নিজের পাতা জালে নিজেই আটক
লেখক হানাফী জাল হাদীস ধরার জন্য যেন জাল পেতেছেন। অবশেষে নিজের পাতা জালে নিজেই আটকা পড়েছেন। মানসুখ কাহিনী : ঐতিহাসিক মিথ্যাচার শিরোনামে তিনি রাসূল সা. যে সারাজীবন রফয়ে ইয়াদায়ন করেছেন তার প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে ইবনে উমর রা. বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করেছেন, যার শেষ বাক্যটি হলো আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করা পর্যন্ত তার ছালাত সর্বদা এরূপই ছিল।
এ হাদীসটি জাল। এর সনদে দু’জন রাবী আছেন, যাদের ব্যাপারে প্রচ- আপত্তি রয়েছে। একজন হলেন আব্দুর রহমান ইবনে কুরাইশ। দারাকুতনী আল মু’তালিফ গ্রন্থে (৪/১৮৭৯) বলেছেন, له أحاديث غرائب তার অজানা অচেনা কিছু হাদীস রয়েছে।
মীযানুল ইতিদাল গ্রন্থে যাহাবী ও লিসানুল মীযান গ্রন্থে ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন, اتهمه السليماني بوضع الحديث অর্থাৎ (মুহাদ্দিস) সুলায়মানী তাকে হাদীস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। অপর রাবী হলেন ‘ঈসমা ইবনে মুহাম্মদ আল আনসারী’। তার সম্পর্কে আবু হাতেম ও ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, كذاب يضع الحديث বড় মিথ্যুক, হাদীস জাল করতো। মুহাদ্দিস উকায়লী বলেছেন, يحدث بالبواطيل বাতিল ও অসত্য হাদীস বর্ণনা করতো। ইবনে আদী বলেছেন, وكل حديثه غير محفوظ وهو منكر الحديث তার সব হাদীসই বেঠিক, সে আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী।
আশ্চর্য হলেও সত্য, ড. আসাদুল্লাহ গালিবও তার ছালাতুর রাসূল ছা. গ্রন্থে এ জাল হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। (দ্র. পৃ. ১০৯)
আসল কথা কী, এ হাদীসটি তাদের খুবই দরকার। কারণ রাসূল সা. যে এক সময় একাধিক জায়গায় রফয়ে ইয়াদায়ন করতেন তা কোন হানাফী আলেম অস্বীকার করেন না। বরং তারা বলেন, রাসূল সা. ইন্তেকাল পর্যন্ত রফয়ে ইয়াদায়ন করেছেন এমন দাবির কোন দলিল নেই। এদিকে ইবনে মাসউদ রা. সহ একাধিক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে শুধু একবার হাত ওঠানোর কথা এসেছে। সেই সঙ্গে প্রবীন সাহাবী হযরত উমর, আলী ও ইবনে মাসউদ রা. সহ কূফার শত শত সাহাবীর শুধু একবার রফয়ে ইয়াদায়ন করেছেন। এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমৃত্যু রফয়ে ইয়াদাইন করেন নি। আর এজন্যই এমন একটি হাদীস জাল করা হয়েছে। ইবনে উমর রা.এর হাদীসটি বুখারী-মুসলিম সহ প্রায় হাদীসের সকল গ্রন্থেই উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু বায়হাকী ছাড়া তাদের কেউই এ অংশটি উল্লেখ করেন নি।
বাকি রইল, ইমাম বুখারী রহ. যে বলেছেন, ‘কোন সাহাবী থেকে রফা না করা প্রমাণিত নয়’, এ কথা ঠিক নয়। ইমাম বুখারীর শিষ্য ইমাম তিরমিযী পরিস্কার বলে দিয়েছেন, এটা একাধিক সাহাবী ও তাবিঈর মত (অর্থাৎ শুধু একবার রফয়ে ইয়াদায়ন করা)। এটাই সুফিয়ান ছাওরী ও কূফাবাসীর মত। ইমাম তিরমিযী ইমাম বুখারীর মতো একথাও বলেন নি যে, সকল সাহাবী তাবিঈ ও আলেমগণ রফয়ে ইয়াদাইনের ব্যাপারে একমত। তিনি বরং স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন,
وبهذا يقول بعض أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم منهم ابن عمر و جابر بن عبد الله و أبو هريرة و أنس و ابن عباس و عبد الله بن الزبير وغيرهم ومن التابعين الحسن البصري و عطاء و طاووس و مجاهد و نافع و سالم بن عبد الله و سعيد بن جبير وغيرهم
অর্থাৎ আর এটাই মত হলো কিছু আলেমের, সাহাবীগণের মধ্যে ইবনে উমর, জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ, আবু হুরায়রা, আনাস, ইবনে আব্বাস ও ইবনে যুবায়ের প্রমুখের মত। তাবিঈদের মধ্যে হাসান বসরী, আতা, তাউস, মুজাহিদ, নাফি, সালিম ও সাঈদ ইবনে জুবায়র প্রমুখের মত।
