঈমাম ইবনূল বার্ : জামিউল বায়ান ওয়াল ইলমে বি ফাদ্বলিহী, ২/৯০পৃ.।
৫/ ঈমাম আহমদ : আল মুসনাদ, ৪/১২৭পৃ., হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে।
৬/ আল্লামা মোল্লা অালী ক্বারী : মওদ্বুআতুল কাবীর, ৩১৬পৃ., হাদিস ৪৫৩।
৭/ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসারুল মারফূ অা, ২১০পৃ., হাদিস ৮২৯।
৮/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭০পৃ., হাদিস ২২৯৬।
প্রিয় পাঠক, দেখুন! আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি বলেছেন যে, এতটুকুই যথেষ্ট যেহেতু হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমলটি করেছেন এবং হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত সনদটি প্রসারিত, তাই বুঝা গেল যারা না করবে এবং আমলটিকে অস্বীকার করে তারা সাহাবীদের বিরোধী বাতীল ৭২দলের সদস্য বাতীল ফির্কা হিসেবেই গণ্য।
অপরদিকে ধোঁকাবাজ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার বইয়ে মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহির বক্তব্যটিকে বিকৃত করে বর্ণনা করেছেন।
০৩ ও ০৪. আল্লামা তাহের পাটনী ও আল্লামা শাওকানী অভিমতঃ
আহলে হাদিস মাওলানা কাযী শাওকানী তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ফাওয়ায়িদুল মওদ্বুআত ১/১৯ পৃষ্ঠায় হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসটি বর্ণনার পর লিখেন,
অর্থাৎঃ "উক্ত হাদিসটি ঈমাম দায়লামী রহমাতুল্লহি আলাইহি 'মুসনাদিল ফিরদাউস' গ্রন্থে বর্ণনা করেন মারফূ হিসেবে (যার সনদ রাসুুল দঃ পর্যন্ত পৌঁছেছে।) উক্ত হাদিস সম্পর্কে আল্লামা তাহের পাটনী রহমাতুল্লহি আলাইহি তাঁর "তাযকিরাতুল মওদ্বুআত" গ্রন্থে বলেন হাদিসটি সহিহ্ পর্যায়ের নয় (তবে হাসান)।"
[সূত্রঃ আহলে হাদিস মাওলানা কাযী শাওকানী : ফাওয়ায়িদুল মওদ্বুআত ১/১৯ পৃষ্ঠা।]
আর আল্লামা তাহের পাটনীর মুল বক্তব্যটি হচ্ছে তার তাযকিরাতুল মওদ্বুআত গ্রন্থের ১/ ৩৪পৃষ্ঠায়। হাদিসটি সহিহ্ নয় বলতে "হাসান" হাদিস বুঝায় যা উপরের লিংকের প্রবন্ধে অসংখ্য মুহাদ্দিসের মতামত দিয়ে আলোচনা করে এসেছি। শুধু তাই নয় আল্লামা তাহের পাটনী আরও বলেন, উক্ত হাদিসটিও কয়েক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
তাই তার মত অনুসারে হাদিসটি "হাসান" হিসেবে প্রমাণ পাওয়া গেল। তাছাড়া ঈমাম সাখাভী মাকাসিদুল হাসানার ৩৯১পৃষ্ঠায় উক্ত হাদিসটির অনেকগুলো সূত্র ও অামল বর্ণনা করেছেন যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল্লামা আযলূনী তার কাশফুল খাফা ২/১৮৫পৃ., হাদিস ২২৯৪-এ।
আর দ্বঈফ হাদিসও যখন একাধিক সনদে বর্ণিত হয় তখন হাদিসটি "হাসান" হয়ে যায় যা আমি শুরুতে বিস্তারিত আলোকপাত করেছি। উক্ত প্রচলিত জাল হাদীস গ্রন্থে শুধু মাকাসিদুল হাসানার উদ্ধৃতি দিয়ে ১২২পৃষ্ঠায় লিখেছে এটি প্রমাণিত নয়। তারা কেমন মিথ্যুক দেখুন অথচ ঈমাম সাখাভী বলেছেন হাদিসটি সহিহ এর অন্তর্ভূক্ত নয় অর্থাৎ সহিহের নিম্নে হাসান।
তাই মিথ্যাবাদীদেরকে বলতে চাই এমন হক্কানী লেখকের নাম দিয়ে মিথ্যে লেখা বন্ধ করুন। অথচ তাদের আরেকজন মাওলানা বাবুনগরী তার বইয়ের ১১৭পৃষ্ঠায় লিখেছে ঈমাম সাখাভী হাদিসটি সম্পর্কে বলেছেন হাদিসটি সহিহ্ নয়। তাদের দু'জনের মধ্যে কেমন পার্থক্য দেখুন। সুতরাং মাওলানা মতিউর রহমানের মুনাফিকী স্বয়ং তাদের দলের আলেমই তুলে ধরেছেন।
