জুমার খুতবা
###########

২য় জুমা, রমযান ১৪৩৮ হি: জুন ২০১৭সাল

বিষয়: রমযান মাস ও রোযার ফযিলত-২

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী

খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। #
بسم الله الرحمن الرحيم. نحمده ونصلى ونسلم على رسوله الكريم وعلى آله وصحبه أجمعين.
◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊◊
দান-সদকার মাস:

এ মাসটি ধনী এবং আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপনকারীদের জন্যও বিরাট সুযোগ। রমযান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। তাদের কাজ-কর্ম এবং অনুভূতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য, তারা যেন দরিদ্রদের প্রয়োজন ও ব্যথা অনুভব করতে পারে। নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। আল্লাহ যে পথে ব্যয় করতে সম্পদ দিয়েছেন সে পথে তারা সম্পদ ব্যয় করতে পারে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত আছে তাদের বাঁচাতে তারা যেন এগিয়ে আসতে পারে। তারা যদি তাদের ক্ষুধার্তদেরকে না খাওয়ায়, বস্ত্রহীনদেরকে বস্ত্র না দেয় আর দুর্বলদেরকে সাহায্য না করে মনে করতে হবে তাদের ঈমান বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে। মহানবীর ভাষায়, ‘সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে মাস মাহে রমযান’ (বায়হাকি)।

কেননা ধনী ও বিত্তশালীরা সারা দিন রোযা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুধার জ্বালার দহন-বেদনা বুঝতে সক্ষম হন, ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। এ মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানের কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমযানে যখন তিনি জিবরীলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন, তিনি ছিলেন প্রবাহমান বাতাসের চেয়েও অধিক বদান্য। (বুখারী মুসলিম)

ইমাম শাফেয়ি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে তার উম্মতের জন্য উত্তম কাজ হল রমযান মাসে তারা বেশি করে দান-সদকা করবে। কারণ এ মাসে মানুষের প্রয়োজন বেশি থাকে। অপরদিকে রমযান হল জিহাদের মাস। তাই প্রত্যেকের উচিত অর্থ-সম্পদ দান করার মাধ্যমে জিহাদে অংশ নেয়া ও রমযান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে আয়েশা, অভাবগ্রস্ত মানুষকে ফেরত দিয়ো না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলেও দান করো। দরিদ্র মানুষকে ভালোবেসে কাছে টানো। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে কাছে টানবেন।

রোযাদারদের ইফতার করানো:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:“যে ব্যক্তি কোন সিয়াম পালনকারীকে (রোযাদারকে) ইফতার করাবে সে সিয়াম পালনকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তাতে সিয়াম পালনকারীর সওয়াব বিন্দুমাত্র কমে যাবে না।’ ( আহমদ) হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন: আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, আমি তাকে ভালবাসি। যখন আমি তাকে ভালবাসি সে আমার কান হয়ে যায় যা দিয়ে সে শোনে। আমার চক্ষু হয়ে যায় যা দিয়ে সে দেখে। হাত হয়ে যায় যা দিয়ে সে ধরে। পা হয়ে যায় যা দিয় সে চলে। (বুখারী)।

মজুদদার অভিশপ্ত:

রমযান মাস এলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। এটা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, “মজুদদার অভিশপ্ত।’ এটি শুধুই অমানবিক নয়, রীতিমত হিংস্রতাও। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে কঠোর সতর্কতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, “কেউ যদি কৃত্রিম উপায়ে অর্থাৎ খাদ্য গুদামজাত করে সঙ্কট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ দেবেন কিংবা একদিন না একদিন তাকে অবশ্যই গরিব বানাবেন।’ অতএব ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। দাম বাড়ানোর কারণে যেন কোনো রোযাদার কষ্ট না পান, নিজেরাও যাতে হালাল উপার্জনে রোযা পালন করতে পারেন।


সিয়াম আগুন ও প্রবৃত্তির তাড়না থেকে রক্ষাকারী ঢাল:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “সিয়াম প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বাঁচার জন্য ঢাল, এর মাধ্যমে বান্দা আগুন থেকে মুক্তি পায়।(আহমাদ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: “হে যুবকেরা! যে সামর্থ রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা দৃষ্টিকে সংরক্ষণ করে এবং যৌনাঙ্গের হিফাযত করে। যে বিবাহের সামর্থ রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা এটি তার জন্য সুরক্ষা। (বুখারী মুসলিম)।

সিয়াম জান্নাতের পথ:

ইমাম নাসাঈ রহ. আবু উমামা রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে এমন বিষয়ের নির্দেশ দেন যার মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে প্রতিদান দেবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি অসাল্লাম বলেন:তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর কোন তুলনা নেই। (নাসাঈ)

