ছয় তাকবীরে ঈদের নামাযের সহীহ হাদীস সম্পর্কে আলোচনা।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে তাঁর বিভিন্ন শাগরিদ এ কথা যেমন বর্ণনা করেছেন যে, তিনি দুই ঈদের নামাযে ৯টি করে তাকবীর দিতেন তেমনি একাধিক সূত্রে এর ব্যাখ্যাও বর্ণিত হয়েছে। আর উভয় ধরনের বর্ণনাই হাদীসের কিতাবে কমবেশি বিদ্যমান আছে।
একটি বর্ণনা এই-

أخبرنا محمد بن أبان، عن أبي إسحاق، عن أبي الأحوص، عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه أنه كان يكبر في العيدين تسعاً تسعاً : كان يبتدئ بالتكبيرة التي يفتتح بها الصلاة، ثم يكبر ثلاثاً ثم يقرأ، ثم يكبر الخامسة فيركع بها، ثم يسجد، ثم يقوم فيقرأ، ثم يكبر ثلاثاً، ثم يكبر الرابعة فيركع بها.
অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. মুহাম্মাদ ইবনে আবান থেকে, তিনি আবু ইসহাক (আমর ইবনে আবদুল্লাহ সাবিয়ী) থেকে, তিনি আবুল আহওয়াছ থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (ইবনে মাসউদ রা.) দুই ঈদের নামাযে ৯টি করে তকবীর দিতেন। যে তাকবীর দ্বারা নামায শুরু করতেন সেই তাকবীর দ্বারা ৯ তাকবীরের প্রথম তাকবীর দিতেন। তারপর ৩ তাকবীর দিয়ে কুরআন পড়তেন। ৫ম তাকবীর দ্বারা রুকু করতেন। তারপর সেজদা করতেন। (দ্বিতীয় রাকাতের জন্য) দাঁড়িয়ে কুরআন পড়তেন। তারপর ৩ তাকবীর দিতেন। ৪র্থ তাকবীর দ্বারা রুকু করতেন।
[সূত্রঃ কিতাবুল হুজ্জা আলা আহলিল মাদীনা ১/৩০৪]।
মুহাম্মাদ ইবনে আবানের মতো ইমাম সুফিয়ান ছাওরীও আবু ইসহাক সাবেয়ী থেকে ভিন্ন সনদে একই কথা বর্ণনা করেছেন।
তাঁর বর্ণনাটি এই-
عن الثوري، عن أبي إسحاق، عن علقمة والأسود بن يزيد، أن ابن مسعود كان يكبر في العيدين تسعاً تسعاً : أربعاً قبل القراءة، ثم كبر فركع، وفي الثانية يقرأ، فإذا فرغ كبر أربعاً ثم ركع.
অর্থাৎ ইমাম আবদুর রায্যাক রাহ. (সুফিয়ান) ছাওরী থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আলকামা ও আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ থেকে, তাঁরা ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (ইবনে মাসউদ রা.) দুই ঈদের নামাযে ৯টি করে তাকবীর দিতেন। কুরআন পাঠের আগে ৪টি। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করতেন। দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়তেন। কুরআন পড়া শেষ হলে ৪ তাকবীর দিতেন। তারপর রুকু করতেন।
[সূত্রঃ মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, বর্ণনা ৫৬৮৬]।
ইবনে মাসউদ রা.-এর আমলে যেমন তেমনি ফতোয়ায়ও ৯ তাকবীরের একই ব্যাখ্যা বিদ্যমান আছে।
একটি ফতোয়া এই-

عن معمر، عن أبي إسحاق، عن علقمة والأسود بن يزيد قال : كان ابن مسعود جالساً وعنده حذيفة وأبو موسى الأشعري، فسألهما سعيد بن العاص عن التكبير في الصلاة يوم الفطر والأضحى، فجعل هذا يقول : سل هذا، وهذا يقول: سل هذا، فقال له حذيفة : سل هذا ـ لعبد الله بن مسعود ـ فسأله، فقال ابن مسعود : يكبر أربعاً ثم يقرأ، ثم يكبر فيركع، ثم يقوم في الثانية فيقرأ، ثم يكبر أربعاً بعد القراءة.
অর্থাৎ ইমাম আবদুর রায্যাক রাহ. মা‘মার থেকে, তিনি আবু ইসহাক (আমর ইবনে আবদুল্লাহ সাবিয়ী) থেকে, তিনি আলকামা ও আসওয়াদ থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা বলেছেন, একবার ইবনে মাসউদ রা. বসে ছিলেন। তাঁর কাছে হুযায়ফা রা. ও আবু মূসা আশআরী রা.ও ছিলেন। সায়ীদ ইবনুল আস উভয়কে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাযের তাকবীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে এঁ ওঁকে ওঁ এঁকে জিজ্ঞাসা করতে বলেন। শেষে হুযায়ফা রা. ইবনে মাসউদ রা.-এর দিকে ইশারা করে বললেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা কর। জিজ্ঞাসা করলে ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ৪ তাকবীর দিয়ে কুরআন পড়বে। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করবে। দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়বে। তারপর ৪ তাকবীর দিবে।
[সূত্রঃ মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, বর্ণনা ৫৬৮৭]।
ইমাম ইবনে হাযম (৪৫৬ হি.) ‘আলমুহাল্লা’  গ্রন্থে  (৫/৯৩) এর সাথে আরেকটি আছার উল্লেখ করেবলেন, هذان إسنادان في غاية الصحة ‘এ দু’টি সনদ উঁচুপর্যায়ের সহীহ।’
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (৮৫২) বলেন, بإسناد صحيح‘আবদুর রায্যাক এটি সহীহ সনদে বর্ণনাকরেছেন।’
[সূত্রঃ আদদিরায়া (হিদায়ার সাথে মুদ্রিত) ১/১৭৩]।
আবু ইসহাক সাবিয়ী রাহ. থেকে তাঁর আরেকজন শাগরিদ ইমাম সুফিয়ান ছাওরীও ভিন্ন সূত্রে একই ফতোয়া বর্ণনা করেছেন।
তাঁর বর্ণনাটি এই-

