বিতর সালাত: পরিশিষ্ট (দ্বিতীয় অংশ)

পর্যালোচনা

(ক) বর্ণনাটি মওকুফ তথা সাহাবীর কথা

প্রথমত বর্ণনাটিকে গ্রন্থকার ‘মারফু’ তথা নবীজীর কথারূপে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম ইবনু আব্দিল বার বলেন: ইমাম নাসায়ী (রহ) বর্ণনাটি ‘মওকুফ’ তথা সাহাবীর বক্তব্য হওয়াকে বিশুদ্ধ মনে করেন (আততামহীদ ১৩/২১৯)। ইমাম দারা কুতনীও ‘মওকুফ’ হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [দেখুন-কিতাবুল ইলাল, দারাকুতনী হা.১০০৫ সুনানে দারাকুতনী হা.১৬৩০ মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার হা.১৩৯৪]

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) বলেন: ইমাম আবু-হাতেম, যুহলী, দারাকুতনী, বাইহাকী এবং আরো একাধিক ইমাম এটিকে মওকুফ বলেছেন। আর এটিই সঠিক। [আত-তালখীছুল হাবীর ২/৩৬-৩৭]

(খ) হাদীসের অংশবিশেষ গোপন করা

এ হাদীসেরই একটি অতিরিক্ত অংশ বিশুদ্ধ সনদে সুনানে নাসায়ী (হা.১৭১৩) তে রয়েছে। যার শব্দটি হল :(وَمَنْ شَاءَ أَوْتَرَ بِوَاحِدَةٍ وَمَنْ شَاءَ أَوْمَأَ إِيمَاءً ،...) অর্থ: ‘...আর যার ইচ্ছা এক রাকাত পড়ে নেবে, আর যার ইচ্ছা একটি ইশারা করে নেবে’। [মুছান্নাফে আব্দির রাযযাক হা.৪৬৩৩ আস-সুনানুল কুবরা- বাইহাকী ৩/২৪ হা.৪৭৭৯-৪৭৮০ সহীহ ইবনে হিব্বান হা.২৪১১] তাহলে এ বর্ণনার আলোকে বিতর এর নামায ইশারা করে নিলেই আদায় হয়ে যাবে।

গ্রন্থকার হাদীসের শেষ অংশটি উল্লেখ করেননি। আমার যতদূর মনে হয় তিনি ইচ্ছাকরেই এ অংশটুকু এড়িয়ে গেছেন। কেননা তিনি টীকায় বরাত দিয়েছেন “ছহীহু ইবনে হিব্বান হ?২৪১১”। আর ইবনে হিব্বান এ নম্বরে হাদীসটির এ অংশটুকুসহই আছে।

গ্রন্থকার - ৯

গ্রন্থকার ছয় নম্বরে এক রাকাত বিতরের দলিল হিসেবে ইবনে মাসউদ (রা.) এর একটি বর্ণনা এভাবে পেশ করেন: “রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ বিজোড়। তিনি বিজোড়কে পসন্দ করেন। সুতরাং হে কুরআনের অনুসারীরা! তোমরা বিতর পড়”। গ্রন্থকার এখানে বলেন: “হাদীছটিতে সরাসরি আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ এক বিজোড় না তিন বিজোড় না পাঁচ বিজোড় তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?” (পৃ.৩২৮)

পর্যালোচনা

(ক) ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনাও এক রাকাত বিতর এর দলিল নয়

উল্লেখযোগ্য কোন মুহাদ্দিস বা ফকীহ এ হাদীস দিয়ে এক রাকাত বিতর এর পক্ষে দলিল পেশ করেছেন বলে আমার জানা নেই।

হাদীসের বক্তব্য হল:‘আল্লাহ বেজোড়। তিনি বেজোড়কে পসন্দ করেন। (বিতর নামাযও যেহেতু বেজোড়) তাই বিতর নামায আদায় কর/ বিতরকেও বেজোড় করে পড়’। এখানে শুধু বিতর নামায আদায়ের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তাই ইমাম নববীসহ অনেক মুহাদ্দিসই হাদীসটিকে ‘বিতর নামাযে উৎসাহ প্রদান’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। (খুলাছাতুল আহকাম: হা.১৮৫৪)

