কিছু লোকের বাড়াবাড়ির ফলে আমাদের মহান পূর্বসূরিগণের একটি জামাতের গুরুত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ জামাতটি হলো ফকীহ ও মুজতাহিদগণের জামাত। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে হিজরী দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ জামাতের গুরুত্ব ছিল প্রায় সর্বজন স্বীকৃত।
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তায়ালা কুরআন ও সুন্নাহ সংরক্ষণের যে জিম্মাদারি নিজেই গ্রহন করেছেন, তার প্রেক্ষিতেই তিনি উম্মতের এক এক জামাতকে এক একটি দিক সংরক্ষণের কাজে লাগিয়েছেন। কাউকে দিয়ে ব্যকরণ, কাউকে দিয়ে বালাগাত বা অলংকারের দিক সংরক্ষণ করিয়েছেন। কাউকে দিয়ে কুরআনের পঠন রীতি, কিরাআত ও তাজবীদ সংরক্ষণের খেদমত নিয়েছেন। হিফজ করার তাওফীক দিয়ে লক্ষ লক্ষ হাফেজে কুরআন ও হাফেজে হাদীস সৃষ্টি করে কুরআন-সুন্নাহর শব্দ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। একই ধারাবাহিকতায় বিশাল এক জামাতকে এর অর্থ ও মর্ম নির্ণয়ন, উদঘাটন, শরীয়তের বিধিবিধান আহরণ ও আবিস্কারের কাজে লাগিয়ে দিয়ে কুরআন-সুন্নাহ’র মর্ম সংরক্ষণ করেছেন। পরিভাষায় এঁদেরকেই বলা হয় মুজতাহিদ ও ফকীহ। এমন মহান জামাতের গুরুত্বকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে দীন ও ইসলাম সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি ও নির্ভুল অনুধাবন থেকে বঞ্চিত থাকারই নামান্তর।
প্রশ্ন হতে পারে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চলতে বলেছেন। কোন ফকীহ বা মুজতাহিদের দারস্থ হতে বলেন নি। উত্তরে বলব, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ঐ হাদীসে আরবী ব্যকরণ, বালাগাত, অভিধান, হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি, হাদীসবিদগণের পরিভাষা, রিজাল শাস্ত্র বা হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনীমূলক গ্রন্থসমূহ ইত্যাদি বিষয়ে পড়ালেখার কথাও বলেন নি। এমনকি কোন তাফসিরবিদ ও হাদীসবিদের দ্বারস্থ হতেও বলেন নি। তাহলে কি এসব ছাড়াই কুরআন-সুন্নাহ বোঝা যাবে এবং তদনুযায়ী আমল করা সম্ভব হবে? যদি বলা হয়, এসবের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তাহলে বলব, মুজতাহিদ ইমামগণের প্রয়োজনীয়তা ও মুখাপেক্ষিতাও একইভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না।
একটি আয়াত বা হাদীসেই সবকিছু খুঁজতে চেষ্টা করা আমাদের একটি বড় দোষ। কুরআন-হাদীসের সবটুকু নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে, মুজতাহিদ ইমামগণের দ্বারস্থ হওয়ার আদেশও আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। এখানে দুটি প্রমাণ তুলে ধরা হলো :
এক. একটি প্রমাণ হাফেজ ইবনুল কায়্যিম রহ. তার ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন গ্রন্থে (১/৮) ‘ইসলামের ফকীহগণের ফযীলত ও মর্যাদা’ শিরোনামে (فضل فقهاء الإسلام ومنزلتهم) উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,
القسم الثاني فقهاء الإسلام ومن دارت الفتيا على أقوالهم بين الأنام الذين خصوا باستنباط الأحكام وعنوا بضبط قواعد الحلال والحرام فهم في الأرض بمنزلة النجوم في السماء بهم يهتدي الحيران في الظلماء وحاجة الناس إليهم أعظم من حاجتهم إلى الطعام والشراب وطاعتهم أفرض عليهم من طاعة الأمهات والآباء بنص الكتاب قال تعالى يا أيها الذين آمنوا أطيعوا الله وأطيعوا الرسول وأولي الأمر منكم فإن تنازعتم في شيء فردوه إلى الله والرسول إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر ذلك خير وأحسن تأويلا قال عبد الله بن عباس في إحدى الروايتين عنه وجابر بن عبد الله والحسن البصري وأبو العالية وعطاء بن أبي رباح والضحاك ومجاهد في إحدى الروايتين عنه أولو الأمر هم العلماء وهو إحدى الروايتين عن الإمام أحمد وقال أبو هريرة وابن عباس في الرواية الأخرى وزيد بن أسلم والسدي ومقاتل هم الأمراء وهو الرواية الثانية عن أحمد. والتحقيق أن الأمراء إنما يطاعون إذ أمروا بمقتضى العلم فطاعتهم تبع لطاعة العلماء
অর্থাৎ দ্বিতীয় ভাগ হলেন ইসলামের ফকীহবৃন্দ। ঘুরে ফিরে যাদের মতানুসারেই ফতোয়া দেওয়া হয়। যাদেরকে বিধিবিধান আহরণ ও নির্গতকরণের কাজে বৈশিষ্ট্যম-িত করা হয়েছে। তারা হালাল-হারামের নীতিমালা প্রণয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে তারা ঠিক আকাশের তারকারাজির মতোই ছিলেন। যা দেখে অন্ধকারে দিশাহীনরা সঠিক পথের দিশা পায়। মানুষ পানাহারের যতটা না মুখাপেক্ষী, তার চেয়ে ঢেড় বেশি তাদের মুখাপেক্ষী ছিলেন ও আছেন। তাদের আনুগত্য মাতা-পিতার আনুগত্যের চেয়েও বড় ফরজ। এর প্রমাণ কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার উলুল আমর’এর আনুগত্য করা। যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে বিবাদ হয়, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের সমীপে পেশ কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। এটাই সর্বোত্তম ও পরিণামে সর্বাধিক সুন্দর। (নিসা : ৫৯)
এক বর্ণনামতে ইবনে আব্বাস রা., জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা., হাসান বসরী, আবুল আলিয়া, আতা ইবনে আবূ রাবাহ, দাহহাক ও এক বর্ণনামতে মুজাহিদ বলেছেন, (উক্ত আয়াতে উল্লিখিত) ‘উলুল আমর’ হলেন আলেমগণ। ইমাম আহমাদের একটি মতও অনুরূপ। আবার আবু হুরায়রা রা., অপর বর্ণনায় ইবনে আব্বাস রা., যায়দ ইবনে আসলাম, সুদ্দী ও মুকাতিল বলেছেন, উলুল আমর তারা, যারা নেতৃত্ব-কতৃত্বের অধিকারী। আহমাদের অপর একটি মতও অনুরূপ। সত্য কথা হলো, নেত্বত্ব-কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের কথাও কেবল তখনই মানা যাবে, যখন তারা ইলম ও দ্বীনী জ্ঞানের আলোকে আদেশ দেবেন। সুতরাং তাদের আনুগত্যও আলেমগণের আনুগত্যের অধীন। (দ্র. ১/৮)
দুই. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন,
وَمَا كَانَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لِيَنۡفِرُوۡا كَآفَّةً ؕ فَلَوۡلَا نَفَرَ مِنۡ كُلِّ فِرۡقَةٍ مِّنۡهُمۡ طَآٮِٕفَةٌ لِّيَـتَفَقَّهُوۡا فِى الدِّيۡنِ وَ لِيُنۡذِرُوۡا قَوۡمَهُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَيۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُوۡنَ
অর্থ, তাদের (মুসলিমদের) একটি গোত্র থেকে একদল লোক কেন (রাসূলের সঙ্গে) বের হয় না? যাতে তারা দীনের সঠিক বুঝ লাভ করতে পারে এবং ফিরে এসে নিজ গোত্রের লোকদেরকে সতর্ক করতে পারে। এতে তারাও হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে। (তাওবা, ১২২)
এ আয়াতে কিছু লোককে দ্বীনের ফকীহ হতে বলা হয়েছে। নিজ গোত্রের লোকদেরকে সতর্ক করতে ও দ্বীনের সঠিক জ্ঞানের আলোকে পরিচালিত করতেও বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে গোত্রের লোকদেরকেও তাদের নির্দেশনা অনুসারে চলতে বলা হয়েছে। সুতরাং কিছু মানুষ দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ সমঝ-বুঝ অর্জন করবে, আর কিছু মানুষ তাদের শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করে জীবন চালাবে: এটাই কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা।
একথা বহু হাদীস থেকেও বোঝা যায়, বুখারী শরীফে একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের পূর্বাভাষ সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহ এলেম তুলে নেবেন আলেমকে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে। অবশেষে যখন তিনি কোন আলেম অবশিষ্ট রাখবেন না, তখন মানুষ মূর্খ ও অজ্ঞদেরকেই অনুসৃত বানিয়ে নেবে। তারা জিজ্ঞাসিত হলে সঠিক এলেম ছাড়াই ফতোয়া দিয়ে বসবে। ফলে নিজেরাও গোমরাহ হবে, অন্যদেরকেও গোমরাহ করবে। (হা. ১০০)
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, কিছু মানুষ ফতোয়া দেন, আর কিছু মানুষ তার অনুসরণ করেন। ফতোয়া দানকারীগণ যদি যথানিয়ম অনুসরণ করে পর্যাপ্ত ও সঠিক উপায়ে লব্ধ জ্ঞানের আলোকে ফতোয়া দিয়ে থাকেন, তবে তারা ও তাদের অনুসারীরা সঠিক পথেই প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। কিয়ামতের লক্ষণ জাহির হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এমন অবস্থাই চলতে থাকবে। পক্ষান্তরে ফতোয়া দানকারীরা যদি এর বিপরীত করেন তবে নিজেরাও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবে, সেই সঙ্গে অন্যদের বিচ্যুতিরও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিয়ামতের পূর্বে এমন অবস্থাই বিরাজ করবে।
ফকীহগণের বৈশিষ্ট্যাবলী
ক. তারা কুরআন-সুন্নাহর কোনটি মানসুখ (রহিত), কোনটি নাসিখ (রহিতকারী) সে সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।
খ. কোন বিধানটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে খাছ, আর কোনটি উম্মাহর সকল ব্যক্তির জন্য ব্যাপক, তাও তারা ভালভাবে জানতেন।
গ. কুরআন-সুন্নাহ’য় যেসব বিধান এসেছে, সেসবের অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত করে সেসব কারণ আরো যেসব বিষয়ে বিদ্যমান, সেসবকেও একই বিধানের আওতাভুক্ত সাব্যস্ত করে তারা দ্বীন-ইসলামকে চলমান ও জীবন্ত ধর্মের রূপে দৃশ্যমান করেছেন। এতে করে হাজার হাজার নিত্য নতুন সমস্যার সমাধান লাভ করা সহজ হয়েছে। এ মহান কাজটি না হলে দ্বীন-ইসলামকেও অন্যান্য ধর্মের মতো বন্ধ্যাত্ব বরণ করতে হতো।
ঘ. কুরআন-সুন্নাহ থেকে তারা যেমন শরীয়তের নীতিমালা আহরণ ও উদ্ধার করেছেন, তেমনি এক একটি আয়াত ও হাদীস থেকে বহু সমস্যার সমাধান বের করেছেন। কুরআন-সুন্নাহ’র দালালত ও নির্দেশনা, ইকতিযা ও দাবী এবং ইশারা ও ইঙ্গিত থেকে তারা উদ্ভূত ও অনুদ্ভূত বহু মাসাইলের সমাধান দিয়ে গেছেন।
ঙ. আয়াত ও হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই সর্বাধিক জ্ঞাত ছিলেন। এটা আল্লাহ তায়ালারই নিজাম বা সুষ্ঠু পরিচালনা বৈ কি। কুরআন ও হাদীসের হাফেজগণকে দিয়ে তিনি যেমন শব্দ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি ফকীহগণের মাধ্যমে মর্ম সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছেন। একথা মুহাদ্দিসীন বা হাদীসবিদগণও স্বীকার করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, كذلك قال الفقهاء وهم أعلم بمعاني الحديث অর্থাৎ ফকীহগণ এমনটাই বলেছেন। আর হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই সবিশেষ জ্ঞাত। (হা. ৯৯০)
এসব কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস অন্বেষণকারী মুহাদ্দিসকে উৎসাহিত করেছেন, কোন হাদীস শুনলে তা এমনভাবে প্রচার কর, যাতে হাদীসটি কোন ফকীহ’র হাতে এসে পৌঁছে। তিনি ইরশাদ করেছেন,
نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ
আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে ঔজ্জ্বল্য দান করুক, যে আমার কথা শুনল, অতঃপর তা স্মরণ রাখল ও পৌঁছে দিল। অনেক ব্যক্তি সমঝদারির কথা তার চেয়ে ফকীহ ও সমঝদার ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দেয়, অনেক সমঝদারি কথার বাহক ফকীহ বা সমঝদার নয় । (আবু দাউদ, হা. ৩০৫৬)
এ হাদীস থেকে যেমন বোঝা গেল, সকল হাদীস বর্ণনাকারী সমঝদারির ক্ষেত্রে সমান নয়, তেমনি বোঝা গেল, সমঝদার ব্যক্তি ঐ হাদীস থেকে যা বুঝবেন অন্যদের উচিৎ হবে তার অনুসরণ করা।
আ’মাশ রহ.এর উক্তি থেকেও একথা প্রমাণিত হয়। আবু সুলায়মান আ’মাশ ইমাম আবু হানীফার উস্তাদ ছিলেন। ছিলেন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস বা হাদীসবিদও। বুখারী-মুসলিমসহ সকল মুহাদ্দিস তার বর্ণিত হাদীস প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করেছেন। একদিন জনৈক ব্যক্তি এসে তাকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করল। তিনি জবাব দিতে পারলেন না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইমাম আবু হানীফা। তিনি অনুমতি নিয়ে জবাব দিলেন। আ’মাশ রহ. বিস্ময়াভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোথায় পেয়েছ? আবু হানীফা রহ. বলেলেন, কেন, আপনিই তো অমুকের সূত্রে অমুক থেকে এ হাদীস আমাকে শুনিয়েছেন! এভাবে তিনি একাধিক সূত্রে আ’মাশের হাদীসগুলো এক মুহূর্তেই তার সামনে তুলে ধরেন। আ’মাশ তখন বললেন, أيها الفقهاء أنتم الأطباء ونحن الصيادلة অর্থাৎ ফকীহগণ! তোমরাই চিকিৎসক, আর আমরা ঔষধ বিক্রেতা। (আবু নুআয়ম, মুসনাদ আবু হানীফা, ১/২২; আল কামিল, ৮/২৩৮)
ঔষধ বিক্রেতারা জানে না, কোন ঔষধ কি কাজে লাগে। এটা ডাক্তার ও চিকিৎসকই বলতে পারেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও তেমনি অনেকে হাদীসটির ধারক-বাহক হন বটে, কিন্তু উক্ত হাদীস থেকে মাসআলার সমাধান বের করা ফকীহগণেরই কাজ।
মুহাদ্দিসগণও ফকীহগণের কদর বুঝতেন
আ’মাশ রহ.এর উপরোক্ত উক্তিটি সোনার হরফে লিখে রাখার মতো। এতে ফকীহগণের মর্যাদার প্রকৃত চিত্র ফুঠে উঠেছে। তার মতো অনেক সেরা সেরা মুহাদ্দিস ফকীহগণের যথাযোগ্য কদর করতেন। নিম্নে তাদের কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরা হলো :
১. ইমাম মালেক বলেছেন, ما كنا نأخذ (أي الحديثَ) إلا من الفقهاء অর্থাৎ আমরা কেবল ফকীহগণের কাছ থেকেই হাদীস গ্রহণ করতাম। (কাজী ইয়ায, তারতীবুল মাদারিক, ১/১২৪)
২. আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী একজন শীর্ষ মুহাদ্দিস। বুখারী-মুসলিমের দাদা উস্তাদ। তিনি বলেছেন, ما أصلي صلاة إلا وأنا أدعو للشافعي فيها অর্থাৎ আমি যখনই নামায পড়ি তখনই শাফেয়ীর জন্য দুআ করি। (সিয়ারুয যাহাবী, ইমাম শাফেয়ীর জীবনী)
৩.ইমামুল জারহি ওয়াত তাদীল ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও হাফেজে হাদীস ছিলেন। তিনি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা উস্তাদ ছিলেন। তিনি বলেছেন, أنا أدعو الله للشافعي في صلاتي منذ أربع سنين অর্থাৎ আমি চার বছর যাবৎ নামাযে (ইমাম) শাফেয়ীর জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করি। (প্রাগুক্ত)
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে দাউদ খুরায়বী ছিলেন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও বুখারী শরীফের রাবী। তিনি বলতেন,
يجب على أهل الإسلام أن يدعو الله لأبي حنيفة في صلاتهم وذكر حفظه عليهم السنن والفقه
মুসলমানদের কর্তব্য হলো নিজ নিজ নামাযে আল্লাহর নিকট আবু হানীফার জন্য দুআ করা। এ প্রসঙ্গে তিনি (খুরায়বী) মুসলমানদের জন্য তাঁর (আবু হানীফার) সুন্নাহ ও ফেকাহ সংরক্ষণের বিষয়টি তুলে ধরেন। (খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১৫/৪৫৯)
৫.ইমাম আহমাদ বলেছেন, وإني لأدعو للشافعي منذ أربعين سنة في الصلاة অর্থাৎ আমি নামাযে চল্লিশ বছর যাবৎ শাফেয়ীর জন্য দুআ করি। (প্রাগুক্ত)
৬. আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্ব ছিলেন ইমাম মালেকের বিশিষ্ট ছাত্র ও বড় উঁচু মানের মুহাদ্দিস। তিনি বলেছেন,الحديث مضلة إلا للعلماء ফকীহগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদীস শরীফ বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (কাযী ইয়ায, তারতীবুল মাদারিক, ১/৯১)
তিনি আরো বলেছেন, لولا أن الله أنقذني بمالك والليث لضللت، فقيل له : كيف ذلك؟ قال : أكثرت من الحديث فحيرني فكنت أعرض ذلك على مالك والليث فيقولان لي : خذ هذا ودع هذا. অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে মালেক ও লায়ছ (ইবনে সাদ) এর দ্বারা রক্ষা না করতেন, তবে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি বেশী বেশী হাদীস সংগ্রহ করে (হাদীসের পরস্পর বিরোধিতার কারণে) বেদিশা হয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে মালেক ও লায়ছের নিকট সেগুলো পেশ করলে তারা বললেন, এটি গ্রহণ কর, আর এটি বর্জন কর। (ইবনে ফারহুন, আদ দীবাজ, ১/৪১৬)
৭. মুহাম্মদ ইবনে ফাদল আল বাযযায বলেছেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি যে, আমি ও আহমাদ ইবনে হাম্বল একবার হজ্জে গিয়ে একই স্থানে অবস্থান করেছি। ফজরের নামাযান্তে আমি আহমাদ ইবনে হাম্বলের খোঁজে সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নার মজলিসে এবং আরো অন্যান্য মুহাদ্দিসের মজলিসে গেলাম। অবশেষে তাকে একজন আরবী যুবকের মজলিসে পেলাম। ভিড় ঠেলে আমি তার নিকট গিয়ে বসলাম, এবং বললাম, আপনি সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নার মজলিস ছেড়ে এখানে এসে বসেছেন! অথচ তার নিকট যুহরী, আমর ইবনে দীনার ও যিয়াদ ইবনে ইলাকাহ প্রমুখ এমন অসংখ্য তাবিঈর হাদীস রয়েছে, যাদের সংখ্যা আল্লাহই ভাল জানেন। একথা শুনে আহমাদ বললেন, اسكت ، فإن فاتك حديث بعلو تجده بنزول ولا يضرك في دينك ولا في عقلك وإن فاتك عقل هذا الفتى أخاف أن لا تجده إلى يوم القيامة ، ما رأيت أحدا أفقه في كتاب الله من هذا الفتى القرشي ، قلت : من هذا؟ قال : محمد بن إدريس الشافعي.অর্থাৎ চুপ থাক, যদি উচ্চ সনদের কোন হাদীস তোমার হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে নি¤œ সনদে হলেও তুমি তা পেয়ে যাবে। এতে তোমার দ্বীন ও জ্ঞানবুদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু এই যুবকের জ্ঞানবুদ্ধি যদি তোমার হাতছাড়া হয়, তবে আমার আশংকা হয় কিয়ামত পর্যন্ত তা তোমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে এই কুরায়শী যুবকের চেয়ে বেশী সমঝদার আর কাউকে আমি পাই নি। আমি বললাম, ইনি কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস আশ শাফেয়ী। (আল জারহু ওয়াত তাদীল, আব্দুর রহমান ইবনে আবু হাতিম, ৭/১১৩০)
৮. সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না রহ. ছিলেন অনেক উচ্চ পর্যায়ের মুহাদ্দিস। তিনি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের দাদা উস্তাদ ছিলেন। তিনি বলেছেন, الحديث مضلة إلا للفقهاء অর্থাৎ ফকীহগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদীস শরীফ বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (ইবনুল হাজ্জ মালেকী, আল মাদখাল, ১/১২৮) তিনি আরো বলেছেন, التسليم للفقهاء سلامة في الدين অর্থাৎ ফকীহগণের হাতে নিজেকে ন্যাস্ত করাই দ্বীন কে নিরাপদ রাখার নামান্তর। (তারীখে বাগদাদ, ৭/৫৬১)
৯. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. ছিলেন অতি উঁচু মানের মুহাদ্দিস, বুযুর্গ ও মুজতাহিদ। তিনিও ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা উস্তাদ ছিলেন। তিনি বলেছেন, لولا أن الله أغاثني بأبي حنيفة وسفيان كنت كسائر الناس অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে আবু হানীফা ও সুফিয়ান (ছাওরী) এর মাধ্যমে রক্ষা না করতেন তবে আমি অন্যান্য মানুষের (মুহাদ্দিসের) মতো হয়ে থাকতাম। (খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১৫/৪৫৯)
১০. আবুয যিনাদ আব্দুল্লাহ ইবনে যাকওয়ান ছিলেন ইমাম মালেক রহ.এর উস্তাদ ও হযরত আনাস রা.এর শিষ্য। তিনি বলেছেন, وأيم الله إن كنا لنلتقط السنة من أهل الفقه والثقة ونتعلمها شبيها بتعلمنا آي القرآن অর্থাৎ আল্লাহর কসম, আমরা ফকীহ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণের কাছ থেকে সুন্নাহ ও হাদীস সংগ্রহ করতাম এবং কুরআনের আয়াতসমূহ যেভাবে শেখা হয় সেভাবে তা শিখতাম। (ইবনে আব্দুল বার, জামিউ বায়ানিল ইলম, ২/৯৮)
১১. ইবনে আবুয যিনাদ বলেছেন, كان عمر بن عبد العزيز يجمع الفقهاء ويسألهم عن السنن والأقضية التي يعمل بها فيثبتها وما كان منه لا يعمل به الناس ألغاه وإن كان مخرجه من ثقة অর্থাৎ উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. ফকীহগণকে সমবেত করে সেসব সুন্নাহ ও ফায়সালা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন যেগুলো অনুসারে আমল করা হতো। তিনি সেগুলো বহাল রাখতেন। আর যেগুলো অনুসারে মানুষ আমল করত না, সেগুলো বাদ দিতেন, যদিও তা বিশ্বস্ত লোকদের সূত্রে বর্ণিত হোক।
১২. ইমাম আহমাদের উস্তাদ শীর্ষ মুহাদ্দিস আবু আসিম আন নাবীল সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ বলেছেন, حضر قوم من أصحاب الحديث في مجلس أبي عاصم ضحاك بن مخلد فقال لهم : ألا تتفقهون أو ليس فيكم فقيه؟ فجعل يذمهم فقالوا فينا رجل، فقال : من هو؟ فقالوا : الساعة يجيئ ،فلما جاء أبي قالوا قد جاء فنظر إليه فقال له تقدم الخ অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণের একটি জামাত আবু আসিম দাহহাক ইবনে মাখলাদের মজলিসে হাজির হলেন। তিনি বললেন, তোমরা ফেকাহ শিখ না কেন? তোমাদের মধ্যে কি কোন ফকীহ নেই? অতঃপর তিনি তাদেরকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। তারা বললেন, আমাদের মধ্যে একজন আছেন। তিনি বললেন, কে? তারা বললেন, তিনি এখনই আসছেন। একটু পরে আমার পিতা (ইমাম আহমাদ) হাজির হলে তারা বললেন, তিনি এসে গেছেন। তিনি তাকে দেখে বললেন, সামনে চলে আস।...(ইবনে আসাকির, তারীখে দিমাশক, ৫/২৯৭)
১৩. যুহায়র ইবনে মুআবিয়া একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। তার সম্পর্কে শুআয়ব ইবনে হারব বলেছেন, শো’বা রহ.এর মতো বিশ জনের চেয়েও যুহায়র আমার দৃষ্টিতে বড় হাফেজে হাদীস। মুহাদ্দিস ইমাম আলী ইবনুল জাদ বলেছেন, আমরা যুহায়র ইবনে মুআবিয়ার মজলিসে ছিলাম, এমন সময় একজন লোক আসল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে আসলেন? লোকটি বলল, আবু হানীফার কাছ থেকে। তখন যুহায়র বললেন, إن ذهابك إلى أبي حنيفة يوما واحدا أنفع لك من مجيئك إليّ شهرا অর্থাৎ আমার নিকট এক মাস আসার চেয়ে আবু হানীফার নিকট একদিন যাওয়া তোমার জন্য অধিক লাভজনক। (ইবনে আব্দুল বার, আল ইনতিকা, পৃ. ২০৮)
