বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আরবী শা’বান মাসের ১৫ তারিখের রাত,

যাকে আরবীতে ‘লাইলাতুন্ নিসফে মিন শা’বান’

তথা শা’বান মাসের মধ্য দিবসের রাত (শবে বরাত)

বলা হয়, তা বছরের সেরা রাতগুলোর

একটি [ইসলামী সালের দিন গণনায় রাত

আগে আসে, তাই এটি শা’বানের ১৫ তারিখ দিনের

আগের রাত/১৪ তারিখ দিনগত রাত]। হযরত আতা’

ইবনে ইয়াসার (রা:) বলেন যে লাইলাতুল কদর-এর

পরে ১৫ শা’বানের রাতের চেয়ে উত্তম রাত

আর নেই। এর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ

হলো এতে বর্ষিত খোদায়ী রহমত ও বরকত।

এক রাতে সাইয়্যেদাহ আয়েশা (রা:) লক্ষ্য

করেন যে মহানবী (দ:) তাঁর ঘরে নেই।

তিনি হুযূর পাক (দ:)-কে খুঁজতে বের হন

এবং তাঁকে ’বাকী’ কবরস্থানে দু’হাত আকাশের

দিকে প্রসারিত অবস্থায় মোনাজাতে রত

দেখতে পান। তিনি হযরত আয়েশা (রা:)-

কে বলেন যে এই রাতে, অর্থাৎ, শা’বান মাসের

১৫ তারিখ রাতে, আল্লাহতা’লা ‘কালব’ গোত্রের

অধীনে তাবৎ ভেড়ার যতোগুলো লোম

আছে, তার চেয়েও

বেশি মানুষকে ক্ষমা করে দেন [ইমাম আহমদ

(রহ:), ইমাম তিরমিযী (রা:) ও ইমাম ইবনে মাজাহ

(রা:) এটি বর্ণনা করেন; বানু কালব গোত্র

আরবদের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিল এর সদস্যদের

মালিকানাধীন বিশাল ভেড়ার পালের জন্যে]।

রাসূলুল্লাহ (দ:) অন্যত্র এরশাদ ফরমান, “শা’বান

মাসের ১৫ তারিখের রাতে আল্লাহ পাক তাঁর

সৃষ্টিকুলের দিকে তাকান এবং দুই শ্রেণীর মানুষ

ছাড়া বাকি সবাইকে মাফ করে দেন; এই দুই প্রকার

হলো আল্লাহর সাথে শরীককারী এবং এমন

লোক যারা মুসলমান ভাইদের প্রতি বিদ্বেষভাব

পোষণ করে” [ইমাম আহমদ (রহ:) বর্ণিত]।

নবী করীম (দ:) বলেন যে এই রাত যখন

আগমন করে তখন আমাদের উচিত সারা রাত

এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হওয়া এবং পরের

দিন রোযা রাখা, কেননা সূর্যাস্ত

থেকে সোবেহ সাদেক পর্যন্ত আল্লাহ

সবাইকে ডেকে বলেন, “ক্ষমাপ্রার্থী কেউ

এমন আছ কি, যাকে আমি মাফ করতে পারি? রিযক-

প্রার্থী এমন কেউ আছ কি, যাকে আমি রিযক দান

করতে পারি? রোগাক্রান্ত কেউ আছ কি,

যাকে আমি আরোগ্য দিতে পারি?” [ইবনে মাজাহ

(রহ:) বর্ণিত]

ইমাম আলী (রা:) শা’বান মাসের ১৫ তারিখের

রাতে ঘরের বাইরে গিয়ে আসমানের

দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি বলেন যে হযরত

দাউদ (নবী আলাইহিস্ সালাম)-ও এই রাতের একই

সময়ে ঘরের বাইরে যেতেন এবং হযরত দাউদ

(আ:) বলেছেন যে কেউ যদি এই সময়

আল্লাহকে ডাকে, তাহলে আল্লাহ তার প্রার্থনার

জবাব দেন; আর কেউ তাঁর

কাছে ক্ষমা চাইলে তাকেও তিনি মাফ করে দেন।

এই কারণেই ইমাম আলী (রা:)

সারা রাতব্যাপী এবাদত-বন্দেগী করতেন।

বর্ণিত আছে যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান,

“পাঁচটি রাতে দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না: রজব

মাসের ১ম রাত, শা’বান মাসের ১৫ তারিখের রাত,

বৃহষ্পতিবার রাত, ঈদুল ফিতরের (রোযার ঈদের)

রাত এবং ঈদুল আযহার (কোরবানি ঈদের)

রাত।” [ইমাম সৈয়ুতী বর্ণিত]

হযরত একরিমাহ (রা:) ও অন্যান্য তাফসীরবিদ

উলেমা বলেন যে আল-কুরআনের

সূরা দুখানে উল্লেখিত ‘লাইলাতুল

মোবারাকাহ’ (বরকতময় রাত) বলতে শা’বান

মাসের ১৫ তারিখের রাতকে উদ্দেশ্য

করা হয়েছে [তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মোফাসসিরীন

এটিকে ‘লাইলাতুল কদর’ তথা কদরের

রাত্রি বলেছেন]।





 আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান,

“এই রাতে প্রতিটি হেকমতময় আজ্ঞার বণ্টন

স্পষ্ট হয়” [সূরা দুখান, ৪র্থ আয়াত]।

তাফসীরকারদের এই মতানুযায়ী, শবে বরাতের

রাতে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের

জন্যে পরবর্তী বছরের যে রিযক বরাদ্দ

করেছেন তা বলবৎ হয় (ইমাম আহমদ রেযা খান

কৃত তাফসীরে কানযুল ঈমানেও লাইলাতুল

কদরের পাশাপাশি শবে বরাতের কথা উল্লেখ

আছে – অনুবাদক)। তাঁদের রিযক বরাদ্দের

পাশাপাশি যাদের ভাগ্যে মৃত্যু লেখা আছে,

তাদেরও নাম উল্লেখ করা হয়। হযরত

’আতা ইবনে এয়াসার (রা:) বলেন যে এই

রাতে মৃত্যুদূত আজরাইল

ফেরেশতা একটি তালিকা পান;