ইবনুল আছীর নিহায়া গ্রন্থে বলেছেন: “হাদীসে ‘বেজোড় কর’ দ্বারা উদ্দেশ্য বিতর পড়তে আদেশ করা। আর তা হল, ব্যক্তি দুই দ্ইু রাকাত নামায পড়বে। অতঃপর সবশেষে এক রাকাত পৃথক আদায় করবে অথবা পূর্বের রাকাতসমুহের সাথে মিলিয়ে আদায় করবে। এ অর্থেই অন্য হাদীসে রয়েছে : ‘ইসতিঞ্জায় ঢিলা ব্যবহার করার সময়ও তা বিতর করবে’ অর্থাৎ যে ঢিলা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে তা বেজোড় হবে। হয়ত এক বা তিন কিংবা পাঁচ। হাদীসে এ ধরণের শব্দ বারবার এসেছে”। (টীকা-১)

(খ) বর্ণনাকারী সাহাবীগণ হাদীস থেকে এক সংখ্যা বুঝেননি

এ হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আবু হুরায়রা, হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, হযরত আবু সাঈদ খুদরী এবং তাবেঈ মুহাম্মদ ইবনে সীরীন ও আতা ইবনে আবী রাবাহ সকলেই বুঝেছেন: ‘আল্লাহ বেজোড় তাই তিনি বেজোড়কে পসন্দ করতেন’। এর দ্বারা আল্লাহর সাথে তুলনা করে এক সংখ্যা বুঝানো হয়নি। বরং এক তিন পাঁচ সব বেজোড় সংখ্যাই আল্লাহর কাছে প্রিয়।

দেখুন:

১. ইবনে উমর থেকে এ হাদীস বর্ণনা করার পর: নাফে বলেন, ইবনে উমর সব কাজই বেজোড় করতেন। (মুসনাদে আহমদ হা.৫৮৪৬)

২. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) এ হাদীস বর্ণনা করার পর অনেকগুলো বেজোড় বস্তুর সাথে আসমানকেও বেজোড় হিসেবে গুণলেন। অতঃপর বলেন: যে, মিসওয়াক করবে, ইস্তিঞ্জায় ঢেলা ব্যবহার করবে ও যে কুলি করবে তারা যেন বেজোড় করে। (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা.৯০৮৩) বলা বাহুল্য ঢেলা ব্যবহার ও কুলি করার ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে উত্তম হল তিনবার করা। একবার করা নয়।

৩-৪. উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর উপস্থিতিতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা নিজে বেজোড় এবং বেজোড়কে পসন্দ করেন। অতঃপর অনেকগুলো বেজোড় বস্তুর কথা উল্লেখ করেন। যেমন: আসমান ও যমীন সাতটি। সপ্তাহে সাত দিন। সূরা ফাতেহার আয়াত সংখ্যা সাত যাকে কুরআনে বলা হয়েছে: ‘সাবআন মিনাল মাসানী’। সাফা-মারওয়া ও কাবার তাওয়াফ সাত বার। প্রস্তর নিক্ষেপ সাত বার। সিজদা করার হুকুম করেছেন সাত অঙ্গের উপর ইত্যাদি। [দেখুন:আত-তাম্হীদ ২/২১০ হিলয়াতুল আউলিয়া- আবু নূআঈম হা.১১৫৭ জুযউ আবিল আব্বাস ইউনুস ইবনে কুদাইম আল-বাছরী]

৫. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) লাইলাতুল কদর তালাশ করার হুকুম করে বলেন: “ তোমরা একে শেষ দশকের ‘বিতর’ তথা বেজোড় সংখ্যায় তালাশ কর। কেননা আল্লাহ ‘বিতর’ এবং তিনি ‘বিতর’ তথা বেজোড়কে পসন্দ করেন। (মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালীসী হা.১২৮০)

৬. নাফে বলেন: সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) তাওয়াফ সমাপ্ত করতেন বেজোড় সংখ্যায় আর বলতেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা ‘বিতর’ এবং তিনি ‘বিতর’কে পসন্দ করেন। (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা.৯৮০০)