১৪. হুমায়দী ছিলেন ইমাম বুখারীর উস্তাদ। বুখারী শরীফের প্রথম হাদীসটি তার সূত্রেই বর্ণিত। তিনি মুসনাদ নামক একটি হাদীসগ্রন্থের সংকলকও। বর্তমানে এটি মুদ্রিত। তিনি বলেছেন, আহমাদ ইবনে হাম্বল আমাদের সঙ্গে মক্কা শরীফে অবস্থান করে সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নার মজলিসে হাজির হতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, এখানে একজন কুরায়শী ব্যক্তি আছেন যার বিশ্লেষণ ও জ্ঞানের পরিধি যথেষ্ট। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস আশ শাফেয়ী। পরে আমি তার মজলিসে গেলাম। অনেক মাসআলা নিয়ে কথা হলো। বের হওয়ার পর আহমাদ বললেন, কেমন পেলেন? আপনি কি চান না একজন কুরায়শী ব্যক্তির এমন জ্ঞান ও বিশ্লেষণ হোক? তার কথা আমার মনে রেখাপাত করল। আমি তার মজলিসে উপস্থিত হতে লাগলাম। একপর্যায়ে সবার চেয়ে অগ্রণী হয়ে গেলাম। আবু বকর ইবনে ইদরীস বলেন, فلم يزل يقدم مجلس الشافعي حتى كان يفوت مجلس سفيان بن عيينة وخرج مع الشافعي إلى مصر অর্থাৎ তিনি এত বেশী পরিমাণে শাফেয়ীর মজলিসে হাজির হতে লাগলেন যে, সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নার মজলিসে উপস্থিত হওয়া প্রায় ছুটেই গিয়েছিল। অবশেষে তিনি শাফেয়ী রহ.এর সঙ্গে মিসর চলে গিয়েছিলেন। (ইবনে আবু হাতেম, আল জারহু ওয়াত তাদীল, ৭/১১৩০)
১৫. ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ ছিলেন ইমাম বুখারী ও মুসলিমের বিশিষ্ট উস্তাদ। তিনি বলেছেন, আমরা মক্কা শরীফে ছিলাম। শাফেয়ীও মক্কায় ছিলেন। সেসময় আহমাদ ইবনে হাম্বলও মক্কায় অবস্থান করছিলেন। একদিন আহমাদ আমাকে বললেন, এই ব্যক্তির: অর্থাৎ শাফেয়ীর: সাহচর্য অবলম্বন করুন। আমি বললাম, ما أصنع به سنه قريب من سننا ، أترك ابن عيينة والمقرئ؟ قال : ويحك ، إن ذاك لا يفوت وذا يفوت فجالسته অর্থাৎ তাকে দিয়ে আমার কী হবে? তাঁর বয়স আর আমাদের বয়স প্রায় সমান। আমি কি ইবনে উয়ায়না ও মুকরি’ (আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ)এর মজলিস ছেড়ে দেব? আহমাদ বললেন, আরে ওটা তো তোমার হাতছাড়া হবে না। আর এটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এরপর থেকে আমি তার সাহচর্য অবলম্বন করি। (প্রাগুক্ত)
এই ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ একসময় ইমাম শাফেয়ীর এতই ভক্ত হলেন যে, তিনি নিজেই বলেছেন, كتبت إلى أحمد بن حنبل وسألته أن يوجه إليّ من كتب الشافعي ما يدخل في حاجتي فوجه إليّ بكتاب الرسالة অর্থাৎ আমি আহমাদ ইবনে হাম্বলের নিকট পত্র লিখলাম এবং আরজ করলাম তিনি যেন শাফেয়ীর সেসব কিতাব আমার নিকট প্রেরণ করেন, যা দ্বারা আমার প্রয়োজন মিটে যায়। তিনি আমার নিকট আর-রিসালা কিতাবটি পাঠিয়েছিলেন। (প্রাগুক্ত)
ইসহাক ইবনে রাহুয়ার নিবাস ছিল আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী মার্ভে। তিনি সেখানে এক বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন। যার প্রথম স্বামীর নিকট ইমাম শাফেয়ীর অনেক কিতাব ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর ঐ নারী সেগুলোর মালিক হয়েছিলেন। বলা হয়, কিতাবগুলোর আকর্ষণই ছিল ইসহাক রহ.এর উক্ত বিবাহের মূল কারণ। (মুকাদ্দিমা মাসাইলে আহমাদ ওয়া ইসহাক, ১/১৪২)
১৬. হিলাল ইবনে খাব্বাব বলেন, আমি সাঈদ ইবনে জুবায়ের রহ.কে জিজ্ঞেস করলাম, ما علامة هلاك الناس ؟ قال : إذا هلك فقهاءهم هلكوا অর্থাৎ মানুষের ধ্বংস হওয়ার আলামত কী? তিনি বললেন, যথন তাদের ফকীহগণ মৃত্যুবরণ করবে তখন তারাও বরবাদ হয়ে যাবে। (আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ১/১৫৪)
হাদীসের হাফেজগণও ফকীহগণের মুখাপেক্ষী ছিলেন :
শুধু হাদীস জানা ফকীহগণের প্রয়োজন ও মুখাপেক্ষিতা মেটাতে ও দূর করতে পারে না। এই কারণে বড় বড় হাফেজে হাদীসগণ শুধু ফকীহগণের কদরই করেন নি, তাদের কাছ থেকে ফিকহের ইলম অর্জন করেছেন, কিংবা তাদের রচিত বইপুস্তক গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। কিংবা তাদের মতানুসারে ফতোয়া দিয়েছেন। এখানে কয়েকজন হাফেজে হাদীসের বিবরণ তুলে ধরা হলো :
১. ওয়াকী ইবনুল জাররাহ বড় হাফেজে হাদীস ছিলেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ এবং ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রবাদতুল্য। তাঁর সম্পর্কে খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, يفتي بقول أبي حنيفة তিনি আবু হানীফার মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। (কাযী সায়মারী, আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবুহু, যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৪/ ১২২০; যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১/২২৪; ইবনে আসাকির, তারীখু দিমাশক, ৬৩/৭৬)
২. ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান বড় জবরদস্ত মুহাদ্দিস ও হাফেজে হাদীস। তিনিও ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ, আহমাদ, ইবনে মাঈন ও আলী ইবনুল মাদীনীর ন্যায় হাদীসের সমুদ্রতুল্য মুহাদ্দিসগণের উস্তাদ ছিলেন। তিনি নিজে বলেছেন, لا نكذب الله ما سمعنا أحسن من رأي أبي حنيفة وقد أخذنا بأكثر أقوالهআমরা আল্লাহর নিকট মিথ্যা বলব না, আমরা আবু হানীফার মতের চেয়ে উত্তম কোন মতের কথা শুনি নি। আমরা তাঁর অধিকাংশ মতই গ্রহন করেছি। (খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১৫/৪৭৩; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৯/৩১২; ইবনে কাছীর, আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া, ১০/১১৪)
এই ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ সম্পর্কে তারই শিষ্য ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, كان يفتي أيضا بقول أبي حنيفةতিনিও আবু হানীফার মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। (যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৪/১২২০)
৩.আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী ছিলেন হাদীসের আরেক মহাসাগর। তিনি ইয়াহয়া ইবনে সাঈদের সহপাঠী এরং ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ ছিলেন। তার সম্পর্কে যাহাবী রহ. সিয়ার গ্রন্থে লিখেছেন, كتب عبد الرحمن بن مهدي إلى الشافعي وهو شاب أن يضع له كتابا فيه معاني القرآن ويجمع قبول الأخبار وحجة الإجماع وبيان الناسخ والمنسوخ فوضع له كتاب الرسالة ইমাম শাফেয়ী যখন যুবক ছিলেন, তখন আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী তার নিকট এই মর্মে পত্র লিখলেন যে, তিনি যেন তার জন্য এমন একটি গ্রন্থ রচনা করে দেন, যে গ্রন্থে থাকবে কুরআনের মর্ম ও বিশ্লেষণ, হাদীসগ্রহণের নিয়মনীতি, ইজমা বা ঐকমত্যের (শরীয়তের দলিল হওয়ার) প্রমাণ ও নাসিখ (রহিতকারী) মানসূখ (রহিত) এর বিবরণ। তার সে আবেদনের প্রেক্ষিতেই তিনি আর রিসালা গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন। (সিয়ার, ইমাম শাফেয়ীর জীবনী, ৮/৩৯৪) আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, ثم من بعد مالك عبد الرحمن بن مهدي كان يذهب مذهبهم ويقتدي بطريقتهمআব্দুর রহমান ইবনে মাহদী তাদের (মদীনার ফকীহগণের) মাযহাব অবলম্বন করতেন এবং তাদের পথ অনুসরণ করতেন। (ইলাল, পৃ. ৭২)
৪. সুফিয়ান ছাওরী ছিলেন প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস ও হাদীসের সম্রাট। তাঁর সম্পর্কে ইমাম আবু ইউসুফ কাযী বলেছেন, سفيان الثوري أكثر متابعة لأبي حنيفة منيসুফিয়ান ছাওরী আমার চেয়ে বেশী আবু হানীফার অনুসারী ছিলেন। (ফাযাইলু আবী হানীফা, লি ইবনে আবুল আওয়াম, নং ১৬২; ইবনে আব্দুল বার, আল ইনতিকা, পৃ. ১৯৮) ওয়াকেদী বলেছেন, كان سفيان الثوري يسألني أن أجيئه بكتب أبي حنيفة لينظر فيها সুফিয়ান ছাওরী আমার নিকট আবেদন করতেন, আমি যেন আবু হানীফার কিতাবগুলো তার কাছে নিয়ে আসি, যাতে তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে পারেন। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইল, নং ২৫৮) আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, سفيان الثوري كان يذهب ويفتي بفتواهم সুফিয়ান ছাওরী কুফার ফকীহগণের মাযহাব অনুসরণ করতেন এবং তাদের মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। (ইবনে আবু হাতিম, আল জারহু ওয়াত তাদীল, ১/৫৮)
খ্যাতনামা হাফেজে হাদীস ইয়াযীদ ইবনে হারুন বলেছেন, كان سفيان يأخذ الفقه عن علي بن مسهر من قول أبي حنيفة وأنه استعان به وبمذاكرته على كتابه هذا الذي سماه الجامع সুফিয়ান (ছাওরী) আবু হানীফার মতাশ্রিত ফিকাহ শিখতেন আলী ইবনে মুসহির (আবু হানীফার বিশিষ্ট শিষ্য ও প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ) এর কাছ থেকে। তিনি তার এই গ্রন্থ: যার নাম দিয়েছেন তিনি আল জামে: রচনার সময় আলী ইবনে মুসহিরের ও তার সঙ্গে কৃত মৌখিক আলোচনার সাহায্য নিয়েছেন। (আল্লামা মাসউদ ইবনে শায়বা সিন্ধী, মুকাদ্দিমা কিতাবুত তালীম, তাহাবীকৃত আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবুহু এর বরাতে, ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ. ১৮৪-১৮৫)
৫.ইমাম মালেক রহ. ছিলেন মদীনা শরীফের বিখ্যাত হাফেজে হাদীসগণের অন্যতম। ফিকহের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্কও ছিল। মদীনাবাসীর আমলও ছিল তার চোখের সামনে। তার সম্পর্কে আব্দুল আযীয দারাওয়ার্দী বলেছেন, كان مالك ينظر في كتب أبي حنيفة وينتفع بهاমালেক আবু হানীফার কিতাবগুলো দেখতেন এবং সেগুলো থেকে উপকৃত হতেন। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইলে আবী হানীফা, নং ৪৯৫)
৬.সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না কুফার অতঃপর মক্কার শীর্ষ হাফেজে হাদীস ছিলেন। তার সম্পর্কে কাযী বিশর ইবনুল ওয়ালীদ বলেছেন, كنا نكون عند ابن عيينة ، فكان إذا وردت عليه مسألة مشكلة يقول : هاهنا أحد من أصحاب أبي حنيفة؟ فيقال بشر ، فيقول : أجب فيها ، فأجبت فيقول : التسليم للفقهاء سلامة في الدين. অর্থাৎ আমরা ইবনে উয়ায়না’র মজলিসে থাকতাম। কোন জটিল মাসআলা দেখা দিলে তিনি বলতেন, এখানে আবু হানীফার শিষ্য বা শিষ্যের শিষ্য কেউ আছে? বলা হতো বিশর আছে। বলতেন, এর সমাধান দাও। আমি সমাধান দিলে তিনি বলতেন, ফকীহগণের নিকট নিজেকে সমর্পন করাই দ্বীনকে নিরাপদ রাখার নামান্তর। (তারীখে বাগদাদ, ৭/৫৬১)
