প্রসঙ্গঃ মুসলমানদের বিজয় সত্ত্বেও সাময়িক বিপর্যয়, তিনটি মো’জেযা প্রকাশ
বদরের যুদ্ধের ১৩ মাস পর তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ বা ১৪ তারিখ শনিবার ওহোদের যুদ্ধ অনুষ্টিত হয়। বদরের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য কোরাইশরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। মহিলারা পুরুষদেরকে ধিক্কার দিতে লাগলো। তারা সাজ-সজ্জা ত্যাগ করে মাতমজারীতে মগ্ন হলো। আবু সুফিয়ান বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য ইতিপূর্বে একবার মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে দু’শো কোরাইশ বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল দূরে ওরাইজ নামক স্থানে পৌঁছে একজন আনসার মুসলমানকে শহীদ করে এবং খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দেয়। নবী করীম [ﷺ] দু’শ সাহাবী নিয়ে আবু সুফিয়ানকে ধাওয়া করলে সে সসৈন্যে পালিয়ে যায় এবং গমের বস্তা রাস্তায় ফেলে যায়। এ জন্য এ অভিযানের নাম দেয়া হয় ছাভিক বা ছাতুর যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের গ্লানি আবু সুফিয়ানকে আরও পাগল করে তুলে। সে এর প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত নারী ও তৈল স্পর্ষ করবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করে। এদিকে মদীনার ইহুদী ও মুনাফিকরা হুযুরের সাথে মদীনা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে গোপনে মক্কায় এসে আবু সুফিয়ানকে উত্তেজিত করে তুললো। মদীনা আক্রমণ করলে তারা সাহায্যেরও আশ্বাস দিলো। মক্কায় যুদ্ধ প্রস্তুতির সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। মহিলারা অশ্লীল গান গেয়ে পুরুষদেরকে ক্ষেপাতে লাগলো।
কুরাইশরা তিন হাজারের দূর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে রাওয়ানা দিল। সাথে মহিলারা গান গাইতে গাইতে অগ্রসর হতে লাগলো। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এবং খালেদ ইবনে ওয়ালীদের সেনাপতিত্বে কোরাইশ বাহিনী ওহোদের পাদদেশে “বাতনে ওয়াদী" নামক স্থানে একত্রিত হলো। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)- যিনি বদরের যুদ্ধে ধৃত হয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েবের পরিচয় পেয়ে মুসলমান হয়ে গোপনে মক্কায় অবস্থান করেছিলেন- তিনি কোরাইশদের এই সংবাদ পূর্বাহ্নেই গোপনে মদীনায় নবীজীর দরবারে পৌঁছি দিয়েছিলেন। নবী করীম [ﷺ] সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ সভায় বসলেন। বদর যুদ্ধের আলোকে নবী করীম [ﷺ] এবার মদীনা শহরে থেকেই দুশমনকে প্রতিরোধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু যুবক শ্রেণীর আনসারগণ আরয করলেন- “তারা আমাদের মাথার উপর চড়াও হয়ে আক্রমণ করবে- আর আমরা ঘরে বসে যুদ্ধ করবো- তা কী করে হয়? তারা আমাদেরকে কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করবে। এর চেয়ে ভাল হয়- যদি আপনি আমাদের নিয়ে শহরের বাইরে গিয়ে তাদের মোকাবিলা করেন।" নবী করীম [ﷺ] বললেন- তাহলে “ছাবয়ীন বি-ছাবয়ীন" অর্থাৎ- বদরের ৭০ কোরাইশের বদলে ৭০ মুসলমানের শাহাদাত হতে পারে। এভাবে হুজুর [ﷺ] ওহোদের ক্ষয়ক্ষতির কথা পূর্বেই বলে দিয়েছিলেন। এটাই তাঁর ইলমে গায়েবের প্রমাণ।
