মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তাফা ﷺ ১ম পর্ব
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين - والصلوة والسلام على اشرف الانبياء والمرسلين- وعلى اله واصحابه اجمعين-
♦মূলঃ ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী রহমাতাল্লাহি আলাইহি
মাসআলা
=====
নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতা সম্বন্ধে শরয়ি হুকুম হল তাঁরা উভয়ে নাজাতপ্রাপ্ত এবং তাঁরা জাহান্নামী নন। অনেক উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। এ মাসআলার উপর আলোচনাকারীদের পক্ষ থেকে কয়েকটি মসলক বা অভিমত প্রকাশ পেয়েছে।
এ মাসআলার উপর উলামায়ে কেরামদের প্রথম মসলক বা অভিমত
==================
প্রথম মসলক বা অভিমত হল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং তাদের উপর কোন আযাব হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (সূরা বনি ইসরাইল- ১৫)
আমাদের আশআরী ইমামদের মধ্যে আকাইদ ও উসুলবিদগণ এবং শাফেয়ী মাযহাবের ফোকাহাগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দাওয়াত পৌঁছার পূর্বে যদি কেউ মুত্যুবরণ করে তাহলে সে নাজাতপ্রাপ্ত হবে। এবং ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। এমতাবস্থায় যদি তাকে হত্যা করা হয় তাহলে এর রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে।
ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ তাঁর অনুসারীবৃন্দ এর উপর দলিল প্রয়োগ করেছেন। বরং কোন কোন অনুসারীগণ বলেছেন এমতাবস্থায় কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা প্রয়োগ করতে হবে। তবে বিশুদ্ধ মত হল এক্ষেত্রে কিসাস প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ সে প্রকৃত অর্থে মুসলমান নয়। এবং কিসাসের জন্য শর্ত হলো উভয় ব্যক্তি সমপর্যায়ের হতে হবে।
এজন্য কোন কোন ফোকাহাগণ বলেছেন- এমতাবস্থায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার শাস্তি হবে না। কারণ সে ফিতরাতের উপর ছিল এবং তার প থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি। এবং তার কাছে এমন কোন রাসূল আগমন করেননি যাকে সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।
এই মসলক বা অভিমতের মধ্যে সর্বপ্রথম যার অভিমত শুনেছি তিনি হচ্ছেন শাইখুল ইসলাম শরফুদ্দিন আল মানাওয়ী। তাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হল ‘তিনি কি জাহান্নামী?’ এতে তিনি প্রশ্নকারীকে কঠোরভাবে ধমক দিলেন। অতঃপর প্রশ্নকারী বললেন- তাঁর ইসলাম সম্বন্ধে কোন প্রমাণ আছে কি? জবাবে তিনি বললেন- নবীজীর পিতা ফাতরাতের যুগে ইন্তেকাল করেছেন এবং নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে কোন শাস্তি নেই।
সিবত ইবনুল জুযি তাঁর কিতাব ‘মিরআতুয যামানে’ একটি জামাত থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। তিনি তার দাদার সূত্রে নবীজীর মায়ের পুনর্জীবনসংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অতঃপর বলেন- এ ব্যাপারে দলিল হল আল্লাহতায়ালার বাণী-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নেই। সুতরাং তাদের কোন গোনাহ নেই। এ বিষয়টি উবাই তাঁর ‘শরহে মুসলিম’ কিতাবে শক্তভাবে বর্ণনা করেছেন। তার ইবারতটুকু আমি অচিরেই উল্লেখ করব।
আহলে ফাতরাত বা ফাতরাতের অধিবাসীদের সম্বন্ধে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামত দিবসে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। আর আয়াতে কারীমাগুলোও ইঙ্গিত বহন করে যে তাদের কোন শাস্তি হবে না।
এ মতটিই গ্রহণ করেছেন তৎকালীন যুগের হাফিজুল হাদিস শাইখুল ইসলাম আবুল ফদল বিন হাজর। তিনি তাঁর কোন একটি কিতাবে উল্লেখ করেছেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার-পরিজন যারা নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটাত্মীয় হবার দরুণ তাঁর সম্মানার্থে সে পরীায় আনুগত্য প্রকাশ করবেন।
অতঃপর তাকে দেখেছি তিনি ‘ইসাবা’ গ্রন্থে বলেছেন- এ ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, অধিক বৃদ্ধ ব্যক্তি, ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী, জন্ম থেকে অন্ধ, বোবা ও বধির ব্যক্তি, জন্ম থেকে পাগলব্যক্তি, অথবা নাবালিগ অবস্থায় পাগলব্যক্তি এ রকম অন্যান্য সকল ব্যক্তিবর্গ দলিল হিসেবে দাবি করবে যে, যদি আমি সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন হতাম অথবা যদি আমাকে স্মরণ করানো হতো তবে আমি ঈমান আনয়ন করতাম।
তখন তাদের জন্য অগ্নি প্রজ্বলিত করে বলা হবে এতে প্রবেশ কর। তখন যে ব্যক্তি আগুনে প্রবেশ করবে সে শান্তি ও শীতলতা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলোর ইহাই ভাবার্থ।
তিনি বলেন- এ সমস্ত রেওয়ায়েতগুলো আমি স্বতন্ত্রভাবে সন্নিবেশিত করেছি। আমরা আশা করি আব্দুল মোত্তালিব ও তার পরিবারবর্গ তাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন যারা আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিপ্রাপ্ত হবেন। তবে আবু তালিব ব্যতিত। কারণ তিনি নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু ঈমান আনয়ন করেননি। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে তিনি জাহান্নামের লেলিহান শিখার মধ্যে থাকবেন।
কিয়ামতের দিন পরীা নেওয়ার বিষয়টি আমি প্রথম মসলকের অন্তর্ভুক্ত করেছি। যদিও বাহ্যিকভাবে ইহা স্বতন্ত্র মসলকের দাবিদার। কিন্তু আমি ইহাকে এমন সুক্ষ্ণ অর্থবিশিষ্ট পেয়েছি যা জ্ঞানবানদের নিকট অস্পষ্ট নয়।
আয়াত- ১.
=====
আল্লাহতায়ালার বাণী-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (সূরা বনি ইসরাইল- ১৫)
এ আয়াত দ্বারা আহলে সুন্নাতের ইমামগণ দলিল পেশ করেন যে, নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে কোন আযাব নেই এবং এ আয়াত দ্বারা সুন্নি ইমামগণ মু’তাজিলা ও তাদের অনুগামী সম্প্রদায়ের মতবাদ খণ্ডন করেন। তাদের দাবি হলো আকল তথা বুদ্ধিমত্তার উপর ফয়সালা করা হবে।
ইবনে জারির এবং ইবনে আবি হাতিম স্ব-স্ব তাফসির গ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال ان الله ليس بمعذب احدا حتى يسبق اليه من الله خبر او تأتيه من الله بينة-
অর্থ: তিনি বলেন- আল্লাহতায়ালা ততণ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি প্রদান করেন না যতণ পর্যন্ত তার নিকট আল্লাহর পক্ষে থেকে কোন সংবাদ বা কোন প্রমাণ না পৌঁছবে।
আয়াত- ২.
=====
আল্লাহর বাণী-
ذلك ان لم يكن ربك مهلك القرى بظلم واهلها غفلون-
অর্থ: এটা এজন্য যে আপনার প্রতিপালক কোন জনপদের অধিবাসীদেরকে জুলুমের কারণে ধ্বংস করেন না এমতাবস্থায় যে তথাকার অধিবাসীরা অজ্ঞ থাকে। (আনআম- ১৩১)
ইমাম যারকাশী এ আয়াতটিকে তাঁর شرح جمع الجوامع কিতাবে ঐ মূলনীতির দলিল হিসেবে পেশ করেছেন যে, আকলী তথা বুদ্ধিভিত্তিক দলিল দ্বারা নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব হয় না। বরং ছেমায়ী বর্ণিত দলিল প্রয়োজন।
আয়াত- ৩.
=====
আল্লাহর বাণী-
ولو لا ان تصيبهم مصيبة بما قدمت ايديهم فيقولوا ربنا لو لا ارسلت الينا رسولا فنتبع ايتك ونكون من المؤمنين-
অর্থ: আর এজন্য যে, তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের কোন বিপদ হলে তারা বলতো হে আমাদের পালনকর্তা আপনি আমাদের কাছে কোন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? করলে আমরা তোমার আয়াতসমূহের অনুসরণ করতাম এবং আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারী হয়ে যেতাম। (সূরা কাসাস- ৪৭)
উক্ত আয়াতটিও ইমাম যারকাশী রেওয়ায়েত করেছেন। তাছাড়া ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসিরগ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান সনদে আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الها لك فى الفترة يقول رب لم يأتنى كتاب ولا رسول- ثم قرء هذه الاية-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি বলবে- হে প্রতিপালক আমার কাছে কোন কিতাব কিংবা কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর নবীজী উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।
আয়াত- ৪.
=====
আল্লাহর বাণী-
ولو انا اهلكنهم بعذاب من قبله لقالوا ربنا لولا ارسلت الينا رسولا فنتبع ايتك من قبل ان نذل ونخزى-
অর্থ: যদি আমি এদেরকে ইতোপূর্বে কোন শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম, তবে এরা বলত হে আমাদের পালনকর্তা আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? তাহলেতো আমরা অপমানিত ও হেয় হবার পূর্বেই আপনার নির্দেশসমূহ মেনে চলতাম। (ত্ব-হা- ১৩৪)
ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এ আয়াতের অধীনে আতিয়্যাহ আল উফি থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال- الهالك فى الفترة يقول رب لم يأتنى كتاب ولا رسول
অর্থ: তিনি বলেন ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি বলবে হে রব আমার কাছে কোন কিতাব কিংবা কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।
আয়াত- ৫.
=====
আল্লাহর বাণী-
وما كان ربك مهلك القرى حتى يبعث فى امها رسولا يتلوا عليهم ايتنا-
অর্থ: আপনার পালনকর্তা জনপদসমূহকে ধ্বংস করেন না যে পর্যন্ত তার কেন্দ্রস্থলে কোন রাসূল প্রেরণ না করেন। যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন। (কাসাস- ৫৯)
ইবনে আবি হাতিম উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قال لم يهلك الله ملة حتى يبعث اليهم محمدا صلى الله عليه وسلم فلما كذبوا وظلموا بذالك هلكوا-
অর্থ: তারা উভয়ে বলেন- আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ না করা পর্যন্ত তার জাতিকে ধ্বংস করেননি। অতঃপর যখন তারা নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং তাঁর উপর যুলুম করল তখন তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো।
আয়াত- ৬.
=====
আল্লাহর বাণী-
وهذا كتاب انزلنه مبرك فاتبعوه واتقوا لعلكم ترحمون- ان تقولوا انما انزل الكتاب على طائفتين من قبلنا- وان كنا عن دراستهم لغفلين-
অর্থ: ইহা এমন একটি গ্রন্থ যা আমি অবতীর্ণ করেছি খুব বরকতপূর্ণ। অতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর যাতে তোমরা করুণা প্রাপ্ত হও। এ জন্য যে কখনো তোমরা বলতে শুরু কর, গ্রন্থতো কেবল আমাদের পূর্ববর্তী দু’সম্প্রদায়ের প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছে এবং আমরা সেগুলোর পাঠ ও পঠন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। (আনআম- ১৫৫-১৫৬)
আয়াত- ৭.
