==



بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ


فإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ – وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً – فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ – وَانْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ – وَالْمَلَكُ عَلَى أَرْجَائِهَا وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ – يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ – فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَيَقُولُ هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ – إِنِّي ظَنَنْتُ أَنِّي مُلَاقٍ حِسَابِيَهْ – فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ – فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ – قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ – كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ-


অনুবাদ: (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) অতঃপর যখন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, একটি মাত্র ফুৎকার। এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া হবে। সেদিন যে, সংঘটিত হয়ে যাবে কেয়ামত। এবং আকাশ বিদীর্ণ হবে। অতঃপর সেদিন সেটার অবস্থা দুর্বল হবে। আর ফিরিশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে এবং সেদিন আপনার প্রতিপালকের আরশকে আটজন ফিরিশতা তাদের উপর বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে যে, তোমাদের মধ্যে কোন গোপনীয় সত্তা গোপন থাকতে পারবে না। সুতরাং ওই ব্যক্তি, যার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে, ‘নাও, আমলনামা পাঠ কর। আমার দৃঢ় বিশ^াস ছিল যে, আমি আমার হিসাবের সম্মুখীন হব।’ সুতরাং সে মনোরম শান্তিতে রয়েছে, সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত থাকবে। আহার কর এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে পুরষ্কার সেটারই, যা তোমরা বিগত দিনগুলোতে আগে প্রেরণ করেছ। [১৩-২৪ নং আয়াত, সূরা আল হাক্বক্বাহ]


আনুষঙ্গিক আলোচনা 
فإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-আরবিصور শব্দের অর্থ শিংগা। যেমন, তিরমিযী শরীফে সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার রেওয়ায়াতে উল্লেখিত আছে যে, صُّورِ শিং এর আকারে কোন বস্তুকে বলা হয়। কেয়ামতের দিন এতে ফুৎকার দেওয়া হবে। হঠাৎ একযোগে এই শিংগায় আওয়াজ দেওয়া হবে। এবং সবার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত একটানা আওয়াজ অব্যাহত থাকবে। কুরআনে কারীমের আয়াত ও হাদীসে নববী শরীফের রেওয়ায়াতের ভাষ্যানুযায়ী কেয়ামতের দিন শিংগার দুটি ফুৎকারের বিষয় প্রমাণিত । প্রথম ফুৎকারকে نفخة صعق অর্থাৎ বেহুশ হয়ে মৃত্যুবরণ করায় ফুৎকার বলা হয়। যেমন, সূরা “যুমার ” এর ৬৮ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ অর্থাৎ এবং শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে। অতঃপর আসমানগুলোর অধিবাসী (ফেরেশতা) এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী (মানব, জি¦ন ও অন্যান্য জীব-জন্তু) অজ্ঞান হয়ে যাবে। অতএব এই অজ্ঞান অবস্থায় সবার মৃত্যু ঘটবে। আর দ্বিতীয় ফুৎকারকে نفخة بعث বলা হয়। بعث মানে পুনর্জীবিত হওয়া। এই দ্বিতীয় ফুৎকারের মাধ্যমে সকল মৃত জীবিত হয়ে দাড়িয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে সূরা “যুমার ” এর ৬৮ নং আয়াতের শেষাংশে এরশাদ হয়েছে- ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ অর্থাৎ পুনরায় শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। ফলে অকস্মাৎ সব মৃত জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং দেখতে থাকবে।


কোন কোন রেওয়ায়াতে এই দুই ফুৎকারের পূর্বে তৃতীয় একটি ফুৎকারের উল্লেখ আছে। এর নাম نفخة فزع কিন্তু এ প্রসঙ্গে সকল রেওয়ায়াতের সমষ্টিতে চিন্তা করলে জানা যায় যে, এটা প্রথম ফুৎকারই। শুরুতে একে نفخة فزع বলা হয়েছে এবং পরিণামে এটাই نفخة صعق হয়ে যাবে। [তাফসীরে মাযহারী শরীফ]







وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ
আল্লাহর পবিত্র বাণী “আর কেয়ামতের দিন আটজন ফেরেশতা আল্লাহর আরশকে বহন করবে।” কোন কোন রেওয়ায়াতে উল্লেখিত আছে যে, কেয়ামতরে পূর্বে চারজন ফেরেশতা এ দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। আর কেয়ামতের দিন তাদের সাথে আরো চারজন ফেরেশতা মিলিত হবে। এই পরিবর্তনের হেকমত বা রহস্য মহান আল্লাহই ভাল জানেন।


মুফাসসেরীনে কেরাম বলেছেন- দুনিয়ায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের চারটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যের বিশেষভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটেঃ ইলম বা জ্ঞান, কুদরত বা ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, ইরাদাহ বা অভিলাষ-ইচ্ছা এবং হেকমত বা প্রজ্ঞা। আর কেয়ামত দিবসে এ চারটা গুণের সাথে আরো চারটা গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। (সুবহানাল্লাহ) ওইগুলো হলো- ইযহার বা প্রকাশ ঘটানো, কামাল বা শ্রেষ্ঠত্ব, কুদ্ছ বা পবিত্রতার মহিমা এবং আদল বা ন্যায়বিচার। [তাফসীরে আযিযী শরীফ]


