শাহাদাতে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু
***********************************************
মুহাররম, ১৪৩৯ হিজরি. অক্টোবর-২০১৭.
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ. খতীব, মুসাফির খানা জামে মসজিদ, নন্দন কানন, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين, أما بعد!
১০ মুহররম নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাথীদের ৭২ জন সদস্যের মহান শাহাদাত দিবস। ৬১ হিজরির এই দিনে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ৫৭ বছর বয়সে তাঁর নানাজান মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত প্রকৃত ইসলামকে রক্ষা করতে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরিচিতি:
———————————————————
সাইয়েদুশ-শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ৬২৫ খৃস্টাব্দে চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের ৫ তারিখে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার (৬০৫-৬৩৩) গর্ভে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন তাঁর পিতা। জন্মের পর সরকারে মদিনা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কানে আযান দিয়ে দ’ুআ করেছিলেন, এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু’নামের প্রচলন ছিল না। মাতামহ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হোসাইনকে অপরিসীম স্নেহ করতেন। আপন সন্তান থেকেও তিনি তাঁদেরকে অধিক ভালবাসতেন, তাঁদেরকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘রায়হানাতা রাসূলিল্লাহ’ বা ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই ফুল’। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা যে বিশেষ বিশেষ মুআ’মালা করেছেন এবং তাঁকে দুনিয়ার সর্বোত্তম যে সব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে এই দুটি ফুলেরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ সুমহান চরিত্রের অধিকারী, জ্ঞান গভীর, অভিজ্ঞ ও খোদাপ্রেমিক সুশিক্ষিত হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর নয়নমনি হযরত ইমাম হাসান-হোসাইনকে নিজে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের সুসংবাদ:
———————————————————-
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্মের সাথে সাথে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদৌলতে তাঁর শাহাদাতের কথা সবার কাছে জানাজানি হয়ে যায়। হযরত আলী, হযরত ফাতিমাতুয যাহরাসহ অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বাইতের সংশ্লিষ্ট সকলেই হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শৈশবাবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, এ ছেলেকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং কারবালার ময়দান তাঁর রক্তে রঞ্জিত হবে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে । বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাত সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকবার ভবিষ্যদ্বানী করেছেন । ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শৈশবকালেই এটা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হযরত উম্মুল ফদল বিনতে হারেস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, “আমি একদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার খিদমতে উপস্থিত হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, এর কারণ কী? ইরশাদ করলেন, আমার কাছে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে এ খবর দিয়ে গেলেন ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।’ হযরত উম্মুল ফদল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! এ শিশুকে শহীদ করবে? হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,‘হ্যাঁ। হযরত জিব্রীল আলাইহিস সালাম শাহাদাত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন। “আমার ছেলে (দৌহিত্র) হযরত ইমাম হুসাইনকে ফোরাত নদীর তীরে যে জায়গায় শহীদ করা হবে, সে জায়গার নাম কারবালা।”(হাকেম, ৩/১১৬-১১৭)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রানপ্রিয় দৌহিত্রের শাহাদত হওয়ার খবর পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন বটে কিন্তু রক্ষা করার জন্য খোদার দরবারে দুয়া করেননি বরং হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যেন এ মহা পরীক্ষায় ধৈর্য ও সবরের সাথে কামিয়াব হয়ে আল্লাহ্র দরবারে উচ্চস্থান লাভ করেন এ দোয়া করেছেন।
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কারবালার তৃষ্ণার্ত রক্তাক্ত প্রান্তরে এজিদের হুকুমে ইবনে জিয়াদের নির্দেশে আনাস ইবনে নাখই ওরফে সীমর শহীদ করেছে । কেবল কি ইমামে আকবর? না, অনেক আপন জনও শহীদ হয়েছেন । তার মধ্যে ইমামে আকবরের বড় ছেলে ইমাম আলী আকবর, ছয় মাসের দুধের শিশু ইমাম আলী আসগর, ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে ইমাম কাসেম এবং ইমামে আকবের ভাই ইমাম আব্বাস এবং ইমাম আউন ও আরো অনেকে ।
কারবালার পটভ’মি:
———————-
ইয়াজিদ ২৫-২৬ হিজরির দিকে জন্মগ্রহণ করে প্রায় ৩৫ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হয়্। ইয়াজিদের চরিত্র ইসলামসম্মত ছিলনা। তার চরিত্রে মদ্যপান, নামায তরক করা, নাচ-গান এবং নারী কেলেঙ্কারিতে লিপ্ত হওয়ার কলঙ্ক লেগে আছে। কোনো রাজা বাদশাহর ছেলের চরিত্রে যদি এত সব অনৈতিকতা থাকে তাহলে তার স্বভাবে ক্ষমতার লোভ থাকা এবং ক্ষমতার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। ইতিহাস থেকে সে প্রমাণই পাওয়া যায়। ইয়াজিদের অবস্থাও তাই ।
