ইসলাম আল্লাহ তায়ালার মনোনীত একমাত্র ‘দ্বীন’ একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, দোলনা থেকে কবর পযর্ন্ত এ ব্যবস্থার আলোকে একজন মুসলমানকে জীবন যাপন করতে হয়, মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন, ন্যায়নীতি ও সুবিচার ভিত্তিক শান্তি শৃংখলাপূর্ণ গতিশীল সমাজ গঠন ও সংরক্ষণে ইসলামের কোন বিকল্প নেই, হতে ও পারেনা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ان الدين عند الله الاسلام
অর্থাৎ, ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ‘দ্বীন’।(১)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : ومن يبتغ غير الاسلام دينا فلن يقبل منه-
অর্থাৎ, কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ‘দ্বীন’ গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবূল করা হবেনা।(২)
ইসলামী আর্দশ ও শিষ্টাচারিতা অতি চমৎকার, ছোট-বড় সকলের প্রাপ্য অধিকার, স্নেহ, ভালবাসা, সম্মান, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের যে শিক্ষা ইসলামে দেয়া হয়েছে তা অন্য কোন ধর্মে দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
بعثت معلما لاتمم مكارم الاخلاق-
অর্থাৎ, আমি ্উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।(৩)
বস্তুত প্রিয় নবীজী (দঃ) ইরশাদ করেন اكمل المؤمنين ايمانا احسنهم خلقا-
অর্থাৎ, মু’মিনদের মাঝে উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী তারাই যারা সুন্দর চরিত্রের অধিকারী।(৪)
বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ সম্পর্কে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃليس منا من لم يرهم صغيرنا ولم يوقر كبيرنا –
অর্থাৎ, যে বড়দের সম্মান করেনা এবং ছোটকে স্নেহ করেনা সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।(৫)
সুতরাং ছোটদের প্রতি স্নেহ ও বড়দের সম্মান প্রদর্শন নবী-ই করীমের শিক্ষা, সম্মান প্রদর্শন বিভিন্নভাবে হতে পারে, যেমন- সালাম প্রদান, পিছনে চলা, বিনয়ী ও নিম্ন স্বরে কথা বলা, দেখলে সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া, কাজ-কর্মে সহযোগীতা করা, প্রয়োজনীয় বস্তু এগিয়ে দেয়া, যাতয়াত ও সাক্ষাতের প্রাক্কালে হাতবুচি ও কদমবুচি (হাত ও পা চম্বুন) করা,অনেকে এ জায়েয ও সুন্নাতী আমল কদমবুচিকে নাজায়েয মনে করে, এমনকি উহাকে হারাম ও শিরক ইত্যাদি ফতোয়া দিতে ও দ্বিধা করেনা। বড় দুঃখ ও পরিতাপের ব্যাপার যে কোরআন-হাদীসে অনুমোদিত এমন একটি সুন্নাতী আমলকে শিরকসহ ইত্যাদি লাগামহীন বক্তব্য দ্বারা সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলে নিজেরা পথভ্রষ্ট হইতেছে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করতেছে। আর ক্রমশ সমাজ হচ্ছে শিষ্টাচার বঞ্চিত।
তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা সুন্দরতম আদব-কায়দার অন্যতম পন্থা যে কদমবুচি ইসলামী শরীয়তে কুতটুকু অনুমোদিত তা পাঠক সম্মুখে উপস্থাপনই এ প্রয়াস। নিন্মে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত দলীল পেশ করা হল :
১নং হাদীস :
عن زارع وكان فى وفد عبد القيس قال لما قدمنا المدينة وجعلنانتبادر من رواحلنا فنقبل يد رسول الله صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থাৎ হযরত যারেঈ রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু যিনি আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা যখন ম’দ্বীন’া শরীফে আগমন করলাম তখন আমাদের বাহন হতে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম এবং রসূল এ করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হস্ত মোবারক ও পা মোবারক চম্বুন করলাম।(৬)
২ নং হাদীস :
عن صفوان بن عسال ان قوما من اليهود قبلوا يد النبى صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থাৎ, হযরত ছাফওয়ান বিন আসলাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই ইয়াহুদীদের একটি গোত্র হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হাত ও পা মোবারক চুম্বন করেন।(৭)
৩ নং হাদীস:
হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
