প্রশ্নঃ বিভিন্ন কবরস্থানে এবং মাজার শরীফে ফুল দেওয়া ইসলামিক দৃষ্টিতে জা-য়েয আছে কিনা? ____ মাওলানা মুফতী বখতিয়ার উদ্দীন
________________________________________
[ ﻋﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻣﺮ ﺍﻟﻨﺒﻰ ﷺ ﺑﻘﺒﺮﻳﻦ ﻳﻌﺬﺑﺎﻥ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻧﻬﻤﺎ ﻟﻴﻌﺬﺑﺎﻥ ﻭﻣﺎ ﻳﻌﺬﺑﺎﻥ ﻓﻰ ﻛﺒﻴﺮ ﺍﻣﺎ ﺍﺣﺪﻫﻤﺎ ﻓﻜﺎﻥ ﻻﻳﺴﺘﺘﺮ ﻣﻦ ﺍﻟﺒﻮﻝ ﻭﺍﻣﺎ ﺍﻻﺧﺮ ﻓﻜﺎﻥ ﻳﻤﺸﻰ ﺑﺎﻟﻨﻤﻴﻤﺔ ﺛﻢ ﺍﺥﺀ ﺟﺮﻳﺪﺓ ﺭﻃﺒﺔ ﻓﺸﻘﻬﺎ ﺑﻨﺼﻔﻴﻦ ﺛﻢ ﻏﺮﺯ ﻓﻰ ﻛﻞ ﻗﺒﺮ ﻭﺍﺣﺪﺓ ﻓﻘﺎﻟﻮﺍ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻟﻢ ﺻﻨﻌﺖ ﻫﺬﺍ ﻓﻘﺎﻝ ﻟﻌﻠﻪ ﺍﻥ ﻳﺨﻔﻒ ﻋﻨﻬﻤﺎ ﻣﺎﻟﻢ ﻳﻴﺒﺴﺎ . ]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস [ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী করিম [ﷺ ] একদা এমন দু’টি কবরের পাশ দিয়ে গমন করলেন যাতে আযাব চলছিল। অতঃপর নবী করিম [ ﷺ ] ইরশাদ ফরমান, বাহ্যিক দৃষ্টিতে বড় ধরনের কোন গুনাহর কারণে তাদের আযাব চলছেনা বরং তাদের একজনের অভ্যাস ছিল সে প্রস্রাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতো না, অপরজন পরনিন্দা করে বেড়াত। অতঃপর নবী-ই আকরাম [ ﷺ] একটি কাঁচা খেজুরের ডাল নিলেন, আর সেটাকে দু’ভাগ করে দু’কবরে গেড়ে দিলেন। সাহাবা-ই কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! [ﷺ ] এ কাজটি কি জন্য করলেন? প্রিয় নবীজী জবাব দিলেন, এ জন্য যে, যতদিন ডাল দু’টি তরু-তাজা থাকবে, ততদিন তাদের আযাব হালকা করা হবে।” [ সহীহ বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, ১৮২ পৃ. কিতাবুল জানা-ইয ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনাঃ
___________________
বিশ্বজগতের সকল বস্তু স্ব স্ব ভাষা ও অবস্থায় মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছে, কিন্তু কেউ কারো তাসবীহ বুঝতে পারে না। ঈমানদার মুসলমানদের কবরের উপর যে সবুজ গাছ থাকে সেগুলোও আল্লাহর তাসবীহ বর্ণনা করছে এবং এবং সেসব তাসবীহ’র সওয়াবের কারণে কবরবাসী উপকৃত হয়। যদি কবরবাসী নেককার হন, তাহলে তার মর্তবা বেড়ে যায়, আর বদকার গুনাগার হলে এই তাসবীহ-তাহলীলের বরকতে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সুতরাং মুসলমানদের কবর এবং আউলিয়া-এ কেরামের মাজারে পাকে ফুল চড়ানোর উদ্দেশ্যই সেটাই। যেহেতু কবরের উপর ছিটানো ফুল যতক্ষণ তাজা থাকবে কতক্ষণ তাদের পঠিত তাসবীহ-তাহলীল, তাকবীরের বরকত কবরবাসীর কাছে পৌঁছবে।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
