জুমার খুতবা
###########
০৩য় জুমা, জুমাদা আল উখরা, ১৪৩৮ হি: March-২০১৭

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু-

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!

সিদ্দীক উপাধি: রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে মিরাজের কথা অনেকেই যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোল খাচ্ছিল, তখন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। লোকে আবু বকরের কাছে গিয়ে বলেঃ আবু বকর তোমার বন্ধুকে তুমি বিশ্বাস কর? সে বলেছে, সে নাকি গতরাতে বাইতুল মাকদিসে গিয়েছে, সেখানে নামায পড়েছে, অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছে। আবু বকর বললেনঃ তোমরা কি তাঁকে বিশ্বাস কর? তারা বললঃ হ্যাঁ, ঐতো মসজিদে বসে লোকজনকে এ কথাই বলেছে। আবু বকর বললেনঃ আল্লাহর কসম, তিনি যদি এ কথাই বলে থাকেন তাহলে সত্য কথাই বলেছেন। এতে অবাক হাওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন, তাঁর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে ওহী আসে মাত্র এক মুহর্তের মধ্যে। তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস করি। তোমারা যে ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছো এটা তার চেয়েও বিস্ময়কর। তারপর তিনি রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর নবী, আপনি কি জনগনকে বলেছেন যে, আপনি গত রাতে বাইতুল মাকদিস ভ্রমন করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আবু বকর বললেনঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল। রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেলঃ হে আবু বকর, তুমি সিদ্দিক। এভাবে আবু বকর “সিদ্দিক” উপাধিতে ভুষিত হন।

ইবন ইসহাকের মতে, এই অবিচল বিশ্বাসের দরুনই তিনি “আস-সিদ্দিক” উপাধি প্রাপ্ত হন। ইসলামের ঐতিহাসিক বিবরণগুলির আদ্যান্ত এই উপাধি তাঁর নামের সহিত জড়িত।
হিজরাত: তার জীবনের চরম গৌরবের দিন আসে যখন হযরত মুহাম¥দ মোস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করার সময় তাঁকে স্বীয় সঙ্গী হিসেবে মনোনীত করেন। ইবনে ইসহাক বলেন “আবু বকর রাসুলাল্লাহর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হিজরতের অনুমতি চাইলে রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেনঃ তুমি তাড়াহুড়া করোনা, আল্লাহ হয়তো তোমাকে একজন সহযাত্রী জুটিয়ে দেবেন। আবু বকর একথা শুনে ভাবতেন যে, রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো নিজের কথাই বলেছেন। তাই তিনি তখন থেকেই দুটো উট কিনে অত্যন্ত যতœ সহকারে পুষতে থাকেন, এই আশায় যে, হিজরাতের সময় হয়তো কাজে লাগতে পারে।


উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বর্ণনা করেনঃ রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনে অন্তত একবার আবু বকরের বাড়িতে আসতেন। যেদিন হিজরতের অনুমতি পেলেন সেদিন দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসলেন, এমন সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাঁকে দেখামাত্র আবু বকর বলে উঠলেন, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। তা না হলে এমন সময় রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসতেন না। তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করলে আবু বকর খাটের একধারে সরে বসলেন। আবু বকরের বাড়ীতে তখন আমি ও আমার বোন আসমা ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার এখানে অন্য যারা আছে, তাদেরকে আমার কাছ হতে দুরে সরিয়ে দাও। আবু বকর বললেন: হে আল্লাহর রাসুল! আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ আমাকে হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন। আবু বরক জিজ্ঞেস করলেন আমিও কি সঙ্গে যেতে পারব? রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ যেতে পারবে।

আয়েশা বলেনঃ সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যেও এত কাঁদতে পারে। আমি আবু বকরকে সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অতঃপর আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এই দেখুন আমি এই উট দুটো এ কাজের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি।
রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের সেই কঠিন মুহূর্তে আবু বকরের কোরবানী, বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য্য ও বন্ধুত্বের কথা ইতিহাসে চিরদির অম্লান হয়ে থাকবে। তাঁর সহচার্যের কথা তো পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে। বলা বাহুল্য কোরানে হযরত আবু বকর সিদ্দীককে রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের “ছাহেব” বা সাথী শব্দে ব্যাবহার করা হয়ছে। আল্লাহ্ তাআলা আল-কুরআনে “দুই জনের মধ্যে দ্বিতীয়”(সুরা ৯: আয়াত৪০) আখ্যায় তার নাম অমর করে এই আত্মত্যাগী মহান ভক্তকে পুরস্কৃত করেন।মক্কী ও মাদানী জীবনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু ও ইসলামের পরম খেদমতকারী ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ।

ইসলামের প্রথম খলিফা; হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ইসলামের ইতাহাসে একজন ক্ষণজন্মা হিসেবে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলীফা হিসেবে ইসলামের এক সংকটময় মুহূর্তে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। হযরত মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর যে চারজন খলিফা ইসলামের পতাকা অতি উচ্চে তুলে ধরেছিলেন তাদের মধ্যে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ছিলেন অন্যতম।তাঁর খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময়টি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তৎকালীন মুসলিম জাহানের বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা, ভ- নবীদের উৎপাত, জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি ইত্যাদি দমনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

