بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ


فَلَا أُقْسِمُ بِمَا تُبْصِرُونَ – وَمَا لَا تُبْصِرُونَ – إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ – وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيلًا مَا تُؤْمِنُونَ – وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ – تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ – وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ – لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ – ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ – فَمَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ – وَإِنَّهُ لَتَذْكِرَةٌ لِلْمُتَّقِينَ – وَإِنَّا لَنَعْلَمُ أَنَّ مِنْكُمْ مُكَذِّبِينَ – وَإِنَّهُ لَحَسْرَةٌ عَلَى الْكَافِرِينَ – وَإِنَّهُ لَحَقُّ الْيَقِينِ – فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ –


তরজমা: (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) সুতরাং আমার শপথ রইল, ওই সব বস্তুর, যেগুলো তোমরা দেখতে পাচ্ছ এবং যেগুলো তোমরা দেখতে পাও না। নিশ্চয় এই কোরআন একজন সম্মানিত রাসুলের সাথে বলা বানীসমূহ এবং তা কোন কবির বানী নয়। কত কমই তোমরা অনুধাবন কর। তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি সমগ্র বিশে^র প্রতিপালক । এবং যদি তিনি আমার নামে একটা কথাও রচনা করতেন। তবে অবশ্য আমি তাঁর নিকট থেকে সজোরে বদলা নিতাম। অতঃপর তাঁর হৃদয়-শিরা কেটে দিতাম। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাঁর রক্ষাকারী থাকত না। এবং নিশ্চয় এ কুরআন খোদাভীরুদের জন্য একটি উপদেশ। এবং অবশ্য আমি জানি তোমাদের মধ্যে কিছু লোক মিথ্যারোপকারী রয়েছে। এবং নিশ্চয় তা কাফিরদের জন্য অনুশোচনা। নিশ্চয় এটা নিশ্চিত সত্য অতএব আপনি আপনার মহান পালন কর্তার নামের পবিত্রতা বর্ণনা করুণ।
[৩৮-৫২ নং আয়াত, সূরা আল হাক্বক্বাহ]


আনুষঙ্গিক আলোচনা 
فَلَا أُقْسِمُ بِمَا تُبْصِرُون
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই সব বস্তুর শপথ করেছেন যা বান্দারা দেখতে পায় অর্থাৎ যা প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান বস্তু সামগ্রী যথা, দুনিয়া দেহ বিশিষ্ট যা জড় বস্তুসমূহ ইত্যাদী। এবং সেই সব বস্তুরও শপথ করেছেন যা বান্দাগণ দেখতে পায় না অর্থাৎ অপ্রকাশ্য ও অদৃশ্য বস্তু সামগ্রী যেমন আখেরাত, রূহসমুহ, জীন সম্প্রদায়, ফেরেশতাকুল, এবং সকল অদৃশ্য জগত ইত্যাদি। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, দৃশ্যমান-অদৃশ্য, ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল সৃষ্ট বস্তু মহান আল্লাহর শপথের আওতাভুক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলেন, “তোমরা যা দেখ না” বলে মহান আল্লাহর কুদরতি মহিমান্বিত স্বত্ত্বা ও গুণাবলী বুঝানো হয়েছে। [তাফসীরে নুরুল ইরফান ও মাযহারী শরীফ]







إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ
উদ্ধৃত মহান আল্লাহর বানী নিশ্চয় এই কোরআন একজন পরম সম্মানিত রাসুলের বানী” এর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন, অভিশপ্ত কাফের-মুশরিকরা কখনো রাসুলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবি আর কুরআনে কারীমকে কবিতা আবার কখনো আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গণক আর কুরআনে হাকীমকে গণকের ভবিষ্যৎ বানী ইত্যাদী বলে আল্লাহর নবী দোজাহানের সরদার মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কুরআনে আজীম এবং দ্বীন ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ বিতর্কিত ও হালকা করার অপচেষ্টা চালাত বিভিন্ন সময়ে। মহান আল্লাহ উপরোক্ত আয়াতসহ পরবর্তী কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ করে কাফের-মুশরিকদের উক্ত প্রপাগান্ডার খন্ডন করেছেন, এবং এরশাদ করেছেন, এই কুরআন নিঃসন্দেহে একজন পরম সম্মানিত রাসুলের বাণী। এটা কোন কবির কবিতা কিংবা গনকের ভবিষ্যৎ বানী নয়।
এর দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, সমগ্র কুরআনই হচ্ছে মহান আল্লাহর ওই কথোপকথন, যা তিনি আপন রাসুলের সাথে করেছেন। এজন্য কুরআনে কারীমে এমন সব আয়াতও রয়েছে, যেগুলোর মর্ম জ্ঞান রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো নিকট নেই। যেমন ‘আয়াতে মুতাশাবেহাত’ তথা অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াতসমূহ। এর মাধ্যমে রাসুলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একক, দ্বিতীয় ও ব্যতীক্রমধর্মী শান-মান ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
[তাফসীরে নুরুল ইরফান শরীফ] আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত “রাসুলিন কারীম” বলে আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে সকল তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণের মতে। যদিও বা কেউ কেউ বলেছেন “রাসুলিন কারীম” বলে হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বক্ষমান আয়াতে।
[তাফসীরে কাশ্শাফ] আলোচ্য আয়াতে কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “কারীম” তথা “বড় দানশীল” বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর দানশীল-দাতা তিনিই হতে পারেন যিনি ধন-ভান্ডারের মালিক হন। অতএব প্রমাণিত হল আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র খোদায়ী ধন-ভান্ডারের মালিক, যেমন, “সুরা কাউছার” এর প্রথম আয়াতে এরশাদ হয়েছে إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ অর্থাৎ ওহে রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিশ্চয় আমি আপনাকে কাউছার দান করেছি। আর সায়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুমার তাফসীর হল, كَوْثَر মানে الخير الكثير অর্থাৎ অসংখ্য-অপরসিম কল্যান-মঙ্গল। অতএব অপরিসিম কল্যাণ-মঙ্গললের কিয়দাংশ হল খোদায়ী ধন-ভান্ডার। অতএব কুরআনের মর্মালোকে প্রমাণিত হল রাসুলে আকরাম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খোদায়ী ধন-ভান্ডারের মালিক এবং অতিশয় দানশীল। তাই কোন ভিখারী কোন দিন নবীর দরবারে ভিক্ষা প্রার্থী হয়ে কখনো শূণ্য হাতে ফিরে যায়নি। বরং যে নবীর মুখাপেক্ষি হয়েছে দুনিয়া-আখেরাতের অপরিসীম নেয়ামত লাভে চির ধন্য হয়েছে।


فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন, পূর্ববর্তী আয়াত সমূহে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, রাসুলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু বলেন না। তিনি আল্লাহর কালামই বলেন। এই কালাম খোদাভীরুদের জন্য উপদেশ। কিন্তু আমি আল্লাহ অবশ্য একথাও জানি যে, এসব অকাট্য ও নিশ্চিত বিষয়াদি জানা সত্ত্বেও অনেক লোক মিথ্যারোপ করতে থাকবে। এর পরিণাম হবে পরকালে তাদের অনুশোচনা ও সার্বক্ষণিক আযাব। অতঃপর বলা হয়েছে, وَإِنَّهُ لَحَقُّ الْيَقِينِ অর্থাৎ এটা পুরোপুরি সত্য ও নিশ্চিত। এতে সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। অতঃপর রাসুলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ওহে রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি এই হটকারী কাফের-মুশরিকদের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না এবং দুঃখিতও হবেন না। বরং আপনার মহান পালনকর্তার পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনায় নিজেকে নিয়োজিত করুন। এটাই সব দুঃখ থেকে মুক্তির উপায়।
অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে, وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ – فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ- অর্থাৎ আমি আল্লাহ অবশ্যই জানি আপনি কাফেরদের অর্থহীন কথবার্তায় মনক্ষুন্ন হন। এর প্রতিকার এই যে, আপনি আপনার পালনকর্তার প্রশংসায় মশগুল হয়ে যান এবং সেজদাকারীদের দলভূক্ত হয়ে যান। কাফেরদের কথাবার্তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না।
আবু দাউদ শরীফের রেওয়ায়াতে হযরত ওকবা বিন আমের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যখন فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ আয়াতখানি নাযিল হয় তখন রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন এ আয়াতের আমলকে তোমরা রুকুতে রাখ অতঃপর যখন فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْاعَلى আয়াতখানি নাযিল হয় তখন তিনি বললেন এ আয়াতের আমলকে তোমরা তোমাদের সিজদায় রাখ। এ কারণেই সর্বসম্মতভাবে রুকু সিজদায় এই দুটি তাসবিহ পাঠ করা হয়। অধিকাংশ ইমামের মতে এগুলো তিনবার পাঠ করা সুন্নাত কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন।



Top