আইম্মায়ে কিরামদের অভিমত
আল কিয়া আল হিরাসীর অভিমত: আল কিয়া আল হিরাসী স্বীয় উসূল গ্রন্থে নিয়ামতের শোকরিয়া সংক্রান্ত মাসআলার অধীনে বলেছেন- জেনে রাখুন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমামদের মূলনীতি হল শরয়ী দলিল ব্যতিত কোন আহকাম প্রতিষ্ঠা হয় না। শুধুমাত্র বুদ্ধিভিত্তিক ফয়সালা দ্বারা হুকুম সাব্যস্ত হয় না। অতএব সর্বপ্রথম যারা এ ব্যাপারে আহলে হকের সাথে বিরোধিতা করেছেন তারা হলেন রাফেজী, কারামিয়া ও মুতাজিলা প্রমূখ। তাদের মতে আহকাম কয়েক প্রকার। তার মধ্যে একটি হল, যা শরয়ী দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অন্যটি হল যা বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত।
আল হিরাসী বলেন আমাদের মতে কোন রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত কিছুই ওয়াজিব হয় না। অতএব যখন রাসূল আগমন করে মুজিযা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে চিন্তা গবেষণা করা সম্ভব।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় ‘আল মাহসুল’ গ্রন্থে বলেছেন, যুক্তিভিত্তিক দলিল দ্বারা ‘নিয়ামতের শোকরিয়া’ ওয়াজিব সাব্যস্ত হয় না। তবে এক্ষেত্রে মুতাজিলাদের মতামত আমাদের ব্যতিক্রম। যদি নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয় তাহলে তার অস্বীকারকারীকে এমন কারণে শাস্তি দেওয়া হবে যা আবশ্যক নয়। এখানে মতানৈক্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট। তাকে যে শাস্তি দেয়া হবে না তা আল্লাহর বাণীতেই রয়েছে। وما كنامعذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
উক্ত আয়াতে নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত শাস্তি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তথাপি যদি শাস্তি প্রদান করা হয় তাহলে আল্লাহর কথার মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা দিবে। যা অসম্ভব।
এ অভিমতটি الحاصل والتحصيل গ্রন্থের মুসান্নিফ এবং ইমাম বায়জাভী তাঁর ‘মিনহাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
কাজী তাজ উদ্দিন সুবুকি (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম সুবুকি রাদিয়াল্লাহু আনহু شرح مختصر ابن الحاجب কিতাবে নিয়ামতের শোকরিয়াসংক্রান্ত মাসআলায় বলেছেন- যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই আমাদের মাযহাব অনুযায়ী তারা নাজাতপ্রাপ্ত হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। যদি হত্যা করা হয়, তবে রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে। তবে হত্যাকারীর উপর কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা ওয়াজিব হবে না। ইহাই বিশুদ্ধ মত।
ইমাম বগভী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম বগভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘তাহযিব’ গ্রন্থে বলেছেন যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে এক্ষেত্রে কাফফরা ও রক্তপণ আবশ্যক হবে।
ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মতে এ হত্যার জন্য রক্তপণ আবশ্যক হবে না। কারণ তার আকল তথা বুদ্ধির উপর দলিল প্রয়োগ করা হবে। তবে আমাদের মতে দাওয়াত পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
অতএব প্রমাণিত হল যে, রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত নাই।
এমনিভাবে ইমাম রাফেয়ী বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মত ব্যতিক্রম। তাঁর নিকট এই ব্যতিক্রমের মূল ভিত্তি হল, সে ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের নিকট যার কাছে দাওয়াত পৌঁছে নাই তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
ইমাম গাজ্জালী (রা.) এর অভিমত
============
ইমাম গাজ্জালী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘আল বাসিত’ গ্রন্থে বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তার হত্যার জন্য কাফফারা ও রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যা করা যাবে না ইহাই বিশুদ্ধ মত। কেননা হাকিকী অর্থে সে মুসলিম নয়। শুধুমাত্র অর্থগতভাবে সে মুসলিম। এমনিভাবে ইবনে রিফায়া বলেছেন ‘আল কিফায়া’ গ্রন্থে কেননা সে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে জন্মগ্রহণকারী এবং তার থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি।
ইমাম নবভী (রা.) এর অভিমত
==========
ইমাম নববী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে মুশরিক শিশুদের মাসআলায় বলেছেন- এব্যাপারে মুহাক্কিক উলামাযে কেরামদের সহিহ অভিমত হল মুশরিকদের শিশুগণ জান্নাতী। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করে আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। তিনি বলেন-দাওয়াত না পৌঁছার কারণে যদি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে আযাব না দেওয়া হয় তাহলে অপ্রাপ্ত শিশুদের বেলায়ও আযাব হবে না।
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
==========
ইমাম সুয়ুতি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- তুমি যদি প্রশ্ন কর উল্লেখিত মসলক বা অনুসারীদের যে মতামত আপনি উল্লেখ করেছেন তা কি জাহিলিয়াত যুগের সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য?
