আরো কয়েকটি হাদীস সম্পর্কে :
১.হযরত জাবের রা.এর হাদীস :
হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা ইমামের পেছনে জোহর ও আসরে প্রথম দু’রাকআতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ করতাম, আর শেষ দু’রাকআতে সূরা ফাতিহা পাঠ করতাম। (ইবনে মাজাহ, হা. নং ৮৪৩)
এ হাদীসটি দিয়ে দলিল দেওয়া হয় যে, সিররী নামাযে সূরা ফাতিহা তো পড়া যাবেই, সেই সঙ্গে মুক্তাদি অন্য সূরাও পড়তে পারবে।
কিন্তু দলিল দেওয়ার পূর্বে হাদীসটিকে সহীহ প্রমাণিত করতে হবে। সনদের বিচারে কেউ কেউ সহীহও বলেছেন। কিন্তু এতে ‘ইমামের পেছনে’ (خلف الإمام)কথাটি সহীহ নয়। অর্থাৎ এটি মুক্তাদি সম্পর্কে নয়। একাকী নামায আদায়কারী সম্পর্কে। একটু বিস্তারিত বললে বিষয়টি এভাবে বলা যায়, এ হাদীসটি হযরত জাবের রা. থেকে তিনজন তাবিঈ বর্ণনা করেছেন। উবায়দুল্লাহ ইবনে মিকসাম, যুহরী ও ইয়াযীদ আল ফাকীর। উবায়দুল্লাহর বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন আবুদর রাযযাক (২৬৬১, ২৬৬২), তাহাবী (১২৪৮, ১২৪৯) ও ইবনুল মুনযির (আল আওসাত-১৩৩২)। এই বর্ণনার কোথাও ‘ইমামের পেছনে’ কথাটি নেই।
ইমাম যুহরীর বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন আব্দুর রাযযাক (২৬৫৬)। এ বর্ণনায়ও ‘ইমামের পেছনে’ কথাটি নেই।
ইয়াযীদ আল ফাকীর থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন দুজন: মিসআর ও শো’বা। মিসআর থেকে এটি বর্ণনা করেছন ওয়াকী, ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান, ইসমাঈল ইবনে আমর বাজালী, বুকায়র ইবনে বাক্কার ও মুআবিয়া ইবনে হিশাম: এই পাঁচ জন। ওয়াকীর বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আবু শায়বা (৩৭৪৯)। কাত্তানের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন তাহাবী (১২৫১) ও বায়হাকী, সুনানে কুবরায় (২৪৭৬) ও জুযুউল কিরাআতে (৪৭)। ইসমাঈলের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন আবু নুআইম হিলয়া গ্রন্থে (৭/২৬৯)। বুকায়র ইবনে বাক্কারের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন বায়হাকী জুযউল কিরাআতে (৩৫৯)। আর মুআবিয়া ইবনে হিশামের বর্ণনাটিও উদ্ধৃত করেছেন বায়হাকী তার জুযউল কিরাআতে (৪৮)। এসব বর্ণনার কোনটিতেই ‘ইমামের পেছনে’ কথাটি নেই।
বাকি রইল শোবার বর্ণনাটি। এটি শুধু ইমাম ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত করেছেন। এতে ‘ইমামের পেছনে’ কথাটি এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে, এটি একটি ভুল বর্ণনা। তবে এ ভুলের দায় শোবার উপর পড়বে না। পড়বে তার শিষ্য সাঈদ ইবনে আমেরের উপর। তিনি বিশ্বস্ত হলেও কিছু কিছু ভুলত্রুটির শিকার হতেন। আবু হাতেম রাযী বলেছেন,
كان رجلا صالحا وكان في حديثه بعض الغلط وهو صدوق
তিনি নেক মানুষ ছিলেন, তার হাদীসে কিছু কিছু ত্রুটি ছিল। তবে তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ ছিলেন।
এই সাঈদ ইবনে আমের অন্য একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন শো’বা থেকে, তিনি আব্দুল আযীয ইবনে সুহায়ব রহ.এর সূত্রে আনাস রা. থেকে। হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী মন্তব্য করেছেন,
لا نعلم أحدا رواه عن شعبة مثل هذا غير سعيد بن عامر وهو حديث غير محفوظ
সাঈদ ইবনে আমের ছাড়া শো’বা থেকে অন্য কেউ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন বলে আমরা জানি না। এ হাদীসটি সঠিক নয়। (তিরমিযী শরীফ, হা. ৬৯৪)
