▆ "ইলমে তাসাওউফ" : "তাজকিয়ায়ে নাফস" : চরিত্র গঠন ▆

মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাথে যেমনভাবে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বিধি-বিধান রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে মানুষের আত্মার সাথে সম্পৃক্ত বিধি-বিধানও আছে।
শারিরীক বিধানের মতোই ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে হারাম, মাকরূহ।
এই আত্মিক জগতের পরিশুদ্ধি কিংবা ইসলাহে কলবের নাম হলো তাযকিয়া।
দ্বীনের এই অংশটি অতীতের কোন এক সময়ে "তাসাওউফ" নামে পরিচিতি পেয়ে গেছে।
আবার
আমাদের উপমহাদেশে তা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে 'পীর-মুরিদী' নামে।
যে ইলম অভ্যন্তরীণ সৎ গুণাবলীর বিশদ ব্যাখ্যা এবং তা অর্জনের দিক নির্দেশনা দেয়; অন্তরের রোগ সমূহের বিশ্লেষণ এবং তার চিকিৎসা নির্ধারণ করে তারই নাম "ইলমে তাসাউওফ"।
আর
সেসব সৎ গুণাবলী অর্জন এবং আত্মিক রোগ মুক্তির জন্যে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও হক্কানী বুযুর্গের চিকিৎসা ও তরবিয়তের অধীনে থাকার নাম 'পীর-মুরীদী'।

তসাওউফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
তসাওউফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ পাকের মহব্বত, আল্লাহর ভয়, ইয়াকিন, ইখলাস, ইস্তিহযার, ইহসান ও আখলাকে হামিদা অর্জন করা।
ইসলামে তাই এর গুরুত্ব অনেক বেশি এবং নিঃসন্দেহে ঈমান ও ইসলামের পূর্ণতাও এগুলোর উপর নির্ভরশীল এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উম্মতকে এসব শিখিয়েছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন।

এই তাসাউফ অর্থাৎ ইসলাহে বাতেনকে তথা আত্ম শুদ্ধিকেই কুরআনের ভাষায় তাযকিয়া বলা হয়।
আর
এই তাযকিয়াকেই আল্লাহ তাআলা সফলতার চাবিকাঠি বলেছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا
অর্থাৎ, যে নিজের নফসকে পবিত্র করছে, সেই সফলকাম হয়েছে
وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا
এবং যে নিজেকে কলুষিত করেছে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছে।
*_* সূরা আশ-শামস; আয়াত ৯।

এ তাযকিয়াই আখেরী নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের প্রেরণের একটি উদ্দেশ্য।
কুরআনের ভাষায়-
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ [٣:١٦٤
অর্থাৎ : আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন (তাযকিয়া) করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।
*_* সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৬৪।

উক্ত আয়াতে (এমনিভাবে সূরা বাকারার ১২৯ নং আয়াতে) থেকে সুস্পষ্ট যে, কালামে পাকের তেলাওয়াত এবং কোরআন ও হিকমত শিক্ষার পাশাপাশি তাযকিয়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া অালিহি ওয়াসাল্লামের আগমনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।
আর
এ তাযকিয়াই তাসাউফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে তাযকিয়ার জন্যে কেনো কোনো শায়খের প্রয়োজন যেখানে আমাদের সামনে কোরআন ও সুন্নাহ রয়েছে?

উপরের আয়াত থেকেই একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,
ইলম ও কিতাব আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়, বরং এর জন্য জরুরী এমন একজন "মুযাক্কী' তথা সংশোধনকারীও, যার তরবীয়ত ও তত্বাবধানে এ দৌলত অর্জন করা যেতে পারে।
কারণ
শুধু নীতি ও দর্শনগত দিক থেকে কোন বিষয় হাছিল হওয়ার দ্বারা আমলের পূর্ণতা (Maturity) অর্জিত হয় না।
তাই
যতদিন কোন রাহানুমা/রাহবার /মুরব্বী/বয়:জ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে থেকে আমলী সংশোধনের মাধ্যমে দ্বীনকে অভ্যাসে পরিণত না করবে ততদিন পর্যন্ত অপূর্ণতা থেকেই যাবে।
সুলূক ও তাসাওউফে একজন কামেল শাইখ বা উস্তাদ কিংবা পীরের কাজ এতটুকু যে, কোরান-হাদিসে যেসব বিধানাবলীর তাত্ত্বিক (থিওরিক্যাল) আলোচনা রয়েছে, তিনি সেগুলোকে আমলের রূপদান এবং অভ্যাসে পরিণত করিয়ে থাকেন অর্থাৎ ব্যবহারিক (প্র্যাকটিক্যাল) শিক্ষা দিয়ে থাকেন।