০৫. আল্লামা ঈমাম আযলূনী রহমাতুল্লহি আলাইহি এর অভিমতঃ
আল্লামা অাযলূনী রহমাতুল্লহি আলাইহি হাদিসটি তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করে বলেন,
অর্থাৎঃ উক্ত হাদিসটি ঈমাম দায়লামী রহমাতুল্লহি আলাইহি তাঁর মুসনাদিল ফিরদাউস গ্রন্থে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেন.......আল্লামা ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি আলাইহি হাদিসটি সম্পর্কে বলেন, হাদিসটি সহিহ্ পর্যায়ের নয়।"
[সূত্রঃ আল্লামা অাযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/১৮৫পৃ., হাদিস ২২৯৪।]
০৬. ঈমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমাতুল্লহি আলাইহি এর অভিমতঃ
ঈমাম শামী রহমাতুল্লহি আলাইহি উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে বলেন, ঈমাম ইসমাঈল জারহী রহমাতুল্লহি আলাইহি বলেন,
অর্থাৎঃ "এ ব্যাপারে মারফূ হিসেবে যে ক'টি সনদ বর্ণিত হয়েছে সে সবগুলোর একটিও সহীহ্ পর্যায়ের নয়।"
[সূত্রঃ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী : রুদ্দুল মুখতার, বাবুল আযান, ১/৩৯৮পৃ.।]
ঈমাম শামী রহমাতুল্লহি আলাইহি এঁর বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় হাদিসটি "সহিহ্ নয়"; অার সহিহ্ নয় বলতে হাদিসটি "হাসান" বুঝায়, যা উপরের লিংকের প্রবন্ধটিতে আলোকপাত করা হয়েছে।
পাঠকদের পুনরায় আলোচনাটি দেখার অনুরোধ রইল।
০৭. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহিমাহুল্লহ্ এর অভিমতঃ
বিশ্ব বিখ্যাত মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফক্বিহ আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি এর অদ্বিতীয় তাফসীর গ্রন্থ 'রুহুল বায়ানে' ষষ্ঠ পারার সূরা মায়েদার ৫৭নং আয়াতের তাফসীরে লিখেন,
অর্থাৎঃ "আযানে 'মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ' বলার সময় নিজের শাহাদাতের আঙ্গুলসহ বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখে চুমু দেয়ার বিধানটিতে কিছুটা দুর্বলতা বিদ্যমান। কেননা এ বিধানটা মারফূ হাদিস দ্বারা প্রমানিত নয়। কিন্তু মুহাদ্দিসিনে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে আকর্ষণ সৃষ্টি ও ভীতি সঞ্চারের বেলায় দ্বঈফ সনদের হাদিসের উপর আমল করা জায়েয।"
আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি বলেন,
অর্থাৎঃ "ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি আলাইহি তাঁর 'মাকাসিদুল হাসানা' কিতাবে বলেছেন, উক্ত হাদিসটি মারফূ হিসেবে সহীহ্ পর্যায়ের অন্তর্ভূক্ত নয়। আর মারফূ বলা হয় ঐ হাদিসকে যা সাহাবী রাসূলে পাক (صلى الله عليه و آله وسلمথেকে বর্ণনা করেন।"
[সূত্রঃ আলামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বায়ান, ১২/২২৯পৃ., দারূল কিতাব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানান।]
আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর এ গ্রন্থে আরো বলেন যে,