حدثنا وكيع، عن سفيان، عن أبي إسحاق، عن عبد الله بن أبي موسى، وعن حماد، عن إبراهيم:  أن أميراً من أمراء الكوفةথقال سفيان، أحدهما : سعيد بن العاص، وقال الآخر: الوليد بن عقبةথبعث إلى عبد الله بن مسعود وحذيفة بن اليمان وعبد الله بن قيس فقال : إن هذا العيد قد حضر فما ترون؟ فأسندوا أمرهم إلى عبد الله، فقال : تكبر تسعاً : تكبيرة تفتتح بها الصلاة، ثم تكبر ثلاثاً ثم تقرأ سورة، ثم تكبر ثم تركع، ثم تقوم فتقرأ سورة، ثم تكبر أربعاً تركع بإحداهن.
অর্থাৎ ইমাম ইবনে আবী শাইবা রাহ. ওকী থেকে, তিনি সুফিয়ান (ছাওরী) থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আবী মূসা থেকে, ওকী এটি হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান থেকেও বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবরাহীম নাখায়ী থেকে, তাঁরা (আবদুল্লাহ ইবনে আবী মূসা ও ইবরাহীম নাখায়ী) বলেছেন, কূফার এক আমীর (বর্ণনাকারী ছাওরী বলেন, সায়ীদ ইবনুল আস, অন্য বর্ণনাকারী হাম্মাদ বলেন, ওলীদ ইবনে ওকবা) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ও আবদুল্লাহ ইবনে কায়স রা.-কে ডেকে পাঠালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ঈদ হাজির হয়েছে (এর নিয়ম সম্পর্কে) আপনারা কী বলেন? তাঁরা সকলেই এর দায়িত্ব দেন ইবনে মাসউদ রা.-কে। ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ৯ তাকবীর দিবে। ১ তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করবে। তারপর ৩ তাকবীর দিয়ে সূরা পড়বে। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করবে। দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে সূরা পড়বে। তারপর ৪ তাকবীর দিয়ে একটা দ্বারা রুকু করবে।
[সূত্রঃ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৫৭৪৮]।
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (৮৫৫হি.) বলেন,أخرجه من ثلاث طرق صحاح‘ইমাম তহাবী ইবনে মাসউদ রা.-এর এ ফতোয়া তিনটি সহীহ সূত্রে বর্ণনাকরেছেন(তার মধ্যে এ সূত্রটিও রয়েছে)।
[দ্রষ্টব্য. নুখাবুল আফকার  ১৬/৪৫১]।
এ বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ইবনে মাসউদ রা. ঈদের নামাযে যে ৯ তাকবীর দিতেন তাতে নামাযের শুরুর এক তাকবীর ও রুকুর দুই তাকবীর গণ্য ছিল। অর্থাৎ মোট ৯ তাকবীর, তার মধ্যে ৩ টি যেকোনো নামাযের বিধান। বাকি ৬টি ঈদের নামাযের জন্য বিশেষ বিধান।
বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকেও ৯ তাকবীরের একই ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে।
বর্ণনাটি এই-

حدثنا إبراهيم بن مرزوق قال : ثنا عبد الصمد بن عبد الوارث قال: ثنا شعبة قال : ثنا قتادة وخالد الحذاء، عن عبد الله بن الحارث أنه صلى خلف ابن عباس رضي الله عنهما في العيد،  فكبر أربعاً ثم قرأ، ثم كبر فركع، ثم قام في الثانية فقرأ، ثم كبر ثلاثاً، ثم كبر فركع
অর্থাৎ ইমাম তহাবী রাহ. ইবরাহীম ইবনে মারযূক থেকে, তিনি আবদুস সামাদ ইবনে আবদুল ওয়ারিছ থেকে, তিনি শুবা থেকে, তিনি কাতাদা ও খালিদ (ইবনে মেহরান) আলহায্যা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে হারিছ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনে আব্বাস রা.-এর পেছনে ঈদের নামায পড়তে গিয়ে লক্ষ করেছেন, তিনি ৪ তাকবীর দিয়ে কুরআন পড়েছেন। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করেছেন। দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়ে ৩ তাকবীর দিয়েছেন। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করেছেন।
[সূত্রঃ শরহু মাআনিল আছার ৪/৫৭০]।
ইমাম ইবনে হাযম এর সাথে আরেকটি আছার উদ্ধৃতকরে লেখেন, هذان إسنادان في غاية الصحة ‘এ দু’টিসনদ উঁচু পর্যায়ের সহীহ।’ ইবনুত তুরকুমানী রাহ. (৭৫০হি.) বলেন, هذا سند صحيح ‘এটি সহীহ সনদ।’বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন,
 أخرجه من طريقين صحيحين
‘ইমাম তহাবী এটি দু’টি সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।’
[সূত্রঃ আলমুহাল্লা ৫/৯৩; আলজাওহারুন নাকী ৩/২৮৭; নুখাবুল আফকার ১৬/৪৪৮]।
আসলে শুধু ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস রা.-ই নন, সাহাবী-তাবেয়ীদের মধ্যে যাঁদের থেকে ৯ তাকবীরের কথা বর্ণিত হয়েছে, (যেমন আবু মূসা আশআরী, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, মুগীরা ইবনে শুবা, আনাস ইবনে মালেক রা., মাসরূক ইবনুল আজদা, আলকামা ইবনে ইয়াযিদ, আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ, সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব, হাসান বছরী, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন, আমের ইবনে শারাহীল শাবী, আবু কিলাবা, ইবরাহীম নাখায়ী প্রমুখ) তাঁদের সকলের পদ্ধতি এক ও অভিন্ন।
এ আলোচনা থেকে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এসকল সাহাবী-তাবেয়ীর ঈদের নামাযের পদ্ধতি তা-ই যাকে আজ চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে এ পদ্ধতির নাকি কোনো দলীল নেই?! অথচ তারা ঠিক সেভাবেই নামায পড়েন যেভাবে নামায পড়তেন বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ী। অর্থাৎ মোট ৯ তাকবীরে। তার মধ্যে ১টি তাহরীমার তাকবীর, ২টি রুকুর আর ৬টি ঈদের বিশেষ বিধান।
আর এই যে বলা হয়, ঈদের নামাযে ৬ তাকবীর, এর অর্থ তো এই না যে, মোট ৬ তাকবীর। এর অর্থ বরং নামাযের শুরুর এক তাকবীর ও রুকুর দুই তাকবীর ছাড়া ৬ তাকবীর। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৬ তাকবীর। তাহরীমা ও রুকুর দুই তাকবীর সব নামাযে বিদ্যমান থাকায় তা উল্লেখ না করে শুধু ৬ তাকবীরের কথা বলা হয়, যা ঈদের নামাযের জন্য বিশেষ বিধান।
ঈদের তাকবীর গণনার ক্ষেত্রে তাহরীমা বা রুকুর তাকবীর বাদ দেওয়ার উদাহরণ হাদীস-আছারের কিতাবেও পাওয়া যায়। একটি উদাহরণ দেখুন :
হযরত মাকহুল থেকে বর্ণিত, সায়ীদ ইবনুল আস রাহ.-এর কাছে যিনি উপস্থিত ছিলেন তিনি আমাকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (সায়ীদ ইবনুল আস) ‘আসহাবে শাজারা’র ৪ সাহাবীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁদের ঈদের তাকবীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলেন, ৮ তাকবীর দিবে।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি ইবনে সীরীনের কাছে তা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, বর্ণনাকারী সত্য বলেছেন তবে নামাযের শুরুর তাকবীরটি ছেড়ে দিয়েছেন!
সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا هشيم، عن ابن عون، عن مكحول قال : أخبرني من شهد سعيد بن العاص أرسل إلى أربعة نفر من أصحاب الشجرة، فسألهم عن التكبير في العيد فقالوا : ثمان تكبيرات.
 قال : فذكرت ذلك لابن سيرين فقال : صدق ولكنه أغفل تكبيرة فاتحة الصلاة.
[সূত্রঃ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ৫৭৪৫২]।
মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. (১১০ হি.)-এর উদ্দেশ্য, সাহাবীগণ মূলত ৯ তাকবীরের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু বর্ণনাকারী নামাযের শুরুর তাকবীরটি উল্লেখ করেননি।
সারকথা এই যে, ৯ তাকবীর বা সাধারণ পরিভাষায় অতিরিক্ত ৬ তাকবীর, এ দুয়ের মধ্যে শব্দগত কিছু পার্থক্য থাকলেও আমলগত কোনো পার্থক্য নেই।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। ঈদের নামাযে মোট ৯ তাকবীর বা সাধারণ পরিভাষায় অতিরিক্ত ৬ তাকবীর, এ বিষয়ে সবচেয়ে সহীহ  হাদীস হল বিশিষ্ট তাবেয়ী কাসিম আবু আবদুর রহমানের হাদীস, যা তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। এটি ইমাম তহাবী রাহ. (৩২১ হি.) তাঁর ‘শরহু মাআনিল আছার’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
সনদসহ হাদীসটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ:

