শেষকথা
সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে জাহান্নামীদের মধ্যে সর্বনিু আযাব হলো আবু তালিবের। সে থাকবে জাহান্নামের আগুনের শিখার মধ্যে। তার পায়ে দুটি জুতা পরানো হবে এবং এর তাপে তার মগজ গলে বের হবে। ইহা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা জাহান্নামী নয়। কারণ যদি তারা জাহান্নামী হন তাহলে আবু তালিবের চেয়ে তাদের শাস্তি কম হতে হবে। কেননা তারা হচ্ছেন নবীজীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং তাদের রয়েছে অনেক উযর বা অপারগতা। তারা নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত অবকাশ পাননি এবং এমন হয়নি যে, তাদের কাছে ইসলাম পেশ করা হয়েছে তথাপি তারা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু আবু তলিবের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
অতএব অধিক সত্যবাদী নবীর হাদিস অনুযায়ী সর্বনিম্ন শাস্তি হবে আবু তালিবের। সুতরাং নবীজীর পিতা-মাতা জাহান্নামী নন-
وهذا يسمى عند اهل الاصول دلالة الاشارة-
অর্থ: আহলে উসূলদের ভাষায় ইহাকে বলা হয় ইঙ্গিতসূচক দলিল।
ঝগড়ার ময়দান
=======
বর্তমান যুগে ঝগড়াকারীর অভাব নেই। বিশেষ করে উল্লেখিত মাসআলার ব্যাপারে। তাদের অধিকাংশই দলিল প্রমাণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অজ্ঞ। সুতরাং তাদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করা অনর্থক। তবে তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি যারা একটু যুক্তিযুক্ত তর্ক করেন তাদের অনেকেই শুধুমাত্র মুসলিমশরীফের ঐ হাদিসটি দলিল হিসেবে পেশ করে বলেন- ইহা আপনার মতের ব্যতিক্রম।
অতএব ঝগড়াকারী ব্যক্তি যদি আমাদের শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হয় তাহলে তার ক্ষেত্রে আমি বলব- সহিহ মুসিলমশরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পড়েন নাই। অথচ আপনার মতে ‘বিসমিল্লাহ’ ব্যতিত নামায সহিহ হয় না।
এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ইমাম নির্ধারণ করা হয় তাকে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং ইমামের ব্যতিক্রম কর না। যখন তিনি রুকু করেন তোমরাও রুকু কর। যখন মাথা উত্তোলন করেন তোমরাও উত্তোলন কর। যখন ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলেন তখন তোমরা ‘রাব্বানা লাকাল হাম্দ’ বল। যখন বসে নামায পড়েন তখন তোমরাও সবাই বসে নামায পড়।
অথচ আপনার মত হল- ইমাম যখন ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলেন তখন আপনিও ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলেন।
আবার ইমাম যদি উযরের কারণে বসে নামায পড়েন, আর আপনি সুস্থ্য ব্যক্তি হন তাহলে আপনি ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়েন, বসে পড়েন না। এমনিভাবে বুখারী মুসলিমে তাইয়াম্মুমের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে ‘তোমাদের জন্য যথেষ্ট যে একবার মাটিতে হাত দ্বারা আঘাত করবে। অতঃপর বাম হাত দ্বারা ডানহাতের তালুও চেহারা মাসেহ করবে।
অথচ আপনি তাইয়াম্মুমের মধ্যে একবার আঘাত করাকে যথেষ্ট মনে করেন না এবং হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসেহ করাকে যথেষ্ট মনে করেন না।
অতএব বুখারী ও মুসলিম উভয়টি অথবা একটির মাধ্যমে প্রমাণিত বিষয়ের ব্যতিক্রম আপনি কিভাবে করেন?
