আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ফরমাইয়াছেন, ঈমানের শাখা-প্রশাখা ৭০ এর চেয়ে বেশি, তন্মধ্যে প্রধান শাখা কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’এর সবচেয়ে ছোট শাখা, রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু (যা ক্ষতিকারক তা) সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি প্রধান শাখা (বুখারী ও মুসলিম)।

ঈমানের আভিধানিক অর্থ নিরাপত্তা প্রদান করা, মুমিন অর্থ নিরাপত্তা প্রদানকারী। মু’মিন ঈমান এনে নিজেকে জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান বলা হয়, নবী করিম (সা.) থেকে যেসব বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেসব বিষয় দিলের দ্বারা বিশ্বাস করা ও মান্য করা।

দ্বীনের মূল হল ঈমান। এ ঈমানের ফজিলতের ওয়াজ সর্বদাই চলছে। অথচ কিসে ঈমান আনতে হবে তা অনেকেরই জানা নেই, শুধু ফাযায়েলের বয়ানেই ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। এ ঈমানের শাখা প্রশাখা পবিত্র কোরআন হাদীসের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। সীমাহীন চেষ্টার মাধ্যমে মুহাদ্দিছীনে কেরাম সেগুলো একত্রিত করেছেন। তাদের হিসেব মতো এর শাখা প্রশাখার সংখ্যা ৭৭।

সহী হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈমানের সমস্ত শাখাগুলো যার মধ্যে পাওয়া যাবে তিনিই পূর্ণ ঈমানদার হবেন। আর যার মধ্যে এক বা একাধিক শাখা থাকবে না, সে পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না। তার ঈমান অপূর্ণ রয়ে যাবে। যার ঈমান আছে –আখেরাতে তিনি হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ সফলকাম মানুষ এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মহা দৌলত জান্নাতের অধিকারী। একবিন্দু পরিমাণ ঈমান যদিও কারো থাকে, একদিন না একদিন সে জান্নাতে যাবেই।

বান্দার ওপর সর্ব প্রথম ফরজ হলো ঈমান আনা। আখেরাতে নাজাত পাওয়ার সর্ব প্রধান এবং সর্বশেষ সম্বল হলো ঈমান। কাজেই সকলেরই প্রাণপণে চেষ্টা করা দরকার যাতে ঈমানের একটি শাখাও কারো মধ্যে অনুপস্থিত না থাকে; বরং সবগুলো শাখাই তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। নিজেকে একজন পূর্ণ ও খাটি মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ঈমানের এসব শাখা সমূহের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আমল থাকতে হবে। অত্র শাখাগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো।

ঈমানের ৭৭টি শাখার মধ্যে ৩০টি দিলের সাথে,৭টি জবানের সাথে এবং ৪০টি হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ পর্বে আমরা জানবো ঈমানের ৩০টি শাখা নিয়ে, যা দিলের সাথে সংশ্লিষ্ট-

(১) আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান আনা অর্থাৎ আল্লাহ সর্বশক্তিমান, সবকিছুর স্রষ্টা, অনাদি অনন্ত তাঁর সত্তা চিরকাল আছেন ও চিরকাল থাকবেন। তাঁর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনি সকলেরই সৃষ্টিকর্তা, স্বয়ং সম্পূর্ণ। (সূরা: হাশর- আয়াত ২২,২৩,২৪)

(২) সৃষ্টিকূলের ক্ষণস্থায়ীত্বে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সব জিনিসের কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। এক আল্লাহ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং অস্তিত্ব দান করেছেন। (সূরা: বাকারা- আয়াত: ২৯)

(৩) তাঁর ফেরেস্তাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা। (সূরা: নাবা- আয়াত: ৩৮)

(৪) আসমানী কিতাব সমূহে বিশ্বাস করা (অবশ্যই বর্তমানে আল কোরআন ছাড়া অন্যান্য কিতাবের হুকুম বিদ্যমান নেই)। (সূরা: ইউসূফ- আয়াত: ২)

(৫) সকল নবী এবং রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস করা যে, তাঁরা সবাই সত্য, আল্লাহর পক্ষ হতে মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রেরিত। কোরআন ও ছহী হাদীসে তাঁদের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার ওপর ঈমান আনা জরুরী নয়। অবশ্যই এখন শুধু রাসূলুল্লাহ (সা.) এর তরিকায় চলার আদেশ বিদ্যমান আছে। কারণ তিনিই খাতামুন নাবীয়্যীন বা শেষ নবী-তাঁর পরে কোনো নবী আসবেনা। (সূরা: মুমিন- আয়াত: ৭৮)

