আট রাকাতের দলিল : কিছু পর্যালোচনা
আট রাকাতের পক্ষে তিনটি দলিল পেশ করা হয়:
১নং দলিল: হযরত আবূ সালামা র. হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নামায কিরূপ হতো? তিনি বললেন, রমযান ও গায়র রমযানে তিনি এগানো রাকাতের বেশী পড়তেন না। তিনি চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। এরপর চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। এর পর তিন রাকাত পড়তেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যে বেতের পড়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েন? তিনি বললেন, আয়েশা! আমার চোখ ঘুমায় বটে, তবে আমার কল্ব জাগ্রত থাকে। (বুখারী, মুসলিম)।
এ হাদীসটি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। কিন্তু আসলে এ হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে, তারাবী সম্পর্কে নয়। এটিকে তারাবী সম্পর্কে মনে করা ভুল। কারণ:
ক. এ হাদীসে সেই নামাযের কথা বলা হয়েছে যা রমযান ও অন্য সময় পড়া হতো, অথচ তারাবী রমযান ছাড়া অন্য সময় পড়া হয় না।
খ. এখানে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা ঘরে একাকী পড়তেন। অথচ তারাবী জামাতের সঙ্গে মসজিদে পড়া হয়।
গ. এখানে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। পরে ঘুম থেকে উঠে বেতের পড়তেন। অথচ তারাবীতে নামায শেষ করে বেতের পড়া হয়। তাছাড়া এখানে যে বেতের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তা তিনি একাকী পড়তেন। অথচ তারাবীতে বেতের জামাতে পড়া হয়।
ঘ. এই নামায চার রাকাত, চার রাকাত ও তিন রাকাত পড়া হয়েছিল। লা-মাযহাবী আলেম মোবারকপুরী তার তিরমিযী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থে বলেছেন, চার রাকাত এক সালামে পড়া হয়েছিল, এমনিভাবে তিন রাকাতও এক সালামে। অথচ তারাবী দুরাকাত করে পড়া হয়।
ঙ. এই নামায যদি তারাবী সম্পর্কে হতো, তবে ফকীহগণের কেউ না কেউ এগারো রাকাতের মত পোষণ করতেন। অথচ তাদের কেউই অনুরূপ মত পোষণ করেননি।
বোঝা যায়, ফকীহগণের কেউই এই হাদীসকে তারাবীর ক্ষেত্রে মনে করেননি। অথচ ইমাম তিরমিযী র. জানায়েয অধ্যায়ে লিখেছেন,
كذلك قال الفقهاء وهم أعلم بمعاني الحديث
অর্থাৎ ফকীহগণ অনুরূপ বলেছেন, আর হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই অধিক জ্ঞাত।
চ. মুহাদ্দিসগণও এই হাদীসকে তারাবীর ক্ষেত্রে নয়, তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রেই মনে করতেন। ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইমাম মালেক, আব্দুর রাযযাক, দারিমী, আবূ আওয়ানা ও ইবনে খুযায়মা র. প্রমুখ সকলেই এই হাদীসকে তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন; তারাবী বা কিয়ামে রামাযান অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি।
এমনকি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে নাসর মারওয়াযী র. তার ‘কিয়ামুল লাইল’ গ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন,
باب عدد الركعات التي يقوم بها الإمام للناس في رمضان
অর্থাৎ অনুচ্ছেদ: রমযানে লোকদেরকে নিয়ে ইমাম যে নামায পড়বেন তার রাকাত-সংখ্যা। উক্ত অনুচ্ছেদে তিনি তারাবীর রাকাত-সংখ্যা সম্পর্কে বহু হাদীস উল্লেখ করেছেন। অথচ হযরত আয়েশা রা. এর এ হাদীস উচ্চ মানের সহীহ হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখ করা তো দূরের কথা, এর প্রতি কোন ইশারা-ইংগিতও করেননি। এতে বোঝা যায়, তাঁর গবেষণায়ও এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে নয়, তাহাজ্জুদ সম্পর্কে।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শুধু ইমাম বুখারী র. এ হাদীস তারাবী ও তাহাজ্জুদ উভয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারীর নীতি সকলের জানা। তিনি সামান্য সম্পর্কের কারণেই হাদীস পুনরুল্লেখ করেন। তিনি একথাও বুঝিয়ে থাকতে পারেন, রমযানে তারাবী পড়া হলেও শেষে তাহাজ্জুদও পড়ে নেয়া উচিৎ । বুখারী র. নিজেও তারাবী পড়ে শেষরাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন। ফাতহুল বারীর মুকাদ্দিমা, পৃ ৬৪৫।
