তাসবীহ্ ছড়া দিয়ে তাসবীহ্ জপা।

ইসলামী শরীয়তের মৌলিক নীতিমালার আলোকে প্রমাণিত হয় যে, যদি লোক দেখানো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে প্রচলিত তাসবীহ দ্বারা যিকির করা জায়েয আছে।

তাসবীহ্ হাতে থাকলে, কিংবা তাসবীহ্ ছড়া দেখলে মানুষ তাসবীহ্ পাঠে উৎসাহ পেয়ে থাকে, আর তাছাড়া তাতে আল্লাহর যিকিরের কথাও স্মরণে আসে। তাই তাসবীহ্ ছড়াকে “মুযাক্কীর” (যা স্মরণ করিয়ে দেয়)’-ও বলা যায়।

কাজেই, এ উদ্দেশ্যে যদি কেউ তাসবীহ্ ছড়া ব্যবহার করে তা কখনই বিদাআত হবে না।
কোন কিছু কারো কাছে মুবাহ বা বৈধতার সাধারণ নিয়ম হচ্ছে উহাকে সে দ্বীনে অপরিহার্য, কিংবা একে সুন্নাহ্ মনে করবে না।

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাসবিহ জিকিরের সমার্থকরূপেও ব্যবহৃত হয়। যেমন কেউ জিকিরে রত থাকলে বলা হয় তিনি তাসবিহ-তাহলিল করছেন।
এমনকি এটি এত বেশি পরিচিতি পেয়েছে যে, জিকিরের সংখ্যা গণনার জপমালাকেও তাসবিহ বলা হয় এবং এ জপমালায় যা-ই পাঠ করা হোক না কেন তাকে তসবিহ বা তাসবিহ পাঠ নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণ মানুষ একে তাসবিহ’র ছড়া, তাসবিহ’র দানা ইত্যাদি নামে চিনে। এর থেকে বোঝা যায়, জিকিরের ক্ষেত্রে তাসবিহ’র প্রভাব কতখানি প্রবল ও প্রকট রূপ পরিগ্রহ করেছে।
বর্তমানে তাসবিহ ইসলামী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। গ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ওজিফা বা জিকিরের সংখ্যা হাতের আঙুলের করে গণনা করা সুন্নত। তাসবিহ’র ছড়া ব্যবহার সুন্নত না হলেও এর দ্বারা ওজিফা আদায় করতে ও জিকিরের সংখ্যা মনে রাখতে খুবই সহজ এবং এটি জিকির ও ওজিফায় অভ্যস্ত করা এবং মনে করিয়ে দিতে সহায়ক হয়।
মনে রাখতে হবে তাসবিহ প্রচার বা প্রদর্শনের বিষয় নয়; এটি ইবাদতে সহায়ক বস্তু।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন:
رَأَيْتُ النَّبِيَّ  يَعْقِدُ التَّسْبِيْحَ بِيَدِهِ [بِيَمِيْنِهِ]
“আমি নবীজী (صلى الله عليه و آله وسلم)-কে দেখলাম তিনি নিজের হাতে [ডান হাতে] তাসবীহের গিঠ দিচ্ছেন (গণনা করছেন)।”
[সূত্রঃ তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৭২- বাব.. আকদীদ তাসবীহ) ৫/৪৮৬, নং ৩৪৮৬, (ভা ২/১৮৬); আবূ দাউদ ২/৮২ (ভা ১/২১০); মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩১, ৭৩২]।
এছাড়া রাসূলুল্লাহصلى الله عليه و آله وسلمহাতে গণনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন।
মহিলা সাহাবী ইউসাইরাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) আমাদেরকে বলেছেন:
عَلَيْكُنَّ بِالتَّسْبِيْحِ وَالتَّهْلِيْلِ وَالتَّقْدِيْسِ وَاعْقِدْنَ بِالأَنَامِلِ فَإِنَّهُنَّ مَسْؤُوْلاَتٌ وَمُسْتَنْطَقَاتٌ
“তোমরা মহিলাগণ অবশ্যই তাসবীহ (সুব‘হানাল্লাহ), তাহলীল (লা- ইলাহা ইল্লল্লাহ), তাকদীস (সুব্বুহুন ক্বুদ্দূসুন) করবে এবং আঙ্গুলের গিটে গণনা করবে; কারণ এদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে এবং কথা বলানো হবে। (এরা যিকিরের সাক্ষ্য প্রদান করবে।)”
[সূত্রঃ তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৭২- বাব.. আকদীদ তাসবীহ) ৫/৪৮৬, নং ৩৪৮৬, (ভা ২/১৮৬); সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১২২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩২, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৩৯]।
পাশাপাশি দানা বা তাসবীহ-মালা দ্বারা যিকির গণনা জায়েয ও সাহাবী-তাবেয়ীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত বলেও জানা যায়।

বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) কোনো কোনো সাহাবীকে দানা বা বীচির দ্বারা তাসবীহ-তাহলীল বা যিকির গণনা করতে দেখেছেন। তিনি তাঁদেরকে এভাবে গণনা করতে নিষেধ করেননি।

ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেন, কোন কারণে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম কোন এক মহিলার কাছে আসলেন, মহিলাটি তখন খেজুরের বীচি ও কাঁকর দিয়ে তাসবীহ্ গণনা করছিলেন। রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম তখন তাঁকে তিরষ্কার করেন নি, আবার অসম্মতি জ্ঞাপনও করেন নি।
ঈমাম তিরমিযী উক্ত হাদিস মুবারাককে ‘হাসান’ বলে রায় দিয়েছেন।
[সূত্রঃ هدية الأبرار في سبحة الأذكار، ص ২৩، دار الفتح]।


এ সকল হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কাঁকর, দানা, বীচি ইত্যাদির মাধ্যমে যিকির গণনা সুন্নাহ-সম্মত জায়েয।
পরবর্তী যুগে কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে জমা করা কাঁকর, দানা, গিরা দেওয়া সুতা বা ‘তাসবীহ’ ব্যবহারের কথা জানা যায়।
ঈমাম আহমদ রহমাতুল্লহি আলাইহি ‘আয্ যুহদ’ এ হযরত ইউনুস বিন উবাইদ সূত্রে তিনি তাঁর মা থেকে বর্ণনা করেন, আমাদের প্রতিবেশী সাহাবী হযরত আবু সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহুআনহু কাঁকর দিয়ে তাসবীহ-যিকির করতেন।

رقم৩৫৫৪ – حدثنا محمد بن بشار حدثنا عبد الصمد بن عبد الوارث حدثنا هاشم وهو ابن سعيد الكوفي حدثني كنانة مولى صفية قال سمعت صفية تقول : دخل علي رسول الله صلى الله عليه و سلم وبين يدي أربعة آلاف نواة أسبح بها فقلت لقد سبحت بهذه فقال ألا أعلمك بأكثر مما سبحت ؟ فقلت علمني فقال قولي سبحان الله عدد خلقه (ترمذي ২/১৯৫)
হযরত আবু সাফিয়্যা (রা) নামক এই সাহাবী পাত্র ভর্তি কাঁকর রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তিনি এগুলো দিয়ে যিকির করতেন। আবার বিকালেও অনুরূপ করতেন।

ইবনে সা’দ স্বীয় ‘তাবাকাত’-এ হযরত হাকীম বিন দাইলাই থেকে বর্ণনা করেনন, সাহাবী হযরত সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কাঁকর দিয়ে তাসবীহ তাহলীল ও যিকর্ করতেন।