=====
আল্লাহর বাণী-
وما اهلكنا من قرية الا لها منذرون- ذكرى وما كنا ظلمين-
অর্থ: আমি কোন জনপদ ধ্বংস করিনি, কিন্তু এমতাবস্থায় যে, তার সতর্ককারী ছিল। স্মরণ করানোর জন্য এবং আমার কাজ অন্যায় আচরণ নয়। (সূরা- শুআরা, ২০৮-২০৯)
হযরত আব্দ বিন হুমাইদ, হযরত ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে তাদের তাফসিরগ্রন্থে হযরত কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন-
ما اهلك الله من قرية الا من بعد الحجة والبينة والعذر حتى يرسل الرسل وينزل الكتب تذكرة لهم وموعظة وحجة لله ذكرى وما كنا ظالمين-
অর্থ: আল্লাহতায়ালা ততণ পর্যন্ত কোন জনপদকে ধ্বংস করেন না যতণ পর্যন্ত তাদের নিকট কোন রাসূল সুস্পষ্ট প্রমাণ ও কিতাবাদীসহ আগমন করে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন না করেন। যেমন আল্লাহর বাণী- স্মরণ করানোর জন্য এবং আমার কাজ অন্যায় আচরণ নয়।
আয়াত- ৮.
=====
আল্লাহর বাণী-
وهم يصطرخون فيها- ربنا اخرجنا نعمل صالحا غير الذى كنا نعمل- او لم نعمركم ما يتذكر فيه من تذكر وجاء كم النذير-
অর্থ: সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবেন হে আমার রব আমাদেরকে বের করুন, আমরা সৎকাজ করব। পূর্বে যা করতাম তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদের এতটা বয়স দেইনি যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। (ফাতির- ৩৭)
মুফাসসিরীনে কিরামগণ বলেন- উক্ত আয়াতে নাযির বা সতর্ককারী বলতে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে।
নিম্নে সে সমস্ত হাদিস উল্লেখ করা হল যা প্রমাণ করে যে, কিয়ামতের দিবসে ফাতরাতের যুগের লোকদেরকে পরীক্ষা করা হবে। তখন যারা আনুগত্য প্রকাশ করবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর যারা নাফরমানী করবে তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
হাদিস- ১.
=====
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ইসহাক বিন রাহওয়ায় স্বীয় মসনদ গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাকী ‘কিতাবুল ইতেকাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বায়হাকী ইহাকে সহীহ বলেছেন-
عن الاسود بن سريع- ان النبى صلى الله عليه وسلم قال اربعة يمتحنون يوم القيامة- رجل اصم لايسمع شيأ- ورجل احمق ورجل هرم ورجل مات فى فترة فاما الاصم فيقول رب لقد جاء الاسلام وما اسمع شيأ- واما الاحمق فيقول رب لقد جاء الاسلام والصبيان يحذفونى بالبعر- واما الهرم فيقول رب لقد جاء الاسلام وما اعقل شيأ- واما الذى مات فى الفترة فيقول رب ما اتانى لك رسول فيأخذ مواثيقهم ليطيعنه فيرسل اليهم ان ادخلوا النار فمن دخلها كانت عليه بردا وسلاما ومن لم يدخلها يسحب اليها-
অর্থ: আসওয়াদ বিন সারি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামদের দিন চার প্রকার লোকের কাছ থেকে পরীা নেয়া হবে। ১. বধির ব্যক্তি, যে কিছুই শুনতে পায় না। ২. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তি। ৩. অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। ৪. এবং ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি।
অতএব বধির ব্যক্তি বলবে হে প্রভু, ইসলাম এসেছিল কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাইনি। বোকা ব্যক্তি বলবে, প্রভূ ইসলাম এসেছিল কিন্তু আমি অনুধাবন করতে পারিনি। অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি বলবে হে প্রভূ এব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী বলবে, হে প্রভু আমার কাছে তোমার কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর তাদেরকে পরীা করা হবে এবং বলা হবে জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন যে ব্যক্তি আগুনে প্রবেশ করবে তার প্রতি শীতল শান্তি বর্ষিত হবে। আর যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে না তাকে জাহান্নামে নিপে করা হবে।
হাদিস-২.
=====
ইমাম আহমদ, ইসহাক বিন রাহ্ওয়ায় তাদের মসনাদ গ্রন্থে, ইবনে মারদুভীয়াহ স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাকী ‘কিতাবুল ইতেক্বাদ’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان النبى صلى الله عليه وسلم قال اربعة يمتحنون
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- চার শ্রেণির লোকদেরকে পরীা করা হবে। হাদিসের বাকী অংশ পূর্বে বর্ণিত আসওয়াদ বিন সারি কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের অনুরূপ।
হাদিস- ৩.
=====
ইমাম বাযযার স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤتى بالهالك فى الفترة والمعتوه والمولود- فيقول الها لك فى الفترة لم يأتنى كتاب ولا رسول ويقول المعتوه اى رب لم تجعل لى عقلا اعقل به خيرا ولا شرا ويقول المولود لم ادرك العمل- قال فيرفع لهم نار فيقال لهم ردوها او قال ادخلوها فيدخلها من كان فى علم الله سعيدا لو ادرك العمل- ويمسك عنها من كان فى علم الله شقيا لو ادرك العمل- فيقول تبارك وتعالى اياى عصيتم فكيف برسلى بالغيب-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ফাতরাতের যুগে মৃত্যুপ্রাপ্ত, মস্তিষ্ক বিকৃত এবং শিশুকালে নিহত ব্যক্তিদেরকে উপস্থাপন করা হবে। ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি বলবে আমার কাছে কোন কিতাব বা কোন রাসূল আগমন করেননি। মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি বলবে হে প্রভু, আমার ভাল মন্দ বুঝার মত কোন জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না। শিশুকালে মৃত্যুপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলবে আমি আমল করার মত অবকাশ পাইনি।
অতঃপর তাদের জন্য আগুন প্রস্তুত করা হবে। এবং বলা হবে এতে প্রবেশ কর। তখন আল্লাহর ইলমে যারা সৌভাগ্যশীল অর্থাৎ অবকাশ পেলে আমল করত তারা আগুনে প্রবেশ করবে। কিন্তু আল্লাহর ইলমে যারা দূর্ভাগা সময় পেলেও আমল করত না, তারা প্রবেশ করবে না। তখন আল্লাহতায়লা বলবেন- তোমরা সরাসরি আমার হুকুম অমান্য করেছ। অতএব আমাকে না দেখে কিভাবে আমার রাসূলের আনুগত্য করবে?
উল্লেখিত হাদিসের সনদে ‘আতিয়্য আল উফি’ বর্ণনাকারী রয়েছেন। তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তবে ইমাম তিরমিজি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।
এ হাদিসের পে আরো অনেক হাদিস রয়েছে যা এ হাদিসটিকে হাসান এবং শক্তিশালী হবার প্রমাণ বহন করে।
হাদিস- ৪.
=====
ইমাম বাযযার ও আবু ইয়ালা তাদের মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤتى باربعة يوم القيامة- بالمولود والمعتوه ومن مات فى الفترة وبالشيخ الفانى كلهم يتكلم بحجته- فيقول الله تعالى لعنق من جهنم ابرزى فيقول لهم انى كنت ابعث الى عبادى رسلا من انفسهم وانى رسول نفسى اليكم ادخلوا هذه- فيقول من كتب الله عليه الشفاء- يا رب اتدخلناها ومنها كنا نفرق ومن كتب له السعادة فيمضى فيقتحم فيها مسرعا- فيقول الله قد عصيتمونى فانتم لرسلى اشد تكذيبا ومعصية فيدخل هؤلاء الجنة وهؤلاء النار-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কিয়ামতের দিন চার শ্রেণির লোকদেরকে আনয়ন করা হবে। ১. নাবালেগ সন্তান। ২. মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি। ৩. ফাতরাতের সময় মৃত্যুবরণকারী ও ৪. অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। তখন আল্লাহতায়ালা জাহান্নামকে আদেশ করবেন উত্তপ্ত হবার জন্য। অতঃপর বলবেন আমি আমার বান্দাদের প্রতি তাদের মধ্যে থেকে রাসূল প্রেরণ করেছি। আমি স্বয়ং তোমাদের প্রতি রাসুল হয়ে হুকুম দিচ্ছি জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন যারা দুর্ভাগা তারা বলবে- হে প্রভু আপনি কি আমাদেরকে আগুনে প্রবেশ করাবেন? আমরা তো আগুনকে ভয় করি। আর যাদের নসিবে কল্যাণ নিহিত রয়েছে সে আগুনের দিকে দ্রুত গমন করবে। তখন আল্লাহ বলবেন- তোমরা আমার অবাধ্যতা করেছ অতএব তোমরা আমার রাসূলের অধিক অবাধ্যতা করতে। তখন তাদেরকে জাহান্নামে এবং এদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।
হাদিস- ৫.
=====
আব্দুর রাজ্জাক ইবনে জারির ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال اذا كان يوم القيامة جمع الله اهل الفترة والمعتوه والاصم والابكم والشيوخ الذين لم يدركوا الاسلام ثم ارسل اليهم رسولا ان ادخلوا النار- فيقولون كيف ولم تأتنا رسل؟ قال وايم الله لو دخلوها لكانت عليهم بردا وسلاما ثم يرسل اليهم فيطيعه من كان يريد ان يطيعه- قال ابوهريرة اقرؤوا ان شئتم (وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا)
অর্থ: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা ফাতরাতের যুগের অধিবাসী, পাগল, বধির, বোবা ও অতিশয় বৃদ্ধ যে ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই অনুধাবন করতে পারেনি, তাদের প্রত্যেককে একত্রিত করবেন। অতঃপর তাদের প্রতি একজন ফেরেশতা পাঠাবেন তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানোর জন্য। তখন তারা বলবে এটা কিভাবে সম্ভব? অথচ আমাদের কাছে কোন রাসূল আসেননি। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- আল্লাহর কসম যদি তারা তখন জাহান্নামে প্রবেশ করত তাহলে তাদের প্রতি শান্তি ও শীতলতা অবতীর্ণ হত। অতঃপর তাদের কাছে আবার পাঠনো হবে। তখন যারা আনুগত্যকারী তারা আনুগত্য প্রকাশ করবে। অতঃপর আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- যদি তোমরা চাও তবে এ আয়াতটি পড়ে নাও। وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (বনি ইসরাইল-১৫)
এ হাদিসটির সনদ বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ।
হাদিস- ৬.
=====
ইমাম বাযযার এবং ইমাম হাকিম স্বীয় মুস্তাদরাক গ্রন্থে হযরত ছাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- কিয়ামতের দিন জাহিলিয়াত যুগের লোকগণ তাদের গোনাহসমূহ পিঠে নিয়ে আগমন করবে। তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন। জবাবে তারা বলবে হে আমাদের রব আমাদের কাছে কোন রাসূল কিংবা আপনার কোন বিধান আগমন করেনি। যদি আমাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করতেন তাহলে আমরা আপনার অনুগত বান্দা হতাম।
অতঃপর আল্লাহতায়ালা বলবেন- তোমরা কি জান যে, আমার নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়? তারা বলবে হ্যাঁ।
অতঃপর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হবে জাহান্নামে প্রবেশ করার জন্য। তখন তারা জাহান্নামের দিকে গমন করবে। যখন জাহান্নামের নিকটবর্তী হবে তখন তারা এর ভয়াবহ গর্জন ও হুংকার শুনতে পাবে। তখন সবাই তাদের প্রভুর কাছে ফিরে আসবে এবং বলবে হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করুন।
তখন তিনি বলবেন- তোমরা কি জাননা যে আমার নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়? অতঃপর এ ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। আল্লাহ বলবেন- যাও জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন সবাই সেদিকে গমন করবে। যখন তারা জাহান্নাম দর্শন করবে তখন প্রত্যাবর্তন করে আসবে এবং বলবে- হে আমাদের রব আমাদেরকে রা কর। আমরা এতে প্রবেশ করতে পারব না। তখন আল্লাহ বলবেন- যাও অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ কর।
অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- যদি তারা প্রথমেই জাহান্নামে প্রবেশ করত তাহলে তাদের উপর শান্তি ও শীতলতা বর্ষিত হত।
ইমাম হাকিম বলেন এ হাদিসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহিহ।
হাদিস- ৭.