জবাবে আমি বলব ‘না’। বরং ইহা শুধুমাত্র তাদের জন্য নির্দিষ্ট যাদের নিকট প্রকৃত পে কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছে নাই। কেননা যার নিকট পূর্ববর্তী কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছেছে, তথাপি সে কুফুরির উপর অটল ছিল সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে, এতে কোন মতবিরোধ নেই।
অতএব রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতার ব্যাপারটি সুস্পষ্ট। উল্লেখিত মসলকটি এ অভিমতই গ্রহণ করেছেন যে, তাদের কাছে কোন দাওয়াত পৌঁছে নাই। আর এর পিছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। যেমন তাদের যুগ ছিল অনেক পরবর্তী যুগ এবং তাদের ও পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যখানে ছিল বিরাট ব্যবধান। যেমন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে সর্বশেষ নবী ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি ও আমাদের নবীর মধ্যখানে ফাতরাতের সময় ছিল প্রায় ছয়শত বছর।
তথাপি নবীজীর পিতা-মাতার যুগ ছিল জাহিলিয়াতের যুগ। পূর্ব পশ্চিম, সমগ্র পৃথিবী জাহিলিয়াতে ঢেকে গিয়েছিল। হাতেগোনা কিছুসংখ্যক আহলে কিতাব পাদ্রী ব্যতিত শরিয়ত সম্বন্ধে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ছিল না। তদুপরি তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। যেমন শ্যাম ও অন্যান্য দেশ। মদিনাশরীফ ছাড়া অন্য কোন দেশে নবীজীর পিতা-মাতা ভ্রমণ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া তারা উভয়ে এমন লম্বা হায়াতও পাননি যাতে করে এ ব্যাপারে অধিক খোঁজখবর করতে পারেন। কেননা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা সামান্য কিছু দিনের হায়াত পেয়েছিলেন।
হাফিজ সালাহউদ্দিন আল আলায়ীর অভিমত
==========
ইমাম হাফিজ সালাহ উদ্দিন আল আলায়ী الدرة السنية فى مولد سيد البرية কিতাবে বলেছেন, মা আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গর্ভধারণ করেন তখন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বয়স মাত্র আঠারো বৎসর। অতঃপর তিনি খেজুর সংগ্রহের জন্য মদিনাশরীফ গমন করেন এবং সেখানে মামার বাড়ি বনি নাজ্জার গোত্রে ইন্তেকাল করেন।
মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহাও প্রায় একই রকম বয়স পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পর্দাশীল মহিলা। তিনি সবসময় পুরুষদের মেলামেশা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বাড়িতে অবস্থান করতেন। তখনকার অধিকাংশ মহিলারাই জানতেন না ধর্মীয় ও শরিয়তের ব্যাপারে পুরুষদের কি দায়িত্ব। বিশেষ করে জাহিলিয়াতের যুগে পুরুষগণও জানতেন না মহিলাদের উপর তাদের কি প্রাধান্য রয়েছে। এজন্য যখন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হলেন তখন আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলো ابعث الله بشرا رسولا অর্থ: আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন (ইসরা- ৯৪) এবং তারা বলতো-
ولو شاءالله لانزل ملئكة ما سمعنا بهذا فى ابائنا الاولين-
অর্থ: আল্লাহ ইচ্ছা করলে ফেরেশতাই নাজিল করতেন। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এরূপ কথা শুনিনি। (মুমিনুন- ২৪)
অতএব যদি তাদের নিকট রাসূল প্রেরণের জ্ঞান থাকতো তবে তারা ইহা অস্বীকার করতো না। আবার কখনো তারা ধারণা করত তারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর শরিয়তের উপরেই আছে। কারণ ইব্রাহিমী শরিয়তের জ্ঞানসম্পন্ন কারো সাাত তারা পায়নি। কেননা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তাদের মধ্যখানে প্রায় তিনহাজার বছরের অধিক ব্যবধান ছিল।
অতএব এ আলোচনার দ্বারা ইহাই স্পষ্ট হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা এ মসলকেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম (রা.) এর অভিমত
==========
শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেন- আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতিত অন্যান্য সমস্ত নবীগণ শুধুমাত্র তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিই প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন এ মূলনীতি অনুযায়ী আহলে ফাতরাতের সমস্ত অধিবাসীগণ তাদের পূর্ববর্তী নবীর বংশধর। তাদের পূর্ববর্তী নবীর দিকে সম্বোধন করা হয়। এবং তারা তাদের পূর্ববর্তী শরিয়তকে অনুসরণ করেন। অতএব তারাই হলেন আহলে ফাতরাত।