سأل أعربى النبى صلى الله عليه وسلم أية فقال له قل لتلك الشجرة رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعوك فقال فمالت الشجرة عن يمينها وشمالها وبين يديها وخلفها فقطعت عروقها ثم جاءت يتخذ الارض تجر عروقها مغبرة حتى وقعت بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم ثم قال له السلام عليك يا رسول الله قال الاعرابى مرها فلترجع الى منبتها فرجعت فدلت عروقها فاستوت فقال الاعربى ائذن لى اسجد لك قال لو أمرت احدا ان يسجد لاحد لامرت المرأة ان
تسجد لزوجها قال فأذن لى ان اقبل يديك ورجليك فاذن له
অর্থাৎ, একজন বেদুঈন হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র কাছে মুজিযা দেখতে চাইল, হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেদুঈনকে এরশাদ করলেন ওই বৃক্ষটাকে বলো আল্লাহর রসূল তোমাকে ডাকছেন, সে যখন বললো বৃক্ষ তার ডানে-বামে, সম্মুখে পেছনে ঝুকল তখন ওটার শিকড়গুলো ভেঙ্গে গেল। তারপর তা মাটি খোদাই করে শিকড়গুলো টেনে বালি উড়িয়ে হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সম্মুখে এসে দাড়াল এবং বলল আস্সালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ! বেদুঈন বললো “আপনি তাকে আদেশ করুন যেন এটা ওখানে (উৎপত্তিস্থল) ফিরে যায়” তাঁর নির্দেশে ওটা ফিরে গেল এবং তার শেকড়গুলোর উপর গিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। বেদুঈন বললো “আমাকে অনুমতি দিন আমি আপনাকে সিজদা করবো” তিনি এরশাদ করলেন, “যদি কাউকে সাজদাহ করার হুকুম দিতাম তাহলে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম সে যেন তার স্বামীকে সাজদাহ করে।” বেদুঈন লোকটি আরজ করলো “হুযুর তাহলে আমাকে আপনার হস্ত ও পদদ্বয় মোবারক চুম্বন করার অনুমতি দিন” তিনি (নবীজী দঃ) তাকে অনুমতি প্রদান করলেন।(৮)
৪ নং হাদীস :
روى عن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقبل فاطمة ويقول اجد منها ريح الجنة وقبل ابو بكر رأس عائشة وقال النبى صلى الله عليه وسلم من قبل رجل امه فكان قبل عنبة الجنة
অর্থাৎ, হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, হযরত ফাতেমা (নবীজীর স্নেহের কন্যা) রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহাকে চুমু খেতেন আর তিনি বলতেন আমি ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছ থেকে বেহেশতের সুঘ্রান পাচ্ছি। হয়রত আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার মাথা মোবারক এ চুমু খেয়েছেন। আর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি তার মায়ের পা চুম্বন করবে সে যেন বেহেশতের চৌকট চুমু খেল।(৯)
৫ নং হাদীস :
عن ذكوان عن صهيب قال رايت عليا يقبل يد العباس ورجله
অর্থাৎ হযরত যাকওয়ান রদ্বিয়াল্লাহু হযরত ছুহাইব সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে (স্বীয় চাচা) হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহুর হাত ও পা যুগল চুম্বন করতে দেখেছি।(১০)
কদমবুচির শরয়ী অনুমোদনে ফোক্বাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীনে এজামদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য :
হযরত আল্লামা ইমাম আইনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
قال الامام العينى بعد كلام فعلم اباحة تقبيل اليد والرجل والرأس كما علم من احاديث المتقدمة اباحتها على الجبهة وعلى العينين وعلى الشفتين على وجه المبرة والكرام
অর্থাৎ, আল্লামা আইনী বলেন দীর্ঘ আলোচনার পরে হাত চুম্বন, কদমবুচি, মাথা বুচি, ও ইত্যাদির বৈধতা প্রমানিত হলো। যেভাবে বর্ণিত হাদীস হতে কপালে, দুই চোখের মাঝে, দু’ঠোটের উপরে চুমু দেয়ার বৈধতা প্রমাণিত হল, তবে এ সকল ক্ষেত্রে চুম্বন তখন জায়েয যখন সম্মান ও বরকত হাসিল উদ্দেশ্য হয়।(১১)
* মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) বলেন-
لا يكره التقبيل لزهد وعلم وكبرسن -قال النبوى رحمةالله تعالى عليه تقبيل اليد للغير ان كان لعلمه وصيانته وزهده وديانته ونحو ذالك من الامر الدينيه لم يكره بل يستحب
অর্থাৎ, তিনি বলেন, চুমু দেয়া মাকরুহ হবেনা যখন তা কোন পরহেজগারিতা, ইলম বা জ্ঞান ও বয়োজৌষ্ঠের কারনে হবে। ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাত চুম্বন, যদি ব্যক্তির জ্ঞানগত মার্যাদা, খোদা ভীরুতা ও ধামির্কতা ইত্যাদি কারনে হয় তাহলে মাকরুহ তো হবে না; বরং মুস্তাহাব বা উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত হবে।(১২)
* বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফতহুল বারী’ এর মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজর আল আসকালানী (রহ:) বলেন,
والحديث يدل على جواز تقبيل اليد والرجل -وقال الابهرى انما كرهها مالك اذا كانت على التعظيم والتكبر واما اذا كانت على وجه التقرب الى الله تعالى لدينه اولعلمه او لشرافته فان ذالك جائز-
অর্থাৎ, (তিনি বলেন) হাদীস শরীফ দ্বারা হাতবুচি ও কদমবুচির বৈধতা ও অনুমোদন প্রমাণিত তবে ইমাম মালেক ও ইমাম আবহারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমা এগুলিকে মাকরুহ বলেছেন যদি বড়ত্ব আহমিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু যদি আল্লাহ তা’য়ালার নেকট্যবান বান্দা বা জ্ঞানগত সম্মান ও মর্যাদার কারনে হয় তাহলে উহা নি:সন্দেহে জায়েয।(১৩)
* বুখারী শরীফে মুকাদ্দামায় আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন-
قال جاء مسلم بن الحجاج الى البخارى فقبل بين عينيه وقال دعنى اقبل رجليك يا استاذ الاستاذين ويا سيدالمحدثين ويا طبيب الحديث فى علله –
অর্থাৎ,- একদা হযরত ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি হযরত ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষাৎ পানে ধন্য হওয়ার জন্য আগমন করে ইমাম বুখারীর উভয় চোখের মাঝখানে চুম্বন করলেন, অত:পর তিনি ইমাম বুখারীকে সম্বোধন করে বললেন, হে শিক্ষককূল শিরমণি! মূহাদ্দিসগণের সম্রাট ও হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কারনসমূহ অনুসন্ধানে ডাক্তারের ভূমিকা পালনকারী সম্মানিত ও পবিত্র সত্ত্বা, আমাকে একটু মেহেরবানী করে আপনার পদযুগল চুম্বন করে ধন্য হওয়ার সুযোগ দিন।(১৪)
* আশিয়াতুল লমুয়াত এ বর্ণিত হয়েছে, পরহেজগার আলেমদের হাত চুম্বন জায়েয এবং কেহ কেহ বলেন ইনসাফ ও দ্বীনের সম্মানার্থে বুচা বা চুমু দেয় তাতে কোন দোষ নেই তবে দুনিয়াবী স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষে হলে তা অবশ্যই মাকরুহ, হাদীস শরীফে সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কদমবুচি বা কদম মোবারক চুম্বন করার একাধিক বর্ননা এসেছে। সুতরাং গ্রহণযোগ্য মত এটাই যে, সফর থেকে ফিরে এসে সাক্ষাতের সময় মুয়ানাকা ও চুম্বন করা জায়েয, মাকরুহ নয়।(১৫)
* পাক ভারত উপমহাদেশের সর্বজন স্বীকৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল হক মহাদ্দিসে দেহলভীর অভিমতঃ
قال الشيخ عبد الحق المحدث الدهلوى: وفى هذا الحديث دليل على جواز تقبيل الارجل-
অর্থাৎ, হযরত শায়খ এ দেহলভী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জারে কর্তৃক বর্ণিত কদমবুচি অনুমোদিত হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, (মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি চিত্তে) বুর্জগানে দ্বীন ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের পদযুগল চুমু দেয়ার বৈধতা অত্র হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত।
কদমবুচির বৈধতায় দেওবন্দীদের অভিমতঃ
وفی الفتاویٰ رشیدیہ: سوال:کسی شخص کے لئے تعظیم کو کھڑا ہو جانا اور پاوں پکڑنا اور چومنا تعظیما درست ہے یا نہیں؟
جواب: برائے تعظیم دینداروں کے لئے کھڑا ہونا درست ہے اور پاوں چومنا اس جیسی شخص کا بھی درست ثابت ہے۔
অর্থ, দেওবন্দি আলেম রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী তার রচিত “ফতুয়ায়ে রশিদিয়ার” মধ্যে প্রশ্নোত্তরে বলেন- প্রশ্ন: কোন ব্যক্তির সম্মানে দাড়ানো বা তাকে কদমবুচি করা বৈধ কিনা ?
উত্তর: দ্বীনদার ব্যক্তির সম্মানে দাড়ানো ও তাদের পায়ে চুমু খাওয়া বৈধ এবং তা হাদীসে রসূল দ্বারা প্রমাণিত।(১৬)
২. দেওবন্দী মুফতি শফির অভিমত :
حضرت شیخ محمد عابد سندھی نے اپنی رسالہ میں تحریر فرمایا کہ تعظیم و تکریم کیلئے دست بوسی یا قدم بوسی صرف ان لوگوں کی جائز ہے جو عالم صالح یا سلطان عادل ہویا کوئی دینی شرف و بزرگی رکھتا ہو۔[ذکر الشفعی فی جواھر الفقہ صفحہ،১৮৫ جلد،৮]
অর্থ- তিনি বলেন, হযরত শায়খ মুহাম্মদ আবেদ সিনদী বলেছেন, তাকওয়াবান আলেম, ন্যায়পরায়ন বাদশা, ধর্মীয় দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী শুধুমাত্র এমন লোকদের হাত ও পা চুম্বন করা জায়েয।(১৭)
