প্রশ্ন-উত্তর শানে আউলিয়াকেরাম
প্রথম প্রশ্নের উত্তর ঃ
‘বাবা’ এই শব্দটা কেবল মাত্র জন্মদাতা বাবার জন্য খাস নয়। বাবা বলে কাউকে ডাকলেই তার মানে সে জন্মদাতা বাবা তা নয় এর উদাহরণ আমরা আসে পাশে ও নিজের পরিবারে লক্ষ্য করতে পারি। আমার ছোট শিশু বাচ্চাদের স্নেহ ভালো দিয়ে ‘বাবা শোনো’ ‘বাবা এসো’ ইত্যাদি বলি অতএব এখানে শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা ‘বাবা’ শব্দটি স্নেহ ভালোবাসার উদ্দেশ্যে ব্যাবহার করছি। আমরা চাচা কাকা নিজের জন্মদাতা বাবার নিজের ও দূর সম্পর্কের ভাইদেরকে আমরা ‘বড় বাবা,ছোট বাবা,মেজো বাবা’ ইত্যাদি ভাবে ডেকে থাকি ।এখানে আমরা ‘বাবা’ শব্দটি কাকা বা চাচা এই অর্থে ব্যাবহার করছি । এই সব ক্ষেত্রে যখন আমরা পরিবার ও সমাজে ‘বাবা’ শব্দটি ব্যবহার করছি তখন তাতে কোন দোষ ওহাবী দেওবন্দী নবী ওলির দূশমনরা দেখতে পাইনা যখন কোন আল্লাহর ওলির ক্ষেত্রে যেমন ‘খাজা বাবা’ ‘দাতা বাবা’ ‘পীরবাবা’ ইত্যাদি ব্যাবহার করা হয় তখন আর তাদের সহ্য হয়না তখন হয়ে যায় দোষ ?
আমি প্রথমেই কুর’আন শরীফের একটি আয়াত দিয়ে পোস্ট শুরু করেছি সেটি হলো পারা ১৭,সূরা আল- হজ্ব-আয়াত-৭৮ এখানে আল্লাহ এব্রাহিম আলাইহিস সাল্লামকে মুসলমানঅদের বা জাতির পিতা বলে ঘোষণা করেছেন, কিন্তু তিনিও তো আমাদের জন্মদাতা বাবা না তবুও কেন আল্লাহ ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম কে জাতির বাবা বলে ঘোষণা করেছেন ?
Quote from the Holy Qur’an: Al-Ahzaab (33:6)
النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ ۗ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ إِلَّا أَنْ تَفْعَلُوا إِلَىٰ أَوْلِيَائِكُمْ مَعْرُوفًا ۚ كَانَ ذَٰلِكَ فِي الْكِتَابِ مَسْطُورًا
এই নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক অন্তরঙ্গ, আর তাঁর পত্নীগণ হচ্ছেন তাদের মাতা। আর গর্ভজাত সম্পর্কধারীরা — তারা আল্লাহ্র বিধানে একে অন্যে অধিকতর নিকটবর্তী মুমিনদের ও মুহাজিরদের চাইতে, তবে তোমরা যেন তোমাদের বন্ধুবর্গের প্রতি সদাচার করো। এমনটাই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
উল্লেখিত আয়াতে এখন প্রশ্ন জাগে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম) ’র পবিত্র স্ত্রীগণ যদি মুমিন মুসলমানের মাতা হন,তাহলে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম) কি? নিঃসন্দেহে এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়,নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম) তা হলে বাবা। এই রকম হাদিস শরীফেও আমরা অনেক লক্ষ্য করি।
باب فِي ذَرَارِيِّ الْمُشْرِكِينَ
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ رَجُلاً، قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيْنَ أَبِي قَالَ ” أَبُوكَ فِي النَّارِ ” . فَلَمَّا قَفَّى قَالَ ” إِنَّ أَبِي وَأَبَاكَ فِي النَّارِ ” .