কোরআন-হাদিস অনুযায়ী একথা স্পষ্ট যে,
মানব জাতির ইসলাহ ও তরবিয়তের জন্য সর্বযুগে দুটি জিনিস প্রয়োজন।
তা হলো:
এক- কুরআন ভিত্তিক হেদায়াত।
দুই- তা বুঝা এবং সে মুতাবেক আমল করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য শরীয়ত বিশেষজ্ঞ ও আল্লাহওয়ালাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।
একথা শুধু দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং পৃথিবীর অন্যান্য বিদ্যা (Faculty) এবং শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা পদ্ধতির জন্যও প্রযোজ্য।
যেমন :
একদিকে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নির্ভরযোগ্য পুস্তকাবলী, অন্যদিকে থাকবে বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিবর্গের তা'লীম ও তরবিয়ত ও দিক নির্দেশনা।
তাই
সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের অধিকাংশ সময় নববী মজলিসে কাটাতেন।
ইসলামি শিক্ষার তরবিয়ত হাতে-কলমে (Practically) গ্রহণ করতেন।
এজন্যই পূর্ববর্তীদের মাঝে শুরু থেকেই বুযুর্গদের (Matured) সংশ্রব অবলম্বন এবং তাঁদের নসীহত ও ইসলাহের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার ধারা চলে আসছে।
আত্মশুদ্ধি ও আমলী তরবিয়ত এ পথে যতটুকু সম্ভব, শুধু কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে তা সম্ভব নয়।

শাইখুত তা'লীম বা উস্তাদঃ
দ্বীনী ইলম যে শাইখ (Master) থেকে অর্জন করা হয় তাকে বলে শাইখুত তা'লীম বা উস্তাদ।
শাইখুত তরবিয়ত তথা পীর বা মুরব্বীঃ
যে শাইখ (Master) হতে তাযকিয়া ও তরবিয়ত অর্জন করা হয় তাঁকে বলা হয় শাইখুত তরবিয়ত তথা পীর বা মুরব্বী।
কখনো এমন হতে পারে যিনি উস্তাদ তার মুরব্বী (Practically Experienced Master) হওয়ার যোগ্যতাও আছে।
যাহোক, নফসের ইসলাহ ও সংশোধনের জন্যে, তরবীয়তের জন্যে একজন শাইখ (Master) কিংবা মুরব্বী (Practically Experienced Master) এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
একে 'পীর-মুরীদী' বলা হোক কিংবা অন্য কিছু, সেটা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।

সোহবত বা সান্নিধ্য লাভের প্রভাবঃ
সোহবত বা সান্নিধ্য লাভের প্রভাব স্বভাবের উপর অত্যন্ত কার্যকরী হয়। এটি অতি সুস্পষ্ট বিষয়।
এজন্যে শরীয়তে নেককার এবং উলামায়ে কেরামের সংসর্গ অবলম্বনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা'আলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ [٩:١١٩]
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।
*_* সূরা তাওবা, আয়াত ১১৯।
উপরের আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তা'আলার ভয় অর্জনের পন্থা বাতলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহওয়ালা তথা আল্লাহর সত্যিকারের বান্দাদের সান্নিধ্যই মানুষকে পাপমুক্ত শুদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে।
অতএব
আত্মশুদ্ধির সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ পথ হলো সত্যিকার আল্লাহওয়ালাদের সান্নিধ্য বা সোহবত।

হাদিসেও আল্লাহওয়ালাদের সান্নিধ্যের কথা বলা হয়েছে এবং সাথে সাথে অসৎ সঙ্গ বর্জনের জন্য কঠোরভাবে তাকিদ দেওয়া হয়েছে।

ইমাম বায়হাকী (রহ) স্বীয় হাদিস গ্রন্থ 'শুয়াবুল ঈমান' এ লিখেনঃ
"স্বতঃসিদ্ধ কথা যে,
একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যখন জ্ঞানীদের সাথে উঠা-বসা করে তখন তার বুদ্ধিমত্তা আরো বৃদ্ধি পায়।
একজন আলেম যখন উলামায়ে কেরামের সংস্পর্শে আসে, তখন তার ইলম বৃদ্ধি পায়।
এমনিভাবে
একজন পুণ্যবান ও জ্ঞানীদের সোহবতে এলেও তাই হয়।
কাজেই
সৎগুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদের সোহবতে একজন সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন হবে এটাও অনস্বীকার্য।"
*_* শুয়াবুল ঈমান; ৬/২২৯।