=====
ইমাম তাবরানী ও আবু নঈম হযরত মায়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- কিয়ামতের দিন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি, ফাতরাতের সময় নিহত এবং বাল্যকালে নিহত ব্যক্তিদেরকে আনয়ন করা হবে।
তখন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তি বলবে, হে প্রভু, যদি আমাকে বুদ্ধি প্রদান করতেন। যাদেরকে বুদ্ধি প্রদান করেছেন তারা আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যশীল হয়েছে। ঠিক এমনিভাবে ফাতরাতের সময় নিহত ও বাল্যকালে নিহত ব্যক্তি আপত্তি করবে।
তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন- আমি তোমাদেরকে আদেশ করব তোমরা তা মান্য করবে তো? তারা বলবে হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন তবে যাও জাহান্নামে প্রবেশ কর। নবীজী বলেন- যদি তারা প্রবেশ করে তাহলে তাদের কোন তি হবে না। অতঃপর তাদের জন্য জাান্নামের উত্তপ্ত পানি প্রস্তুত করা হবে। তখন তাদের মনে হবে যেন আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিরাজি ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তারা দ্রুতগতিতে ফিরে আসবে। অতঃপর তাদেরকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়া হবে। তথাপি তারা প্রত্যাবর্তন করবে। তখন প্রভূ বলবেন- তোমাদের সৃষ্টির পূর্বেই আমি জানতাম তোমরা কি আমল করবে এবং তোমাদের কি পরিণতি হবে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে।
আল কিয়া আল হিরাসীর অভিমত: আল কিয়া আল হিরাসী স্বীয় উসূল গ্রন্থে নিয়ামতের শোকরিয়া সংক্রান্ত মাসআলার অধীনে বলেছেন- জেনে রাখুন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমামদের মূলনীতি হল শরয়ী দলিল ব্যতিত কোন আহকাম প্রতিষ্ঠা হয় না। শুধুমাত্র বুদ্ধিভিত্তিক ফয়সালা দ্বারা হুকুম সাব্যস্ত হয় না। অতএব সর্বপ্রথম যারা এ ব্যাপারে আহলে হকের সাথে বিরোধিতা করেছেন তারা হলেন রাফেজী, কারামিয়া ও মুতাজিলা প্রমূখ। তাদের মতে আহকাম কয়েক প্রকার। তার মধ্যে একটি হল, যা শরয়ী দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অন্যটি হল যা বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত।
আল হিরাসী বলেন আমাদের মতে কোন রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত কিছুই ওয়াজিব হয় না। অতএব যখন রাসূল আগমন করে মুজিযা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে চিন্তা গবেষণা করা সম্ভব।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় ‘আল মাহসুল’ গ্রন্থে বলেছেন, যুক্তিভিত্তিক দলিল দ্বারা ‘নিয়ামতের শোকরিয়া’ ওয়াজিব সাব্যস্ত হয় না। তবে এক্ষেত্রে মুতাজিলাদের মতামত আমাদের ব্যতিক্রম। যদি নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয় তাহলে তার অস্বীকারকারীকে এমন কারণে শাস্তি দেওয়া হবে যা আবশ্যক নয়। এখানে মতানৈক্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট। তাকে যে শাস্তি দেয়া হবে না তা আল্লাহর বাণীতেই রয়েছে। وما كنامعذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
উক্ত আয়াতে নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত শাস্তি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তথাপি যদি শাস্তি প্রদান করা হয় তাহলে আল্লাহর কথার মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা দিবে। যা অসম্ভব।
এ অভিমতটি الحاصل والتحصيل গ্রন্থের মুসান্নিফ এবং ইমাম বায়জাভী তাঁর ‘মিনহাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
কাজী তাজ উদ্দিন সুবুকি (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম সুবুকি রাদিয়াল্লাহু আনহু شرح مختصر ابن الحاجب কিতাবে নিয়ামতের শোকরিয়াসংক্রান্ত মাসআলায় বলেছেন- যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই আমাদের মাযহাব অনুযায়ী তারা নাজাতপ্রাপ্ত হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। যদি হত্যা করা হয়, তবে রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে। তবে হত্যাকারীর উপর কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা ওয়াজিব হবে না। ইহাই বিশুদ্ধ মত।
ইমাম বগভী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম বগভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘তাহযিব’ গ্রন্থে বলেছেন যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে এক্ষেত্রে কাফফরা ও রক্তপণ আবশ্যক হবে।
ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মতে এ হত্যার জন্য রক্তপণ আবশ্যক হবে না। কারণ তার আকল তথা বুদ্ধির উপর দলিল প্রয়োগ করা হবে। তবে আমাদের মতে দাওয়াত পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
অতএব প্রমাণিত হল যে, রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত নাই।
এমনিভাবে ইমাম রাফেয়ী বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মত ব্যতিক্রম। তাঁর নিকট এই ব্যতিক্রমের মূল ভিত্তি হল, সে ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের নিকট যার কাছে দাওয়াত পৌঁছে নাই তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
ইমাম গাজ্জালী (রা.) এর অভিমত
============
ইমাম গাজ্জালী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘আল বাসিত’ গ্রন্থে বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তার হত্যার জন্য কাফফারা ও রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যা করা যাবে না ইহাই বিশুদ্ধ মত। কেননা হাকিকী অর্থে সে মুসলিম নয়। শুধুমাত্র অর্থগতভাবে সে মুসলিম। এমনিভাবে ইবনে রিফায়া বলেছেন ‘আল কিফায়া’ গ্রন্থে কেননা সে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে জন্মগ্রহণকারী এবং তার থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি।
ইমাম নবভী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম নববী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে মুশরিক শিশুদের মাসআলায় বলেছেন- এব্যাপারে মুহাক্কিক উলামাযে কেরামদের সহিহ অভিমত হল মুশরিকদের শিশুগণ জান্নাতী। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করে আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। তিনি বলেন-দাওয়াত না পৌঁছার কারণে যদি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে আযাব না দেওয়া হয় তাহলে অপ্রাপ্ত শিশুদের বেলায়ও আযাব হবে না।
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
==========
ইমাম সুয়ুতি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- তুমি যদি প্রশ্ন কর উল্লেখিত মসলক বা অনুসারীদের যে মতামত আপনি উল্লেখ করেছেন তা কি জাহিলিয়াত যুগের সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য?
জবাবে আমি বলব ‘না’। বরং ইহা শুধুমাত্র তাদের জন্য নির্দিষ্ট যাদের নিকট প্রকৃত পে কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছে নাই। কেননা যার নিকট পূর্ববর্তী কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছেছে, তথাপি সে কুফুরির উপর অটল ছিল সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে, এতে কোন মতবিরোধ নেই।
অতএব রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতার ব্যাপারটি সুস্পষ্ট। উল্লেখিত মসলকটি এ অভিমতই গ্রহণ করেছেন যে, তাদের কাছে কোন দাওয়াত পৌঁছে নাই। আর এর পিছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। যেমন তাদের যুগ ছিল অনেক পরবর্তী যুগ এবং তাদের ও পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যখানে ছিল বিরাট ব্যবধান। যেমন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে সর্বশেষ নবী ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি ও আমাদের নবীর মধ্যখানে ফাতরাতের সময় ছিল প্রায় ছয়শত বছর।
তথাপি নবীজীর পিতা-মাতার যুগ ছিল জাহিলিয়াতের যুগ। পূর্ব পশ্চিম, সমগ্র পৃথিবী জাহিলিয়াতে ঢেকে গিয়েছিল। হাতেগোনা কিছুসংখ্যক আহলে কিতাব পাদ্রী ব্যতিত শরিয়ত সম্বন্ধে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ছিল না। তদুপরি তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। যেমন শ্যাম ও অন্যান্য দেশ। মদিনাশরীফ ছাড়া অন্য কোন দেশে নবীজীর পিতা-মাতা ভ্রমণ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া তারা উভয়ে এমন লম্বা হায়াতও পাননি যাতে করে এ ব্যাপারে অধিক খোঁজখবর করতে পারেন। কেননা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা সামান্য কিছু দিনের হায়াত পেয়েছিলেন।
হাফিজ সালাহউদ্দিন আল আলায়ীর অভিমত
==========
ইমাম হাফিজ সালাহ উদ্দিন আল আলায়ী الدرة السنية فى مولد سيد البرية কিতাবে বলেছেন, মা আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গর্ভধারণ করেন তখন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বয়স মাত্র আঠারো বৎসর। অতঃপর তিনি খেজুর সংগ্রহের জন্য মদিনাশরীফ গমন করেন এবং সেখানে মামার বাড়ি বনি নাজ্জার গোত্রে ইন্তেকাল করেন।
মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহাও প্রায় একই রকম বয়স পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পর্দাশীল মহিলা। তিনি সবসময় পুরুষদের মেলামেশা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বাড়িতে অবস্থান করতেন। তখনকার অধিকাংশ মহিলারাই জানতেন না ধর্মীয় ও শরিয়তের ব্যাপারে পুরুষদের কি দায়িত্ব। বিশেষ করে জাহিলিয়াতের যুগে পুরুষগণও জানতেন না মহিলাদের উপর তাদের কি প্রাধান্য রয়েছে। এজন্য যখন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হলেন তখন আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলো ابعث الله بشرا رسولا অর্থ: আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন (ইসরা- ৯৪) এবং তারা বলতো-
ولو شاءالله لانزل ملئكة ما سمعنا بهذا فى ابائنا الاولين-
অর্থ: আল্লাহ ইচ্ছা করলে ফেরেশতাই নাজিল করতেন। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এরূপ কথা শুনিনি। (মুমিনুন- ২৪)
অতএব যদি তাদের নিকট রাসূল প্রেরণের জ্ঞান থাকতো তবে তারা ইহা অস্বীকার করতো না। আবার কখনো তারা ধারণা করত তারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর শরিয়তের উপরেই আছে। কারণ ইব্রাহিমী শরিয়তের জ্ঞানসম্পন্ন কারো সাাত তারা পায়নি। কেননা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তাদের মধ্যখানে প্রায় তিনহাজার বছরের অধিক ব্যবধান ছিল।
অতএব এ আলোচনার দ্বারা ইহাই স্পষ্ট হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা এ মসলকেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম (রা.) এর অভিমত
==========
শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেন- আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতিত অন্যান্য সমস্ত নবীগণ শুধুমাত্র তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিই প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন এ মূলনীতি অনুযায়ী আহলে ফাতরাতের সমস্ত অধিবাসীগণ তাদের পূর্ববর্তী নবীর বংশধর। তাদের পূর্ববর্তী নবীর দিকে সম্বোধন করা হয়। এবং তারা তাদের পূর্ববর্তী শরিয়তকে অনুসরণ করেন। অতএব তারাই হলেন আহলে ফাতরাত।