৩. এমদাদুল ফতোয়া কিতাবের ভাষ্য মতে :
پس صحیح جواز تقبیل قدم فی نفسہ ہے اور فقہاء کی منع عارض مفسد۔
অর্থ- কদমবুচি মূলত একটি জায়েয আমল। তবে দিক বিবেচনা করে তা নিষেধ করেছেন।(১৮)
৪. এমদাদুল আহকাম গ্রন্থে আছে-عالم،والدین کہ تقبیل ید ورجل جائز ہے مگر انحناء مثل رکوع حرام ہے۔
অর্থ, আলেম, পিতা-মাতা ইত্যাদির হাত ও পায়ে চুম্বন করা জায়েয, কিন্তু রুকুর উদ্দেশ্য মাতা ঝুকানো হারাম।(১৯)
৫. ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া গ্রন্থে আছে-
جو شخص واجب الاکرم ہو اس کی قدم بوسی کے اجازت ہیں لیکن اعتقاد میں غلو نہ ہو اور سجدہ کی ھیّت نہ ہوئی پائی۔
অর্থ, যে ব্যক্তি সম্মানের পাত্র তার কদমবুচি করা বৈধ। তবে ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং সেজদার মত হবেনা।(২০)
৬. মৌলভী আশরাফ আলী থানভীর অভিমত :
اس حدیث پہ بھی معلوم ہوا ہے یہ جو محبین کے عادت ہے کہ پیر کے ہاتھ کو یا پیشانی وغیرہ کو بوسہ دیتے ہیں اسکا بھی کچھ حرج نہیں البتہ اذن شرعی سے تجاوز نہ چاہئے۔
অর্থ, তিনি “আওাকাশুফ” গ্রন্থের একটি হাদীস উদ্ধৃত করে বলেন, এই হাদীসের জ্ঞাতব্য মূল কথা হল- পীরের প্রায় মুরীদগণের অভ্যাস হল স্বীয় পীরের হাত, পা ও কপালে চুম্বন করা। সুতরাং এতে কোন অসুবিধা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে শরয়ী হুকুমের কোন ব্যাত্যয় যাতে না ঘটে।(২১)
যেহেতু বিশুদ্ধ হাদীস শরীফ, সাহাবায়ে কেরামের আমল ও বিশ্ব বরেন্য ওলামায়ে কেরাম-এর অভিমত ও আমল দ্বারা প্রমাণিত হল হাত ও কদমবুচি শুধু জায়েয নয়’ বরং সুন্নাত।
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে পায়ে হাত লাগিয়ে চুমু দেয়ার যে প্রচলন রয়েছে তা জায়েয বটে কিন্তু সুন্নাত নহে। কেননা প্রিয় নবীজীর যুগে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আমলই ছিল হাত ও পায়ে ঠোট লাগিয়ে চুমু খাওয়া। সুতরাং সুন্নাতের উপর আমল করতে গেলে আমাদের তাই করতে হবে; অন্যতায় সুন্নত আদায় হবে না।
পরিশেষে বলতে হয়, মা- বাবা, শিক্ষক মন্ডলী, পীর-মাশায়েখ, বুজুর্গানে দ্বীন এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে হাত বুচি ও কদমবুচি নি:সন্দেহে একটি বৈধ ও সুন্নাতী আমল, যা নতুন প্রজন্মের একটি উত্তম আদর্শ ও বটে। এতে শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি, স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। আর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার না হও আর ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা; যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরেকে ভাল না বাস।” বড় বা গুনীজনদের ক্ষেত্রে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হল ইসলাম প্রদর্শিত পন্থায় শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে, আর ছোটদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায় স্নেহ বিনিময়ের মাধ্যমে। সুতরাং একে অপরকে ভালবাসা ঈমানের দাবী ও ঈমানদারের পরিচায়ক আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর রাসূলের শেখানো আদর্শ পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন ‘বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন’।
তথ্যসূত্র :-
১. সূরা আলে ইমরান. ৩:১৯।
২. সূরা আলে ইমরান ৩:৮৫।
৩. মুসনাদে আহমদ, মিশকাত শরীফ পৃ. ৪৩২।
৪. সূত্র : আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ পৃ- ৪৩২-৪৩৩।
৫. তিরমিযী, সুত্র: মিশকাত শরীফ ৪২৩ পৃষ্ঠা।
৬. সূত্র: আবূ দাউদ শরীফের সূত্রে মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃষ্ঠা: ৪০২।
৭. সূত্র: ইবনে মাজাহ পৃ: ২৯২।
৮. সূত্রঃ শিফা শরীফ, দালাইলুন্নুবয়্যাহ আবু না’ঈম, পৃষ্ঠা- ৩৩২।
৯. সূত্র: মাবসুত লিস সারাখছি, খন্ড-১০, পৃষ্ঠা: ১৪৯।
১০. সূত্রঃ মিশকাত শরীফ।
১১. সূত্রঃ রদ্দুল মোখতার, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা- ৩৮০।
১২. সূত্রঃ মিরকাত, খন্ড ৯ম, পৃঃ ৭৬।
১৩. সূত্র: ফতহুল বারী শরহে বুখারী, খন্ড- ১১তম, পৃ: ৫৭।
১৪. সূত্র: মুকাদ্দামাতু সহিহীল বুখারী, পৃষ্ঠা- ৩।
১৫. সূত্র: আশিয়াতুল লময়াত, খন্ডঃ ৪র্থ, পৃ: ৩৩, মোজাহিরুল হক্ব, খন্ড: ৪র্থ, পৃষ্ঠা: ৬০।
১৬. সূত্রঃ ফতুয়ায়ে রশিদিয়া।
১৭. সূত্র: জাওহারুল ফিকহ: খন্ড ১, পৃ: ১৮৫।