জান্নাতে একটি দরজা আছে সেখান দিয়ে শুধু সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়ান। কিয়ামত দিবসে সেখান দিয়ে সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সে দরজা দিয়ে অন্য কেহ প্রবেশ করবে না। বলা হবে: সিয়াম পলনকারী কোথায়? তারা দাঁড়াবে, তারা ছাড়া আর কেহ প্রবেশ করবে না। তারা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেহ সে স্থান দিয়ে প্রবেশ করবে না। (বুখারী মুসলিম)।

সিয়াম ও আল-কোরআন কিয়ামত দিবসে সুপারিশকারী:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: সিয়াম এবং কোরআন বান্দার জন্য কিয়ামত দিবসে সুপারিশকারী হবে, সিয়াম বলবে, হে প্রভু আমি তাকে দিনের বেলায় খাওয়া এবং প্রবৃত্তির তাড়না থেকে নিবৃত্ত রেখেছি, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তাআলা বলবেন: তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হল। (আহমদ) প্রতি বছর রমযান মাসে জিবরাইল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পূর্ণ কোরআন শোনাতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও তাকে পূর্ণ কোরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমযানে আল্লাহর রাসূল দু বার পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহি মুসলিমের হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত।

সিয়াম গুনাহের ক্ষমা এবং কাফফারা হিসাবে গৃহিত হয়:

কেননা ভাল কাজ অন্যায়কে মুছে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: যে রমযানে ঈমান এবং এহতেসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (বুখারী মুসলিম) যে ব্যক্তি রমযান মাস পেয়েও তার পাপসমূহ ক্ষমা করানো থেকে বঞ্চিত হলো আল্লাহর রাসূল তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যার কাছে রমযান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি। (তিরমিযি) সত্যিই সে প্রকৃত পক্ষে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত যে এ মাসেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল।

সিয়াম ইহকাল এবং পরকালের সৌভাগ্যের কারণ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: সিয়াম পালনকারীর দুটি খুশি, প্রথম খুশি যখন সে ইফতার করে, আর এক খুশি যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশক আম্বরের চেয়ে অধিক প্রিয়। (বুখারী মুসলিম)

এ মাসের বরকত:

এ মাসের অন্যতম বরকত হল ভাল কাজের প্রতিদান অনেক বেড়ে যায়। যেমন, রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেন: যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমযানের রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (বুখারী) মুসলিম)

সিয়াম পালনকারীর জন্য সাহরী খাওয়া উত্তম: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন: সাহরী বরকতের খাবার। তা খাওয়া থেকে বিরত হবে না। কেহ যদি এক ঢোক পানিও পান করে তবুও সে সাহরী খেল। কেননা আল্লাহ তাআলা এবং ফেরেশতাগণ সাহরীতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করতে থাকেন। (আহমাদ)

ইফতার তাড়াতাড়ি করা এবং দোয়া করা:

ইমাম তিরমিযি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ তাআলা ফেরৎ দেন না: ন্যায়পরায়ণ শাষক, সিয়াম পালনকারী যখন ইফতার করে ও অত্যাচারিতের দোয়া। (তিরমিযি)

রমযান জাহান্নাম থেকে মুক্তির লাভের মাস:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে ঘোষণা দিতে থাকে যে, হে সৎকর্মের অনুসন্ধানকারী তুমি অগ্রসর হও ! হে অসৎ কাজের অনুসন্ধানকারী তুমি থেমে যাও ! এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। (তিরমিযি)

এতেকাফ:

ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন।” ( মুসলিম)। এতেকাফ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরি বলেন, আশ্চর্যজনক হল মুসলমানরা এতেকাফ পরিত্যাগ করে অথচ রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত কখনো এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি।

দোয়া-প্রার্থনা করা:

আল্লাহ রাব্বুল সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন: “আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই।’ (সূরা আল-বাকারা : ১৮৬)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: রমযান মাসে প্রত্যেক মুসলিমের দোয়া কবুল করা হয়। (মুসনাদ আহমদ) অন্য হাদিসে এসেছে – আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমযানের প্রতি রাতে ও দিনে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন এবং প্রতি রাত ও দিবসে মুসলিমের দোয়া-প্রার্থনা কবুল করা হয়। (সহি আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব) তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া-প্রার্থনা করবে।

তওবা করার মাস:

সর্বদা তওবা করা ওয়াজিব। বিশেষ করে এ মাসে তো বটেই। এ মাসে তওবার অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নাম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া রমযান মাসের সকল ইবাদত বন্দেগি তওবার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি রমযান মাস পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক।” (তিরমিযি) তাই রমযান মাসটাকে তওবা ও ক্ষমা পাওয়ার মাস হিসেবে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه اجمعين.

Top