উক্ত আলোচনা দ্বারা ইহাই সুস্পষ্ট হয় যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতা আহলে ফাতরাতের অন্তর্ভুক্ত এতে কোন সন্দেহ নাই। কেননা তারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর বংশধর নয় এবং তার সম্প্রদায় এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইবনে হাজর আসকালনী (রা.) এর অভিমত
==========
হাফিজুল আসর আবুল ফজল বিন হাজর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতামাতা সম্বন্ধে যে ধারণা করা হয় তারা কিয়ামতের দিন পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হবেন এর দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে।
প্রথম ব্যাখ্যা
=====
ইমাম হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহু মুস্তাদরাক কিতাবে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলেছেন-
قال قال شاب من الانصار (لم ار رجلا كان اكثر سوالا لرسول الله صلى الله عليه وسلم منه) يا رسول الله أرأيت ابواك فى النار- فقال ما سألتها ربى فيطيعنى فيها وانى لقائم يومئذ المقام المحمود-
অর্থ: ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- একদা আনসারী এক যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল (ইবনে মাসউদ বলেন তার চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক প্রশ্ন করতে কাউকে দেখিনি) ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি কি মনে করেন, আপনার পিতা-মাতা জাহান্নামী? তখন তিনি বললেন- আমি তাদের সম্বন্ধে আমার প্রভুর নিকট যা চাইব আমাকে তাই দেয়া হবে। আর সেদিন আমি মাকামে মাহমুদে অবস্থান করব।
উল্লেখিত হাদিসটি প্রমাণ করে যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাকামে মাহমুদে অবস্থান করবেন তখন তিনি তাঁর পিতা-মাতার কল্যাণ কামনা করবেন। আর তা হল যখন আহলে ফাতরাতদেরকে পরীক্ষা করা হবে তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করবেন যেন তারা উভয়ে পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হন। এতে কোন সন্দেহ নাই যখন নবীজী মাকামে মাহমুদে সমাসীন হবেন তখন তাকে বলা হবে سل تعط واشفع تشفع অর্থ: আপনি সুয়াল করুন, দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, কবুল করা হবে। ইহা সহিহ হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব যখন তিনি পিতা-মাতার ব্যাপারে সুয়াল করবেন তখন তা কবুল হবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা
=====
ইবনে জারির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে-ولسوف يعطيك ربك فترضى আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন-
قال من رضا محمد صلى الله عليه وسلم ان لايدخل احد من اهل بيته النار
অর্থ: ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনÑ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেযা বা সন্তুষ্টি হচ্ছে তাঁর পরিবারের কোন সদস্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। এজন্য হাফিজ ইবনে হাজর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার উক্তিতে বলেছেন-
الظن بال بيته كلهم ان يطيعوا عند الامتحان
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার সম্বন্ধে ধারণা করা হয় যে, তারা প্রত্যেকেই পরীার সময় আনুগত্যশীল হবেন।
তৃতীয় হাদিস: হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু شرف النبوة গ্রন্থে এবং মুল্লা তার সীরাতগ্রন্থে ইমরান বিন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم سألت ربى ان لا يدخل النار احدا من اهل بيتى فاعطانى ذالك-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি আমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছি যেন আমার পরিবার থেকে কাউকে জাহান্নামে প্রবেশ না করান। অতঃপর আমাকে তা প্রদান করা হয়েছে।
এ হাদিসটি হাফিজ মুহিব উদ্দিন তাবারী তাঁর ذخائر العقبى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
আবু তালিবের জন্য শাফায়াত
==========
চতুর্থ হাদিস: এ হাদিসটি উল্লেখিত হাদিসদ্বয়ের চেয়ে অধিক স্পষ্ট। ইহা তামাম আর রাযি জয়িফ সনদে তাঁর فوائد গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كان يوم القيامة شفعت لابى وامى وعمى ابى طالب واخ لى كان فى الجاهلية-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি কিয়ামতের দিন আমার পিতা, মাতা, চাচা আবু তালিব ও আমার জাহিলিয়াতের যুগের ভাইয়ের জন্য শাফায়াত করব।
এ হাদিসটি ইমাম তাবারী ذخائر العقبى فى مناقب ذوى القربى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন হাফিজুল হাদিস ও ফকীহ। তিনি বলেন- এখানে আবু তালিবের ব্যাপারটি তাওয়িল বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফায়াতে আবু তালিবের আযাব হ্রাস করা হবে।
তবে এ তাওয়িলটি শুধুমাত্র আবু তালিবের ব্যাপারে প্রযোজ্য। অন্যান্য তিনজন তথা নবীজীর পিতা, মাতা ও দুধভাইয়ের জন্য আবশ্যক নয়। কেননা আবু তালিব নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত হায়াত পেয়েছিলেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেননি। অন্যান্য তিনজন ফাতরাতের সময়েই ইন্তেকাল করেছেন। এ হাদিসটি অন্য একটি সূত্রে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। যদিও এ সূত্রটি অধিক জয়িফ। যা আবু নাঈম সহ অন্যান্যগণ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে ভাই বলতে দুধভাইকে বুঝানো হয়েছে।
فهذه احاديث عدة يشد بعضها بعضا- فان الحديث الضعيف يتقوى بكثرة طرقه-
অর্থ: এ সমস্ত হাদিসগুলি একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। কেননা জয়িফ হাদিস যখন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয় তখন তা শক্তিশালী হয়ে যায়।
যার উদাহরণ হল ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস, ইমাম হাকিম ইহাকে সহিহ বলেছেন।
এ ব্যাপারটি ইবনে আবি দুনিয়ার বর্ণনা দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন কাসিম বিন হাশিম সিমসার, তিনি মাকাতিল বিন সুলাইমান রমলী থেকে, তিনি আবি মু’শার থেকে, তিনি সাঈদ মাকবারী থেকে, তিনি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلو سألت ربى ابناء العشرين من امتى فوهبهم لى-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি আমার প্রভূর কাছে আমার উম্মতের বিশবছর বয়সি যুবকদের জন্য প্রার্থনা করেছি। অতঃপর তিনি তাদেরকে আমাকে দান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বর্ণনা রয়েছে, যদিও ইহা আলোচনার সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। যা ইমাম দায়লামী হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اول من اشفع له يوم القيامة اهل بيتى ثم الاقرب فا لاقرب-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমি সর্বপ্রথম শাফায়াত করব আহলে বাইতের জন্য। অতঃপর নিকটাত্মীয়দের জন্য। অতঃপর তাদের নিকটাত্মীয়দের জন্য।
ইমাম তাবারী ذخائر العقبى গ্রন্থে এবং ইমাম আহমদ মানাকিব গ্রন্থে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا معشر بنى هاشم والذى بعثنى بالحق نبيا لو اخذت بحلقة الجنة ما بدأت الابكم-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- হে হাশিম সম্প্রদায়ের লোকেরা! সে সত্ত্বার কসম, যিনি আমাকে সত্য সহ নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আমি জন্নাতের কড়া ধারণ করি তাহলে আমি তোমাদেরকে নিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করব।
ইহা খতিব তাঁর তারিখ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এমনিভাবে আবুল বখতারী হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان رحمى لا ينتفع بلى حتى تبلغ حكم وهم احد قبيلتين من اليمن- انى لاشفع فاشفع حتى ان من اشفع له فيشفع حتى ان ابليس ليتطاول طمعا فى الشفاعة-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে যে, আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন উপকার করবে না। কিন্তু না অবশ্যই উপকার করবে। এমনকি ‘হুকুম’ সম্প্রদায় পর্যন্ত উপকৃত হবে। (হুকুম হল ইয়ামনের একটি গোত্র)। আমি শাফায়াত করব এবং যার জন্য শাফায়াত করব তা গ্রহণ করা হবে। শেষ পর্যন্ত ইবলিসও শাফায়াতের জন্য আকাক্সা করবে।
এমনিভাবে তাবরানী উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان النبى صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان شفاعتى لا تنال اهل بيتى وان شفاعتى تنال حاء وحكم-
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে আমার পরিবারগণ আমার শাফায়াত লাভ করবে না। নিশ্চয় আমার শাফায়াত ‘হা’ ও ‘হুকুম’ গোত্রদ্বয় পর্যন্ত লাভ করবে।
সূক্ষ্মকথা
=====
ইমাম যারকাশী ‘খাদিম’ গ্রন্থে ইবনে দাহইয়া থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি প্রতি সোমবারে আবু লাহাবের আযাব হ্রাসকরণকে শাফায়াতের প্রকারভেদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা হচ্ছে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদশরীফে খুশি হয়ে আবু লাহাব সুয়াইবা দাসীকে মুক্ত করেছিল, যখন সুয়াইবা তাকে এ সংবাদ প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেন- ইহা হচ্ছে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কিরামত বা মর্যাদা।
সতর্কবাণী
=====
অতঃপর দেখেছি ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন খালফ আল উবাই ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে এই মাসআলার উপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি- ان ابى واباك فى النار অর্থ আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ এ হাদিসের অধীনে ইমাম নবভীর উক্তি উল্লেখ করেছেন। নবভী বলেন- যে ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী এবং তার নিকটাত্মীয়গণ তার কোন উপকার করতে পারবে না।
অতঃপর আল উবাই বলেন- আমি বলব এই সম্বোধনটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
এমনিভাবে সুহাইলী বলেছেন- এভাবে মন্তব্য করা আমাদের জন্য উচিত নয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لا تؤذوا الاحياء بسب الاموات
অর্থ: তোমরা মৃতদেরকে গালি দেয়ার মাধ্যমে জীবিতদেরকে কষ্ট দিও না।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله অর্থ: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত। (আহযাব- ৫৭)
সম্ভবত এজন্য ইহা সঠিক যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তাঁর পিতামাতাকে জীবিত করে দিলেন। অতঃপর তারা নবীজীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। কারণ আল্লাহর নিকট কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
অতঃপর তিনি ইমাম নবভীর উক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন- এমনিভাবে যে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণ করছে ঐ বিশ্বাসের উপর যার উপর আরবগণ ছিল অর্থাৎ মূর্তিপূজক হিসেবে সেও জাহান্নামী।
আর এ শাস্তি এ জন্য নয় যে, তার নিকট কোন দাওয়াত পৌঁছেনি। বরং তাদের নিকট ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীদের দাওয়াত পৌঁছেছে।