৭. ইমাম আহমাদ ছিলেন অন্যতম একজন হাফেজে হাদীস। তিনি ইমাম শাফেয়ী ও তার ফিকহের প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, তিনি শুধু নিজেই নন, হুমায়দী, ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ ও ইবনে ওয়ারাহ প্রমুখ বড় বড় হাফেজে হাদীসকে ইমাম শাফেয়ীর পাগল বানিয়ে ছেড়েছেন। পেছনে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা গত হয়েছে। ইমাম আহমাদ বলেছেন, إذا سئلت عن مسألة لا أعرف فيها خبرا قلت فيها بقول الشافعي لأنه إمام قرشي আমাকে যদি এমন কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যে বিষয়ে কোন হাদীস আছে বলে আমি জানি না, তবে আমি শাফেয়ীর মতানুসারে ফতোয়া দিই। কেননা তিনি কুরায়শ বংশীয় ইমাম। (সিয়ার, ৮/৪১৪) ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ বলেন, قال لي أحمد بن حنبل : تعال حتى أريك رجلا لم تر عيناك مثله فأقامني على الشافعي আমাকে আহমাদ ইবনে হাম্বল বললেন, চল, তোমাকে এমন এক লোক দেখাব, তোমার দুচোখ তার মতো কাউকে দেখে নি। এরপর তিনি আমাকে শাফেয়ীর নিকট হাজির করলেন। (হিলয়াতুল আওলিয়া, আবু নুয়ায়ম, ৯/৯৭; বায়হাকী, আল মারিফা, নং ৩৭৭)
ইবনে ওয়ারাহ (ইমাম মুসলিমের উস্তাদ) বলেন, قدمت من مصر وأتيت أحمد بن حنبل فقال لي : كتبت كتب الشافعي؟ قلت : لا، قال فرطت ما عرفنا العموم من الخصوص وناسخ الحديث من منسوخه حتى جالسنا الشافعي قال : فحملني ذلك على الرجوع إلى مصر فكتبتها আমি মিসর থেকে আসলাম। আহমাদ ইবনে হাম্বলের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, তুমি কি শাফেয়ীর কিতাবগুলো লিখে এনেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তুমি ত্রুটি করেছ। আমরা তো শাফেয়ীর নিকট বসার আগ পর্যন্ত জানতাম না, খাস কাকে বলে, ‘আম কাকে বলে, হাদীসের নাসিখ কোনটি, মানসুখ কোনটি। ইবনে ওয়ারা বলেন, তার কথায় আমি পুনরায় মিসর গেলাম, এবং সেগুলো লিখে আনলাম। (যাহাবী, সিয়ার, ৮/৪০০)
৮.ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ ছিলেন ইমাম বুখারী ও মুসলিমের উস্তাদ। তার সম্পর্কে পূর্বে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। তিনি ইমাম শাফেয়ীর মজলিসে বসার পরই তার ভক্ত হন এবং তার ওফাতের পর বলা হয়,انكب على كتبه دراسة يستوعبها তার কিতাবসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন। (মুকাদ্দিমা মাসাইলে আহমাদ ওয়া ইসহাক, ১/১৪২) তিনি মার্ভের এক বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন ইমাম শাফেয়ীর কিতাবগুলোর আকর্ষণেই। তদুপরি ইমাম আহমাদকে অনুরোধ করে তার মাধ্যমে ইমাম শাফেয়ীর আর রিসালা গ্রন্থটিও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। কুহুস্তানী বলেন,
دخلت يوما على إسحاق فأذن لي وليس عنده أحد فوجدت كتب الشافعي حواليه فقلت : معاذ الله أن نأخذ إلا من وجدنا متاعنا عنده ، فقال لي : والله ما كنت أعلم أن محمد بن إدريس في هذه المحل الذي هو محله ولو علمت لم أفارقه
আমি একবার ইসহাক ইবনে রাহুয়ার নিকট গেলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলে ভেতরে গিয়ে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই। দেখলাম, তার চতুর্দিকে ইমাম শাফেয়ীর কিতাবসমূহ। আমি বললাম, যার কাছে আমাদের মাল পেয়েছি, তার পরিবর্তে অন্য কাউকে গ্রেফতার করব: এর থেকে আল্লাহর পানাহ। (এটি সুরা ইউসুফের ৭৯ নং আয়াত, এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে, আপনি তো এগুলো রাখতে পারেন না। আপনি তো মুহাদ্দিস, আপনার সম্পদ তো হাদীসভা-ার। অনুবাদক) তখন ইসহাক বললেন, আল্লাহর কসম! আমি জানতাম না মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস (শাফেয়ী) এই মানে পৌঁছে গেছেন, যে মানে তিনি রয়েছেন। যদি জানতাম তবে তার থেকে পৃথক হতাম না। (মুকাদ্দিমা মাসাইলে আহমাদ ওয়া ইসহাক, ১/১৪২)
৯.হুমায়দী ছিলেন মক্কা শরীফের খ্যাতনামা হাফেজে হাদীসগণের অন্যতম। তিনি ইমাম বুখারীর বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। ইমাম আহমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ইমাম শাফেয়ীর এমনই পাগল হলেন যে, ইমাম শাফেয়ী যখন শেষ জীবনে স্থায়ীভাবে মিসরে চলে যান, তখন তার সঙ্গে হুমায়দীও চলে গিয়েছিলেন। তার আশা ছিল ইমাম শাফেয়ীর ওফাতের পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, কিন্তু মিসরে ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট শিষ্য ইবনে আব্দুল হাকামের কারণে তা হয়ে ওঠে নি। (আজমী, মুকাদ্দিমা মুসনাদিল হুমায়দী) যাহাবী রহ. সিয়ারে লিখেছেন, وهو معدود في كبار أصحاب الشافعي তিনি ইমাম শাফেয়ীর শীর্ষস্থানীয় শিষ্যদের মধ্যে গণ্য। (তাযকিরাতুল হুফফাজ, ২/৩)
১০.ইয়াহয়া ইবনে মাঈন ছিলেন প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস। ইমাম আহমাদ ও আলী ইবনুল মাদীনীর সঙ্গে ছিল তার গভীর বন্ধুত্ব। তিনি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের উস্তাদ ছিলেন। ইমাম আহমাদ সম্পর্কে আবু জাফর বলেছেন,كان يفعل بيحيى بن معين مالم أره يعمل بغيره من التواضع والتكريم والتبجيل ইমাম আহমাদ ইয়াহয়া ইবনে মাঈনের সঙ্গে এমন বিনয় ও সম্মানের আচরণ করতেন, যা অন্য কারো সঙ্গে করতে আমি দেখি নি। (যাহাবী, সিয়ার, ৯/৫২২)
এই ইবনে মাঈন সম্পর্কে হাফেজ যাহাবী বলেছেন, كان أبو زكريا حنفيا في الفروع আবু যাকারিয়া (ইয়াহয়া ইবনে মাঈন) ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী ছিলেন। (সিয়ার, ৯/৩৫৯) একই মন্তব্য করেছেন তিনি তার তারীখুল ইসলাম গ্রন্থেও। (দ্র. ৫/৯৫৬)
ইবনে মাঈন বলেছেন, القراءة عندي قراءة حمزة والفقه فقه أبي حنيفة وعلى هذا أدركت الناس হামযার (সাত কারীর একজন) কিরাআতই হলো আমার দৃষ্টিতে কিরাআত, আর আবু হানীফার ফিকাহই হলো ফেকাহ। এ কথার উপরই আমি মানুষকে পেয়েছি। (কাযী সায়মারী, আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবুহু, ১/৮৭; ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আ’য়ান, ইমাম আবু হানীফার জীবনী)
ইবনে মাঈন যে আবু হানীফার ফিকাহ অনুসরণ করতেন সেটা তার নিম্নোক্ত উক্তি থেকেও বোঝা যায়। তার শিষ্য ইবনে মুহরিয বলেছেন, سمعت يحيى يقول : ما قرأت خلف إمام قط جهر أو لم يجهر আমি ইয়াহয়াকে বলতে শুনেছি যে, আমি কখনো ইমামের পেছনে কোরআন পড়ি নি, চাই তিনি সরবে কিরাআত পড়ুন বা নীরবে। (তারীখে ইবনে মাঈন বি রিওয়ায়াতি ইবনে মুহরিয, ১/১৫৬)
১১. হাফেজ আবু যুরআ রাযী ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। হাফেজ আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে উমর রাযী বলেছেন, لم يكن في هذه الأمة أحفظ من أبي زرعة الرازي এই উম্মতের মধ্যে আবু যুরআ রাযীর চেয়ে বড় হাফেজে হাদীস ছিল না। তিনি আরো বলেছেন, وحفظ كتب أبي حنيفة في أربعين يوما فكان يسردها مثل الماء তিনি আবু হানীফার কিতাবগুলো চল্লিশ দিনে মুখস্থ করে ফেলেছেন। তিনি সেগুলো পানির মতো মুখস্থ বলে যেতেন। (মিযযী, তাহযীবুল কামাল)
যাহাবী সিয়ার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, قال أبو زرعة وقيل له اختيار أحمد وإسحاق أحب إليك أم قول الشافعي؟ قال بل اختيار أحمد وإسحاق (৯/৪৫২) আবু যুরআকে জিজ্ঞেস করা হলো, আহমাদ ও ইসহাকের মত আপনার কাছে বেশী পছন্দের নাকি শাফেয়ীর মত? তিনি বললেন, আহমাদ ও ইসহাকের মত। (৯/৪৫২)
১২. খতীব বাগদাদী স্বীয় সনদে বর্ণনা করেছেন যে, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ বলেছেন, كان لنا جار من خيار الناس وكان من الحفاظ للحديث আমাদের একজন উত্তম প্রতিবেশী ছিলেন, তিনি হাদীসের হাফেজও ছিলেন। এই প্রতিবেশী তার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। একবার তাদের মধ্যে একটু ঝগড়া হলো। ফলে লোকটি বলে ফেললেন, আজ রাতেই যদি তুমি আমার নিকট তালাক চাও, আর আমি তালাক না-ও দিই, তবুও তুমি তিন তালাক। তার স্ত্রীও বলে ফেললেন, আজ রাতে যদি আমি তালাক না চাই, তবে আমার সব গোলাম আজাদ (মুক্ত) ও আমার সব সম্পদ সদকা। এরপর রাতেই তারা আমার নিকট আসলেন। মহিলাটি বললেন, আমি এই বলে ফেলেছি। আর প্রতিবেশী বললেন, আমি এই বলে ফেলেছি। আমি বললাম, আমার কাছে এর কোন সমাধান নেই। চলুন এই শায়খের: অর্থাৎ আবু হানীফার: কাছে যাই। আশা করি তার কাছে আমরা এর সমাধান পাব। লোকটি আবু হানীফার কিছু বিরূপ সমালোচনা করতেন এবং আবু হানীফার সেকথা জানাও ছিল। তিনি বললেন, আমার লজ্জা বোধ করে। আমি বললাম, আপনি তো আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। তবুও তিনি যেতে চাইলেন না। অবশেষে আমি তাদেরকে নিয়ে ইবনে আবু লায়লা ও সুফিয়ানের নিকট গেলাম। তারা উভয়েই বললেন, এ বিষয়ে আমাদের নিকট কোন সমাধান নেই। পরে আমরা আবু হানীফার কাছেই গেলাম। এবং পুরো ঘটনা খুলে বললাম। আমি তাকে একথাও জানালাম যে, আমরা সুফিয়ান ও ইবনে আবু লায়লার নিকটও গিয়েছিলাম। তারা কোন জবাব দিতে পারেন নি। তিনি (লোকটিকে) বললেন, আপনার সমস্যার সমাধান দেওয়াই আমার কর্তব্য, যদিও আপনি আমার সঙ্গে দুশমনি করতেন। এরপর তিনি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিভাবে বলেছেন? স্ত্রীকেও জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিভাবে বলেছেন? সবশুনে তিনি বললেন, আপনারা কি আল্লাহর ধরা থেকে নিষ্কৃতি চান এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বাঁচতে চান? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি (মহিলাকে) বললেন,
سليه أن يطلقك فقالت طلقني فقال للرجل قل لها أنت طالق ثلاثا إن شئت فقال لها ذلك فقال للمرأة قولي لا أشاء فقال : قد بررتما وخرجتما من طلبة الله لكما
আপনি স্বামীর নিকট তালাক চান। মহিলা বললেন, তুমি আমাকে তালাক দাও। অতঃপর তিনি স্বামীকে বললেন, আপনি বলুন, তুমি যদি চাও তবে তোমাকে তিন তালাক। তিনি স্ত্রীকে তাই বললেন। তিনি (আবু হানীফা) মহিলাকে বললেন, আপনি বলুন, আমি চাই না। এরপর বললেন, আপনারা শপথ ভেঙ্গে যাওয়া থেকে রক্ষা পেলেন এবং আল্লাহর ধরা থেকেও বেঁচে গেলেন।
ওয়াকী রহ. বলেন, فكان الرجل بعد ذلك يدعو لأبي حنيفة في دبر الصلوات وأخبرني أن المرأة تدعو له كلما صلتএরপর থেকে এ ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর আবু হানীফার জন্য দুআ করতেন এবং আমাকে একথাও জানিয়েছেন যে, তার স্ত্রীও যখনই নামায পড়েন তাঁর জন্য দুআ করেন। (আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ২/১৯৪)
লক্ষ করুন, এই ব্যক্তি নিজেও হাদীসের হাফেজ ছিলেন। ওয়াকী ও সুফিয়ান ছাওরীও হাদীসের হাফেজ হওয়ার পাশাপাশি উচ্চ মানের ফকীহও ছিলেন। ইবনে আবু লায়লাও ছিলেন কুফার কাযী ও বিচারক। এতদসত্ত্বেও তারা কেউ উক্ত সমস্যার সমাধান দিতে পারেন নি।
ওয়াকীসহ এই বারজন খ্যাতনামা হাফেজে হাদীসের কেউ কোন ফকীহর শিষ্য হয়েছেন, কেউ তাদের রচিত গ্রন্থ সংগ্রহ করে মুখস্থ বা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। কেউ বা কোন ফকীহর মতানুসারে ফতোয়া দিয়েছেন। এছাড়া শত শত মুহাদ্দিস ও হাফেজে হাদীস যারা চার ইমামসহ অন্যান্য ফকীহগণের নিকট ফেকাহ শিখেছেন বা তাদের মাযহাব অবলম্বন করেছেন তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।
যদি হাদীস জানা বা মুখস্থ থাকাই যথেষ্ট হতো, তবে এসব হাফেজে হাদীসের জন্য কেন তা যথেষ্ট হলো না? তাদের চেয়ে বড় কোন হাফেজে হাদীসের কথা কি আজ কল্পনা করা যায়?