একদিকে নব্যুয়তের প্রতি ইর্ষান্বিত বেদুইণদের হিংষা, অমুসলিমদের চক্রান্ত, ভন্ড নবীদের প্রাদুর্ভাব,অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপ, ভন্ডনবীদের আবির্ভার ও বহি:শত্রুর আক্রমন, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ইসলাম ধর্ম এবং নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকার সুযোগে একদল লোক যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এমনকি তারা যাকাত বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে কোনো কোনো প্রভাবশালী লোক যাকাত প্রথা উচ্ছেদের সুপারিশ করে। কিন্তু দূরদর্শী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু শরীয়তের সিদ্ধান্তে অটল থেকে আন্দোরনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্হা গ্রহণ করেন। ফলে তারা যাকাত প্রদানে বাধ্য হয়।

হযরত মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর ভন্ডনবীরা মদিনাভিমুখে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পেলে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ওদের দমনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। তিনি তাদেরকে আত্মসর্মপণ করার কঠোর নির্দেশ দান করেন। অন্যথায় যুদ্ধ অনিবার্য বলে ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে হযরত ওসমানকে ভন্ডনবী আসওয়াদকে দমনের জন্য অভিযানের র্নিদেশ দান করেন। আসওয়াদ ছিল আনাস জাতির নেতা সে তার অনুচরদের নিয়ে দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন নগরে বাস করতো গ্রামের সরদারদের প্রভাবান্বিত করে আসওয়াদ এক বিরাট সৈন্যদল গঠন করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিন্তু শেষ র্পযন্ত হযরত ওসমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তার মৃত্যু হয়।

আসওয়াদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং মুসলমানদের রাজধানী মদিনা অবরুদ্ধ করার প্রয়াস পায়। হযরত আবু কবর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাই মদিনা নগরীকে সুরক্ষিত করেন এবং সৈন্যবাহিনীকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভন্ডনবী ও ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে তাদের প্রেরণ করে। সেনাপতি হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ ৩৫০০ সৈন্য নিয়ে ভন্ডনবী তোলায়হার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তোলায়হা বনু তাইম বংশের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তায়িম বংশের নেতা আদি বিন হাতিম হযরত খালীদের পরার্মশে স্বীয় সম্প্রদায়কে তোলায়হার বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য বলেন। এভাবে খালিদ তোলায়হাকে র্দুবল করে ফেলেন এবং সহজেই পরাজিত করেন। তেলায়হা প্রথমত সাইবেরিয়াতে পলায়ন করে অবশেষে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন।

হযরত আবু বকর মাত্র আড়াই বছরের মত খেলাফত পরিচালনা করেন। তবে তাঁর এ সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ বলে বিবেচিত হয়। রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। আরবের বিদ্রোহ সমূহ নির্মুল করা। রাষ্ট্র ও সরকারকে তিনি এত মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মুসলমানরা ইরান ও রোমের মত দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে সাহসী হয় ও অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বহু অঞ্চল দখল করে নেয়।

“খলিফাতু রাসুলিল্লাহ”- এ উপাধিটি কেবল তাঁকেই দেয়া হয়। পরবর্তী খলিফাদের ‘আমিরুল মোমেনীন’ উপাধি দেয়া হয়েছে। রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়লে তৎপরিবর্তে আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এর উপর মসজিদে নাববীর জামাআতে ইমামাত করার ভার ন্যস্ত হয় ।

কোরআনের সংকলন: হযরত আবু বকরের আরেকটি অবদান পবিত্র কোরআনের সংকলন ও সংরক্ষন। তাঁর খিলাফত কালের প্রথম অধ্যায়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সেই সব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কয়েকশত হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরন করেন। শুধু মাত্র মুসায়লামা কায্যাবের সাথে যে যুদ্ধ হয় তাতেই সাত শ’ হাফেয শহীদ হন। অতঃপর হযরত উমারের পরামর্শে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সম্পুর্ণ কোরআন একস্থানে গ্রন্থাকারে সংকলন করেন এবং কপিটি নিজের কাছে সংরক্ষন করেন। ইতিহাসে কোরআনের এই আদি কপিটি ‘মাসহাফে সিদ্দিকী’ নামে পরিচিত। পরবর্তী কালে হযরত ওসমানের যুগে কোরআনের যে কপিগুলো করা হয় তা ‘মাসহাফে সিদ্দিকী’র অনুলিপি মাত্র।

ইন্তেকাল: ১৩ই হিজরীর ৭ই জমাদিউল উখরা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু জ্বরে আক্রান্ত হন। ১৫দিন রোগাক্রান্ত থাকার পর ২২শে জমাদিউল উখরা মোতাবেক ৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে ইন্তেকাল করেন। হযরত আয়েশার রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হুজরায় রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসাল্লামের রওজা মুবারকের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি দু’বছর তিন মাস দশ দিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।

আল্লাহ্ আমাদেরকে হুজুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই প্রিয় সাহাবির ফয়েয লাভের তৌফিক দান করুন। (আমিন)
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله رب العالمين.

Top