অর্থাৎঃ "এই অধম আরজ করেছি যে, ওলামায়ে ক্বিরাম থেকে বিশুদ্ধ কথা হলো আমলের ব্যাপারে দ্বঈফ সনদের হাদিস গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারটি সহীহ্ সূত্রে বর্ণিত আছে। অতএব হাদিসটি মারফূ না হওয়ার দ্বারা এটি আবশ্যক হয় না যে ঐ হাদীসের মর্মানুযায়ী আমল করা যাবে না। সুতরাং আল্লামা কুহিস্তানী যে এটাকে মুস্তাহাব বলেছেন তাই সঠিক। "কুউয়াতুল কুলুব" কিতাবে ঈমাম আবু তালিব মক্কী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি এর বর্ণনাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। তার হিফয, ইলমের ব্যাপারে আল্লামা শায়খ সোহরাওয়ার্দী রহিমাহুল্লহ সাক্ষ্য দিয়েছেন "আওয়ারিফুল মা'আরিফ" গ্রন্থে এবং কূউয়াতুল কুলুব কিতাবের বর্ণিত সকল মাস'আলা তিনি গ্রহণ করেছেন।"
[সূত্রঃ ইসমাঈল হাক্কী : রুহুল বায়ান, ১২/২২৯পৃ.।]
ফকিহগণের দৃষ্টিতে এই হাদিসের উপর আমলঃ
০১. আল্লামা ঈমাম শামী রহিমাহুল্লহঃ
তিনি তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব ফতোয়ায় শামীতে باب الاذانএ লিখেন,
অর্থাৎঃ "মুস্তাহাব হলো আযানের সময় শাহাদাত বলার মধ্যে صلى الله عليك يا رسول اللهবলা এবং দ্বিতীয় শাহাদাত বলার সময় বলবে قرة عينى بك يا رسول الله অত:পর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখে চুমু খেয়ে স্বীয় চোখদ্বয়ের উপর রাখবে এবং এই দোয়াটি الهم متعنى بالسمع والبصرপড়বে এর ফলে হুযুর (صلى الله عليه و آله وسلمতাকে নিজের পিছনে পিছনে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাবেন। অনুরূপ কানযুল ইবাদ ও কুহস্থানী গ্রন্থে বর্ণিত আছে। ফাতাওয়ায়ে সূফিয়ায়ও তদ্রুপ উল্লেখিত আছে। কিতাবুল ফিরদাউসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আযানে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ শুনে স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ চুম্বন করে, আমি তাকে আমার পিছনে পিছনে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাব এবং তাকে বেহেশতীদের কাতারে অন্তর্ভূক্ত করবো। এর পরিপূর্ণ আলোচনা বাহারুর রায়েক এর টীকায় ফতোয়ায়ে রমলীতে আছে।"
সূত্রঃ
১/ ঈমাম ইবনে আবেদীন শামী : ফতোয়ায় শামী, ১/৩৯৮পৃষ্ঠা কিতাবুল অাযান অধ্যায়।
২/ মুফতী আমিমুল ইহসান মুজাদ্দেদী : কাওয়াইদুল ফিকহ্, ১/২৩৩পৃষ্ঠা।
৩/ ইমাম আহমাদ রেজা খান : আহকামে শরীয়ত, ১/১৭২পৃ.।
৪/ ঈমাম অাহমদ রেজা : ফতোয়ায় আফ্রিকা, ৭৮পৃ.।
৫/ মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হাক্ক, ২/২৪৬পৃ.।
৬/ আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বায়ান, ৭/২২৯পৃ.।
প্রচলিত জাল হাদিস বইয়ের (মাওলানা মতিউর রহমান) এর লেখক উক্ত বইয়ের ১২৩ পৃষ্ঠায় আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন অথচ আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী এর অভিমত কী তা ব্যক্ত করে নি, অথচ দেখুন তিনি নিজেই এই হাদিসের উপর আমল করতেন এবং তাঁর উপর ফতোয়া দিয়েছেন। যেমন তার গ্রন্থ "মাজমুআয়ে ফতোয়ায়ে আব্দুল হাই" এ লিখেন,