উক্ত আলোচনা দ্বারা ইহাই সুস্পষ্ট হয় যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতা আহলে ফাতরাতের অন্তর্ভুক্ত এতে কোন সন্দেহ নাই। কেননা তারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর বংশধর নয় এবং তার সম্প্রদায় এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইবনে হাজর আসকালনী (রা.) এর অভিমত
==========
হাফিজুল আসর আবুল ফজল বিন হাজর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতামাতা সম্বন্ধে যে ধারণা করা হয় তারা কিয়ামতের দিন পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হবেন এর দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে।
প্রথম ব্যাখ্যা
=====
ইমাম হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহু মুস্তাদরাক কিতাবে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলেছেন-
قال قال شاب من الانصار (لم ار رجلا كان اكثر سوالا لرسول الله صلى الله عليه وسلم منه) يا رسول الله أرأيت ابواك فى النار- فقال ما سألتها ربى فيطيعنى فيها وانى لقائم يومئذ المقام المحمود-
অর্থ: ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- একদা আনসারী এক যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল (ইবনে মাসউদ বলেন তার চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক প্রশ্ন করতে কাউকে দেখিনি) ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি কি মনে করেন, আপনার পিতা-মাতা জাহান্নামী? তখন তিনি বললেন- আমি তাদের সম্বন্ধে আমার প্রভুর নিকট যা চাইব আমাকে তাই দেয়া হবে। আর সেদিন আমি মাকামে মাহমুদে অবস্থান করব।
উল্লেখিত হাদিসটি প্রমাণ করে যে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাকামে মাহমুদে অবস্থান করবেন তখন তিনি তাঁর পিতা-মাতার কল্যাণ কামনা করবেন। আর তা হল যখন আহলে ফাতরাতদেরকে পরীক্ষা করা হবে তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করবেন যেন তারা উভয়ে পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হন। এতে কোন সন্দেহ নাই যখন নবীজী মাকামে মাহমুদে সমাসীন হবেন তখন তাকে বলা হবে سل تعط واشفع تشفع অর্থ: আপনি সুয়াল করুন, দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, কবুল করা হবে। ইহা সহিহ হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব যখন তিনি পিতা-মাতার ব্যাপারে সুয়াল করবেন তখন তা কবুল হবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা
=====
ইবনে জারির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে-ولسوف يعطيك ربك فترضى আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন-
قال من رضا محمد صلى الله عليه وسلم ان لايدخل احد من اهل بيته النار
অর্থ: ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনÑ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেযা বা সন্তুষ্টি হচ্ছে তাঁর পরিবারের কোন সদস্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। এজন্য হাফিজ ইবনে হাজর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার উক্তিতে বলেছেন-
الظن بال بيته كلهم ان يطيعوا عند الامتحان
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার সম্বন্ধে ধারণা করা হয় যে, তারা প্রত্যেকেই পরীার সময় আনুগত্যশীল হবেন।
তৃতীয় হাদিস: হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু شرف النبوة গ্রন্থে এবং মুল্লা তার সীরাতগ্রন্থে ইমরান বিন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم سألت ربى ان لا يدخل النار احدا من اهل بيتى فاعطانى ذالك-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি আমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছি যেন আমার পরিবার থেকে কাউকে জাহান্নামে প্রবেশ না করান। অতঃপর আমাকে তা প্রদান করা হয়েছে।