পরিচ্ছদঃ ১৮. মুশরিকদের সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে।
৪৬৪৩. মূসা ইবন ইসমাঈল রহমাতুল্লাহ আলাইহি ………. আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা কোথায়? তিনি বলেনঃ তোমার পিতা জাহান্নামে। যখন সে চলে যাচ্ছিল, তখন তিনি বলেনঃ আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে।
সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ)
হাদিস নম্বরঃ [4643]
অধ্যায়ঃ ৩৫/ সুন্নাহ (كتاب السنة)
উপরিউক্ত হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার পিতা বলতে আবু লাহাবকে বলেছেন।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় নবী আলাইহিস সাল্লাম, চাচা ,কাকা, ছোট, স্নেহাশিষ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমারা ‘বাবা’ শব্দটি ব্যাবহার করতে পারি। তবে আমরা কেন আল্লাহর ওলিদের ক্ষেত্রে বা পীর মাশায়েখদের ক্ষেত্রে যাদের কাছ থেকে আমরা শরীয়ত ও মারিফতের জ্ঞান লাভ করি তাদের সম্মানে বাবা শব্দটি ব্যাবহার করতে পারবো না ?
যেখানে আল্লাহ ওলি দের সমন্ধে বলেছেন
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন,
” আলা ইন্না আওলিয়া আল্লাহি লা খাওফুন আ ’লাইহিম ওয়া লাহুম ইয়াহ্ঝানুন। আল্লাযীনা আ ’মানূ ওয়া কানূ ইয়াত্তাকানূন।” অর্থ- “জেনে রাখ নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলিদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। সূরা ইউনুস ১০: ৬২- ৬৩।
”নিশ্চয়ই তোমাদের ওলি হলেন আল্লাহ এবং তাঁর রসুল আর ঈমানদার লোকেরা- যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দিয়ে দেয়, এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত বাধ্যগত থাকে। যারা ওলি মানে আল্লাহকে এবং আল্লাহর রসুলকে আর ঈমানদার লোকদেরকে, তারাই আল্লাহর দল এবং আল্লাহর দলই থাকবে বিজয়ী”। (সূরা আল মায়িদা,আয়াত-৫৫-৫৬)”
অবশ্যই “পীরবাবা” ‘খাজা বাবা’ ‘দাতা বাবা’ বলা জায়েয রয়েছে।
দ্বিতয় প্রশ্নের উত্তর ঃ
বাবা থাকতে পীর ধরা বা পীরের হাতে বায়াত হওয়া কেমন ? এর উত্তর আমাদের জানতে আমাদেরকে আগেই জানতে হবে পীর ধরা বা পীরের হাতে বায়াত হওয়ার কারণ কি?আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻣَﻊَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ
অনুবাদ-হে মুমিনরা! আল্লাহকে ভয় কর,
আর সৎকর্মপরায়নশীলদের সাথে থাক।
{সূরা তাওবা-১১৯)
এ আয়াতে কারীমায় সুষ্পষ্টভাবে বুযুর্গদের সাহচর্যে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ﺍﻫْﺪِﻧَﺎ ﺍﻟﺼِّﺮَﺍﻁَ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﺻِﺮَﺍﻁَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻤْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ
অনুবাদ- আমাদের সরল সঠিক পথ [সীরাতে মুস্তাকিম] দেখাও। তোমার নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের পথ। {সূরা ফাতিহা-৬,৭}
সূরায়ে ফাতিহায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামাতপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম। আর তার নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দা হলেন-
ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻴِّﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺼِّﺪِّﻳﻘِﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀِ
ﻭَﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ
অনুবাদ-যাদের উপর আল্লাহ তাআলা নিয়ামত দিয়েছেন, তারা হল নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, ও নেককার বান্দাগণ। {সূরা নিসা-৬৯}
এ দু’আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে,নিয়ামতপ্রাপ্ত
বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ, আর তাদের পথই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ তাদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলা হয়ে যাবে। যেহেতু আমরা নবী দেখিনি, দেখিনি সিদ্দীকগণও, দেখিনি
