জালিয়াতি কেন?

যাহোক, এতটুকু তো ছিল ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু এর পরে তারা হাফেজ ইবনে হাজার র. এর বক্তব্য হিসেবে একথা লিখেছেন, আবুল হাসানা কর্তৃক বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যাত. এটা নিঃসন্দেহে জালিয়াতি। হাফেজ ইবনে হাজার একথা বলেননি।

আমাদের আলোচ্য আবুল হাসনাকে মাসতূর বলা যেতে পারে। অর্থাৎ যার একাধিক বর্ণনাকারী ছাত্র আছে, কিন্তু তার ব্যাপারে কারো পক্ষ থেকে সুনাম বর্ণিত হয়নি। মাসতূরের বর্ণনা অনেকেই নিঃশর্তে গ্রহণ করেছেন। এর জন্য ‘আর রাফউ ওয়াত তাকমীলে’র পরিশিষ্ট দেখা যেতে পারে। কেউ কেউ শর্ত আরোপ করেছেন সমর্থক বর্ণনাকারীর। অর্থাৎ তার সমর্থনে যদি অন্য কোন ব্যক্তির বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে। এখানে তাও পাওয়া যাচ্ছে। আবুল হাসনার মতো আবূ আব্দুর রহমান সুলামীও হযরত আলী রা. থেকে একই কথা উল্লেখ করেছেন। এ মূলনীতিটি ‘শারহুন নুখবা’য়ও বিধৃত হয়েছে। হযরত আলী রা. যে বিশ রাকাত তারাবী শিক্ষা দিয়েছেন, তা এ থেকেও স্পষ্ট হয় যে, তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র শুতাইর ইবনে শাকাল, আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বাকরা, সাঈদ ইবনে আবূল হাসান, সুয়াইদ ইবনে গাফালা ও আলী ইবনে রাবীআ প্রমুখ বিশ রাকাত তারাবী পড়াতেন ও পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, সুনানে বায়হাকী, ২/৪৯৮; কিয়ামুল লাইল লি ইবনে নাসর, পৃ২০০-২০২)।

বিভিন্ন শহরে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের আমল:

ক. মক্কা শরীফের আমল:

সাহাবা ও তাবেয়ীনের যুগে মদীনা শরীফে যেমন বিশ রাকাত তারাবী পড়া হতো, মক্কা শরীফেও তেমনি বিশ রাকাতই পড়া হতো। আতা ইবনে আবূ রাবাহ (টীকা-১)(মৃত্যু ১১৪ হি)- যিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন এবং বহু সংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাৎলাভে ধন্য ছিলেন, মক্কা শরীফেই তার নিবাস ছিল- বলেছেন,

أدركت الناس وهم يصلون ثلاثا وعشرين ركعة بالوتر

অর্থাৎ আমি লোকদেরকে ( সাহাবা ও প্রথম সারির তাবেয়ীদেরকে) পেয়েছি তারা বেতের সহ ২৩ রাকাত পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৭০।)

এমনি ভাবে ইবনে আবী মুলাইকা র. (টীকা-২) মক্কার অধিবাসী ছিলেন। তিনি সেখানকার কাজি (বিচারক ) ও মুয়াজ্জিন ছিলেন। ১১৭ হি. সনে তার ওফাত হয়। তার সম্পর্কে নাফে’ ইবনে উমর বলেন,

كان يصلي بنا في رمضان عشرين ركعة

অর্থাৎ আমাদেরকে নিয়ে তিনি বিশ রাকাত পড়তেন।

ইমাম শাফেয়ী র.ও মক্কার অধিবাসী ছিলেন। ২০২ হি. সালে তাঁর ওফাত হয়। তিনি বলেছেন, هكذا أدركت ببلدنا بمكة يصلون عشرين অর্থাৎ অনুরূপ ভাবে

আমি আমাদের শহর মক্কা শরীফে পেয়েছি,তারা বিশ রাকাত নামায পড়তেন। (তিরমিযী শরীফ)

ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব

ইমাম শাফেয়ী র.ও যেহেতু বিশ রাকাত তারাবীকে অবলম্বন করেছেন (টীকা-৩) , তাই তাঁর অনুসারীরা মক্কা ও অন্যান্য স্থানে বিশ রাকাতের উপরই আমল করতেন। মক্কার হারাম শরীফে চালু হওয়া এ আমল আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

মদীনা শরীফের আমল

সাহাবী যুগের শেষ দিকে মদীনাবাসীগণ যখন দেখলেন মক্কাবাসীগণ বিশ রাকাত তারাবী পড়েন বটে, কিন্তু তারা প্রত্যেক তারবীহার (বিশ্রামের জন্য বিরতি) সময় তওয়াফ করে অতিরিক্ত ফায়দা লাভ করছেন তখন থেকে তারা সেখানে প্রত্যেক তারবীহার সময় চার রাকাত বাড়িয়ে পড়তে লাগলেন। এভাবে সেখানে ২০+১৬=৩৬ রাকাত পড়ার প্রচলন হতে থাকে। কেউ আরো দু’রাকাত যোগ করে ৩৮ রাকাত পড়তে থাকেন। এভাবে তিন রাকাত বেতেরসহ তাদের ৩৯ বা ৪১ রাকাত হতো।

ইমাম মালেক র. মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ১৭৯ হি. সনে তার ওফাত হয়। তিনি বলেছেন, হাররার ঘটনার (যা ৬৩ হি সনে ঘটেছিল) পূর্ব থেকে একশো বছরের অধিক সময় জুড়ে মদীনা শরীফে ৩৮ রাকাত তারাবী পড়া হতে থাকে। সালেহ মাওলাত তাওয়ামা র. (তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন) এর বর্ণনাও অনুরূপ।

মুআয আবূ হালীমা রা. সাহাবী ছিলেন এবং তিনি হাররার ঘটনায় শহীদ হয়েছিলেন। তার সম্পর্কে ইবনে সীরীন র. সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ৪১ রাকাত তারাবী পড়াতেন। এ তিনটি বর্ণনা ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থেও বিধৃত হয়েছে। (দ্র, ২খ, ৭২পৃ)

নাফে র. ছিলেন হযরত ইবনে উমর রা. এর আযাদকৃত দাস। হযরত আয়েশা রা., আবূ হুরায়রা রা. ও আবূ রাফে রা. প্রমুখেরও ছাত্র ছিলেন তিনি। ১১৭ হি সনে তাঁর ওফাত হয়। তাঁর বর্ণনা হলো, আমি লোকদেরকে ৩৬ রাকাত তারাবী ও তিন রাকাত বেতের পড়তে দেখেছি ও পেয়েছি। (দ্র, প্রাগুক্ত, ২/৭৩)

দাউদ ইবনে কায়স র. বলেন, আমি হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয র. (মৃত্যু ১০১হি) ও আবান ইবনে উসমান র. (মৃত্যু ১০৫ হি, ইনি হযরত উসমান রা. এর ছেলে ছিলেন) এর আমলে মদীনাবাসীকে ৩৬ রাকাত পড়তে দেখেছি। (দ্র, কিয়ামুল লায়ল, পৃ ৯১)।

তিনি এও বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয র. হাফেজদেরকে ৩৬ রাকাত পড়াতে হুকুম দিতেন। (প্রাগুক্ত, পৃ ৯০)