৭. মুহাম্মদ ইবনে সীরীন এ হাদীসের কারণে সব কিছুকেই বেজোড় করে করতেন। এমনকি কোন কিছু খেলেও তা বেজোড় সংখ্যায় খেতেন। (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা.৯৮০১)

৮. এ হাদীসের কারণেই হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ বলেন: তিন আঙ্গুল (অর্থাৎ বেজোড় সংখ্যা) আমার কাছে চার আঙ্গুল (জোড় সংখ্যা) থেকে প্রিয়। (মুছান্নাফে আব্দির রাযযাক: হা.৯৮০৩)

(গ) গ্রন্থকারের উল্লিখিত এ হাদীসটির বর্ণনাকারী হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। আর তিনি এ হাদীস থেকে এক রাকাত বিতর বুঝবেন দূরের কথা তিনি এক রাকাতকে নামাযই মনে করেন না। যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে।

(ঘ) সর্বোপরি হাদীসে এ অংশ বিশেষের ব্যাখ্যা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই করেছেন। তিনি বলেন: আল্লাহর রয়েছে নিরান্নব্বইটি নাম। যে তা আয়ত্ত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ ‘বিতর’ (তথা বেজোড়)। তিনি ‘বিতর’ (তথা বেজোড়কে) পসন্দ করেন। [সহীহ মুসলিম হা.২৬৭৯ বুখারী হা.৬৪১০]

(ঙ) শুধু এক রাকাত বিতর পড়া যদি এ হাদীসের উদ্দেশ্য হত তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করতেন। অথচ শুধু এক রাকাত বিতর পড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বারের জন্যও প্রমাণিত নয়, যা স্পষ্ট বলেছেন ইবনছ ছালাহ রহ.। [আত-তালখীছুল হাবীর ২/৩১] ইবনে হাজার সহীহ ইবনে হিব্বানের যে বর্ণনা দ্বারা আপত্তি করেছেন এটি মুলত একটি বর্ণনার সংক্ষিপ্তরূপ। সহীহ ইবনে হিব্বানে একই হাদীসের বিশদ বর্ণনায় পূর্ণ নামাযের বিবরণ উল্লিখিত রয়েছে। [সহীহ ইবনে হিব্বান, শায়খ শুআইব সম্পাদিত হা. ২৫৯২, ২৬২৬ ও হা. ২৪২৪ এর টীকা]

সুতরাং বিতরের যে পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অধিকাংশ সাহাবী থেকে প্রমাণিত নেই। বরং তাদের আমল এর বিপরীত। সে পদ্ধতিকেই হাদীসের উদ্দিষ্ট অর্থ সাব্যস্ত করা এবং এ দাবী করা যে, এটিই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণিত; এ যে কত সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এক সালাম ও দুই বৈঠকে তিন রাকাতে বিতর

গ্রন্থকার - ১০

গ্রন্থকার ‘তিন রাক‘আত বিতর পড়ার সময় দুই রাক‘আতের পর তাশাহ্হুদ পড়া’ শিরোনামে বলেন: “তিন রাক‘আত বিতর একটানা পড়তে হবে। মাঝখানে কোন বৈঠক করা যাবে না। এটাই সুন্নত। (পৃ.৩৩০)

পর্যালোচনা

দুই তাশাহ্হুদ ও এক সালামে তিন রাকাত বিতর বিষয়ে নবীজী থেকে, সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে সহীহ ও সুস্পষ্ট অনেক দলিল পূর্বে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে।

গ্রন্থকার - ১১

(এক) ইবনে মাসউদ (রা) এর মওকুফ বর্ণনা

গ্রন্থকার তিন রাকাত বিতর এর দলিল পর্যালোচনায় বলেন:“(ক) ইবনে মাসউদ বলেন, মাগরিবের ছালাতের ন্যায় বিতরের ছালাত তিন রাক‘আত।” (পৃ.৩৩০-৩৩১)

পর্যালোচনা : মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে সহীহকে যঈফ সাব্যস্ত করা