১৮. সুত্রঃ- প্রাগুক্ত, খন্ড ৫, পৃ: ৪৫।
১৯. সূত্র: এমদাদুল আহকাম: খন্ড, ১ম পৃ: ৩৫ পৃষ্ঠা।
২০. সূত্র: ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: খন্ড-১ পৃষ্ঠা: ১৭৫।
২১. সূত্রঃ ‘আত্তাকাশুফ’।
অর্থাৎ, ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ‘দ্বীন’।(১)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : ومن يبتغ غير الاسلام دينا فلن يقبل منه-
অর্থাৎ, কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ‘দ্বীন’ গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবূল করা হবেনা।(২)
ইসলামী আর্দশ ও শিষ্টাচারিতা অতি চমৎকার, ছোট-বড় সকলের প্রাপ্য অধিকার, স্নেহ, ভালবাসা, সম্মান, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের যে শিক্ষা ইসলামে দেয়া হয়েছে তা অন্য কোন ধর্মে দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
بعثت معلما لاتمم مكارم الاخلاق-
অর্থাৎ, আমি ্উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।(৩)
বস্তুত প্রিয় নবীজী (দঃ) ইরশাদ করেন اكمل المؤمنين ايمانا احسنهم خلقا-
অর্থাৎ, মু’মিনদের মাঝে উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী তারাই যারা সুন্দর চরিত্রের অধিকারী।(৪)
বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ সম্পর্কে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃليس منا من لم يرهم صغيرنا ولم يوقر كبيرنا –
অর্থাৎ, যে বড়দের সম্মান করেনা এবং ছোটকে স্নেহ করেনা সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।(৫)
সুতরাং ছোটদের প্রতি স্নেহ ও বড়দের সম্মান প্রদর্শন নবী-ই করীমের শিক্ষা, সম্মান প্রদর্শন বিভিন্নভাবে হতে পারে, যেমন- সালাম প্রদান, পিছনে চলা, বিনয়ী ও নিম্ন স্বরে কথা বলা, দেখলে সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া, কাজ-কর্মে সহযোগীতা করা, প্রয়োজনীয় বস্তু এগিয়ে দেয়া, যাতয়াত ও সাক্ষাতের প্রাক্কালে হাতবুচি ও কদমবুচি (হাত ও পা চম্বুন) করা,অনেকে এ জায়েয ও সুন্নাতী আমল কদমবুচিকে নাজায়েয মনে করে, এমনকি উহাকে হারাম ও শিরক ইত্যাদি ফতোয়া দিতে ও দ্বিধা করেনা। বড় দুঃখ ও পরিতাপের ব্যাপার যে কোরআন-হাদীসে অনুমোদিত এমন একটি সুন্নাতী আমলকে শিরকসহ ইত্যাদি লাগামহীন বক্তব্য দ্বারা সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলে নিজেরা পথভ্রষ্ট হইতেছে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করতেছে। আর ক্রমশ সমাজ হচ্ছে শিষ্টাচার বঞ্চিত।
তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা সুন্দরতম আদব-কায়দার অন্যতম পন্থা যে কদমবুচি ইসলামী শরীয়তে কুতটুকু অনুমোদিত তা পাঠক সম্মুখে উপস্থাপনই এ প্রয়াস। নিন্মে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত দলীল পেশ করা হল :
১নং হাদীস :
عن زارع وكان فى وفد عبد القيس قال لما قدمنا المدينة وجعلنانتبادر من رواحلنا فنقبل يد رسول الله صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থাৎ হযরত যারেঈ রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু যিনি আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা যখন ম’দ্বীন’া শরীফে আগমন করলাম তখন আমাদের বাহন হতে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম এবং রসূল এ করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হস্ত মোবারক ও পা মোবারক চম্বুন করলাম।(৬)
২ নং হাদীস :
عن صفوان بن عسال ان قوما من اليهود قبلوا يد النبى صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থাৎ, হযরত ছাফওয়ান বিন আসলাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই ইয়াহুদীদের একটি গোত্র হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হাত ও পা মোবারক চুম্বন করেন।(৭)
৩ নং হাদীস:
হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
سأل أعربى النبى صلى الله عليه وسلم أية فقال له قل لتلك الشجرة رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعوك فقال فمالت الشجرة عن يمينها وشمالها وبين يديها وخلفها فقطعت عروقها ثم جاءت يتخذ الارض تجر عروقها مغبرة حتى وقعت بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم ثم قال له السلام عليك يا رسول الله قال الاعرابى مرها فلترجع الى منبتها فرجعت فدلت عروقها فاستوت فقال الاعربى ائذن لى اسجد لك قال لو أمرت احدا ان يسجد لاحد لامرت المرأة ان