অতঃপর আল উবাই বলেন, আমি বলব তার বক্তব্যের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ যার নিকট দাওয়াত পৌঁছেছে তারা আহলে ফাতরাত নয়। কেননা আহলে ফাতরাত হল ঐ সমস্ত লোক যারা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়ে ছিলেন। পূর্বেকার নবী তাদের প্রতি প্রেরিত হননি। আবার পরবর্তী নবীকেও তারা পাননি। যেমন আরবজাতী, তাদের প্রতি ঈসা আলাইহি সালামকে প্রেরণ করা হয়নি। আবার তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাতও পায়নি।
এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ফাতরাত বললে ঐ যুগকে বুঝায় যা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়।
কিন্তু ফুকাহায়ে কিরামগণ যখন ফাতরাত সম্পর্কে আলোচনা করেন তখন তারা শুধুমাত্র ঈসা আলাইহিস সালাম ও আমাদের নবীর মধ্যবর্তী সময়কে নির্দিষ্ট করেন।
অতএব যখন অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত হল যে, হুজ্জত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কোন শাস্তি নাই। তখন আমরা বুঝতে পারলাম তাদের কোন শাস্তি হবে না।
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين - والصلوة والسلام على اشرف الانبياء والمرسلين- وعلى اله واصحابه اجمعين-
♦মূলঃ ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী রহমাতাল্লাহি আলাইহি
মাসআলা
=====
নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতা সম্বন্ধে শরয়ি হুকুম হল তাঁরা উভয়ে নাজাতপ্রাপ্ত এবং তাঁরা জাহান্নামী নন। অনেক উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। এ মাসআলার উপর আলোচনাকারীদের পক্ষ থেকে কয়েকটি মসলক বা অভিমত প্রকাশ পেয়েছে।
এ মাসআলার উপর উলামায়ে কেরামদের প্রথম মসলক বা অভিমত
==================
প্রথম মসলক বা অভিমত হল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং তাদের উপর কোন আযাব হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (সূরা বনি ইসরাইল- ১৫)
আমাদের আশআরী ইমামদের মধ্যে আকাইদ ও উসুলবিদগণ এবং শাফেয়ী মাযহাবের ফোকাহাগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দাওয়াত পৌঁছার পূর্বে যদি কেউ মুত্যুবরণ করে তাহলে সে নাজাতপ্রাপ্ত হবে। এবং ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। এমতাবস্থায় যদি তাকে হত্যা করা হয় তাহলে এর রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে।
ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ তাঁর অনুসারীবৃন্দ এর উপর দলিল প্রয়োগ করেছেন। বরং কোন কোন অনুসারীগণ বলেছেন এমতাবস্থায় কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা প্রয়োগ করতে হবে। তবে বিশুদ্ধ মত হল এক্ষেত্রে কিসাস প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ সে প্রকৃত অর্থে মুসলমান নয়। এবং কিসাসের জন্য শর্ত হলো উভয় ব্যক্তি সমপর্যায়ের হতে হবে।
এজন্য কোন কোন ফোকাহাগণ বলেছেন- এমতাবস্থায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার শাস্তি হবে না। কারণ সে ফিতরাতের উপর ছিল এবং তার প থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি। এবং তার কাছে এমন কোন রাসূল আগমন করেননি যাকে সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।
এই মসলক বা অভিমতের মধ্যে সর্বপ্রথম যার অভিমত শুনেছি তিনি হচ্ছেন শাইখুল ইসলাম শরফুদ্দিন আল মানাওয়ী। তাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হল ‘তিনি কি জাহান্নামী?’ এতে তিনি প্রশ্নকারীকে কঠোরভাবে ধমক দিলেন। অতঃপর প্রশ্নকারী বললেন- তাঁর ইসলাম সম্বন্ধে কোন প্রমাণ আছে কি? জবাবে তিনি বললেন- নবীজীর পিতা ফাতরাতের যুগে ইন্তেকাল করেছেন এবং নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে কোন শাস্তি নেই।
সিবত ইবনুল জুযি তাঁর কিতাব ‘মিরআতুয যামানে’ একটি জামাত থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। তিনি তার দাদার সূত্রে নবীজীর মায়ের পুনর্জীবনসংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অতঃপর বলেন- এ ব্যাপারে দলিল হল আল্লাহতায়ালার বাণী-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নেই। সুতরাং তাদের কোন গোনাহ নেই। এ বিষয়টি উবাই তাঁর ‘শরহে মুসলিম’ কিতাবে শক্তভাবে বর্ণনা করেছেন। তার ইবারতটুকু আমি অচিরেই উল্লেখ করব।
আহলে ফাতরাত বা ফাতরাতের অধিবাসীদের সম্বন্ধে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামত দিবসে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। আর আয়াতে কারীমাগুলোও ইঙ্গিত বহন করে যে তাদের কোন শাস্তি হবে না।
এ মতটিই গ্রহণ করেছেন তৎকালীন যুগের হাফিজুল হাদিস শাইখুল ইসলাম আবুল ফদল বিন হাজর। তিনি তাঁর কোন একটি কিতাবে উল্লেখ করেছেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার-পরিজন যারা নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটাত্মীয় হবার দরুণ তাঁর সম্মানার্থে সে পরীায় আনুগত্য প্রকাশ করবেন।
অতঃপর তাকে দেখেছি তিনি ‘ইসাবা’ গ্রন্থে বলেছেন- এ ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, অধিক বৃদ্ধ ব্যক্তি, ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী, জন্ম থেকে অন্ধ, বোবা ও বধির ব্যক্তি, জন্ম থেকে পাগলব্যক্তি, অথবা নাবালিগ অবস্থায় পাগলব্যক্তি এ রকম অন্যান্য সকল ব্যক্তিবর্গ দলিল হিসেবে দাবি করবে যে, যদি আমি সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন হতাম অথবা যদি আমাকে স্মরণ করানো হতো তবে আমি ঈমান আনয়ন করতাম।
তখন তাদের জন্য অগ্নি প্রজ্বলিত করে বলা হবে এতে প্রবেশ কর। তখন যে ব্যক্তি আগুনে প্রবেশ করবে সে শান্তি ও শীতলতা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলোর ইহাই ভাবার্থ।
তিনি বলেন- এ সমস্ত রেওয়ায়েতগুলো আমি স্বতন্ত্রভাবে সন্নিবেশিত করেছি। আমরা আশা করি আব্দুল মোত্তালিব ও তার পরিবারবর্গ তাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন যারা আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিপ্রাপ্ত হবেন। তবে আবু তালিব ব্যতিত। কারণ তিনি নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু ঈমান আনয়ন করেননি। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে তিনি জাহান্নামের লেলিহান শিখার মধ্যে থাকবেন।
কিয়ামতের দিন পরীা নেওয়ার বিষয়টি আমি প্রথম মসলকের অন্তর্ভুক্ত করেছি। যদিও বাহ্যিকভাবে ইহা স্বতন্ত্র মসলকের দাবিদার। কিন্তু আমি ইহাকে এমন সুক্ষ্ণ অর্থবিশিষ্ট পেয়েছি যা জ্ঞানবানদের নিকট অস্পষ্ট নয়।
আয়াত- ১.
=====
আল্লাহতায়ালার বাণী-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (সূরা বনি ইসরাইল- ১৫)
এ আয়াত দ্বারা আহলে সুন্নাতের ইমামগণ দলিল পেশ করেন যে, নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে কোন আযাব নেই এবং এ আয়াত দ্বারা সুন্নি ইমামগণ মু’তাজিলা ও তাদের অনুগামী সম্প্রদায়ের মতবাদ খণ্ডন করেন। তাদের দাবি হলো আকল তথা বুদ্ধিমত্তার উপর ফয়সালা করা হবে।
ইবনে জারির এবং ইবনে আবি হাতিম স্ব-স্ব তাফসির গ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال ان الله ليس بمعذب احدا حتى يسبق اليه من الله خبر او تأتيه من الله بينة-
অর্থ: তিনি বলেন- আল্লাহতায়ালা ততণ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি প্রদান করেন না যতণ পর্যন্ত তার নিকট আল্লাহর পক্ষে থেকে কোন সংবাদ বা কোন প্রমাণ না পৌঁছবে।
আয়াত- ২.
=====
আল্লাহর বাণী-
ذلك ان لم يكن ربك مهلك القرى بظلم واهلها غفلون-
অর্থ: এটা এজন্য যে আপনার প্রতিপালক কোন জনপদের অধিবাসীদেরকে জুলুমের কারণে ধ্বংস করেন না এমতাবস্থায় যে তথাকার অধিবাসীরা অজ্ঞ থাকে। (আনআম- ১৩১)
ইমাম যারকাশী এ আয়াতটিকে তাঁর شرح جمع الجوامع কিতাবে ঐ মূলনীতির দলিল হিসেবে পেশ করেছেন যে, আকলী তথা বুদ্ধিভিত্তিক দলিল দ্বারা নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব হয় না। বরং ছেমায়ী বর্ণিত দলিল প্রয়োজন।
আয়াত- ৩.
=====
আল্লাহর বাণী-
ولو لا ان تصيبهم مصيبة بما قدمت ايديهم فيقولوا ربنا لو لا ارسلت الينا رسولا فنتبع ايتك ونكون من المؤمنين-
অর্থ: আর এজন্য যে, তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের কোন বিপদ হলে তারা বলতো হে আমাদের পালনকর্তা আপনি আমাদের কাছে কোন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? করলে আমরা তোমার আয়াতসমূহের অনুসরণ করতাম এবং আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারী হয়ে যেতাম। (সূরা কাসাস- ৪৭)
উক্ত আয়াতটিও ইমাম যারকাশী রেওয়ায়েত করেছেন। তাছাড়া ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসিরগ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান সনদে আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الها لك فى الفترة يقول رب لم يأتنى كتاب ولا رسول- ثم قرء هذه الاية-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি বলবে- হে প্রতিপালক আমার কাছে কোন কিতাব কিংবা কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর নবীজী উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।
আয়াত- ৪.
=====
আল্লাহর বাণী-
ولو انا اهلكنهم بعذاب من قبله لقالوا ربنا لولا ارسلت الينا رسولا فنتبع ايتك من قبل ان نذل ونخزى-
অর্থ: যদি আমি এদেরকে ইতোপূর্বে কোন শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম, তবে এরা বলত হে আমাদের পালনকর্তা আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? তাহলেতো আমরা অপমানিত ও হেয় হবার পূর্বেই আপনার নির্দেশসমূহ মেনে চলতাম। (ত্ব-হা- ১৩৪)
ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এ আয়াতের অধীনে আতিয়্যাহ আল উফি থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال- الهالك فى الفترة يقول رب لم يأتنى كتاب ولا رسول
অর্থ: তিনি বলেন ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি বলবে হে রব আমার কাছে কোন কিতাব কিংবা কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।
আয়াত- ৫.
=====
আল্লাহর বাণী-
وما كان ربك مهلك القرى حتى يبعث فى امها رسولا يتلوا عليهم ايتنا-
অর্থ: আপনার পালনকর্তা জনপদসমূহকে ধ্বংস করেন না যে পর্যন্ত তার কেন্দ্রস্থলে কোন রাসূল প্রেরণ না করেন। যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন। (কাসাস- ৫৯)
ইবনে আবি হাতিম উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قال لم يهلك الله ملة حتى يبعث اليهم محمدا صلى الله عليه وسلم فلما كذبوا وظلموا بذالك هلكوا-
অর্থ: তারা উভয়ে বলেন- আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ না করা পর্যন্ত তার জাতিকে ধ্বংস করেননি। অতঃপর যখন তারা নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং তাঁর উপর যুলুম করল তখন তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো।
আয়াত- ৬.
=====
আল্লাহর বাণী-
وهذا كتاب انزلنه مبرك فاتبعوه واتقوا لعلكم ترحمون- ان تقولوا انما انزل الكتاب على طائفتين من قبلنا- وان كنا عن دراستهم لغفلين-
অর্থ: ইহা এমন একটি গ্রন্থ যা আমি অবতীর্ণ করেছি খুব বরকতপূর্ণ। অতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর যাতে তোমরা করুণা প্রাপ্ত হও। এ জন্য যে কখনো তোমরা বলতে শুরু কর, গ্রন্থতো কেবল আমাদের পূর্ববর্তী দু’সম্প্রদায়ের প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছে এবং আমরা সেগুলোর পাঠ ও পঠন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। (আনআম- ১৫৫-১৫৬)
আয়াত- ৭.