যুবকরা এতেও রাযী দেখে নবী করীম [ﷺ] তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। শুক্রবার দিন জুমআর নামাযান্তে এক ভাষণে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্যেরও আশ্বাস প্রদান করলেন। এতে যুবকরা খুশি হয়ে গেলেন। নবী করীম [ﷺ] হুজরা মোবারকে গিয়ে যুদ্ধের পোষাক পরিধান করে বের হয়ে আসলেন। বয়স্ক সাহাবাগণ নবী করীম [ﷺ]-এঁর প্রথম পরামর্শের যথার্থতা অনুধাবন করে আরয করলেন- "ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের যুবকরা প্রকৃত অবস্থা গভীরভাবে চিন্তা না করেই জোশের সাথে যা বলে ফেলেছে, সেজন্য আমরা দুঃখিত। আপনার ইচ্ছামতই আপনি ব্যবস্তা গ্রহণ করুন।" নবী করীম[ﷺ] এরশাদ করলেন- “যুদ্ধের পোষাক পরিধান করে আবার খুলে ফেলা কোন নবীর পক্ষে শোভনীয় নয়। নবী এবং তাঁর দুশমনদের মধ্যে আল্লাহর যা ইচ্ছা- তাই তিনি ফয়সালা করবেন।"
(এই বাণীর মধ্যে যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে অতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল। এটাই ইলমে গায়েব। যুবকদের উদ্দ্যেশে “৭০ এর বিনিময়ে ৭০" বলার মধ্যে ছিল ওহোদ যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে পরিষ্কার ইঙ্গিত। ওহাবীরা বলে -নবীজী যুদ্ধের পরিণাম জানলে যুদ্ধে যেতেন না। এটা তাঁদের অজ্ঞতারই পরিচয়।)
পরদিন সকালে অতি প্রত্যুষে ফযরের নামায সমাপ্ত করে নবী করীম [ﷺ] এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহোদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মোহাজির ডিভিশনের পতাকা দিলেন হযরত আলী (رضي الله عنه)-এঁর হাতে। আনসারগণকে দুই ডিভিশনে বিভক্ত করে খাযরায গোত্রের পতাকা দিলেন হোবাবা ইবনে মুনযের (رضي الله عنه)-এঁর হাতে এবং আউছ ডিভিশনের পতাকা দিলেন উসায়দ ইবনে হোযায়ের (رضي الله عنه)-এঁর হাতে। অগ্রগামী দলের নেতৃত্ব দিলেন সাআদ ইবনে মুয়ায ও সাআদ ইবনে উবাদা (رضي الله عنهما)। মদীনার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন অন্ধ সাহাবী হযরত আবদুলল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (رضي الله عنه)-এঁর উপর।
মধ্যপথ হতে মোনাফেক সর্দার আবদুলল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর তিনশ অনুসারী নিয়ে সটকে পড়লো এবং বললো-আমাদের পরামর্শ গ্রহণ না করে নবী করীম [ﷺ] এতবড় ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধের ময়দানে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- সুতরাং আমরা এর সাথে নেই। তাঁদের এই শঠতা ও হঠকারিতা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া এবং শত্রুকে উৎসাহিত করা। যেমন করেছিল মীর জাফর পলাশীর ময়দানে।
অবশিষ্ট ৭০০ মুসলমান প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও নবী করীম [ﷺ]-এঁর আশ্বাসবাণী এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে তাঁদের দিলে প্রশান্তি নাযিল- এই দুই জিনিস তাঁদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করলো। গোজামিলের চেয়ে গড়মিল অনেক ভাল। যুগেযুগে মুসলমানদের মধ্য হতেই কিছু সংখ্যক মোনাফেক মুসলমানদের চরম ক্ষতি সাধন করে থাকে। ওহোদের ময়দানে মোনাফেকরা নিজেদেরকে মুসলমানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে।
যুদ্ধ শুরুঃ
নবী করীম [ﷺ] ওহোদের মূল ভূমিতে ওহোদ পাহাড়কে পিছনে রেখে সৈন্য বাহিনী মোতায়েন করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (رضي الله عنه)-এঁর নেতৃত্বে ৫০ জনের তীরন্দাজ বাহিনীকে পাহাড়ের চূড়ায় মোতায়েন করা হলো। নবী করীম [ﷺ] তাঁদের প্রতি নির্দেশ দিলেন “জয় পরাজয়-কোন অবস্থাতেই তোমরা আপন স্থান ত্যাগ করবেনা-যে পর্যন্ত না আমি নির্দেশ দেই। এমনকি আমাদেরকে শহীদ হতে দেখলেও সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবেনা। বিজয়ের পর গণিমতের মাল সংগ্রহ করতে দেখেও স্থান ত্যাগ করবেনা।" (মাওয়াহেব)।
