সঠিকভাবে কুরআন বুঝতে যা জানা দরকার
কুরআন মাজীদের সঠিক মর্ম ও উদ্দেশ্য জানার জন্য অথবা শুদ্ধভাবে তার অর্থ ও তাফসীর বুঝার জন্য শুধু আরবী ভাষা জ্ঞান ও সাহিত্যে পারদর্শিতা যথেষ্ট নয়। বরং এর জন্য চাই, আরবীর বেশ কিছু শাস্ত্রে সিদ্ধহস্ত হওয়া।
কুরআন বিজ্ঞানের মহাজ্ঞানী আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সঠিকভাবে কুরআন মাজীদের অর্থ ও তাফসীর বুঝার জন্য পনের রকমের জ্ঞানে পারদর্শী হতে হয়। যথা,
১)আরবী ভাষা,
২)ব্যাকরণ,
৩)ইলমে ছারফ,
৪)ইলমে ইশতিকাক,
৫)ইলমুল বায়ান,
৬)ইলমে বাদী‘,
৭)ইলমুল কির‘আত,
৮) ইলমু উসূলিদ্দীন,
৯) ইলমু উসূলিল ফিকহ,
১০)আসবাবে নুযূল,
১১)কাসাস বা ঘটনাবলী,
১২)নাসেখ ও মানসূখ,
১৩)ইলমে ফিকহ,
১৪)ইলমুল হাদীস এবং
১৫)ইলমে লাদুনী।
এসব জ্ঞান হলো তাফসীরে কুরআনের অপরিহার্য মাধ্যম। এসব জ্ঞানে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন ব্যতিরেকে কেউ কুরআনের তাফসীর করলে তা হবে ‘তাফসীর বির রায়’ তথা মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’ তবে জ্ঞান থাকলেও যদি হাদীসের জ্ঞান না থাকে অথবা হাদীসকে বাদ দেয়া হয়, তবুও কুরআন বুঝা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের কিছু ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় :
 আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ ﭐﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺀَﺍﻣَﻨُﻮﺍْ ﻭَﻟَﻢۡ ﻳَﻠۡﺒِﺴُﻮٓﺍْ ﺇِﻳﻤَٰﻨَﻬُﻢ ﺑِﻈُﻠۡﻢٍ ﺃُﻭْﻟَٰٓﺌِﻚَ ﻟَﻬُﻢُ ﭐﻟۡﺄَﻣۡﻦُ ﻭَﻫُﻢ ﻣُّﻬۡﺘَﺪُﻭﻥَ ٨٢﴾ ‏[ ﺍﻷﻧﻌﺎﻡ : 82 ]
‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে যুলমের
সাথে সংমিশ্রণ করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত’। {সূরা আল-আন‘আম,
আয়াত : ৮২}
আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, যখন আল্লাহ জাল্লা জালালুহূ এ আয়াত নাযিল করলেন, তখন সাহাবীগণ রাদিআল্লাহু ‘আনহুম একে ভারী মনে করলেন। তাঁরা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের ওপর কোনো ‘যুলুম’ করে নি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হও নি। আয়াতে ‘যুলুম’ বলে শিরককে বুঝানো হয়েছে। দেখ অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআ‘লা বলেন,
﴿ ﻭَﺇِﺫۡ ﻗَﺎﻝَ ﻟُﻘۡﻤَٰﻦُ ﻟِﭑﺑۡﻨِﻪِۦ ﻭَﻫُﻮَ ﻳَﻌِﻈُﻪُۥ ﻳَٰﺒُﻨَﻲَّ ﻟَﺎ ﺗُﺸۡﺮِﻙۡ ﺑِﭑﻟﻠَّﻪِۖ ﺇِﻥَّ ﭐﻟﺸِّﺮۡﻙَ ﻟَﻈُﻠۡﻢٌ ﻋَﻈِﻴﻢٞ ١٣ ﴾ ‏[ ﻟﻘﻤﺎﻥ: ١٣ ]
‘আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শিরক করো না; নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলম।’ {সূরা লুকমান, আয়াত : ১৩}
কাজেই এ আয়াতের অর্থ হবে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন করে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা, নাম ও
গুণাবলিতে এবং ইবাদতের বেলায় কাউকে অংশীদার না বানায়, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথপ্রাপ্ত।
 আয়েশা রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« ﻟَﻴْﺲَ ﺃَﺣَﺪٌ ﻳُﺤَﺎﺳَﺐُ ﺇِﻻَّ ﻫَﻠَﻚَ ».