ছ. এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে হলে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে বিশ রাকাত পড়া আদৌ সম্ভব ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, তাঁর সুন্নত ও আদর্শের প্রতি তাঁদের চেয়ে অধিক মহব্বত আর কারো হতে পারে না।
জ. খোদ হযরত আয়েশা রা.ও মনে করতেননা এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে। অন্যথায় তাঁর চোখের সামনে ৪০টি বছর মসজিদে নববীতে তাঁরই হুজরার পাশে এভাবে সুন্নতের পরিপন্থী কাজ করা হবে, আর তিনি প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকবেন- তা হতে পারে না।
ঝ. এ হাদীস তারাবী সম্পর্কে হলে লা-মাযহাবী আলেম শাওকানী সাহেব ও নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান কেন বলবেন: তারাবীর রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই?
শাওকানী বলেছেন,
فقصر الصلاة المسماة بالتراويح على عدد معين وتخصيصها بقراءة مخصوصة لم ترد به سنة
অর্থাৎ তারাবী নামাযকে বিশেষ সংখ্যায় ও বিশেষ কেরাতে আবদ্ধ করার ব্যাপারে কোন হাদীস আসেনি। দ্র, নায়লুল আওতার।
নওয়াব সাহেব তো আরো স্পষ্ট করে বলেছেন,
ان صلاة التراويح سنة بأصلها ثبت أنه عليه السلام صلاها في ليالي ثم ترك شفقة على الأمة أن لا تجب على العامة أو يحسبوها واجبة ولم يأت تعيين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة
অর্থাৎ তারাবী মূলতঃ সুন্নত। একথা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েক রাত এটি পড়েছিলেন। অতঃপর উম্মতের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তিনি এটি ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর আশংকা ছিল সাধারণের উপর এটি ফরজ হয়ে যায় কি না, কিংবা তারাই এটিকে ফরজ মনে করে বসে কি না। তবে এর নির্দিষ্ট সংখ্যা কোন সহীহ মারফূ হাদীসে উল্লেখ করা হয়নি। দ্র, আল ইনতিকাদুর রাজীহ, পৃ,৬১
সুবকী র.ও তার ‘শারহুল মিনহাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
اعلم أنه لم يبنقل كم صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم في تلك الليالي هل هو عشرون أو أقل
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ রাতগুলোতে বিশ রাকাত না তার কম পড়েছিলেন সে কথা বর্ণিত হয়নি। দ্র, আল মাসাবীহ, পৃ ৪৪
আল্লামা ইবনে তায়মিয়াও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন,
ومن ظن أن قيام رمضان فيه عدد معين موقت عن النبي صلى الله عليه وسلم لا يزاد فيه ولا ينقص فقد أخطأ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি মনে করবে রমযানে তারাবীর রাকাত সংখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত, এতে বাড়ানো কমানো যাবে না, সে ভুল করবে। (দ্র. মাজমাউল ফাতাওয়া, ২২/২৭২)
এসব থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, এ চারজন মনীষীর দৃষ্টিতেও হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে, তারাবী সম্পর্কে নয়। (টীকা-১) ইবনে তায়মিয়া র. যে ভুলের প্রতি ইংগিত দিয়েছেন আলবানী সাহেব সেই ভুলেই পতিত হয়েছেন।
আমরা অবশ্য বলি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন-মেজায, রুচি-প্রকৃতি, আমল ও কর্ম সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে ভাল জানতেন।