৬০ হিজরীতে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইন্তিকাল কনেন, ইন্তিকালের পর এজিদ শাসন ক্ষমতা হাতে নেয় এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ইয়াযিদ ইসলামের সনাতন সংস্কৃতিকে বদলে দিয়ে বাদশাহী কায়দায় সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায়ই সে নিজেকে মুসলমানদের খলিফা ঘোষণা করে ও ঈমানদারদের বাইআত দাবি করে। ইয়াযিদ তার পথকে নিষ্কণ্টক করার জন্য লোভ ও হুমকি প্রদান করে একে একে মক্কা ও মদীনার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পদানত করে সর্বশেষে ইমাম হোসাইনের দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতো একজন ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই ইয়াযিদের মতো একজন মানুষের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে পারেননা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুযোগ্য উত্তরাধিকার হোসাইন তাঁর ইমামতের প্রজ্ঞায় সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট এক কালজয়ী পথ রচনা করেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ন্যায়ের প্রতিভূ ইমাম হোসাইন ও অন্যায়ের প্রতিভূ ইয়াযিদ,এ দু’য়ের কারও পথ ও কর্মকৌশলে লক্ষ্যহীন ও অপরিকল্পিত ছিল না। জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইনের প্রতিপক্ষ ইয়াযিদ শুধু শক্তিবলেই বলশালী ছিল না; বরং উত্তরাধীকার সূত্রে তার পক্ষে ছিল উমাইয়াদের কূটকৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও সমগ্র অপকৌশলের এক সমন্বিত অস্ত্রমালা। তার সেসকল অস্ত্রের কোনটিই সে প্রয়োগ করতে বাদ রাখনি।
এজিদের ঔদ্ধত্য ইমাম হোসাইনকে স্থির থাকতে দিল না। মুসলিম জনগণও ইয়াজিদের শাসন ক্ষমতা প্রাপ্তিতে বিচলিত হয়ে উঠলো। এই সংকটময় মুহূর্তে এজিদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে নিজের নিরাপত্তা চাইলে ইসলামের আদর্শকে বিসর্জন দিতে হয়। আর ইসলামের কল্যাণ চাইলে এজিদের শাসনকে অস্বীকার করতে হয়। ইমাম হোসাইন এই উভয় সংকটে পড়ে শেষোক্ত ত্যাগের পথই বেছে নিলেন। আর এরই শেষ পরিণতি হিসেবে (৬১ হিঃ ১০ই মুহাররম-মোতাবেক ৬৮০ খৃঃ) কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। অন্যথায় শুধু ইসলামই আপন সত্তা হারাতো না, নবী বংশসহ দুনিয়ার সকল মুসলমান কলঙ্কিত হতো এবং শাহাদাতে কারবালার প্রেরণা নিয়ে যুগে যুগে যেসব ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, তাও হতো কি না সন্দেহ।
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাত :
———————————————————–
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবা কেরাম মতামতের ভিত্তিতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খলিফা নির্বাচিত হন। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে মনোনীত করে যাননি। এরপর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সাহাবাদের পরামর্শ নিয়ে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করেন। যিনি তার বংশের কেউ ছিলেন না। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ গঠন করে দিয়েছিলেন। যেখানে তাঁর কোনো আত্মীয় ছিল না। মদিনার মুসলমানদের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত ওসমানের পর খলিফার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, যা ছিল মুসলিম রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার এবং খলিফা নির্বাচনের ইসলামী নিয়ম।
হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যিনি সিরিয়ায় হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর প্রতিনিধি ও আমীর ছিলেন, তিনি পরবর্তী পর্যায়ে ৬০ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছর আমীর মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইসলামী জাহান শাসন করেন। পিতার ইন্তিকালের পর ৬০ হিজরিতে এজিদ দামেস্ক কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফার পদে বসে। চরিত্রগতভাবে ইয়াজিদ দুষ্ট চরিত্রের হওয়ায় নবী পরিবার ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং মদিনার মুসলমানেরা ইয়াজিদকে খলিফা মেনে নিতে রাজি হননি। এই কারণেই এবং আগামীতে বেনামাজি, নাচ-গানকারী চরিত্রহীন লোকদেরকে মুসলামনেরা যেন নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ না করে, প্রিয়নবী এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত রক্ষা করার শিক্ষা পায়, তাই ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সপরিবারে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদতবরণ করেন; কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে রাজি হননি ।
