بسم الله الرحمن الرحيم
اِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (১) قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ (২) أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ (৩) يَغْفِرْ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرْكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى إِنَّ أَجَلَ اللَّهِ إِذَا جَاءَ لَا يُؤَخَّرُ لَوْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৪) قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا (৫) فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلَّا فِرَارًا (৬) وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا (৭) ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا (৮) ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا (৯)
তরজমা: (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) নিশ্চয় আমি (মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা) হযরত নূহ আলায়হিস্ সালামকে প্রেরণ করেছি তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি (এ নির্দেশ সহকারে) তোমার সম্প্রদায়কে সতর্ক কর। এর পূর্বে যে, তাদের উপর বেদনাদায়ক শাস্তি আসবে। তিনি (হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম বললেন – হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য অবশ্যই সুস্পষ্ট সতর্ককারী, (এ মর্মে) যে, আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাঁকে ভয় করো আর আমার নির্দেশ মেনে চলো। (ফলে) তিনি তোমাদের গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং একটা নির্দিষ্ট মেয়াদকাল পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্র নির্দিষ্ট মেয়াদকাল যখন আসে তখন তা পেছানো যায় না। যদি তোমরা তা জানতে (তবে কতই না উত্তম হতো) তিনি (অর্থাৎ হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম) বললেন হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবা রাত্রি দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের পলায়ন করাকেই বৃদ্ধি করেছে। আর আমি যতবারই তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, যাতে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, ততবারই তারা তাদের কানে আঙ্গুল দিয়ে বসেছে, মুখমণ্ডল বস্ত্রাবৃত করেছে, একগুঁয়ে হয়ে রয়েছে, এবং অহংকার করেছে। অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি। অতঃপর আমি তাদেরকে ঘোষণা সহকারেও বলেছি এবং নি¤œ স্বরে গোপনেও বলেছি।
[সূরা নূহ, ১-৯ নম্বর আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ …
সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম
তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণের অভিমত অনুযায়ী সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম এর প্রকৃত নাম আব্দুল গাফ্ফার অথবা ইয়াশকুর। নূহ হলো উপাধী। মহান আল্লাহ্র স্মরণে অধিক হারে আর্তনাদ আহাজারী করতেন বিধায় নূহ নামে আখ্যায়িত হন শরীয়তের বিধি-বিধান, আদেশ-নিষেধ সম্বলিত ওহীপ্রাপ্ত নবীগণের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম নবী আল্লাহর দ্বীন ও ওহী অস্বীকারকারী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম তাঁর সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক হারে খোদায়ী আযাব অবতীর্ণ হয়।
তিনি সুদীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর দুনিয়ার জীবনে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর দৈহিক শক্তি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি, একটি দাঁত ও পড়েনি, একগাছি চুল মোবারকও পাকেনি। তিনি সারা জীবন তার সম্প্রদায়ের নির্যাতন-নিপীড়ন অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সহ্য করেছেন।