[ ﺗُﺴَﺒِّﺢُ ﻟَﻪُ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕُ ﺍﻟﺴَّﺒْﻊُ ﻭَﺍﻟْﺄَﺭْﺽُ ﻭَﻣَﻦ ﻓِﻴﻬِﻦَّ ۚ ﻭَﺇِﻥ ﻣِّﻦ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﻟَّﺎ ﻳُﺴَﺒِّﺢُ ﺑِﺤَﻤْﺪِﻩِ ﻭَﻟَٰﻜِﻦ ﻟَّﺎ ﺗَﻔْﻘَﻬُﻮﻥَ ﺗَﺴْﺒِﻴﺤَﻬُﻢْ ۗ ﺇِﻧَّﻪُ ﻛَﺎﻥَ ﺣَﻠِﻴﻤًﺎ ﻏَﻔُﻮﺭًﺍ. ]
অর্থাৎ- “তাঁরই পবিত্রতা ঘোষণা করে সপ্ত আসমান ও যমীন এবং যা কিছু সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এবং এমন কোন বস্তু নেই, যা তাঁর প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা বর্ণনা করছে না। তবে তোমরা সেগুলোর তাসবীহ অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত -৪৪]
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
আল্লামা ইবনে হাজর আসক্বালানী [ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ] ‘ফতহুল বারী শরহে বুখারী’তে লিখেন-
[ ﺍﻥ ﺍﻟﻤﻌﻨﻰ ﻓﻴﻪ ﺍﻧﻪ ﻳﺴﺒﺢ ﻣﺎﺩﺍﻡ ﺭﻃﺒﺎ ﻧﻴﺨﺼﻞ ﺍﻟﺘﺨﻔﻴﻒ ﺑﺒﺮﻛﺔ ﺍﻟﺘﺴﺒﻴﺢ ﻭﻋﻠﻰ ﻫﺬﺍ ﻓﻴﻄﺮﺩ ﻓﻰ ﻛﻞ ﻣﺎ ﻓﻴﻪ ﺭﻃﻮﺑﺔ ﻣﻦ ﺍﻻﺷﺠﺎﺭ ﻭﻏﻴﺮﻫﺎ ﻭﻛﺬﻟﻚ ﻓﻴﻤﺎ ﻓﻴﻪ ﺑﺮﻛﺔ ﻛﺎﻟﺬﻛﺮ ﻭﺗﻼﻭﺓ ﺍﻟﻘﺮﺍﻥ ﻣﻦ ﺑﺎﺏ ﺍﻻﻭﻟﻰ. ]
“হাদীসের মর্মার্থ হল- গাছের ডালপালা, ফুল কিংবা ঘাস যতক্ষণ তাজা থাকবে ততক্ষণ সেগুলোর তাসবীহ পাঠের বরকতে কবরের আযাব হালকা করে দেয়া হবে। সুতরাং গাছ এবং গাছ জাতীয় (উদ্ভিদ) যাতে সজীবতা রয়েছে যেমন- ফুল ইত্যাদি কবরের উপর ছিটানো যাবে। যেহেতু এসব আল্লাহর যিকর করে থাকে। সুতরাং কবরের উপর কুরআন তিলাওয়াত আরো বেশী বরকতপূর্ণ আমল।”
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফয়জুল বারী’তে উল্লেখ আছে-
[ ﻓﻰ ﺍﻟﺪﺭ ﺍﻟﻤﺨﺘﺎﺭ ﺍﻥ ﺍﻧﺒﺎﺕ ﺍﻟﺸﺠﺮﺓ ﻣﺴﺘﺤﺐ ﻭﻓﻰ ﺍﻟﻌﺎﻟﻤﻐﻴﺮﻳﺔ ﺍﻥ ﺍﻟﻘﺎﺀ ﺍﻟﺮﻳﺎﺣﻴﻦ ﺍﻳﻀﺎ ﻣﻔﻴﺪ . ]
“অর্থাৎ- দুররে মুখতার কিতাবে রয়েছে, কবরের উপর গাছ লাগানো মুস্তাহাব, আর ফতওয়া-ই আলমগীরী’তে রয়েছে কবরের উপর ফুল ছিটানো উপকারী।”
[সূএঃ ফয়জুল বারী কৃত- আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী, ২য় খন্ড, ৪৮৯ পৃ.]