علي بن عبد الرحمن ويحيى بن عثمان قد حدثانا قالا : ثنا عبد الله بن يوسف، عن يحيى بن حمزة قال : حدثني الوضين بن عطاء أن القاسم أبا عبد الرحمن حدثه قال : حدثني بعض أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : صلى بنا النبي صلى الله عليه وسلم يوم عيد  فكبر أربعاً  وأربعاً، ثم أقبل علينا بوجهه حين انصرف قال : لا تنسوا كتكبير الجنائز وأشار بأصابعه وقبض إبهامه.
অর্থাৎ ইমাম তহাবী রাহ. আলী ইবনে আবদুর রহমান ও ইয়াহইয়া ইবনে উসমান থেকে, তারা আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে হামযা থেকে, তিনি ওযীন ইবনে আতা থেকে, তিনি কাসিম আবু আবদুর রহমান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাহাবী) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে ঈদের নামায পড়েছেন, তাতে তিনি ৪টি করে তাকবীর দিয়েছেন। নামায শেষে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ভুলে যেয়ো না, (ঈদের নামাযের তাকবীর) জানাযার নামাযের মত। এ কথা বলে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি গুটিয়ে বাকি ৪ আঙুল দ্বারা ইশারা করলেন।
[সূত্রঃ শরহু মাআনিল আছার ৪/৫৬৮]।
পাঠকগণ আগে লক্ষ করেছেন যে, ঈদের তাকবীর গণনার ক্ষেত্রে কখনো কখনো তাকবীরে তাহরীমা উল্লেখ করা হত না। সে হিসেবে এ হাদীসটি ৯ তাকবীরের পক্ষে দলীল বিবেচিত হয় এবং বহু ফকীহ-মুহাদ্দিস এটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দলীলস্বরূপ পেশও করেছেন।

সনদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা
____________
এই হাদীসের সনদ সহীহ, এর রাবীগণ সকলেই ছিকা। ইমাম তহাবী রাহ. হাদীসটি বর্ণনা করে লেখেন,
فهذا حديث حسن الإسناد، وعبد الله بن يوسف ويحيى بن حمزة والوضين والقاسم كلهم أهل رواية معروفون بصحة الرواية، ليس كمن روينا عنه الآثار الأول، فإن كان هذا الباب من طريق صحة الإسناد يؤخذ، فإن هذا أولى أن يؤخذ به مما خالفه.
অর্থাৎ ‘এই হাদীসের সনদ ‘হাসান’।৩ আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ, ইয়াহইয়া ইবনে হামযা, ওযীন ও কাসিম, সকলেই সহীহ হাদীস বর্ণনায় প্রসিদ্ধ। এঁরা প্রথমোক্ত (১২ তাকবীর বিষয়ক) হাদীসগুলোর বর্ণনাকারীদের মত নন। সুতরাং ঈদের তাকবীর প্রসঙ্গে সনদগত বিশুদ্ধতা বিবেচিত হলে এটি এর বিপরীত হাদীস অপেক্ষা গ্রহণের অধিক উপযুক্ত।’
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রাহ. ‘নুখাবুল আফকার’ গ্রন্থে (১৬/৪৪২) বলেন, هذا إسناد صحيح ورجاله ثقات ‘এটি সহীহ সনদ এবং এর রাবীগণ ছিকা।’
জরহ-তাদীল ও আসমাউর রিজালের কিতাব থেকে এই রাবীদের জীবনী অধ্যয়ন করলে পাঠকগণ স্পষ্ট দেখবেন যে, এঁরা সকলেই ছিকা ও নির্ভরযোগ্য, যেমনটি ইমাম তহাবী ও আইনী রাহ. বলেছেন।
এখানে শুধু দু’জন রাবী সম্পর্কে ইমামদের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করা হল।
কাসিম আবু আবদুর রহমান
কাসিম আবু আবদুর রহমান ছিকা তথা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য এবং দামেশকের বিশিষ্ট ফকীহও বটে। ৪ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন (২৩৩হি.) বুখারী (২৫৬হি.), আবু হাতেম (২৭৭হি.), ইয়াকুব ইবনে শাইবা (২৬২হি.), ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান (২৭৭হি.), তিরমিযী (২৭৯হি.), আবু ইসহাক হারাবী (২৮৫হি.) প্রমুখ তাঁকে ছিকা বলেছেন।
দূরী বলেন, আমি ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনকে বলতে শুনেছি,
القاسم أبو عبد الرحمن ثقة
‘কাসিম আবু আবদুর রহমান ছিকা।’
[সূত্রঃ তারিখে ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, দূরী ২/৩৩০]।
ইমাম তিরমিযী বলেন, আমি মুহাম্মাদ (ইবনে ইসমাঈল বুখারী)-কে বলতে শুনেছি, ثقة القاسم‘কাসিম ছিকা।’
[সূত্রঃ সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৩১৯৫-এর আলোচনা]।
ইমাম আবু হাতেম বলেন,
حديث الثقات عنه مستقيم لا بأس به، وإنما ينكر عنه الضعفاء.
‘ছিকা রাবীদের মাধ্যমে বর্ণিত তাঁর হাদীস সঠিক। তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। তাঁর থেকে মুনকার রেওয়ায়েত তো বর্ণনা করে দুর্বল রাবীরা।’
[সূত্রঃ তারিখে দিমাশক ৪৯/১০৮]।
ইমাম ইয়াকুব ইবনে শাইবা, ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান ও তিরমিযী রাহ. বলেন, ثقة القاسم ‘কাসিম ছিকা।’
[সূত্রঃ তারিখে দিমাশক ৪৯/১০৮; আলমারিফাতু ওয়াততারিখ ৩/৩৭৫; সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৪২৮, ২৭৩১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য]।
আবু ইসহাক হারাবী বলেন, كان من ثقات المسلمين‘তিনি ছিকা মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।’
[সূত্রঃ তাহযীবুত তাহযীব ৮/৩২৪]।
 