অর্থাৎঃ "জেনে রাখুন! নিশ্চয় মুস্তাহাব হলো আযানে যখন প্রথম শাহাদাত বাক্য বলবে, তখন শ্রোতারা বলবে صلى الله عليك يا رسول اللهতারপর যখন দ্বিতীয় শাহাদাত বাক্য বলবে তখন শ্রোতারা বলবে যে قرة عينى بك يا رسول الله অতঃপর বলবে اللهم متعنى بالسمع والبصرতারপর দুই বৃদ্ধাঙ্গুলী দ্বয়ের নখের পৃষ্ঠে চুমু দিয়ে চক্ষুদ্বয়ের উপর মুছে দেবে, যে অনুরুপ করবে নিশ্চয় রাসুল (صلى الله عليه و آله وسلمতাকে বেহেশতের দিকে নিজের পিছনে নিবেন, এটা 'কানযুল ইবাদে' আছে।
[সূত্রঃ আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভি : মাজমূআয়ে ফতোয়া, ১/১৮৯, কিতাবুস সালাত।]
প্রমাণ হয়ে গেল, হযরত আব্দুল হাই লাক্ষনৌভি রহমাতুল্লহি আলাইহি নিজেই এটার উপর আমল করতেন।
হানাফী মাযহাবের অন্যতম প্রসিদ্ধ ফক্বিহ্ ঈমাম তাহতাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর ফতোয়ার কিতাবে লিখেছেন,
অর্থাৎঃ "ঈমাম কুহিস্তানী রহমাতুল্লহি আলাইহি কানযুল ইবাদ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন নিশ্চয় মুস্তাহাব হলো আযানে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ শুনবে তখন বলবে صلى عليك يا رسول اللهআর যখন দ্বিতীয়বার শুনবে তখন বলবেقرة عينى بك يا رسول الله তারপর এই দোয়া পড়বেاللهم متعنى بالسمع والبصر পড়ার পর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখে চুমু খেয়ে চক্ষুদ্বয়ে রাখবেন। যে এরুপ করবে তাকে হুযুর (صلى الله عليه و آله وسلم)নিজের পিছনে টেনে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।"
[সূত্রঃ ঈমাম তাহতাভী : মারাকিল ফালাহ, ১/২০৬পৃ., কিতাবুল আযান, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানান।]
আল্লামা ঈমাম তাহতাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি আরও একটু সামনে অগ্রসর হয়ে উল্লেখ করেন, وكذا روي عن الخضر عليه السلام وبمثله يعمل في الفضائل"এ ব্যাপারে হযরত খিযির 'আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণনা রয়েছে, যা ফাযায়েলে আ'মালের জন্যে গ্রহণযোগ্য।"
[সূত্রঃ ঈমাম তাহতাভী : মারাকিল ফালাহ, ১/২০৬পৃ., কিতাবুল আযান, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানান।]
প্রসিদ্ধ কিতাব সালাতে মাসউদী কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ড باب نماز অধ্যায়ে আছে,
অর্থাৎঃ "হুজুর (صلى الله عليه و آله وسلم)থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আযানে আমার নাম শুনে স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চোখের উপর রাখে আমি তাকে কিয়ামতের দিন কাতার সমূহের মধ্যে খোঁজ করবো এবং নিজের পিছে পিছে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাব।"
[সূত্রঃ আল্লামা মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হক, ২৪৬পৃ.।]
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি এঁর লিখিত ফতোয়ার কিতাব শরহে নেকায়ার প্রথম খণ্ডেরباب الذان অধ্যায়ে উল্লেখ আছে,
অর্থাৎঃ "জানা দরকার যে, মুস্তাহাব হচ্ছে যিনি দ্বিতীয় শাহাদাতের প্রথম শব্দ শুনে বলবেনصلى الله عليك يا رسول الله দ্বিতীয় শব্দ শুনে বলবেনقرة عينى بك يا رسول الله এবং নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখে চুমু খেয়ে চক্ষুদ্বয়ে রাখবেন, তাকে হুযুর (صلى الله عليه و آله وسلم)(হাশরে) নিজের পিছনে পিছনে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাবেন। অনুরুপ কানযুল ইবাদ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।"
