শুকরিয়া, ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্য হলো কারও উপকার এবং সদয় আচরণের প্রতিদান স্বরূপ তার প্রশংসা করা এবং তার প্রতিও সদয় আচরণ করা। মানুষের ধন্যবাদ এবং প্রশংসা পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্য সত্ত্বা হলেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। কারণ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আমাদেরকে অসংখ্য অনুগ্রহের মাধ্যমে ধন্য করছেন। এইসব নেয়ামতের জন্য তিনি আমাদেরকে তাঁর প্রশংসা করার এবং সেগুলোকে অস্বীকার না করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় করো, আমার সাথে কুফরী কোরো না।” [আল-বাকারা; ২ : ১৫২]
যারা আল্লাহ্র এই নির্দেশের আনুগত্য করেছেন এবং তাঁর যোগ্য শোকরকারী বান্দা বলে বিবেচিত হয়েছেন, তাঁরা হলেন নবী এবং রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম)। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “নিশ্চয়, ইবরাহীম ছিলেন (একাই) এক উম্মত (একটি জাতির জীবন্ত প্রতীক), আল্লাহ্র একান্ত অনুগত, ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার রবের নেয়ামতের শোকরকারী। তিনি তাকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১২০-১২১]
আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে আমাদের প্রতি তাঁর কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে সবের জন্য আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, খুব অল্প কিছু মানুষই তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: ১। “হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহ্র শোকর করো যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” [সূরা বাকারা; ২ : ১৭২] ২। “আর অবশ্যই আমি তো তোমাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।” [সূরা আরাফ; ৭ : ১০] ৩। “আর তাঁর নির্দেশনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি [বৃষ্টির] সুসংবাদ বহনকারী হিসেবে বাতাস প্রেরণ করেন এবং যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমত আস্বাদন করাতে পারেন এবং যাতে তাঁর নির্দেশে নৌযানগুলো চলাচল করে, আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ থেকে কিছু সন্ধান করতে পারো। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” [সূরা রুম; ৩০: ৪৬] এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক অফুরন্ত নেয়ামত। আমরা এখানে সেগুলো থেকে মাত্র কয়েকটা উল্লেখ করলাম। বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতের তালিকা করা অসম্ভব। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের গণনা করো, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিমাত্রায় যালিম, অকৃতজ্ঞ।” [সূরা ইবরাহীম;১৪: ৩৪] আমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে তিনি আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতিকে ক্ষমা করে দেবেন এবং আমাদের প্রতি করুনা করবেন। এই মর্মে তিনি বলেন: “আর যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়মত গণনা করো, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১৮]
আল্লাহ্ না চাইলে, কেউ তাঁর প্রশংসা করতে পারে না। তাই মুসলিমরা সর্বদাই আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করে, যেন তিনি তাদেরকে তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া করার সামর্থ্য দান করেন। একারণেই বিশুদ্ধ হাদীসে আল্লাহ্র প্রশংসা করার জন্য তাঁর সাহায্য চেয়ে দো‘আ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত মু‘আয ইবনু জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত ধরে বললেন : “হে মু‘আয! আল্লাহ্র কসম, তোমাকে আমি ভালবাসি, আল্লাহ কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তারপর তিনি বললেন, “হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের শেষে তুমি বলতে ভুলে যাবে না: হে আল্লাহ্! তোমাকে উত্তমরূপে স্মরণ করার, তোমার শুকরিয়া করার এবং তোমার ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করো।” [আবু দাউদ ১৫২২]
আল্লাহ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে, আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আরও বেশী নেয়ামত প্রাপ্ত হবো। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।”[ইবরাহীম; ১৪: ৭] মানুষ কীভাবে তার প্রতিপালকের দেওয়া নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করবে? আল্লাহ শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে সবগুলো নির্ধারিত শর্তসমূহ পূর্ণ করা অপরিহার্য। যেমন: অন্তরের শুকরিয়া, জিহ্বার শুকরিয়া এবং অন্য সকল শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া। “অন্তরের শুকরিয়া হলো আত্মসমর্পণ এবং বিনম্রতায়; জিহ্বার শুকরিয়া হলো প্রশংসা এবং স্বীকারোক্তিতে; আর শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া হলো আনুগত্য এবং বশ্যতায়।” [মাদারিজ আল-সালিকীন ২/২৪৬]
১. অন্তরের শুকরিয়া:
এর অর্থ হলো, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, অন্তর সেই অনুগ্রহসমূহকে পূর্ণ গুরুত্বের সাথে উপলব্ধি করে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে যে, কেবল আল্লাহ্ই তাকে এইসব অনুগ্রহ দান করেছেন যার কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: “আর তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত আছে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।” [আন-নাহল; ১৬ : ৫৩]
আমরা সমস্ত নেয়ামত যে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পাই, তা স্বীকার করা কেবল মুস্তাহাব (উৎসাহিত) নয়; বরং তা ফরয (বাধ্যতামূলক)। শায়েখ আস-সা‘দি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন: “মানুষকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত নেয়ামত আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। তবেই সে পরিপূর্ণভাবে তাওহীদ-কে অর্জন করবে। যে কেউ মুখে বা অন্তরে আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহকে অস্বীকার করবে, সে একজন কাফির এবং ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। যে দৃঢ়ভাবে অন্তরে বিশ্বাস করে যে, সকল নেয়ামত শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, আবার কখনও কখনও সেগুলোকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, কখনও নিজের কর্ম বা অন্যের প্রচেষ্টার ফসল মনে করে তাহলে তাকে তাওবা করতে হবে এবং সমস্ত নেয়ামতসমূহ তার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে বলে মনে করবে না এবং সে অবশ্যই নিজেকে দিয়ে তা (তাওবা) করাবে। কারণ আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে, ঈমান অর্জন করা যায় না। ঈমানের মূলকথাই হলো আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা যা তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: বান্দার প্রতি আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতকে অন্তরে স্বীকার করা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা; এবং এই শুকরিয়াকে কাজে লাগিয়ে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত এবং আনুগত্য করা যিনি সমস্ত নেয়ামতের যোগানদাতা।” [আল-কাওল আস্-সাদীদ ফী মাকাসিদুত তাওহীদ পৃষ্ঠা ১৪০]
যারা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা কোন ধরণের মানুষ, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “তারা আল্লাহ্র নেয়ামত চেনে, তারপরও তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই কাফির।” [সূরা নাহল; ১৬ : ৮৩]
২. মুখের শুকরিয়া:
এর অর্থ হলো, সমস্ত নেয়ামত শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একথা অন্তরে বিশ্বাস করার পর, তা মৌখিকভাবে স্বীকার করা এবং নিজের জিহ্বাকে সর্বদায় আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র প্রশংসায় নিয়োজিত রাখা।
হযরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। আল্লাহ্র প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান: “আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির প্রতি খুশি হন, যে কোনো খাবার খাওয়ার পরে তাঁর প্রশংসা করে অথবা যে কোনো কিছু পান করার পর তাঁর প্রশংসা করে।” [সহীহ্ মুসলিম-২৭৩৪]
নেয়ামত সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার জন্য শুকরিয়া আদায় করাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় যা জান্নাতের অধিবাসীদের সবচেয়ে মহান বৈশিষ্ট্য। যখন জান্নাতীরা বলবে, “আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা সৃষ্টির মধ্যে অন্য কাউকে দেননি” তখন আল্লাহ্ তাআলা তাদের উদ্দেশে বলবেন: “আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়েও অধিক উত্তম কিছু দেবো না?” তারা বলবে “সেটা কী? আপনি কি আমাদের মুখম-লগুলোকে উজ্জ্বল করেননি এবং আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি বা রক্ষা করেননি? তিনি বলবেন, “তোমাদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম এবং এরপর আর কখনোও তোমাদের প্রতি রাগান্বিত হবো না।” এ কারনে সালাফে ছালেহীন কেরাম বলেছেন: কেউ কোনো নেয়ামতের কথা গোপন করলে সে ওই নেয়ামতকে অস্বীকার করল, আর কোনো নেয়ামতের কথা প্রকাশ করলে সে ওটার জন্য শুকরিয়া আদায় করলো। “আল্লাহ্ যখন কোনো ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন, তিনি ওই বান্দার উপর সেই অনুগ্রহের প্রভাব দেখতে ভালোবাসেন।” [মাদারিজি আল সালেকিন ২/২৪৬] ওমার ইবনু আব্দুল আযীয রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: (আল্লাহ্র) নেয়ামতের কথা পরস্পরকে স্মরণ করিয়ে দাও। কারণ সেগুলো আলোচনা করাও হলো শুকরিয়া আদায় করা।
৩. শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া:
এর অর্থ হলো শারীরিক ক্ষমতাকে আল্লাহ্র আনুগত্যের জন্য ব্যবহার করা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত: “আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করতেন, তিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা মুবারক দুটো ফুলে যেতো। হযরক আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বললেন: হে আল্লাহ্র রাসুল! আপনি এমনটি কেন করছেন? অথচ আল্লাহ্ আপনাকে অতীতে ও ভবিষ্যতে কোন প্রকার গুনাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেননি? তিনি বললেন: “হে আয়েশা! আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না?” [বুখারি –৪৫৫৭ এবং মুসলিম –২৮২০]
যারা আল্লাহ্র এই নির্দেশের আনুগত্য করেছেন এবং তাঁর যোগ্য শোকরকারী বান্দা বলে বিবেচিত হয়েছেন, তাঁরা হলেন নবী এবং রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম)। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “নিশ্চয়, ইবরাহীম ছিলেন (একাই) এক উম্মত (একটি জাতির জীবন্ত প্রতীক), আল্লাহ্র একান্ত অনুগত, ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার রবের নেয়ামতের শোকরকারী। তিনি তাকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১২০-১২১]
আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে আমাদের প্রতি তাঁর কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে সবের জন্য আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, খুব অল্প কিছু মানুষই তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: ১। “হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহ্র শোকর করো যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” [সূরা বাকারা; ২ : ১৭২] ২। “আর অবশ্যই আমি তো তোমাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।” [সূরা আরাফ; ৭ : ১০] ৩। “আর তাঁর নির্দেশনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি [বৃষ্টির] সুসংবাদ বহনকারী হিসেবে বাতাস প্রেরণ করেন এবং যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমত আস্বাদন করাতে পারেন এবং যাতে তাঁর নির্দেশে নৌযানগুলো চলাচল করে, আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ থেকে কিছু সন্ধান করতে পারো। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” [সূরা রুম; ৩০: ৪৬] এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক অফুরন্ত নেয়ামত। আমরা এখানে সেগুলো থেকে মাত্র কয়েকটা উল্লেখ করলাম। বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতের তালিকা করা অসম্ভব। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের গণনা করো, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিমাত্রায় যালিম, অকৃতজ্ঞ।” [সূরা ইবরাহীম;১৪: ৩৪] আমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে তিনি আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতিকে ক্ষমা করে দেবেন এবং আমাদের প্রতি করুনা করবেন। এই মর্মে তিনি বলেন: “আর যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়মত গণনা করো, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১৮]
আল্লাহ্ না চাইলে, কেউ তাঁর প্রশংসা করতে পারে না। তাই মুসলিমরা সর্বদাই আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করে, যেন তিনি তাদেরকে তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া করার সামর্থ্য দান করেন। একারণেই বিশুদ্ধ হাদীসে আল্লাহ্র প্রশংসা করার জন্য তাঁর সাহায্য চেয়ে দো‘আ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত মু‘আয ইবনু জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত ধরে বললেন : “হে মু‘আয! আল্লাহ্র কসম, তোমাকে আমি ভালবাসি, আল্লাহ কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তারপর তিনি বললেন, “হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের শেষে তুমি বলতে ভুলে যাবে না: হে আল্লাহ্! তোমাকে উত্তমরূপে স্মরণ করার, তোমার শুকরিয়া করার এবং তোমার ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করো।” [আবু দাউদ ১৫২২]
আল্লাহ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে, আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আরও বেশী নেয়ামত প্রাপ্ত হবো। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।”[ইবরাহীম; ১৪: ৭] মানুষ কীভাবে তার প্রতিপালকের দেওয়া নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করবে? আল্লাহ শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে সবগুলো নির্ধারিত শর্তসমূহ পূর্ণ করা অপরিহার্য। যেমন: অন্তরের শুকরিয়া, জিহ্বার শুকরিয়া এবং অন্য সকল শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া। “অন্তরের শুকরিয়া হলো আত্মসমর্পণ এবং বিনম্রতায়; জিহ্বার শুকরিয়া হলো প্রশংসা এবং স্বীকারোক্তিতে; আর শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া হলো আনুগত্য এবং বশ্যতায়।” [মাদারিজ আল-সালিকীন ২/২৪৬]
১. অন্তরের শুকরিয়া:
এর অর্থ হলো, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, অন্তর সেই অনুগ্রহসমূহকে পূর্ণ গুরুত্বের সাথে উপলব্ধি করে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে যে, কেবল আল্লাহ্ই তাকে এইসব অনুগ্রহ দান করেছেন যার কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: “আর তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত আছে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।” [আন-নাহল; ১৬ : ৫৩]