শহীদদের। তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের কুরআন সুন্নাহ থেকে বের করে সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলার চেয়ে একজন পূর্ণ শরীয়তপন্থী হক্কানী বুযুর্গের অনুসরণ করার দ্বারা সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলাটা হবে সবচেয়ে সহজ। আর একজন
শরীয়ত সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করার নামই হল পীর মুরিদী। রাসূলে কারীম ﷺ একাধিক স্থানে নেককার ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন-
ﻋﻦ ﺃﺑﻲ ﻣﻮﺳﻰ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ
ﻗﺎﻝ
( ﻣﺜﻞ ﺍﻟﺠﻠﻴﺲ ﺍﻟﺼﺎﻟﺢ ﻭﺍﻟﺴﻮﺀ ﻛﺤﺎﻣﻞ ﺍﻟﻤﺴﻚ ﻭﻧﺎﻓﺦ ﺍﻟﻜﻴﺮ
ﻓﺤﺎﻣﻞ ﺍﻟﻤﺴﻚ
ﺇﻣﺎ ﺃﻥ ﻳﺤﺬﻳﻚ ﻭﺇﻣﺎ ﺃﻥ ﺗﺒﺘﺎﻉ ﻣﻨﻪ ﻭﺇﻣﺎ ﺃﻥ ﺗﺠﺪ ﻣﻨﻪ ﺭﻳﺤﺎ ﻃﻴﺒﺔ
ﻭﻧﺎﻓﺦ ﺍﻟﻜﻴﺮ
ﺇﻣﺎ ﺃﻥ ﻳﺤﺮﻕ ﺛﻴﺎﺑﻚ ﻭﺇﻣﺎ ﺃﻥ ﺗﺠﺪ ﺭﻳﺤﺎ ﺧﺒﻴﺜﺔ )
অনুবাদ- হযরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে
বর্ণিত। রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন-সৎসঙ্গ আর অসৎ সঙ্গের উদাহরণ হচ্ছে মেশক বহনকারী আর
আগুনের পাত্রে ফুঁকদানকারীর মত। মেশক বহনকারী হয় তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা
তুমি নিজে কিছু খরীদ করবে। আর যে ব্যক্তি আগুনের পাত্রে ফুঁক দেয় সে হয়তো তোমার
কাপড় জ্বালিয়ে দিবে, অথবা ধোঁয়ার গন্ধ ছাড়া তুমি আর কিছুই পাবে না।
{সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫২১৪, সহীহমুসলিম,
হাদীস নং-৬৮৬০, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৩১৯০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৮৩১,
সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬১, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৪২৯৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৬৬০, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৭৭০, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২৬২২, মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস নং-১৩৭৭, মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-৫১৫}
এছাড়াও অনেক হাদীস নেককার ও বুযুর্গ
ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণের প্রতি তাগিদ বহন
করে। আর সবচে’ বড় কথা হল-বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষই দ্বীন বিমুখ। যারাও দ্বীনমুখী, তাদের অধিকাংশই কুরআন হাদীসের আরবী ইবারতই সঠিকভাবে পড়তে জানে না, এর অর্থ জানবেতো দূরে থাক। আর যারাও বাংলা বা অনুবাদ পড়ে বুঝে, তাদের অধিকাংশই আয়াত
বা হাদীসের পূর্বাপর হুকুম, বা এ বিধানের প্রেক্ষাপট, বিধানটি কোন সময়ের জন্য, কাদের
জন্য ইত্যাদী বিষয়ে সম্যক অবহিত হতে পারে না। তাই বর্তমান সময়ে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে কুরআন সুন্নাহ থেকে নিজে বের করে আল্লাহ
তাআলার উদ্দিষ্ট সীরাতে মুস্তাকিমে চলা বান্দার
জন্য কষ্টসাধ্য। তাই আল্লাহ তাআলা সহজ পথ বাতলে দিলেন একজন বুযুর্গের পথ অনুসরণ করবে, তো সীরাতে মুস্তাকিমেরই অনুসরণ হয়ে যাবে।
পীর হওয়ার জন্য শর্ত রয়েছে ১। সুন্নী ও সঠিক আক্বিদা হওয়া দরকার ,২।এতোটা জ্ঞান থাকা দরকার যে হাদিস কুর’আন ও কিতাব থেকে মাস’আলা মাসায়েল বের করে দিতে পারে,৩।ফাসিক না হওয়া ,৪। পীরের সিলসিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম পর্যন্ত পৌছানো নাতো ফায়েজ পৌছাবে না।
উপরিউক্ত গুনাবলী যদি জন্মদাতা বাবা মধ্যে থাকে তাহলে সেখানে আপনি পীরের হাতে বায়াত না হলেও হবে কিন্তু যদিও সে পীরের হাতে বায়াত গ্রহণ করে তাতে ক্ষতি নাই।কেননা যত শিক্ষক থাকে সে ততো ইলম অর্জন করতে পারবে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার তৌফিক দান করুক । আমীন সুম্মামীন। ওয়া আখিরুদাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।