যদি তাঁর নিকট ইলমের একটু গন্ধ থাকে তাহলে সে বলবে এ ব্যাপারে অন্যান্য দলিল রয়েছে যা এর সাথে সাংঘর্ষিক। তাই আমি অন্য দলিলকে এর উপর প্রাধান্য দিয়েছি।
ইমাম সুয়ুতি বলেন- তাহলে আমি তাকে বলব আলোচ্য ব্যাপারটিও এরকম একটি মাসআলাহ। এর পে শুধুমাত্র মুসলিমের ঐ হাদিস ব্যতিত অন্য কোন হাদিস নেই।
যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি মালিকি মাযহাবের অনুসারী হয় তবে তার ক্ষেত্রে বলব বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে ক্রেতা ও বিক্রেতার কিয়ার তথা গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার উভয়ে পৃথক হওয়া পর্যন্ত থাকবে। অথচ আপনি খিয়ারে মজলিসকে গ্রহণ করেন না।
এমনিভাবে সহিহ মুসলিমশরীফে বর্ণিত হয়েছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজুর সময় সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করতেন না। অথচ আপনার মতে অজুতে সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করা ওয়াজিব। অতএব সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের বিরোধিতা আপনি কিভাবে করেন? তিনি জবাবে বলবেন- এ ব্যাপারে সাংঘর্ষিক অন্যান্য দলিল রয়েছে। তাই আমি অন্যটিকে প্রাধান্য দিয়েছি।
সুয়ুতি বলেন- আলোচ্য মাসআলাটিও এ ধরণের একটি বিষয়। যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি হানাফি মাযহাবের অনুসারী হয় তাহলে তার েেত্র বলব- সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে ‘যদি কুকুর তোমাদের কারো পাত্রে মুখ লাগায় তাহলে ইহাকে সাতবার ধৌত কর।’ অথচ আপনি সাতবার ধৌত করা শর্তারোপ করেন না।
এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়বে না তার নামায শুদ্ধ হবে না’ অথচ আপনি এ ক্ষেত্রে সূরা ফাতিহা ব্যতিত নামায শুদ্ধ মনে করেন।’
এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে ছাবিত হয়েছে ‘অতঃপর রুকু থেকে মাথা উত্তোলন কর এবং তাদিল তথা বিলম্ব সহকারে দাঁড়াও অথচ আপনি তাদিল ব্যতিত নামায শুদ্ধ মনে করেন।
অনুরূপভাবে সহিহ হাদিসে বর্ণিত ‘পানি যখন দুই কুল্লা পর্যন্ত পৌঁছবে তখন অপবিত্র হবে না। অথচ আপনি দুই কুল্লা ধর্তব্য করেন না।
এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইয়ে মুদাব্বির করতেন। অথচ আপনি ‘বাইয়ে মুদাব্বির’ গ্রহণ করেন না।
অতএব কিভাবে এ সমস্ত সহিহ হাদিসসমূহের বিরোধিতা করেন?
তিনি বলবেন, এ সমস্ত ব্যাপারে অন্যান্য দলিল রয়েছে যা এগুলোর সাংঘর্ষিক। তাই আমি অন্যান্য দলিলকে এগুলোর উপর প্রাধান্য দিয়েছি।
সুয়ুতি বলেন- আমি বলব আমাদের আলোচ্য মাসআলাটিও এ ধরণের একটি বিষয়।
যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী হন তাহলে তার ক্ষেত্রে বলব- বুখারী মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে- যে ব্যক্তি সন্দেহের দিন রোযা রাখল সে আবুল কাশিম তথা নবীয়েপাকের অবাধ্যতা করল।
এমনিভাবে উভয় কিতাবে বর্ণিত হয়েছে- রোযা রাখার ক্ষেত্রে রমজান মাসকে একদিন বা দুইদিন অগ্রবর্তী করো না। অথচ আপনি সন্দেহের দিন রোযা রাখতে বলেন। অতএব সহিহাইন দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের বিরোধিতা আপনি কিভাবে করেন?