(ক) টীকায় গ্রন্থকার শুধু আল-মুজামুল কাবীরের বরাত দিয়েছেন। অথচ হাদীসটি রয়েছে: মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবা (হা.৬৭৭৯) মুয়াত্তা মালেক: মুহাম্মদের বর্ণনা (হা.২৬২) শরহু মা‘আনিল আসার (হা.১৬১৩) আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকী (৩/৩০ হা.৫০০৭)।

(খ) তাহকীকের নামে গ্রন্থকার বলেন:“ ইবনুল জাওযী বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়।”। কিন্তু এ হাদীস সম্পর্কে ইবনুল জাওযীর এ বক্তব্য আমি খুঁজে পাইনি। টীকায় গ্রন্থকার এর যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন: (هذا حديث لا يصح : তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৭) তার রহস্য আমি খুঁজে পেলাম না। কারণ:

১. তানক্বীহ নামে ইবনুল জাওযীর কোন গ্রন্থ নেই।

২. অনেক তালাশ করে গ্রন্থকারের টীকায় উল্লিখিত ‘আপত্তিটি’ ইবনুল জাওযী (রহ.) এর ‘আল ইলালুল মুতানাহিয়া’ কিতাবে পাওয়া গেল। কিন্তু সেখানে তিনি এ মন্তব্যটি ইবনে মাসউদ এর মরফু বা মওকুফ কোন হাদীসের উপরই নয় বরং হযরত আয়শা থেকে বর্ণিত এ ধরণের ভিন্ন একটি ‘মরফু’ বর্ণনা সম্পর্কে করেছেন।

(গ) ইবনে মাসউদ (রা) এর উল্লিখিত বর্ণনাটি সহীহ:

১. নূরুদ্দীন হাইছামী (মৃত.৮০৭) বলেন: (ورجاله رجال الصحيح) :এর সকল বর্ণনাকারীগণ সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারীর মানে উত্তীর্ণ। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ হ.৩৪৫৫)

২. ইমাম বাইহাক্বী বলেন: (هذا صحيح عن عبد الله بن مسعود من قوله): আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর বক্তব্য হিসেবে এটি সহীহ। (আস-সুনানুল কুবরা ৩/৩০) বাইহাকী (রহ.) এ বক্তব্যটি গ্রন্থকারের জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার ইঙ্গিতও করেননি: যার প্রমাণ সামনে পেশ করা হবে।

৩. বিশেষত মুয়াত্তা ও ইবনে আবী শাইবার সকল বর্ণনাকারী বুখারী ও মুসলিমের রাবী। শুধু মালিক ইবনুল হারিস মুসলিমের রাবি। (দেখুন, মুয়াত্তা-ইমাম মুহাম্মদের বর্ণনা, তাহক্বীক:তাক্বী উদ্দীন নদবী হা. ২৬২)।

গ্রন্থকার - ১২

ইবনে উমরের বর্ণনা

গ্রন্থকার দুই নম্বরে বলেন: “(খ) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন, মাগরিবের ছালাত দিনের বিতর ছালাত। তাহক্বীক্ব: অনেকে উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বিতর ছালাত মাগরিব ছালাতের ন্যায় প্রমাণ করতে চান। অথচ তা ত্রুটিপূর্ণ। বর্ণনাটি কখনো মারফু‘ সূত্রে এসেছে, কখনো মাওকুফ সূত্রে এসেছে। তবে এর সনদ যঈফ। মুহাদ্দিস শুআইব আরঊত বলেন, ঐ অংশটুকু ছহীহ নয়।”

পর্যালোচনা

(ক) বিভ্রান্তিপূর্ণ তাহক্বীক

এখানেও তিনি তাহকীকের নামে কি পরিমাণ গোলমাল করেছেন তা পাঠকের সামনে তুলে ধরছি:

(১) গ্রন্থকারের বক্তব্য “অথচ তা ত্রুটিপূর্ণ” : কোন কথাটিকে তিনি ত্রুটিপূর্ণ বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তিনি কি বলতে চাচ্ছেন বর্ণনাটি ত্রুটিপূর্ণ? প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্যই ত্রুটিপূর্ণ!