ওযীন ইবনে আতা
ওযীন ইবনে আতাও ছিকা। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, আহমদ ইবনে হাম্বল (২৪১হি.) ও আবদুর রহমান ইবনে ইবরাহীম দুহাইম (২৪৫হি.) তাঁকে ছিকা বলেছেন।
দারিমী বলেন, ইবনে মায়ীন বলেছেন,  ثقة الوضين بن عطاء ‘ওযীন ইবনে আতা ছিকা।’
মুহাম্মাদ ইবনে আউফ বলেন, ইবনে মায়ীন বলেছেন,لا بأس به  ‘তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।’
[সূত্রঃ তাহযীবুল কামাল ৩০/৪৫০-৪৫১]।
আবদুল্লাহ বলেন, আমার পিতা (ইমাম আহমদ) বলেছেন, الوضين بن عطاء ثقة ‘ওযীন ইবনে আতা ছিকা।’
অন্যত্র তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, ليس به بأس ‘তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।’
[সূত্রঃ আলইলাল ওয়া মারিফাতুর রিজাল, ইমাম আহমদ ২/৫৩৮, ৩/১১৫]।
আবু যুরআ দিমাশকী বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবনে ইবরাহীম দুহাইমকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ثقة ‘সে ছিকা।’
[সূত্রঃ তারিখে আবু যুরআ ১/৩৯৪]।
ইমাম ইবনে আদী (৩৬৫হি.) ‘আলকামিল ফী যুআফাইর রিজাল’ গ্রন্থে (৮/৩৭৭) তাঁর জীবনীতে কিছু বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, وللوضين أحاديث غير ما ذكرت، وما أدري بأحاديثه بأساً ‘তাঁর আরো হাদীস আছে। আমি তাঁর হাদীসে কোনো সমস্যা মনে করি না।’
ইবনে হিব্বান রাহ. (৩৫৪হি.) তাঁকে ‘ছিকাত’ গ্রন্থে (৭/৫৬৪) উল্লেখ করেছেন।
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কাসিম আবু আবদুর রহমান ও ওযীন ইবনে আতা  উভয়ই ছিকা।
এখানে এ বিষয়টিও স্মরণ রাখতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ঈদের নামাযে ৯ তাকবীর দিতেন, এ শুধু জনৈক সাহাবীর একার বর্ণনা নয়, আরো বহু সাহাবী তা বর্ণনা করেছেন। আর আমলরূপে তো অসংখ্য সাহাবী বর্ণনা করেছেন। উপরন্তু এটি আমলে মুতাওয়ারাছ তথা যুগ পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মুগীরা ইবনে শুবা, আবু মূসা আশআরী, হুযায়ফা রা.সহ অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ীর আমল তাই ছিল এবং মানুষকে তাঁরা এরই তালীম দিয়েছেন।
তো বিষয়বস্তুর দিক থেকে আলোচিত হাদীসটির বিশুদ্ধতা খাইরুল কুরূনের ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’-এর মাধ্যমে প্রমাণিত এবং এর বিশুদ্ধতা তখন এক স্বীকৃত বিষয় ছিল। একই সাথে এটি সনদগতভাবেও সহীহ। ইমাম তহাবী রাহ.সহ বিভিন্ন মুহাদ্দিস একে সহীহ বলেছেন।
ইমাম তহাবীর ইন্তেকাল ৩২১ হিজরীতে। এরপর সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও কোনো ফকীহ-মুহাদ্দিস হাদীসটি সম্পর্কে কোনো আপত্তি করেননি। ইমাম বায়হাকী রাহ. (৪৫৮হি.) ‘আসসুনানুল কুবরা’ও ‘মারিফাতুস সুনানি ওয়ালআছার’ গ্রন্থে নিয়মিত তহাবী রাহ.-এর আলোচনার ‘নকদ’ করতে চেষ্টা করেন। কিন্ত এই হাদীস সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ সত্ত্বেও সম্প্রতি একশ্রেণির লোককে এতে কিছু আপত্তি করতে দেখা যায়, যা তাদের জরহ-তাদীল শাস্ত্রের নিয়মনীতি, প্রয়োগ-পদ্ধতি এবং হাদীস অনুসরণের পন্থা সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক।

কিছু আপত্তি
____________
বাংলাদেশের মুযাফ্ফর বিন মুহসিন লেখেন, “...বিভিন্ন ত্রুটির কারণে তা নিতান্তই যঈফ, যা দলীল গ্রহণের একেবারেই অযোগ্য।
প্রথমত : এর সনদে দুইজন অভিযুক্ত রাবী আছে। (ক) ক্বাসেম ইবনু আব্দুর রহমার আবু আব্দুর রহমান শামী নামক রাবী যঈফ। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, আলী ইবনু ইয়াযীদ কাসেম থেকে উদ্ভুত ঘটনা বর্ণনা করেছে। আর তার থেকে ছাড়া এরকম আর কাউকে বর্ণনা করতে দেখিনি। ইমাম আজলী (রহঃ) বলেন, ‘সে শক্তিশালী নয়’। ইয়াকূব ইবনু শাইবাহ বলেন, ‘যাদেরকে যঈফ সাব্যস্ত করা হয় সে তাদের মধ্যে একজন’। ইবনু হাজার (রহঃ)সহ অধিকাংশ মুহাদ্দিছই তাকে ‘অজ্ঞাত’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। তাছাড়া ইমাম আহমাদ, আবু হাতেম, ইবনু মাঈন (রহঃ) প্রমুখ মুহাদ্দিছ তার বর্ণিত হাদীছসমূহকে ছহীহ হাদীছের বিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। গিলাবী বলেন, ‘সে হাদীছ বর্ণনায় অস্বীকৃত’। ... প্রকৃতপক্ষে সে হাদীছ বর্ণনার ব্যাপারে মুনকার রাবী। এ সমস্ত ত্রুটির কারণে ইবনু হিব্বানের উক্তি তুলে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) চূড়ান্ত মন্তব্য করে বলেন,
‘আমার বক্তব্য হ’ল- ইবনু হিব্বান বলেছেন, ছাহাবীদের থেকে সে বিভ্রান্তিকর হাদীছ বর্ণনা করে থাকে’।
(খ) ওয়াযীন ইবনে আত্বা নামে একজন দুর্বল রাবী রয়েছে। ইবনু সা’দ বলেন, ‘সে হাদীস বর্ণনায় যঈফ’। ইবনু ক্বানে বলেন, ‘সে যঈফ’। ইমাম জাওযজানী বলেন, ‘হাদীছ বর্ণনায় সে অত্যন্ত দুর্বল’। ...ইবনু হাজার আসক্বালানীও তার সম্পর্কে স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল বলে অভিযোগ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সে যে ছহীহ হাদীছের বিপরীত বর্ণনা করেছে তা প্রমাণ করেই ইবনু হাজার আসক্বালানী তাকে মুনকার বলে চূড়ান্ত মন্তব্য করেছেন। ..কেউ কেউ ‘তার সমস্যা নেই’ বলে নরম ভাষায় মন্তব্য করলেও ।...
দ্বিতীয়ত : এই বর্ণনাটিও মরফূ নয়। ...এটিও ত্রুটিপূর্ণভাবে আব্দুর রহমান শামী থেকে মারফূ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।...
....
চতুর্থত : সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণিত সকল ছহীহ হাদীছের বিরোধী। অতএব ছহীহ হাদীছের বিপরীতে এমন ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না ...।”
[সূত্রঃ ছহীহ হাদীছের কষ্টিপাথরে ঈদের তাকবীর পৃ. ২৩-২৪]।
সচেতন পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, মুযাফ্ফর বিন মুহসিন এখানে কী কী ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন এবং বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন! পাঠকবর্গের সহজতার জন্য নিম্নে অতি সংক্ষেপে এ আপত্তিগুলোর কিছু পর্যালোচনা করা হল।
এক. ইমাম ইবনে মায়ীন, বুখারী, আবু হাতেম, ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান, ইয়াকুব ইবনে শাইবা, তিরমিযী রাহ.সহ বড় বড় ও অধিকাংশ জরহ-তাদীলের ইমাম কাসিম আবু আবদুর রহমানকে ছিকা বলেছেন। কিন্তু তিনি এগুলো সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে কেবল ইমাম আহমদ, ইজলী, গাল্লাবী ও ইবনে হিব্বানের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। এঁদের মধ্যে শুধু ইমাম আহমদ আপত্তির কারণ বয়ান করেছেন। তাই দেখা যাক তাঁর আপত্তির কারণ কী?
আবু বকর আলআছরাম বলেন, একবার ইমামআহমদ রাহ.-এর সামনেالدباغ طهور, এ হাদীসটি  উল্লেখ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন,