সুন্নতের প্রতি তাঁদের আসক্তি, সুন্নতকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রণী ভূমিকা সকলেরই জানা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশই শুধু নয়, তাঁর ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন তাঁদের জীবনের বড় লক্ষ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে খুলাফায়ে রাশেদীন ছিলেন আরো অগ্রগামী। হযরত উমর রা. সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে নবী হওয়ার সুযোগ থাকলে উমরই হতো। (তিরমিযী) তিনি আরো বলেছেন, আমার উম্মতে মুহাদ্দাস (যার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এলহাম হয়) থেকে থাকলে সে হবে উমর। তিনি আরো বলেছেন, উমর যে পথ ধরে চলে শয়তান সে পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ দিয়ে চলে। এই দুটি হাদীসই বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে।
অন্যদিকে বেদ’আত বা নব-উদ্ভাবিত আমল ও কর্মের প্রতি সাহাবীগণের ঘৃণা ও অসন্তোষ ছিল চরম পর্যায়ের। মুয়াজ্জিন আযান দিয়ে পুনরায় ডাকাডাকি করতে শুনে হযরত ইবনে উমর রা. সেই মসজিদ থেকে রাগে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেকে নামাযে সূরা ফাতেহার পূর্বে বিসমিল্লাহ জোরে পড়তে শুনে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রা. বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ছেলেকে সাবধান করে তিনি বলেছিলেন,
إياك والحدث في الإسلام
খবরদার ! ইসলামে নতুন কিছু উদ্ভাবন করো না।
এদুটি হাদীস তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে।
তামাত্তু হজ্জ সম্পর্কে জনৈক ব্যক্তি হযরত ইবনে উমর রা.কে একথা বললেন, আপনার বাবাই তো এটা করতে নিষেধ করেছেন। এর উত্তরে তিনি বলেছেন, মনে কর একটি কাজ সম্পর্কে আমার বাবা নিষেধ করছেন, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেইকাজ করেছেন, তবে তুমি কোনটি ধরবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলটি নয়কি? (তিরমিযী শরীফ)
কুরআন সংকলনের ব্যাপারে যায়দ ইবনে ছাবেত রা.কে দায়িত্ব দিতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন,
كيف تفعل شيئا لم يفعله رسول الله صلى الله عليه وسلم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজ করেননি সে কাজ আপনি কিভাবে করবেন? কিন্তু হযরত উমর রা. তাঁকে ও আবূ বকর রা.কে বুঝিয়ে একাজটি করিয়ে নিয়েছেন।
এসব কথা বিবেচনায় রাখলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি তারাবী সম্পর্কে হয়ে থাকলে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে ২০ রাকাত পড়ার উপর ঐকমত্য হওয়া আদৌ সম্ভব হতো না। অনুরূপ ভাবে ২০ রাকাতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন নির্দেশনা না থাকলে তাও তাদের পক্ষে পড়া সম্ভব হতো না। কেউ না কেউ অবশ্যই প্রতিবাদ বা আপত্তি করে বসতেন। আমার উম্মত গোমরাহীর উপর একমত হবেনা- নবীজীর এ বাণী কে না শুনেছেন?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর রা. এর আমলে সাহাবীগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ হয়ে মসজিদে তারাবী পড়েছেন। উমর রা. যখন তাদের এক ইমামের পেছনে একত্রিত করতে চাইলেন, তখনই হযরত উবাই ইবনে কাব রা. আপত্তি করে বসলেন। মুসনাদে আহমদ ইবনে মানী’ ও জিয়া মাকদিসীর ‘আল মুখতারাহ’ হাদীস গ্রন্থদ্বয়ে আবূল আলিয়া র. থেকে বর্ণিত হাদীসটি, যা ৪০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, জামাতে পড়ার ব্যাপারে হযরত উবাই রা. তো আপত্তি করে বসেছিলেন। কিন্তু বিশ রাকাতের ব্যাপারে তিনি কোন আপত্তি না করে বিনা দ্বিধায় বিশ রাকাত পড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ প্রথম বিষয়টি ছিল ব্যবস্থাপনাগত এবং শরীয়তের রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর দ্বিতীয় বিষয়টি শরীয়তের একটি বিধান। কোন নামাযের রাকাত সংখ্যা নিজের থেকে নির্ধারণ করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে যদি ৮ রাকাত পড়া নির্ধারিত থাকতো তাহলে তিনি স্বেচ্ছায়ও বিশ রাকাত পড়াতেন না। অন্য কেউ পড়াতে বললেও তিনি আপত্তি করে বলতেন, এ কাজ তো ইতিপূর্বে হয়নি, আমি কিভাবে করবো?