হাদিসে ইরশাদ করা হয়েছেঃ
"পুণ্যবান সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গী যথাক্রমে মেশক বহনকারী এবং হাপরের ফুৎকারদানকারীর ন্যায়।
মেশক বহনকারী হয়ত তোমাকে মেশক প্রদান করবে কিংবা তুমি তার নিকট হতে ক্রয় করবে।
তাও না হলে সুগন্ধি তুমি অবশ্যই পাবে।
পক্ষান্তরে
হাপরের ফুৎকারকারী হয়ত তোমার কাপড় জ্বালাবে, নতুবা দুর্গন্ধতো অবশ্যই পাবে।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সহীহ বুখারী; ২/৮৩০, হাদিস ৫৫৩৪।
আরেক হাদিসে দুর্গন্ধের জায়গায় বলা আছে-
"তার স্ফুলিঙ্গ না লাগলেও ধোঁয়া থেকে রেহাই পাবে না।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সুনানে আবু দাউদ; ২/৬৬৪, হাদিস ৪৮১৯।

অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে-
"তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী সে, যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যার কথায় ইলম বৃদ্ধি পায়; যার কাজ-কর্ম তোমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* আব্দ ইবনে হুমাইদ, আবু ইয়ালা- ইথাফুল খিয়ারা; ৮/১৬৩।

আরেক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
"মুমিন মুমিনের জন্য আয়না"।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সুনানে আবু দাউদ; ২/৩১৭, হাদিস ৪৯১৮।
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুনাভী (রহ) বলেনঃ
"যে ব্যক্তির মধ্যে ঈমানী গুনাবলীর সমন্বয় ঘটে, ইসলামের আদব-শিষ্টাচার পূর্ণতা লাভ করে এবং যার অন্তর সৎচরিত্রে আলোকিত, যার অন্তকরণ ইহসানেরর চূড়ায় আরোহণ করে, তিনি লির্মলতায় হন আয়নাতুল্য।
মুমিনগণ তাঁর দিকে তাকালে তাঁর স্বচ্ছতায় নিজেদের দোষগুলো দেখতে পায়।
ভেসে উঠে তার সুন্দরতম চরিত্রে নিজেদের অসুভ কার্যকলাপসমূহ।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ফয়যুল কাদীর; ৬/২৫১-২৫২।

সারকথা
আত্মশুদ্ধির জন্যে, তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে নেককার মুত্তাকীদের সোহবত-সংশ্রব অবলম্বনের অপর নাম 'পীর-মুরিদী' বা 'তাসাওউফ'।
আর
যে শাস্ত্রে কুরআন-হাদিস এবং সলফের (পূর্বসূরীদের) বাণীসমূহের আলোকে আত্মশুদ্ধি বা পীর-মুরীদী সম্পর্কিত নিয়ম কানুন ও তার বিধিবিধানের আলোচনা করা হয় তারই নাম "ইলমে তাসাওউফ"।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
"শুনে রাখ! মানব শরীরে একটি গোশতের টুকরোম আছে, যা ঠিক হয়ে গেলে পুরো শরীর ঠিক হয়ে যায়।
আর তা নষ্ট হয়ে গেলে পুরো শরীরটাই নষ্ট হয়ে যায়।
আর শুনে রাখ! সে টুকরোটি হচ্ছে ক্বলব ।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সহীহ বুখারীঃ ১/১৩, হাদিস ৫২;
*_* সহীহ মুসলিমঃ ২/২৮, হাদিস ৩৯৭৩।

চিন্তার বিষয় এই যে,
সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ইমামুল মুর্সালীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম পুরো শরীরের আমলের ইসলাহ ও সংশোধনকে অন্তরের ইসলাহ ও সংশোধনের উপর নির্ভরশীল বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেছেন,
অন্তরের ত্রুটি দেখা দিলে পুরো শরীরের আমলের মাঝে ত্রুটি ও বিপর্যয় দেখা দেয়।
আত্মিক গুণাবলীর মাঝে আছে-
'ইখলাস, খোদাভীতি, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি, আল্লাহর মহব্বত, বদন্যতা ও নম্রতা ইত্যাদি।

পক্ষান্তরে
আত্মিক রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে- রিয়া, কপটতা, অহংকার, আত্মগর্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, অবৈধ যৌনাচার, কুপ্রবৃত্তি, ধন-সম্পদ ও সম্মানের মোহ, লোভ-লালসা ও কুধারণা ইত্যাদি।


কুরআন হাদিসে অন্তরকে উপরোক্ত গুণাবলীসহ অন্যান্য গুণাবলী দ্বারা অন্তরকে সুসজ্জিত করার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সাথে সাথে উপরোক্ত রোগসমূহসহ অন্যান্য রোগ থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখার জন্যেও জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং অন্তরকে এসবের সাথে জড়ানোর ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।

এখন অনেকেই প্রশ্ন করেন তাসাওউফে আত্মশুদ্ধির জন্য যে বিশেষ ধরণের কাজগুলো করা হয় সেগুলোর সুস্পষ্ট বিধান তো কোরআন হাদিসে নেই, তাহলে এটা কি বিদায়াত নয়?