يروى على بن يزيد عنه أعاجيب وتكلم فيهما وقال: ما أرى هذا إلا من قبل القاسم.
অর্থাৎ ‘আলী ইবনে ইয়াযিদ কাসিম আবু আবদুর রহমান থেকে কিছু অদ্ভুত রেওয়ায়েত বর্ণনা করে। এরপর উভয় সম্পর্কে আপিত্ত করে বলেন, আমি মনে করি, এটা কাসিমের পক্ষ থেকেই হয়েছে’?!
এখানে আমরা লক্ষ করলাম যে, ইমাম আহমদ রাহ. কাসিমের ‘বর্ণিত হাদীসসমূহ’ অর্থাৎ সমস্ত হাদীস বা ওযীন ইবনে আতার সূত্রে বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যান করেননি। তিনি এমন কিছু হাদীস সম্পর্কে আপত্তি করেছেন, যা তাঁর থেকে আলী ইবনে ইয়াযিদ বর্ণনা করেছে। অথচ আলোচিত হাদীসটি আলী ইবনে ইয়াযিদের সূত্রে বর্ণিত নয়, এটি তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন ওযীন ইবনে আতা, যিনি ছিকা। সুতরাং এই হাদীসের ব্যাপারে ইমাম আহমদ রাহ.-এর এ বক্তব্য উদ্ধৃত করা অনুচিত।
দ্বিতীয়ত আলী ইবনে ইয়াযিদের সূত্রে বর্ণিত কিছু হাদীস সম্পর্কে যে আপত্তি করা হয়েছে ইমাম ইবনে মায়ীন, বুখারী ও আবু হাতেম রাহ. প্রমুখের মতে তা-ও সঠিক নয়। তাঁরা কাসিম আবু আবদুর রহমানকে ছিকা বলার পাশাপাশি এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাঁর মাধ্যমে বর্ণিত কিছু হাদীসে যে আপত্তিকর বিষয় পাওয়া গিয়েছে, এর ‘ইল্লত’ তিনি নন, তাঁর কিছু যয়ীফ শাগরিদ। কেননা আপত্তিকর বিষয় পাওয়া গিয়েছে শুধু যয়ীফ শাগরিদদের মাধ্যমে বর্ণিত কিছু হাদীসে, যা থেকে বোঝা যায় যে, এর ইল্লত এরাই, তিনি নন।
ইবনুল জুনাইদ বলেন, আমি ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনকে বলতে শুনেছি, ‘কাসিম আবু আবদুর রহমান ছিকা। এঁরা (দুর্বল বর্ণনাকারীরা) তাঁর থেকে যা মারফূরূপে বর্ণনা করে, ছিকা বর্ণনাকারীগণ তা মুরসালরূপে বর্ণনা করেন।’
অন্যত্র বলেন, এবং এ-ও বলতে শুনেছি যে, ‘কাসিম আবু আবদুর রহমান ছিকা। এই হাদীসগুলো তাঁর থেকে ছিকা রাবীগণও বর্ণনা করেন কিন্তু মারফূরূপে নয়।’
এরপর তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো যয়ীফ রাবী এমন আছে যাদের বর্ণনাই তাদের যয়ীফ হওয়া নির্দেশ করে।’
[সূত্রঃ সুআলাতে ইবনুল জুনাইদ পৃ. ৩৯৬, ৪০৯]।
ইবনে মায়ীন রাহ.-এর উদ্দেশ্য, কাসিমের কিছু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর শাগরিদদের মধ্যে ইখতিলাফ হয়েছে। র্দ্বুল শাগরিদরা মারফূরূপে বর্ণনা করে আর ছিকাগণ মুরসালরূপে বর্ণনা করেন। এই মুরসাল বর্ণনাকে মারফূ বানিয়ে ফেলার দোষ ঐ দুর্বলদেরই, তাঁর নয়।
মুহাম্মাদ ইবনে উমর বলেন, ইবনে মায়ীন বলেছেন, আলী ইবনে ইয়াযিদ কাসিম থেকে, তিনি আবু উমামা থেকে, এই সূত্রে বর্ণিত সব হাদীস যয়ীফ।’
[সূত্রঃ তাহযীবুল কামাল ২১/১৭৯]।
বলাবাহুল্য, এ হাদীসগুলোকে যয়ীফ বলা হয়েছে আলী ইবনে ইয়াযিদের কারণেই।
আবু হাতেম রাহ.-এর এ বক্তব্য আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ‘ছিকাদের মাধ্যমে বর্ণিত তাঁর হাদীস সঠিক। তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। তাঁর থেকে মুনকার রেওয়ায়েত তো বর্ণনা করে দুর্বল রাবীরা।’
মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম বলেন, আমি আবু হাতেম রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আলী ইবনে ইয়াযিদ কাসিম থেকে, তিনি আবু উমামা থেকে, এই সূত্রে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আপনি কী বলেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘এগুলো যয়ীফ।’
[সূত্রঃ তাহযীবুল কামাল ২১/১৮১]।
তিরমিযী রাহ. তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে কাসিমের একাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
এসব হাদীস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য নিম্নরূপ: 
*هذا حديث حسن صحيح غريب من هذا الوجه، والقاسم هو ابن عبد الرحمن يكنى أبا عبد الرحمن،... وهو ثقة شامي، وهو صاحب أبي أمامة.
*هذا حديث حسن صحيح غريب، وهو أصح عندي من حديث معاوية بن صالح.
*هذا حديث حسن غريب.
*هذا حديث حسن صحيح غريب.
*هذا إسناد ليس بالقوي، قال محمد: وعبيد الله بن زحر ثقة، وعلي بن يزيد ضعيف، والقاسم هو ابن عبد الرحمن يكنى أبا عبد الرحمن... وهو ثقة والقاسم شامي.
*هذا حديث غريب إنما يروى من حديث القاسم عن أبي أمامة، والقاسم ثقة وعلي بن يزيد يضعف في الحديث، سمعت محمداً يقول: القاسم ثقة وعلي بن يزيد يضعف.
এখানে আমরা দেখলাম, তিরমিযী রাহ. তাঁর ৩টিহাদীসকে ‘হাসানুন সহীহুন গরীব’, ১টিকে ‘হাসানুন গরীব’, ১ টিকে ‘গরীব’ আর ১টিকে ‘শক্তিশালী নয়’বলেছেন। সেই সাথে এ দিকেও ইশারা করেছেন যে, এই গারাবত বা দুর্বলতার ‘ইল্লত’ আলী ইবনে ইয়াযিদ, কাসিম নন।
[সূত্রঃ সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৪২৮, ১৬২৭, ১৬৬৯, ২৬৮৫, ২৭৩১, ৩১৯৫, এর আলোচনা]।
মোদ্দাকথা এই যে, কাসিম আবু আবদুর রহমান ছিকা। আর আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর করা আপত্তি এখানে মোটেই প্রযোজ্য নয়। উপরন্তু অনেক ইমাম তা খ-নও করেছেন।
 