ইমাম মালেকের মাযহাব

ইমাম মালেক র. এর এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। ২০ রাকাত ও ৩৬ রাকাত । মদীনা মিশর স্পেনসহ বিভিন্ন শহরে তার অনুসারীরা ২০ বা ৩৬ রাকাত তারাবী পড়তে থাকেন। ইমাম শাফেঈর ওফাত হয় ২০২ হি. সনে। তাঁর দুজন ছাত্র মুযানী ও যাআফরানী তাঁর এ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন যে, ورأيتهم يقومون بالمدينة بتسع وثلاثين وبمكة بثلاث وعشرين অর্থাৎ আমি মদীনাবাসীকে বেতেরসহ ৩৯ রাকাত ও মক্কাবাসীকে ২৩ রাকাত পড়তে দেখেছি। (দ্র. মুখতাসারুল মুযানী ও ফাতহুল বারী) বোঝা গেল, তাঁর যুগে মদীনায় ৩৬ রাকাত তারাবী পড়া হতো। এমনিভাবে ইমাম তিরমিযী (মৃত্যু ২৭৯ হি) এর যুগেও মদীনায় ৩৬ রাকাতই পড়া হতো। (দ্র, তিরমিযী শরীফ)

শায়খ আতিয়া সালেম লেখেন,

مضت المأة الثانية والتراويح ست وثلاثون وثلاث وتر ودخلت المأة الثالثة وكان المظنون أن تظل على ما هي عليه تسع وثلاثون بما فيه الوتر

অর্থাৎ মদীনায় ২য় হিজরী শতকে তারাবী ৩৬ রাকাত ও বেতের তিন রাকাত পড়া হতো। তৃতীয় শতকেও তাই হয়ে থাকবে। (আততারাবী আকছার মিন আলফি আম, পৃ ৪১)

হিজরী ৪র্থ শতকে মদীনার এ আমল পরিবর্তিত হয়ে বিশ রাকাতে এসে পৌঁছেছে। শায়খ আতিয়া লেখেন,

عادت التراويح في تلك الفترة كلها إلى عشرين ركعة فقط بدلا من ست وثلاثين في السابق

অর্থাৎ এ সময়ে পূর্বের ৩৬ রাকাতের পরিবর্তে তারাবী বিশ রাকাতে ফিরে আসে। (প্রাগুক্ত পৃ, ৪২)

তখন থেকে আজ পর্যন্ত মদীনার মসজিদে নববীতে ২০ তারাবী অব্যাহত রয়েছে। এ পরিবর্তনের কারণ এ হতে পারে যে, ইমাম মালেক রহ.এর দৃষ্টিতেও তারাবী মূলত ২০ রাকাতই সুন্নত। কিন্তু যেহেতু মক্কাবাসীদের প্রত্যেক তারবীহায় (চার রাকাত পরবর্তী বিশ্রামের সময়) একটি করে তওয়াফ করার সুযোগ গ্রহণের কারণে মদীনাবাসীরাও চার রাকাত করে পড়ার নিয়ম চালু করে এবং দীর্ঘকাল যাবৎ উক্ত নিয়ম চালু থাকে। তাই তিনি তা ভাঙতে চাননি। ইবনে রুশদ তার বিদায়াতুল মুজতাহিদ গ্রন্থে লিখেছেন, وذكر ابن القاسم عن مالك أنه كان يستحسن ستا وثلاثين ركعة والوثر ثلاث ইবনুল কাসিম (ইমাম মালেকের বিশিষ্ট ছাত্র ও তার ফিকহের প্রথম সংকলক) ইমাম মালেক সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ৩৬ রাকাত তারাবী ও তিন রাকাত বেতের পছন্দ করতেন।

ইবনুল কাসেম রহ. আরো বলেছেন যে, আমি নিজেই ইমাম মালেককে বলতে শুনেছি যে, (খলীফা) জাফর ইবনে সুলায়মান আমার নিকট লোক মারফত জানতে চেয়েছিলেন যে, তারাবীর রাকাত-সংখ্যা কমিয়ে দেব কি না? আমি তাকে নিষেধ করলাম। মালেক রহ.কে পরে জিজ্ঞেস করা হলো: রাকাত সংখ্যা কমানো কি মাকরুহ বা অপছন্দনীয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কারণ দীর্ঘকাল যাবৎ মানুষ এভাবে তারাবী পড়ে আসছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, তারাবী কত রাকাত? বললেন, বেতেরসহ ৩৯ রাকাত। (দ্র. কিয়ামুল লাইল, পৃ. ৯২)