তাসাওউফের মূল লক্ষ্য ও উদেশ্য কি তা উপরেই আলোচনা করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে
তাসাওউফের মাঝে এমন কিছু কাজ করা হয় যেগুলো মাধ্যম বা উপায় বা পন্থা হিসেবে করা হয়।
এসব মাধ্যমগুলোর কোন কোনটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআন হাদিসে বিধৃত হয়েছে।
যেমন শরয়ী মুজাহাদা, অধিকতর মৃত্যুর স্মরণ ও নফসের মুহাসাবা (হিসাব নেওয়া) ইত্যাদি।

আর
কতিপয় মাধ্যম বা পন্থা এমন আছে, যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই কুরআন হাদিসে বর্ণিত নেই, আবার শরীয়তের কোন দলীলের পরিপন্থীও নয়।
বরং
হক্কানী মাশায়েখ স্থান-কাল-পরিবেশ এবং মুরীদের বিশেষ অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে সেগুলোর নির্দেশ (Prescribe) দিয়েছেন।
সেগুলো শরীয়তের বিধান হিসেবে নয়, বরং কোন শরয়ী উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য চিকিৎসা স্বরূপ (As prescriptions)।
যেমন-যিকিরের সময় বিশেষ পদ্ধতির জবর লাগানো এবং পানাহার অত্যাধিক কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
এ গুলোকে শরীয়তের হুকুম বা বিধান মনে করা বা সুন্নাতের মর্যাদা দেওয়া নিতান্তই ভুল এবং এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করাও ঠিক নয়।

তাছাড়া
যিকির ও মুজাহাদার সময় বহু মানুষই অনিচ্ছাধীন বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
যেমন যিকিরের সময় আলো দেখতে পাওয়া, কোন গায়েবী আওয়াজ শুনা, ভাল স্বপ্ন দেখা এবং ভয়ের আধিক্যে সংজ্ঞাহীন হওয়া ইত্যাদি।
এ ধরণের অবস্থা সৃষ্টি হওয়াও শরীয়তের নির্দেশনাবলীর অন্তর্ভুক্ত নয়।
এগুলোকে তাসাওউফের উদ্দেশ্য মনে করা এবং সেগুলো সম্পর্কে অতিরঞ্জিত করা আদৌ ঠিক নয়।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* আল ইতিসাম (আল্লামা শাতেবী রহঃ) : ১/২৬৫-২৬৯,
দেওবন্দী গ্রন্থ সূত্র :
*_* তারবিয়াতুস সালেক (শাহ ইসমাইল দেহলভী) :১/২৬-৩৪,
*_* কামালাতে আশ্রাফিয়াঃ ১৩৫,৩২৪;
*_* শরীয়ত ও তরীকত কা আলাযুমঃ ১৬৭-১৬৯,
*_* বিস বড়ে মুসলমানঃ ১০০-১০১৪,
*_* ইমদাদুল ফাতোয়াঃ ১/১১৬-১১৭।

কিন্তু
বর্তমানে কিছু লোকের তাসাওউফ শব্দটি শুনা মাত্রই কপালের ভাঁজ পড়ে যায়।
এর কারণ হল,
এ পরিভাষার প্রতি তাদের ভীতি জন্মেছে এবং তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে স্বয়ং তথাকথিত সূফীদের সম্পর্কে।

কিন্তু
এরূপ ঘটনা শুধু তাসাওউফের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, বরং সকল শাস্ত্র, প্রতিটি ইসলাহী দাওয়াত এবং প্রতিটি নেক কাজের একই দশা। তার ধারক-বাহকদের মাঝে, তার আহ্বায়ক এবং দাবীদারদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল খাঁটি-মেকি, অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ, পরিপক্ক-অপরিপক্ক, সত্যবাদী-মুনাফেক সব প্রকৃতির মানুষ।
এতদসত্বেও কোন তত্ত্বসন্ধানী ব্যক্তিই মূল বিষয়টির প্রয়োজনীতা অস্বীকার করতে বা তার বিরোধিতা করতে পারে না।

ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন যুগ অতিবাহিত হয়নি, যে যুগে তাসাওউফ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এবং তাসাওউফের ইমামগণ আসল-নকল, হাকীকত-সূরত, মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও প্রথাকে পৃথক পৃথক বুঝিয়ে দেননি ।

ইমাম গাযালী (রহ), শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) ও শাইখ শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রহ) থেকে নিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ), হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রহ), হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্বী (রহ) প্রমুখ মনীষীরা সবাই মূল দ্বীনী ও আনুষঙ্গিক উভয় বিষয়ে বিস্তারিত ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন।
বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে হক-নাহকের পার্থক্য তুলে ধরারা ক্ষেত্রে তাঁরা অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
কঠোর হস্তে ঐ সব রসম-রেওয়াজ খণ্ডন করেছেন, যেগুলো অমুসলিমদের সংশ্রবের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল।

এখন সূফিয়া-কিরামের কিছু বাণী দেখুন, তারা কিরূপ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ইলমে তাসাওউফের সঠিক রুপরেখা প্রদানের জন্যে-
বিখ্যাত বুযুর্গ সূফীকুল শিরোমণি জুনাইদ বাগদাদী (রহ) বলেন-
"আমাদের এই ইলম (ইলমে তাসাওউফ) কুরআন-হাদিসের সাথেই সম্পৃক্ত (অর্থাৎ, এগুলোর ভিত্তি কোরআন-হাদিস)।
সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনের ইলম অর্জন করেনি এবং হাদিস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করেনি তাকে আদর্শ বানানো যাবে না।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সিয়ারুল আলামিন নুবালাঃ ১১/১৫৪।

শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী(রহ) বলেন-
"সকল আউলিয়া কেরাম শুধু কুরআন-হাদিসের (শরীয়তের বিধানাবলী) আহরণ করেন এবং কুরআন হাদিসের যাহের মোতাবেকই আমল করেন।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* রুহুল মাআনীঃ ১৬/১৯।

ইমামে রাব্বনী মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ) স্বীয় মাততুবাতে লিখেন-
"স্বীয় যাহেরকে (বাহ্যিক দিক) শরীয়তের যাহের তথা আহকাম দ্বারা এবং বাতেনকে (অভ্যন্তরকে) শরীয়তের বাতেন (আকীদা এবং ইসলাহে নফস সংক্রান্ত বিধানাবলী) দ্বারা সুসজ্জিত রাখুন।
কেননা,
হাকীকত ও তরীকত দ্বারা শরীয়তেরই হাকীকত ও তরীকত উদ্দেশ্য। এমন নয় যে, শরীয়ত এক জিনিস আর হাকীকত ও তরীকত ভিন্ন আরেক জিনিস। কেননা, এরূপ (ভিন্নতার) ধারণা যিন্দিকী, ইলহাদ ও কুফরী।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইরশাদে মুজাদ্দেদে আলফে সানীঃ মাকতুবঃ ৫৭।

বিখ্যাত বুযুর্গ আবু ইয়াযীদ বিস্তামী (রহ) লোক মুখে যিনি বায়েজিদ বোস্তামী নামে প্রসিদ্ধ তিনি বলেন,
"তোমরা যদি কারো হাতে অলৌকিক কার্যাবলী প্রকাশ পেতে দেখ, এমনকি যদি তাকে আকাশে উড়তেও দেখ, তবু প্রতারিত হয়ো না, যতক্ষণ পর্যন্ত যাচাই করে না দেখবে যে, সে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ, শরয়ী সীমা সংরক্ষণ, শরীয়তের পাবন্দী এবং শরীয়তের অনুসরণ অনুকরণে সে কেমন?"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ ১০/৪৮৪।

তাসাওউফ শাস্ত্রের ইমাম শাইখ আবু সুলাইমান দারানী (রহ) বলেন-
"প্রায়ই আমার অন্তরে তাসাওউফের কোন ভেদতত্ত উদয় হয়, কিন্তু আমি তা নির্ভরযোগ্য সাক্ষীদ্বয়- কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল-এঁর সাক্ষী ব্যতীত গ্রহণ করি না।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ ৮/৪৭৩।