ইয়াযীদ রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই মদীনার গভর্ণরের কাছে পত্র লিখে, যাতে তার পক্ষে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বাইয়াত আদায় করা হয়। উদ্দেশ্য ইমামকে ইয়াযিদের কাছে বাইআত হতে বাধ্য করা। আর তার পরই গোটা উম্মাহর মাঝে প্রচার করা হবে যে, মহানবীর দৌহিত্র হোসাইনও ইয়াযিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। রাসূলে খোদার নাতি হয়ে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একজন অপদার্থ ও ইসলামী শরীয়তের রীতিনীতির প্রতি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণকারীর হাতে বায়আত বা আনুগত্যের শপথ নিতে পারেন না। তাই রাতের অন্ধকারে তিনি মদীনা থেকে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন হিজরি ৬০ সালের রজব মাসে। এজিদের প্রতি বিদ্রোহী ছিল কুফার জনগণের মন। কুফা বর্তমান ইরাকের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যখন মদীনায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সপরিবারে কুফায় চলে যান। কারণ, কুফার লোকেরা ছিল হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সমর্থক ও অনুরক্ত। ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খেলাফতের দাবি ত্যাগ ও পরে বিষপ্রয়োগে শাহাদত বরণ করলে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আহলে বায়তের সদস্যদের নিয়ে মদীনায় চলে আসেন। কাজেই কুফার লোকেরা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পূর্ব পরিচিত ছিল এবং কুফাবাসীও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ভালোভাবে চিনত। এজিদ দামেস্কে খেলাফতের মসনদে বসার পর হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মক্কায় চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুফার গণ্যমান্য লোকেরা একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে হোসাইনের কাছে। সবার বক্তব্য ছিল, আমরা কিছুতেই এজিদের মতো অপদার্থের হাতে বায়আত নেব না। আপনি আমাদের মাঝে চলে আসুন আমরা আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করে প্রয়োজনে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। রজব, শাবান, রমযান, শাওয়াল, জিলকদ এই পাঁচ মাস হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বিষয়টি নিয়ে চিন্তা, ভাবনা করেন, সবার সাথে পরামর্শ করেন। অধিকাংশ লোকের পরামর্শ ছিল কুফার লোকেরা বিশ^াসঘাতক, কাজেই আপনি যাবেন না। তিনি দেখেন যে, এজিদ নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে মক্কা আক্রমণ করবে। তখন কাবাঘর ও মক্কা নগরীর পবিত্রতা লুণ্ঠিত হবে। ‘আমার কারণে মক্কার অমর্যাদা হোক’ তা হোসাইন সহ্য করতে পারেন না। তাই সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন কুফায় যাবেন। তিনি মাহে রমযান ও হজের মওসুমে মানুষকে ইসলামী খেলাফত বিপথগামী হওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। ওদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকীল রিপোর্ট দেন, এ পর্যন্ত কুফার ১৮ হাজার মানুষ আপনার পক্ষে আমার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন। ইসলামী খেলাফতের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রার যে দিনটি নির্ধারণ করেন তা ছিল ৮ই যিলহজ¦, যেদিন হাজীরা ইহরাম পরে মক্কা থেকে মিনা ও আরাফাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঐদিনই তিনি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে জানতে পারেন কুফাবাসী বিশ^াসঘাতকতা করেছে। নতুন গভর্নর ইবনে যিয়াদের ষড়যন্ত্রের শরীক হয়ে মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যা করেছে।
ইমাম অগ্রসর হতে লাগলেন, কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই হুর ইবনে এজিদের নেতৃত্বে কুফার গভর্ণরের প্রেরিত বাহিনী অন্য কোথাও যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় এবং কারবালা প্রান্তরে উপনীত হতে বাধ্য করে। ইতিহাসের বিম্ময়কর তথ্য হল, পথিমধ্যে নামাযের সময় হলে পথরোধকারীরাও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইমামতিতে নামায পড়ে। নামায শেষ হলে আবার তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এভাবে কুফার সামরিক অধিনায়ক হুর ইবনে এজিদ হিজরি নববর্ষ ৬১ সালের মহররম মাসে ইমাম ও তার পরিবারকে কারবালায় গিয়ে শিবির স্থাপনে বাধ্য করে। কুফার গভর্নর দামেস্ক অধিপতি এজিদের নির্দেশে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ২২ হাজার বা ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে। সে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে মুহাম্মদ ইবনে সাদকে। তিনি ছিলেন কাদেসিয়া বিজয়ী হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ছেলে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে সেই অঞ্চলের শাসকের পদ প্রদানের লোভ দেখিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠায়। দুনিয়ার সামান্য স্বর্থের লোভে তিনি এতবড় ঝুঁকি মাথায় নেন। শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে শান্তি স্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইমাম শিবিরের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। চরম মুহূর্তে সেনাপতি হুর ইবনে এজিদ ইমামের শিবিরে পালিয়ে আসে এবং পরে ইমামের পক্ষ নিয়ে বীর-বিক্রমে লড়াই করে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন। যা প্রমাণ করে ইমাম ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আর এজিদ ও ইবনে যিয়াদের বাহিনী যুদ্ধ করেছিল মিথ্যার পক্ষে।
পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর সাথে বহুবার বৈঠক ও মতবিনিময় করে শান্তি স্থাপন ও যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আশুরার আগের রাতে সঙ্গীদের ডেকে অন্ধকারের ঢাল ব্যবহার করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ শাহাদাত আসন্ন জেনেও ইমামকে ছেড়ে যেতে তারা কেউ রাজি হয়নি। আশুরার দিন তিনি সেনাপতির ন্যায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধের ব্যুহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথী যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসূলে পাকের অদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বুঝা যাবে, ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