২নং দলিল
হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. থেকে বর্ণিত:
أنه صلى في رمضان بنسوة في داره ثمان ركعات
অর্থ: তিনি রমযানে তার ঘরের মহিলাদের নিয়ে আট রাকাত পড়েছেন।
অনুরূপ আবূ ইয়ালায় বর্ণিত হযরত জাবির রা. এর হাদীস: জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন,
جاء أبي بن كعب إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال يا رسول الله إن كان مني الليلة شيئ يعني في رمضان قال: وماذا يا أبي؟ قال نسوة في داري قلن إنا لا نقرأ القرآن فنصلي بصلاتك قال : فصليت بهن ثمان ركعات ثم أوترت
উবাই ইবনে কাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! গত রাতে : তার উদ্দেশ্য হলো রমযানে- আমার থেকে একটি ব্যাপার ঘটে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উবাই! সেটা কি? তিনি বললেন,আমার ঘরের নারীরা বললো যে, আমরা তো কুরআন পড়তে পারিনা (অর্থাৎআমাদের কুরআন মুখস্থ নেই)। তাই আমরাও তোমার পেছনে নামায পড়বো। আমি তাদের নিয়ে আট রাকাত পড়লাম। এবং পরে বেতেরও পড়লাম।
এ হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে বন্ধুদের কয়েকটি ভুল তুলে ধরছি। হাদীসটির অনুবাদে তারা ৩টি ভুল করেছেন। এক, ‘রমযানের রাত্রিতে’ কথাটি তারা জুড়ে দিয়েছেন, যা মূল হাদীসে নেই। দুই, ব্র্যাকেটে তারা ‘তারাবী’ কথাটি জুড়ে দিয়েছেন, এটিও মূল হাদীসে নেই। তিন, এর পরের ভুলটিতো পুরো জালিয়াতি। ‘পড়েছেন’ স্থলে তারা লিখেছেন, ‘আদায় করতেন’। ‘পড়েছেন’ বললে বোঝা যায় কোন একবারের ঘটনা। আর ‘পড়তেন’ বা ‘আদায় করতেন’ বললে বোঝা যায়, এটা তার নিয়মিত আমল ছিল। ৫ম ভুল করেছেন এই বলে যে, ‘আব্দুল্লাহ বলেন’। সঠিক হবে ‘জাবির রা. বলেন’।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। এ হাদীসটি আবূ ইয়ালা র. তার মুসনাদে (১৭৯৫) , মুহাম্মদ ইবনে নাসর র. তার ‘কিয়ামুল লাইলে’ (পৃ ৯০) , তাবারানী তার ‘আওসাতে’ (৩৭৩১) ও আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ তার ‘যাওয়ায়েদে মুসনাদে আহমদে’ (৫/১১৫ : ২১৪১৫) উদ্ধৃত করেছেন। হায়ছামী র. আবূ ইয়ালার শব্দে মাজমাউয যাওয়ায়েদে (২/১৭৯) এটি উল্লেখ করেছেন। সকলে একই সনদে বা সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই হাদীস যয়ীফ, এটি প্রমাণযোগ্য নয়। কারণ:
ক. এর সনদে ঈসা ইবনে জারিয়া আছেন, তিনি যয়ীফ। তার হাদীস প্রমাণযোগ্য নয়। তার সম্পর্কে ইবনে মাঈন র. বলেছেন, ليس حديثه بذاك অর্থাৎ তার হাদীস মজবুত নয়। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, ليس بشيئ অর্থাৎ তিনি কোন বস্তুই নন। অপর এক বর্ণনায় আছে عنده مناكيرঅর্থাৎ তার কিছু কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে। ইমাম নাসায়ী ও আবূ দাউদ র. বলেছেন, منكر الحديث অর্থাৎ তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। অপর এক বর্ণনায় ইমাম নাসায়ী বলেছেন متروك الحديث অর্থাৎ তার হাদীস বর্জনযোগ্য। ইবনে আদী বলেছেন, أحاديثه غير محفوظةঅর্থাৎ তার হাদীস সঠিক নয়। সাজী র. ও উকাইলী র. তাকে যয়ীফদের কাতারে গণ্য করেছেন। ইবনুল জাওযী র.ও তাকে যয়ীফ বলেছেন। (দ্র. তাহযীব ও মীযানুল ইতিদাল)