(২) তিনি বলেছেন: “বর্ণনাটি কখনো মারফু সূত্রে এসেছে, কখনো মাওকুফ সূত্রে এসেছে”

মূলত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর থেকে দুটি বর্ণনা রয়েছে:

(ক) একটি ‘মরফু’ তথা নবীজীর বক্তব্য, আর একটি ‘মওকুফ’ তথা ইবনে উমরের বক্তব্য।

(খ) একটি বর্ণনা করেছেন তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহ.) (মুসনাদে আহমদ ও অন্যান্য) আর অপরটি আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার (মুয়াত্তা মালেক)।

(গ) দুটি বর্ণনার বক্তব্যেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। মরফু বর্ণনা:

عَن مُحَمَّد بْن سِيرِينَ عَن ابْنِ عُمَر عن النبي صلى الله عليه وسلم قَالَ: صَلَاةُ الْمَغْرِبِ وِتْرُ النَّهَارِ، فَأَوْتِرُوا صَلَاةَ اللَّيْلِ .

ইবনে সীরীন রহ. বলেছেন: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মাগরিবের নামায দিনের বিতর। সুতরাং তোমরা রাতের নামাযকেও বিতর করে পড়।

মওকুফ বর্ণনা:

عَن عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يَقُولُ: صَلَاةُ الْمَغْرِبِ وِتْرُ صَلَاةِ النَّهَارِ

: মাগরিবের নামায দিনের নামাযের বিতর।

(ঘ) বর্ণনা দুটিতে কোন বিরোধও নেই বরং আপন আপন স্থানে দুটি বর্ণনাই সঠিক।

সুতরাং দুটিকে এক বর্ণনা বানিয়ে দেয়ার কোন যুক্তি নেই। এ কারণে ইমাম ইবনু আব্দিল বার (মৃ.৪৬৩) দুটি বর্ণনাকেই উল্লেখ করে যথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন। (আল-ইসতিযকার ৫/২৮৩)

(৩) গ্রন্থকার চরম দুঃসাহসিকতার সাথে ‘মরফ’ু ও ‘মওকুফ’ পার্থক্য না করেই বলেন: “তবে এর সনদ যঈফ”! ফলে বুঝা যায় মওকুফ বর্ণণাটিও যঈফ!

(খ) মওকুফ বর্ণনাটি কি যঈফ?

পূর্বেই বলেছি: এখানে দুটি বর্ণনার দুটি ভিন্ন ভিন্ন সনদ। কোন সনদটি যঈফ? কে বলেছেন যঈফ এবং কেন যঈফ? :এর কিছুই গ্রন্থকার বলেননি। এর জন্য কোন বরাতও গ্রন্থকার দেননি। তাহলে কি এটি তার ‘নিজস্ব’ ভিত্তিহীন বক্তব্য! যা অনুসরণ করতে তিনি পাঠককে বাধ্য করতে চান?! কোন ইমাম বা মুহাদ্দিস কি এ মওকুফ বর্ণনাটিকে যঈফ বলেছেন এর প্রমাণ গ্রন্থকার দিতে পারবেন?

দেখুন: গ্রন্থকার যে বর্ণনাটি উল্লেখ করে টীকায় মুয়াত্তা (হা/২৫৪) এর বরাত দিয়েছেন: এটি ইমাম মালেক তাবেয়ী আব্দুলাøহ ইবনে দীনার থেকে। আর তিনি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। এখানে ইমাম মালেক ও সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বাদ দিলে থাকে কেবল: আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার। তিনি বুখারী মুসলিমসহ ছয় কিতাবের রাবি। ইমাম আহমদ, ইবনে মাঈন, আবু-যুরআ, নাসায়ী, (ইবনে হিব্বান, ইজলী,) ইবনে সা‘দ প্রমুখ সকল ইমামই তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। (তাহযীবুল কামাল) ইমাম যাহাবী তাঁকে ইমাম ও হুজ্জাহ উপাধী দিয়েছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা) ইবনে হাজার আসকালানী (তাকরীবে) ও সয়ূতী (ইস‘আফে) তাঁকে সিকাহ বলেছেন। এমন বর্ণনাকারীকে ‘যয়ীফ’ বলার সাধ্য কি গ্রন্থকারের আছে?!

