image

**মাযার নির্মাণ ও সেখানে কুরআন তেলাওয়াত**
বর্তমানে কতিপয় মুসলমান ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে যে, মহানবী (দঃ)-সহ ঈমানদার পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারত করে কেউ তাঁদেরকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় ওসীলা বা মধ্যস্ততাকারী হিসেবে গ্রহণ করলে বা তাঁদের স্মৃতিবহ কোনো জিনিসকে বরকত আদায়ের মাধ্যম মনে করলে শিরক কিংবা বিদ‘আত হবে। ভ্রান্তদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও দাবি করে যে, এই কাজ সাহাবা-এ-কেরাম (রাঃ)-বৃন্দ করেননি, বিগত শতাব্দীগুলোতেও এগুলো অনুশীলিত হয়নি; আর মাযার-রওযার ওপর স্থাপত্য নির্মাণও শরীয়তে আদিষ্ট হয়নি। তারা রাসূলুল্লাহ (দঃ)-এর রওযা শরীফের ওপর নির্মিত সবুজ গুম্বজকে বিদ‘আত আখ্যা দিয়ে থাকে (‘সালাফী’ গুরু নাসিরুদ্দীন আলবানী এটির প্রবক্তা)। আমরা চূড়ান্তভাবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে এতদসংক্রান্ত ফায়সালা এক্ষণে অনুধাবন করবো।

**কুরআনের দলিল:**  
কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:  
> *"এবং এভাবে আমি তাদের (আসহাবে কাহাফ) বিষয় জানিয়ে দিলাম, যাতে লোকেরা জ্ঞাত হয় যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই; যখন এই সব লোক তাদের (আসহাবে কাহাফ) ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করতে লাগলো, অতঃপর তারা বললো, ‘তাদের গুহার ওপর কোনো ইমারত নির্মাণ করো! তাদের রব (খোদা)-ই তাদের বিষয়ে ভাল জানেন।’ ওই লোকদের মধ্যে যারা (এ বিষয়ে) ক্ষমতাধর ছিল তারা বললো, ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের (আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণ করবো’"* (সূরা কাহাফ, আয়াত ২১)।

**তাফসীরে কবীরে ইমাম রাযী (রহঃ)-এর ব্যাখ্যা:**  
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) এই আয়াতের তাফসীরে লেখেন:  
> *"কেউ কেউ (ওদের মধ্যে) বলেন যে গুহার দরজা বন্ধ করে দেয়া হোক, যাতে আসহাবে কাহাফ আড়ালে গোপন থাকতে পারেন। আরও কিছু মানুষ বলেন, গুহার দরজায় একটি মসজিদ নির্মাণ করা হোক। তাঁদের এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে এই মানুষগুলো ছিলেন ‘আল্লাহর আরেফীন’ (আল্লাহ-জ্ঞানী), যাঁরা এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে বিশ্বাস করতেন এবং নামাযও পড়তেন"* (তাফসীরে কবীর, ৫ম খণ্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠা)।

**মাযার নির্মাণের বৈধতা:**  
ইমাম রাযী (রহঃ) আরও লেখেন:  
> *"‘এবং আল্লাহর কালাম – ‘(এ বিষয়ে) যারা ক্ষমতাশালী’ বলতে বোঝানো হয়ে থাকতে পারে ‘মুসলমান শাসকবৃন্দ’, অথবা আসহাবে কাহাফ (মু’মিনীন)-এর বন্ধুগণ, কিংবা শহরের নেতৃবৃন্দ। ‘আমরা নিশ্চয় তাদের স্মৃতিস্থানের ওপরে মসজিদ নির্মাণ করবো’ – এই আয়াতটিতে এ কথাই বোঝানো হয়েছে, ‘আমরা যাতে সেখানে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে পারি এবং এই মসজিদের সুবাদে আসহাবে কাহাফ তথা গুহার সাথীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করতে পারি’"* (তাফসীরে কবীর, ৫ম খণ্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠা)।

**সাহাবায়ে কেরামের আমল:**  
মহান হানাফী মুহাদ্দিস ইমাম মোহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানী (রহঃ) বলেন:  
> *"ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) আমাদের জানিয়েছেন এই বলে যে, সালিম আফতাস্ আমাদের (তাঁর কাছে) বর্ণনা করেন: ‘এমন কোনো নবী নেই যিনি কা‘বা শরীফে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে নিজ জাতিকে ছেড়ে আসেন নি; আর এর আশপাশে ৩০০ জন নবী (আঃ)-এর মাযার-রওযা বিদ্যমান’"* (ইমাম শায়বানীর ‘কিতাবুল আসার’, লন্ডন সংস্করণ, ১৫০ পৃষ্ঠা)।

**মাযার ধ্বংসের বিপদ:**  
যারা মাযার-রওযা ধ্বংস করে এবং আল্লাহর আউলিয়াবৃন্দের প্রতি বিদ্বেষভাব প্রদর্শন করে, তারা কুরআন মজীদের সূরা কাহাফে বর্ণিত সুস্পষ্ট আয়াতের সরাসরি বিরোধিতা করে। অথচ কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, আউলিয়া কেরাম (রহঃ)-এর মাযার-রওযা নির্মাণ ও তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ বৈধ। এটি কুরআনের ‘নস’ (দলিল), যাকে নাকচ করা যায় না; এমনকি কোনো হাদীস দ্বারাও নয়।

**হাদীসের সমর্থন:**  
হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দঃ)-এর হাদীস:  
> *"মসজিদে আল-খায়ফের মধ্যে (‘ফী’) ৭০ জন নবী (আঃ)-এর মাযার-রওযা (এক সাথে) বিদ্যমান"* (সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৪৭৩)।  
ইমাম আল-হায়তামী (রহঃ) বলেন: *"এই হাদীসের সনদ সহীহ"* (মজমাউয্ যাওয়াইদ, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং ৫৭৬৯)।

**কবরের নিকট কুরআন তেলাওয়াত:**  
ইমাম নববী (রহঃ) ‘কিতাবুল আযকার’-এ উল্লেখ করেন:  
> *"কবর যেয়ারতকারীর উচিত সেখানে কুরআন তেলাওয়াত করা এবং ইন্তেকালপ্রাপ্তের জন্যে দোয়া করা। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও তাঁর শিষ্যবৃন্দ বলেন, ‘কুরআন খতম করলে তা উত্তম’"* (কিতাবুল আযকার, ২৭৮ পৃষ্ঠা)।

**ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যার বর্ণনা:**  
> *"হযরত হাসান ইবনে জারবী (রহঃ) তাঁর বোনের কবরে সূরা মুলক পাঠ করেছিলেন। পরে এক ব্যক্তি তাঁকে জানান, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন যে এই তেলাওয়াতের বরকতে তাঁর বোনের গুনাহ মাফ হয়েছে"* (কিতাবুর রূহ, বাংলা সংস্করণ, ১৭ পৃষ্ঠা)।

**উপসংহার:**  
কুরআন-হাদীস ও সালাফে সালিহীনের ঐক্যমত অনুযায়ী, মাযার নির্মাণ ও সেখানে কুরআন তেলাওয়াত শরীয়ত সম্মত। ওহাবী/সালাফী গোষ্ঠীর অপপ্রচার নিরসনে প্রতিটি মুসলমানের উচিত সুন্নী ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা।
Top