জালিয়াতির আরেক চিত্র
আল্লামা আলবানী একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বুখারী শরীফের টীকায় আহসানুল্লাহ বিন সানাউল্লাহ এ মাসআলায় প্রায় আঠার পৃষ্ঠা কলমবন্দ করেছেন। তথ্য বিকৃতি, জালিয়াতি, সাহাবী-তাবিঈ ও অন্যান্য মনীষীগণের নাম ও কিতাবের নামের বিকৃতিতে ভরা এই আঠার পৃষ্ঠা। নমুনা হিসাবে এখানে কিছু তুলে ধরা হলো।
১.রফয়ে ইয়াদায়নের পক্ষের হাদীসগুলো উল্লেখ করতে গিয়ে ১ নম্বরে ইবনে উমর রা. বর্ণিত ও বুখারী-মুসলিমসহ বহু হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীসদুটি তুলে ধরার পর ২ নম্বরে লেখক বলেছেন, উপরোক্ত হাদীসটি বায়হাকীতে বর্ধিতভাবে বর্ণিত আছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ স. মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত সর্বদাই উক্ত নিয়মেই সলাত আদায় করতেন (অর্থাৎ তিনি আজীবন উক্ত তিন সময়ে রফউল ইয়াদাইন করতেন।) (বায়হাকী, হিদায়াহ দিরায়াহ, ১/১১৪, ইমাম বুখারীর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী রহ. বলেন, এ হাদীস আমার নিকট সব উম্মাতের উপর হুজ্জাত বা দলীলস্বরূপ। (পৃ. ৫১৬)
এখানে এই জালিয়াতি করা হয়েছে যে, আলী ইবনুল মাদীনীর মন্তব্যটি প্রথম হাদীসটি সম্পর্কে। অথচ তিনি এটি দ্বিতীয় হাদীসটির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। এতে করে পাঠক মনে করবেন, এ হাদীসটিও সহীহ। অথচ এটি একটি জাল হাদীস। পেছনে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
২.রফউল ইয়াদায়ন সম্পর্কে হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠ আলেমগণের অভিমত শিরোনামে ১ নম্বরে তিনি লিখেছেন, মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রহ.) বলেন, সলাতে রুকু’তে যাওয়ার সময় ও রুকু’ থেকে উঠার সময় দু’হাত না তোলা সম্পর্কে যেসব হাদীস রয়েছে সেগুলো সবই বাতিল। তন্মধ্যে একটিও সহীহ নয়। (মাওযু’আতে কাবীর, পৃ. ১১০)
এখানে এই জালিয়াতি করা হয়েছে যে, একথাগুলো আসলে মোল্লা আলী কারীর নয়। বরং হাফেয ইবনুল কায়্যিমের, মোল্লা আলী কারী তা উল্লেখ করার পর খ-ন করেছেন। মনে হচ্ছে, এই লেখক কারী সাহেবের কিতাবটি দেখেন নি, অন্য কারো পুস্তক থেকে নকল করে দিয়েছেন।
৩.একই শিরোনামে ২ নম্বরে তিনি লিখেছেন, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী হানাফী (রহ.) রুকুর পূর্বে রফউল ইয়াদাইন করার ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে লিখেছেন, ইমাম আবূ হানীফা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তা ত্যাগ করলে গুনাহ হবে। (উমদাতুল কারী, ৫/২৭২) এও এক জালিয়াতি। পাঠকের অবগতির জন্য উমদাতুল কারী গ্রন্থের আরবী পাঠ এখানে তুলে ধরা হলো :
وفي ( التوضيح ) ثم المشهور أنه لا يجب شيء من الرفع وحكى الإجماع عليه وحكى عن داود إيجابه في تكبيرة الإحرام وبه قال ابن سيار من أصحابنا وحكي عن بعض المالكية وحكي عن أبي حنيفة ما يقتضي الإثم بتركه
৪.অর্থাৎ তাওযীহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রসিদ্ধ মত হলো কোন রফাই জরুরী নয়। এ ক্ষেত্রে ইজমাও উল্লেখ করা হয়েছে। দাউদ থেকে বর্ণিত আছে যে, তাকবীরে তাহরীমার সময় রফা করা জরুরী। আমাদের ফকীহগণের মধ্যে ইবনু সাইয়্যার এমতটিই অবলম্বন করেছেন। কোন কোন মালেকী থেকেও একথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা থেকে এমন কথা বর্ণিত হয়েছে যা থেকে বোঝা যায় এটা ত্যাগ করলে গুনাহ হবে। (উমদাতুল কারী, ৫/২৭২)