تسجد لزوجها قال فأذن لى ان اقبل يديك ورجليك فاذن له
অর্থাৎ, একজন বেদুঈন হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র কাছে মুজিযা দেখতে চাইল, হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেদুঈনকে এরশাদ করলেন ওই বৃক্ষটাকে বলো আল্লাহর রসূল তোমাকে ডাকছেন, সে যখন বললো বৃক্ষ তার ডানে-বামে, সম্মুখে পেছনে ঝুকল তখন ওটার শিকড়গুলো ভেঙ্গে গেল। তারপর তা মাটি খোদাই করে শিকড়গুলো টেনে বালি উড়িয়ে হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সম্মুখে এসে দাড়াল এবং বলল আস্সালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ! বেদুঈন বললো “আপনি তাকে আদেশ করুন যেন এটা ওখানে (উৎপত্তিস্থল) ফিরে যায়” তাঁর নির্দেশে ওটা ফিরে গেল এবং তার শেকড়গুলোর উপর গিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। বেদুঈন বললো “আমাকে অনুমতি দিন আমি আপনাকে সিজদা করবো” তিনি এরশাদ করলেন, “যদি কাউকে সাজদাহ করার হুকুম দিতাম তাহলে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম সে যেন তার স্বামীকে সাজদাহ করে।” বেদুঈন লোকটি আরজ করলো “হুযুর তাহলে আমাকে আপনার হস্ত ও পদদ্বয় মোবারক চুম্বন করার অনুমতি দিন” তিনি (নবীজী দঃ) তাকে অনুমতি প্রদান করলেন।(৮)
৪ নং হাদীস :
روى عن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقبل فاطمة ويقول اجد منها ريح الجنة وقبل ابو بكر رأس عائشة وقال النبى صلى الله عليه وسلم من قبل رجل امه فكان قبل عنبة الجنة
অর্থাৎ, হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, হযরত ফাতেমা (নবীজীর স্নেহের কন্যা) রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহাকে চুমু খেতেন আর তিনি বলতেন আমি ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছ থেকে বেহেশতের সুঘ্রান পাচ্ছি। হয়রত আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার মাথা মোবারক এ চুমু খেয়েছেন। আর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি তার মায়ের পা চুম্বন করবে সে যেন বেহেশতের চৌকট চুমু খেল।(৯)
৫ নং হাদীস :
عن ذكوان عن صهيب قال رايت عليا يقبل يد العباس ورجله
অর্থাৎ হযরত যাকওয়ান রদ্বিয়াল্লাহু হযরত ছুহাইব সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে (স্বীয় চাচা) হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহুর হাত ও পা যুগল চুম্বন করতে দেখেছি।(১০)
কদমবুচির শরয়ী অনুমোদনে ফোক্বাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীনে এজামদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য :
হযরত আল্লামা ইমাম আইনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
قال الامام العينى بعد كلام فعلم اباحة تقبيل اليد والرجل والرأس كما علم من احاديث المتقدمة اباحتها على الجبهة وعلى العينين وعلى الشفتين على وجه المبرة والكرام
অর্থাৎ, আল্লামা আইনী বলেন দীর্ঘ আলোচনার পরে হাত চুম্বন, কদমবুচি, মাথা বুচি, ও ইত্যাদির বৈধতা প্রমানিত হলো। যেভাবে বর্ণিত হাদীস হতে কপালে, দুই চোখের মাঝে, দু’ঠোটের উপরে চুমু দেয়ার বৈধতা প্রমাণিত হল, তবে এ সকল ক্ষেত্রে চুম্বন তখন জায়েয যখন সম্মান ও বরকত হাসিল উদ্দেশ্য হয়।(১১)
* মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) বলেন-
لا يكره التقبيل لزهد وعلم وكبرسن -قال النبوى رحمةالله تعالى عليه تقبيل اليد للغير ان كان لعلمه وصيانته وزهده وديانته ونحو ذالك من الامر الدينيه لم يكره بل يستحب
অর্থাৎ, তিনি বলেন, চুমু দেয়া মাকরুহ হবেনা যখন তা কোন পরহেজগারিতা, ইলম বা জ্ঞান ও বয়োজৌষ্ঠের কারনে হবে। ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাত চুম্বন, যদি ব্যক্তির জ্ঞানগত মার্যাদা, খোদা ভীরুতা ও ধামির্কতা ইত্যাদি কারনে হয় তাহলে মাকরুহ তো হবে না; বরং মুস্তাহাব বা উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত হবে।(১২)
* বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফতহুল বারী’ এর মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজর আল আসকালানী (রহ:) বলেন,