৬) তাকদীরে বিশ্বাস যে, জগতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে বা হবে সবই আল্লাহ তায়ালা আদিকাল হতেই জানেন এবং সে হিসেবে নির্ধারিত। তাঁর জানার বা ইচ্ছার বিপরীত কোনো কিছুই হয় না। (সূরা: ফুরকান- আয়াত: ২)

(৭) কিয়ামত ও পুনরুত্থান নিশ্চয়ই হবে। পুনরায় সকলকে জীবিত হয়ে সমস্ত জীবনের পাপ পুণ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিতে হবে। (সূরা: মুমিনুন- আয়িাত: ১১৫)

(৮) বেহেস্ত আছে, নেকের পুরস্কার স্বরূপ বেহেস্ত হবে। (সূরা: নিসা- আয়াত: ১৩)

(৯) দোযখ আছে, পাপের শাস্তি স্বরূপ দোযখ হবে। (সূরা: আ‘রাফ- আয়াত ৪১)

(১০) আল্লাহ তায়ালার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা রাখা। (সূরা: আলে ইমরান- আয়াত: ৩১,৩২)

(১১) রাসূলূল্লাহ (সা.) এর প্রতি মহব্বত রাখা। (সূরা: আলে ইমরান- আয়াত ১৩২)

(১২) কারো সাথে দোস্তী বা দুশমনি রাখলে শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্যই রাখা। (মাজমাউয যাওয়াইদ: ১/৪৮৫)

(১৩) ইখলাছ- প্রত্যেক কাজ শুধু আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য এবং সন্তুষ্টির জন্য করা। (সূরা: আ‘রাফ- আয়াত ২৯)

(১৪) তওবা- কোনো গুনাহের কাজ হয়ে গেলে তার জন্য অন্তরে কষ্ট অনুভব করে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া। (সূরা: বাকারা- আয়াত ১৫৯-১৬০)

(১৫) আল্লাহকে ভয় করা (আল্লাহর আযাবের ভয় করা)। (সূরা: বাকারা- আয়াত ১৯৭)

(১৬) সর্বদা আল্লাহ তায়ালার রহমতের আশা করা, আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া কুফরীর শামিল। (সূরা: যুমার- আয়াত ৫৩)

(১৭) লজ্জা করা- আল্লাহ ও রাসূলের নীতির বিরূদ্ধ কাজে সংকোচবোধ করে তা পরিত্যাগ করা। (মুসলিম শরীফ: ১/৪৭)

(১৮) আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের শোকর আদায় করা। (সূরা: বাকারা- আয়াত ১৫২)

(১৯) বৈধ ওয়াদা পালন করা। (সূরা: বাণী ইস্রাঈল- আয়াত: ৩৪)

(২০) আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে কোনো বালা-মুছিবত, রোগ-শোক আসলে ধৈর্য্য ধারণ করা। (সূরা: আছর- আয়াত ৩)

(২১) বিনয়ী হওয়া- নিজেকে অপর হতে ছোট মনে করা। (সূরা: ফুরকান- আয়াত ৬৩)

(২২) সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়া করা। (তিরমিজী: ২/১৫)

(২৩) আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে যা কিছু হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকা। (মুসলিম শরীফ, কিতাবুল কদর: ২/৩৩)

(২৪) তাওয়াক্কুল করা- প্রত্যেক কাজের ফলাফল যে আল্লাহ তায়ালার হাতে তা বিশ্বাস করে তার ফলাফলের জন্য আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভরসা করা। (সূরা: আলে ইমরান- আয়াত: ১৬০)

(২৫) আত্মগরিমা না করা- নিজের গুণে গর্বিত না হয়ে নিজের গুণগুলো আল্লাহর দান মনে করা। (মুসলিম শরীফ: ১/৬৫)

(২৬) কারো সাথে মনোমালিন্য না রাখা। (সূরা: হজ্ব- আয়াত ৭৭)

(২৭) হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করা- অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা। মনের এভাব বর্জন করা। (বুখারী শরীফ: ২/৮৯৬)

(২৮) রাগ দমন করা। (সূরা: শুরা- আয়াত: ৩৭)

(২৯) কারো অমঙ্গল কামনা না করা। (মুসলিম শরীফ: ১/৭০)

(৩০) দুনিয়ার ধন-দৌলত ও প্রভুত্ব ইত্যাদির প্রতি মহব্বত না রাখা। (বুখারী শরীফ: ২/৯৪৯)

ডেইলি বাংলাদেশ/আরএজে

Top