সুতরাং ‘ইমামের পেছনে’ কথাটিও সাঈদ ইবনে আমেরের ভুল। কারণ তিনি ছাড়া অন্য কেউ এ কথাটি উল্লেখ করেন নি। এ কারণটি ছাড়াও আরো এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় এটি একটি ভুল বর্ণনা। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো:
ক. সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জাবের রা. বলেছেন, ফাতিহা ব্যতীত নামায হয় না। তবে ইমামের পেছনে হলে সেকথা ভিন্ন। (অর্থাৎ তার নামায হয়ে যায়।)
খ. হযরত জাবের রা. নিজেও যে ইমামের পেছনে ফাতিহা পড়তেন না, এমনকি অন্যকেও পড়তে নিষেধ করতেন, সহীহ সনদে বর্ণিত বহু হাদীসে তার প্রমাণ রয়েছে। যেমন,
১. আব্দুর রাযযাক স্বীয় মুসান্নাফে (হা. ২৮১৮) দাউদ ইবনে কায়সের সূত্রে উবায়দুল্লাহ ইবনে মিকসাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা.কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ইমামের পেছনে জোহর ও আসরে কিছু পড়েন? তিনি বললেন, না। সনদটি সহীহ।
২. ইবনে আবু শায়বা স্বীয় মুসান্নাফে বর্ণনা করেছেন ওয়াকী থেকে, তিনি দাহহাক ইবনে উছমানের সূত্রে উবায়দুল্লাহ থেকে, তিনি জাবের রা. থেকে, তিনি বলেন, ইমামের পেছনে পড়বে না। (হা. ৩৭৮৬) সনদটি সহীহ।
৩. তাহাবী শরীফে আছে, ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন ইবনে ওয়াহাব থেকে, তিনি হায়ওয়াহ ইবনে শুরায়হ থেকে, তিনি বাক্র ইবনে আমর থেকে, তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে মিকসাম থেকে, তিনি ইবনে উমর, যায়দ ইবনে ছাবিত ও জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (এই তিন সাহাবী)কে জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, তুমি কোন নামাযেই ইমামের পেছনে পড়বে না। (হা. ১৩১২) সনদটি সহীহ।
গ. হাফেজ ইবনে হাজার দিরায়াহ গ্রন্থে বলেছেন,
وإنما يثبت ذلك عن ابن عمر وجابر وزيد بن ثابت وابن مسعود وجاء عن سعد وعمر وابن عباس وعلي رض
ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ না করা প্রমাণিত রয়েছে ইবনে উমর, জাবের, যায়দ ইবনে ছাবিত ও ইবনে মাসউদ রা. থেকে। এছাড়া সাদ, উমর, ইবনে আব্বাস ও আলী রা. থেকেও তেমনটা বর্ণিত হয়েছে।
২.হযরত আনাস রা.এর হাদীস:
রাসূল সা. তার সাহাবীগণকে নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে তাদের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ইমাম যখন কিরাআত পড়ে তখন কি তোমরা তোমাদের নামাযে ইমামের পেছনে কিরাআত পড়? তারা চুপ রইলেন। তিনি উক্ত কথা তিনবার বললেন। তখন তাদের একজন বা একাধিকজন বললেন, হ্যাঁ, আমরা এমনটি করি। তিনি বললেন, এমন করো না। তোমরা নীরবে সূরা ফাতিহা পাঠ করো। (সহীহ ইবনে হিব্বান, ১৮৪১; মুসনাদে আবু ইয়ালা, ২৮০৫)
এ হাদীসটির একজন রাবী হলেন আইয়ুব সাখতিয়ানী রহ.। তার থেকে উবায়দুল্লাহ ইবনে আমর আর রাক্কী এটি অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আর হাম্মাদ ইবনে যায়দ, হাম্মাদ ইবনে সালামা ও আব্দুল ওয়ারিছ ইবনে সাঈদ এটি মুরসাল বা সূত্রবিচ্ছিন্নরূপে বর্ণনা করেছেন। যেহেতু আইয়ুব সাখতিয়ানীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিষ্য হলেন হাম্মাদ ইবনে যায়দ, আবার তার সমর্থন করেছেন আরো দু’জন, তাই তার বর্ণনাই সঠিক বলে বিবেচিত হওয়া উচিৎ। বিশেষ করে এ কারণেও যে, উবায়দুল্লাহ বিশ্বস্ত হলেও ইবনে যায়দের সমপর্যায়ের নন। আবার ইবনে সাদ ও হাফেজ ইবনে হাজারের মতে তিনি মাঝেমধ্যে ভুল করে বসতেন। আর মুরসাল বর্ণনা লা-মাযহাবী বন্ধুদের নিকট গ্রহণযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য নয়।