দুই. ইয়াকুব ইবনে শাইবা রাহ.-এর বক্তব্যটি তিনি ইমাম যাহাবী কৃত ‘মীযানুল ইতিদাল’ থেকে নিয়েছেন। তাই প্রথমে দেখা যাক সেখানে তা কীভাবে আছে। যাহাবী রাহ. ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য ‘তিনি ছিকা’ উদ্ধৃত করে বলেন,
وقال يعقوب بن شيبة: منهم من يضعفه.
অর্থাৎ ‘এবং ইয়াকুব ইবনে শাইবা বলেছেন, তাদের (ইমামদের) কেউ কেউ তাঁকে (কাসিমকে) যয়ীফ বলেন।’
এ হল ‘মীযানুল ইতিদাল’র পাঠ আর এটাকেই মুযাফ্ফর বিন মুহসিন ‘যাদেরকে যঈফ সাব্যস্ত করা হয় সে তাদের মধ্যে একজন’ বানিয়ে দিয়েছেন! যার অর্থ অনেকটা এরকম, তিনি সর্বসম্মত যয়ীফ! অথচ ‘মীযানুল ইতিদাল’-এর ওই পাঠ থেকেও বোঝা যায় যে, কোনো কোনো ইমাম তাঁকে ছিকাও বলেছেন এবং বাস্তবতাও তাই। এটা স্বয়ং ইয়াকুব ইবনে শাইবা রাহ.-এর বক্তব্যেই বিদ্যমান আছে। তাঁর পুরো বক্তব্য লক্ষ করুন,
قد اختلف الناس فيه، فمنهم من يضعف روايته، ومنهم من يوثقه.
অর্থাৎ ‘তাঁর (কাসিম আবু আবদুর রহমানের) ব্যাপারে ইমামদের ইখতিলাফ হয়েছে। কেউ কেউ যয়ীফ বলেন আর কেউ কেউ ছিকা বলেন।’
[সূত্রঃ তারিখে দিমাশক ৪৯/১১৩; তাহযীবুল কামাল ২৩/৩৮৯; তাহযীবুত তাহযীব ৮/৩২৪]।
তার চেয়েও বড় বিষয় এই যে, ইয়াকুব ইবনে শাইবা রাহ. এখানে কাসিম সম্পর্কে ইমামদের যে ইখতিলাফ আছে কেবল সেটাই উল্লেখ করেছেন, নিজের মত এখানে উল্লেখ করেননি। তা উল্লেখ করেছেন অন্যত্র এবং সেখানে তিনি তাঁকে ছিকা বলেছেন। মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে ইয়াকুব বলেন, আমার দাদা (ইয়াকুব ইবনে শাইবা) বলেছেন القاسم أبو عبد الرحمن ثقة ‘কাসিম আবু আবদুর রহমান ছিকা।’
[সূত্রঃ তারিখেদিমাশক ৪৯/১০৮; তাহযীবুল কামাল ২৩/৩৮৯; তাহযীবুত তাহযীব ৮/৩২৪]।

তিন. ইবনে হাজার রাহ.সহ অধিকাংশ মুহাদ্দিস কাসিমকে কোথায় ‘অজ্ঞাত’ বলে অভিযুক্ত করেছেনসেটার উদ্ধৃতি তিনি দেননি এবং সম্ভবও নয়। ইবনেহাজার রাহ. ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে (পৃ. ৫২৫) তাঁকে নূন্যতম صدوق বলেছেন। আর এ বাক্য দ্বারা তাঁর কী উদ্দেশ্য সেটা তো তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন। ‘তাকরীবুত তাহযীব’-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,
الرابعة : من قصر عن درجة الثالثة قليلاً، وإليه الإشارة بصدوق أولا بأس به...
অর্থাৎ ‘চতুর্থ, যে তৃতীয় স্তর তথা ছিকার চেয়ে কিছুটা নিম্নের হয়। আর তার দিকেই ইঙ্গিতকরা হবে  صدوقবা  لا بأس به ..দ্বারা।’
[সূত্রঃ তাকরীবুততাহযীব পৃ. ৯৬]।
আর ইমাম ইবনে মায়ীন, বুখারী, আবু হাতেম, ইয়াকুব ইবনে শাইবা, ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান, তিরমিযী, আবু ইসহাক হারাবী তো তাঁকে ছিকা বলেছেন। আর দু-একজন মাত্র যয়ীফ বলেছেন।কিন্তু ‘অজ্ঞাত’ বলেন নি কেউই।

চার. ইমাম আহমদ, আবু হাতেম, ইবনে মায়ীন রাহ. প্রমুখ মুহাদ্দিস কোথায় তাঁর বর্ণিত হাদীস সমূহকে সহীহ হাদীসের বিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন?! এঁরা তো তাঁকে ছিকা বলেছেন।

পাঁচ. ‘তাহযীবুত তাহযীব’ মূলত হাযেফ আবুলহাজ্জাজ মিয্যী রাহ. (৭৪২হি.) রচিত ‘তাহযীবুলকামাল’ থেকে সংক্ষেপিত। ইবনে হাজার রাহ. এতে প্রথমে ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থে উল্লেখিত বক্তব্য গুলো উদ্ধৃত করেন। এরপর এতে অনুল্লেখিত কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। এক্ষেত্রে তিনি শুরুতে قلت বলেন, যাতে ‘তাহযীবুল কামাল’-এর আলোচনা আর তাঁর বর্ধিতের মাঝে পার্থক্য হয়। ‘তাহযীবুত তাহযীব-এর ভূমিকায় তিনি পরিষ্কার লিখেছেন,

وما زدته في أثناء التراجم قلت في أوله: >قلت<، فجميع ما بعد >قلت< فهو من زيادتي إلى آخر الترجمة.
অর্থাৎ ‘রাবীর জীবনীতে আমি যা বাড়াব তার আগেقلت বলব। সুতরাং قلت -এর পর থেকে জীবনীর শেষপর্যন্ত যা কিছু আছে সবই আমার বাড়ানো।’
[সূত্রঃ তাহযীবুত তাহযীব ১/৫]।

এ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, قلت বাক্যটি মিয্যী রাহ.-এর আলোচনা আর ইবনে হাজার রাহ.-এর বর্ধিতের মাঝে পার্থক্য চিহ্ন মাত্র, মন্তব্য সূচক নয়। সুতরাং ইবনে হিব্বানের বক্ত্যবকে ইবনে হাজার রাহ.-এর মন্তব্য মনে করা ভুল।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ইবনে হিব্বানের ওই বক্তব্য চরম আপত্তিকর। যাহাবী রাহ. তা খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন,

قلت : قد وثقه ابن معين من وجوه عنه.
অর্থাৎ ‘আমি বলব, ইবনে মায়ীন রাহ. তাঁকে (কাসিম আবু আবদুর রহমানকে) ছিকা বলেছেন, যা তাঁর থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।’
[সূত্রঃ মীযানুল ইতিদাল ৩/৩৭৩]।


ছয়. আহমদ ইবনে হাম্বল, ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, ইবনে হিব্বান, ইবনে আদী রাহ.সহ বড় বড় ও অধিকাংশ আইম্মায়ে জরহ-তাদীল ওযীন ইবনেআতাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। আর যে কজন তাঁকে যয়ীফ বলেছেন এঁরা মাকাম-মর্যাদার দিক থেকে ওঁদের চেয়ে নিম্নের। একারণে ওঁদের প্রশংসার  (তাওছীক) বিপরীতে এঁদের সমালোচনা (জরহ) গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না। ইমাম যাহাবী রাহ. (৭৪৮হি.) ‘আলকাশিফ’ গ্রন্থে (৪/৪৫০) সম্ভবত সেদিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। তিনি  লেখেন, ثقة وبعضهم ضعفه ‘তিনি (ওযীন) ছিকা  (নির্ভরযোগ্য), কেউ কেউ তাঁকে যয়ীফ বলেছেন।’
নূরুদ্দীন হাইছামী রাহ. (৮০৭ হি.) ‘মাজমাউয যাওয়াইদ’ গ্রন্থে (৫/২৯৩) এক হাদীসের আলোচনায় বলেছেন,
وثقه أحمد وابن معين وابن حبان، وضعفه من هو دونهم في المنزلة
‘তাঁকে ছিকা বলেছেন ইমাম আহমদ, ইবনে মায়ীন ও ইবনে হিব্বান। আর যয়ীফ বলেছেন যারা এঁদের চেয়ে নিম্নের স্তরের।’