প্রথমে বিজয়ঃ
কোরাইশ বাহিনীর নেতৃত্বে খালিদ ও ইকরামা তাদের সৈন্য মোতায়েন করলো “ছাবখা" নামক স্থানে। উভয় পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। মোশরেকদের পক্ষে ২৩ জন নিহত হলো। আল্লাহর সাহায্যে মুসলমানগণ প্রথমে বিজয়ী হলো। কাফেরগণ পলায়ন করতে লাগল। কোরাইশ মহিলারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মুসলমানগণ কোরাইশ বাহিনীর পশ্চাদধাবন করলেন। তাদের ফেলে যাওয়া মাল সম্পদ ও অস্ত্রসস্ত্রসহ গণিমতের মাল সংগ্রহ করতে লাগলেন।
মধ্যখানে বিপর্যয়ঃ
সুস্পষ্ট বিজয় দেখে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়োজিত তীরন্দাজ বাহিনীর ৫০ জনের মধ্যে ৪২ জন নীচে নেমে এসে গণিমতের মাল সংগ্রহ করতে লেগে গেলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর (رضي الله عنه)-এঁর সাথে মাত্র ৭ জন লোক নিজ নিজ দায়িত্বে অটল রইলেন।
দূর থেকে সুচতুর খালিদ বিন ওয়ালিদ এ অবস্থা দেখে পাহাড়ের ঘাঁটি অরক্ষিত পেয়ে বিদ্যুৎ বেগে ওহোদের পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করে বসলো এবং অবশিষ্ট ৮ জন তীরন্দাজকে শহীদ করে ফেললো। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলো। মুসলমানগণ এই আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো। কাফেরদের আক্রমণে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হয়ে গেলেন। স্বয়ং নবী করীম [ﷺ] শত্রুদের তীরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে গেলেন। এই বিপর্যয়ের কারণ ছিল হুজুর [ﷺ]-এর সুস্পষ্ট নির্দেশ ভুলক্রমে লঙ্ঘন করা।
হুজুর [ﷺ]-এঁর মুখের নিম্নপাটির সম্মুখভাগের দুটি দান্দান মোবারক কিয়দাংশ শহীদ হয়ে গেল। মাত্র ১৪ জন সাহাবী নবী করীম [ﷺ]-এঁর সাথে ছিলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর মুখ মোবারক থেকে যখন খুন বয়ে যাচ্ছিল, তখন আবু ছায়ীদ খুদরী (رضي الله عنه)-এঁর পিতা মালেক বিন সিনান (رضي الله عنه) জখমী জায়গায় মুখ লাগিয়ে খুন মোবারক চুষে খেয়ে ফেললেন - জমিনে পড়তে দিলেন না। তাঁর এই ভালবাসা দেখে নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করলেনঃ
من مس دمى دمه لم تصبه النار
অর্থঃ “আমার রক্ত যার রক্তের সাথে মিশেছে-তাকে জাহান্নাম স্পর্শ করবেনা।"
এই হাদীস থেকে মোজতাহিদগণ নবী করীম [ﷺ]-এঁর বদন মোবারক থেকে নির্গত যাবতীয় বর্জ বস্তুকে পাঁক পবিত্র বলে ফতোয়া দিয়েছেন।
উক্ত যুদ্ধে এক আনসারী মহিলার পিতা, ভাই ও স্বামী – তিনজনই শহীদ হন। মহিলা ওহোদের ঘটনা শুনে-বিশেষতঃনবী করীম [ﷺ]-এঁর শাহাদাতের ঘটনা শুনে যুদ্ধের ময়দানের দিকে দৌড়াতে লাগলেন। পথিমধ্যে মোজাহিদদের নিকট নিজ পিতা, ভ্রাতা ও স্বামীর শাহাদাতের খবর শুনে শুধু “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন" পড়ে নবী করীম [ﷺ] সুস্থ আছেন কিনা-তা জানতে চাইলেন। অবশেষে নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে হাযির হয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন- “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি জীবিত ও সুস্থ থাকলেই আমি সব শোক ভুলে যাব"। একেই বলে নবী প্রেমের বাস্তব নমুনা।