এ হাদিসটি হাফিজ মুহিব উদ্দিন তাবারী তাঁর ذخائر العقبى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
আবু তালিবের জন্য শাফায়াত
==========
চতুর্থ হাদিস: এ হাদিসটি উল্লেখিত হাদিসদ্বয়ের চেয়ে অধিক স্পষ্ট। ইহা তামাম আর রাযি জয়িফ সনদে তাঁর فوائد গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كان يوم القيامة شفعت لابى وامى وعمى ابى طالب واخ لى كان فى الجاهلية-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি কিয়ামতের দিন আমার পিতা, মাতা, চাচা আবু তালিব ও আমার জাহিলিয়াতের যুগের ভাইয়ের জন্য শাফায়াত করব।
এ হাদিসটি ইমাম তাবারী ذخائر العقبى فى مناقب ذوى القربى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন হাফিজুল হাদিস ও ফকীহ। তিনি বলেন- এখানে আবু তালিবের ব্যাপারটি তাওয়িল বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফায়াতে আবু তালিবের আযাব হ্রাস করা হবে।
তবে এ তাওয়িলটি শুধুমাত্র আবু তালিবের ব্যাপারে প্রযোজ্য। অন্যান্য তিনজন তথা নবীজীর পিতা, মাতা ও দুধভাইয়ের জন্য আবশ্যক নয়। কেননা আবু তালিব নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত হায়াত পেয়েছিলেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেননি। অন্যান্য তিনজন ফাতরাতের সময়েই ইন্তেকাল করেছেন। এ হাদিসটি অন্য একটি সূত্রে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। যদিও এ সূত্রটি অধিক জয়িফ। যা আবু নাঈম সহ অন্যান্যগণ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে ভাই বলতে দুধভাইকে বুঝানো হয়েছে।
فهذه احاديث عدة يشد بعضها بعضا- فان الحديث الضعيف يتقوى بكثرة طرقه-
অর্থ: এ সমস্ত হাদিসগুলি একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। কেননা জয়িফ হাদিস যখন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয় তখন তা শক্তিশালী হয়ে যায়।
যার উদাহরণ হল ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস, ইমাম হাকিম ইহাকে সহিহ বলেছেন।
এ ব্যাপারটি ইবনে আবি দুনিয়ার বর্ণনা দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন কাসিম বিন হাশিম সিমসার, তিনি মাকাতিল বিন সুলাইমান রমলী থেকে, তিনি আবি মু’শার থেকে, তিনি সাঈদ মাকবারী থেকে, তিনি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلو سألت ربى ابناء العشرين من امتى فوهبهم لى-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি আমার প্রভূর কাছে আমার উম্মতের বিশবছর বয়সি যুবকদের জন্য প্রার্থনা করেছি। অতঃপর তিনি তাদেরকে আমাকে দান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বর্ণনা রয়েছে, যদিও ইহা আলোচনার সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। যা ইমাম দায়লামী হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اول من اشفع له يوم القيامة اهل بيتى ثم الاقرب فا لاقرب-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমি সর্বপ্রথম শাফায়াত করব আহলে বাইতের জন্য। অতঃপর নিকটাত্মীয়দের জন্য। অতঃপর তাদের নিকটাত্মীয়দের জন্য।
ইমাম তাবারী ذخائر العقبى গ্রন্থে এবং ইমাম আহমদ মানাকিব গ্রন্থে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا معشر بنى هاشم والذى بعثنى بالحق نبيا لو اخذت بحلقة الجنة ما بدأت الابكم-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- হে হাশিম সম্প্রদায়ের লোকেরা! সে সত্ত্বার কসম, যিনি আমাকে সত্য সহ নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আমি জন্নাতের কড়া ধারণ করি তাহলে আমি তোমাদেরকে নিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করব।
ইহা খতিব তাঁর তারিখ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এমনিভাবে আবুল বখতারী হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان رحمى لا ينتفع بلى حتى تبلغ حكم وهم احد قبيلتين من اليمن- انى لاشفع فاشفع حتى ان من اشفع له فيشفع حتى ان ابليس ليتطاول طمعا فى الشفاعة-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে যে, আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন উপকার করবে না। কিন্তু না অবশ্যই উপকার করবে। এমনকি ‘হুকুম’ সম্প্রদায় পর্যন্ত উপকৃত হবে। (হুকুম হল ইয়ামনের একটি গোত্র)। আমি শাফায়াত করব এবং যার জন্য শাফায়াত করব তা গ্রহণ করা হবে। শেষ পর্যন্ত ইবলিসও শাফায়াতের জন্য আকাক্সা করবে।