এটিতে আসছে বছর যারা ইন্তেকাল করবেন

তাদের নাম থাকে। “কোনো ব্যক্তি ফসল

রোপণ, বিয়ে-শাদী ও ঘর নির্মাণ

করতে পারেন, কিন্তু তার নাম

ইতোমধ্যে মৃতদের তালিকায় লিপিবদ্ধ

হয়েছে।” তাই পুণ্যবান মুসলমানদের

অনেকেই শবে বরাতে আল্লাহর কাছে তাঁর

মনোনীত বান্দাদের নামের তালিকায়

নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে দরখাস্ত

করতেন, যেমনিভাবে তাঁরা প্রচুর রিযকের

জন্যেও প্রার্থনা করতেন।

সাইয়্যেদুনা উমর ইবনে আব্দিল আযীয (রহ:)

বলেন, “বছরের

চারটি রাতকে উপেক্ষা করবে না,

কেননা ওগুলোতে আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের

প্রতি রহমত নাযেল করেন: রজব মাসের ১ম রাত,

শা’বান মাসের ১৫ তারিখের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত

এবং ঈদুল আযহার রাত।” এই কারণে প্রাথমিক যুগের

মুসলমানদের অনেকেই শা’বান মাসের ১৫

তারিখের রাতকে ‘জীবন্ত’ করে তুলতেন।

তাঁরা মানুষকে ওই রাতে মসজিদে এসে রাত

জেগে এবাদত-বন্দেগী ও

ক্ষমা প্রার্থনা (তওবা) করার জন্যে উৎসাহিত

করতেন।

বেশ কিছু হাদীসে বলা হয়েছে যে এই

রাতে আল্লাহতা’লার রহমত-

বরকতপ্রাপ্তি থেকে কয়েক শ্রেণীর মানুষ

বাদ পড়বে। এদের

মধ্যে রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে শরীক

করে এবং যারা মুসলমান ভাইদের প্রতি বিদ্বেষভাব

পোষণ করে। কিছু কিছু

উলেমা সুনির্দিষ্টভাবে সেই সব লোকের

কথা উল্লেখ করেন যারা সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)

বা প্রাথমিক যুগের মুসলমানদেরকে অপমান

করে থাকে, কিংবা যারা মুসলমানদেরকে কাফের

(’মুশরিক’) ও

বেদআতী আখ্যা দিয়ে থাকে [যেমন –

ওহাবী, মওদূদী, সালাফী এন্ড কোং –

অনুবাদক]। এছাড়া, রহমত থেকে বঞ্চিত

লোকদের

মধ্যে রয়েছে যেনাকারী (অবৈধ যৌনাচারী),

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও পিতা-মাতার

অবাধ্য সন্তান।

এই শ্রেণীভুক্ত লোকেরা রমযান মাসের ১ম

রাত ও লাইলাতুল কদরের মতো মহিমান্বিত

রজনীগুলোতেও আল্লাহর রহমত-বরকত পায়

না। তাই আমাদের উচিত এই সব গুনাহ ও দূষণীয়

কাজ সর্বাত্মকভাবে এড়িয়ে চলা। প্রাথমিক জমানার

কোনো এক আলেম বলেছিলেন,

“সর্বোত্তম গুণাবলী হলো নির্মল অন্তর,

মহানুভব আত্মা ও উম্মতের কল্যাণকামী হওয়া।

এই সকল গুণের মাধ্যমেই পুণ্যবান

বুযূর্গানে দ্বীন নিজ নিজ সুউচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত

হয়েছেন, বিপুল পরিমাণ এবাদত-বন্দেগী ও

রোযা (উপবাস) দ্বারা নয়।”

শবে বরাতে যে রহমত-বরকত আল্লাহ পাক

মঞ্জুর করেন, তা যেন আমাদের প্রতিও

তিনি বর্ষণ করেন। এই রাতে তাঁর

কাছে প্রার্থনা দ্বারা তাঁরই রেযামন্দি হাসিল ও

ক্ষমা লাভের সামর্থ্য যেন তিনি আমাদের

নসীব করেন; আমরা এও তাঁর

কাছে কামনা করি যেন তিনি আমাদের সামগ্রিক

কল্যাণ বরাদ্দ করেন এবং সকল অনিষ্ট দূর করেন।

তিনি যেন অফুরন্ত সালাত-সালাম আমাদের

হেদায়াতদাতা মহানবী (দ:)-এর প্রতি প্রেরণ

করেন, যাঁর

মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি দুনিয়ার জীবন

থেকে আখেরাতের জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব

এবং যাঁর হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শনের মধ্যে নিহিত

এই জীবন ও পরকালীন জীবনের সকল

কল্যাণ।

[শায়খ আব্দুল করিম ইয়াহইয়া ইয়েমেনের

হাদরামাওতে বসবাস করেন। এ দেশীয়

বাতেলপন্থীরা দাবি করে থাকে যে শবে বরাত

শুধু উপমহাদেশেই পালন করা হয়, আরবে নয়।

তাদের এই অসত্য দাবি খণ্ডনের উদ্দেশ্যেই

এই লেখাটি অনুবাদ করা হয়েছে।

Top