ইয়াযিদ সম্পর্কে আমাদের অভিমত:
————————————-
বিদ্বেষী শ্রেণীটি ইবনে যিয়াদের উপর দোষ চাপিয়ে এজিদকে ভারমুক্ত করার জন্যও এক ধরনের প্রচারণা চালায়। অথচ ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সামান্য লেখাপড়া আছে তারাও জানে যে, এজিদ ক্ষমতায় আরোহণের পর প্রথম বছর কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটায়। দ্বিতীয় বছর মদীনা আক্রমণ করে তিনদিন পর্যন্ত মসজিদে নববীকে যোদ্ধাদের ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে। আর তৃতীয় বছর যখন কাবা ঘরে আশ্রিত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে হত্যার জন্য সিরীয় সৈন্যরা কাবাঘর লক্ষ করে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছিল তখনই দামেস্ক থেকে এজিদের মৃত্যুর সংবাদ আসে এবং তারা ফিরে যায়। কাজেই এমন পাপাচারীর পক্ষ নেয়ার সুযোগ কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের নেই। ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কারবালা প্রান্তরে অসহায়ভাবে শহীদ হয়েছিলেন আর দৃশ্যত এজিদ বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সেদিন বিজয়ী হয়েছিলেন। যার কারণে বিশে^র ঘরে ঘরে আজ হাসান ও হোসাইন নামের এত আদর ও কদর। পক্ষান্তরে কোনো মানুষই নিজের সন্তানের নাম এজিদ রাখতে রাজি নয়। ইতিহাস বলে, কুফাবাসী তাদের বিশ^াসঘাতকতার চরম প্রায়শ্চিত্ব ভোগ করেছিল পরবর্তী মুখতারের আন্দোলনে। কারাবালায় অংশগ্রহণকারীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল। রাসূলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এতবড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা।
কারবালার শিক্ষা:
——————–
যুগে যুগে সত্যাশ্রয়ী ও নীতিনিষ্ঠদের ভূমিকা একই ছিল। তারা যে মত ও পথকে সত্য জ্ঞান করেছেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই নীতি, মত ও পথের উপর অবিচল থেকেছেন। নীতির প্রশ্নে তারা যেমন কারও সঙ্গে আপোষ করতেন না, তেমনি কে বা কারা এবং কত সংখ্যক লোক তাদের সঙ্গে রয়েছে, সে দিকেও ভ্রূক্ষেপ করতেন না। আর এমনিভাবে একদিন দেখা যায়, কোনো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যেখানে মুষ্টিমেয় লোক কাজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজের শত বাধা উপেক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, পরবর্তী পর্যায়ে সেখানে গোটা সমাজ তাদের আদর্শের পতাকা হাতে এগিয়ে এসেছে। শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইনের সংগ্রামী জীবনেও আমরা এ সত্যের অভিব্যক্তি দেখতে পাই। তিনিই প্রথম ত্যাগী পুরুষ, যিনি মানুষের জন্যে নির্ধারিত ইসলামের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের এবং অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। সত্যের ঝান্ডাকে উঁচু করে রাখার সংগ্রামে শত্রুশক্তির বিপুলসংখ্যাধিক্য, হামলার প্রচন্ডতা ও নির্মমতা তাঁকে এতটুকু নত করতে পারেনি। নিজের এবং প্রাণপ্রিয় মাসুম সন্তানদের বুকের রক্ত দিয়ে তিনি একথা প্রমাণ করে গেছেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে তার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখার প্রশ্নে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে কোনো মুসলমানের পক্ষে নিজের ও প্রাণপ্রিয় সন্তানদের জীবনাহুতির বিষয়টি অতি তুচ্ছ। কারণ, এরি মাধ্যমে প্রমাণিত হয় খোদাপ্রীতির প্রকৃত স্বরূপ।
স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সত্যের পতাকা নিয়ে রুখে না দাঁড়ালে, মানুষ মুলত অনাগত দিনগুলোতে অত্যাচারীর সামনে হক কথা বলার সাহসী কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাবে না। মুলত একটি প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রবল ও জনবল শূন্য অবস্থায় কথা বলার পরিণতি কি হতে পারে, সংগ্রামী ইমাম তা ভাল করেই অনুধাবন করেছিলেন। এজন্যেই শুধু একটি বাক্য- ‘ইয়াজীদের আনুগত্য করি’ এই বলে কাপুরুষতা দেখাননি, দেখিয়েছেন ঈমানের প্রদীপ্ত শিখা। এছাড়া হোসাইন পরিবারের উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এমন কোনো মহল একথা বলতে পারবে না যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কর্তৃত্ব হাসিলের জন্য তিনি এ পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুও শতভাগ সঠিক পদক্ষেপ নিলেন। কারণ, সেটিই ছিল তাঁর করণীয়া। তিনি তা না করলে কেয়ামত পর্যন্ত বিচ্যুত শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে থাকতো না। এজন্যই হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এই দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে যে, না, সবাই চোখবন্ধ আনুগত্য করবে না। বরং কিছু লোকের এমনও হওয়া উচিত যে, এ দুঃসহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরোয়াহীনভাবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে যেসব সংস্কারবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যেসব বৈপ্লবিক প্রয়াস উচ্চকিত হয়েছে, সেসব ক’টিরই পেছনে হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর স্থাপিত দৃষ্টান্ত ভূমিকা রেখেছে। তারা ওই দৃষ্টান্ত থেকে অনুধাবন করেছেন, এ জাতীয় প্রতিরোধ শিশুসুলভ কোনো চাঞ্চল্য নয়, নয় কোনো উত্তেজক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অস্থিরতা। বরং এটি হচ্ছে হোসাইনী সুন্নত। হযরত হোসাইনের আদর্শ-নীতি।
***********************************************
মুহাররম, ১৪৩৯ হিজরি. অক্টোবর-২০১৭.