الفجر الصادق কিতাবের ৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
অর্থাৎঃ "শাইখুল মাশাইখ রঈসুল মুহাক্বিকীন মক্বায়ে মোকাররমার হানাফী উলামায়ে কেরামের ঈমাম মাওলানা কামালুদ্দীন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আল মক্কী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর ফতোয়ায় বলেন, আজানের মধ্যে রাসূলে পাক (صلى الله عليه و آله وسلم)এর নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করে তা উভয় চোখের পাতার উপর রাখার ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে এটা জায়েজ নাকি না জায়েজ? উত্তরে আমি বলছি, হ্যাঁ, এটা জায়েজ বরং মুস্তাহাব। আমাদের মাশায়েখগণ এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।"
[সূত্রঃ আল্লামা আবু হামিদ মারযুক : আল ফাজরুস্ সাদিক্ব, ৮৩পৃ.।]
সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ 'ফাতহুল মুগীছ শরহে উলফিয়্যাহ' এর ২৭পৃষ্ঠায় অনুরুপ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এ ছাড়া হাদিস বিশেষজ্ঞগণ অদ্যাবধি اربعينات('আরবাঈনাত' এমন একটি হাদিস গ্রন্থ যেখানে শুধুমাত্র চল্লিশটি হাদিস রয়েছে।) রচনা করে আসছেন।
মুহাদ্দিসিনে কিরামের অসংখ্য নজীরও অনুরুপভাবে আমাদের নিকট উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে মওজুদ রয়েছে। দীর্ঘ হওয়ার কারণে আমরা তা এখানে উল্লেখ করি নি।
আল্লামা মুহাদ্দিস তাহের পাটনী হানাফী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ تكمله مجمع بحار الانوار(মাযমাউল বিহারুল আনওয়ার) এ হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস উল্লেখ করে ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহির রায় প্রকাশ করার পর লিখেছেন وروى تجربة ذالك عن كثيرين "এটি পরিক্ষিত আমল হিসেবে অনেকের থেকেই বর্ণিত হয়েছে।"
আল্লামা শামসুদ্দীন বিন আবু নসর বুখারী এর দৃষ্টিতে এ আমলঃ
হযরত ঈমাম তাউস রহমাতুল্লহি 'আলাইহি বলেন, আমি আবু নসর বুখারী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি কে হাদীস বর্ণনায় শুনেছি যে,
অর্থাৎঃ "কোন ব্যক্তি মুয়াযযিনকে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলতে শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখে স্পর্শ করবে এবং এই দোয়া পাঠ করবে اللهم احفظ حذفتى ونورهما ببركة حذفتى محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم ونورهمতাহলে সে কখনো অন্ধ হবে না।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ঈমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ১/২৮৫পৃ., হাদীস ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭১পৃ., হাদীস ২২৯৬।
৩/ মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হক্ব, ২/২৪৬পৃ.।
আল্লামা আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মাদ রহমাতুল্লহি 'আলাইহির দৃষ্টিতে এ আমলঃ
আল্লামা আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মাদ রহমাতুল্লহি 'আলাইহি বলেন,