[তাফসীরে মাযহারী শরীফ] মুফাসসির কুল সরদার সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার পক্ষ থেকে বর্ণিত, সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হলে নবুওয়ত এর মিশনের প্রচার-প্রসারের সূত্রপাত করেন। সুদীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর ব্যাপী তিনি কখনো চেষ্টায় ক্ষান্ত হননি, এবং কোন দিন নিরাশ ও হননি। সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানাবিধ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে তিনি সবর করেন।
ইমাম দাহহাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সাইয়্যেদুনা হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম তাঁর সম্প্রদায়ের প্রহারের চোটে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন। এরপর তারা তাঁকে একটি কম্বলে জড়িয়ে গৃহে রেখে যেত। তারা ধারণা করত যে, তিনি মারা গেছেন। (নাউযুবিল্লাহ্) কিন্তু পরবর্তী দিন যখন তাঁর চৈতন্য ফিরে আসত তখন আবার তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ তা’য়ালার দিকে দাওয়াত দিতেন এবং দ্বীনি মিশনের প্রচার কার্যে আত্মনিয়োগ করতেন।

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক হযরত ওবায়দ ইবনে আমরেশি থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এ সংবাদপ্রাপ্ত হয়েছেন যে, তাঁর সম্প্রদায় গলা টিপে দিত। ফলে তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলতেন। পুনরায় চেতনা ফিরে এলে তিনি এই দোয়া করেন رب اغفر لقومي فانهم لايعلمون ” “অর্থাৎ হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করুন, কারণ তারা অবুঝ। তাদের এক পুরুষের ঈমানের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে তিনি দ্বিতীয় পুরুষের ঈমানের ব্যাপারে আশাবাদী হতেন। দ্বিতীয় পুরুষের পর তৃতীয় পুরুষের ব্যাপারেও এমনি আশাবাদী হয়ে তিনি কতর্ব্য পালনে নিয়োজিত থাকতেন। কারণ তাদের পুরুষানুক্রমিক বয়স সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম এর ন্যায় দীর্ঘ ছিল না। তিনি মু’জেযা হিসেবে দীর্ঘ বয়স পেয়েছিলেন। যখন সম্প্রদায়ের একের পর এক প্রজন্ম অতিক্রান্ত হতে থাকে এবং প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম বিগত প্রজন্ম অপেক্ষা অধিকতর দুষ্টমতি প্রমাণিত হতে থাকে, তখন সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম মহান আল্লাহ্র দরবারে অভিযোগ পেশ করে আরজ করলেন- হে আমার প্রতিপালক! আমি তাদেরকে দিবা-রাত্রি দলবদ্ধভাবে ও পৃথকভাবে, প্রকাশ্যে ও সংগোপনে – অর্থাৎ সর্বোতভাবে পথে আনার চেষ্টা করেছি, কখনো আযাবের ভয় প্রদর্শন করেছি কখনো জান্নাতের নেয়ামতরাজির লোভ দেখিয়েছি। আরো বলেছি – ঈমান ও সৎকর্মের বরকতে আল্লাহ্ তোমাদেরকে দুনিয়াতেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন এবং কখনো আল্লাহ্র কুদরতের নিদর্শনাবলী পেশ করে বুজিয়েছি কিন্তু তারা কিছুতেই কর্ণপাত করল না। অপরদিকে আল্লাহ্ তা’য়ালা সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম কে জানিয়ে দিলেন আপনার সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত নতুন কেউ ঈমান আনায়ন করবে না أَنَّهُ لَنْ يُؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ إِلَّا مَنْ قَدْ آمَنَ আয়াতের মর্মার্থ এটাই। এমনি নৈরাশ্যের পর্যায়ে পৌছে সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম এর যবানে পাকে বদদোয়া উচ্চারিত হল। ফলে সমগ্র সম্প্রদায় নিমজ্জিত ও ধ্বংস হল, তবে মুমিনগণ সংখ্যায় নগণ্য হলেও রক্ষা পেল।
وَيُؤَخِّرْكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى
উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরিনে কেরাম উল্লেখ করেছেন أَجَلٍ مُسَمًّى মানে সুনির্দিষ্ট সময় কাল, মেয়াদ ইত্যাদি। অতএব আয়াতের মর্মার্থ হলো তোমরা ঈমান আনায়ন করলে আল্লাহ্ তা’য়ালা তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত অবকাশ দেবেন। অর্থাৎ জাগতিক জীবনের নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বে তোমাদেরকে কোন পার্থিব আযাবে ধ্বংস করবেন না। এর সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, ঈমান না আনলে নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বেই তোমাদেরকে আযাবে ধ্বংস করে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। জাগতিক জীবনের মেয়াদের মাঝে মাঝে এরূপ শর্ত থাকে যে, সে অমুক কাজ করলে উদাহারনতঃ তার বয়স আশি বছর হবে এবং না করলে ষাট বছর বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। এমনিভাবে অকৃতজ্ঞতার কাজে বয়স হ্রাস পাওয়া এবং কৃতজ্ঞতার কাজে বয়স বেড়ে যাওয়াও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে। তাফসীরে মাযহারী শরীফে বয়স হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কিত আলোচনায় উল্লেখিত আছে যে, তাকদীর দুই প্রকার। যথা: এক. এবরাম বা চূড়ান্ত অকাট্য, দুই. মুয়াল্লাক বা শর্তযুক্ত। অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে এভাবে লেখা হয় যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’য়ালার আনুগত্য করলে ষাট বছর হবে এবং আনুগত্য না করলে পঞ্চাশ বছর বয়সে খতম করে দেয়া হবে। দ্বিতীয় প্রকার তাকদীরে শর্তের অনুপস্থিতিতে পরিবর্তন হতে পারে। উভয় প্রকার তাকদীর কুরআনে কারীমের এ আয়াতে উল্লেখ আছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ অর্থাৎ আল্লাহ্ লাওহে মাহফুজে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে থাকেন এবং তাঁর কাছে রয়েছে মূল কিতাব। “মূল কিতাব” বলে সহীহ কিতাবকে বুঝানো হয়েছে, যাতে অকাট্য তাকদীর আছে। কেননা, শর্তযুক্ত তাকদীরে লিখিত শর্ত সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’য়ালা পূর্ব থেকেই জানেন যে, এ ব্যক্তি পরিপূর্ণ করবে কি করবে না। তাই চূড়ান্ত তাকদীরে অকাট্য ফায়সালা লেখা হয়। সাইয়্যেদুনা হযরত সালমান ফারেসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন –
لاَ يَرُدُّ القَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ، وَلاَ يَزِيدُ فِي العُمْرِ إِلاَّ البِرُّ অর্থাৎ দোয়া ব্যতীত কোন কিছু আল্লাহ্ তা’য়ালার ফায়সালা রোধ করতে পারে না এবং পিতা-মাতার বাধ্য অনুগত হওয়া ব্যতীত কোন কিছু বয়স বৃদ্ধি করতে পারে না। এই হাদীস শরীফের মতলব এটাই যে, শর্তযুক্ত তাকদীরে এসব কর্মের কারণে পরিবর্তন হতে পারে। সার কথা, আয়াতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অবকাশ দেয়াকে তাদের ঈমান আনার উপর নির্ভরশীল করে তাদের বয়স সম্পর্কে শর্তযুক্ত তাকদীর বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ সায়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম কে এ সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন। এ কারণে তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলে দিলেন, তোমরা ঈমান আনলে মহান আল্লাহ্ তোমাদের জন্য মূল বয়স নির্ধারণ করেছেন। সেই পর্যন্ত তোমরা অবকাশ পাবে এবং পার্থিব কোন আযাবে ধ্বংস হবে না। পক্ষান্তরে যদি তোমরা ঈমান না আন, তবে এই আসল বয়সের পূর্বেই আল্লাহ্ তা’য়ালার আযাব তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে। এমতাবস্থায় পরকালের আযাবে লিপ্ত হবে। অতঃপর আরো বলে দিলেন যে, ঈমান আনলেও চিরতরে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে না। বরং অকাট্য তাকদীরে তোমাদের যে বয়স লিখিত আছে সেই বয়সে মৃত্যু আসা অপরিহার্য। কারণ মহান আল্লাহ স্বীয় রহস্য বলে এই বিশ্ব চরাচরকে চিরস্থায়ী করেন। এখানকার প্রত্যেক বস্তু অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এতে ঈমান ও আনুগত্য এবং কুফর ও গুনাহের কারণে কোন পার্থক্য হয় না। إِنَّ أَجَلَ اللَّهِ إِذَا جَاءَ لَا يُؤَخَّرُ আয়াতাংশে এই চরম সত্যিই বিধৃত হয়েছে।
Top