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ. খতীব, মুসাফির খানা জামে মসজিদ, নন্দন কানন, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين, أما بعد!
১০ মুহররম নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাথীদের ৭২ জন সদস্যের মহান শাহাদাত দিবস। ৬১ হিজরির এই দিনে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ৫৭ বছর বয়সে তাঁর নানাজান মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত প্রকৃত ইসলামকে রক্ষা করতে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরিচিতি:
———————————————————
সাইয়েদুশ-শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ৬২৫ খৃস্টাব্দে চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের ৫ তারিখে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার (৬০৫-৬৩৩) গর্ভে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন তাঁর পিতা। জন্মের পর সরকারে মদিনা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কানে আযান দিয়ে দ’ুআ করেছিলেন, এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু’নামের প্রচলন ছিল না। মাতামহ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হোসাইনকে অপরিসীম স্নেহ করতেন। আপন সন্তান থেকেও তিনি তাঁদেরকে অধিক ভালবাসতেন, তাঁদেরকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘রায়হানাতা রাসূলিল্লাহ’ বা ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই ফুল’। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা যে বিশেষ বিশেষ মুআ’মালা করেছেন এবং তাঁকে দুনিয়ার সর্বোত্তম যে সব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে এই দুটি ফুলেরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ সুমহান চরিত্রের অধিকারী, জ্ঞান গভীর, অভিজ্ঞ ও খোদাপ্রেমিক সুশিক্ষিত হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর নয়নমনি হযরত ইমাম হাসান-হোসাইনকে নিজে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের সুসংবাদ:
———————————————————-
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্মের সাথে সাথে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদৌলতে তাঁর শাহাদাতের কথা সবার কাছে জানাজানি হয়ে যায়। হযরত আলী, হযরত ফাতিমাতুয যাহরাসহ অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বাইতের সংশ্লিষ্ট সকলেই হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শৈশবাবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, এ ছেলেকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং কারবালার ময়দান তাঁর রক্তে রঞ্জিত হবে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে । বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাত সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকবার ভবিষ্যদ্বানী করেছেন । ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শৈশবকালেই এটা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হযরত উম্মুল ফদল বিনতে হারেস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, “আমি একদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার খিদমতে উপস্থিত হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, এর কারণ কী? ইরশাদ করলেন, আমার কাছে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে এ খবর দিয়ে গেলেন ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।’ হযরত উম্মুল ফদল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! এ শিশুকে শহীদ করবে? হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,‘হ্যাঁ। হযরত জিব্রীল আলাইহিস সালাম শাহাদাত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন। “আমার ছেলে (দৌহিত্র) হযরত ইমাম হুসাইনকে ফোরাত নদীর তীরে যে জায়গায় শহীদ করা হবে, সে জায়গার নাম কারবালা।”(হাকেম, ৩/১১৬-১১৭)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রানপ্রিয় দৌহিত্রের শাহাদত হওয়ার খবর পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন বটে কিন্তু রক্ষা করার জন্য খোদার দরবারে দুয়া করেননি বরং হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যেন এ মহা পরীক্ষায় ধৈর্য ও সবরের সাথে কামিয়াব হয়ে আল্লাহ্র দরবারে উচ্চস্থান লাভ করেন এ দোয়া করেছেন।
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কারবালার তৃষ্ণার্ত রক্তাক্ত প্রান্তরে এজিদের হুকুমে ইবনে জিয়াদের নির্দেশে আনাস ইবনে নাখই ওরফে সীমর শহীদ করেছে । কেবল কি ইমামে আকবর? না, অনেক আপন জনও শহীদ হয়েছেন । তার মধ্যে ইমামে আকবরের বড় ছেলে ইমাম আলী আকবর, ছয় মাসের দুধের শিশু ইমাম আলী আসগর, ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে ইমাম কাসেম এবং ইমামে আকবের ভাই ইমাম আব্বাস এবং ইমাম আউন ও আরো অনেকে ।
কারবালার পটভ’মি:
———————-
ইয়াজিদ ২৫-২৬ হিজরির দিকে জন্মগ্রহণ করে প্রায় ৩৫ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হয়্। ইয়াজিদের চরিত্র ইসলামসম্মত ছিলনা। তার চরিত্রে মদ্যপান, নামায তরক করা, নাচ-গান এবং নারী কেলেঙ্কারিতে লিপ্ত হওয়ার কলঙ্ক লেগে আছে। কোনো রাজা বাদশাহর ছেলের চরিত্রে যদি এত সব অনৈতিকতা থাকে তাহলে তার স্বভাবে ক্ষমতার লোভ থাকা এবং ক্ষমতার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। ইতিহাস থেকে সে প্রমাণই পাওয়া যায়। ইয়াজিদের অবস্থাও তাই ।