ইমাম আবু হানীফা ছিলেন যুগের সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও ফকীহ
এই এগার নম্বর ঘটনা ও নয় নম্বরে উল্লেখিত ইবনে মাঈনের বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়, ইমাম আবু হানীফা ছিলেন তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও ফকীহ। ইমাম শাফেয়ীর একথা তো খুবই প্রসিদ্ধ যে,
الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة
ফিকহের ক্ষেত্রে সকল মানুষ ইমাম আবু হানীফার পরিবারতুল্য।
অর্থাৎ পরিবারের লোকজন যেমন কর্তার মুখাপেক্ষী, তেমনি ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষ ইমাম আবু হানীফার মুখাপেক্ষী। ইমাম শাফেয়ী একথাও বলেছেন যে, من أراد أن يتبحر في الفقه فهو عيال على أبي حنيفة وكان أبو حنيفة ممن وفق له الفقه ফিকহের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি পা-িত্য অর্জন করতে চাইবে, সেই আবু হানীফার মুখাপেক্ষী হবে। আবু হানীফাকে ফিকহের জ্ঞান বিশেষভাবে দান করা হয়েছিল। (ওয়াফায়াতুল আ’য়ান)
প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস ইয়াযীদ ইবনে হারুন বলেছেন,
أدركت ألف رجل من الفقهاء وكتبت عن أكثرهم ما رأيت فيهم أفقه وألا أورع ولا أعلم من خمسة : أولهم أبو حنيفة
আমি এক হাজার ফকীহর দেখা পেয়েছি। এবং তাদের অধিকাংশের ইলম লিপিবদ্ধ করেছি। তাদের মধ্যে পাঁচজনের চেয়ে বড় ফকীহ পরহেযগার ও সহনশীল কাউকে পাই নি। তাদের প্রথম হলেন আবু হানীফা। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইল, নং ৩৮)
অপর এক বর্ণনায় আছে, ইয়াযীদ ইবনে হারুনকে জিজ্ঞেস করা হলো, من أفقه من رأيت؟ قال أبو حنيفةআপনি যাদের পেয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ কে? তিনি বললেন, আবু হানীফা। (প্রাগুক্ত, নং ১০৯)
প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস আবু বকর ইবনে আইয়াশ বলেছেন, كان النعمان بن ثابت فهما من أفقه أهل زمانهনুমান ইবনে ছাবিত (আবু হানীফা) অত্যন্ত সমঝদার ও যুগের অন্যতম ফকীহ ছিলেন। (প্রাগুক্ত, নং ১০৩)
আবু আসিম আন নাবীল বলেছেন, أبو حنيفة عندي أفقه من سفيان আমার দৃষ্টিতে আবু হানীফা সুফিয়ানের চেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন। (প্রাগুক্ত, নং ১০৯)
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, إن كان لأحد من هذه الأمة أن يقول بالرأي فهو لأبي حنيفة এ উম্মতের কারো যদি মতামত দেয়ার অধিকার থাকে তবে তা আবু হানীফার রয়েছে। (প্রাগুক্ত, নং ১১৬)
আহমদ ইবনে হারব বলেছেন, كان أبو حنيفة في العلماء كالخليفة في الأمراء আমীর-উমারাদের মধ্যে খলীফার যে মর্যাদা, আলেমগণের মধ্যে আবু হানীফারও তেমনি মর্যাদা। (প্রাগুক্ত, নং ১১৫)
ইমাম আবু ইউসুফ বলেছেন, ما رأيت أحدا أعلم بتفسير الحديث من أبي حنيفة হাদীসের মর্ম সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফার চেয়ে বড় জ্ঞানী কাউকে আমি দেখি নি। (প্রাগুক্ত, নং ১২১)
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, لا تقولوا رأي أبي حنيفة ولكن قولوا تفسير الحديث তোমরা বলো না আবু হানীফার মত, বরং বলো এটা হাদীসের মর্ম ও ব্যাখ্যা। (প্রাগুক্ত, নং ১৫০)
প্রসিদ্ধ হাফেজে হাদীস ঈসা ইবনে ইউনুসও বলেছেন,والله ما رأيت أفضل منه ولا أورع منه ولا أفقه منهআল্লাহর কসম! আবু হানীফার চেয়ে উত্তম, তার চেয়ে বড় পরহেযগার ও তার চেয়ে বড় ফকীহ কাউকে আমি দেখি নি। (ইবনে আব্দুল বার, আল ইনতিকা, পৃ. ২১২)
ইমাম আবু হানীফাও হাফেজে হাদীস ছিলেন
একজন মুজতাহিদ ফকীহর জন্য অপরিহার্য হলো ন্যূনপক্ষে বিধিবিধান সংক্রান্ত হাদীস ও সুন্নাহর হাফেজ হওয়া। অন্যথায় তিনি সঠিক ফতোয়াও দিতে পারবেন না। সঠিক মাসাইল কুরআন-সুন্নাহ থেকে বের করতেও পারবেন না। ইমাম আবু হানীফাকে মুসলিম উম্মাহর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ সবচেয়ে বড় ফকীহ আখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি অন্তত বিধানসম্বলিত সুন্নাহর হাফেজ ছিলেন। এ কারণেই হাফেজে হাদীসগণের জীবনীমূলক গ্রন্থগুলোতে ইমাম আবু হানীফার জীবনীও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন হাফেজ যাহাবী তার তাযকিরাতুল হুফফাজ গ্রন্থে (১/১৬৮), হাফেজ ইবনে আব্দুল হাদী তার আল মুখতাসার ফী তাবাকাতি উলামাইল হাদীস গ্রন্থে (২/৯৭), হাফেজ ইবনে নাসেরুদ্দীন আত তিবয়ান গ্রন্থে (দ্র. আব্দুর রশীদ নুমানী, মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ. ৬০), ইমাম ও মুহাদ্দিস ইবনুল মিবরাদ হাম্বলী তার তাবাকাতুল হুফফাজ গ্রন্থে (দ্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১) হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়ূতী তার তাবাকাতুল হুফফাজ গ্রন্থে (পৃ. ৮০) ও আল্লামা বাদাখশী তার তারাজিমুল হুফফাজ গ্রন্থে। (দ্র. মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস,পৃ. ৬২, ৬৩)
উল্লেখ্য, এসব গ্রন্থকারের কেউই হানাফী ছিলেন না। তাই এমন সন্দেহেরও কোন অবকাশ নেই যে, ভক্তির আতিশয্যে তাঁরা এমনটি করেছেন।
ইমাম আবু হানীফা ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী। হাফেজ যাহাবী তার আল ইবার গ্রন্থে লিখেছেন, وكان من أذكياء بني آدم তিনি ছিলেন আদমসন্তানের মধ্যে বড় বড় মেধাবীদের একজন। (১/১১২)
এমন তীক্ষè মেধার অধিকারী মানুষ সম্পর্কে যখন হাফেজ যাহাবী বলেন, طلب الحديث وأكثر منه في سنة ماءة وبعدها একশ হিজরী ও তার পরবর্তী সময়ে তিনি হাদীস শিক্ষা করেছেন এবং অনেক হাদীস শিক্ষা করেছেন। (সিয়ার, ৬/৩৯৬) তখন তিনি কী পরিমাণ হাদীস আয়ত্ব করেছেন, তা সহজেই অনুমেয়। যাহাবী আরো লিখেছেন, وعني بطلب الآثار وارتحل في ذلك তিনি হাদীস শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং এজন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। (সিয়ার, ৬/৩৯২)
ইমাম আবু হানীফার সহপাঠী ছিলেন মিসআর ইবনে কিদাম। তিনি এত বড় হাদীসবিদ ছিলেন যে, শো’বা ও সুফিয়ানের মতো হাদীসস¤্রাটের মধ্যে হাদীস বিষয়ে কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে দুজনই বলতেন, اذهبا بنا إلى الميزان مسعر আমাদেরকে (হাদীসের) মানদ- মিসআরের নিকট নিয়ে চল। (হাফেজ আবু মুহাম্মাদ রামাহুরমুযী, আল মুহাদ্দিসুল ফাসিল, পৃ. ১৩৯)
এই মিসআরই ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেছেন,
طلبت مع أبي حنيفة الحديث فغَلَبَنا وأخذنا في الزهد فبرع علينا وطلبنا معه الفقه فجاء منه ما ترون
আবু হানীফার সঙ্গে হাদীস শিক্ষা করলাম, সে আমাদের উপর অগ্রণী হয়ে গেল। যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতায় লাগলাম, সে আমাদের ছাড়িয়ে গেল। তার সঙ্গে ফেকাহ শিক্ষা করলাম, এতে তোমরা তো দেখতেই পাচ্ছ সে কেমন বুৎপত্তি অর্জন করেছে। (যাহাবী, মানাকিবু আবী হানীফা, পৃ. ৪৩)
এমনিভাবে ওয়াকী সম্পর্কে ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, وكان قد سمع من أبي حنيفة حديثا كثيرا তিনি আবু হানীফা থেকে প্রচুর হাদীস শুনেছেন। (ইবনে আব্দুল বার, জামিউ বায়ানিল ইলম, ২/১০৮২)
ইবনে আব্দুল বার আল ইনতিকা গ্রন্থে লিখেছেন, وروى حماد بن زيد عن أبي حنيفة أحاديث كثيرة আবু হানীফা থেকে হাম্মাদ ইবনে যায়দ বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। (পৃ. ২০১)
যাহাবী বলেছেন, روى عنه من المحدثين والفقهاء عدة لا يحصون তাঁর থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। (মানাকিব, পৃ. ২০)
হাফেজ শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আস সালেহী বলেছেন,
إن الإمام أبا حنيفة من كبار حفاظ الحديث ولولا كثرة اعتنائه بالحديث ما تهيأ له استنباط مسائل الفقه فإنه أول من استنبطه من الأدلة
ইমাম আবু হানীফা একজন শীর্ষ হাফেযে হাদীস। তিনি যদি অধিক হারে হাদীস অর্জন না করতেন, তবে তাঁর পক্ষে ফিকহের মাসাইল আবিস্কার করা সম্ভব হতো না। কুরআন-সুন্নাহ থেকে তিনিই তো প্রথম (মাসাইল) আবিস্কার করেছেন। (উকুদুল জুমান, পৃ. ৩১৯)
মুহাদ্দিস ইসমাঈল আজলূনী লিখেছেন,
فهو رضي الله عنه حافظ حجة فقيه لم يكثر في الرواية لما شدد في شروط الرواية والتحمل وشروط القبول
তিনি ছিলেন হাফেজে হাদীস, প্রামাণ্য ব্যক্তিত্ব ও ফকীহ। তবে হাদীস অর্জন ও বর্ণনার শর্তাবলি ও হাদীস গ্রহণের শর্তাবলির ক্ষেত্রে তিনি কড়াকড়ি করেছেন। ফলে তিনি অধিক হারে হাদীস বর্ণনা করেন নি। (ইকদুল জাওহারিছ ছামীন, পৃ. ৬)
সকল ফকীহরই নির্ভরতা ছিল সহীহ হাদীসের উপর
প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ সকল মুজতাহিদ ফকীহই নির্ভর করেছেন সহীহ হাদীসের উপর। কারণ তাদের সকলের ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী ও কর্ম সঠিকভাবে ধরতে পারা। ফলে এ ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের বিকল্প ছিল না। ইমাম আবু হানীফা তাঁর মূলনীতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন,
أني آخذ بكتاب الله إذا وجدته ، فما لم أجده فيه آخذ بسنة رسول الله والآثار الصحاح عنه التي فشت في أيدي الثقات عن الثقات فإذا لم أجد في كتاب الله ولا سنة رسول الله أخذت بقبول أصحابه من شئت وأدع قول من شئت ثم لا أخرج عن قولهم إلى قول غيرهم فإذا انتهى الأمر إلى إبراهيم والشعبي والحسن وعطاء وابن سيرين وسعيد بن المسيب وعدّد رجالا فقوم قد احتجوا فلي أن أجتهد كما اجتهدوا.