সাত. ইবনে হাজার রাহ. ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে (পৃ. ৬৭৪) ওযীন ইবনে আতা সম্পর্কে কেবল বলেছেন, سيء الحفظ ‘তাঁর স্মৃতি খারাপ।’ আর ‘স্মৃতি খারাপ’ আর ‘স্মৃতি শক্তি অত্যন্ত দুর্বল’ দুটো  এক পর্যায়ের নয়।
তাছাড়া ওযীন ইবনে আতা সম্পর্কে ইবনে হাজাররাহ.-এর এ বক্তব্য না ইমামদের বিস্তারিত বক্তব্য গুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের সাথে। বরং স্বয়ং তাঁর (অন্য কিতাবের) বক্তব্যের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি ‘ফাতহুলবারী’ গ্রন্থে  (২/৫৫৯) এক হাদীস সম্পর্কে, যার সনদে ওযীন ইবনে আতা আছেন বলেছেন, إسناده قوي ‘এরসনদ শক্তিশালী।’
আট. ইবনে হাজার রাহ. ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে قلت বলে মুহাদ্দিস সাজীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।
তিনি লেখেন,
قلت: وقال الساجي: عنده حديث واحد منكر غير محفوظ عن علقمة، عن عبد الرحمن بن عائذ، عن علي: حديث "العينان وكاء السه...
অর্থাৎ ‘আমি (ইবনে হাজার) বলব, সাজী বলেছেন, তাঁর (ওযীন ইবনে আতার) একটি মুনকার বর্ণনা আছে, যা তিনি আলকামা থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আয়িয থেকে, তিনি আলী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন...।’
[সূত্রঃ তাহযীবুত তাহযীব ১১/১২১]।

এ থেকে পরিষ্কার যে, ইবনে হাজার রাহ. এখানে ওযীন ইবনে আতাকে মুনকার বলে চূড়ান্ত মন্তব্য করেন নি। তিনি কেবল قلت বলে সাজীর এ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, ‘তাঁর একটি মুনকার বর্ণনা আছে...।’
আর পাঠকগণ আগে স্বয়ং ইবনে হাজারের জবানিতে দেখেছেন যে, قلت দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য ‘তাহযীবুলকামাল’-এ অনুল্লেখিত কিছু বক্তব্য কেবল উল্লেখ করা, মন্তব্য করা নয়।
উপরন্তু সাজী রাহ. এখানে ওযীন ইবনে আতাকে মুনকার বলেন নি, তিনি শুধু বলেছেন, ‘তাঁর একটি মুনকার বর্ণনা আছে। আর ‘তার একটি মুনকার বর্ণনা আছে’ ও ‘তিনি মুনকার’ দুটোর মাঝে আসমান-জমিন ফারাক। একটি মুনকার বর্ণনার কারণে রাবী মুনকার হয়ে যায় না।
তাছাড়া সাজী যে বর্ণনাটিকে মুনকার আখ্যা দিয়েছেন সেটা আসলে মুনকার কি না, হলে এর ইল্লতকে, এ বিষয়ে মুহাদ্দিসদের মতভেদ আছে।
দেখুন : আলবদরুল মুনীর ২/৪২৫-৪২৯; নাসবুর রায়াহ১/৪৪-৪৫; ইলালে ইবনে আবী হাতেম ১/৪৭; মুখতাসারু সুনানি আবি দাউদ ১/১৪৫; তাহযীবুততাহযীব ১১/১২১]।

নয়. ‘তার হাদীসে কোনো সমস্যা নেই’, এটি প্রশংসা-বাক্য। এর সাধারণ অর্থ, রাবী ‘ছিকা’র চেয়ে একটু নিম্নের, যার হাদীসকে ‘হাসান’ বলা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা ‘ছিকা’র অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। জরহ-তাদীলের কিতাবে এর অসংখ্য উদাহরণ আছে।

দশ. এই হাদীসটি মারফূ নয় তো কি? মারফূ তো ঐ হাদীসকেই বলে যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী বা কর্ম বর্ণনা করা হয়। আর এখানে তো তাঁরই আমল বর্ণনা করা হয়েছে।
কোনো ইমাম কি এটি মারফূ হওয়া অস্বীকার করেছেন বা কোনো রাবী কি তা মারফূ ছাড়া অন্যভাবে বর্ণনা করেছে? কিছুই নয়। একারণেই পরমুহূর্তে তিনি কথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, ‘এটি ত্রুটিপূর্ণ ভাবে আব্দুর রহমান শামী থেকে মারফূ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে’!? তো এখানে তিনি এটি মারফূ হওয়া স্বীকার করেছেন। তাহলে আগে কেন বললেন, এটি মারফূ নয়? এটা পাঠককে বিভ্রান্তি ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলার একটা অপকৌশল। পাঠকগণ দেখেছেন, এই হাদীসের রাবীগণ সকলেই ছিকা এবং এর সনদে কোনো ত্রুটি নেই।

এগারো. ১২ তাকবীর বিষয়ক হাদীসগুলোর পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায় যে, এ বিষয়ে প্রমাণিত মাত্র দু-একটি হাদীসই। তা-ও সহীহ স্তরের নয়, হাসান পর্যায়ের।
আর সহীহ ধরে নেওয়া হলেও হাদীস অনুসরণের অনুসৃত ও মাসনূন পদ্ধতি কি এই যে, দু-একটি সহীহ হাদীসের কারণে সনদগত ভাবে সহীহআর আমলগতভাবে মুতাওয়ারাছ একটি হাদীসকেপ্রত্যাখ্যান করে দেওয়া? সুন্নাহ্ সম্মত পদ্ধতি তো বরং এ কথা স্বীকার করা যে, উভয় পদ্ধতিই নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত, তিনি কখনো এভাবে করেছেন, কখনো ওভাবে। অন্যথায় একই কথা  তো অন্যদেরও বলার সুযোগ থাকবে।

সারকথা এই যে, আলোচিত হাদীসটি সনদগত ভাবে সহীহ (ইমাম তহাবী ও বদরুদ্দীন আইনী রাহ. একে সহীহ বলেছেন এবং বহু ফকীহ-মুহাদ্দিস এর দ্বারা দলীল পেশ করেছেন)। আর আমলগত ভাবে মুতাওয়ারাছ। আর একে যয়ীফ সাব্যস্ত করার জন্য যা কিছুর অবতারণা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও শাস্ত্রীয় নিয়মনীতি বহির্ভূত।

বেশ ক’জন গাইরে মুকাল্লিদ আলেমও তা স্বীকার করেছেন।
লা মাযহাবী আলবানী (১৪২০হি.) তার  ‘সিলসিলাতুলআহাদীসিস সহীহা’ গ্রন্থে ইমাম তহাবী রাহ.-এর বক্তব্য সমর্থন করার পর লেখেন, ‘সুতরাং এটি (ইমাম) আবু দাউদ প্রমুখ ‘হাসান’ সনদে আবুআয়েশার সূত্রে আবু হুরায়রা রা.-এর যে হাদীস বর্ণনা করেছেন সেটার শক্তিশালী ‘শাহিদ’। ... এটি মূলত একটি বিরল ও শক্তিশালী বর্ণনা, যা ইমাম তহাবী রাহ. আমাদের জন্য সংরক্ষণ করেছেন...। এর শক্তি আরো বৃদ্ধি পায় আবদুর রায্যাক রাহ. যা বর্ণনা করেছেন তা দ্বারা...।’
এরপর তিনি কিছু আছার উল্লেখ করে বলেন, ‘এসব শক্তিশালী আছার শিরোনামের হাদীস তথা আলোচিত হাদীসের সমর্থন করে। এগুলো মওকূফ হলেও মারফূর হুকুমে। কারণ এ ধরনের বিষয়ে (রাসূলের) নির্দেশনা ছাড়া এক জামাত সাহাবীর ঐক্য সম্ভব নয়। এ জাতীয় বিষয় যদি মওকূফ রূপেও বর্ণিত হত তবু দলীল বিবেচিত হত। অথচ তা দু’টি মারফূ সূত্রেবর্ণিত হয়েছে, একটি শিরোনামের হাদীস অন্যটি এরশাহিদ আবু আয়েশার হাদীস...।’
[সূত্রঃ সিলসিলাতুলআহাদীসিস সহীহা, হদীস ২৯৯৭]।
তার আলোচনার আরবী পাঠ এই,