৬০ হিজরীতে হযরত মোয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইন্তিকাল কনেন, ইন্তিকালের পর এজিদ শাসন ক্ষমতা হাতে নেয় এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ইয়াযিদ ইসলামের সনাতন সংস্কৃতিকে বদলে দিয়ে বাদশাহী কায়দায় সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায়ই সে নিজেকে মুসলমানদের খলিফা ঘোষণা করে ও ঈমানদারদের বাইআত দাবি করে। ইয়াযিদ তার পথকে নিষ্কণ্টক করার জন্য লোভ ও হুমকি প্রদান করে একে একে মক্কা ও মদীনার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পদানত করে সর্বশেষে ইমাম হোসাইনের দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতো একজন ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই ইয়াযিদের মতো একজন মানুষের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে পারেননা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুযোগ্য উত্তরাধিকার হোসাইন তাঁর ইমামতের প্রজ্ঞায় সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট এক কালজয়ী পথ রচনা করেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ন্যায়ের প্রতিভূ ইমাম হোসাইন ও অন্যায়ের প্রতিভূ ইয়াযিদ,এ দু’য়ের কারও পথ ও কর্মকৌশলে লক্ষ্যহীন ও অপরিকল্পিত ছিল না। জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইনের প্রতিপক্ষ ইয়াযিদ শুধু শক্তিবলেই বলশালী ছিল না; বরং উত্তরাধীকার সূত্রে তার পক্ষে ছিল উমাইয়াদের কূটকৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও সমগ্র অপকৌশলের এক সমন্বিত অস্ত্রমালা। তার সেসকল অস্ত্রের কোনটিই সে প্রয়োগ করতে বাদ রাখনি।
এজিদের ঔদ্ধত্য ইমাম হোসাইনকে স্থির থাকতে দিল না। মুসলিম জনগণও ইয়াজিদের শাসন ক্ষমতা প্রাপ্তিতে বিচলিত হয়ে উঠলো। এই সংকটময় মুহূর্তে এজিদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে নিজের নিরাপত্তা চাইলে ইসলামের আদর্শকে বিসর্জন দিতে হয়। আর ইসলামের কল্যাণ চাইলে এজিদের শাসনকে অস্বীকার করতে হয়। ইমাম হোসাইন এই উভয় সংকটে পড়ে শেষোক্ত ত্যাগের পথই বেছে নিলেন। আর এরই শেষ পরিণতি হিসেবে (৬১ হিঃ ১০ই মুহাররম-মোতাবেক ৬৮০ খৃঃ) কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। অন্যথায় শুধু ইসলামই আপন সত্তা হারাতো না, নবী বংশসহ দুনিয়ার সকল মুসলমান কলঙ্কিত হতো এবং শাহাদাতে কারবালার প্রেরণা নিয়ে যুগে যুগে যেসব ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, তাও হতো কি না সন্দেহ।
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাত :
———————————————————–
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবা কেরাম মতামতের ভিত্তিতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খলিফা নির্বাচিত হন। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে মনোনীত করে যাননি। এরপর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সাহাবাদের পরামর্শ নিয়ে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করেন। যিনি তার বংশের কেউ ছিলেন না। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ গঠন করে দিয়েছিলেন। যেখানে তাঁর কোনো আত্মীয় ছিল না। মদিনার মুসলমানদের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত ওসমানের পর খলিফার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, যা ছিল মুসলিম রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার এবং খলিফা নির্বাচনের ইসলামী নিয়ম।
হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যিনি সিরিয়ায় হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর প্রতিনিধি ও আমীর ছিলেন, তিনি পরবর্তী পর্যায়ে ৬০ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছর আমীর মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইসলামী জাহান শাসন করেন। পিতার ইন্তিকালের পর ৬০ হিজরিতে এজিদ দামেস্ক কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফার পদে বসে। চরিত্রগতভাবে ইয়াজিদ দুষ্ট চরিত্রের হওয়ায় নবী পরিবার ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং মদিনার মুসলমানেরা ইয়াজিদকে খলিফা মেনে নিতে রাজি হননি। এই কারণেই এবং আগামীতে বেনামাজি, নাচ-গানকারী চরিত্রহীন লোকদেরকে মুসলামনেরা যেন নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ না করে, প্রিয়নবী এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত রক্ষা করার শিক্ষা পায়, তাই ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সপরিবারে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদতবরণ করেন; কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে রাজি হননি ।