বোঝাই যাচ্ছে, ইমাম আবূ হানীফা উক্ত কথা বলে থাকলে তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত তোলা সম্পর্কে বলেছেন।
৫.উক্ত শিরোনামেই আব্দুল হাই লক্ষণৌভীর বরাতে ৭ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক, সুফিয়ান সাওরী এবং শুবা বলেন, ইসাম ইবনু ইউসুফ মুহাদ্দিস ছিলেন। সেজন্য তিনি রফউল ইয়াদাইন করতেন। (আল ফাওয়ায়িদুল বাহিয়্যাহ, পৃ. ১১৬)
এও একটি মারাত্মক জালিয়াতি। ইবনুল মুবারক, সুফিয়ান ও শোবা আদৌ একথা বলেন নি। যিনি বলেছেন তিনিও এভাবে কথাটি বলেন নি। পাঠকের অবগতির জন্য আল ফাওয়াইদুল বাহিয়্যার মূল আরবী পাঠ তুলে ধরা হলো :
وفي طبقات القاري : عصام بن يوسف روى عن ابن المبارك والثوري وشعبة وكان صاحب حديث يرفع يديه عند الركوع وعند رفع الرأس منه اهـ
অর্থাৎ মোল্লা আলী কারীর আত তাবাকাত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ’ইসাম ইবনে ইউসুফ হাদীস বর্ণনা করেছেন ইবনুল মুবারক, (সুফিয়ান) ছাওরী ও শোবা থেকে। তিনি হাদীসবিদ ছিলেন। রুকুর সময় ও রুকু থেকে ওঠার সময় তিনি রফয়ে ইয়াদাইন করতেন।
৬.একই শিরোনামে ১৩ নম্বরে বলা হয়েছে, মুফতী আমিমুল ইহসান লিখেছেন, যারা বলে রফউল ইয়াদাইন করার হাদীস মানসূখ, আমি বলি তাদের একটি মাত্র দলীল (অর্থাৎ ইবনু মাসউদের হাদীস), দ্বিতীয় কোন দলীল নেই। (ফিকহুস সুন্নাহ ওয়াল আসার, পৃ. ৫৫)
এখানেও ধোঁকার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। মুফতী সাহেব এখানে তিন জায়গা ছাড়াও যেসব হাদীসে আরো অন্যান্য স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করার উল্লেখ এসেছে সেসব হাদীস উল্লেখপূর্বক বলেছেন,
قلت : ومن ذهب إلى نسخه فليس له دليل إلا مثل دليل من قال : لا يرفع يديه في غير تكبيرة الافتتاح
অর্থাৎ আমি বলব, যারা এর (অর্থাৎ তিন স্থান ছাড়া অন্যান্য স্থানের রফয়ে ইয়াদাইন) মানসুখ বা রহিত হওয়ার মত পোষণ করেন, তাদের দলিলও ঠিক তেমন, যেমন শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রফা করার প্রবক্তাদের দলিল।
মুফতী সাহেব একটি দলিলের কথা বলবেন কী করে? তিনি নিজেই তো শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় রফা করার পাঁচ-সাতটি হাদীস উল্লেখ করেছেন।
৭.নামের ক্ষেত্রে তিনি বারা রা.কে বারাআ, কাতাদা ইবনে রিবঈকে রব্য়ী, আতা ইবনে আবূ রাবাহকে রিবাহ, নুমান ইবনে আবু আইয়্যাশকে আয়াশ, কায়সকে কায়িস, ইসহাক ইবনে রাহাওয়ায়হ্কে রাহওয়াহ, ইবনে মাঈনকে মুঈন, মিকসামকে মুকসিম, ইবনে দুকায়নকে দাকীন, যুহরীকে যুহুরী, মুহারিবকে মুহাররব, সাওওয়ারকে সিওয়ার ও ’আব্বাদকে উব্বাদ বানিয়ে রিজাল শাস্ত্র বিষয়ে বড় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
একইভাবে কিতাবের নামের ক্ষেত্রে বায়হাকীর খিলাফিয়্যাতকে খুলাফিয়াত, হাকেমের মাদখালকে মুদখাল নামে উল্লেখ করেছেন। ৫১৭ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, যাহাবীর শারহু মুহাযযাব। অথচ এ নামে যাহাবী’র কোন কিতাব নেই। শারহুল মুহাযযাব হলো ইমাম নববীর লেখা। ৫৩৪ পৃষ্ঠার শুরুতে তিনি লিখেছেন, আনাস বর্ণিত হাদীসটি হাকিম মুদখাল গ্রন্থে বর্ণনার পর বলেন, হাদীসটি মাওযূ (বানোয়াট)। তিনি বাদরুল মুনীর গ্রন্থে বলেন, এর সানাদে মুহাম্মাদ ইবনু উকাশাহ রয়েছে। অথচ আল বাদরুল মুনীর হাকেমের রচনা নয়, এটি ইবনুল মুলাক্কিনের রচনা। তবুও এরা আহলে হাদীস!