...فالحديث شاهد قوي بهذا الإسناد لما أخرجه أبو داود وغيره بإسناد حسن عن أبي عائشة جليس لأبي هريرة... وهي في الحقيقة رواية عزيزة جيدة،مما حفظه لنا الإمام الطحاوي رحمه الله،... ويزداد قوة بما رواه عبد الرزاق... فهذه آثار كثيرة قوية تشهد لحديث الترجمة، وهي وإن كانت موقوفة، فهي في حكم المرفوع، لأنه يبعد عادة أن يتفق جماعة منهم على مثله دون توقيف، ولو جاء مثله غير مرفوع لكان حجة، فكيف وقد جاء مرفوعا من وجهين أحدهما حديث الترجمة، والآخر شاهده المذكور عن أبي عائشة...

কিছু আছার
৯ তাকবীরের পক্ষে কিছু আছার আগে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে আরো কিছু উল্লেখ করা হল।
১. আবদুল্লাহ ইবনে হারিছ থেকে বর্ণিত, আমি ইবনে আব্বাস রা.-কে বছরায় ঈদের নামাযে ৯ তাকবীর দিতে দেখেছি এবং মুগীরা ইবনে শুবা রা.-কেও অনুরূপ করতে দেখেছি।
ইসমাইল ইবনে আবুল ওলীদ বলেন, আমি খালিদকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইবনে আব্বাস রা. কীভাবে তাকবীর দিয়েছেন? উত্তরে তিনি আমাদের মা‘মার ও ছাওরীর সূত্রে বর্ণিত আবু ইসহাকের হাদীসে ইবনে মাসউদ রা. যেভাবে তাকবীর দিয়েছেন ঠিক তাই বর্ণনা করেছেন।
[সূত্রঃ মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, বর্ণনা ৫৬৮৯]।
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই,

عبد الرزاق قال : أخبرنا إسماعيل بن أبي الوليد قال : حدثنا خالد الحذاء، عن عبد الله بن الحارث قال : شهدت ابن عباس كبر في صلاة العيد بالبصرة تسع تكبيرات...
قال : وشهدت المغيرة بن شعبة فعل ذلك أيضاً. فسألت خالداً كيف فعل ابن عباس؟ ففسر لنا كما صنع ابن مسعود في حديث معمر والثوري عن أبي إسحاق سواء.
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেন, إسناده صحيح ‘এরসনদ সহীহ’।
[সূত্রঃ আদদিরায়া ১/১৭৩]

২. মুহাম্মাদ (ইবনে সীরীন) থেকে বর্ণিত, আনাস রা. বলেন, নামাযের তাকবীর (তাকবীরে তাহরীমা)সহ৯ তাকবীর হবেÑ প্রথম রাকাতে ৫টি আর দ্বিতীয় রাকাতে ৪টি।
[সূত্রঃ শরহু মাআনিল আছার ৪/৫৭৩]।

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই,

حدثنا أبو بكرة قال : ثنا روح قال : ثنا الأشعث، عن محمد، عن أنس بن مالك رضي الله عنه أنه قال : تسع تكبيرات : خمس في الأولى، وأربع في الأخيرة مع تكبيرة الصلاة.
বদরুদ্দীন আইনী রাহ. ‘নুখাবুল আফকার’ গ্রন্থে  (১৬/৪৫৪) বলেন, أخرجه من طريقين صحيحين ‘ইমামতহাবী এটি দু’টি সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।’

৩. ইবরাহীম নাখায়ী থেকে বর্ণিত, আসওয়াদ ওমাসরূক ঈদের নামাযে ৯ তাকবীর দিতেন।
[প্রাগুক্ত ৪/৫৭৪]।

সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই,
حدثنا أبو بكرة قال : ثنا روح قال : ثنا شعبة قال : سمعت منصوراً يحدث عن إبراهيم، عن الأسود ومسروق أنهما كانا يكبران في العيدين تسع تكبيرات.
বদরুদ্দীন আইনী ‘নুখাবুল আফকার’ গ্রন্থে  (১৬/৪৫৮) বলেন, فأخرجه أيضاً بإسناد صحيح ‘ইমামতহাবী এটিও সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।’

৪. খালিদ (ইবনে মেহরান আলহায্যা) থেকে বর্ণিত, আবু কিলাবা বলেন, দুই ঈদের নামাযে তাকবীর ৯টিকরে।
[সূত্রঃ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৫৭৬২]।
সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই,

حدثنا الثقفي، عن خالد، عن أبي  قلابة قال : التكبير في العيدين تسع تسع.
৫. হিশাম (ইবনে হাস্সান) থেকে বর্ণিত, হাসান (বছরী) ও মুহাম্মাদ (ইবনে সীরীন) ৯ তাকবীর দিতেন। [প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৫৭৬৫]।
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই,

حدثنا إسحاق الأزرق، عن هشام، عن الحسن ومحمد أنهما كانا يكبران تسع تكبيرات.
আরো দেখুন : শরহু মাআনিল আছার, নুখাবুল আফকারসহ) ১৬/৪৫৯-৪৬০।

৬. শাইবানী (সুলায়মান ইবনে আবী সুলায়মান) থেকে বর্ণিত, শাবী ও মুসায়্যিব (ইবনে রাফি) বলেন, ঈদের নামাযে ৯ তাকবীর হবে, প্রথম রাকাতে ৫টি, দ্বিতীয় রাকাতে ৪টি। আর দুই কেরাতের মাঝে কোনো তাকবীর নেই।
[প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৫৭৭৪]

সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই,

حدثنا إسحاق بن منصور قال : حدثنا أبو كدينة، عن الشيباني، عن الشعبي والمسيب قالا : الصلاة يوم العيدين  تسع تكبيرات، خمس في الأولى وأربع في الآخرة، ليس بين القراءتين تكبيرة.

৭. ইবরাহীম নাখায়ী থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) রা.-এর শাগরিদগণ ঈদের নামাযে ৯ তাকবীর  দিতেন।
[প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৫৭৬১]।
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই,
حدثنا إسحاق الأزرق، عن الأعمش، عن إبراهيم: أن أصحاب عبد الله كانوا يكبرون في العيد تسع تكبيرات .
৮. আবু মা‘শার (যিয়াদ ইবনে কুলায়ব) থেকে বর্ণিত, ইবরাহীম নাখায়ী বলেন, ৯ তাকবীর হবে।
[সূত্রঃ শরহু মাআনিল আছার ৪/৫৭৫]।

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই,

حدثنا أبو بكرة قال : ثنا روح قال : ثنا سعيد، عن أبي معشر، عن إبراهيم النخعي قال:  تسع تكبيرات.
বদরুদ্দীন আইনী ‘নুখাবুল আফকার’ গ্রন্থে (১৬/৪৫৯) বলেন,
فأخرجه أيضاً بإسناد صحيح
‘ইমাম তহাবী এটিও সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।’
_______________
Top