‘ দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ উভয়টি আরবী শব্দ।পরবর্তীতে উর্দু এবং ফার্সি ভাষায় ও  দু’টি ব্যবহৃত হতে থাকে।এ দু’টি শব্দের যে কোন একটি, রাজনৈতিকভাবে যেমন কোন রাষ্ট্রের বিশ্লেষণ, তেমনি ইসলামের বহু অনুশাসন ও বিধি -বিধান এ দু’টি বিশ্লেষণ অনুসারে কার্যকর হয়। তাই এ দু’টি বিশ্লেষণের কোনটি, কোন রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য, তা নির্ণয়ের জন্য এ দু’টির সংজ্ঞা সম্পর্কে পরিচিত হওয়া আবশ্যক বৈ- কি।



এ দু’টি বিশ্লেষণ সম্পর্কে পরবর্তীতে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা হবে।প্রথমে সংক্ষেপে বলা যায়- ১.’ দারুল ইসলাম ‘ হচ্ছে ওই রাষ্ট্র, যাতে ‘ ইসলামি সালাতানাৎ’ বলবৎ থাকে [সুত্র : ফী- রুযুল লুগাত]

২. আর ‘ দারুল হারব’ হচ্ছে ওই রাষ্ট্র, যেখানে অমুসলিমদের শাসন প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ফরয ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পালনে বাধা দেওয়া হয়, বা নিষিদ্ধ। [ সুত্র :প্রাগুক্ত ]



এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলা – পাক- ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।তারপর দীর্ঘদিন যাবৎ ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।তারপর(১৯৪৭ ইং) হিন্দুস্থান ( ভারত) ও পাকিস্তান দু’টি  রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর(১৯৭১ইং) পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।







উল্লেখ্য, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’টি  মুসলিম রাষ্ট্র (দারুল ইসলাম) তাতে কারো দ্বিমত নেই; কিন্তু যেহেতু ভারতে তার স্বাধীনতা লাভের পূর্বে দু’শতাব্দীকাল ইংরেজদের শাসন এবং স্বাধীনতা লাভের পরে হিন্দুদের শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেহেতু হিন্দুস্থানকে  কি ‘ দারুল ইসলাম’ বলা যাবে, না ‘দারুল  হারব’ বলতে হবে? এটা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।এ প্রসঙ্গে,  দেখা যায়, এক শ্রেণীর আলিম ও রাজনৈতিক নেতা তাদের সুবিধা কিংবা দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে কখনো ‘দারুল হারব’ আবার কখনো ‘দারুল ইসলাম সাব্যস্ত করেছেন; কিন্তু যেহেতু আমাদের ইসলামী ফিক্বহ শাস্ত্রে এ প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও বিধান লিপিবদ্ধ আছে, সেহেতু আমাদের বিজ্ঞ ও নিষ্ঠাবান ওলামা-ই কেরাম এ বিষয়ে শরীয়তের আলোকে অকাট্যভাবে যুগান্তকারী ফতওয়া দিয়েছেন- যথাসময়ে। এ শেষোক্ত বিজ্ঞ ওলামা-ই কেরামের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ও আদর্শ ইমামের ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেযা বেরেলভী (রহ:)।তিনি ভারতকে ‘ দারুল ইসলাম’ হিসেবে সাব্যস্ত করে ফতওয়া প্রণয়ন করে তা প্রকাশ করলেন।তখন তা নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা হৈ-চৈ করলেও এ প্রসঙ্গে আ’লা হযরতের ফতওয়ায় বিশুদ্ধ প্রমাণিত হয়।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ আন্দোলনের পরম্পরায় ‘খেলাফত আন্দোলন’ ও ‘অসহযোগ আন্দোলন'(যথাক্রমে ‘তাহরিক ই খিলাফত’ ও’তাহরিক ই তরকে মু’আমালাত)(১৯১৯-১৯২০) অতি উল্লেখযোগ্য।এ দু’ আন্দোলনের সময়ে আ’লা হযরতের সুচিন্তিত, বাস্তব ধর্মী ও দুরদর্শিতালব্ধ অবস্থান ও নির্ভুল মতামত বা ফতওয়কে কেন্দ্র করে বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধিতার ঝড় তুলেছিল। বস্তুত এটা রাজনৈতিক আবেগ প্রবণতার যুগ ছিল।এমন নাজুক পরিস্থিতিতে আ’লা হযরতেরর খলিফাগণ, সদরুল আফাযিল সৈয়দ নঈম উদ্দীন মারাদাবাদী ও তাজুল ওলামা মাওলানা মুফতি ওমর নঈমী আলাইহিমুর রহমাহ প্রমুখ তাঁদের রাজনৈতিক মেধা, উন্নত চিন্তা ও বোধশক্তি এবং দুরদর্শিতার প্রমান রেখে গিয়েছিলেনন।তখন তাঁদের ওই ভূমিকাকে যতটুকু মূল্যায়ন করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশী মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছেন পরবর্তী তথা বর্তমানকার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।তাঁরা নির্দ্বিধায় ঔসব ওলামা ই দ্বীনের দুরদর্শিতা ও পরিণাম দর্শিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