ইমাম মালেক রহ. যে মূলত ২০ রাকাত তারাবীকেই সুন্নত মনে করতেন তার ইংগিত তাঁর মুয়াত্তা থেকেও পাওয়া যায়। কারণ তিনি ১১ রাকাতের বর্ণনা উল্লেখ করার পর ২০ রাকাতের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। তেমনি মালেকী ফিকহের অনেক কিতাবেই ২০ রাকাতকেই তাঁর মাযহাব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আল আনওয়ারুস সাতি’আহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, وتتأكد صلاة التراويح في رمضان وهي عشرون ركعة بعد صلاة العشاءঅর্থাৎ রমযান মাসে তারাবীর নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এই নামায এশার পর বিশ রাকাত। (দ্র. আওজাযুল মাসালিক, ১/৩৯৭) এমনিভাবে আহমাদ আদ দারদের ‘আশ শারহুল কাবীরে’ (১/৩১৫) বলেছেন, وهي ثلاث وعشرون ركعة بالشفع والوتر كما كان عليه عمل الصحابة والتابعين ثم جعلت في زمن عمر بن عبد العزيز ستا وثلاثين بغير الشفع والوتر لكن الذي جرى عليه العمل سلفا وخلفا هو الأول অর্থাৎ তারাবী ২৩ রাকাত, বেতের তিন রাকাতসহ। সাহাবী ও তাবেঈগণের আমল এমনই ছিল। পরবর্তীকালে উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. এর যুগে পরের তিন রাকাত ছাড়াই ৩৬ রাকাত নির্ধারণ করা হয়। তবে সালাফ ও খালাফ, পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিদের আমল ছিল প্রথমটিই (অর্থাৎ বিশ রাকাত)।

আবু যায়দ কায়রাওয়ানীও তার আছ ছামারুদ দানী গ্রন্থে ২০ রাকাতের কথাই উল্লেখ করেছেন।

ইমাম মালেকের সরাসরি ছাত্র ও তার মাযহাবের সংকলকদের এসব স্পষ্ট উদ্ধৃতি ও বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে যারা বলবেন, তাঁর মত ছিল ১১ রাকাত, তাদের বিবেকের উপর ক্রন্দন করা ছাড়া করার কিছুই নেই।

উল্লেখ্য, আলবানী ও মোবারকপুরী দুজনই ইমাম মালেক র. এর এগারো রাকাতের একটি মতও উল্লেখ করেছেন। এ মতটি ভুয়া । ইমাম মালেকের কোন ছাত্র বা তাঁর মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কোন গ্রন্থে এ মতটি বর্ণিত হয়নি। জূরী নামক শাফেয়ী মাযহাবের জনৈক ব্যক্তি এ মতটির কথা উল্লেখ করেছেন। এই ব্যক্তির জন্ম ইমাম মালেকের কয়েকশ বছর পরে। (টীকা-৪)

খ. কূফাবাসীর আমল:

কূফাবাসীর আমলও মক্কা ও মদীনাবাসী সাহাবী ও তাবেয়ীগণের আমল থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। কূফা ছিল হযরত আলী রা. এর দারুল খেলাফত বা রাজধানী। তিনিই তো বিশ রাকাত পড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কূফায় বসবাস করতেন। তিনিও বিশ রাকাত পড়তেন। (কিয়ামুল লাইল, পৃ, ৯১)

আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ র. ছিলেন শীর্ষ তাবেয়ী। হযরত উমর, ইবনে মাসউদ ও হুযায়ফা রা. প্রমুখ বড় বড় সাহাবীগণের সাহচর্য লাভে তিনি ধন্য হয়েছিলেন। ৭৫ হি সনে তার ওফাত হয়। তিনি চল্লিশ রাকাত তারাবী পড়তেন। সুয়াইদ ইবনে গাফালা ছিলেন হযরত আলী ও ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখের শীর্ষ ছাত্র । তিনি বিশ রাকাত পড়াতেন। বায়হাকী, ২/৪৯৬। হযরত আলী রা. এর শিষ্য হারেছ (টীকা-৫) ও বিশ রাকাত পড়াতেন। আলী ইবনে রাবীআ ছিলেন হযরত আলী ও সালমান ফারসী রা. এর সাহচর্য ধন্য (টীকা-৬) । তিনিও বিশ রাকাত পড়াতেন । সাঈদ ইবনে জুবায়ের ছিলেন হযরত ইবনে আব্বাস রা. সহ বহু সাহাবীর শিষ্য। তিনিও বিশ রাকাতের বেশী তারাবী পড়তেন। ৯৫ হি সনে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সুফিয়ান ছাওরী (মৃত্যু ১৬১ হিজরী) ছিলেন কূফার বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ, সিহাহ সিত্তায় তার সূত্রে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বুখারী র. এর উস্তাদের উস্তাদ ছিলেন। তিনিও বিশ রাকাত তারাবীর পক্ষে। ইমাম আবূ হানীফা (মৃত্যু ১৫০ হি) বিশ রাকাত তারাবীকে সুন্নত বলার পর তার অনুসারীরা কূফা ও অন্যান্য শহরে বিশ রাকাতই তারাবী পড়তে থাকেন। বৃটিশ আমলে এই আহলে হাদীস ফেরকার উদ্ভবের পূর্বে উপমহাদেশের সর্বত্র বিশ রাকাত তারাবীই পড়া হতো।

ইমাম আবু হানীফার মাযহাব

উল্লেখ্য যে, ইমাম আবু হানীফার এ মতটি হানাফী ফিকহের সকল কিতাবেই বিদ্যমান আছে। তার সরাসরি ছাত্র হাসান ইবনে যিয়াদের বর্ণনায়ও এটি উদ্ধৃত হয়েছে। হাসান ইবনে যিয়াদ বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেছেন,

إنها سنة يصلون في مسجدهم خمس ترويحات ويؤمهم رجل ويسلم في كل ركعتين

অর্থাৎ তারাবী পড়া সুন্নত। নিজেদের মসজিদে বিশ রাকাত পড়বে। পুরুষ ইমামতি করবে। প্রতি দুরাকাতে সালাম ফিরাবে। (দ্র. খুলাসাতুল ফাতাওয়া, ১/৬৩) এছাড়া ইমাম তাহাবী ও তার ইখতিলাফুল আইম্মাহ গ্রন্থে বলেছেন, قال أصحابنا والشافعي يقومون بعشرين ركعة سوى الوتر وقال مالك بتسع وثلاثين ركعة بالوتر অর্থাৎ আমাদের ইমামগণ ও শাফেঈ বলেছেন, বেতের ব্যতীত বিশ রাকাত। আর মালেক বলেছেন, বেতেরসহ উনচল্লিশ রাকাত। (মুখতাসার, নং ২৭১)

গ.বসরা বাসীর আমল:

সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগে ইরাকের বসরা নগরী ইলম ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী ছিল। সেখানেও কেউ বিশ রাকাতের কম তারাবী পড়তেন না। আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বাকরা, সাঈদ ইবনে আবুল হাসান ও ইমরান আবদী ৮৩ হিজরীর পূর্বে বসরার জামে মসজিদে বিশ রাকাত তারাবী পড়াতেন। (কিয়ামুল লাইল, পৃ ৯২)

যুরারা ইবনে আবূ আওফা (মৃত্যু ৯৩ হি) শীর্ষ তাবেয়ী ছিলেন। তিনিও বিশ রাকাতের বেশী তারাবী পড়াতেন। (প্রাগুক্ত)

ঘ. বাগদাদ বাসীর আমল:

ইমাম আহমাদের মাযহাব

বাগদাদে ইমাম আহমাদ র. (মৃত্যু ২৪১ হি) বিশ রাকাত তারাবীকে সুন্নত বলেছেন। (টীকা-৭) ফলে তার অনুসারীরা বাগদাদ ও অন্যান্য শহরে বিশ রাকাত তারাবী আদায় করতেন। হাম্বলী মাযহাবের সকল কিতাবে বিশ রাকাত তারাবীকে সুন্নত বলা হয়েছে। দাউদ জাহিরীও ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী। তিনিও ছিলেন বিশ রাকাত তারাবীর পক্ষে।

এমনিভাবে মার্ভের অধিবাসী আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক র. (মৃত্যু ১৮১ হি) বিশ রাকাত কে অবলম্বন করেছেন। ইসহাক ইবনে রাহাওয়ায়হ র. ৪১ রাকাতকে অবলম্বন করেছেন।

হাফেজ ইবনে তায়মিয়ার মত :

ইবনে তায়মিয়া র. এর মতেও বর্তমানে ২০ রাকাত পড়াই উত্তম। তিনি বলেছেন,

والأفضل يختلف بإختلاف أحوال المصلين فإن كان فيهم إحتمال لطول القيام فالقيام بعشر ركعات وثلاث بعدها كما كان النبى يصلى لنفسه فى رمضان وغيره هو الأفضل وإن كانوا لا يحتملونه فالقيام بعشرين هو الأفضل وهو الذى يعمل به أكثر المسلمين فإنه وسط بين العشر وبين الأربعين وإن قام بأربعين وغيرها جاز ذلك ولا يكره شىء من ذلك

অর্থাৎ তারাবী কত রাকাত পড়া উত্তম তা নির্ভর করবে মুসল্লীদের ধৈর্য্য-শৈর্যৈর উপর। তারা যদি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়, তবে ১০ রাকাত ও পরে তিন রাকাত পড়া - যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ও গায়রে রমযানে নিজের জন্য অবলম্বন করেছিলেন- উত্তম হবে। আর যদি তারা এর সামর্থ না রাখে তবে বিশ রাকাত পড়াই উত্তম হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এ অনুযায়ীই আমল করে আসছে। কারণ এটা ১০ ও ৪০ এর মাঝামাঝি। যদি কেউ ৪০ রাকাত বা তার কমবেশি পড়তে চায় তবে সেটাও জায়েয। এর কোনটাই মাকরূহ বা অপছন্দনীয় নয়। মাজমূউল ফাতাওয়া, ২২/২৭২।

বর্তমানে মানুষের শক্তি ও সামর্থের কথা সকলের জানা । তাই ইবনে তায়মিয়ার মতেও বর্তমানে বিশ রাকাত পড়াই উত্তম। আরেকটি কথাও তিনি স্পষ্ট করেছেন, চল্লিশ বা অন্য যে কোন সংখ্যায় তারাবী পড়া হোক না কেন, তা মাকরূহ হবে না, বরং জায়েযই হবে। অথচ আলবানী সাহেব বলেছেন, জোহরের পূর্বের চার রাকাত সুন্নত পাঁচ রাকাত পড়া যেমন, এগারো রাকাতের বেশী তারাবী পড়াও ঠিক তেমন।এমন দুঃসাহসিক কথা আলবানী ছাড়া কে বলতে পারবে? আমাদের জানামতো সমগ্র পৃথিবীর আলেমদের কেউই এমন কথা বলেননি।

এমনকি লা-মাযহাবী আলেমদের মুরুব্বী মাওলানা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানও স্পষ্ট বলেছেন, বিশ রাকাতের ভেতর যেহেতু এগারো রাকাতও অন্তর্ভূক্ত, তাই বিশ রাকাত আদায়কারীও সুন্নত অনুযায়ী আমলকারী বলে বিবেচিত হবে। (দ্র, ‘আল ইন্তিকাদ’ুর রাজীহ, পৃ ১৩৮)

Top