হে আবু আব্দির রাহমান (ইবনে উমর রা.-এর উপ নাম) পাগড়ি কি সুন্নত ?

قال نعم

উত্তরে তিনি বলেন হ্যাঁ।
[সূত্রঃ উমদাতুল ক্বারী খণ্ড ১৯ পৃষ্ঠা ৭১০]।
কোন কোন আলেম এটাকে “পোশাকের সুন্নতও বলেছেন। যারা সুন্নাত বলেছেন, তারাও সুন্নাতে জায়েদা বলেছেন।

(أقرب الوسائل إلى شرح الشمائل)

আল্লামা শওকানী রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি বলেন,

والاحاديث يدل على استحباب لبس العمامة
একাধিক সূত্রে হাদীসের বর্ণনা পাগড়ি পরিধান মুস্তাহাব প্রমাণ করে।

( نيل الاوطار جلد٢ صفحة ١١٠)

আল্লামা মুনাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি “ফয়যুল ক্বাদীর”এ বলেন, পাগড়ী পরিধান করা মুস্তাহাব।

(درس ترمذى كتاب إللباس جاد ٩ صفحة ٣٤٣)
আল্লামা ইবনুল হাজ্জ রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি “মাদখাল” নামক কিতাবে পাগড়ি পরিধান করা মুবাহ বলেছেন।

(الدعامة صفحة١٠١)

সুন্নত আদায়ের যে সওয়াব রয়েছে পাগড়ী সুন্নত মনে করে পরিধান করলে সেই সওয়াব হবে।

উপরন্তু রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাগড়ি বাঁধার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধও করেছেন।

মুবারাক এক হাদিসে এসেছে :

عَلَيْكُمْ بِالْعَمَائِمِ فَإِنَّهَا سِيمَا الْمَلَائِكَةِ
অর্থাৎঃ তোমরা পাগড়ি বাঁধো; কেননা তা ফেরেশতাদের প্রতীক।
[সূত্রঃ শুআবুল ইমান, হাদিস নং- ৫৮৫১]।
বদর যুদ্ধের দিন আল্লাহ তাআলা পাঁচ হাজার ফেরেশতা মুসলমানদের সাহায্যের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তাদের সবাই পাগড়িবাঁধা ছিল।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু অানহুকে ডেকে পাগড়ি বেঁধে দিলেন। অতঃপর বললেন :

فاعتموا فإن العمامة سيما الإسلام وهى حاجز بين المسلمين والمشركين
অর্থাৎ: পাগড়ি বাঁধো; কারণ, পাগড়ি ইসলামের নিদর্শন এবং কুফর ও ঈমানের মাঝে পার্থক্য নিরূপণকারী।
[সূত্রঃ জামেউল আহাদিস, হাদিস নং-৩৮৩৫৪]।

অনুবাদ ছাড়া আরো হাদিস দিচ্ছি :
১ : عن ابن عباس قال: لما عمم رسول الله صلى الله عليه وسلم عليا بالسحاب قال له: “يا علي! العمائم تيجان العرب، والاحتباء حيطانها، وجلوس المؤمن في المسجد رباطه” .”الديلمي”.
كنز العمال في سنن الأقوال والأفعال – ১৫ / ৪৮৩
: ২ إن فرق ما بيننا وبين المشركين العمائم على القلانس . كنز العمال في سنن الأقوال والأفعال – ১৫ / ৩০৬
. ৩ – … عَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ قَالَ: أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِثِيَابٍ مِنَ الصَّدَقَةِ فَقَسَمَهَا بَيْنَ أَصْحَابِهِ فَقَالَ: ” اعْتَمُّوا خَالِفُوا عَلَى الْأُمَمِ قَبْلَكُمْ ” شعب الإيمان – ৮ / ২৯৫
আরো অনেক হাদিস দেওয়া যাবে। হাদিসের কিছু কিছু কিতাবে পাগড়ি বিষয়ে পৃথক অনুচ্ছেদও রয়েছে। এর দ্বারাই বিষয়টির গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।

পাগড়িকে আরবিতে الْعِمَامَةُ বলা হয়। আর الْعَمَائِمُ হচ্ছে এর বহুবচন। তবে পাগড়ির জন্যে الْعِصَابَةُ শব্দও ব্যবহৃত হয়। الْعَصَائِبُ হল এর বহুবচন। হাদিস ও ফিকহের কিতাবে দুনো শব্দই ব্যবহার হয়েছে। এ সংক্রান্ত কোনো বিধান জানতে হলে দুনো শব্দ লিখে সার্চ দিলে ফলাফল পাওয়া যাবে।