আমরা সমস্ত নেয়ামত যে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পাই, তা স্বীকার করা কেবল মুস্তাহাব (উৎসাহিত) নয়; বরং তা ফরয (বাধ্যতামূলক)। শায়েখ আস-সা‘দি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন: “মানুষকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত নেয়ামত আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। তবেই সে পরিপূর্ণভাবে তাওহীদ-কে অর্জন করবে। যে কেউ মুখে বা অন্তরে আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহকে অস্বীকার করবে, সে একজন কাফির এবং ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। যে দৃঢ়ভাবে অন্তরে বিশ্বাস করে যে, সকল নেয়ামত শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, আবার কখনও কখনও সেগুলোকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, কখনও নিজের কর্ম বা অন্যের প্রচেষ্টার ফসল মনে করে তাহলে তাকে তাওবা করতে হবে এবং সমস্ত নেয়ামতসমূহ তার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে বলে মনে করবে না এবং সে অবশ্যই নিজেকে দিয়ে তা (তাওবা) করাবে। কারণ আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে, ঈমান অর্জন করা যায় না। ঈমানের মূলকথাই হলো আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা যা তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: বান্দার প্রতি আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতকে অন্তরে স্বীকার করা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা; এবং এই শুকরিয়াকে কাজে লাগিয়ে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত এবং আনুগত্য করা যিনি সমস্ত নেয়ামতের যোগানদাতা।” [আল-কাওল আস্-সাদীদ ফী মাকাসিদুত তাওহীদ পৃষ্ঠা ১৪০]
যারা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা কোন ধরণের মানুষ, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “তারা আল্লাহ্র নেয়ামত চেনে, তারপরও তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই কাফির।” [সূরা নাহল; ১৬ : ৮৩]
২. মুখের শুকরিয়া:
এর অর্থ হলো, সমস্ত নেয়ামত শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একথা অন্তরে বিশ্বাস করার পর, তা মৌখিকভাবে স্বীকার করা এবং নিজের জিহ্বাকে সর্বদায় আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র প্রশংসায় নিয়োজিত রাখা।
হযরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। আল্লাহ্র প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান: “আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির প্রতি খুশি হন, যে কোনো খাবার খাওয়ার পরে তাঁর প্রশংসা করে অথবা যে কোনো কিছু পান করার পর তাঁর প্রশংসা করে।” [সহীহ্ মুসলিম-২৭৩৪]
নেয়ামত সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার জন্য শুকরিয়া আদায় করাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় যা জান্নাতের অধিবাসীদের সবচেয়ে মহান বৈশিষ্ট্য। যখন জান্নাতীরা বলবে, “আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা সৃষ্টির মধ্যে অন্য কাউকে দেননি” তখন আল্লাহ্ তাআলা তাদের উদ্দেশে বলবেন: “আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়েও অধিক উত্তম কিছু দেবো না?” তারা বলবে “সেটা কী? আপনি কি আমাদের মুখম-লগুলোকে উজ্জ্বল করেননি এবং আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি বা রক্ষা করেননি? তিনি বলবেন, “তোমাদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম এবং এরপর আর কখনোও তোমাদের প্রতি রাগান্বিত হবো না।” এ কারনে সালাফে ছালেহীন কেরাম বলেছেন: কেউ কোনো নেয়ামতের কথা গোপন করলে সে ওই নেয়ামতকে অস্বীকার করল, আর কোনো নেয়ামতের কথা প্রকাশ করলে সে ওটার জন্য শুকরিয়া আদায় করলো। “আল্লাহ্ যখন কোনো ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন, তিনি ওই বান্দার উপর সেই অনুগ্রহের প্রভাব দেখতে ভালোবাসেন।” [মাদারিজি আল সালেকিন ২/২৪৬] ওমার ইবনু আব্দুল আযীয রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: (আল্লাহ্র) নেয়ামতের কথা পরস্পরকে স্মরণ করিয়ে দাও। কারণ সেগুলো আলোচনা করাও হলো শুকরিয়া আদায় করা।
৩. শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া:
এর অর্থ হলো শারীরিক ক্ষমতাকে আল্লাহ্র আনুগত্যের জন্য ব্যবহার করা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত: “আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করতেন, তিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা মুবারক দুটো ফুলে যেতো। হযরক আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বললেন: হে আল্লাহ্র রাসুল! আপনি এমনটি কেন করছেন? অথচ আল্লাহ্ আপনাকে অতীতে ও ভবিষ্যতে কোন প্রকার গুনাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেননি? তিনি বললেন: “হে আয়েশা! আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না?” [বুখারি –৪৫৫৭ এবং মুসলিম –২৮২০]