এই সাতজনের সমালোচনার বিপরীতে শুধু আবূ যুরআ র. বলেছেন, لا بأس به অর্থাৎ তার মধ্যে কোন অসুবিধা নেই। আর ইবনে হিব্বান তাকে ‘সিকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে ব্যাখ্যা সম্বলিত র্জাহ বা সমালোচনা অগ্রগণ্য হয়ে থাকে।(টীকা-২) ফলে ঈসা যয়ীফ প্রমাণিত হন। বিশেষত নাসায়ী ও আবূ দাউদ র. যে বলেছেন ‘মুনকারুল হাদীস’- এটি সম্পর্কে খোদ মোবারকপুরী সাহেব সাখাবী র. এর উদ্ধৃতিতে বলেছেন, منكر الحديث وصف في الرجل يستحق به ترك حديثه অর্থাৎ ‘মুনকারুল হাদীস’ হওয়া ব্যক্তির এমন একটি দোষ যার কারণে তার হাদীস বর্জনযোগ্য হয়ে যায়। (দ্র, আবকারুল মিনান)
এসব কারণেই ইবনে হাজার ‘তাকরীবে’ তার সম্পর্কে বলেছেন, فيه لين তার মধ্যে দুর্বলতা আছে। সুতরাং হায়ছামী ও আলবানী সাহেব হাসান বললেই এটা হাসান হয়ে যাবে না। একইভাবে মীযানুল ইতিদাল গ্রন্থে যাহাবী রহ. এর সনদকে ওয়াসাত বা মধ্যম স্তরের বলে যে মন্তব্য করেছেন, পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের মন্তব্যগুলো সামনে রাখলে সেটিও সঠিক বলে মনে হয় না।
খ. এ হাদীসের কোথাও তারাবীর কথা নেই। সুতরাং এর দ্বারা আট রাকাত তারাবী প্রমাণ করার চেষ্টা হবে ব্যর্থ চেষ্টা । মহিলাদের নিয়ে ঘরে নামায পড়া থেকে তাহাজ্জুদ পড়ার কথাই সাধারণভাবে বুঝে আসে।
গ. তারাবী সংক্রান্ত ঘটনা হওয়া তো দূরের কথা, এটাকে রমযানের ঘটনা প্রমাণিত করাও মুশকিল। কারণ এই হাদীস মুসনাদে আহমাদে ও তাবারানীর আওসাত গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, সেখানে রমযানের কোন কথাই নেই। আর মুসনাদে আবূ ইয়ালায় বলা হয়েছে, يعني في رمضانঅর্থাৎ তার উদ্দেশ্য হলো, রমযানে। একথাটি নিশ্চয়ই হযরত জাবির রা. বা ঈসা ইবনে জারিয়া কিংবা অন্য কেউ বলেছেন। এমতাবস্থায় মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এটি মুদরাজ বলে বিবেচিত হবে, যার উৎস বর্ণনায় উল্লেখ করা হয় নি। অবশ্য ‘কিয়ামুল লাইলে’র বর্ণনায় আছে, جاء أبي بن كعب في رمضان فقال يا رسول الله الخঅর্থাৎ হযরত উবাই ইবনে কাব রমযানে আসলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ::::। উপরোক্ত বর্ণনাগুলোর আলোকে অনুমিত হয় যে, ঈসা ইবনে জারিয়া কখনও রমযানে আসার কথা বলেছেন; কখনও বলেছেন, তার উদ্দেশ্য হলো রমযানে; আবার কখনও তিনি রমযানের প্রসঙ্গই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এতে করে তার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতাই বেশী করে প্রমাণিত হয়। কেননা হাদীসটি কেবল তার সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া কিয়ামুল লাইলের সনদে মুহাম্মদ ইবনে হুমায়দ রাযী আছেন। ইমাম বুখারী তার সম্পর্কে বলেছেন فيه نظر অর্থাৎ তার ব্যাপারে আপত্তি আছে। ইবনে হাজার বলেছেন, حافظ ضعيف অর্থাৎ দুর্বল হাফেজে হাদীস। যাহাবী র. ‘কাশেফ’ গ্রন্থে বলেছেন, الأولى تركه অর্থাৎ তাকে বর্জন করাই শ্রেয়। সুতরাং ‘রমযানে আসলেন’ কথাটি তার বৃদ্ধিও হতে পারে।
