হাদিস “সহিহ নয়” বলতে মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে কী বুঝায়?

‘হাদিসের নামে জালিয়াতি’ বইয়ের ১৭৪ পৃষ্ঠায় লেখক ড.আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর কোন প্রমাণ ছাড়াই মুহাদ্দিসদের উক্তি ‘হাদিসটি সহিহ নয়’ বলতে জাল হাদিস বুঝায় বলে উল্লেখ করেছে।তার কাছে আমার প্রশ্ন যে, হাদিস শাস্ত্রের ভূয়া নীতিমালা কোন মুহাদ্দিসেরর? অবশ্যই কোন মুহাদ্দিসেরর নয়।তা না হলে সে কেনন একটি দলীলও উল্লেখ করতে পারেনি।এটা দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে,এটা কোন হক্কানী মুহাদ্দিসেরর মন্তব্য নয়; বরং তার নিজের গড়া মন্তব্য।অপরদিকে মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী লিখিত আরেকটি বিভ্রান্তিকর বই ‘প্রচলিত জাল হাদিস’ এর ৪৯ পৃষ্ঠায় প্রমানহীনভাবে কোন মুহাদ্দিসের উক্তি ‘হাদিসটি সহিহ নয়’ বলতে জাল হাদিস বুঝায় বলে বুঝানোর অপচেষ্টা চালিয়েছেন।

হাদিসের নীতিমালাঃ
*******************
হাদিস তিন প্রকার।
১. সহিহ
২.হাসান
৩.দ্বঈফ
এগুলো হাদিসেরই অন্তর্ভুক্ত। বর্ণনার সুত্রানুসারে এভাবে হাদিস বিশারদগণ হাদিসের প্রকারভেদ করেছেন।আমাদের দেশে বা বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণীর নামধারী আলেম মনগড়াভাবে হাদিস শাস্ত্রের মুলনীতিমালাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হাদিস -ই-দ্বঈফকে হাদিস বলেই স্বীকার করতে রাজি নয়।

জবাবঃ
****************
দলীল নং-১
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানীর(রহঃ)[যিনি বুখারী শরীফের প্রথম ব্যাখ্যাকারি ]রচিত ” আল ক্বওলুল মুসাদ্দাদ ফিয যুব্বি আন মুসনাদি আহমদ” নামক কিতাবে উল্লেখ করছেন যে,
” হাদিসটি সহীহ নয় বললে, সেটা মওদ্বু বা বানোয়াট হওয়া অপরিহার্য নয়”।(১/৩৭ পৃষ্ঠা,মাকতাবাতে ইবনে তাইমিয়া,কাহেরা মিশর)

দলীল নং-২
***********
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেয আল্লামা ইমাম আবদুর রহমান জালালুদ্দীন সূয়ূতী(রহঃ) তার লিখিত কিতাব “তা’কিবাত আলাল মওদ্বুয়াত” গ্রন্থে বলেন,
“এ হাদিস সম্পর্কে ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী (রহঃ) সর্বপরি এ মন্তব্য করেছেন যে, হাদিসের বচনগুলো বা (মতন) সহিহ নয়।এ কথা দ্বারা বুঝা যায়, হাদিসটি দ্বঈফ বা দুর্বল পর্যায়ের(সুত্রের বা বচনের দিক দিয়ে)।
(সুয়ুতী কৃতঃ তা’কিবাত আলাল মওদ্বুআত,পৃঃ ২৪৫)

দলীল নং৩
***********
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ)এ প্রসঙ্গে বলেন-
“এতে সন্দেহের অবকাশ নেই কোন মুহাদ্দিস ‘হাদিসটি সহিহ নয়’ বললে সেটার দ্বারা হাদিসটি বানোয়াট হওয়া অপরিহার্য হবে”
(মোল্লা আলী ক্বারী কৃতঃ আসরারুর মারফূয়াত,১/১০৮পৃষ্ঠা, হাদিসঃ৮৫, মুয়াসসাতুর রিসালা, বৈরুত, লেবানন)

দলীল নং-৪
***********
উক্ত কিতাবে মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) তিনি আশুরার দিন সুরমা লাগানোর বিষয়ে একটি বর্নিত হাদিস সম্পর্কে হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এর উক্তি ‘ এ হাদিস সহিহ নয়’ বলে মন্তব্য করার পর লিখেছেন-
” আমার (মোল্লা আলী ক্বারী) কথা হল এ হাদিস ‘ সহিহ নয়’ মানে বানোয়াট বা মওদ্বু নয়।সর্বশেষ দ্বঈফ বলা যায় মাত্র।”
(প্রাগুক্ত ১/৪৭৪পৃঃ)