আমি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অনুসারে আমল করি, যদি সেখানে পাই। অন্যথায় রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ ও তাঁর থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করি, যা বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের সূত্রে বিশ্বস্তদের হাতে হাতে ছড়িয়ে আছে। যদি কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও না পাই তবে সাহাবীগণের যার মত পছন্দ হয় গ্রহণ করি, যার মত পছন্দ হয় না গ্রহণ করি না। তবে তাঁদের মতের বাইরেও আমি যাই না। আর যখন ইবরাহীম নাখায়ী, শা’বী, হাসান, আতা, ইবনে সীরীন ও সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব: আরো অনেকের নাম বলেছেন: প্রমুখ পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়ায়, তো তাঁরাও ইজতেহাদ করেছেন, আমিও তাদের মতো ইজতেহাদ করেছি। (আল ইনতিকা, পৃ. ২৬৪, ২৬৫)
সুফিয়ান ছাওরীও ইমাম আবু হানীফার নীতি সম্পর্কে অনুরূপ বলেছেন। তিনি বলেছেন,
يأخذ بما صح عنده من الأحاديث التي كان يحملها الثقات وبالآخر من فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم وبما أدرك عليه علماء الكوفة
বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বর্ণনাকৃত যেসব হাদীস তাঁর নিকট সহীহ বলে প্রমাণিত হতো, তিনি সে অনুযায়ী আমল করতেন, আমল করতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ আমল অনুযায়ী এবং কুফর আলেমগণকে যেভাবে আমল করতে দেখেছেন, সে অনুযায়ী। (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাসান ইবনে সালেহও বলেছেন,
كان النعمان بن ثابت فهما بعلمه متثبتا فيه ، إذا صح عنده الخير عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يعدُه إلى غيره
নুমান ইবনে ছাবিত (আবু হানীফা) নিজের ইলম সম্পর্কে বোদ্ধা ছিলেন এবং এক্ষেত্রে খুব পাকা ও সুদৃঢ় ছিলেন। তাঁর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস সহীহ প্রমাণিত হলে তিনি সেটা ছেড়ে অন্য কিছু অবলম্বন করেন না। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইলু আবী হানীফা, নং ১১৯)
হাফেজে হাদীস ঈসা ইবনে ইউনুস বলেছেন, كان النعمان بن ثابت شديد الاتباع لصحيح حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم নুমান ইবনে ছাবিত (আবু হানীফা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহীহ হাদীস কঠিনভাবে অনুসরণ করতেন। (প্রাগুক্ত, নং ২৬৭)
একটি ধারণা ও তার খণ্ডন
কেউ কেউ মনে করেন, ইমাম ও ফকীহগণ যদি সকলেই সহীহ হাদীস মেনে চলতেন, তবে তাদের মধ্যে মতভিন্নতা হত না। অথচ বাস্তবতা হলো, তাদের মধ্যে মতভিন্নতা হয়েছে।
কিন্তু এমন মনে করাটা সঠিক নয়। এমন ভাসা ভাসা ধারণা কোন সাধারণ মানুষ করলে করতে পারে। কোন আলেমের জন্য, আসবাবে এখতেলাফ বা মতভিন্নতার কারণ সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির জন্য এমন ধারণা পোষণ করার সুযোগ নেই। ফকীহ ইমামগণ ও তাদের মতের অনুসারীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যুগে যুগে যারা মাযহাব অনুসরণ না করে সহীহ হাদীস অনুসরণের দাবী করেছেন, তাদের মধ্যেও অসংখ্য মতভিন্নতা দেখা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক সাহেবের রচিত ‘উম্মাহর ঐক্য পথ ও পন্থা’ পুস্তকটি ৭৪-৭৮ পৃষ্ঠা দেখা যেতে পারে। এখানে মোটা মোটা কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে :
ক. আলবানী সাহেব বলেছেন, জাহরী নামাযে মুকতাদী সুরা ফাতেহা পাঠ করবে না। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের লা মাযহাবী ভাইয়েরা বলে থাকেন, জাহরী ও সিররী সব নামাযেই তা পড়তে হবে।
খ. আলবানী সাহেব বলেছেন, সেজদায় যেতে প্রথমে হাত পরে হাঁটু রাখা ফরজ। আসাদুল্লাহ গালিব বলেছেন, সুন্নত। শায়খ বিন বায ও শায়খ উছায়মীন বলেছেন, এমনটা করবে না, বরং সুন্নত হলো আগে হাঁটু রাখা, পরে হাত।
গ. ইমাম বুখারী বলেছেন, রুকু পেলে রাকাত পাওয়া ধর্তব্য হবে না। আমাদের অনেক লা মাযহাবী ভাইও অনুরূপ বলে থাকেন। অপরদিকে শায়খ বিন বায, শায়খ উছায়মীন, আলবানী প্রমুখ বলেছেন, রুকু পেলে রাকাত পাওয়া ধর্তব্য হবে।
ঘ. শাওকানী সাহেব বলেছেন, ইকামত জোড়া জোড়া শব্দে বলা উত্তম। মুবারকপুরী বলেছেন, বেজোড় শব্দে বলা উত্তম।
এ বিষয়গুলো এই গ্রন্থেই বরাত উল্লেখসহ বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
ঙ. শায়খ বিন বায বলেছেন, রুকু থেকে ওঠার পর পুনরায় হাত বাঁধবে। বাকর আবু যায়দ বলেছেন, পুনরায় হাত বাঁধবে না।
সহীহ হাদীস অনুসারে চলার দাবীদার এসব আলেমদের মধ্যে যদি দ্বিমত হতে পারে, তবে মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণের মধ্যেও দ্বিমত হওয়া স্বাভাবিক। যদিও তাদের প্রত্যেকেরই নীতি ছিল সহীহ হাদীস অনুসারে চলা।
কেউ কেউ বলে থাকেন, ইমামগণের ঐ নীতি ছিল সেই কথা ঠিক। কিন্তু সব সহীহ হাদীস তো তাদের নিকট নাও পৌঁছতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের কোন একজনকে অনুসরণ করলে সহীহ হাদীস অনুসারে চলা নাও হয়ে উঠতে পারে। একথাটি একেবারে অমূলক নয়। তবে কোন হাদীসটি ইমামগণের নিকট পৌঁছেছে আর কোনটি পৌঁছে নি সেই ফয়সালা করবে কে? বিশেষ করে যে প্রসিদ্ধ মতভেদপূর্ণ মাসায়েলের ক্ষেত্রে একথা বলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করা হয় সেসবগুলোতেই দেখা যায়, সহীহ হাদীসগুলো ইমামগণের নিকট পৌঁছেছে। তারা সেগুলো অনুযায়ী আমল করেছেন ও ফতোয়া দিয়েছেন অথবা সেগুলোর ব্যাখ্যা পেশ করে বিপরীত সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করেছেন। ইমাম আবু হানীফার কথাই ধরা যাক, বিরোধপূর্ণ প্রসিদ্ধ সব মাসায়েলের পক্ষে তার নিকট সহীহ হাদীস বিদ্যমান ছিল। আবার অন্যরা যেসব সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করেন এবং বলে থাকেন, এই হাদীসগুলো হয়তো তার নিকট পৌঁছে নি, সেগুলোও তার অজানা ছিল না। সেগুলোর অধিকাংশই তিনি রেওয়ায়েত করেছেন। এর জন্য মুরতাযা হাসান যাবীদী কৃত ‘উকুদুল জাওয়াহিরিল মুনীফা’ কিতাবটি দেখা যেতে পারে। আবার এসব মাসায়েলের প্রায় সব কটিতেই তার সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন সুফিয়ান ছাওরী। তিরমিযী শরীফ দেখলেই এ তথ্য পাওয়া যাবে। সুফিয়ান তো ছিলেন আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস: হাদীসের স¤্রাট ও মহাসাগর। তার ব্যাপারে তো এই সন্দেহ হওয়ার কথা নয় যে, ঐ সব সহীহ হাদীস তার নিকট পৌঁছে নি। সুতরাং দলিলপ্রমাণ ছাড়া এসব কথা বলে লাভ নেই।
হ্যাঁ, সামগ্রিক বিচারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হানাফী বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ: যাদেরকে আসহাবুত তারজীহ (অগ্রগণ্য আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ) বলা হয়: চিহ্নিত করেছেন যে, সেসব ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার নিকট সহীহ হাদীস পৌঁছে নি। ফলে কোথাও তাঁরা ইমাম আবু হানীফার বিশিষ্ট শিষ্য ইমাম কাযী আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মতকে: যা সহীহ হাদীস অনুসারে হওয়া প্রমাণিত: অগ্রগণ্য আখ্যা দিয়েছেন। কোথাও তাঁদের দুজনের কোন একজনের মতকে, কোথাও আবার ইমাম যুফার বা হাসান ইবনে যিয়াদের: এ দুজনও ছিলেন ইমাম আবু হানীফার বিশিষ্ট শিষ্য: মতকে অগ্রগণ্য আখ্যা দিয়েছেন। এভাবে আজকে যাদের মাথায় এমন সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে, বহু পূর্বেই হানাফী মনীষীগণ তার গোড়া কেটে দিয়েছেন। ফলে এখন আর এমন সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। অন্যান্য মাযহাব সম্পর্কেও এই একই কথা।
সব সহীহ হাদীসই কি আমলযোগ্য?