একই পরম্পরায় ওই যুগে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী আলাইহি রাহমাহর একটি ফতওয়া “ই’লামুল আ’লাম বিআন্না হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম”( বিজ্ঞজনদের জ্ঞাতার্থে নিঃসন্দেহে হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম) নামে (১৩০৬হি./১৮৮৮ইং,মুদ্রণে ‘ হাসানী প্রেস, বেরেলী) প্রকাশিত হয়; যখন হিন্দুস্থানের একশ্রেণীর আলিম হিন্দুস্থানকে দারুল হারব সাব্যস্ত করে সুদকে বৈধ বলে সাব্যস্ত করছিল।তাদের খন্ডনে তিনি তাঁর উক্ত ফতওয়ায় উল্লেখ লিখেছিলেন-



” অর্থাৎ ওইসব লোক সম্পর্কে চিন্তা করতেও আশ্চর্যবোধ হয়, যারা সুদকে বৈধ করার জন্য, যা কোরআনের অকাট্য আয়াতসমূহ দ্বারা হারাম বলে সাব্যস্ত এবং এর বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির হুমকি এসেছে, এ দেশকে ‘ দারুল হারব’ সাব্যস্ত করেছেন,আর শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ( এদেশ) থেকে হিজরত করার খেয়ালটুকু পর্যন্ত আনেননি! এ দেশ যেন ওই দিনের জন্য ‘দারুল হারব’ হয়েছিল যে, তাতে সুদের মজা লুফে নেবেন এবং পূর্ণ আরামে প্রিয় মাতৃভূমিতে পরিতুষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াবেন! আল্লাহ তা’আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, ” তোমরা কি ‘কিতাব'(কোরআন মাজীদ) এর একাংশের উপর ঈমান রাখছো, আরেকাংশের সাথে কুফর করছো?”

[সুত্র ঃই’লামুল আলাম, পৃঃ৭,কৃতঃ ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী রহঃ]

প্রকাশ থাকে যে, ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী রহঃ নিছক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ফতওয়া আরোপের ঘোর বিরোধী ছিলেন।অর্থাৎ- যখন সমাজ তাদের সুবিধানুসারে সুদ নিতে চাচ্ছিলো,তখন হিন্দুস্থানকে ‘দারুল হারব’ সাব্যস্ত করে নিল, আর যখন রাজনৈতিক সুবিধা ভোগের নিমিত্তে মুসলমানদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করতে চাইলো তখন আবারো এ দেশকে ‘দারুল হারব’ বলে সাব্যস্ত করে নিলো! এ কেমন আবু লাহাব সুলভ পদক্ষেপ?

[সুত্র ঃ’হায়াতে মাওলানা আহমদ রেযা খান বেরেলভী, হাশিয়া,পৃঃ১০৫,প্রফেসর ড.মাসউদ আহমদ]



আ’লা হযরতের এ ফতওয়া আরোপের প্রেক্ষাপট কি ছিল?/

##############

১২৯৮ হি/১৮৮০ ইং বদায়ূনে মির্যা আলী বেগ আ’লা হযরত আহমদ রেযা বেরেলভী রহঃ থেকে ৩টি প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলেন।আ’লা হযরত তার জবাবে ” ই’লামুল আ’লাম বিআন্না হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম” শিরোনামে একটি ফতওয়া পুস্তক প্রণয়ন করেন।প্রশ্নগুলো নিম্নরুপঃ

১ম প্রশ্নঃ হিন্দুস্থান কি দারুল ইসলাম, না দারুল হারব?

২য় প্রশ্নঃবর্তমান যুগে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা কি কিতাবী, না মুশরিক?

৩য় প্রশ্নঃবিদআতীদের প্রসঙ্গে বিধান কি?