ঘ. হাদীসটি যে প্রমাণযোগ্য নয় তার একটি প্রমাণ এও হতে পারে, এটি সহীহ হয়ে থাকলে হযরত উমর রা. এর আমলে হযরত উবাই রা. যখন তারাবীর ইমাম হলেন, তখন তিনি আট রাকাতই পড়াতেন। অথচ পেছনে বহু সূত্রে আমরা প্রমাণ করে এসেছি, তিনি বিশ রাকাতই পড়িয়েছেন।
৩নং দলিল
হযরত জাবির রা. বলেন,
صلى بنا رسول الله صلى الله صلى الله عليه وسلم في ليلة رمضان ثمان ركعات والوتر فلما كان من القابلة اجتمعنا في المسجد ورجونا أن يخرج إلينا فلم نزل فيه حتى أصبحنا إلى آخر الحديث
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে রমযানে আট রাকাত ও বেতের পড়লেন। পরের রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হলাম এবং আশা করলাম তিনি বেরিয়ে আমাদের কাছে আসবেন। কিন্তু সকাল পর্যন্ত আমরা মসজিদে (অপেক্ষা করতেই) থাকলাম। (অর্থাৎ তিনি আর বের হননি)।
এ হাদীসটিও যয়ীফ, প্রমাণযোগ্য নয়। কেননা এর সনদেও ঐ পূর্বোক্ত ঈসা ইবনে জারিয়া আছেন। তাছাড়া এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, এটা কেবল এক রাতের ঘটনা ছিল। যেহেতু সে সময় তারাবী নামায জামাতের সঙ্গে পড়ার প্রচলন ছিল না, তাই এই হাদীসকে সহীহ ধরে নিলেও এই সম্ভাবনা থাকে যে, অবশিষ্ট নামায জামাত ছাড়া একাকী পড়ে নেওয়া হয়েছে। আর এটা নিছক অনুমান নয়। মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রা. এর এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তারাবীতে শরীক হওয়ার একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন,
ثم صلى صلاة لم يصلها عندنا
অর্থাৎ এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হুজরায় গিয়ে ) কিছু নামায পড়েছেন যা আমাদের নিকট পড়েননি। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১১০৪
ঈসা ইবনে জারিয়া বর্ণিত হাদীসটি সঠিক না হওয়ার আরো একটি কারণ এই যে, সহীহ হাদীস সমূহে একাধিক সাহাবী কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তারাবী পড়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা রা. এর বর্ণনা বুখারী (৯২৪) ও মুসলিমে (৭৬১) উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত আনাস রা. এর বর্ণনা মুসলিম শরীফে (১১০৪), হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রা. এর বর্ণনা বুখারী (৭৩১) ও মুসলিমে (৭৮১) উদ্ধৃত হয়েছে। আবূ যর রা. এর বর্ণনা আবূদাউদ (১৩৭৫) ও তিরমিযী শরীফে (৮০৬) উদ্ধৃত হয়েছে এবং নুমান ইবনে বাশীর রা. এর বর্ণনা নাসায়ী শরীফে (১৬০৬) উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু তাদের কারো বর্ণনাতেই রাকাত-সংখ্যার উল্লেখ আসেনি। এসেছে শুধু হযরত জাবির রা. এর বর্ণনায়। তাও ঈসা ইবনে জারিয়ার মতো দুর্বল বর্ণনাকারীর সূত্রে।
কিছু গ্রন্থের বরাত প্রসঙ্গে
আলোচনার এ পর্যায়ে লামাযহাবী বন্ধুদের আরেকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। তারা আমাদের হানাফী ও অন্যান্য কিছু আলেমের মতামত উল্লেখ করে বোঝাতে চেয়েছেন, এঁরাও তাদের সঙ্গে একমত। সর্বপ্রথম তারা আব্দুল হক দেহলভী র. এর কথা এনেছেন, কিন্তু তাঁর কোন গ্রন্থের বরাত দেননি। অথচ তিনি তার ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