লেখক মুযাফফর বিন মুহসিন বলেছেন, রাফউল ইয়াদায়েনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমলটি জাল হাদীসের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। আর এর কারখানা ছিল ইরাকের কুফা ও বসরায়। তাই তিরমিযী বলেন, এটা সুফিয়ান ছাওরী ও কূফাবাসীর বক্তব্য।
এরই নাম হলো লা-মাযহাবী ফেতনা। কুফায় জাল হাদীসের কারখানা কখন থেকে হলো? সাহাবীযুগ থেকে? না তাবিঈদের যুগ থেকে? লেখক তা বলেন নি। সুফিয়ান ছাওরীর মতো হাদীসস¤্রাট কি করে জাল হাদীসের ফাঁদে আটকা পড়লেন? লেখক তাও বলেন নি। মুুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে নসর মারওয়াযী ও ইবনে আব্দুল বার ও তিরমিযী রহ.এর কথা থেকে তো বোঝা যায়, সব যুগেই কূফার এ আমল ছিল। তাহলে এত শত শত সাহাবী ও তাবিঈ কিভাবে জাল হাদীসের ফাঁদে আটকা পড়লেন? আর ইমাম বুখারী কিভাবে বললেন, আমি হাদীস শিক্ষার জন্য অন্যান্য শহরে কতবার গিয়েছি তা বলতে পারব, কিন্তু কূফা ও বাগদাদে কতবার গিয়েছি তার হিসাব দিতে পারব না? হাকেম আবু আব্দুল্লাহ যখন বিভিন্ন শহরের বিশ্বস্ত মুহাদ্দিসগণের পরিসংখ্যান দিলেন তার মারিফাতু উলূমিল হাদীস গ্রন্থে, তখন সর্বাধিক সংখ্যক মুহাদ্দিসের তালিকায় আসল কূফা নগরী, এরই বা কারণ কি?
আমাদের জানামতে এত বড় শক্ত ও জঘন্য কথা ইতিপূর্বে কেউ বলেন নি। কূফা নগরী যে মদীনা শরীফের পরে বৃহত্তম ইলমী নগরী ছিল সে কথা শুরুতেই আমরা বলে এসেছি। এছাড়া আসওয়াদ ও আলকামা রহ. দুজনই ছিলেন মুখাযরাম অর্থাৎ রাসূল সা. এর যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পান নি। তাই বড় বড় সাহাবীর কাছ থেকে হাদীস ও ইলম অর্জন করেছেন। একাধিকবার সফর করে কূফা থেকে মদীনায় গেছেন। হযরত উমর রা.এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.এর এ শীর্ষ দুই ছাত্র স্বীয় উস্তাদ থেকে শিখেছিলেন রুকু করার সময় দুহাত জোড় করে উভয় হাঁটুর মাঝখানে রাখতে হয়। কিন্তু মদীনায় গিয়ে তারা হযরত উমর রা. থেকে নিজেদের আমল সংশোধন করে নিয়েছিলেন। তখন থেকে তারা হাঁটুর উপর হাত রাখতে শুরু করলেন। রফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে কুফার জাল হাদীসের কারখানা দ্বারা তারা যদি প্রতারিত হয়ে থাকতেন, তাহলে মদীনা শরীফে যাওয়ার পর উমর রা. থেকে এটা কি সংশোধন করতে পারতেন না?
ইবনে আবী শায়বার মুসান্নাফে সহীহ সনদে তাদের থেকে বর্ণিত আছে, তারা শুধু প্রথম তাকবীরের সময়ই হাত তুলতেন। আর শুধু তারা কেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও আলী রা.এর সকল ছাত্র এমনটি করতেন। এটি ইবনে আবু শায়বা বর্ণনা করেছেন ওয়াকী ও আবু উসামা থেকে, তারা শোবা থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে। (নং ২৪৪৬) এর বর্ণনাকারীরা সকলে বুখারী ও মুসলিমের রাবী। তাহলে এটা কে জাল করল? হাদীস জালকারীর সূত্রেও কি ইমাম বুখারী-মুসলিম হাদীস নিয়েছেন? আব্দুল মালেক ইবনে আবজার মুসলিম শরীফের রাবী। তিনি বলেছেন, আমি শাবী, ইবরাহীম ও আবু ইসহাককে দেখেছি তারা শুধু নামাযের শুরুতেই হাত তুলতেন। (মুসান্নাফ, ২৪৫৪) এত বড় বড় ফকীহও জাল হাদীসের ফাঁদে পা দিলেন? এরা তিনজনই তো বুখারী ও মুসলিমের রাবী। শুধু কি তাই, তাহাবী বর্ণনা করেছেন ইবনে আবী দাউদ থেকে, তিনি আহমদ ইবনে ইউনুস (বুখারী-মুসলিমের রাবী) থেকে, তিনি আবু বকর ইবনে আইয়াশ থেকে, তিনি বলেছেন, আমি কোন ফকীহকেই কখনো এমনটা করতে দেখিনি যে, তারা প্রথম তাকবীর ছাড়া হাত উত্তোলন করতেন। (নং ১৩৬৭) এই আবু বকর ইবনে আইয়াশ বুখারী শরীফের রাবী। ১৯৩ বা ১৯৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তিনি কি মিথ্যা কথা বলেছেন? যদি তাই হয়, তবে ইমাম বুখারী কি মিথ্যুকের হাদীস নিয়েছেন?