তিনি বলবেন এ ব্যাপারে অন্যান্য দলিল রয়েছে যা একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই আমি সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমি বলব- আমাদের আলোচিত বিষয়বস্তুটিও এ রকমই একটি মাসআলাহ। এ আলোচনাটি বর্তমান সময়ে বিবেকবানদের জন্য একটি চমৎকার। যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি এমন হয় যার নিকট হাদিস রয়েছে কিন্তু কোন ফিকাহ নাই তাহলে তার ক্ষেত্রে বলা হবে-
قد قالت الاقدمون- المحدث بلا فقه كعطار غير طبيب- فالادوية حاصلة فى دكانه ولا يدرى لماذا تصلح- والفقيه بلا حديث كطبيب ليس بعطار يعرف ما تصلح له الادوية الا انها ليست عنده-
অর্থ: পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামগণ বলেছেন- ফিকাহ ব্যতিত মুহাদ্দিস ঐ আতর ব্যবসায়ীর মতো। যার নিকট কোন ডাক্তার নেই। তার দোকানে ঔষধ আছে কিন্তু সে জানে না এগুলো কোন রোগের নিরাময়ক।
আবার হাদিস ব্যতিত ফকিহ ঐ ডাক্তারের মতো, যার কাছে কোন ঔষধ নাই। সে জানে কোন রোগের কোন প্রতিষেধক। কিন্তু তার নিকট সে ঔষধ মওজুদ নাই।
আল্লাহর শোকরিয়া, আমার নিকট হাদিস, ফিকাহ, উসূল, সমস্ত আরবি ব্যাকরণ, মায়ানী, বয়ান ইত্যাদি মজুদ আছে। অতএব আমি জানি কিভাবে কথা বলতে হবে। কিভাবে দলিল প্রদান করতে হবে। এবং কিভাবে কোনটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
কিন্তু ভাই (আল্লাহ আমাকে ও তোমাকে তৌফিক দান করুক) এ বিষয়টি তোমার বুঝে আসবে না। কারণ তুমি ফিকাহ, উসূল এমনি আরবি উপকরণের কোনটিই জান না। হাদিসশাস্ত্রে কথা বলা এবং দলিল পেশ করা এত সহজ ব্যাপার নয়।
অতএব এ ব্যাপারে যিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী কথা বলতে গিয়ে তার উপর অগ্রসর হওয়া উচিত নয়।
অতএব আল্লাহ তোমাকে যতটুকু জ্ঞান দান করেছেন তার উপর সীমাবদ্ধ থাক। অর্থাৎ যখন কোন হাদিস সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন শুধুমাত্র এ কথাই বল ইহা বর্ণিত আছে অথবা বর্ণিত হয় নাই। হাফিজে হাদিসগণ ইহাকে সহিহ হাসান অথবা জয়িফ বলেছেন। এর চেয়ে অধিক কিছু ফতোয়া দেয়া তোমার জন্য জায়েয নয়। কবি বলেন-
لا تحسب المجد تمرا انت اكله - لن تبلغ المجد حتى تلعق الصبرا
অর্থ: তুমি খেজুরের সম্মান বুঝবে না। কারণ তুমি শুধুমাত্র একজন ভণকারী। ধৈর্য্য ধরে চেটে না খাওয়া পর্যন্ত এর সম্মান তোমার কাছে পৌঁছবে না।
অতঃপর আমি অন্য একটি বিষয় চার মাযহাবের সকল অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলব, তা হলো ইমাম মুসলিম রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় সহিহ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি রেওয়ায়ত বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর যুগ এবং উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর প্রাথমিক যুগ পর্যন্ত তিন তালাককে এক তালাক ধর্তব্য করা হত।
এখন আমি সকল জ্ঞান অন্বেষণকারীদের বলব- আপনি কি উক্ত হাদিসের মর্মার্থ গ্রহণ করেন? যদি কেউ তার স্ত্রীকে বলে তোমাকে তিন তালাক দিলাম, তাহলে আপনি কি এক্ষেত্রে এক তালাক ধর্তব্য করবেন?
যদি জবাবে সে বলে ‘হ্যাঁ’ আমি এক তালাক মনে করি। তবে তার থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
যদি বলে না আমি এক তালাক মনে করি না। তাহলে আমি তাকে বলব, কিভাবে তার বিরোধিতা কর, যা সহিহ মুসলিম দ্বারা প্রমাণিত। যদি বলে এব্যাপারে অন্যান্য সাংঘর্ষিক দলিল রয়েছে। তাহলে আমি বলব আমাদের আলোচ্য মাসআলাটিকেও সেরকম মনে কর।
والمقصود من سياق هذا كله انه ليس كل حديث فى صحيح مسلم يقال بمقتضاه لوجود المعارض له-
অর্থ: পূর্বে উল্লেখিত আলোচনার মকসুদ হলো যে, মুসলিমশরীফে বর্ণিত সকল হাদিস তার মর্মার্থ অনুযায়ী গ্রহণ করা হয় না। যখন এর সাংঘর্ষিক অন্য কোন দলিল বিদ্যমান থাকে।
Home
»
কিতাবঃ মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তফা (ﷺ)
» কিতাবঃ (পর্ব ১৪) মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তফা (ﷺ)