والذي استقر عليه الأمر واشتهر من الصحابة والتابعين ومن بعدهم هو العشرون
অর্থাৎ ২০ রাকাত তারাবীই সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও পরবর্তী আলেমগণ থেকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং এটাই শেষ পর্যন্ত বহাল হয়েছে।
২য় নম্বরে তারা ইবনুল হুমাম র. এর নাম উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি বলেছেন, ২০ রাকাত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, যার অনুসরণের তাগিদ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই দিয়ে গেছেন। ২০ রাকাতের আমল হযরত উমর রা. এর যুগ থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসছে।
৩য় নাম এসেছে কাশ্মীরী র. এর ‘আল আরফুশ শাযী’ (তারা লিখেছেন, উরফুশ শাযী, এটা ভুল) গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে। এটি কাশ্মীরী র. রচিত কোন কিতাব নয়। বরং তাঁর ক্লাসের আলোচনা এক ছাত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে এতে কিছু ভুল-ভ্রান্তিও ঘটে গেছে। কাশ্মীরী র. বুখারী শরীফের দরসী বয়ান ‘ফায়যুল বারী’ যা আল আরফুশ শাযী থেকে অনেক নিখুঁত, যার সংকলক আল্লামা বদরে আলম মিরাঠী কাশ্মিরী রহ.এর নিকট অনেকবার বুখারী শরীফের পাঠ গ্রহণ করেছেন, তাতে বলেছেন, আহলে হাদীস নামধারীদের উচিৎ সেহরী খাওয়া ছুটে যাওয়ার আশংকা হয়, এমন সময় পর্যন্ত ( অর্থাৎ সারারাত) তারাবী পড়া। কেননা এটাই নবীজীর সর্বশেষ আমল ছিল। কিন্তু যারা আট রাকাত পড়ে উম্মতের ‘সাওয়াদে আযম’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এমনকি তাদের উপর বেদআতের দোষ আরোপ করে, তাদের উচিৎ নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করা। (দ্র, ৩খ, ১৮১পৃ)
৪র্থ নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোল্লা আলী কারী র. এর । কিন্তু যে বক্তব্যটি পেশ করা হয়েছে সেটি মূলতঃ ইবনুল হুমাম র. এর । কারী সাহেব এর পূর্বে ইবনে তায়মিয়া রা. এর কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, যারা মনে করে এগারো রাকাতের বেশী পড়া যাবে না, তারা ভুল করবে। আবার ইবনুল হুমাম র. এর বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর কারী সাহেব ইবনে হাজার মক্কী র. এর একথাও উদ্ধৃত করেছেন যে, ২০ রাকাত তারাবীর উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে তারা শুধু নিজেদের মতলবের কথাটিই উল্লেখ করেছেন।
কিছু জালিয়াতি
পঞ্চম উদ্ধৃতি তারা দিয়েছেন ইবনে হাজার আসকালানীর। তিনি নাকি বলেছেন, ২০ রাকাতের হাদীস সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ায় তা বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়। এ হলো লা-মাযহাবীদের আরেক জালিয়াতি । ইবনে হাজার র. আবূ শায়বা বর্ণিত মারফূ হাদীসে যে বিশ রাকাতের উল্লেখ এসেছে, সে সম্পর্কে বলেছেন, এটা হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। ‘তা বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়’ কথাটি বন্ধুরা নিজেদের পকেট থেকে যোগ করেছেন। (দ্র, ফাতহুল বারী, ৪/৩১০: হাদীস নং ২০১৩) এর পূর্বে ইবনে হাজার র. ৩০৮ পৃষ্ঠায় ১১,১৩ ও ২০ রাকাত তারাবী সম্পর্কিত বর্ণনাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে বলেছেন বিশ রাকাত শেষ আমল ছিল।
