১৩ রাকআতের ব্যাখ্যা
১৩ রাকআতের বর্ণনাটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাদের কেউ বলেছেন, এতে দু’রাকআত ইশার সুন্নত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ফজরের সুন্নতসহ ১৩ রাকআত বলা হয়েছে। মুযাফফর বিন মুহসিনও আলবানীর অনুসরণে এই দ্বিতীয় মতটিই উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এসব কথা নেই। এটা ১১ ও ১৩ এর গরমিলকে মিল দেওয়ার প্রচ্ষ্টো মাত্র। বুখারী শরীফে ১১৬৪ নং হাদীসে হযরত আইশা রা. বলেছেন, রাসূল সা. রাতে ১৩ রাকআত পড়তেন। অতঃপর যখন ফজরের আযান শুনতেন তখন হালকা দু’রাকআত পড়তেন। এই হাদীসে দেখা যায়, রাসূল সা. ফজরের সুন্নত ছাড়াই ১৩ রাকআত পড়তেন। এমনিভাবে মুসনাদে আহমাদ (২৫১৫৯) ও আবু দাউদ (১৩৬২) এর বর্ণনায় এসেছে, আইশা রা. বলেছেন, রাসূল সা. রাতের নামায পড়তেন চার ও তিন, ছয় ও তিন, আট ও তিন এবং দশ ও তিন রাকআত। তের রাকআতের বেশী পড়তেন না, সাতের কমও না।
ইবনে আববাস ও যায়দ ইবনে খালেদ রা.এর হাদীসেও তের রাকআতের কথা এসেছে। সুতরাং ইবনে ইসহাকের বর্ণনাটির উপরোক্ত ব্যাখ্যা ঠিক নয়। বিশেষত এ কারণেও যে, ইবনে ইসহাক তার বর্ণনাটি প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলেছেন, وهذا أثبت ما سمعت في ذلك وهو موافق لحديث عائشة في صلاة النبي صلى الله عليه وسلم بالليل এটি সর্বাধিক মজবুত বর্ণনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নামায সম্পর্কে আইশা রা.এর হাদীসের মোয়াফেক বর্ণনা এটি। (ইবনে নাসর, কিয়ামুল লাইল)
১১ ও ২৩ দুটি বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় বা ২৩ এর বর্ণনাটি অগ্রগণ্য হওয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নত আলেমগণের বক্তব্য একটু পরে উল্লেখ করা হচ্ছে। তাদের কেউই এভাবে সমন্বয় করেন নি যে, প্রথমে ২৩ রাকআতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পরে ১১ রাকআতের। এমনটি তারা বলতেও পারেন না। কারণ বারশত বছরের ইতিহাসে কোথাও ১১ রাকআত তারাবী পড়া হয়েছে, এমন কথা কোন কিতাবে নেই। এ কারণে শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রহ. যেখানে হযরত উমর রা. কর্তৃক তারাবীহ্র এন্তেজাম করা এবং পরবর্তীকালে এর আমল চালু হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, সেখানে ১১ রাকআতের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেন নি। তিনি বলেছেন,
فلما جمعهم عمر على أبي كان يصلي بهم عشرين ركعة ويوتر بثلاث وكان يخفف في القراءة بقدر ما زاد من الركعات لأن ذلك أخف على المأمومين من تطويل الركعات ثم كان طائفة من السلف يقومون بأربعين ركعة ويوترون بثلاث وآخرون بست وثلاثين وأوتروا بثلاث وهذا كله حسن سائغ.
উমর রা. যখন লোকদেরকে উবাই রা.এর ইমামতিতে একত্রিত করলেন, তখন তিনি (উবাই রা.) তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকআত পড়তে লাগলেন। এবং তিন রাকআত বেতের পড়তেন। যত রাকআত বৃদ্ধি পেয়েছিল তিনি সে হিসাবে কিরাআত হালকা করতেন। কারণ তা মুক্তাদীদের পক্ষে রাকআত দীর্ঘ করার তুলনায় সহজ ছিল। এরপর পূর্বসূরিদের এক জামাত ৪০ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআত বেতের পড়তে থাকেন। আরেক জামাত ৩৬ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআত বেতের পড়তে থাকেন। এসবই ভাল ও সিদ্ধ। (আল ফাতাওয়াল কুবরা, ২/১১৯)
একইভাবে সউদী আরবের প্রথম ও প্রধান মুফতী শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম বলেন,
وذهب أكثر أهل العلم كالإمام أحمد والشافعي وأبي حنيفة إلى أن صلاة التراويح عشرون ركعة لأن عمر لما جمع الناس على أبي بن كعب صلى بهم عشرين ركعة وكان هذا بمحضر من الصحابة فيكون كالإجماع. (الفتاوى والرسائل)
অর্থাৎ অধিকাংশ আলেম, যেমন ইমাম আহমদ শাফেঈ ও আবু হানীফার মত হলো, তারাবীহ ২০ রাকআত। কেননা উমর রা. যখন লোকদেরকে উবাই ইবনে কাবের অধীনে একত্রিত করলেন, তখন তিনি তাদেরকে নিয়ে ২০ রাকআত পড়েছিলেন। আর এটা হয়েছিল সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই। ফলে তা ইজমা বা ঐকমত্যের মতোই হয়ে গিয়েছিল। (আল ফাতাওয়া ওয়ার রাসাইল, ২/২৪৪)