একটি হাদিসে এসেছে :

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَهُمْ أَنْ يَمْسَحُوا عَلَى الْعَصَائِبِ .
قَال الْخَطَّابِيُّ : الْعَصَائِبُ الْعَمَائِمُ سُمِّيَتْ عَصَائِبَ ؛ لأَنَّ الرَّأْسَ يُعْصَبُ بِهَا
দেখুন : سنن أبو داود مع شرح الخطابي ১ / ১০১ ، ১০২।

কারো কারো মতে, পাগড়ি হচ্ছে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বভাবগত সুন্নত (سنة عادية)। তবে মূলনীতি হল, কেউ যদি স্বভাবগত সুন্নতকে সুন্নতে নববী হিসেবে গ্রহণ করে, নিঃসন্দেহে সওয়াব পাবে। এতে কারো দ্বিমত নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে পাগড়ি না পরার মহামারি দেখা দিয়েছে। অনেক সুন্নতের মতো পাগড়ির সুন্নতও উপেক্ষিত। পাগড়িকে অনেকে আধুনিক পোশাক ও সাজসজ্জার অন্তরায় মনে করে। আবার অনেকে ঝামেলা ভাবে। কারো ইচ্ছে হলে পাগড়ি পরবে না; কিন্তু পাগড়িকে খারাপ জানা ও পাগড়ি নিয়ে উপহাস করা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং গোনাহের কাজ। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা আলেম সমাজ এবং মুত্তাকী লোকেরাও পাগড়ি বাঁধছে না। এমন একটি সুপ্রমাণিত বিষয়কেও যদি অবহেলা করা হয়, তাহলে কোন্ বিষয়ের ওপর আমল করব?
কেউ নিজে পাগড়ি না পরলেও পাগড়িকে সুন্নত মনে করা আবশ্যক। সময়-সুযোগ হলে পরতে পারেন। পরতে উৎসাহ দিবেন।

পাগড়ি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কুয়েত সরকারের অর্থায়নে ও তত্ত্বাবধানে প্রণীত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফিকহি বিশ্বকোষ আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যার عِمَامَة ভুক্তি দেখা যেতে পারে। খ- নং- ৩০, পৃষ্ঠা- ৩০০।

হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মক্কায়) প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর মাথায় কালো পাগড়ি ছিল।
[সূত্রঃ সহীহ মুসলিম, হা/ ১৩৫৮]।

হযরত মুগীরা ইবনে শুবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন এবং মাথার অগ্রভাগ ও পাগড়ির উপর মাসাহ করলেন।
[সূত্রঃ সহীহ মুসলিম, হা/ ৮১]।
তাঁর পাগড়ি পরিধান সংক্রান্ত এ ধরনের আরো অনেক বর্ণনা হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
সাহাবা, তাবেয়ীগণও নামাযে এবং নামাযের বাইরে বিভিন্ন সময় ব্যাপকভাবে পাগড়ি ব্যবহার করতেন।
[দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী ১/৫৬]।

হযরত সুলাইমান ইবনে আবি আবদিল্লাহ রাহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি বলেন, আমি মুহাজির সাহাবীগণকে কালো, সাদা, হলুদ, সবুজ বিভিন্ন রঙের পাগড়ি পরতে দেখেছি।
[সূত্রঃ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হা/ ২৫৪৮৯]।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি মক্কা মুকাররমার উদ্দেশে বের হলে সঙ্গে পাগড়ি নিতেন এবং তা পরিধান করতেন।
[সূত্রঃ সহীহ মুসলিম, হা/ ২৫৫২]।

হযরত আবু উবাইদ রাহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি বলেছেন, আমি আতা ইবনে ইয়াযিদকে পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় নামায পড়তে দেখেছি।
[সূত্রঃ মুসনাদে আহমদ, হা/ ১১৭৮০]।

সুপ্রিয় পাঠক, আসুন জেনে নেই, পাগড়ী কত হাত হবে এবং কোন রংয়ের পাগড়ী নবীজীর খাস সুন্নাতের অন্তর্ভক্ত।

নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পাঁচ রংয়ের পাগড়ী পরিধান করেছেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়।
কালো, সাদা, যাফরান, হলুদ এবং ছাই বর্ণের পাগড়ী পরিধান করা নবীজীর খাছ সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।
যেমন-

১/ পূর্বোক্ত হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

عن جابر بن عبد الله ان النبي صلي الله عليه وسلم دخل يوم الفتح وعليه عمامة سوداء

‘নিশ্চয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন যখন তথায় প্রবশে করেন তাঁর মাথা মোবারকে ছিল কালো পাগড়ী।’
[সূত্রঃ মুসলিম, কিতাবুল হজ্জ, ৩/১৩৩]।

২/ ইমাম সাখাবী মা আয়েশা ছিদ্দিকা হতে বর্ণনা করেন যে-

ان عمامة رسول الله صلي الله عليه وسلم في السفر كانت بيضاء والحضر كانت سوداء

‘নিশ্চয় সফররত অবস্থায় নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সাদা পাগড়ী এবং মুকীম অবস্থায় কালো পাগড়ী পরিধান করতেন।’
[সূত্রঃ সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৭/২৭৬]।


৩/ হযরত যায়দ বিন আসলাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يصبع ثيابه كلها بالزعفران حتي العمامة

‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সব কাপড়কেই যাফরান দ্বারা রং করেছেন এমন কী পাগড়ীসহ।’
[সূত্রঃ সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৭/২৭৩]।

৪/ হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

خرج علينا رسول الله صلي الله عليه وسلم وعليه قميص اصفر ورداء اصفر وعمامة صفراء

‘নবীজী আমাদের সাথে হলুদ জামা, হলুদ চাঁদর এবং হলুদ পাগড়ী পরিধান করে বের হলেন।’
[সূত্রঃ সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৭/২৭৩]।

৫/ হযরত জাফর বিন আমর বিন হুরাইছ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন-

رأيت علي النبي صلي الله عليه وسلم عمامة حرقانية

‘আমি নবীজীকে ছাই রংয়ের পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।’
[সূত্রঃ নাসাঈ শরীফ, কিতাবুল যিনাত]।

এছাড়াও তাবেয়ী সুলাইমান ইবনু আব্দিল্লাহর বর্ণনায় সাহাবীগণ লাল এবং সবুজ পাগড়ী পরেছেন বলেও বর্ণনায় পাওয়া যায়।
তিনি বলেন-

ادركت المهاجرين الاولين يعتمون بعمائم كرابيس سود وبيض وحمر وخضر وصفر

‘আমি প্রথম যুগের মুহাজির সাহাবীদেরকে দেখেছি যে, তাঁরা সুতী, কালো, সাদা, লাল, সবুজ এবং হলুদ রংয়ের পাগড়ি পরিধান করতেন।’
[সূত্রঃ মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ- ২৫৪৮৯]।

পাগড়ীর পরিমাপ সম্পর্কে-
০১. ‘মিরআত শরহে মিশকাত’ গ্রন্থে বর্ণিত যে, হুযুর পাকের পাগড়ী মোবারকের দৈর্ঘ্য ছিল সাত হাত এবং প্রস্থ ছিল এক বিঘত হতে কিছু বেশি।

০২. ‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ কিতাবে এসেছে যে, পাগড়ীর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১৪ হাত এবং সর্বনিু ৭ হাত। আর পাগড়ীর প্রান্ত সর্বোচ্চ পিঠের মাঝামাঝি ও সর্বনিু চার আঙ্গুল পরিমাণ।

০৩. আ‘লা হযরত ফাতাওয়ায়ে রেজভীয়ায় পাগড়ীর দৈর্ঘ্য সম্পর্কে কয়েকটি মত উল্লেখ করেছেন:
(১) পাগড়ির দৈর্ঘ্য সাত হাত কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি।
(২) সর্বোচ্চ ১২ হাত ও সর্বনিু ৫ হাত।
(৩) শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী তার ‘রেসালায়ে লিবাস’ এর মধ্যে দৈর্ঘ্য ৩১ হাত পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন।
(৪) সাধারণের নিকট যেরূপ প্রচলন রয়েছে এরূপ আমল করতে শরয়ী কোন ভয় নেই।

০৪. শামায়েলে নববীতে এসেছে পাগড়ীর প্রস্থ দেড় হাত এবং তা সুতী কাপড়ের ব্যবহার করা মুস্তাহাব।
Top