সুতারাং আলা হযরত ১ম প্রশ্নের জবাব লিখেছেন-

“আমাদের ইমামে আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু,বরং ওলামাই সালাসাহ রাহিমাহুমুল্লাহু আজমাঈনের মাযহাব অনুসারে হিন্দুস্থান হচ্ছে ‘দারুল ইসলাম; দারুল হারব মোটেই নই।কারণ, কোন ‘ দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’ হবার জন্য, আমাদের ইমাম ই আযম, ইমামদের ইমাম হযরত আবু হানিফা ( রাঃ) মতে, ৩ টি বিষয় থাকা আবশ্যক।

এক. সেখানে শির্কী বিধান প্রকাশ্যভাবে জারি করা হবে।

দুই. ইসলামী শরিয়তের বিধানাবলী মোটেই জারি হতে পারবে না।সাহিবাঈনের মতে এতটুকু যথেষ্ট।কিন্তু এখানে, আল্লাহর প্রশংসাক্রমে, এমনটি মোটেই মওজুদ নেই।

তিন. বিধানাবলীর বিবেচনায় জনসাধারণকেও দু’ভাগে ভাগ করা হয়-‘ দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’।হিন্দুস্থানে যখন ইসলামী শাসন ক্ষমতা ছিল,তখন হিন্দুস্থান তো দারুল ইসলাম ই ছিল।কিন্তু যখন হিন্দুদের উপর ইংরেজদের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হল,তখন আলিমদের মধ্যে এ আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল- এখন হিন্দুস্থান কি ‘ দারুল ইসলাম’; না ‘ দারুল হারব’! সুতারাং আলিমদের একটি দল ফতওয়া দিলেন যে, এখন হিন্দুস্থান না দারুল ইসলাম না দারুল হারব; বরং ‘ দারুল আমান'(নিরাপত্তার দেশ); যেমন- মুফতি কেফায়েত উল্লাহ সাহেব দেওবন্দি।তিনি হিন্দুস্থানকে দারুল আমান সাব্যস্থ করলেন।মুফতি আনওয়ার শাহ কাশমিরি দেওবন্দিও গবেষণা করে বললেন, আমাদের দেশ যদি দেশই হয়,তবে এটা দারুল আমান ই।[ মুহাজির নং- ৩৪]

কিন্তু আ’লা হযরত এই মাসাআলার সুস্পষ্ট ফায়সালা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, একটি দারুল ইসলাম দারুল হারব হবার জন্য নিম্নলিখিত ৩ টি শর্ত থাকা জরুরী –

১.কাফিরদের পূর্ণ দখলদারিত্ব

২.ইসলামী বিধান পালনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া

৩.সেটার সীমানার কোন অংশ ইসলামী রাষ্ট্র (দারুল ইসলাম) এর সাথে মিলিত হবে না।সংতারাং যদি কোন রাষ্ট্রের মধ্যে উক্ত ৩টি শর্তের মধ্যে কোন একটি শর্ত ও পাওয়া না যায়,তবে তা হবে দারুল ইসলাম।যেমন কোন রাষ্ট্রে কাফিরদের দখদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাতে ইসলামী বিধানাবলী একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বরং কিছুটা এভাবে স্থায়ী থাকে যে, জুমার নামায, দুই ইদের নামায,পাঁচ ওয়াক্তের নামায ও দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি পালন করা হয়।তাহলে সেটা ‘ দারুল ইসলাম ‘ ই হবে।এ দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুস্থান ইংরেজদের শাসনামলেও দারুল ইসলাম ছিল।কারণ সুস্পষ্ট, ভারতের উপর ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পালন করতে পেরেছেন। আর এ রাষ্ট্রেরর সীমানা ইরান ও আফগানিস্থানের মত ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে মিলিত ছিল। সুতারাং হিন্দুস্থান “দারুল ইসলাম” হবার মধ্যে কোন রুপ সন্দেহ নেই।

সুতারাং আ’লা হযরত বলেছেন-” আমাদের ইমাম ই আযম, বরং আইম্মা ই সালাসাহ (ইমামত্রয়) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আজমাঈনের মাযহাব মতে, হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম ; দারুল হারব মোটেই নয়। কারণ দারুল ইসলাম, দারুল হারব হবার জন্য যেই ৩ টি শর্ত থাকা প্রয়োজন, তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- সেখানে শির্কী প্রথাসমুহ প্রকাশ্যে জারী হবে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে -সেখানে ইসলামী বিধানাবলী মোটেই পালিত হতে পারবে না। কিন্তু এখানে শেষোক্ত বিষয়ের অস্তিত্ব নেই।এখানে মুসলমানদের জুমা, দু’ঈদ,আযান,ইকামত,জামাত সহকারে নামায ইত্যাদি শরীয়তের বিধান বিনা বাধায়,প্রকাশ্যে পালন করা যেতো ও যাচ্ছে। তাছাড়া, বিবাহের ফরযগুলো,দুগ্ধপান,তালাক, ইদ্দত পালন,রাজআত,মাহর,খুলা,স্ত্রীর ভরণপোষণ,শিশু পালন,বংশীয় ধারা রক্ষা, হিবাহ,ওয়াক্বফ,ওসীয়ৎ ও শোফআহ মুসলমানগণ ইসলামী আইনানুসারে পালন করে ও মীমাংসা করেন।





Top