তাসাওফের নাম করে অনেক ভণ্ড বলে থাকে তারা ইয়ায়াকীনের স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই তাদের আর শরীয়তের হুকুম পালন করার প্রয়োজন নেই।
দেখুন হক্কানী সূফিগণ তাদের সস্পর্কে কি বলেছেন-
এক লোক একবার জুনাইদ বাগদাদী (রহ) কে জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ কেউ বলে থাকে, আমরা তো পৌঁছে গেছি। এখন আর আমাদের শরীয়তের অনুসরণের প্রয়োজন নেই। তিনি উত্তরে বললেন- "হ্যাঁ, তারা পৌঁছে গেছে। তবে জাহান্নামে।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* শরহু হাদিসীল ইলমঃ ১৬, রিসালাতুল মুসতারশিদীনঃ ৮৩ টিকা।
তিনি একথাও বলেছেন যে,
"এমনটি বলা যিনা-ব্যাভিচার, চুরি ও মদ্যপান অপেক্ষাও নিকৃষ্ট।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* মাজমূউ ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়াঃ ১১/৪২০।

এভাবে হক্কানী সূফিগণ বাতীলদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছেন।

উলামায়ে দেওবন্দের মাওলানা আশরাফ আলী থানভী-এর ভাষায় তাসাওউফ ও পীর-মুরীদীর হাকিকত বা সার সংক্ষেপ শুনুন।
তারপর আপনি নিজেই ভেবে দেখুন এতে কোন বিষয়টি আছে যাকে বিদায়াত বা শরীয়ত পরিপন্থী বলা যায়।

উলামায়ে দেওবন্দের হাকিম হযরত আশ্রাফ আলী থানবী সাহেব বলেনঃ
"তাসাওউফের সারকথা অতি অল্প।
তা হল,
যে নেক কাজে অলসতা অনুভব হয়, অলসতার মোকাবেলা করে সে কাজটি সম্পাদন করবেন এবং গুনাহের চাহিদা হলে তা দমন করতঃ গোনাহের কাজ হতে বিরত থাকবেন।
যে ব্যক্তি এ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছে, তার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।
কেননা, এতটুকুই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিকারী, এটাই তার সংরক্ষক এবং এটাই তাকে উন্নতির পথে অগ্রসর করবে।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ওয়াযুত তাকওয়া-বাসায়েরে হাকীমুল উম্মতঃ ১০৬।

এই হল তাসাওউফ এবং পীর-মুরীদীর মূলকথা, তার আসল অবয়ব।
অথচ
এ ব্যাপারে উদাসিনতার কারণে, স্পষ্ট ধারণার অভাবে কিছু লোক তাসাওউফ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হয়েছে এবং তাসাওউফকে বিদায়াত বা শরীয়ত পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছে।
অথচ
সত্যিকারের তাসাওউফের মাঝে শরীয়তের অনুসরণ-অনুকরণ ব্যাতীত অন্য কিছুর সামান্যতম মিশ্রণ পর্যন্ত নেই। তাসাওউফের বর্ণিত হাকিকত (মূলতত্ত্ব) জানার পর বিষয়টি দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

তাসাওউফ দ্বীনের কাজ ছাড়ানোর জন্য নয়, বরং তাসাওউফের মাধ্যমে দীনের কাজে আরো শক্তি সঞ্চার হয়, তাতে প্রাণশক্তি আসে।

ইমাম গাযালী(রহ), শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী(রহ), হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি(রহ), হযরত শাহাজালাল (রহ), হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ), হযরত শাহ ওয়ালীওল্লাহ (রহ), হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহ) প্রমুখ বুজুর্গানে দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং যা কিছু দেখিয়েছেন [যার শতাংশ বা সহস্রাংশও বড় বড় সংগঠন ও দল করতে সক্ষম নয়] এ ক্ষেত্রে তাদের ইখলাস এবং হৃদয়ের ঐ আধ্যাত্মিক শক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা তাসাওউফের এ পথে অর্জিত হয়েছিল। তাই দীনের দাঈ, আলেমদের এদিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিৎ।

এবার তাসাওউফকে ব্যঙ্গবিদ্রূপকারী সে লোকদের মতো উপমহাদেশের এক ব্যক্তির কথা শুনুন যার সাথে সে লোকদের বিশ্বাস অনেকটা মিলে যায়, তিনি হলেন মওদুদী সাহেব।
তিনি সূফীবাদের নাম, এর পরিভাষাসমূহ এবং তার রীতিনিয়মের সাথে উপহাস করেছেন।
তিনি পূর্ববর্তীগণের পূণ্যময় তাসাউফকে 'অনৈসলামিক' বলার দুঃসাহস দেখান নি বটে, কিন্তু তাসাউফকে ব্যাঙ্গ করে লিখেছেন-
"কাজেই পানি যেমন হালাল বস্তুও কোন সময় রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তা নিষিদ্ধ হয়, তেমনই এই আদর্শ (তথা তাসাওউফ) মুবাহ হওয়া সত্ত্বেও তখন এ কারণে অকাট্যরূপে বর্জনযোগ্য হয়ে গিয়েছিল যে, এর পোষাকে মুসলমানদেরকে 'আফিং'-এর চুমুক লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে নিকটে যেতেই উক্ত দীর্ঘ দিনের পুরাতন রোগীদেরকে পুনরায় সেই 'চুনাইয়া বেগম' -এর স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তাকে ক্রমশ ক্ষত করতেই থাকে।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* মওদুদী সাহেবের রচিত তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীনঃ ১৩২।