তাছাড়া হতে পারে এ হাদীসে মনে মনে পড়তে বলা হয়েছে, মুখে উচ্চারণ করে নয়। যদিও লেখক বাক্যটির অনুবাদে বলেছেন, ‘নীরবে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে’, কিন্তু এটি এর একমাত্র তরজমা নয়। শায়খ আলবানীর সিফাতুস সালাত গ্রন্থের অনুবাদেও বলা হয়েছে, মনে মনে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। (দ্র. ৮৪ পৃষ্ঠার টীকা।)
৩.যায়দ ইবনে ছাবিত রা.এর হাদীস
এটি পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ইমামের সঙ্গে কোন নামাযেই কিরাআত নেই।
এ হাদীসটি প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, তাছাড়া যায়েদ ইবনু ছাবেত (রাঃ) থেকে যে আছার বর্ণিত হয়েছে, সেখান থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কিরাআত বলতে সূরা ফাতিহা নয়। যেমন ইমাম নববী বলেছেন। যায়েদের কথাই প্রমাণ বহন করে যে, সেটা সূরা ফাতিহার পরের সূরা যা জেহরী ছালাতে পড়া হয়।
কিন্তু কিভাবে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় লেখক তা পরিস্কার করে বলেন নি। ইমাম নববীর কথা এনেছেন তাও ভুল তরজমা করে। টীকায় আরবী উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে:ان قول زيد محمول على قراءة السورة التي بعد الفاتحة في الصلاة الجهرية
অর্থাৎ যায়দ রা.এর বক্তব্য ধর্তব্য হবে জাহরী নামাযে সূরা ফাতিহার পরের সূরা পাঠ করার ক্ষেত্রে।
এ ‘ধর্তব্য হবে’ (محمول) কে মুযাফফর সাহেব ‘প্রমাণ বহন করে’ বলে তরজমা করেছেন। এতেও বোঝা যায়, তিনি আরবী ভাষায় কেমন পাকা!
ইমাম নববী ছিলেন শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী। তিনি তার ইমামের মতের সমর্থনে এমন ব্যাখ্যা দিতেই পারেন। তাঁর পূর্বে একই মাযহাবের অনুসারী ইমাম বায়হাকী আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হলো: وهو محمول على الجهر بالقراءة مع الإمام এটি ধর্তব্য হবে ইমামের সঙ্গে জোরে জোরে পাঠ করার ক্ষেত্রে।
এ ব্যাখ্যাটিকে আলবানী সাহেব প্রচ-ভাবে রদ করেছেন সিলসিলা যঈফা গ্রন্থে (২/৪২১)। ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে শাফেঈ মাযহাব অনুসারীদের এহেন অস্থিরতাই প্রমাণ করে এর একটিও ঠিক নয়।
তাছাড়া রুকু পেলে রাকাত পাওয়া হবে কি না, এ মাসআলায় ইমাম বুখারী তার জুযউল কিরাআতে বলেছেন,
إنما أجاز زيد بن ثابت وابن عمر والذين لم يروا القراءة خلف الإمام
যায়দ ইবনে ছাবিত, ইবনে উমর রা. ও অন্যান্য যারা ইমামের পেছনে কিরাআত (সূরা ফাতেহা) পড়ার পক্ষপাতী নন, তারাই (রাকাআত পাওয়াকে) সঠিক আখ্যা দিয়েছেন।
ইমাম বুখারী উক্ত গ্রন্থে আলী ইবনুল মাদীনী রহ.এর এ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন যে,
إنما أجاز إدراك الركوع من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم الذين لم يروا القراءة خلف الإمام منهم ابن مسعود وزيد بن ثابت وابن عمر
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের মধ্যে যারা ইমামের পেছনে কিরাআত (সূরা ফাতেহা) পড়ার মত পোষণ করেন তারাই রুকু পাওয়াকে সঠিক বলে মত দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইবনে মাসউদ, যায়দ ইবনে ছাবিত, ও ইবনে উমর রা.। (নং ৯৫)
একটু ভেবে দেখুন, এই ‘কিরাআত’ বলে তারা কোন কিরাআত বুঝিয়েছেন? সূরা ফাতিহা পাঠ করা নয় কি?