তাহলে এ বর্ণনায় কাকে তিনি যঈফ সাব্যস্ত করছেন: এই আব্দুল্লাহ ইবনে দীনারকে নাকি মালেক বা সাহাবী ইবনে উমরকে?

(গ) মরফু বর্ণনা

আর মারফু বর্ণনা সম্পর্কেও একই কথা, কে একে যঈফ বলেছেন এবং কেন বলেছেন?

ইমাম আহমদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন: ইয়াযীদ ইবনে হারূন-হিশাম ইবনে হাসসান-মুহাম্মদ ইবনে সীরীন সূত্রে ইবনে উমর (রা.) থেকে। এরা প্রত্যেকেই বুখারী ও মুসলিম এর বর্ণনাকারী ও নির্ভরযোগ্য। এদের কাকে গ্রন্থকার যঈফ সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?

মুসনাদে আহমদে বর্ণনাটি একাধিকবার এসেছে। এবং কিতাবের মুহাক্কিক শায়খ শুআইব আরনাউত বলেছেন: এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত এবং বুখারী মুসলিমের ‘রাবী’। (দেখুন:হা.৪৮৪৭, ৪৯৯২) গ্রন্থকার শুআইব আরনাউতের যে মন্তব্য উল্লেখ করেছেন তা বিভ্রান্তিকর। এর আলোচনা সামনে আসছে ইনশাল্লাহ।

বর্ণনাটিকে যারা সহীহ বলেছেন:

১. হাফেজ আলাউদ্দীন মারদীনী (মৃত.৭৫০) বলেন:(وهذا السند على شرط الشيخين) : বর্ণনাটির সনদ বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ। (আল-জাওহারুননাকী ৩/৩১)

২. হাফেজ ইরাকী (মৃত.৮০৪) (আল-মুগনী আন হামলিল আসফার- তাখরীজুল ইহইয়া-২/৬৯)

৩. মুহাদ্দিস যুরকানী (মৃত.১১৬২) ইরাকীর বক্তব্যকে গ্রহণ করেছেন (শারহুয যুরকানী আলাল মুয়াত্তা-ছালাতুননাবী ফিল বিতরি অধ্যায়)

৪. মুহাদ্দিস আহমদ গুমারী (মৃত. ১৩৮০) বলেন: (هذا سند رجاله رجال الصحيح) : এ সনদের সকল বর্ণনাকারী সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মানোত্তীর্ণ। (আল-হিদায়া ফি তাখরীজি আহাদীসিল বিদায়া ৪/১৪২)

৫. আল্লামা আব্দুল হাই লখনবী ইরাকীর বক্তব্যকে গ্রহণ করেছেন। (আত্তা‘লিকুল মুমাজ্জাদ পৃ.১৪৭)

৬. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী (মৃ.১৪২১)। (ছহীহুল জামেইছ ছাগীর হা.১৪৫৬/৩৮৩৪, ৬৭২০)

৭. গ্রন্থকারের মতাদর্শী আহলে হাদীস আলেম আব্দুল্লাহ আল-কাফী একই উদ্দেশ্যে প্রণিত ‘ছহীহ সুন্নাহর আলোকে বিতর ছালাত’ পুস্তকে (পৃ.৩২) বর্ণনাটি উল্লেখ করেন এভাবে: ছহীহ হাদীছে বর্ণিত আছে, ...।

৮.শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন: “এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত এবং বুখারী মুসলিমের ‘রাবী’।” (দেখুন:মুসনাদে আহমদের টীকা হা.৪৮৪৭) অন্যত্র এ বর্ণনার মতন বিষয়ে শায়খের বক্তব্য সামনে আসছে।

এর সমর্থনে আরো দুটি হাদীস

১. হযরত ইবনে উমর রা. এর বর্ণনা

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন: “আমি নবীজীর সাথে সফরে-হজরে নামায পড়েছি। ...মাগরিবের নামায সফরে-হজরে সর্বদাই তিন রাকাত। সফরে-হজরে এতে (রাকাত সংখ্যায়) কোন হ্রাস পায় না। এটি হল দিনের বিতর। এর পর আরো দুই রাকাত আছে।” ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। [সুনানে তিরমিযী হা.৫৫২]