=====
আল্লাহর বাণী-
وما اهلكنا من قرية الا لها منذرون- ذكرى وما كنا ظلمين-
অর্থ: আমি কোন জনপদ ধ্বংস করিনি, কিন্তু এমতাবস্থায় যে, তার সতর্ককারী ছিল। স্মরণ করানোর জন্য এবং আমার কাজ অন্যায় আচরণ নয়। (সূরা- শুআরা, ২০৮-২০৯)
হযরত আব্দ বিন হুমাইদ, হযরত ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে তাদের তাফসিরগ্রন্থে হযরত কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন-
ما اهلك الله من قرية الا من بعد الحجة والبينة والعذر حتى يرسل الرسل وينزل الكتب تذكرة لهم وموعظة وحجة لله ذكرى وما كنا ظالمين-
অর্থ: আল্লাহতায়ালা ততণ পর্যন্ত কোন জনপদকে ধ্বংস করেন না যতণ পর্যন্ত তাদের নিকট কোন রাসূল সুস্পষ্ট প্রমাণ ও কিতাবাদীসহ আগমন করে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন না করেন। যেমন আল্লাহর বাণী- স্মরণ করানোর জন্য এবং আমার কাজ অন্যায় আচরণ নয়।
আয়াত- ৮.
=====
আল্লাহর বাণী-
وهم يصطرخون فيها- ربنا اخرجنا نعمل صالحا غير الذى كنا نعمل- او لم نعمركم ما يتذكر فيه من تذكر وجاء كم النذير-
অর্থ: সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবেন হে আমার রব আমাদেরকে বের করুন, আমরা সৎকাজ করব। পূর্বে যা করতাম তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদের এতটা বয়স দেইনি যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। (ফাতির- ৩৭)
মুফাসসিরীনে কিরামগণ বলেন- উক্ত আয়াতে নাযির বা সতর্ককারী বলতে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে।
নিম্নে সে সমস্ত হাদিস উল্লেখ করা হল যা প্রমাণ করে যে, কিয়ামতের দিবসে ফাতরাতের যুগের লোকদেরকে পরীক্ষা করা হবে। তখন যারা আনুগত্য প্রকাশ করবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর যারা নাফরমানী করবে তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
হাদিস- ১.
=====
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ইসহাক বিন রাহওয়ায় স্বীয় মসনদ গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাকী ‘কিতাবুল ইতেকাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বায়হাকী ইহাকে সহীহ বলেছেন-
عن الاسود بن سريع- ان النبى صلى الله عليه وسلم قال اربعة يمتحنون يوم القيامة- رجل اصم لايسمع شيأ- ورجل احمق ورجل هرم ورجل مات فى فترة فاما الاصم فيقول رب لقد جاء الاسلام وما اسمع شيأ- واما الاحمق فيقول رب لقد جاء الاسلام والصبيان يحذفونى بالبعر- واما الهرم فيقول رب لقد جاء الاسلام وما اعقل شيأ- واما الذى مات فى الفترة فيقول رب ما اتانى لك رسول فيأخذ مواثيقهم ليطيعنه فيرسل اليهم ان ادخلوا النار فمن دخلها كانت عليه بردا وسلاما ومن لم يدخلها يسحب اليها-
অর্থ: আসওয়াদ বিন সারি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামদের দিন চার প্রকার লোকের কাছ থেকে পরীা নেয়া হবে। ১. বধির ব্যক্তি, যে কিছুই শুনতে পায় না। ২. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তি। ৩. অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। ৪. এবং ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি।
অতএব বধির ব্যক্তি বলবে হে প্রভু, ইসলাম এসেছিল কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাইনি। বোকা ব্যক্তি বলবে, প্রভূ ইসলাম এসেছিল কিন্তু আমি অনুধাবন করতে পারিনি। অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি বলবে হে প্রভূ এব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী বলবে, হে প্রভু আমার কাছে তোমার কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর তাদেরকে পরীা করা হবে এবং বলা হবে জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন যে ব্যক্তি আগুনে প্রবেশ করবে তার প্রতি শীতল শান্তি বর্ষিত হবে। আর যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে না তাকে জাহান্নামে নিপে করা হবে।
হাদিস-২.
=====
ইমাম আহমদ, ইসহাক বিন রাহ্ওয়ায় তাদের মসনাদ গ্রন্থে, ইবনে মারদুভীয়াহ স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাকী ‘কিতাবুল ইতেক্বাদ’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان النبى صلى الله عليه وسلم قال اربعة يمتحنون
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- চার শ্রেণির লোকদেরকে পরীা করা হবে। হাদিসের বাকী অংশ পূর্বে বর্ণিত আসওয়াদ বিন সারি কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের অনুরূপ।
হাদিস- ৩.
=====
ইমাম বাযযার স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤتى بالهالك فى الفترة والمعتوه والمولود- فيقول الها لك فى الفترة لم يأتنى كتاب ولا رسول ويقول المعتوه اى رب لم تجعل لى عقلا اعقل به خيرا ولا شرا ويقول المولود لم ادرك العمل- قال فيرفع لهم نار فيقال لهم ردوها او قال ادخلوها فيدخلها من كان فى علم الله سعيدا لو ادرك العمل- ويمسك عنها من كان فى علم الله شقيا لو ادرك العمل- فيقول تبارك وتعالى اياى عصيتم فكيف برسلى بالغيب-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ফাতরাতের যুগে মৃত্যুপ্রাপ্ত, মস্তিষ্ক বিকৃত এবং শিশুকালে নিহত ব্যক্তিদেরকে উপস্থাপন করা হবে। ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি বলবে আমার কাছে কোন কিতাব বা কোন রাসূল আগমন করেননি। মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি বলবে হে প্রভু, আমার ভাল মন্দ বুঝার মত কোন জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না। শিশুকালে মৃত্যুপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলবে আমি আমল করার মত অবকাশ পাইনি।
অতঃপর তাদের জন্য আগুন প্রস্তুত করা হবে। এবং বলা হবে এতে প্রবেশ কর। তখন আল্লাহর ইলমে যারা সৌভাগ্যশীল অর্থাৎ অবকাশ পেলে আমল করত তারা আগুনে প্রবেশ করবে। কিন্তু আল্লাহর ইলমে যারা দূর্ভাগা সময় পেলেও আমল করত না, তারা প্রবেশ করবে না। তখন আল্লাহতায়লা বলবেন- তোমরা সরাসরি আমার হুকুম অমান্য করেছ। অতএব আমাকে না দেখে কিভাবে আমার রাসূলের আনুগত্য করবে?
উল্লেখিত হাদিসের সনদে ‘আতিয়্য আল উফি’ বর্ণনাকারী রয়েছেন। তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তবে ইমাম তিরমিজি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।
এ হাদিসের পে আরো অনেক হাদিস রয়েছে যা এ হাদিসটিকে হাসান এবং শক্তিশালী হবার প্রমাণ বহন করে।
হাদিস- ৪.
=====
ইমাম বাযযার ও আবু ইয়ালা তাদের মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤتى باربعة يوم القيامة- بالمولود والمعتوه ومن مات فى الفترة وبالشيخ الفانى كلهم يتكلم بحجته- فيقول الله تعالى لعنق من جهنم ابرزى فيقول لهم انى كنت ابعث الى عبادى رسلا من انفسهم وانى رسول نفسى اليكم ادخلوا هذه- فيقول من كتب الله عليه الشفاء- يا رب اتدخلناها ومنها كنا نفرق ومن كتب له السعادة فيمضى فيقتحم فيها مسرعا- فيقول الله قد عصيتمونى فانتم لرسلى اشد تكذيبا ومعصية فيدخل هؤلاء الجنة وهؤلاء النار-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কিয়ামতের দিন চার শ্রেণির লোকদেরকে আনয়ন করা হবে। ১. নাবালেগ সন্তান। ২. মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি। ৩. ফাতরাতের সময় মৃত্যুবরণকারী ও ৪. অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। তখন আল্লাহতায়ালা জাহান্নামকে আদেশ করবেন উত্তপ্ত হবার জন্য। অতঃপর বলবেন আমি আমার বান্দাদের প্রতি তাদের মধ্যে থেকে রাসূল প্রেরণ করেছি। আমি স্বয়ং তোমাদের প্রতি রাসুল হয়ে হুকুম দিচ্ছি জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন যারা দুর্ভাগা তারা বলবে- হে প্রভু আপনি কি আমাদেরকে আগুনে প্রবেশ করাবেন? আমরা তো আগুনকে ভয় করি। আর যাদের নসিবে কল্যাণ নিহিত রয়েছে সে আগুনের দিকে দ্রুত গমন করবে। তখন আল্লাহ বলবেন- তোমরা আমার অবাধ্যতা করেছ অতএব তোমরা আমার রাসূলের অধিক অবাধ্যতা করতে। তখন তাদেরকে জাহান্নামে এবং এদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।
হাদিস- ৫.
=====
আব্দুর রাজ্জাক ইবনে জারির ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال اذا كان يوم القيامة جمع الله اهل الفترة والمعتوه والاصم والابكم والشيوخ الذين لم يدركوا الاسلام ثم ارسل اليهم رسولا ان ادخلوا النار- فيقولون كيف ولم تأتنا رسل؟ قال وايم الله لو دخلوها لكانت عليهم بردا وسلاما ثم يرسل اليهم فيطيعه من كان يريد ان يطيعه- قال ابوهريرة اقرؤوا ان شئتم (وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا)
অর্থ: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা ফাতরাতের যুগের অধিবাসী, পাগল, বধির, বোবা ও অতিশয় বৃদ্ধ যে ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই অনুধাবন করতে পারেনি, তাদের প্রত্যেককে একত্রিত করবেন। অতঃপর তাদের প্রতি একজন ফেরেশতা পাঠাবেন তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানোর জন্য। তখন তারা বলবে এটা কিভাবে সম্ভব? অথচ আমাদের কাছে কোন রাসূল আসেননি। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- আল্লাহর কসম যদি তারা তখন জাহান্নামে প্রবেশ করত তাহলে তাদের প্রতি শান্তি ও শীতলতা অবতীর্ণ হত। অতঃপর তাদের কাছে আবার পাঠনো হবে। তখন যারা আনুগত্যকারী তারা আনুগত্য প্রকাশ করবে। অতঃপর আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- যদি তোমরা চাও তবে এ আয়াতটি পড়ে নাও। وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (বনি ইসরাইল-১৫)
এ হাদিসটির সনদ বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ।
হাদিস- ৬.
=====
ইমাম বাযযার এবং ইমাম হাকিম স্বীয় মুস্তাদরাক গ্রন্থে হযরত ছাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- কিয়ামতের দিন জাহিলিয়াত যুগের লোকগণ তাদের গোনাহসমূহ পিঠে নিয়ে আগমন করবে। তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন। জবাবে তারা বলবে হে আমাদের রব আমাদের কাছে কোন রাসূল কিংবা আপনার কোন বিধান আগমন করেনি। যদি আমাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করতেন তাহলে আমরা আপনার অনুগত বান্দা হতাম।
অতঃপর আল্লাহতায়ালা বলবেন- তোমরা কি জান যে, আমার নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়? তারা বলবে হ্যাঁ।
অতঃপর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হবে জাহান্নামে প্রবেশ করার জন্য। তখন তারা জাহান্নামের দিকে গমন করবে। যখন জাহান্নামের নিকটবর্তী হবে তখন তারা এর ভয়াবহ গর্জন ও হুংকার শুনতে পাবে। তখন সবাই তাদের প্রভুর কাছে ফিরে আসবে এবং বলবে হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করুন।
তখন তিনি বলবেন- তোমরা কি জাননা যে আমার নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়? অতঃপর এ ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। আল্লাহ বলবেন- যাও জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন সবাই সেদিকে গমন করবে। যখন তারা জাহান্নাম দর্শন করবে তখন প্রত্যাবর্তন করে আসবে এবং বলবে- হে আমাদের রব আমাদেরকে রা কর। আমরা এতে প্রবেশ করতে পারব না। তখন আল্লাহ বলবেন- যাও অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ কর।
অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- যদি তারা প্রথমেই জাহান্নামে প্রবেশ করত তাহলে তাদের উপর শান্তি ও শীতলতা বর্ষিত হত।
ইমাম হাকিম বলেন এ হাদিসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহিহ।
হাদিস- ৭.