এমনিভাবে তাবরানী উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
ان النبى صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان شفاعتى لا تنال اهل بيتى وان شفاعتى تنال حاء وحكم-
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে আমার পরিবারগণ আমার শাফায়াত লাভ করবে না। নিশ্চয় আমার শাফায়াত ‘হা’ ও ‘হুকুম’ গোত্রদ্বয় পর্যন্ত লাভ করবে।
সূক্ষ্মকথা
=====
ইমাম যারকাশী ‘খাদিম’ গ্রন্থে ইবনে দাহইয়া থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি প্রতি সোমবারে আবু লাহাবের আযাব হ্রাসকরণকে শাফায়াতের প্রকারভেদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা হচ্ছে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদশরীফে খুশি হয়ে আবু লাহাব সুয়াইবা দাসীকে মুক্ত করেছিল, যখন সুয়াইবা তাকে এ সংবাদ প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেন- ইহা হচ্ছে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কিরামত বা মর্যাদা।
সতর্কবাণী
=====
অতঃপর দেখেছি ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন খালফ আল উবাই ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে এই মাসআলার উপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি- ان ابى واباك فى النار অর্থ আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ এ হাদিসের অধীনে ইমাম নবভীর উক্তি উল্লেখ করেছেন। নবভী বলেন- যে ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী এবং তার নিকটাত্মীয়গণ তার কোন উপকার করতে পারবে না।
অতঃপর আল উবাই বলেন- আমি বলব এই সম্বোধনটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
এমনিভাবে সুহাইলী বলেছেন- এভাবে মন্তব্য করা আমাদের জন্য উচিত নয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لا تؤذوا الاحياء بسب الاموات
অর্থ: তোমরা মৃতদেরকে গালি দেয়ার মাধ্যমে জীবিতদেরকে কষ্ট দিও না।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله অর্থ: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত। (আহযাব- ৫৭)
সম্ভবত এজন্য ইহা সঠিক যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তাঁর পিতামাতাকে জীবিত করে দিলেন। অতঃপর তারা নবীজীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। কারণ আল্লাহর নিকট কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
অতঃপর তিনি ইমাম নবভীর উক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন- এমনিভাবে যে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণ করছে ঐ বিশ্বাসের উপর যার উপর আরবগণ ছিল অর্থাৎ মূর্তিপূজক হিসেবে সেও জাহান্নামী।
আর এ শাস্তি এ জন্য নয় যে, তার নিকট কোন দাওয়াত পৌঁছেনি। বরং তাদের নিকট ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীদের দাওয়াত পৌঁছেছে।
অতঃপর আল উবাই বলেন, আমি বলব তার বক্তব্যের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ যার নিকট দাওয়াত পৌঁছেছে তারা আহলে ফাতরাত নয়। কেননা আহলে ফাতরাত হল ঐ সমস্ত লোক যারা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়ে ছিলেন। পূর্বেকার নবী তাদের প্রতি প্রেরিত হননি। আবার পরবর্তী নবীকেও তারা পাননি। যেমন আরবজাতী, তাদের প্রতি ঈসা আলাইহি সালামকে প্রেরণ করা হয়নি। আবার তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাতও পায়নি।
এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ফাতরাত বললে ঐ যুগকে বুঝায় যা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়।
কিন্তু ফুকাহায়ে কিরামগণ যখন ফাতরাত সম্পর্কে আলোচনা করেন তখন তারা শুধুমাত্র ঈসা আলাইহিস সালাম ও আমাদের নবীর মধ্যবর্তী সময়কে নির্দিষ্ট করেন।
অতএব যখন অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত হল যে, হুজ্জত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কোন শাস্তি নাই। তখন আমরা বুঝতে পারলাম তাদের কোন শাস্তি হবে না।