والحديث يدل على جواز تقبيل اليد والرجل -وقال الابهرى انما كرهها مالك اذا كانت على التعظيم والتكبر واما اذا كانت على وجه التقرب الى الله تعالى لدينه اولعلمه او لشرافته فان ذالك جائز-
অর্থাৎ, (তিনি বলেন) হাদীস শরীফ দ্বারা হাতবুচি ও কদমবুচির বৈধতা ও অনুমোদন প্রমাণিত তবে ইমাম মালেক ও ইমাম আবহারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমা এগুলিকে মাকরুহ বলেছেন যদি বড়ত্ব আহমিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু যদি আল্লাহ তা’য়ালার নেকট্যবান বান্দা বা জ্ঞানগত সম্মান ও মর্যাদার কারনে হয় তাহলে উহা নি:সন্দেহে জায়েয।(১৩)
* বুখারী শরীফে মুকাদ্দামায় আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন-
قال جاء مسلم بن الحجاج الى البخارى فقبل بين عينيه وقال دعنى اقبل رجليك يا استاذ الاستاذين ويا سيدالمحدثين ويا طبيب الحديث فى علله –
অর্থাৎ,- একদা হযরত ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি হযরত ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষাৎ পানে ধন্য হওয়ার জন্য আগমন করে ইমাম বুখারীর উভয় চোখের মাঝখানে চুম্বন করলেন, অত:পর তিনি ইমাম বুখারীকে সম্বোধন করে বললেন, হে শিক্ষককূল শিরমণি! মূহাদ্দিসগণের সম্রাট ও হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কারনসমূহ অনুসন্ধানে ডাক্তারের ভূমিকা পালনকারী সম্মানিত ও পবিত্র সত্ত্বা, আমাকে একটু মেহেরবানী করে আপনার পদযুগল চুম্বন করে ধন্য হওয়ার সুযোগ দিন।(১৪)
* আশিয়াতুল লমুয়াত এ বর্ণিত হয়েছে, পরহেজগার আলেমদের হাত চুম্বন জায়েয এবং কেহ কেহ বলেন ইনসাফ ও দ্বীনের সম্মানার্থে বুচা বা চুমু দেয় তাতে কোন দোষ নেই তবে দুনিয়াবী স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষে হলে তা অবশ্যই মাকরুহ, হাদীস শরীফে সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কদমবুচি বা কদম মোবারক চুম্বন করার একাধিক বর্ননা এসেছে। সুতরাং গ্রহণযোগ্য মত এটাই যে, সফর থেকে ফিরে এসে সাক্ষাতের সময় মুয়ানাকা ও চুম্বন করা জায়েয, মাকরুহ নয়।(১৫)
* পাক ভারত উপমহাদেশের সর্বজন স্বীকৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল হক মহাদ্দিসে দেহলভীর অভিমতঃ
قال الشيخ عبد الحق المحدث الدهلوى: وفى هذا الحديث دليل على جواز تقبيل الارجل-
অর্থাৎ, হযরত শায়খ এ দেহলভী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জারে কর্তৃক বর্ণিত কদমবুচি অনুমোদিত হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, (মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি চিত্তে) বুর্জগানে দ্বীন ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের পদযুগল চুমু দেয়ার বৈধতা অত্র হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত।
কদমবুচির বৈধতায় দেওবন্দীদের অভিমতঃ
وفی الفتاویٰ رشیدیہ: سوال:کسی شخص کے لئے تعظیم کو کھڑا ہو جانا اور پاوں پکڑنا اور چومنا تعظیما درست ہے یا نہیں؟
جواب: برائے تعظیم دینداروں کے لئے کھڑا ہونا درست ہے اور پاوں چومنا اس جیسی شخص کا بھی درست ثابت ہے۔
অর্থ, দেওবন্দি আলেম রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী তার রচিত “ফতুয়ায়ে রশিদিয়ার” মধ্যে প্রশ্নোত্তরে বলেন- প্রশ্ন: কোন ব্যক্তির সম্মানে দাড়ানো বা তাকে কদমবুচি করা বৈধ কিনা ?
উত্তর: দ্বীনদার ব্যক্তির সম্মানে দাড়ানো ও তাদের পায়ে চুমু খাওয়া বৈধ এবং তা হাদীসে রসূল দ্বারা প্রমাণিত।(১৬)
২. দেওবন্দী মুফতি শফির অভিমত :
حضرت شیخ محمد عابد سندھی نے اپنی رسالہ میں تحریر فرمایا کہ تعظیم و تکریم کیلئے دست بوسی یا قدم بوسی صرف ان لوگوں کی جائز ہے جو عالم صالح یا سلطان عادل ہویا کوئی دینی شرف و بزرگی رکھتا ہو۔[ذکر الشفعی فی جواھر الفقہ صفحہ،১৮৫ جلد،৮]
অর্থ- তিনি বলেন, হযরত শায়খ মুহাম্মদ আবেদ সিনদী বলেছেন, তাকওয়াবান আলেম, ন্যায়পরায়ন বাদশা, ধর্মীয় দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী শুধুমাত্র এমন লোকদের হাত ও পা চুম্বন করা জায়েয।(১৭)
৩. এমদাদুল ফতোয়া কিতাবের ভাষ্য মতে :
پس صحیح جواز تقبیل قدم فی نفسہ ہے اور فقہاء کی منع عارض مفسد۔
অর্থ- কদমবুচি মূলত একটি জায়েয আমল। তবে দিক বিবেচনা করে তা নিষেধ করেছেন।(১৮)
৪. এমদাদুল আহকাম গ্রন্থে আছে-عالم،والدین کہ تقبیل ید ورجل جائز ہے مگر انحناء مثل رکوع حرام ہے۔