অর্থাৎঃ "যে ব্যক্তি আযানে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ্ (صلى الله عليه و آله وسلم)শুনে যদি বলে مرحبا بحبيبى وقوة عينى محمد بن عبد الله صلى الله عليه وسلم তারপর স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখে লাগাবে, সে কোনদিন অন্ধ হবে না এবং তার চোখ কখনও রোগাক্রান্ত হবে না।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ঈমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ১/২৮৫পৃ., হাদীস ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭১পৃ., হাদীস ২২৯৬।
৩/ মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হক্ব, ২/২৪৬পৃ.।
আল্লামা ঈমাম ফক্বিহ মুহাম্মাদ বিন শায়বানী রহমাতুল্লহি 'আলাইহির দৃষ্টিতে এ আমলঃ
আল্লামা ঈমাম ফক্বিহ মুহাম্মাদ বিন শায়বানী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি হাদীস নকল করে এটার উপর আমলের ব্যাপারে বলেন,
অর্থাৎঃ "এক সময় জোরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। তখন তার চোখে একটি পাথরের কণা পড়েছিল যা তিনি বের করতে পারেন নি এবং খুবই ব্যথা অনুভব হচ্ছিল। যখন তিনি মুয়াযযিনের কণ্ঠে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলূল্লাহ শুনলেন, তখন তিনি مرحبا بحبيبى وقوة عينى محمد بن عبد الله صلى الله عليه وسلم পাঠ করলেন এবং অনায়াসে চোখ থেকে পাথর বের হয়ে গেল।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ঈমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ১/২৮৫পৃ., হাদীস ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭১পৃ., হাদীস ২২৯৬।
৩/ মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হক্ব, ২/২৪৬পৃ.।
মিশরের পুরাতন আলেমদের আমলঃ
আল্লামা ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন,
অর্থাৎঃ "মসজিদে তৈয়বাহ আল মদিনার ঈমাম ও খতিব ছিলেন হযরত শামস মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল মাদানী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে লিখেন তিনি মিশরে বুজুর্গ হতে শুনেছেন যে, "আযানে রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর নাম মোবারক শ্রবণ করিয়া রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর প্রতি দুরূদ পড়ে তারপর বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ে চুমু দিয়ে অতঃপর চোখে মাসেহ করিবে সে কোন দিন চোখের অসুস্থতায় ভোগবে না।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ঈমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ১/৩৮৪পৃ., হাদীস ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭০পৃ., হাদীস ২২৯৬।
৩/ মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হক্ব, ২/২৪৯পৃ.।
অাল্লামা ইবনে সালেহ রহমাতুল্লহি 'আলাইহির দৃষ্টিতে এ আমলঃ
আল্লামা ইবনে সালেহ রহমাতুল্লহি 'আলাইহি বর্ণনা করেন,
অর্থাৎঃ "আমি ফক্বিহ মুহাম্মাদ বিন যারানাদি রহমাতুল্লহি 'আলাইহি হতে শ্রবণ করেছি তিনি ইরাক ও আজমের বড় শায়খ হতে বর্ণনা করেছেন, হুজুর (صلى الله عليه و آله وسلم)এর নাম মোবারক আযানের মধ্যে শ্রবণ করে বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ে চুমু দিয়ে চোখে মালিশ করবে তারপর বলবে صلى الله عليك يا سيدى يا رسول الله يا حبيب قلبى ويا نور بصرى ويا قرة عينىদু'জন শায়খই বলেছেন, যখন থেকে আমরা এই আমল করতে লাগলাম তখন থেকে আমাদের চোখ কোনদিন অসুস্থ হয় নি।"