আহলে হাদীস আলেম আব্দুর রহামন মুবারকপূরী হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানীর উদ্ধৃতিতে একে গ্রহণযোগ্য ও হাসান গণ্য করে এর ব্যাখ্যা করেছেন: নবীজীর বক্তব্য : “মাগরিব দিনের বিতর” : এখানে মাগরিবের নামায সরবে কেরাত বিশিষ্ট রাতের নামায হওয়া সত্ত্বেও একে দিনের বিতর বলার কারণ এটি দিনের নিকটবর্তী নামায। (টীকা-২)

[তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৩৭৫, ৩/১২০ ফাতহুলবারী ৪/১২৬] এ বর্ণনাকে গ্রহণ করে ইবনে হাজারের আরো বক্তব্য দেখুন: [ফাতহুল বারী ২/৪৯ ৩/২১]

২. হযরত আয়শা রা. এর বর্ণনা

হযরত আয়শা (রা.) বলেন: “আর মাগরিবের নামায (সফরেও তাতে কসর নেই), কেনানা তা দিনের বিতর”।(عن عائشة قالت : فرضت صلاة السفر والحضر ركعتين فلما أقام رسول الله صلى الله عليه و سلم بالمدينة زيد في صلاة الحضر ركعتان ركعتان وتركت صلاة الفجر لطول القراءة وصلاة المغرب لأنها وتر النهار) [সহীহ ইবনে হিব্বান, হা.২৭৩৮ শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন: এর সনদ হাসান, ফাতহুলবারী ১/৪৬৪]

হাদীস দুটিতে মাগরিবকে দিনের বিতর বলা তখনি সঠিক হবে যখন একথা মেনে নেওয়া হবে যে রাতের নামাযেরও একটি বিতর আছে।

সুতরাং উভয় হাদীস থেকেই একথা বুঝা যায় যে, বিতর নামায হল রাতের বিতর।

গ্রন্থকার - ১৩

(ঘ) গ্রন্থকার শেষে বলেন: “তবে এর সনদ যঈফ। মুহাদ্দিস শুআইব আরনাঊত বলেন, ঐ অংশটুকু ছহীহ নয়।” (পৃ.৩৩০)

পর্যালোচনা

গ্রন্থকার এখানে শায়খ শুআইব -এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে যেয়ে তিনটি সমস্যার সৃষ্টি করেছেন:

১. “তবে এর সনদ যঈফ” কথাটি গ্রন্থকারের নিজস্ব বক্তব্য, কারো থেকে উদ্ধৃত নয়।

২. শায়খ শুআইব এর পূর্ণ বক্তব্য এখানে গ্রন্থকার উল্লেখ করেননি। কেননা পূর্ণ বক্তব্য উল্লেখ করলে আসল তথ্য ফাঁস হয়ে যেত। কারণ শায়খ শুআইব: এর আগে বলেছেন: (صحيح) : অর্থাৎ: ‘এ হাদীসটি সহীহ’। আর এর পরই বলেছেন, (... وهذا الإسناد رجاله ثقات رجال الشيخين غير هارون بن إبراهيم الأهوازي، فمن رجال النسائي، وهو ثقة. ) :‘... এ সনদের সকল বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত ও বুখারী মুসলিমের ‘রাবী’। কেবল হারুন ইবনে ইবরাহীম ব্যতিত। আর তিনিও নাসায়ীর ‘রাবী’ এবং বিশ্বস্ত’। (হা.৫৫৪৯)

৩. শায়খ শুআইব এর এ বক্তব্যটি মূলত আলোচ্য হাদীসের বিষয়ে নয়। বরং ইবনে সীরীন সূত্রে ইবনে উমরের ভিন্ন আরেকটি বর্ণনা সম্পর্কে। ভিন্ন হাদীস। সম্পর্কে তোলা আপত্তিকে এ হাদীসে লাগিয়ে দিয়ে শায়খ শুআইবের তাহকীকের অপব্যবহার করেছেন।

বাকী অংশের জন্যে "বিতর সালাত: পরিশিষ্ট-(তৃতীয় অংশ)" দেখুন!!

Top