ইয়াযীদ রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই মদীনার গভর্ণরের কাছে পত্র লিখে, যাতে তার পক্ষে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বাইয়াত আদায় করা হয়। উদ্দেশ্য ইমামকে ইয়াযিদের কাছে বাইআত হতে বাধ্য করা। আর তার পরই গোটা উম্মাহর মাঝে প্রচার করা হবে যে, মহানবীর দৌহিত্র হোসাইনও ইয়াযিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। রাসূলে খোদার নাতি হয়ে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একজন অপদার্থ ও ইসলামী শরীয়তের রীতিনীতির প্রতি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণকারীর হাতে বায়আত বা আনুগত্যের শপথ নিতে পারেন না। তাই রাতের অন্ধকারে তিনি মদীনা থেকে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন হিজরি ৬০ সালের রজব মাসে। এজিদের প্রতি বিদ্রোহী ছিল কুফার জনগণের মন। কুফা বর্তমান ইরাকের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যখন মদীনায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সপরিবারে কুফায় চলে যান। কারণ, কুফার লোকেরা ছিল হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সমর্থক ও অনুরক্ত। ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খেলাফতের দাবি ত্যাগ ও পরে বিষপ্রয়োগে শাহাদত বরণ করলে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আহলে বায়তের সদস্যদের নিয়ে মদীনায় চলে আসেন। কাজেই কুফার লোকেরা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পূর্ব পরিচিত ছিল এবং কুফাবাসীও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ভালোভাবে চিনত। এজিদ দামেস্কে খেলাফতের মসনদে বসার পর হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মক্কায় চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুফার গণ্যমান্য লোকেরা একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে হোসাইনের কাছে। সবার বক্তব্য ছিল, আমরা কিছুতেই এজিদের মতো অপদার্থের হাতে বায়আত নেব না। আপনি আমাদের মাঝে চলে আসুন আমরা আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করে প্রয়োজনে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। রজব, শাবান, রমযান, শাওয়াল, জিলকদ এই পাঁচ মাস হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বিষয়টি নিয়ে চিন্তা, ভাবনা করেন, সবার সাথে পরামর্শ করেন। অধিকাংশ লোকের পরামর্শ ছিল কুফার লোকেরা বিশ^াসঘাতক, কাজেই আপনি যাবেন না। তিনি দেখেন যে, এজিদ নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে মক্কা আক্রমণ করবে। তখন কাবাঘর ও মক্কা নগরীর পবিত্রতা লুণ্ঠিত হবে। ‘আমার কারণে মক্কার অমর্যাদা হোক’ তা হোসাইন সহ্য করতে পারেন না। তাই সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন কুফায় যাবেন। তিনি মাহে রমযান ও হজের মওসুমে মানুষকে ইসলামী খেলাফত বিপথগামী হওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। ওদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকীল রিপোর্ট দেন, এ পর্যন্ত কুফার ১৮ হাজার মানুষ আপনার পক্ষে আমার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন। ইসলামী খেলাফতের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রার যে দিনটি নির্ধারণ করেন তা ছিল ৮ই যিলহজ¦, যেদিন হাজীরা ইহরাম পরে মক্কা থেকে মিনা ও আরাফাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঐদিনই তিনি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে জানতে পারেন কুফাবাসী বিশ^াসঘাতকতা করেছে। নতুন গভর্নর ইবনে যিয়াদের ষড়যন্ত্রের শরীক হয়ে মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যা করেছে।
ইমাম অগ্রসর হতে লাগলেন, কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই হুর ইবনে এজিদের নেতৃত্বে কুফার গভর্ণরের প্রেরিত বাহিনী অন্য কোথাও যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় এবং কারবালা প্রান্তরে উপনীত হতে বাধ্য করে। ইতিহাসের বিম্ময়কর তথ্য হল, পথিমধ্যে নামাযের সময় হলে পথরোধকারীরাও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইমামতিতে নামায পড়ে। নামায শেষ হলে আবার তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এভাবে কুফার সামরিক অধিনায়ক হুর ইবনে এজিদ হিজরি নববর্ষ ৬১ সালের মহররম মাসে ইমাম ও তার পরিবারকে কারবালায় গিয়ে শিবির স্থাপনে বাধ্য করে। কুফার গভর্নর দামেস্ক অধিপতি এজিদের নির্দেশে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ২২ হাজার বা ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে। সে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে মুহাম্মদ ইবনে সাদকে। তিনি ছিলেন কাদেসিয়া বিজয়ী হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ছেলে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে সেই অঞ্চলের শাসকের পদ প্রদানের লোভ দেখিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠায়। দুনিয়ার সামান্য স্বর্থের লোভে তিনি এতবড় ঝুঁকি মাথায় নেন। শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে শান্তি স্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইমাম শিবিরের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। চরম মুহূর্তে সেনাপতি হুর ইবনে এজিদ ইমামের শিবিরে পালিয়ে আসে এবং পরে ইমামের পক্ষ নিয়ে বীর-বিক্রমে লড়াই করে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন। যা প্রমাণ করে ইমাম ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আর এজিদ ও ইবনে যিয়াদের বাহিনী যুদ্ধ করেছিল মিথ্যার পক্ষে।
পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর সাথে বহুবার বৈঠক ও মতবিনিময় করে শান্তি স্থাপন ও যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আশুরার আগের রাতে সঙ্গীদের ডেকে অন্ধকারের ঢাল ব্যবহার করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ শাহাদাত আসন্ন জেনেও ইমামকে ছেড়ে যেতে তারা কেউ রাজি হয়নি। আশুরার দিন তিনি সেনাপতির ন্যায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধের ব্যুহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথী যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসূলে পাকের অদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বুঝা যাবে, ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