দলীল নং-৫
***********
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ) বলেন,
“কোন হাদিসের ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য এ হাদিসটি সুদৃঢ় নয় বললে, হাদিসটি মওদ্বু বা বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ সাবিত বা প্রমাণিত শব্দ দ্বারা শুধু সহিহ হাদিসই বুঝায় এর নিম্ন পর্যায়ের হাদিসের মধ্যে দ্বঈফও রয়েছে।
(আল্লামা তাহের পাটানীঃ তাযকিরাতুল মওদ্বুআত, ৭৫পৃঃ)

দলীল নং-৬-৭
***********
শুধু তাই নয় দেওবন্দিদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি মাওলানা আবদুল হাই লক্ষনৌভি বলেনঃ
“ইমাম আহমদের উক্তি হাদিসটি ‘ সহীহ নয়’ বলার দ্বারা হাদিসটি বাতিল বা জাল হওয়া অপরিহার্য নয়”
(আবদুল হাই কৃতঃ আসরুল মারফুআ, ১/পৃঃ১০১)

দলীল নং-৮
**********
একটি হাদিস শরীফে এও রয়েছে যে,
” খাওয়ার পুর্বে তরমুজ খেলে তা পেটকে একেবারে পরিষ্কার করে দেয় এবং রোগ ব্যাধিকে সমূলে দুরীভুত করে দেয়”।এ হাদিসের ব্যাপারে ইমাম ইবনে আসাকির রহঃ বলেছেন,(এটির শায বিরল পর্যায়ের সহীহ নয়)। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ আলোচ্য হাদিস সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্য সম্পর্কে লিখেছেন,
“এ কথা স্পষ্ট যে,ইবনে আসাকিরের উল্লিখিত মন্তব্য দ্বারা হাদিসটি মওদ্বু বা বানোয়াট নয় বলে বুঝা যায়।”
(ক. মোল্লা আলী ক্বারী কৃতঃ আসরারুল মারফূয়াত, ১/৪৮৬পৃঃ)
খ. আল্লামা আযলুনী কৃতঃ কাশফুল খাফাঃ১/২৫৬পৃঃ, হাদিসঃ৯০৮)

দলীল নং-৯
***********
“ইমাম কামালুদ্দীন মুহাম্মদ বিন হুম্মাম রহঃ বলেন, “কোন হাদিস সম্পর্কে কোন মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এ হাদিসটি সহীহ নয়, তাদের কথা সত্য বলে মান্য করা হলেও কোন অসুবিধা নেই,যেহেতু (শরীয়তের) দলীল বা প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্থ হওয়ার জন্য শুধু (হাদিস) সহীহ হওয়া নির্ভরশীল নয়।সনদ বা সুত্রের দিক দিয়ে ‘হাসান’ হলেও (হাদিসটি শরীয়তের দলীল হিসেবে সাব্যস্থ হওয়ার জন্য) যথেষ্ট। ”
(মোল্লা আলী ক্বারী কৃতঃ মিরকাতঃ৩/৭৭পৃঃ, হাদিস-১০৮)

দলীল নং-১০
************
ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী রহঃ বলেন, হাদিসে ‘হাসান’ শরিয়তের দলীল রুপে গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের সাদৃশ্য, যদিও মরতবা কম।
(আসকালানী কৃতঃ নুযহাতুল নযর ফি তাওদিহে নুখবাতিল ফিকির, ১/৭৮পৃঃ,মাতবাআতে সাফির বিল রিয়াদ, সৌদিআরব)


দলীল নং-১১
***********
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ বলেন,
“ইমাম সাখাভী রহঃ এর বক্তব্য হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ নিষেধ দ্বারা হাদিসটি ‘হাসান’ ও দ্বঈফ হওয়াকে নিষেধ করে না।
(মোল্লা আলী ক্বারী কৃতঃ আসরারুল মারফূয়াত; ১/৩৪৯পৃঃ, হাদিস-৫০২)