=====
ইমাম তাবরানী ও আবু নঈম হযরত মায়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- কিয়ামতের দিন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি, ফাতরাতের সময় নিহত এবং বাল্যকালে নিহত ব্যক্তিদেরকে আনয়ন করা হবে।
তখন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তি বলবে, হে প্রভু, যদি আমাকে বুদ্ধি প্রদান করতেন। যাদেরকে বুদ্ধি প্রদান করেছেন তারা আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যশীল হয়েছে। ঠিক এমনিভাবে ফাতরাতের সময় নিহত ও বাল্যকালে নিহত ব্যক্তি আপত্তি করবে।
তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন- আমি তোমাদেরকে আদেশ করব তোমরা তা মান্য করবে তো? তারা বলবে হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন তবে যাও জাহান্নামে প্রবেশ কর। নবীজী বলেন- যদি তারা প্রবেশ করে তাহলে তাদের কোন তি হবে না। অতঃপর তাদের জন্য জাান্নামের উত্তপ্ত পানি প্রস্তুত করা হবে। তখন তাদের মনে হবে যেন আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিরাজি ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তারা দ্রুতগতিতে ফিরে আসবে। অতঃপর তাদেরকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়া হবে। তথাপি তারা প্রত্যাবর্তন করবে। তখন প্রভূ বলবেন- তোমাদের সৃষ্টির পূর্বেই আমি জানতাম তোমরা কি আমল করবে এবং তোমাদের কি পরিণতি হবে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে।
আল কিয়া আল হিরাসীর অভিমত: আল কিয়া আল হিরাসী স্বীয় উসূল গ্রন্থে নিয়ামতের শোকরিয়া সংক্রান্ত মাসআলার অধীনে বলেছেন- জেনে রাখুন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমামদের মূলনীতি হল শরয়ী দলিল ব্যতিত কোন আহকাম প্রতিষ্ঠা হয় না। শুধুমাত্র বুদ্ধিভিত্তিক ফয়সালা দ্বারা হুকুম সাব্যস্ত হয় না। অতএব সর্বপ্রথম যারা এ ব্যাপারে আহলে হকের সাথে বিরোধিতা করেছেন তারা হলেন রাফেজী, কারামিয়া ও মুতাজিলা প্রমূখ। তাদের মতে আহকাম কয়েক প্রকার। তার মধ্যে একটি হল, যা শরয়ী দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অন্যটি হল যা বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত।
আল হিরাসী বলেন আমাদের মতে কোন রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত কিছুই ওয়াজিব হয় না। অতএব যখন রাসূল আগমন করে মুজিযা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে চিন্তা গবেষণা করা সম্ভব।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় ‘আল মাহসুল’ গ্রন্থে বলেছেন, যুক্তিভিত্তিক দলিল দ্বারা ‘নিয়ামতের শোকরিয়া’ ওয়াজিব সাব্যস্ত হয় না। তবে এক্ষেত্রে মুতাজিলাদের মতামত আমাদের ব্যতিক্রম। যদি নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয় তাহলে তার অস্বীকারকারীকে এমন কারণে শাস্তি দেওয়া হবে যা আবশ্যক নয়। এখানে মতানৈক্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট। তাকে যে শাস্তি দেয়া হবে না তা আল্লাহর বাণীতেই রয়েছে। وما كنامعذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
উক্ত আয়াতে নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত শাস্তি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তথাপি যদি শাস্তি প্রদান করা হয় তাহলে আল্লাহর কথার মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা দিবে। যা অসম্ভব।
এ অভিমতটি الحاصل والتحصيل গ্রন্থের মুসান্নিফ এবং ইমাম বায়জাভী তাঁর ‘মিনহাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
কাজী তাজ উদ্দিন সুবুকি (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম সুবুকি রাদিয়াল্লাহু আনহু شرح مختصر ابن الحاجب কিতাবে নিয়ামতের শোকরিয়াসংক্রান্ত মাসআলায় বলেছেন- যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই আমাদের মাযহাব অনুযায়ী তারা নাজাতপ্রাপ্ত হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। যদি হত্যা করা হয়, তবে রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে। তবে হত্যাকারীর উপর কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা ওয়াজিব হবে না। ইহাই বিশুদ্ধ মত।
ইমাম বগভী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম বগভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘তাহযিব’ গ্রন্থে বলেছেন যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে এক্ষেত্রে কাফফরা ও রক্তপণ আবশ্যক হবে।
ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মতে এ হত্যার জন্য রক্তপণ আবশ্যক হবে না। কারণ তার আকল তথা বুদ্ধির উপর দলিল প্রয়োগ করা হবে। তবে আমাদের মতে দাওয়াত পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
অতএব প্রমাণিত হল যে, রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত নাই।
এমনিভাবে ইমাম রাফেয়ী বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মত ব্যতিক্রম। তাঁর নিকট এই ব্যতিক্রমের মূল ভিত্তি হল, সে ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের নিকট যার কাছে দাওয়াত পৌঁছে নাই তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
ইমাম গাজ্জালী (রা.) এর অভিমত
============
ইমাম গাজ্জালী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘আল বাসিত’ গ্রন্থে বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তার হত্যার জন্য কাফফারা ও রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যা করা যাবে না ইহাই বিশুদ্ধ মত। কেননা হাকিকী অর্থে সে মুসলিম নয়। শুধুমাত্র অর্থগতভাবে সে মুসলিম। এমনিভাবে ইবনে রিফায়া বলেছেন ‘আল কিফায়া’ গ্রন্থে কেননা সে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে জন্মগ্রহণকারী এবং তার থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি।
ইমাম নবভী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম নববী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে মুশরিক শিশুদের মাসআলায় বলেছেন- এব্যাপারে মুহাক্কিক উলামাযে কেরামদের সহিহ অভিমত হল মুশরিকদের শিশুগণ জান্নাতী। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করে আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। তিনি বলেন-দাওয়াত না পৌঁছার কারণে যদি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে আযাব না দেওয়া হয় তাহলে অপ্রাপ্ত শিশুদের বেলায়ও আযাব হবে না।
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
==========
ইমাম সুয়ুতি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- তুমি যদি প্রশ্ন কর উল্লেখিত মসলক বা অনুসারীদের যে মতামত আপনি উল্লেখ করেছেন তা কি জাহিলিয়াত যুগের সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য?
জবাবে আমি বলব ‘না’। বরং ইহা শুধুমাত্র তাদের জন্য নির্দিষ্ট যাদের নিকট প্রকৃত পে কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছে নাই। কেননা যার নিকট পূর্ববর্তী কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছেছে, তথাপি সে কুফুরির উপর অটল ছিল সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে, এতে কোন মতবিরোধ নেই।
অতএব রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতার ব্যাপারটি সুস্পষ্ট। উল্লেখিত মসলকটি এ অভিমতই গ্রহণ করেছেন যে, তাদের কাছে কোন দাওয়াত পৌঁছে নাই। আর এর পিছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। যেমন তাদের যুগ ছিল অনেক পরবর্তী যুগ এবং তাদের ও পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যখানে ছিল বিরাট ব্যবধান। যেমন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে সর্বশেষ নবী ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি ও আমাদের নবীর মধ্যখানে ফাতরাতের সময় ছিল প্রায় ছয়শত বছর।
তথাপি নবীজীর পিতা-মাতার যুগ ছিল জাহিলিয়াতের যুগ। পূর্ব পশ্চিম, সমগ্র পৃথিবী জাহিলিয়াতে ঢেকে গিয়েছিল। হাতেগোনা কিছুসংখ্যক আহলে কিতাব পাদ্রী ব্যতিত শরিয়ত সম্বন্ধে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ছিল না। তদুপরি তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। যেমন শ্যাম ও অন্যান্য দেশ। মদিনাশরীফ ছাড়া অন্য কোন দেশে নবীজীর পিতা-মাতা ভ্রমণ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া তারা উভয়ে এমন লম্বা হায়াতও পাননি যাতে করে এ ব্যাপারে অধিক খোঁজখবর করতে পারেন। কেননা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা সামান্য কিছু দিনের হায়াত পেয়েছিলেন।
হাফিজ সালাহউদ্দিন আল আলায়ীর অভিমত
==========
ইমাম হাফিজ সালাহ উদ্দিন আল আলায়ী الدرة السنية فى مولد سيد البرية কিতাবে বলেছেন, মা আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গর্ভধারণ করেন তখন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বয়স মাত্র আঠারো বৎসর। অতঃপর তিনি খেজুর সংগ্রহের জন্য মদিনাশরীফ গমন করেন এবং সেখানে মামার বাড়ি বনি নাজ্জার গোত্রে ইন্তেকাল করেন।
মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহাও প্রায় একই রকম বয়স পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পর্দাশীল মহিলা। তিনি সবসময় পুরুষদের মেলামেশা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বাড়িতে অবস্থান করতেন। তখনকার অধিকাংশ মহিলারাই জানতেন না ধর্মীয় ও শরিয়তের ব্যাপারে পুরুষদের কি দায়িত্ব। বিশেষ করে জাহিলিয়াতের যুগে পুরুষগণও জানতেন না মহিলাদের উপর তাদের কি প্রাধান্য রয়েছে। এজন্য যখন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হলেন তখন আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলো ابعث الله بشرا رسولا অর্থ: আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন (ইসরা- ৯৪) এবং তারা বলতো-
ولو شاءالله لانزل ملئكة ما سمعنا بهذا فى ابائنا الاولين-
অর্থ: আল্লাহ ইচ্ছা করলে ফেরেশতাই নাজিল করতেন। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এরূপ কথা শুনিনি। (মুমিনুন- ২৪)
অতএব যদি তাদের নিকট রাসূল প্রেরণের জ্ঞান থাকতো তবে তারা ইহা অস্বীকার করতো না। আবার কখনো তারা ধারণা করত তারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর শরিয়তের উপরেই আছে। কারণ ইব্রাহিমী শরিয়তের জ্ঞানসম্পন্ন কারো সাাত তারা পায়নি। কেননা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তাদের মধ্যখানে প্রায় তিনহাজার বছরের অধিক ব্যবধান ছিল।
অতএব এ আলোচনার দ্বারা ইহাই স্পষ্ট হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা এ মসলকেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম (রা.) এর অভিমত
==========
শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেন- আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতিত অন্যান্য সমস্ত নবীগণ শুধুমাত্র তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিই প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন এ মূলনীতি অনুযায়ী আহলে ফাতরাতের সমস্ত অধিবাসীগণ তাদের পূর্ববর্তী নবীর বংশধর। তাদের পূর্ববর্তী নবীর দিকে সম্বোধন করা হয়। এবং তারা তাদের পূর্ববর্তী শরিয়তকে অনুসরণ করেন। অতএব তারাই হলেন আহলে ফাতরাত।
উক্ত আলোচনা দ্বারা ইহাই সুস্পষ্ট হয় যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতা আহলে ফাতরাতের অন্তর্ভুক্ত এতে কোন সন্দেহ নাই। কেননা তারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর বংশধর নয় এবং তার সম্প্রদায় এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইবনে হাজর আসকালনী (রা.) এর অভিমত
==========