সূত্রঃ
১/ আল্লামা ঈমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা, ২৮৪পৃ., হাদীস ১০২১।
২/ আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা, ২/২৭০পৃ., হাদীস ২২৯৬।
৩/ মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী : জা'আল হক্ব, ২/২৪৯পৃ.।
বিশ্ববিখ্যাত সূফী সাধক আল্লামা জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী শরীফে মুহাম্মাদ (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর নামের বরকত ও ফযিলত সম্পর্কে কাব্যের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন যার বাংলা অনুবাদ নিম্নে দেয়া হল-
(ক) ইঞ্জিল কিতাবে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (صلى الله عليه و آله وسلم)এর পাকনাম লিপিবদ্ধ ছিল- যিনি নবীকুল সরদার ও যাঁর জীবন অতি পূতঃপবিত্র।
(খ) উক্ত ইঞ্জিল কিতাবে হুযুরের শারীরিক গঠন, অবয়ব, স্বভাব-চরিত্র, জিহাদ, রোযা পালন এবং পানাহারের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ ছিল।
(গ) খৃষ্টানদের একটি সম্প্রদায় যখন এই ইঞ্জিল গ্রন্থে পূতঃপবিত্র নাম ও সম্বোধনের স্থানে গিয়ে উপনীত হতো, তখন তারা পূণ্য লাভের নিমিত্তে এই পবিত্র নামে চুম্বন দিতো এবং তাঁর পবিত্র আলোচনার প্রতি সশ্রদ্ধ মনোনিবেশ করতো।
(ঘ) এহেন সম্মান প্রদর্শনের কারণে তাদের বংশধর বহুগুনে বৃদ্ধি পেলো এবং হযরত আহমদ মুজতবা (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর নূর মোবারক প্রতি ক্ষেত্রে তাদের সহায় ও সাথী হলো।
(ঙ) অপরদিকে খৃষ্টানদের অপর একটি সম্প্রদায় নবী করিম (صلى الله عليه و آله وسلم)এঁর নামের অবমাননা করতো। তাই তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হলো এবং ধ্বংস হলো; আর তাদের মাযহাব তথা ধর্মীয় বিশ্বাস কলুষিত হয়ে পড়লো।
(চ) হযরত আহমদ মুজতবা (صلى الله عليه و آله وسلم)নাম মোবারক যদি এমন সহায় সাহায্যকারী হয়, তাহলে তাঁর পবিত্র নূরের সত্তা কত সাহায্যকারী ও সহায়তাকারী হবে- তা সহজেই অনুমেয়। শুধু আহমদ নাম যদি নিরাপত্তার জন্যে সুদৃঢ় দূর্গের ন্যায় হয়, তাহলে স্বয়ং রুহুল আমীন ও আহমদ নামধারী ঐ পবিত্র সত্ত্বার মর্যাদা কতটুকু মহিমাময় হবে?
[সূত্রঃ মাওলানা জালালুুদ্দীন রুমী : মসনবী শরীফ, ১ম দপ্তর, ২৪২পৃ.।]
ছারছীনা মাদ্রাসার আল্লামা নেছারুদ্দীন অাহমদ সাহেবের ফতোয়ার কিতাব 'তরিকুল ইসলাম' এর ১ম খণ্ডে ১৯২ পৃষ্ঠায় এ হাদিসের উপর আমলের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
প্রচলিত জাল হাদীস বইয়ে (মতিউর রহমান লিখিত) আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি রহমাতুল্লহি 'আলাইহির নাম দিয়ে দাবী করেছে যে, "তিনি নাকি বলেছেন এ ব্যাপারে যতগুলো হাদিস বর্ণনা এসেছে সবগুলো জাল।" অথচ ঈমাম সুয়ূতি রহমাতুল্লহি 'আলাইহি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস প্রসঙ্গে কোন কিছু উল্লেখই করেন নি। তিনি শুধু এ ব্যাপারে দুইটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে হযরত আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদিস নেই।