মহান আল্লাহর আরশ কি? এর স্বরূপ ও প্রকৃত আকার-আকৃতি কি? ফেরেশতারা কিভাবে একে বহন করছে? এসব প্রশ্নের সমাধান মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি দিতে পারে না এবং এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা কিংবা প্রশ্ন উত্থাপন করার অনুমতি নেই। এধরনের যাবতীয় বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, এসব বিষয়ে মহান আল্লাহর উদ্দ্যেশ্য সত্য এবং স্বরূপ অজ্ঞাত বলে বিশ^াস করতে হবে।


يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিপূর্ণ কুদরতের চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ কেয়ামত সংঘটিত হওয়া, আর কেয়ামত দিবসের ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ ও বিস্ময়কর বিষয়াবলীর অন্যতম হল সেদিন সবাই মহান আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে। কোন আত্মগোপনকারী কোনরূপে আত্মগোপন করতে পারবে না। মহান আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টি থেকে আজ দুনিয়াতেও কেউ আত্মগোপন করতে পারে না। সেই দিনের বিশেষত্ব সম্ভবতঃ এই যে, হাশরের ময়দানে সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ সবটি সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হবে। গর্ত,পর্বত, ঘর-বাড়ি,বৃক্ষ ইত্যাদী আড়াল বলতে কিছুই থাকবে না। ফলে কেউ আত্মগোপন করার সুযোগ পাবে না।


তাছাড়া কুরআনে কারীমের “সূরা আল-ইনফিত্বারে” এরশাদ হয়েছে-
وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ – كِرَامًا كَاتِبِينَ – يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ-
অর্থাৎ অবশ্যই তোমাদের উপর কেরামান-কাতিবিন নামীয় ফেরেশতার দল নিযুক্ত রয়েছেন, যারা তোমাদের সকল কৃতকার্য সম্পর্কে অবগত।


অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে- ما يلفظ من الاّ لديه رقيب عتيد অর্থাৎ বান্দাহর মুখ দিয়ে যাই উচ্চারিত হয় তৎক্ষনাৎ পর্যবেক্ষণকারী ফেরেশতা তা রেকর্ড করে সংরক্ষণ করে। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে- وهو معكم اينما كنتم- অর্থাৎ তিনি (অর্থাৎ মহান আল্লাহ) তোমাদের সঙ্গেই আছেন তোমরা সেখানে যে কর্ম-কান্ডেই লিপ্ত হওনা কেন। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে- والله شهيد على ما تعملون অর্থাৎ মহান আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করেন। সূরা “ আলে ইমরানের” প্রথম পৃষ্ঠায় এরশাদ হয়েছে- إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ এমন সত্ত্বা যার সামনে ভূ-মন্ডল ও নভোমন্ডলের কোন বিষয়েই গোপন নেই।


উপরোক্ত আয়াত সমূহরে মর্মবাণীর আলোকে প্রমাণিত সত্য হল আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রসহ সকল সৃষ্টির সার্বক্ষণিক সব বিষয় মহান আল্লাহর কুদরতের নজরে দৃশ্যমান। মানব আর জি¦নসহ মাখলুক্বাতের কোন মুহুর্তের কোন কৃতকর্ম খোদায়ী কুদরতের পর্যবেক্ষণ হতে গোপন নয়। বরং সবই উম্মুক্ত। উপরন্তু এর উপর প্রামাণ্য দলীল ডকুমেন্ট স্বরূপ। কিরামান-কাতেবিন নামীয় ফেরেশতার তৈরীকৃত “রেকর্ড বুক” তথা আমলনামা তো রয়েছেই। আবার বান্দার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের মাধ্যমে সম্পাদিত কর্মকান্ডের ব্যাপারে কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য প্রদান করবে। যেমন, “সূরা ইয়াসিন” এর ৬৫ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে- الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ অর্থাৎ আজ আমি (আল্লাহ) তাদের মুখগুলোর উপর মোহর করে দেব এবং তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে আর তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দান করবে। (সুবহানাল্লাহ)


উপরোক্ত খোদায়ী ফরমানের আলোকে প্রতীয়মান হয় আমাদের দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ আমাদের সার্বক্ষনিক পরম সাহায্যকারী হওয়ার পাশাপাশি এগুলো আমাদের উপর নিযুক্ত খোদায়ী গোয়েন্দা প্রহরীও বটে। সুতরাং মহান আল্লাহর কুদরতি নজরের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষন, কিরামান-কাতেবিনের রেকর্ডকৃত আমলনামা এবং সর্বোপরি বান্দার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সাক্ষ্য প্রদান ইত্যাদির কারণে কেয়ামতের দিন খোদায়ী এজলাশে কোন বিষয় গোপন করা সম্ভবপর হবে না। বরং সবই স্পষ্টভাবে-দৃশ্যমান হয়ে প্রমাণিত-প্রতিষ্ঠিত হবে।


পরিশেষে মহান আল্লাহর আলিশান দরবারে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন সকল মুমিন নর-নারীকে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।


Top