দলীল নং-১২
***********
একটি হাদিসে রয়েছে-
“যে দাবা খেলে সে অভিশপ্ত।উক্ত হাদিসকে ইমাম নববী রহঃ বলেন, উক্ত হাদিসটি সহিহ পর্যায়ের নয়।ইমাম সাখাভী রহঃ বলেন, হাদিসটি দৃঢ় পর্যায়ের নয়।উক্ত দুই ইমামের রায়কে ইমাম সুয়ুতী রহঃ ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পরিশেষে উক্ত রায় দ্বারা সনদে দুর্বলতায় বুঝায়(জাল নয়)
(ক. আল্লামা আযলূনী: কাশফুল খাফাঃ২/২৪৬; হাদিসঃ২৫৯৬
খ. মোল্লা আলী ক্বারী:আসরারুল মারফূয়াত;১/৩৫৮পৃঃ, হাদিস:৫২৪)

দলীল নং-১৩
************
আল্লামা ইমাম ইবনে জওজী রহঃ একটি হাদিস বর্ণনা করে সনদে একজন রাবী দর্বল থাকায় ইমাম জওজী তার কিতাবুল ইল্লল এ বলেন,”উক্ত হাদিসটি পুর্ণ সহিহ পর্যায়ের নয়,বা সনদটি শক্তিশালী নয়।আল্লামা আযলুনী রহঃ উক্ত হাদিসের রায়ের প্রতি ইতি টেনে বলেন যে,”পরিশেষে তার রায় দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, সনদে দুর্বলতা আছে কিন্তু তাই বলে জাল বা বানোয়াট নয়”
(আল্লামা আযলুনীঃকাশফুল খাফাঃ২/১১০পৃঃ;হাদিসঃ১৯৬৬)

দলীল নং-১৪
************
প্রসিদ্ধ একটি হাদিস আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্নিত-
“আমি ইলমের শহর আর আলী তার দরজা”
উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ বলেন, ” ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ) কে উক্ত হাদিস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, উক্ত হাদিসটি সহিহ নয়, ‘হাসান’ পর্যায়ের হাদিস। ইমাম হাকিম রহঃ বলেন হাদিসটি জাল বা বানোয়াট নয়।”
(ক. মোল্লা আলী ক্বারীঃআসরারুল মারফুআঃ১/১১৮পৃঃ,হাদিস নং-৭১, মুয়াসসাতুর রিসালা, বৈরুত, লেবানন
খ. মোবারকপুরীঃতুহফাতুল আহওয়াজিঃ১০/২২৬,হাদিস নং-৩৭২৩.
গ. আযলূনীঃকাশফুল খাফাঃ১/১৮৪-১৮৫পৃঃ,হাদিস নং-৬১৮
ঘ. ইমাম সাখাভীঃমাকসিদুল হাসানাঃ১২১পৃ,হাদিস নং-১৮৯
ঙ.মোল্লা আলী ক্বারীঃমিরকাতুল মাফাতিহঃ১১/২৫৩,হাদিস নংঃ৬০৯৬)
তাই সুস্পষ্ট বুঝা যায় হাদিসটি সহিহ নয় বলতে “হাসান” হওয়াকে বুঝায়।

দলীল নং-১৫
***********
ইমাম সুয়ুতী রহঃ তার রিয়াল গ্রন্থ ‘আদ দুররুল মনসুর’ এ হযরত আবুল সাঈদ আলায়ী (রহঃ) এর কওল বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উক্ত হাদিসটি একাধিক তরীকায় বর্নিত হওয়ার কারণে ” হাসান” হাদিস, তাই হাদিসটি সহিহও নয় এবং দ্বঈফও নয়”।
(ক.আযলুনীঃকাশফুল খাফাঃ১/১৮৫: হাদিসঃ৬১৮
খ. মোল্লা আলী ক্বারীঃআসরারুল মারফুআ:১/১১৯পৃঃ,হাদিস নং-৭১)

দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল হাদিসটি সহীহ নয় বলতে “হাসান” পর্যায়ের হাদিস বুঝায়, মওদ্বু নয়।

দলীল নং-১৬
************
আহলে হাদিসের কথিত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দিন আলবানী তার ‘ সিলসিলাতুল আহাদিসুদ দ্বঈফা’ গ্রন্থের ১ম খন্ডের ১০২ পৃষ্ঠায় ৭৩ নং হাদিসে রাসুল (দঃ) এর নাম মোবরক শুনে চুমু খাওয়া হযরত আবু বকর (রাঃ) এর বর্ণিত হাদিস প্রসঙ্গে বলেন, হাদিসটি সহীহ পর্যায়ের নয়।বুঝা গেল হাদিসটি জাল নয়।কারণ আলবানী জাল হাদিসকে সরাসরি মওদ্বু বলে উল্লেখ করে।কিন্তু এখানে তিনি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন অপরদিকে দলীল পেশ করেছেন।
Top