[সূত্রঃ ইমাদুদ্দীন : জালালুদ্দীন সুয়ূতি, পৃ., ১২৩।]
আমরা প্রথমে যে হাদিসটি উল্লেখ করেছি সেটি ঈমাম সুয়ূতি রহমাতুল্লহি 'আলাইহি স্বয়ং তার কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
বিরোধীতাকারীরা অন্ধভাবে ভূয়া উদ্ধৃতি সাধারণ পাঠকের সামনে তুলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যে অপচেষ্টা করছে। মূলত তারা এ ভূয়া উদ্ধৃতিটি পাকিস্তানের ওহাবী দেওবন্দী সরফরায খাঁনের "রাহে সুন্নাত" থেকে সংগ্রহ করে অন্ধভাবে বর্ণনা করছে।
এ যুগের নামধারী আহলে হাদিসদের দৃষ্টিতে এ হাদিসের অবস্থানঃ
নামসর্বস্ব আহলে হাদীসের মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দিন আলবানী তার "সিলসিলাতুল আহাদিসুদ্- দ্বঈফাহ" গ্রন্থের ১/১০২ পৃষ্ঠা, হাদিস নং ৭৩ এ রাসূল (صلى الله عليه و آله وسلم)এর নাম মোবারক শুনে চুমু খাওয়ার হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদিস প্রসঙ্গে বলেন, لايصحঅর্থাৎ হাদিসটি সহীহ্ পর্যায়ের নয়। তাই বুঝা গেল, হাদিসটি জাল বা বানোয়াট নয়। কারণ আলবানী জাল হাদিসকে সরাসরি موضوعবলে উল্লেখ করেন।
কিন্তু এখানে আলবানী মওযু (موضوع) বা জাল শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছে।
অপরদিকে আলবানী দলীল পেশ করেছে,
অর্থাৎঃ উক্ত হাদিসটি ঈমাম দায়লামী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর "মুসনাদিল ফিরদাউস" গ্রন্থে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা তাহের পাটনী তাঁর ''তাযকিরাতুল মাওদ্বুআত" গ্রন্থে বলেন, হাদিসটি সহিহ্ পর্যায়ের নয়, তেমনিভাবে আল্লামা শাওকানী "আহাদিসুল মাওদ্বুআত" এর ৯ম পৃষ্ঠায় এবং ঈমাম সাখাভী রহমাতুল্লহি 'আলাইহি তাঁর "মাকাসিদুল হাসানা" গ্রন্থে অনুরুপ বক্তব্য বর্ণনা করেন।"
প্রিয় পাঠক, হাদিস শাস্ত্রের বিধান হচ্ছে মুহাদ্দিসিনে ক্বিরাম হাদিসটি সহিহ্ নয় বললে হাদিসটি বাতীল বা অগ্রহণযোগ্য বা জাল হওয়া শর্ত নয়, যা উপরের লিংকের প্রবন্ধে আমরা দেখেছি।
কাজেই হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রের হাদিসটি হাসান পর্যায়ের। আর হযরত মূসা (আলাইহিস সালাম) এর যুগের হাদিসটির সনদ সহিহ্ পর্যায়ের। আর খিযির 'আলাইহিস সালামের আমলের বর্ণনাটি মুনকাতি'য় হওয়ার দরুন কিছুটা দ্বঈফ।
যেহেতু দ্বঈফ হওয়া পরিত্যাজ্য হাদিস নয়, সে কারণে ফাজায়েলে আমলের ক্ষেত্রে জঈফ হাদিসের উপর আমল করা মুস্তাহাব। সুতরাং আযানের মধ্যে শাহাদৎ বাক্য পাঠ করার সময় বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় চুম্বন করা মুস্তাহাব। কেননা এটা বিশুদ্ধ মওকুফ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এবং 'আল মাকাছেদুল হাছানাহ' কিতাবের ১৮১পৃষ্ঠায় এর দ্বারা চোখের উপকারিতার উপর অসংখ্য ঘটনাবলী বর্ণিত রয়েছে। এমনকি 'মাজমাউল বেহার' কিতাবের সুপ্রসিদ্ধ লেখক এটাকে মুসলিম সমাজের পরীক্ষিত ও ধারাবাহিকভাবে মুসলিম উম্মাহর প্রচলিত প্রথা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
______________
ফতোয়ায়ে শামীর ফতোয়া।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1929589644023138
____________