প্রকাশ থাকে যে, ‘সহীহ’ একটি পারিভাষিক শব্দ। মুহাদ্দিসগণ এ শব্দটি বহু অর্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো, যখন এটি যঈফের বিপরীত শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। এরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও অনেক শর্ত। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক আলেমও এর সংজ্ঞা ও শর্তের খবর রাখেন না। অথচ সাধারণ মানুষের মুখে একথা তুলে দেওয়া হয়েছে, সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করতে হবে।
কিন্তু এই শেষোক্ত সহীহ’র কথাই যদি ধরি, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, সব সহীহ হাদীসই কি আমলযোগ্য? নাকি এর জন্য আরো কোন শর্ত রয়েছে? হ্যাঁ, শর্ত অবশ্যই রয়েছে। যেমন :
১. হাদীসের বিধানটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস না হতে হবে।
২. হাদীসটি মানসুখ বা রহিত না হতে হবে। এ দুটি শর্ত সর্বজনস্বীকৃত।
৩. হাদীসটি অনুসারে সাহাবা, তাবিঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের আমল থাকতে হবে। আমল না থাকা রহিত হওয়ার আলামত।
ইমাম মালেক রহ. বলেছেন,
كان محمد بن أبي بكر بن عمرو بن حزم على القضاء بالمدينة فكان إذا قضى القضاء مخالفا للحديث ورجع إلى منزله قال له أخوه عبد الله بن أبي بكر وكان رجلا صالحا أي أخي قضيت اليوم في كذا كذا بكذا وكذا؟ فيقول له محمد : نعم أي أخي، فيقول له عبد الله : فأين أنت أي أخي عن الحديث أن تقضي به؟ فيقول محمد : أيهات فأين العمل يعني ما اجتمع عليه من العمل بالمدينة والعمل المجتمع عليه عندهم أقوى من الحديث
মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইবনে আমর ইবনে হাযম (তাবিঈ) মদীনার কাযী বা বিচারক ছিলেন। তিনি যখন হাদীসের বিপরীত রায় দিতেন এবং ঘরে ফিরে আসতেন, তার ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর: তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন: তাঁকে বলতেন, ভাইয়া! আজকে আপনি এই এই বিষয়ে এই এই রায় দিয়েছেন, তাই না? তিনি বলতেন, হ্যাঁ, ভাইয়া। আব্দুল্লাহ বলতেন, হাদীস অনুসারে রায় দিলেন না কেন ভাইয়া? মুহাম্মদ তখন বলতেন, তাহলে আমল অর্থাৎ মদীনার সর্বসম্মত আমল কোথায় যাবে? সর্বসম্মত আমল ছিল তাদের নিকট হাদীসের চেয়ে শক্তিশালী। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ১/২৮২)
ইমাম মালেক বলেছেন, والعمل أثبت من الأحاديثহাদীসের চেয়েও (মদীনায় চালু) আমল অধিক শক্তিশালী। (ইবনে আবু যায়দ আল কায়রাওয়ানী, আল জামে, পৃ. ১১৭)
প্রসিদ্ধ হাফেজে হাদীস আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেছেন, السنة المتقدمة من سنة أهل المدينة خير من الحديث পূর্ব থেকে চলে আসা মদীনাবাসীদের আমল হাদীসের চেয়েও উত্তম। (প্রাগুক্ত)
মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত তাব্বা ছিলেন ইমাম মালেকের শিষ্য এবং শীর্ষ হাফেজে হাদীস ও ফকীহ। ২২৪ হি. সনে তার ওফাত হয়। তিনি বলেছেন, كل حديث جاءك عن النبي صلى الله عليه وسلم لم يبلغك أن أحدا من أصحابه فعله فدعه নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যত হাদীস তোমার নিকট পৌঁছবে এবং তাঁর সাহাবীগণের কেউ তদনুযায়ী আমল করেছেন মর্মে কোন কথা তোমার নিকট পৌঁছবে না সে হাদীসগুলো ছেড়ে দাও। (আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ, ১/১৩২)
হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী বলেছেন,
أما الأئمة وفقهاء أهل الحديث فإنهم يتبعون الحديث الصحيح حيث كان إذا كان معمولا به عند الصحابة ومن بعدهم أو عند طائفة منهم فأما ما اتفق على تركه فلا يجوز العمل به ، لأنهم ما تركوه إلا على علم أنه لا يعمل به
ইমামগণ ও ফকীহ মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদীস অনুসরণ করতেন, তা যেখানে পেতেন। তবে শর্ত ছিল হাদীসটি অনুসারে সাহাবীগণের ও পরবর্তী আলেমগণের বা তাদের কোন এক জামাতের আমল থাকবে। পক্ষান্তরে যে হাদীস অনুসারে তাদের কেউ আমল করেন নি, সে হাদীস অনুসারে আমল করা ঠিক হবে না। কেননা এ অনুযায়ী আমল করা যাবে না: একথা জানেন বলেই তারা এটি ছেড়ে দিয়েছেন। (ফাযলু ইলমিস সালাম আলাল খালাফ, পৃ. ৯)
হাফেজ আবুল কাসেম আদ দারাকী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। ৩৭৫ হি. সনে তাঁর ওফাত হয়। তাঁর নিকট কোন মাসআলা আসলে দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর ফতোয়া দিতেন। অনেক সময় তার প্রদত্ত ফতোয়া ইমাম শাফেয়ী ও আবু হানীফার মাযহাবের বিপক্ষে যেত। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস অমুকের সূত্রে অমুক বর্ণনা করেছেন। আর ঐ দুই ইমামের মত গ্রহণ করার চেয়ে হাদীসটি গ্রহণ করাই তো শ্রেয়। হাফেজ যাহাবী তার একথার উপর মন্তব্য করে লিখেছেন,
قلت هذا جيد لكن بشرط أن يكون قد قال بذلك الحديث إمام من نظراء هذين الإمامين مثل مالك أو سفيان أو الأوزاعي وبأن يكون الحديث ثابتا سالما من علة وبأن لا يكون حجة أبي حنيفة والشافعي حديثا صحيحا معارضا للآخر أما من أخذ بحديث صحيح وقد تنكبه سائر أئمة الاجتهاد فلا
অর্থাৎ আমি বলব, এটা ভাল। তবে শর্ত হলো এই দুই ইমামের মতো আরো যেসব ইমাম রয়েছেন, তাদের কেউ না কেউ অনুরূপ বলবেন। যেমন, মালেক, সুফিয়ান ও আওযায়ী। আরেকটি শর্ত হলো, হাদীসটি প্রমাণিত হতে হবে,সকল দোষত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আরেকটি শর্ত হলো, আবু হানীফা ও শাফেয়ীর দলিলটি, যা উক্ত হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, সহীহ হাদীস হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি এমন কোন সহীহ হাদীস গ্রহণ করল, যেটি মুজতাহিদ ইমামগণের কেউ গ্রহণ করেন নি তাহলে সেটা ঠিক হবে না। (যাহাবী, সিয়ার, ১৬/৪০৪)
হাফেজ ইবনুস সালাহও সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করার জন্য তদনুযায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমামের আমল থাকার শর্ত আরোপ করেছেন। (দ্র. আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী, ১/১১৮)
ইবনুস সালাহ’র এই বক্তব্য আলবানী সাহেবও তার সিফাতুস সালাহ গ্রন্থের টীকায় উদ্ধৃত করেছেন। দেখুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি, পৃ. ৩১। উক্ত টীকায় ইমাম সুবকির যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমার নিকট হাদীস অনুসরণ করাই উত্তম, সেটি তার ব্যক্তিগত মত। আমার নিকট: কথাটি তাই নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, মুজতাহিদ ইমামের আমল থাকার শর্ত এজন্যই আরেপ করা হয়েছে যে, উক্ত আমল নির্দেশ করে যে, হাদীসটি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কারণ কোন হাদীস ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে যদি ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ধরে নিতে হবে সেখানে ভিন্ন কোন হাদীস ছিল, যা এটির তুলনায় অগ্রগণ্য।
কেউ কেউ আবার কোন কোন ইমাম থেকে বর্ণিত, إذا صح الحديث فهو مذهبي কথাটি দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে খুবই ব্যস্ত। একথাটি ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন বলে প্রমাণিত রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা থেকে অবিচ্ছিন্ন সনদ বা সূত্রে কথাটি পাওয়া যায় নি। যদিও কোন কোন হানাফী আলেম এটি আবু হানীফার বক্তব্য বলে দাবী করেছেন। কথা যার থেকেই প্রমাণিত থাকুক, কথাটি সত্য, এটাই ইমামগণের মনের কথা ও প্রতিষ্ঠিত নীতি। কিন্তু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারকারীদের মতলব খারাপ। তার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন,
ক. ঐ কথাটির এমন মর্মও হতে পারে, হাদীস সহীহ হলেই তার ওপর আমি আমার মত ও মাযহাবের ভিত্তি রাখি। এ হিসাবে যত মাসআলার তিনি বা তারা সমাধান দিয়েছেন, সহীহ হাদীস অনুসারেই দিয়েছেন। এ মর্ম গ্রহণ করলে মতলববাজদের মতলব পূরণ হয় না।
খ. যারা ঐ কথাটির এই মর্ম গ্রহণ করেছেন যে, কোন সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে সেটাই আমার মাযহাব বলে গণ্য হবে, তারাও এর সঙ্গে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যার কারণে মতলবওয়ালাদের মতলব সিদ্ধি হয় না। যেমন, ইমাম নববী (মৃত্যু ৬৭৬ হি.) বলেছেন,
وإنما هذا فيمن له رتبة الاجتهاد في المذهب وشرطه أن يغلب على ظنه أن الشافعي رحمه الله لم يقف على هذا الحديث أو لم يعلم صحته وهذا إنما يكون بعد مطالعة كتب الشافعي كلها ونحوه من كتب أصحابه الآخذين عنه وما أشبهها ، وهذا شرط صعب قلّ من يتصف به
অর্থাৎ এ কথাটি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যিনি তার মাযহাবে ইজতেহাদের স্তরে পৌঁছে গেছেন। তবে শর্ত হলো, শাফেয়ী রহ. হাদীসটি সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারেন নি, বা তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি জ্ঞান লাভ করতে পারেন নি, এ ব্যাপারে তার প্রায় নিশ্চিত জ্ঞান থাকতে হবে। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন তিনি শাফেয়ীর সকল কিতাব, তার শিষ্যগণের কিতাব ও অনুরূপ আরো কিছু অধ্যয়ন করবেন। এটি একটি কঠিন শর্ত যা খুব কম ব্যক্তির মধ্যেই পাওয়া যায়। (আল মাজমু, ১/১০৪)
হাফেজ আবু আমর ইবনুস সালাহ (মৃত্যু ৬৪৩ হি.) বলেছেন,
وليس هذا بالهين ، فليس كل فقيه يسوغ له أن يستقل بالعمل بما يراه حجة من الحديث
অর্থাৎ এ কাজ অত সহজ নয়। যে কোন ফকীহ এমনটি করতে পারেন না যে, তিনি নিজে যে হাদীসকে প্রামাণ্য জ্ঞান করবেন সে অনুযায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে আমল করবেন। (আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী, ১/১১৮)
হাফেজ আবু শামা রহ. বলেছেন,
ولا يتأتى النهوض بهذا إلا من عالم معلوم الاجتهاد وهو الذي خاطبه الشافعي بقوله : إذا وجدتم حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم على خلاف قولي فخذوا به ودعوا ما قلت ، وليس هذا لكل أحد الخ
এটা এমন আলেমের কাজ, যার ইজতিহাদ করার যোগ্যতা সর্বজনবিদিত। এ ধরনের আলেমকেই শাফেয়ী বলেছিলেন, ‘তোমরা যখন আমার মতের বিপরীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস পাবে, তখন সেটি গ্রহণ করবে আর আমার মতটি ছেড়ে দেবে।’ এটা সকলের জন্য নয়। (আছারুল হাদীস আশ শরীফ, পৃ. ৭০)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃত্যু ৮৫২ হি.) বলেছেন,
إن محل العمل بهذه الوصية ما إذا عرف أن الحديث لم يطلع عليه الشافعي ، أما إذا عرف أنه اطلع عليه وردّه أو تأوله بوجه من الوجوه فلا.
এই ওসিয়তটি মেনে চলার ক্ষেত্র হলো, যখন জানা যাবে শাফেয়ী উক্ত হাদীস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। পক্ষান্তরে যদি জানা যায়, তিনি তা জানতেন, কিন্তু গ্রহণ করেন নি কিংবা এর কোন ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, তখন ওসিয়তটি অনুসারে চলা যাবে না। (ফাতহুল বারী, হা. ৭৩৯)
ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী রহ. ইমাম শাফেয়ীর উক্ত কথাটির ব্যাখ্যায় একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকাই রচনা করে ফেলেছেন। সেখানে তিনি হাফেজ ইবনুস সালাহ ও ইমাম নববীর উল্লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন এবং বলেছেন, هذا تبيين لصعوبة هذا المقام حتى لا يغترّ به كل أحد এই জটিল ক্ষেত্রের এটই বিশ্লেষণ, যাতে কেউ উক্ত কথার দ্বারা ধোঁকায় না পড়ে। (আছারুল হাদীস আশ শরীফ, পৃ. ৬৮)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. রদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলেছেন,
ولا يخفى أن ذلك لمن كان أهلا للنظر في النصوص ومعرفة محكمها من منسوخها
একথা কারো অজানা নয় যে, এটা একমাত্র সেই ব্যক্তির জন্য, যিনি কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে ও তার মধ্যে কোনটি মানসুখ (রহিত) আর কোনটি মুহকাম (রহিত নয়) সে সম্পর্কে গভীর দৃষ্টির অধিকারী। (১/৬৮)
আল্লামা ইবনে আবেদীন তার ফতোয়া দানের মূলনীতি বিষয়ক ‘শারহু উকুদি রাসমিল মুফতী’ গ্রন্থেও উপরোক্ত কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সেখানে তিনি আরো একটি শর্ত যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন,
وأقول أيضا : ينبغي تقييد ذلك بما إذا وافق قولا في المذهب ، إذ لم يأذنوا في الاجتهاد فيما خرج عن المذهب مما اتفق عليه أئمتنا ، لأن اجتهادهم أقوى من اجتهاده ، فالظاهر أنهم رأوا دليلا أرجح مما رآه حتى لم يعملوا به.