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.এর হাদীস :
তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে সরবে কিরাআত পড়তেন। তাই তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা আমার কুরআন পাঠে জট সৃষ্টি করলে। (আবু ইয়ালা, ৫৩৯৭; জুযউল বুখারী, ১৫৪)
আলবানী সাহেব এ হাদীসটির সনদকে হাসান আখ্যা দিয়েছেন, এবং এর দ্বারা সিররী নামাযে মুক্তাদির কিরাআত পাঠ বৈধ হওয়ার প্রমাণ পেশ করেছেন।
কিন্তু এটিকে সহীহ বা হাসান বলা মুশকিল। কারণ এর সনদের গোড়ার দিকে রয়েছেন ইউনুস ইবনে আবু ইসহাক। তার থেকে এটি বর্ণনা করেছেন তার পাঁচজন শিষ্য।
১.আবু আহমাদ যুবায়রী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল আসাদী (ইবনে আবু শায়বা, ৩৭৭৮; মুসনাদে আহমদ, ৪৩০৯; মুসনাদে বাযযার, ২০৭৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা, ৫০০৬; জুযউল বায়হাকী, ৩৬৮)।
২.হাজ্জাজ ইবনে মুহাম্মদ (মুসনাদে সাররাজ, ১৮৯)।
৩.বুকায়র ইবনে বাক্কার (জুযউল বায়হাকী, ৩৬৫)।
৪.হাসান ইবনে কুতায়বা (প্রাগুক্ত)।
এই চারজনের কারো বর্ণনাতেই সরবে পড়ার কথা নেই।
৫.নাদর ইবনে শুমাইল।
তার থেকে চারজন বর্ণনাকারীর একজন অর্থাৎ খাল্লাদ ইবনে আসলামের (বাযযার, ২০৭৯) বর্ণনায়ও ‘সরবে’ কথাটি নেই। বাকি তিনজনের বর্ণনায় ঐ শব্দটি এসেছে। সুতরাং এটা শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা, যা সহীহ হতে পারে না। আর ঐ শব্দটি না হলে হাদীসটির মর্ম দাঁড়াবে নীরবে কিরাআত পড়তেও রাসূল সা. অপছন্দ করেছেন।
৫. আলী রা.এর হাদীস :
মুক্তাদির কিরাআত পড়ার পক্ষে হযরত আলী রা.এর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে (২৬৫৬), মুসান্নাফে ইবনে আবূ শায়বায় (৩৭৪৭, ৩৭৭৪), জুযউল বুখারী (পৃ. ৫) ও সুনানে দারাকুতনীতে (১/৩২২)। এটির সনদ সহীহ। তবে বক্তব্যটি বিভিন্ন শব্দে এসেছে। কোথাও বলা হয়েছে ইমাম ও মুক্তাদি জোহর ও আসরে প্রথম দু’রাকআতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে। আর শেষ দু’রাকআতে সূরা ফাতিহা পড়বে। আরেক বর্ণনায় এসেছে, জোহর ও আসরে ইমামের পেছনে প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ কর। তবে আব্দুর রাযযাক রহ. স্বীয় মুসান্নাফে হাদীসটি এভাবে উদ্ধৃত করেছেন: আলী রা. জোহর ও আসরে প্রথম দু’রাকআতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়তেন। আর শেষ দু’রাকআতে শুধু সূরা ফাতিহা পড়তেন। এখানে ইমামের পেছনে কথাটি নেই। আব্দুর রাযযাক এটি উদ্ধৃত করেছেন নামাযে কিরাআত কিভাবে হবে: এই অনুচ্ছেদে।