হাফিজুল আসর আবুল ফজল বিন হাজর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতামাতা সম্বন্ধে যে ধারণা করা হয় তারা কিয়ামতের দিন পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হবেন এর দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে।
প্রথম ব্যাখ্যা
=====
ইমাম হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহু মুস্তাদরাক কিতাবে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলেছেন-
قال قال شاب من الانصار (لم ار رجلا كان اكثر سوالا لرسول الله صلى الله عليه وسلم منه) يا رسول الله أرأيت ابواك فى النار- فقال ما سألتها ربى فيطيعنى فيها وانى لقائم يومئذ المقام المحمود-
অর্থ: ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- একদা আনসারী এক যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল (ইবনে মাসউদ বলেন তার চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক প্রশ্ন করতে কাউকে দেখিনি) ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি কি মনে করেন, আপনার পিতা-মাতা জাহান্নামী? তখন তিনি বললেন- আমি তাদের সম্বন্ধে আমার প্রভুর নিকট যা চাইব আমাকে তাই দেয়া হবে। আর সেদিন আমি মাকামে মাহমুদে অবস্থান করব।
উল্লেখিত হাদিসটি প্রমাণ করে যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাকামে মাহমুদে অবস্থান করবেন তখন তিনি তাঁর পিতা-মাতার কল্যাণ কামনা করবেন। আর তা হল যখন আহলে ফাতরাতদেরকে পরীক্ষা করা হবে তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করবেন যেন তারা উভয়ে পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হন। এতে কোন সন্দেহ নাই যখন নবীজী মাকামে মাহমুদে সমাসীন হবেন তখন তাকে বলা হবে سل تعط واشفع تشفع অর্থ: আপনি সুয়াল করুন, দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, কবুল করা হবে। ইহা সহিহ হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব যখন তিনি পিতা-মাতার ব্যাপারে সুয়াল করবেন তখন তা কবুল হবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা
=====
ইবনে জারির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে-ولسوف يعطيك ربك فترضى আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন-
قال من رضا محمد صلى الله عليه وسلم ان لايدخل احد من اهل بيته النار
অর্থ: ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনÑ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেযা বা সন্তুষ্টি হচ্ছে তাঁর পরিবারের কোন সদস্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। এজন্য হাফিজ ইবনে হাজর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার উক্তিতে বলেছেন-
الظن بال بيته كلهم ان يطيعوا عند الامتحان
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার সম্বন্ধে ধারণা করা হয় যে, তারা প্রত্যেকেই পরীার সময় আনুগত্যশীল হবেন।
তৃতীয় হাদিস: হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু شرف النبوة গ্রন্থে এবং মুল্লা তার সীরাতগ্রন্থে ইমরান বিন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم سألت ربى ان لا يدخل النار احدا من اهل بيتى فاعطانى ذالك-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি আমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছি যেন আমার পরিবার থেকে কাউকে জাহান্নামে প্রবেশ না করান। অতঃপর আমাকে তা প্রদান করা হয়েছে।
এ হাদিসটি হাফিজ মুহিব উদ্দিন তাবারী তাঁর ذخائر العقبى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
আবু তালিবের জন্য শাফায়াত
==========
চতুর্থ হাদিস: এ হাদিসটি উল্লেখিত হাদিসদ্বয়ের চেয়ে অধিক স্পষ্ট। ইহা তামাম আর রাযি জয়িফ সনদে তাঁর فوائد গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كان يوم القيامة شفعت لابى وامى وعمى ابى طالب واخ لى كان فى الجاهلية-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি কিয়ামতের দিন আমার পিতা, মাতা, চাচা আবু তালিব ও আমার জাহিলিয়াতের যুগের ভাইয়ের জন্য শাফায়াত করব।
এ হাদিসটি ইমাম তাবারী ذخائر العقبى فى مناقب ذوى القربى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন হাফিজুল হাদিস ও ফকীহ। তিনি বলেন- এখানে আবু তালিবের ব্যাপারটি তাওয়িল বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফায়াতে আবু তালিবের আযাব হ্রাস করা হবে।
তবে এ তাওয়িলটি শুধুমাত্র আবু তালিবের ব্যাপারে প্রযোজ্য। অন্যান্য তিনজন তথা নবীজীর পিতা, মাতা ও দুধভাইয়ের জন্য আবশ্যক নয়। কেননা আবু তালিব নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত হায়াত পেয়েছিলেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেননি। অন্যান্য তিনজন ফাতরাতের সময়েই ইন্তেকাল করেছেন। এ হাদিসটি অন্য একটি সূত্রে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। যদিও এ সূত্রটি অধিক জয়িফ। যা আবু নাঈম সহ অন্যান্যগণ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে ভাই বলতে দুধভাইকে বুঝানো হয়েছে।
فهذه احاديث عدة يشد بعضها بعضا- فان الحديث الضعيف يتقوى بكثرة طرقه-
অর্থ: এ সমস্ত হাদিসগুলি একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। কেননা জয়িফ হাদিস যখন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয় তখন তা শক্তিশালী হয়ে যায়।
যার উদাহরণ হল ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস, ইমাম হাকিম ইহাকে সহিহ বলেছেন।
এ ব্যাপারটি ইবনে আবি দুনিয়ার বর্ণনা দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন কাসিম বিন হাশিম সিমসার, তিনি মাকাতিল বিন সুলাইমান রমলী থেকে, তিনি আবি মু’শার থেকে, তিনি সাঈদ মাকবারী থেকে, তিনি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلو سألت ربى ابناء العشرين من امتى فوهبهم لى-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি আমার প্রভূর কাছে আমার উম্মতের বিশবছর বয়সি যুবকদের জন্য প্রার্থনা করেছি। অতঃপর তিনি তাদেরকে আমাকে দান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বর্ণনা রয়েছে, যদিও ইহা আলোচনার সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। যা ইমাম দায়লামী হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اول من اشفع له يوم القيامة اهل بيتى ثم الاقرب فا لاقرب-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমি সর্বপ্রথম শাফায়াত করব আহলে বাইতের জন্য। অতঃপর নিকটাত্মীয়দের জন্য। অতঃপর তাদের নিকটাত্মীয়দের জন্য।
ইমাম তাবারী ذخائر العقبى গ্রন্থে এবং ইমাম আহমদ মানাকিব গ্রন্থে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا معشر بنى هاشم والذى بعثنى بالحق نبيا لو اخذت بحلقة الجنة ما بدأت الابكم-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- হে হাশিম সম্প্রদায়ের লোকেরা! সে সত্ত্বার কসম, যিনি আমাকে সত্য সহ নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আমি জন্নাতের কড়া ধারণ করি তাহলে আমি তোমাদেরকে নিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করব।
ইহা খতিব তাঁর তারিখ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এমনিভাবে আবুল বখতারী হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان رحمى لا ينتفع بلى حتى تبلغ حكم وهم احد قبيلتين من اليمن- انى لاشفع فاشفع حتى ان من اشفع له فيشفع حتى ان ابليس ليتطاول طمعا فى الشفاعة-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে যে, আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন উপকার করবে না। কিন্তু না অবশ্যই উপকার করবে। এমনকি ‘হুকুম’ সম্প্রদায় পর্যন্ত উপকৃত হবে। (হুকুম হল ইয়ামনের একটি গোত্র)। আমি শাফায়াত করব এবং যার জন্য শাফায়াত করব তা গ্রহণ করা হবে। শেষ পর্যন্ত ইবলিসও শাফায়াতের জন্য আকাক্সা করবে।
এমনিভাবে তাবরানী উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان النبى صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان شفاعتى لا تنال اهل بيتى وان شفاعتى تنال حاء وحكم-
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে আমার পরিবারগণ আমার শাফায়াত লাভ করবে না। নিশ্চয় আমার শাফায়াত ‘হা’ ও ‘হুকুম’ গোত্রদ্বয় পর্যন্ত লাভ করবে।
সূক্ষ্মকথা
=====
ইমাম যারকাশী ‘খাদিম’ গ্রন্থে ইবনে দাহইয়া থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি প্রতি সোমবারে আবু লাহাবের আযাব হ্রাসকরণকে শাফায়াতের প্রকারভেদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা হচ্ছে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদশরীফে খুশি হয়ে আবু লাহাব সুয়াইবা দাসীকে মুক্ত করেছিল, যখন সুয়াইবা তাকে এ সংবাদ প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেন- ইহা হচ্ছে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কিরামত বা মর্যাদা।
সতর্কবাণী
=====
অতঃপর দেখেছি ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন খালফ আল উবাই ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে এই মাসআলার উপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি- ان ابى واباك فى النار অর্থ আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ এ হাদিসের অধীনে ইমাম নবভীর উক্তি উল্লেখ করেছেন। নবভী বলেন- যে ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী এবং তার নিকটাত্মীয়গণ তার কোন উপকার করতে পারবে না।
অতঃপর আল উবাই বলেন- আমি বলব এই সম্বোধনটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
এমনিভাবে সুহাইলী বলেছেন- এভাবে মন্তব্য করা আমাদের জন্য উচিত নয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لا تؤذوا الاحياء بسب الاموات
অর্থ: তোমরা মৃতদেরকে গালি দেয়ার মাধ্যমে জীবিতদেরকে কষ্ট দিও না।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله অর্থ: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত। (আহযাব- ৫৭)
সম্ভবত এজন্য ইহা সঠিক যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তাঁর পিতামাতাকে জীবিত করে দিলেন। অতঃপর তারা নবীজীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। কারণ আল্লাহর নিকট কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
অতঃপর তিনি ইমাম নবভীর উক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন- এমনিভাবে যে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণ করছে ঐ বিশ্বাসের উপর যার উপর আরবগণ ছিল অর্থাৎ মূর্তিপূজক হিসেবে সেও জাহান্নামী।
আর এ শাস্তি এ জন্য নয় যে, তার নিকট কোন দাওয়াত পৌঁছেনি। বরং তাদের নিকট ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীদের দাওয়াত পৌঁছেছে।
অতঃপর আল উবাই বলেন, আমি বলব তার বক্তব্যের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ যার নিকট দাওয়াত পৌঁছেছে তারা আহলে ফাতরাত নয়। কেননা আহলে ফাতরাত হল ঐ সমস্ত লোক যারা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়ে ছিলেন। পূর্বেকার নবী তাদের প্রতি প্রেরিত হননি। আবার পরবর্তী নবীকেও তারা পাননি। যেমন আরবজাতী, তাদের প্রতি ঈসা আলাইহি সালামকে প্রেরণ করা হয়নি। আবার তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাতও পায়নি।
এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ফাতরাত বললে ঐ যুগকে বুঝায় যা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়।
কিন্তু ফুকাহায়ে কিরামগণ যখন ফাতরাত সম্পর্কে আলোচনা করেন তখন তারা শুধুমাত্র ঈসা আলাইহিস সালাম ও আমাদের নবীর মধ্যবর্তী সময়কে নির্দিষ্ট করেন।
অতএব যখন অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত হল যে, হুজ্জত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কোন শাস্তি নাই। তখন আমরা বুঝতে পারলাম তাদের কোন শাস্তি হবে না।