ইবনে হাজার র. এর উপরোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর তারা লিখেছেন, একই ধরণের মন্তব্য করেছেন ইমাম নাসায়ী ‘যু’আফা’ গ্রন্থে, আল্লামা আইনী হানাফী র. ‘উমদাতুল কারী’ গ্রন্থে, আল্লামা ইবনে আবেদীন ‘হাশিয়া দুররে মুখতার’ গ্রন্থে এবং অন্যান্য বহু মনীষীগণ।
এ হলো তাদের জালিয়াতির আরেকটি দৃষ্টান্ত। নাসায়ী র. যু’আফা গ্রন্থে অনুরূপ কোন কথাই বলেননি। তিনি শুধু ২০ রাকাতের মারফূ হাদীস বর্ণনাকারী আবূ শায়বাকে মাতরূক বলেছেন। এতেই যদি ঐ বক্তব্য অনিবার্য হয়, তবে আমরাও তো বলতে পারি হযরত জাবির রা. এর আট রাকাতের হাদীসটি সম্পর্কে নাসায়ী র. বলেছেন, এটি বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়। কেননা তিনি এর বর্ণনাকারী ঈসা ইবনে জারিয়া সম্পর্কেও মাতরূক বলেছেন।
আল্লামা আইনীও উমদাতুল কারী গ্রন্থে অনুরূপ কোন বক্তব্য দেননি। তিনি বরং বিশ রাকাতকেই দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে প্রাধান্য দিয়েছেন।
এমনকি হযরত উমর রা. এর যুগে ২০ রাকাত তারাবীর উপর সাহবায়ে কেরামের ইজমা বা ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছেন।
সর্বশেষ ইবনে আবেদীন র. এর হাশিয়া দুররুল মুখতারের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, এটা তো রীতিমত তার উপর মিথ্যারোপ। তিনি বরং স্পষ্ট বলেছেন,
وهي عشرون ركعة ) هو قول الجمهور وعليه عمل الناس شرقا وغربا وعن مالك ست وثلاثون . وذكر في الفتح أن مقتضى الدليل كون المسنون منها ثمانية والباقي مستحبا ، وتمامه في البحر ، وذكرت جوابه فيما علقته عليه . ٢/٤٩٥
অর্থাৎ তারাবী বিশ রাকাত। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এটাই। পূর্ব-পশ্চিমে এ অনুসারেই মানুষের আমল। ইমাম মালেক র. এর মত হলো ৩৬ রাকাত। ফাতহুল কাদীর গ্রন্থে বলা হয়েছে, দলিল প্রমাণের দাবী হলো ৮ রাকাত মাসনূন হওয়া ও বাকী রাকাতগুলো মুস্তাহাব হওয়া। এর পূর্ণ বিবরণ ‘আল বাহরুর রায়েক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের টীকায় (অর্থাৎ মিনহাতুল খালেক- এ ) আমি এ কথার জবাব লিপিবদ্ধ করেছি। (দ্র, ২খ, ৪৯৫পৃ)
তার মানে যিনি এত মজবুত ভাবে ২০ রাকাত তারাবী প্রমাণ করছেন, এমনকি ইবনুল হুমামের মতটিও খ-ন করছেন, তার প্রতিই তারা এমন কথা আরোপ করছেন যে, তিনি বলেছেন, বিশ রাকাত বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়।
একই ভাবে আলবানীর অনুসরণে তারা ইমাম শাফেয়ী র. ও ইমাম তিরমিযী র. সম্পর্কে বলেছেন, তারা নাকি হযরত উমর রা. এর বিশ রাকাত তারাবীর হাদীসকে দুর্বল বর্ণনা বলেই নির্দেশনা দিয়েছেন।
অথচ তারা কোথাও অনুরূপ নির্দেশনা দেন নি। এ আজব তথ্যটি আলবানী সাহেব আবিষ্কার করেছেন তাঁদের একটি কথা থেকে। তাঁরা বলেছেন, روي عن عمرঅর্থাৎ হযরত উমর থেকে বর্ণিত। ব্যাস, এটাকেই তিনি ধরে নিয়েছেন দুর্বল বলেই নির্দেশনা দেওয়া। অথচ স্বয়ং তিরমিযী র. সহীহ বর্ণনার ক্ষেত্রেও ঐ روي শব্দটি ব্যবহার করেছেন। দ্র, হাদীস নং ১২৪, ১৭৮, ১৮৪।