দ্বিতীয় সনদটির আলোচনা
দ্বিতীয় সনদটি এনে তারা বুখারী শরীফের বঙ্গানুবাদের টীকায় মন্তব্য করেছেন, এই হাদীসটির সনদ যয়ীফ। হাদীসের সনদে ১.আবূ উসমান বাসরী রয়েছে, সে হাদীসের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত; ২. খালিদ ইবনে মুখাল্লাদ রয়েছে, সে যয়ীফ, তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত, তার কোন বর্ণনা দলিল হিসেবে গন্য নয়, তদুপরি সে ছিল শিয়া ও মিথ্যাবাদী (তাহযীব, ২য় খ-); ৩.ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা রয়েছে, তার সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত। (মিযানুল ই’তিদাল, তাহযীবুত তাহযীব, ২য় খ-)
কথাগুলো পড়ে আমি মাথায় হাত দিয়েছি। মনে মনে বলেছি, এদের কি আখেরাতের ভয়ও নাই? ভয় থাকলে তারা এমন ডাহা মিথ্যা কথা লিখল কিভাবে? এরা বর্ণনাকারীর নামও শুদ্ধ করে লিখতে পারে না। মাখলাদকে তারা মুখাল্লাদ বানিয়েছে। আবুল হাসনা কে আবুল হাসানা লিখেছে। রুফাই কে রাফে নামে উল্লেখ করেছে। এক পৃষ্ঠায় তিনটি ভুল। এত বড় বড় ডিগ্রীধারী সম্পাদকরা এমন ভুল করবেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
খালিদ ইবনে মাখলাদ ও ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা দুজনই বুখারী ও মুসলিম শরীফের রাবী । তাদের সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত হলে বুখারী ও মুসলিম শরীফে তাদের বর্ণিত হাদীসগুলোর কি দশা হবে? ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম কি মিথ্যুকের হাদীসও গ্রহণ করেছেন? হায়, হায়!!
পাঠক, সত্যি বলছি, যে কিতাব দুটির বরাত তারা দিয়েছেন, তাতে এসব কথার হদিস নেই। আরবী কোন কথাটির অর্থ যে তারা লিখেছেন ‘তার হাদীস প্রত্যাখ্যাত’ তা আমরা বুঝতে পারছি না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আমাদের এই বন্ধুরা মদীনা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী হাসিল করলেও তারা আরবীও বোঝেন না, বাংলাও না।
খালিদ ইবনে মাখলাদ বিশ্বস্ত ছিলেন
খালিদ কে উসমান ইবনে আবী শায়বা র., সালিহ ইবনে মুহাম্মাদ র., ইবনে হিব্বান র. ও ইবনে শাহীন র. প্রমুখ মুহাদদ্দিসগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইবনে মাঈন বলেছেন, ما به بأس অর্থাৎ তার ব্যাপারে কোন অসুবিধা নেই। আবূ দাউদ ও ইবনে হাজার র. তাকে সাদূক বা সত্যবাদী বলেছেন। ইবনে আদী র. বলেছেন,
هو عندي إن شاء الله لا بأس به
অর্থাৎ ইনশাআল্লাহ আমার দৃষ্টিতে তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। ইমাম বুখারী তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন।
হ্যাঁ, ইমাম আহমাদ র. প্রমুখ বলেছেন, له مناكير অর্থাৎ তার কিছু কিছু বর্ণনা আপত্তিকর। (সম্ভবত এ শব্দটির অর্থই তারা করেছেন- প্রত্যাখ্যাত)। ইবনে আদী র. ঐ ধরণের বর্ণনাগুলো উদ্ধৃতও করেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী র. ফাতহুল বারীর ভূমিকায় তার সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেছেন:
أما التشيع فقد قدمنا أنه إذا كان ثبت الأخذ والأداء لا يضره لا سيما ولم يكن داعية إلى رأيه
অর্থাৎ বাকি রইল তার শিয়া মত অবলম্বনের ব্যাপারটি । এসম্পর্কে আমরা পূর্বেই বলেছি, তিনি যখন হাদীস গ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে মজবুত ছিলেন, তাই তার শিয়া মতাবলম্বন ক্ষতিকর নয়। বিশেষ করে এ কারণে যে, তিনি তার মতবাদের প্রতি কাউকে দাওয়াত দিতেন না।
এসব কথা ‘তাহযীবুত তাহযীব’, ‘ফাতহুল বারী’ ও ‘মিযানুল ই’তিদাল’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি মিথ্যাবাদী ও তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত- এমন কথা কোন গ্রন্থেই নেই। কোন মুহাদ্দিসই তাঁর সম্পর্কে বলেননি। এটা তাঁর উপর লা-মাযহাবীদের জঘন্য অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।
যাহোক, তাঁর কিছু কিছু বর্ণনায় আপত্তি থাকলেও আলোচ্য হাদীসটি তার অন্তর্ভূক্ত নয়। কারণ প্রথমত, এতে আপত্তির কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, তিনি ছাড়াও অন্য সনদে ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।