ইয়াযিদ সম্পর্কে আমাদের অভিমত:
————————————-
বিদ্বেষী শ্রেণীটি ইবনে যিয়াদের উপর দোষ চাপিয়ে এজিদকে ভারমুক্ত করার জন্যও এক ধরনের প্রচারণা চালায়। অথচ ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সামান্য লেখাপড়া আছে তারাও জানে যে, এজিদ ক্ষমতায় আরোহণের পর প্রথম বছর কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটায়। দ্বিতীয় বছর মদীনা আক্রমণ করে তিনদিন পর্যন্ত মসজিদে নববীকে যোদ্ধাদের ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে। আর তৃতীয় বছর যখন কাবা ঘরে আশ্রিত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে হত্যার জন্য সিরীয় সৈন্যরা কাবাঘর লক্ষ করে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছিল তখনই দামেস্ক থেকে এজিদের মৃত্যুর সংবাদ আসে এবং তারা ফিরে যায়। কাজেই এমন পাপাচারীর পক্ষ নেয়ার সুযোগ কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের নেই। ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কারবালা প্রান্তরে অসহায়ভাবে শহীদ হয়েছিলেন আর দৃশ্যত এজিদ বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সেদিন বিজয়ী হয়েছিলেন। যার কারণে বিশে^র ঘরে ঘরে আজ হাসান ও হোসাইন নামের এত আদর ও কদর। পক্ষান্তরে কোনো মানুষই নিজের সন্তানের নাম এজিদ রাখতে রাজি নয়। ইতিহাস বলে, কুফাবাসী তাদের বিশ^াসঘাতকতার চরম প্রায়শ্চিত্ব ভোগ করেছিল পরবর্তী মুখতারের আন্দোলনে। কারাবালায় অংশগ্রহণকারীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল। রাসূলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এতবড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা।
কারবালার শিক্ষা:
——————–
যুগে যুগে সত্যাশ্রয়ী ও নীতিনিষ্ঠদের ভূমিকা একই ছিল। তারা যে মত ও পথকে সত্য জ্ঞান করেছেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই নীতি, মত ও পথের উপর অবিচল থেকেছেন। নীতির প্রশ্নে তারা যেমন কারও সঙ্গে আপোষ করতেন না, তেমনি কে বা কারা এবং কত সংখ্যক লোক তাদের সঙ্গে রয়েছে, সে দিকেও ভ্রূক্ষেপ করতেন না। আর এমনিভাবে একদিন দেখা যায়, কোনো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যেখানে মুষ্টিমেয় লোক কাজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজের শত বাধা উপেক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, পরবর্তী পর্যায়ে সেখানে গোটা সমাজ তাদের আদর্শের পতাকা হাতে এগিয়ে এসেছে। শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইনের সংগ্রামী জীবনেও আমরা এ সত্যের অভিব্যক্তি দেখতে পাই। তিনিই প্রথম ত্যাগী পুরুষ, যিনি মানুষের জন্যে নির্ধারিত ইসলামের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের এবং অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। সত্যের ঝান্ডাকে উঁচু করে রাখার সংগ্রামে শত্রুশক্তির বিপুলসংখ্যাধিক্য, হামলার প্রচন্ডতা ও নির্মমতা তাঁকে এতটুকু নত করতে পারেনি। নিজের এবং প্রাণপ্রিয় মাসুম সন্তানদের বুকের রক্ত দিয়ে তিনি একথা প্রমাণ করে গেছেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে তার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখার প্রশ্নে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে কোনো মুসলমানের পক্ষে নিজের ও প্রাণপ্রিয় সন্তানদের জীবনাহুতির বিষয়টি অতি তুচ্ছ। কারণ, এরি মাধ্যমে প্রমাণিত হয় খোদাপ্রীতির প্রকৃত স্বরূপ।
স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সত্যের পতাকা নিয়ে রুখে না দাঁড়ালে, মানুষ মুলত অনাগত দিনগুলোতে অত্যাচারীর সামনে হক কথা বলার সাহসী কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাবে না। মুলত একটি প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রবল ও জনবল শূন্য অবস্থায় কথা বলার পরিণতি কি হতে পারে, সংগ্রামী ইমাম তা ভাল করেই অনুধাবন করেছিলেন। এজন্যেই শুধু একটি বাক্য- ‘ইয়াজীদের আনুগত্য করি’ এই বলে কাপুরুষতা দেখাননি, দেখিয়েছেন ঈমানের প্রদীপ্ত শিখা। এছাড়া হোসাইন পরিবারের উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এমন কোনো মহল একথা বলতে পারবে না যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কর্তৃত্ব হাসিলের জন্য তিনি এ পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুও শতভাগ সঠিক পদক্ষেপ নিলেন। কারণ, সেটিই ছিল তাঁর করণীয়া। তিনি তা না করলে কেয়ামত পর্যন্ত বিচ্যুত শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে থাকতো না। এজন্যই হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এই দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে যে, না, সবাই চোখবন্ধ আনুগত্য করবে না। বরং কিছু লোকের এমনও হওয়া উচিত যে, এ দুঃসহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরোয়াহীনভাবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে যেসব সংস্কারবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যেসব বৈপ্লবিক প্রয়াস উচ্চকিত হয়েছে, সেসব ক’টিরই পেছনে হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর স্থাপিত দৃষ্টান্ত ভূমিকা রেখেছে। তারা ওই দৃষ্টান্ত থেকে অনুধাবন করেছেন, এ জাতীয় প্রতিরোধ শিশুসুলভ কোনো চাঞ্চল্য নয়, নয় কোনো উত্তেজক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অস্থিরতা। বরং এটি হচ্ছে হোসাইনী সুন্নত। হযরত হোসাইনের আদর্শ-নীতি।