তারপর মওদুদী সাহেব ইমাম গাযযালী, ইবনে তায়মিয়া, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী-দের উপর খড়গহস্ত হয়েছেন কেনো তারা তাদের সংস্কার কাজের সময় এই "সুফিয়াতের রোগ" এর জীবানু থেকে নিজেদের মুক্ত করলেন না আর শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেনো মনযোগ দিলেন না।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীন- ৭৮, ৮৬, ১৩১, ১৩৩, ১৩৪।

যারা তাসাওউফের সমালোচনা করেন, তারা অনেকটা এপথে না এসেই, কিংবা ভাসা ভাসা ধারণার উপর।
তাই একজন বুযুর্গ খুব সুন্দর কথা বলেছেনঃ
"ঘরের ভেতরের জিনিস সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি তো ঘরে প্রবেশের পরই অর্জন করা যায়।"
এ যেন একটি প্রসিদ্ধ উক্তির বাস্তব উপলব্ধি-

من لم يذق جم يدر
অর্থাৎ, যে চেখে দেখেনি সে এর স্বাদ বুঝবে না।

মওদুদী সাহেব তার লেখায় তাসাওউফ সম্পর্কে যা লিখেছেন, তাতে এ ধারণা হয় যে, একটি মেধাবী বালক এমন এক বিষয়ে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করেছে, যে বিষয়ে প্রাথমিক ধ্যান-ধারণা লাভের সুযোগ তার হয়নি। তা সত্ত্বেও তার মেধা ধন্যবাদ লাভের যোগ্য।
আর তার চিন্তা এরকমই যে, মাথা ব্যাথা হলে পুরো মাথাটাই কেটে ফেলা উচিৎ।

তাসাওউফ সম্পর্কে এত অল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়।
কারণ
এটি একটি জরুরী এবং জটিল বিষয়।
একদিকে এটিকে নিয়ে যেমন চলছে ছাড়াছাড়ি আরেক দিকে এটিকে নিয়ে চলছে বাড়াবাড়ি।
তাই
বিনীত অনুরোধ তাসাওউফ সম্পর্কে ভালভাবে জানার জন্যে কোরআনকে নিজের খেয়াল খুশি মত বুঝতে চাইবেন না।
বরং
উলামায়ে কিরাম এবং আউলিয়া কিরাম যেভাবে বুঝিয়েছেন সেভাবেই বুঝুন।
কারণ যারা নিজেদের মন মত কোরআন বুঝতে চায়, তাদের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি ব্যতীত কোন লাভ হয়নি।
আর আপনি পীর বলেন, শায়েখ বলেন, আর ওস্তাদ বলেন, যাই বলেন না কেন একথা কেউ অস্বীকার করে নি যে, দ্বীনের পথে চলার জন্য কোন রাহবার প্রয়োজন হয়, তা না হলে নফসের অনুগামী হয়ে এই কোরআন হাদিসকেই কেউ অহংকারের কাজে, বিভেদ সৃষ্টির কাজে, কাউকে ব্যঙ্গ করার কাজে, বিনা লাজে ব্যবহার করতে পারে।
তাই এরকম নিজে নিজে কোরআন হাদিস বুঝা থেকে আল্লাহ আমদের রক্ষা করুক। আমিন।

আর
কারো মনে প্রশ্ন উদ্রেক হতে পারে যে, মানুষ দৈহিক পবিত্রতার পর তাসাওউফের শায়খ কিংবা মুরব্বীর সান্নিধ্যে গমন করে আত্মিক পবিত্রতা লাভ করলে, এতসব ঘুষ, খুন, ডাকাতী, চুরিচামারি এইগুলো কে করে?
দেখুন,
হক্ক ও বাতিলের অস্থিত্ব চিরকালীন। হক্কের তুলনায় বাতিলের সংখ্যা বেশী। অনেকেই এমন রয়েছে যে হক্কের সান্নিধ্যে গমন করে কিন্তু নিজের সংশোধনের জন্য যায় না; যায় দুনিয়া উপার্জনের জন্যে।
আর যারা নিজেদের সংশোধন চান তারা দেখে শুনে যাচাই বাছাই করেই তা করে।
আর আপনার যদি অসুখ হয় তাহলে আপনি নিশ্চয় কোন হাতুড়ী ডাক্তারের কাছে যাবেন না, অবশ্যই আপনি খুঁজেন কে কত ভাল ডাক্তার। বাকিটা নিজেই বুঝে নিবেন।