অর্থ, আলেম, পিতা-মাতা ইত্যাদির হাত ও পায়ে চুম্বন করা জায়েয, কিন্তু রুকুর উদ্দেশ্য মাতা ঝুকানো হারাম।(১৯)
৫. ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া গ্রন্থে আছে-
جو شخص واجب الاکرم ہو اس کی قدم بوسی کے اجازت ہیں لیکن اعتقاد میں غلو نہ ہو اور سجدہ کی ھیّت نہ ہوئی پائی۔
অর্থ, যে ব্যক্তি সম্মানের পাত্র তার কদমবুচি করা বৈধ। তবে ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং সেজদার মত হবেনা।(২০)
৬. মৌলভী আশরাফ আলী থানভীর অভিমত :
اس حدیث پہ بھی معلوم ہوا ہے یہ جو محبین کے عادت ہے کہ پیر کے ہاتھ کو یا پیشانی وغیرہ کو بوسہ دیتے ہیں اسکا بھی کچھ حرج نہیں البتہ اذن شرعی سے تجاوز نہ چاہئے۔
অর্থ, তিনি “আওাকাশুফ” গ্রন্থের একটি হাদীস উদ্ধৃত করে বলেন, এই হাদীসের জ্ঞাতব্য মূল কথা হল- পীরের প্রায় মুরীদগণের অভ্যাস হল স্বীয় পীরের হাত, পা ও কপালে চুম্বন করা। সুতরাং এতে কোন অসুবিধা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে শরয়ী হুকুমের কোন ব্যাত্যয় যাতে না ঘটে।(২১)
যেহেতু বিশুদ্ধ হাদীস শরীফ, সাহাবায়ে কেরামের আমল ও বিশ্ব বরেন্য ওলামায়ে কেরাম-এর অভিমত ও আমল দ্বারা প্রমাণিত হল হাত ও কদমবুচি শুধু জায়েয নয়’ বরং সুন্নাত।
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে পায়ে হাত লাগিয়ে চুমু দেয়ার যে প্রচলন রয়েছে তা জায়েয বটে কিন্তু সুন্নাত নহে। কেননা প্রিয় নবীজীর যুগে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আমলই ছিল হাত ও পায়ে ঠোট লাগিয়ে চুমু খাওয়া। সুতরাং সুন্নাতের উপর আমল করতে গেলে আমাদের তাই করতে হবে; অন্যতায় সুন্নত আদায় হবে না।
পরিশেষে বলতে হয়, মা- বাবা, শিক্ষক মন্ডলী, পীর-মাশায়েখ, বুজুর্গানে দ্বীন এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে হাত বুচি ও কদমবুচি নি:সন্দেহে একটি বৈধ ও সুন্নাতী আমল, যা নতুন প্রজন্মের একটি উত্তম আদর্শ ও বটে। এতে শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি, স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। আর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার না হও আর ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা; যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরেকে ভাল না বাস।” বড় বা গুনীজনদের ক্ষেত্রে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হল ইসলাম প্রদর্শিত পন্থায় শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে, আর ছোটদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায় স্নেহ বিনিময়ের মাধ্যমে। সুতরাং একে অপরকে ভালবাসা ঈমানের দাবী ও ঈমানদারের পরিচায়ক আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর রাসূলের শেখানো আদর্শ পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন ‘বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন’।
তথ্যসূত্র :-
১. সূরা আলে ইমরান. ৩:১৯।
২. সূরা আলে ইমরান ৩:৮৫।
৩. মুসনাদে আহমদ, মিশকাত শরীফ পৃ. ৪৩২।
৪. সূত্র : আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ পৃ- ৪৩২-৪৩৩।
৫. তিরমিযী, সুত্র: মিশকাত শরীফ ৪২৩ পৃষ্ঠা।
৬. সূত্র: আবূ দাউদ শরীফের সূত্রে মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃষ্ঠা: ৪০২।
৭. সূত্র: ইবনে মাজাহ পৃ: ২৯২।
৮. সূত্রঃ শিফা শরীফ, দালাইলুন্নুবয়্যাহ আবু না’ঈম, পৃষ্ঠা- ৩৩২।
৯. সূত্র: মাবসুত লিস সারাখছি, খন্ড-১০, পৃষ্ঠা: ১৪৯।
১০. সূত্রঃ মিশকাত শরীফ।
১১. সূত্রঃ রদ্দুল মোখতার, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা- ৩৮০।
১২. সূত্রঃ মিরকাত, খন্ড ৯ম, পৃঃ ৭৬।
১৩. সূত্র: ফতহুল বারী শরহে বুখারী, খন্ড- ১১তম, পৃ: ৫৭।
১৪. সূত্র: মুকাদ্দামাতু সহিহীল বুখারী, পৃষ্ঠা- ৩।
১৫. সূত্র: আশিয়াতুল লময়াত, খন্ডঃ ৪র্থ, পৃ: ৩৩, মোজাহিরুল হক্ব, খন্ড: ৪র্থ, পৃষ্ঠা: ৬০।
১৬. সূত্রঃ ফতুয়ায়ে রশিদিয়া।
১৭. সূত্র: জাওহারুল ফিকহ: খন্ড ১, পৃ: ১৮৫।
১৮. সুত্রঃ- প্রাগুক্ত, খন্ড ৫, পৃ: ৪৫।
১৯. সূত্র: এমদাদুল আহকাম: খন্ড, ১ম পৃ: ৩৫ পৃষ্ঠা।
২০. সূত্র: ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: খন্ড-১ পৃষ্ঠা: ১৭৫।
২১. সূত্রঃ ‘আত্তাকাশুফ’।