আল-ইমদাদ কিতাবে রয়েছে, ফতোয়ায়ে শামী’তে কবরের উপর হতে ঘাস কাটা মাকরুহ বলা হয়েছে। তার কারণ হল যতক্ষণ কবরের ঘাস, ফুল ইত্যাদি তাজা থাকবে ততক্ষণ আল্লাহর তাসবীহ পড়তে থাকে এবং সে তাসবীহ’র কারণে ঐ কবরবাসীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকবে। এর দলীল হলো ওই হাদীস যাতে বর্ণিত হয়েছে, হুযূর পাক [ﷺ ] খেজুরের শাখাকে দু’টুকরো করে দু’কবরে গেড়ে দিয়েছিলেন এবং নবী করিম [ ﷺ ] স্পষ্টভাবে একথা বলে দিয়েছিলেন যে, যতক্ষণ গাছের শাখা দু’টি তাজা (কাঁচা) থাকবে ততক্ষণ কবরের আযাব হালকা করা হবে।
উপরিউক্ত বর্ণনা হতে একটা বিষয় বুঝে নিতে পারি, কবরের উপর ঘাস লাগানো, ফুল ছিটানো মুস্তাহাব। ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, হযরত বুরাইদা আসলামী (রহঃ) স্বীয় কবরের উপর দু’টি গাছের শাখা গেঁড়ে দেওয়ার ওসীয়ত করে গিয়েছিলেন।
হযরত আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী [ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ] লিখেছেন-
[ ﻭﻗﺪ ﺍﻓﺘﻰ ﺍﻻﺋﻤﺔ ﻣﻦ ﻣﺘﺄﺧﺮﻯ ﺍﺻﺤﺎﺑﻨﺎ ﻣﻦ ﺍﻥ ﻣﺎ ﺍﻋﺘﻘﺪ ﻣﻦ ﻭﺿﻊ ﺍﻟﺮﻳﺤﺎﻥ ﻭﺍﻟﺠﺮﻳﺪﺓ ﺳﻨﺔ ﻟﻬﺬﺍ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﺍﺫﺍ ﻛﺎﻥ ﻳﺮﺟﻰ ﺍﻟﺘﺨﻔﻴﻒ ﺑﺘﺴﺒﺒﺢ ﺍﻟﺠﺮﻳﺪﺓ ﻓﺒﺘﻼﻭﺓ ﺍﻟﻘﺮﺍﻥ ﺍﻋﻈﻢ ﺑﺮﻛﺔ . ]
অর্থাৎ- “আমাদের হানাফী মাযহাবের মুতাআখ্খিরীন (পরবর্তী) ইমামগণ ফত্ওয়া পেশ করেন যে, কবরের উপর ফুল ছিটানো এবং গাছের ডাল-পালা লাগানোর যে প্রচলন আমরা দেখতে পাই, তা উল্লিখিত হাদীস শরীফের ভিত্তিতে সুন্নাত। সুতরাং বলা যায় গাছের ডাল-পালার তাসবীহ পাঠের বরকতে যদি কবরের আযাব হালকা হওয়ার আশা করা যায়, তাহলে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের বরকত কত বেশি হবে, তা সহজে অনুমেয়।
ইমাম নওয়াবী [ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ] বলেন-
“উল্লেখিত হাদীসের আলোকে ওলামায়ে কেরাম কবরের পাশে কুরআন তিলাওয়াত কে মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা খেজুরের শাখার তাসবীহ দ্বারা যদি কবরের আযাব হালকা হতে পারে, তাহলে (শ্রেষ্ঠতম যিকর) আল- কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে কবরের আযাব হালকা হওয়ার আশা করা আরো অধিক যুক্তিযুক্ত।”
ইমাম নওয়াবী আরো বলেনঃ
“এ হাদীস শরীফটির আবেদন ব্যাপক। অর্থাৎ- এটি কেবল খেজুর ডালার জন্যই খাস নয়।” [শরহে মুসলিম, ১ম খন্ড, ১৪১ পৃ.]
ফতোয়া- এ আলমগীরী’তে রয়েছে-
[ ﻭﺿﻊ ﺍﻟﻮﺭﺩ ﻭﺍﻟﺮﻳﺎﺣﻴﻦ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻘﺒﻮﺭ ﺣﺴﻦ ﻭﺍﻥ ﺍﻟﺘﺼﺪﻕ ﺑﻘﻴﻤﺔ ﺍﻟﻮﺭﺩ ﺍﺣﺴﻦ .]
অর্থাৎঃ “গোলাপ কিংবা অন্য কোন ফুল কবরের উপর ছিটানো ভালকাজ এবং ওই ফুলের দাম সাদক্বা করে দেয়া আরো উত্তম।” [সূত্রঃ আলমগীরী, ৫ম খন্ড, ৩৫১ পৃ.]
উপরিউক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হলো, মুসলমানদের কবরের উপর ফুল ছিটানো, ঘাঁস লাগানো ইত্যাদি সুন্নাত; এমনকি নবীজীর আমল। যেহেতু এর বিপরীত কোন হাদীস বর্ণিত হয় নি কিংবা পূর্ববর্ণিত হাদিসকে রহিত করা হয় নি। সেহেতু কোন কালেমা পড়ুয়া মুসলমান এ কাজকে অস্বীকার করতে পারবে না।