ইবনে আবি শাইবাহ রহ. স্বীয় ‘মুসান্নাফ’-এ বর্ণনা করেন যে সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কাঁকর দিয়ে তাসবীহ-যিকির পাঠ করতেন।
ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা ফাতিমা গিঠ দেওয়া সুতা (তাসবীহের মতো) দ্বারা গণনা করে তাসবীহ তাহলীল করতেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা)-এর ১০০০ টি গিরা দেওয়া একটি সুতা ছিল। তিনি এ সংখ্যক তাসবিহ-তাহলীল পাঠ না করে ঘুমাতেন না। এছাড়া তিনি কাঁকর জমা করে তা দিয়ে যিকির করতেন বলে বর্ণিত আছে।
হযরত আবু দারদা (রা) খেজুরের বীচি একটি থলের মধ্যে রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে সেগুলো বাহির করে যিকিরের মাধ্যমে গণনা করে শেষ করতেন।

হাফিজুল হাদীস, আল্লামা ঈমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতি (৯১১হি.) রহ. ও আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী (১৩০৪হি.) উভয় তাসবীহ্ ছড়া ব্যবহারের বৈধতা বিষয়ে পৃথক পুস্তক সংকলণ করেছেন।
[দেখুন- (০১.) “المنحة فى السبحة” ضمن الحاوي للفتاوي، دار الكتب العلميه، ج.٢ ص.٢-٥

(০২.)
نزهة الفكر في سبحة الذكر” مع حاشيته “النفحة بتحشية النزهة” الملقب ب”هدية الأبرار في سبحة الأذكار” ضمن مجموعة رسائل اللكنوي، المكتبة الإمدادية، ص.١١٧-١٥٥]
[আরও দেখুন : মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৩৫৯, মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৩৫৫, ইবনু রাজাব, জামিইল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৪৪৬]।
প্রয়োজনে, বিশেষত যারা ওযীফা হিসেবে দৈনিক বেশি সংখ্যক যিকির নিজের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছেন তারা তাসবীহ, কাঁকর, বীচি, ছোলা, ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।

বর্তমান সৌদের আরবের ওহাবী শায়খ ইবনে উসাইমিন তসবিহ দানাকে ”বিদাত” সাব্যস্ত করে নি। শাইখ ইবনে উসাইমীন বলেছেন,
তাসবীহ্ দানা ব্যবহার করা জায়েয।
[দেখুন- ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম; আল-শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে সালিহ আল-উসাইমিন, আল-লিকা আল-মাফতুহ, ৩/৩০]।
নামধারী সালাফি, বেমাযহাবীরা যাকে ইমাম মানে, সে ইবনে তাইমিয়াও এ বিষয়ে মন্দ বলে নি।
[দেখুন- আল-ফাতওয়া, ২২/১৮৭]।
ফিত্না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আরব বিশ্বে ধিকৃত পরিত্যাক্ত নাসিরুদ্দিন আলবানীই কেবল বিদঅাত বলেছে। আর এটাকেই নব্য বিদঅাতি আখেরী যামানার ফিত্না বেমাযহাবী নামধারী আহলে হাদিস, কথিত সালাফী, ওহাবীরা বিদাত বলে প্রচার করছে।

এ বিষয়ে কতিপয় কথিত আহলে হাদীস, সালাফী নামধারী বক্তার কথা সঠিক নয়। কেননা সহীহ হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মহিলাকে খেজুর দানা অথবা কঙ্কর মাধ্যমে তাসবীহ পড়তে দেখে নিষেধ করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে কোনো কিছু করতে দেখে নিষেধ না করার অর্থ হচ্ছে এই কাজে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি আছে। এটাকে হাদীসের পরিভাষায় “তাক্বীরুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” বলে। তা মারফু হাদীসের অন্তর্ভূক্ত। আর তা কখনো বিদআত হতে পারে না।
সুতরাং এই তথাকথিত আহলে হাদীস, সালাফী নামধারী বেমাযহাবী ওহাবী আলেমেরা যে কথা বলে, সেই অর্থে কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে তারা মিথ্যের আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
[সূত্রঃ মিরকাতুল মাফাতিহ- ৫/২২১, রদ্দুল মুহতার- ১/২৫০ ও ২৫১, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/১৬৪]।



Top