এ তিনটি বর্ণনার সনদ বা সূত্র উপরের দিকে এক। অর্থাৎ ইমাম যুহরী বর্ণনা করেছেন উবায়দুল্লাহ থেকে, তিনি আলী রা. থেকে বা আলী রা. সম্পর্কে। ১ম বর্ণনাটি আব্দুল আলা তার চাচার সূত্রে যুহরী থেকে করেছেন। আব্দুল আলা থেকে নিয়েছেন ইবনে আবু শায়বা (হা. ৩৭৪৭)। ২য় বর্ণনাটি করেছেন আব্দুল আলা স্বীয় উস্তাদ মামার রহ.এর সূত্রে ইমাম যুহরী থেকে। আব্দুল আলা থেকে নিয়েছেন ইবনে আবু শায়বা (হা. ৩৭৭৪)। আর ৩য় বর্ণনাটি করেছেন আব্দুর রাযযাক স্বীয় উস্তাদ মামার রহ. এর সূত্রে যুহরী থেকে (হা. ২৬৫৬)।
সূত্রের বিচারে আব্দুর রাযযাকের বর্ণনাটি অগ্রগণ্য। কারণ মা’মার হলেন যুহরীর বিশিষ্ট শিষ্য, আর আব্দুর রাযযাক হলেন মা’মারের বিশিষ্ট শিষ্য। আব্দুর রাযযাক এ বর্ণনাটি যে অনুচ্ছেদে এনেছেন তা একটু পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, ইমামের পেছনে পড়ার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। অপরদিকে ইমামের পেছনে কিরাআত না পড়া সংক্রান্ত আলী রা.এর একটি বক্তব্য সহীহসূত্রে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়ার পক্ষপাতী ছিলেন না।
৬. উবাদা ইবনুস সামিত রা.এর হাদীস
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে এমন নামায পড়লেন, যে নামাযে সরবে কিরাআত পড়তে হয়। অতঃপর বললেন, আমি যখন সরবে কিরাআত পড়ব, তখন তোমাদের কেউ সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্য কিছু পড়বে না। জুযউল বুখারীসহ অনেক হাদীসগ্রন্থে এটি উদ্ধৃত হয়েছে।
কিন্তু এ হাদীসটি সহীহ নয়। ইমাম আহমদ, ইবনে আব্দুল বার, ইবনে তায়মিয়া, ইবনে রজব হাম্বলী, আল্লামা কাশমিরী ও আলবানী প্রমুখ এ হাদীসকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন। (দ্র. ফাসলুল খিতাব, পৃ. ১৩৯ ও সহীহ ইবনে খুযায়মার টীকা, হা. ১৫৮১)
৭. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.এর হাদীস
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তোমরা কি আমার পেছনে কিরাআত পড়? তারা বললেন, হ্যাঁ, আমরা চটজলদি পড়ে নিই। বললেন, তোমরা এমনটি করবে না, তবে সূরা ফাতিহা (এর ব্যতিক্রম)। (জুযউল বুখারী, ৩৩)
এ হাদীসটিও সহীহ নয়। ইবনে আব্দুল বার তামহীদ গ্রন্থে এটিকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন। এর কারণ, এটি বর্ণনা করেছেন আমর ইবনে শুআইব তদীয় পিতার সূত্রে দাদা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে। কিন্তু ইমাম আওযাঈর বর্ণনামতে আমর ইবনে শুআইব এটি বর্ণনা করেছেন তদীয় পিতার সূত্রে উবাদা রা. থেকে। এটাকে ইযতিরাব (একেক সময় একেক রকম বলা) বলা হয়, যা বর্ণনাটিকে দুর্বল করে দেয়। হাফেজ ইবনে তায়মিয়ার মতেও এটি দুর্বল। (দ্র. মাজমূউল ফাতাওয়া, ২/২৯৯)
তাছাড়া হযরত উবাদা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.এর হাদীস দুটিতে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ ফরজ হওয়ার কোন প্রমাণ নেই। বড়জোর এতে বৈধতা দান করা হয়েছে। সুতরাং এদুটি দিয়ে প্রমাণ পেশ করা লা-মাযহাবী বন্ধুদের জন্য যথেষ্ট হবে না।