‘কেয়ামতের দিন যে ব্যক্তিরই হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’
ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻗُﻠْﺖُ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺟَﻌَﻠَﻨِﻲ ﺍﻟﻠﻪُ ﻓِﺪَﺍﺀَﻙَ ﺃَﻟَﻴْﺲَ ﻳَﻘُﻮﻝُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﺰَّ ﻭَﺟَﻞَّ ‏[ ﻓَﺄَﻣَّﺎ ﻣَﻦْ ﺃُﻭﺗِﻲَ ﻛِﺘَﺎﺑَﻪُ ﺑِﻴَﻤِﻴﻨِﻪِ ﻓَﺴَﻮْﻑَ
ﻳُﺤَﺎﺳَﺐُ ﺣِﺴَﺎﺑًﺎ ﻳَﺴِﻴﺮًﺍ ‏] ﻗَﺎﻝَ
আয়েশা বলেন, একথা শুনে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি বলেন নি,
﴿ ﻓَﺄَﻣَّﺎ ﻣَﻦۡ ﺃُﻭﺗِﻲَ ﻛِﺘَٰﺒَﻪُۥ ﺑِﻴَﻤِﻴﻨِﻪِۦ ٧ ﻓَﺴَﻮۡﻑَ ﻳُﺤَﺎﺳَﺐُ ﺣِﺴَﺎﺑٗﺎ ﻳَﺴِﻴﺮٗﺍ ٨ ﴾ ‏[ﺍﻻﻧﺸﻘﺎﻕ : ٧، ٨ ]
‘অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে; অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ
করা হবে।’ {সূরা ইনশিকাক, আয়াত : ৭-৮}
উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« ﺫَﺍﻙَ ﺍﻟْﻌَﺮْﺽُ ﻳُﻌْﺮَﺿُﻮﻥَ ﻭَﻣَﻦْ ﻧُﻮﻗِﺶَ ﺍﻟْﺤِﺴَﺎﺏَ ﻫَﻠَﻚَ ».
‘আমলনামা পেশ করার কথা যা এভাবে পেশ করা হবে। কিন্তু পরখ করে যার হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’
 আল্লাহ তা‘আালা ইরশাদ করেন,
﴿ ﻭَﻛُﻠُﻮﺍْ ﻭَﭐﺷۡﺮَﺑُﻮﺍْ ﺣَﺘَّﻰٰ ﻳَﺘَﺒَﻴَّﻦَ ﻟَﻜُﻢُ ﭐﻟۡﺨَﻴۡﻂُ ﭐﻟۡﺄَﺑۡﻴَﺾُ ﻣِﻦَ ﭐﻟۡﺨَﻴۡﻂِ ﭐﻟۡﺄَﺳۡﻮَﺩِ ﻣِﻦَ ﭐﻟۡﻔَﺠۡﺮِۖ ﴾ ‏[ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ : ١٨٧ ]
‘আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৭}
এই আয়াত নাযিল হবার পর আদী ইবন হাতেম রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহু একটি কালো সুতা ও
একটি সাদা সুতা নিয়ে বালিশের নীচে রাখলেন। রাত অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে তিনি সে দুটোকে বার বার দেখতে লাগলেন। কিন্ত কালো সাদার পার্থক্য ধরা পড়ল না। সকাল হলে তিনি বললেন,
ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻧِّﻰ ﺃَﺟْﻌَﻞُ ﺗَﺤْﺖَ ﻭِﺳَﺎﺩَﺗِﻰ ﻋِﻘَﺎﻟَﻴْﻦِ ﻋِﻘَﺎﻻً ﺃَﺑْﻴَﺾَ ﻭَﻋِﻘَﺎﻻً ﺃَﺳْﻮَﺩَ ﺃَﻋْﺮِﻑُ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﻬَﺎﺭِ ﻓَﻘَﺎﻝَ
ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ -ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – ‏« ﺇِﻥَّ ﻭِﺳَﺎﺩَﺗَﻚَ ﻟَﻌَﺮِﻳﺾٌ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻫُﻮَ ﺳَﻮَﺍﺩُ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞِ ﻭَﺑَﻴَﺎﺽُ ﺍﻟﻨَّﻬَﺎﺭِ ».
ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি কালো ও সাদা দুটি সুতো আমার বালিশের নীচে রেখেছিলাম। (তারপর সব ঘটনা বললেন।) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে তো দেখছি তোমার বালিশ বেজায় চওড়া! (কারণ রাতের কালো প্রান্তরেখা ও ভোরের সাদা প্রান্তরেখার
জন্য তোমার বালিশের নীচে স্থান সংকুলান হয়েছে।) আসলে এ দুটি সুতো নয় বরং রাতের অন্ধকার এবং দিনের আলো’।
 আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ ﻭَﭐﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳَﻜۡﻨِﺰُﻭﻥَ ﭐﻟﺬَّﻫَﺐَ ﻭَﭐﻟۡﻔِﻀَّﺔَ ﻭَﻟَﺎ ﻳُﻨﻔِﻘُﻮﻧَﻬَﺎ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﭐﻟﻠَّﻪِ ﻓَﺒَﺸِّﺮۡﻫُﻢ ﺑِﻌَﺬَﺍﺏٍ ﺃَﻟِﻴﻢٖ ٣٤ ﴾ ‏[ ﺍﻟﺘﻮﺑﺔ: ٣٤ ]
‘আর যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর
তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩৪}
এই আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম মনে করলেন কোনো ধন-সম্পদ জমা রাখা যাবে না, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« ﺇِﺫَﺍ ﺃَﺩَّﻳْﺖَ ﺯَﻛَﺎﺓَ ﻣَﺎﻟِﻚَ ﻓَﻘَﺪْ ﺃَﺫْﻫَﺒْﺖَ ﻋَﻨْﻚَ ﺷَﺮَّﻩُ ».
‘যদি তুমি তোমার মালের যাকাত আদায় কর তাহলে নিজ থেকে তার ক্ষতিকে তুমি দূর করে দিলে।’ খালেদ ইবন আসলাম বর্ণনা করেন, একদা আমরা আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুমার সঙ্গে বের হয়েছিলাম। তাঁর কাছে এক গ্রাম্য লোক ওপরের আয়াতটি উল্লেখ করে জানত চাইল এর ব্যাখ্যা কী? তিনি বললেন,
ﻣَﻦْ ﻛَﻨَﺰَﻫَﺎ ﻓَﻠَﻢْ ﻳُﺆَﺩِّ ﺯَﻛَﺎﺗَﻬَﺎ ﻓَﻮَﻳْﻞٌ ﻟَﻪُ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻫَﺬَﺍ ﻗَﺒْﻞَ ﺃَﻥْ ﺗُﻨْﺰَﻝَ ﺍﻟﺰَّﻛَﺎﺓُ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃُﻧْﺰِﻟَﺖْ ﺟَﻌَﻠَﻬَﺎ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻃُﻬْﺮًﺍ
ﻟِﻸَﻣْﻮَﺍﻝِ .
‘যে ব্যক্তি যাকাত আদায় না করে সম্পদ সঞ্চিত রাখবে তার ধ্বংস অনিবার্য। সম্পদ সঞ্চয় করলে এই শাস্তির বিধান ছিল যাকাত সংক্রান্ত আয়াত নাযিলের আগে। পরে যখন আল্লাহ তা‘আলা যাকাত ফরয ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেন, তখন তিনি যাকাতকে ধন-মালের পরিশুদ্ধকারী করে দিয়েছেন’।
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন,
ﻛُﻞُّ ﻣَﺎﻝٍ ﺃَﺩَّﻳْﺖَ ﺯَﻛَﺎﺗَﻪُ ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﺗَﺤْﺖَ ﺳَﺒْﻊِ ﺃَﺭْﺿِﻴْﻦَ ﻓَﻠَﻴْﺲَ ﺑِﻜَﻨْﺰٍ ﻭَﻛُﻞُّ ﻣَﺎﻝٍ ﻟَﺎ ﺗُﻮَﺩِّﻯ ﺯَﻛَﺎﺗَﻪُ ﻓَﻬُﻮَ ﻛَﻨْﺰٌ ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ
ﻇَﺎﻫِﺮًﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻪِ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ .
‘যে মালের যাকাত আদায় করা হয়, তা যদি যমীনের সাত স্তর নীচেও থাকে, তাহলেও ‘কানয’ তথা সঞ্চিত ধন-রত্নের মধ্যে গণ্য নয়। আর যে সম্পদের যাকাত আদায় করা হয় না, তা যদি যমীনের পিঠে খোলা থাকলেও ‘কানয’ তথা সঞ্চিত
ধন-রত্নের অন্তর্ভুক্ত।’ এ থেকে বুঝা গেল, যাকাত আদায়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা জমা রাখা গোনাহ নয়।
 আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ ﻭَﻟَﻘَﺪۡ ﺀَﺍﺗَﻴۡﻨَٰﻚَ ﺳَﺒۡﻌٗﺎ ﻣِّﻦَ ﭐﻟۡﻤَﺜَﺎﻧِﻲ ﻭَﭐﻟۡﻘُﺮۡﺀَﺍﻥَ ﭐﻟۡﻌَﻈِﻴﻢَ ٨٧ ﴾ ‏[ﺍﻟﺤﺠﺮ: ٨٧ ]
‘আর আমি তো তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত
সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৮৭}
এই আয়াতে ‘সাবয়ে মাছানী’ অর্থ যে সূরা ফাতেহা,
তা আমরা একমাত্র হাদীস থেকেই জানতে পারি।
এমনিভাবে কুরআন মাজীদের আরো অনেক আয়াত ও শব্দের অর্থ শুধুমাত্র হাদীস থেকেই জানা যায়। হাদীস ছাড়া তা জানার অন্য কোনো উপায় নেই। কুরআনী বিধান বাস্তবায়নে হাদীসের ভূমিকা বিকল্পহীন : যদিও কুরআন মাজীদে শরীয়তের মৌলিক বিধানাবলির বর্ণনা আছে। কিন্তু তা এত সংক্ষিপ্ত যে, শুধু কুরআনের ওপর ভিত্তি করে সেগুলির বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এরূপ অনেক
বিধি-বিধান রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ দু’একটি উল্লেখ করা যায় :
 ‘সালাত’ তথা নামায সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,
﴿ ﻭَﺃَﻗِﻴﻤُﻮﺍْ ﭐﻟﺼَّﻠَﻮٰﺓَ ﻭَﺀَﺍﺗُﻮﺍْ ﭐﻟﺰَّﻛَﻮٰﺓَ ﻭَﭐﺭۡﻛَﻌُﻮﺍْ ﻣَﻊَ ﭐﻟﺮَّٰﻛِﻌِﻴﻦَ ٤٣ ﴾ ‏[ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ: ٤٣ ]
‘আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪৩}
কিন্তু সালাতের ওয়াক্তসমূহ রাকাতের সংখ্যা, কেরা’তের তাফসীল, শর্তাদি, সালাত ভঙ্গের কারণসমূহ এবং সালাতের সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা জানতে হাদীসই ভরসা।
 কুরআন মাজীদে যাকাতের ব্যাপারে বলা হয়েছে,
﴿ ﻭَﺀَﺍﺗُﻮﺍْ ﭐﻟﺰَّﻛَﻮٰﺓَ ﴾ ‏[ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ: ٤٣ ]
‘এবং তোমরা যাকাত আদায় কর’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪৩}
কিন্তু যাকাত কী? এর নেছাব কত? কখন তা আদায় করতে হবে? কতটুকু আদায় করা জরুরী? ইত্যাদি শুধু হাদীস থেকেই আমরা জানি। হাদীস ছাড়া এসব জানার কোনো উপায় নেই।
 কুরআন মাজীদে সাওম বা রোযা সম্পর্কে বলা হয়েছে,
﴿ ﻳَٰٓﺄَﻳُّﻬَﺎ ﭐﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺀَﺍﻣَﻨُﻮﺍْ ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻴۡﻜُﻢُ ﭐﻟﺼِّﻴَﺎﻡُ ﻛَﻤَﺎ ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻰ ﭐﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻣِﻦ ﻗَﺒۡﻠِﻜُﻢۡ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢۡ ﺗَﺘَّﻘُﻮﻥَ ١٨٣ ﴾ ‏[ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ :
١٨٣]
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেযগার হতে পার’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৩}
কিন্তু সিয়াম ফরয হওয়ার জন্য শর্তাদি কী? সিয়াম ভঙ্গের কারণসমূহ কী? সিয়ামাবস্থায় কী কী বৈধ?