অর্থাৎ আমি আরো বলছি, ঐ কথাটি এই শর্তে গ্রহণ করতে হবে যে, হাদীসটি যেন হানাফী মাযহাবের কোন একটি কওল বা মতের মোয়াফেক হয়। কেননা আমাদের ইমামগণ যে বিষয়ে একমত হয়েছেন, সে বিষয়ে মাযহাবের বাইরে ইজতিহাদ করার কোন অনুমতি আলেমগণ দেন নি। কারণ তাদের ইজতিহাদ অবশ্যই ঐ ব্যক্তির ইজতিহাদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। সুতরাং এটাই স্পষ্ট যে, তাঁরা নিশ্চয়ই এমন কোন দলিলপ্রমাণ পেয়েছেন, যা ঐ ব্যক্তির প্রাপ্ত দলিলের চেয়ে মজবুত। ফলে তারা তদনুযায়ী আমল করেছেন। (দ্র. পৃ. ১১৮)
উল্লিখিত শর্তাবলির সারসংক্ষেপ হলো :
১. হাদীসটি ইমামগণের নিকট পৌঁছে নি: এ মর্মে নিশ্চিত জ্ঞান থাকতে হবে। এর জন্য ইমামগণের ও তাদের শিষ্যগণের রচিত গ্রন্থাবলি পরিপূর্ণ অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান করতে হবে।
২. যে ব্যক্তি ইমামগণের মত ছেড়ে ঐ সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করবেন তাকে মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম হতে হবে।
৩. হানাফী মাযহাবের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা ও তার বড় বড় শিষ্যগণের কারো মতের সঙ্গে হাদীসটি মিলতে হবে।
এসব শর্ত উপেক্ষা করে যে কেউ যদি তার নিজের বিচার-বিবেচনায় কোন সহীহ হাদীসকে কোন ইমামের মাযহাব আখ্যা দিতে যান, তাহলে ইমামগণের প্রতিষ্ঠিত ও পরীক্ষিত মাযহাব মানুষের হাতের খেলনায় পরিণত হবে। একজন একটি সহীহ হাদীস পেয়ে বলবেন, এটাই ইমামগণের মাযহাব। আরেকজন এর বিপরীত আরেকটি সহীহ হাদীস পেয়ে বলবেন, এটাই ইমামগণের মাযহাব। একজন একটি হাদীসকে সহীহ মনে করে ইমামগণের মাযহাব আখ্যা দেবেন। অন্যজনের দৃষ্টিতে হাদীসটি সহীহ না হওয়ায় তিনি বলবেন, না, এটা ইমামগণের মাযহাব নয়। কারণ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, অনেক হাদীসের সহীহ হওয়া না হওয়া নিয়ে হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। এমনিভাবে একজন বললেন, এ সহীহ হাদীসই ইমামগণের মাযহাব। আরেকজন বলবেন, আরে এ হাদীসের বিশুদ্ধতা তো ইমামগণের জানা ছিল। তারা তো এটাকে মানসুখ বা রহিত বলে বিশ্বাস করতেন। তাই এটা তাদের মাযহাব নয়। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের অবস্থা হবে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
একথাগুলো যে শুধু কল্পনাপ্রসূত ও যুক্তিনির্ভর তা নয়, অতীতে বাস্তবেই এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাও আবার এমন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা, যারা নিজ নিজ যুগের শীর্ষ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন। কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো :
১. ইবনে আবুল জারুদ: যিনি ইমাম শাফেয়ীর শিষ্য ছিলেন: ও বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকীহ আবুল ওয়ালীদ নিশাপুরী দুজনই একটি সহীহ হাদীস পেয়ে দাবী করলেন, এটাই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। কিন্তু হাফেজ ইবনুস সালহ ও ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী এসে বললেন, এই হাদীস যে সহীহ, ইমাম শাফেয়ী তা জানতেন। কিন্তু তিনি এটাকে মানসুখ বা রহিত মনে করতেন বিধায় এর উপর আমল করেন নি। সুতরাং এটা তার মাযহাব হতে পারে না। (দ্র. আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী, ১/১১৮; আছারুল হাদীস আশ শরীফ, পৃ. ৬৮)
২. ইমাম আবু মুহাম্মদ আল জুআয়নী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। ইমাম বায়হাকীর সমসাময়িক ও মুজতাহিদ পর্যায়ের ফকীহ আলেম। তিনি একটি কিতাব প্রকাশ করতে চাইলেন, যেখানে ইমাম শাফেয়ীর ঐ কথার সূত্র ধরে তাঁর জানামতে অনেক সহীহ হাদীস একত্রিত করলেন এবং দাবী করলেন, এগুলোই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। কিন্তু ইমাম বায়হাকীসহ অনেকে তার দাবী খ-ন করে প্রমাণ করেছেন, তিনি যেসব হাদীসকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে অনেকগুলোই এমন রয়েছে যা সহীহ নয়। (দ্র. যাহাবী কৃত, মানাকিবু আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহি’র টীকা, পৃ. ৬৩-৬৪)
৩. আবুল হাসান কারাজী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী বড় ফকীহ ও মুহাদ্দিস। তিনি একটি হাদীসকে সহীহ ভেবে দাবী করলেন, এটাই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকীও বেশ কিছুদিন তার কথামত আমল করেছেন। পরে ইমাম সুবকীর ভুল ভাঙল। তিনি আবার পূর্বের আমলের দিকে ফিরে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত পূর্বের আমলের উপরই বহাল ছিলেন। (দ্র. আছারুল হাদীস, পৃ. ৬৮)
৪. আবু শামা আল মাকদিসী ছিলেন ইমাম নববীর উস্তাদ ও শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী একজন মুজতাহিদ আলেম। তিনি বুখারী শরীফের একটি হাদীস পেয়ে দাবী করলেন, এটাই ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব। কিন্তু ইমাম নববী ও তাকিউদ্দীন সুবকী তার দাবী নাকচ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, ইমাম নববী ইমাম শাফেয়ীর মতের পক্ষে বুখারী শরীফেরই অন্য একটি হাদীস ও মুসলিম শরীফের একটি হাদীস পেশ করলেন। (দ্র. আছারুল হাদীস, পৃ. ৭১, ৭২)
লক্ষ করুন, এত বড় বড় বিদ্যাসাগর ও শীর্ষ মুহাদ্দিসগণ যেখানে হোঁচট খেয়েছেন, সেখানে বর্তমানের লোকদের উপর কতটুকু ভরসা রাখা যায়! পূর্ববর্তীদের জ্ঞানভাণ্ডার তো বর্তমানকালের লোকদের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি সমৃদ্ধ ছিল।
যাই হোক, আলোচনা চলছিল ইমামগণের ঐ উক্তিটি নিয়ে। আমাদের দেশেও কিছু কিছু মানুষ এটাকে হাতিয়ার বানিয়েছে মানুষকে ধোঁকায় ফেলার। তাদের ধোঁকার জাল ছিন্ন করাও ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ রচনার একটি উদ্দেশ্য। যে কয়টি মাসআলার ক্ষেত্রে ইমামগণের ঐ উক্তি টেনে আনা হয় এবং মানুষকে ভুল বোঝানো হয়, তার প্রায় সবকটিই এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে, প্রতিটি মাসআলাই কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা ও সালাফে সালিহীনের আমল দ্বারা সমৃদ্ধ ও সুসংহত। আল হামদু লিল্লাহ, এপ্রিল ২০১১ তে প্রকাশ পেয়ে এটি অল্পদিনের মধ্যেই পাঠকমহলে আশাতীত সাড়া জাগাতে পেরেছে। ইতিমধ্যে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, কানাডা ও ব্রিটেন পর্যন্ত অনেকের হাতেই এটি পৌঁছে গেছে। অনেকে টেলিফোন করে শুকরিয়াও জানিয়েছেন। বিদেশ থেকে কেউ কেউ ফোন করে বলেছেন, উৎসর্গটি পড়ে তারা কেঁদেছেন এবং মরহুম আব্বার জন্য দোয়াও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এটি ছাপার আয়োজন চলছে।
ভূমিকায় বলেছিলাম, দোস্ত বাকি তো মোলাকাত ভী বাকি: বন্ধু থাকলে সাক্ষাৎও ঘটতে থাকবে। এর মধ্যে দু’একজন বন্ধু এগিয়ে এসেছেন। তাই আমাকেও একটু অগ্রসর হতে হলো। আর তাই এত বড় কলেবরের লেখা। এটি স্বতন্ত্র কোন পুস্তক নয়। দলিলসহ নামাযের মাসায়েল এরই বর্ধিত রূপ মাত্র। এতে একাধিক মাসআলায় কিছু দলিলপ্রমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমাদের দলিলগুলো সম্পর্কে করা আপত্তি-অভিযোগেরও জবাব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্ধুদের দলিল-প্রমাণের কিছু খবর নেওয়া হয়েছে। তাদের কিছু জালিয়াতিরও চিত্র এতে উঠে এসেছে।
দলিলসহ নামাযের মাসায়েল দ্বিতীয়বার নজর দিয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। কিছু নতুন টীকা যোগ করা হয়েছে এবং পূর্বের টীকাগুলোতে কিছু কিছু তথ্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরামর্শক্রমে এটির নাম রাখা হয়েছে দলিলসহ নামাযের মাসায়েল বর্ধিত সংস্করণ। এটির সংক্ষিপ্ত রূপটি এখন থেকে দলিলসহ নামাযের মাসায়েলরূপে প্রকাশিত হবে।
এবারের লেখাটির বিশেষ গুণ-বৈশিষ্ট্য হলো, হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক সাহেব এটি আগাগোড়া দেখে দিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় ও উপকারী অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা তার পরামর্শগুলো কাজে লাগিয়েছি। অনেকস্থানে তিনি সংশোধনীও দিয়েছেন। এর জন্য তার মূল্যবান ও ব্যস্ত সময়ের অনেকটা ব্যয় হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে যথাযোগ্য ও আরো বেশী জাযা দিন।
প্রুফ সংশোধনের কিছু কিছু খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন মাওলানা আব্দুল হাকীম ও এ বছরের তাকমীল জামাতের ছাত্র মারূফ, রাওয়াহা ও মুরশিদ। কম্পিউটার কম্পোজে মাওলানা শিব্বীর আহমদের অসীম ধৈর্য, ঐকান্তিক ও নিরলস চেষ্টা না হলে এটি এত সহজে আলোর মুখ দেখত না। আল্লাহ তায়ালা সকলকে উত্তম বিনিময় দান করুন। মাকতাবাতুল আযহারের স্বত্বাধিকারী মাওলানা ওবায়দুল্লাহ এর প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ না করলে আমাদের জন্য অগ্রসর হওয়া কঠিন হতো। আল্লাহ তাকেও উত্তম জাযা দিন।
বিশেষ জ্ঞাতব্য :
ক. বানান প্রসঙ্গে। আমাদের ও বন্ধুদের বানান ও প্রতিবর্ণায়ন রীতি এক নয়। ফলে একই শব্দ আমাদের ও তাদের ব্যবহারে দু’রকম এসেছে। পাঠককে এটা মনে রাখতে হবে। আবার কিছু শব্দের প্রতিবর্ণায়ন দুভাবেই হতে পারে। এমন শব্দের ক্ষেত্রে আমাদের থেকেও দু’রকম প্রতিবর্ণায়ন ঘটে গেছে। বিভিন্ন সময় লেখার কারণেও এমনটি ঘটেছে।
খ. বরাত উল্লেখ প্রসঙ্গে। অভিজ্ঞ পাঠকমাত্রই জানেন যে, কিছু কিছু হাদীস গ্রন্থের হাদীসনম্বর বিভিন্ন সংস্করণে বিভিন্নরকম এসেছে। সাধারণত আমরা সরাসরি হাদীসগ্রন্থ দেখেই নম্বর উল্লেখ করেছি। কিন্তু কোথাও কোথাও কম্পিউটারে রক্ষিত ‘শামেলা ৬০০০’ থেকেও কিছু নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। কোন এক নম্বরে হাদীসটি খুঁজে না পেলে হতাশ না হয়ে অন্য সংস্করণের নম্বরে খুঁজে দেখতে পাঠকের প্রতি অনুরোধ রইল।