তাসাওউফে ধ্যানমগ্নতা / মোরাকাবাঃ
তাসাওউফে ধ্যানমগ্নতা সম্পর্কে কখনো অভিযোগ করা হয় যে,
"ধ্যানমগ্নতাতো হিন্দু সাধকও করে। তাযকিয়া করা হবে কোরআন ও হিকমাহর মাধ্যমে। কোন মগ্নতায় ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে না"।

দেখুন,
কোন হিন্দু সাধক কি তার ধ্যনের মাঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ধ্যান করে, আসলেই অভিযোগকারীদের বুঝ অপূর্ব!
হাদিসে কি ধ্যান করতে নিষেধ করা হয়েছে, কোন হাদিস কি তারা দেখাতে পারবে?
বরং হাদিসে তো এমন উল্লেখ আছে,
"তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এমনভাবে কাজ করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো। আর যদি তুমি তাঁকে না দেখো তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখেন।"
গ্রন্থ সূত্র :
*_* সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ১৭৩।

আর জানা থাকা চাই যে,
ধ্যান কখনো আসল উদ্দেশ্য হিসেবে করা হয় না বরং তা মাধ্যম হিসেবে করা হয়।
আর সাহাবায়ে কিরাম তো সরাসরি নবীর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং তাঁদের ইমানী হালত ও কাইফিয়াত অনেক মজবুত ছিল, তাই তারা নিজেদের বাহ্য অনুভূতি কখনো হারাতেন না, কিন্তু তাবেয়ীদের থেকেই এই বিশেষ মুরাকাবার চালু হয় যাতে আল্লাহর ধ্যান ও মুহাব্বাত অন্তরে পোক্ত হয়ে যায়।
এ অবস্থায় তারা অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন, অনেকে আল্লাহর ভয়ে মারাও গিয়েছেন।
এগুলো আমার কথা নয় বরং উয়ালামায়ে কিরামের কথা, যার রেফারেন্স দেয়া সম্ভব।

আর উলামায়ে ক্বিরাম নিজেদেরকে সাহাবাদের সমান মনে করেননি যে, তাদের হালত সাহাবীদের মতই হবে।
এখন
এ যুগে যদি কেউ মনে করে সে সাহাবীদের মাকামে পৌঁছে গেছে তাহলে এক্ষেত্রে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়।

আর
অভিযোগকারীর অভিযোগ তাযকিয়া করার জন্য শুধু কুরআন আর হিকমাই যথেষ্ট, যা সরাসরি কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক।
কারণ
এটা আল্লাহর বিধান যে, মানুষের শিক্ষা এবং সংশোধনের জন্য কিতাবুল্লাহ এবং রিজালুল্লাহ (আল্লাহ প্রেমিক মানুষ) উভয়ই প্রয়োজন।
তাহলে আল্লাহ শুধু কিতাব পাঠিয়ে দিলেই হতো আর আদেশ দিতেন, নিজে নিজে শিখে নাও আর সংশোধন হয়ে যাও।
আর সে আয়াতে (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৪)-ই দেখুন কি সুন্দর করে বলা হয়েছে, নবী তাদের কিতাব (কোরআন) ও হিকমাহ শিক্ষা দেন।
এখন যদি শুধু কিতাবই যথেষ্ট হতো তাহলে কেন নবীকে শিক্ষা দিতে বলা হলো, তখনকার আরবেরা কি আরবী বুঝতো না, বরং তখন আরবের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকরা বাস করত।
তাহলে কেনো কিতাব শিক্ষার জন্য মানুষের (রিজালুল্লাহর) প্রয়োজন হলো।
কিতাব শিক্ষা এবং সংশোধনের জন্য যে শিক্ষক প্রয়োজন তা প্রতি যুগের উলামায়ে কিরাম মেনে চলেছেন, কিন্তু যারা ঘরে বাইরে নিজদের মন মত কোরআন আর হাদিস বুঝতে চেয়েছে তারাই গোমরাহ হয়েছে।
________
▆ “ফানাফিল্লাহ” এর কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক প্রমাণঃ তাসাওউফ বা সূফীবাদের অস্বিকার কুফরী।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1843171839331586
________

Top