ইত্যাদি আরো অনেক বিধি-বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীস থেকেই পাওয়া যায়।
 কুরআন মাজীদে হজ্জ্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে,
﴿ ﻭَﻟِﻠَّﻪِ ﻋَﻠَﻰ ﭐﻟﻨَّﺎﺱِ ﺣِﺞُّ ﭐﻟۡﺒَﻴۡﺖِ ﻣَﻦِ ﭐﺳۡﺘَﻄَﺎﻉَ ﺇِﻟَﻴۡﻪِ ﺳَﺒِﻴﻠٗﺎۚ ﻭَﻣَﻦ ﻛَﻔَﺮَ ﻓَﺈِﻥَّ ﭐﻟﻠَّﻪَ ﻏَﻨِﻲٌّ ﻋَﻦِ ﭐﻟۡﻌَٰﻠَﻤِﻴﻦَ ٩٧ ﴾ ‏[ ﺍﻝ
ﻋﻤﺮﺍﻥ : ٩٧ ]
‘আর সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ্ব করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী। আর এ ঘরের হজ করা হ’ল
মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার’। {সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭}
কিন্তু জীবনে হজ কত বার ফরয? হজ্জের রুকুন কী? হজ আদায়ের সঠিক নিয়ম কী? ইত্যাদি হজ ও উমরা সম্পর্কীয় আরো অনেক বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীসেই রয়েছে।
 পানাহারের বস্তু সামগ্রীর কিছুকে হালাল ও অন্য কিছুকে হারাম ঘোষণা করে অবশিষ্ট বস্তুনিচয়
সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,
‘তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে’। অন্য স্থানে আছে ‘অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করা হয়েছে’। কিন্তু কোন বস্তু হালাল ও পবিত্র, আর কোনটি অপবিত্র ও হারাম, এসবের বিস্তারিত বর্ণনা আমরা জানতে পাই শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজ থেকেই।
 কুরআন মাজীদে চুরি করার শাস্তি বলা হয়েছে ‘হাত কেটে ফেলা। কিন্তু কী পরিমাণ মাল চুরি করলে? এবং কতটুকু হাত কাটা হবে? ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীসেই আমরা পেয়ে থাকি।
 কুরআন মাজীদে মদপান হারাম বলা হয়েছে। কিন্তু সকল মাদকদ্রব্যের বিধান কী হবে? নেশাযুক্ত বস্তু পরিমাণে কমবেশি হলে কী বিধান হবে? ইত্যাদি মদ সংক্রান্ত অনেক বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু
হাদীসে পাওয়া যায়।
 কুরআন মাজীদে মহিলাদের মীরাছ সম্পর্কে বলা হয়েছে, একজন হলে সে অর্ধেক সম্পত্তি পাবে, আর যদি দুয়ের অধিক হয়, তখন দুই তৃতীয়াংশ পাবে। কিন্তু দুজন হলে কতটুকু পাবে তা আর কুরআনে নেই, তা শুধু হাদীসেই পাওয়া যায়।
এছাড়া মীরাছ সম্পর্কিত আরো অনেক বিধান আমরা শুধু হাদীস থেকেই নিই।
 কুরআন মাজীদে সুদকে কঠোরভাবে নিষেধ করে একে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন ধরনের লেনদেন সুদের অন্তর্ভুক্ত আর কোনটি নয়- এসব
ব্যাপারে হাদীসেই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এমনিভাবে শরীয়তের আরো অনেক বিধি-বিধান
রয়েছে যেগুলি সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সংক্ষিপ্ত
আলোকপাত করা হয়েছে। অথচ হাদীসেই পাওয়া যায় তার বিস্তারিত বিবরণ। এমতাবস্থায় যে বা যারাই হাদীসকে বাদ দিয়ে কুরআন বুঝার
বা কুরআনী বিধানাবলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে,
তারা যে স্পষ্ট গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট, তা বলার
অপেক্ষা রাখে না।কেন নয়, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেসব দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন তার অন্যতম ছিল মানুষকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং তার বক্তব্য তাদের কাছে সুস্পষ্ট করে দেওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ ﻛَﻤَﺎٓ ﺃَﺭۡﺳَﻠۡﻨَﺎ ﻓِﻴﻜُﻢۡ ﺭَﺳُﻮﻟٗﺎ ﻣِّﻨﻜُﻢۡ ﻳَﺘۡﻠُﻮﺍْ ﻋَﻠَﻴۡﻜُﻢۡ ﺀَﺍﻳَٰﺘِﻨَﺎ ﻭَﻳُﺰَﻛِّﻴﻜُﻢۡ ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻜُﻢُ ﭐﻟۡﻜِﺘَٰﺐَ ﻭَﭐﻟۡﺤِﻜۡﻤَﺔَ ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻜُﻢ ﻣَّﺎ ﻟَﻢۡ
ﺗَﻜُﻮﻧُﻮﺍْ ﺗَﻌۡﻠَﻤُﻮﻥَ ١٥١ ﴾ ‏[ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ : ١٥١ ]
‘যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমারআয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্রকরে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদের শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।’ {সূরা আল- বাকারা, আয়াত : ১৫১}
Top