ওহোদের যুদ্ধে আহত ছয়জন সাহাবী পানি পানি করে কাতরাচ্ছিলেন। যখন তাঁদের প্রথমজনকে পানি পান করতে দেয়া হলো - তখন তিনি বললেন, আমার পাশের ভাইকে আগে পানি দিন, তিনি বেশী আহত। এভাবে ছয়জনই অপরজনকে আগে পানি পান করানোর অনুরোধ করলেন। কিন্তু কেহই পানি পান করতে পারলেন না। সবাই শহীদ হয়ে গেলেন। এ ছিল সাহাবাগণের পরস্পরের প্রতি আত্মত্যাগের নমুনা।
[আমাদের ঈমানী শক্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আমরা আজ মৃত ভাইয়ের মাংস পর্যন্ত তুলে নিচ্ছি। একজন আরেক জনকে ওভারটেক করছি। গাড়ীর ওভারটেকিং অপরাধ বলে গণ্য হলেও মানুষ ওভারটেকিংকে কোন অপরাধ বলেই মনে করছি না। সর্বত্রই এই অবস্থা। এই প্রবণতা আমাদেরকে মানবিক মূল্যবোধ থেকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।]
ওহোদের যুদ্ধে ওতবার গোলাম ওয়াহশীর বর্শার আঘাতে হযরত হামযা (رضي الله عنه) শহীদ হন। তাঁর শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে হিন্দা গলার মালা বানায় এবং কলিজা বের করে চিবাতে থাকে। পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের দিন এই মহিলা মুসলমান হয়ে যান। ওয়াহশীও মুসলমান হন। তবে নবী করীম [ﷺ] তাদেরকে ভবিষ্যতে তাঁর সামনে আসতে নিষেধ করে দেন। এই ওয়াহশী হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর খেলাফতকালে মোরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মোসায়লামা কাযযাবকে নিহত করে পূর্ব অপরাধের কিছুটা ক্ষতিপূরণ করেন।
ওহোদের যুদ্ধে প্রথমে মুসলমানদের বিজয় হলেও মধ্যখানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এর একমাত্র কারণ- হুজুর আকরাম [ﷺ]-এঁর সুস্পষ্ট নির্দেশ ভূলক্রমে লংঘন- যদিও তা ছিল সাহাবাগণের ইজতিহাদী ভুল। পরবর্তীকালে মুসলমানগণ আর কখনোও এমন ভুল করেন নি। আমরা আজ নবী করীম [ﷺ]-এঁর অসংখ্য নির্দেশ লংঘন করছি। তাই আমরা সংখ্যায় বেশী হয়েও ইহুদী-খৃষ্টান-হিন্দু প্রভৃতি বিজাতীর হাতে সর্বত্র মার খাচ্ছি। এর সংশোধন না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
ওহোদের যুদ্ধে তিনটি মোজেযা
প্রথম ঘটনাটি হলোঃ নবী করীম [ﷺ]-এঁর ফুফাতো ভাই ও সাহাবী হযরত আবদুলল্লাহ বিন জাহাশ (رضي الله عنه), যিনি বিবি যয়নাব (رضي الله عنه)-এঁর সহোদর ভাই ছিলেন – তাঁর তরবারীটি যুদ্ধ করতে করতে ভেঙ্গে যায়। নবী করীম [ﷺ] বিকল্প কোন তরবারী না পেয়ে একটি শুকনা খেজুরের ডাল তাঁর হাতে দিয়ে এর দ্বারাই যুদ্ধ করতে বললেন। খেজুর ডালটি তরবারীতে পরিণত হয়ে গেলো। ঐ তরবারীর নাম রাখা হল “উরজুন।" যুদ্ধে তিনি শহীদ হলে ঐ তরবারীটি তাবাররুক হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়। বাগদাদের আব্বাসীয় ৮ম খলিফা মো’তাসিম বিল্লাহর জনৈক বেগা তুর্কী আমীর উক্ত তরবারীটি হযরত আবদুলল্লাহ ইবনে জাহাশ (رضي الله عنه)-এঁর উত্তরাধিকারীগণের নিকট থেকে দু’শো দীনার দিয়ে খরিদ করে সংরক্ষণ করেন। হযরত আমির হামযা (رضي الله عنه) ও হযরত আবদুলল্লাহ ইবনে জাহাশ (رضي الله عنه)-কে ওহোদ ময়দানে একই কবরে দাফন করা হয়। তাঁরা উভয়ে মামা-ভাগ্নে ছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলোঃ ওহোদের যুদ্ধে হযরত কাতাদাহ ইবনে নো’মান (رضي الله عنه)-এঁর চক্ষু শত্রুর তীরের আঘাতে খসে পড়ে গালের উপর লটকাতে থাকে। তিনি চোখটি হাতে নিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে এসে আরয করলেন- "ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার ঘরে নতুন স্ত্রী রয়েছে। আমার চোখটি থাকা খুবই প্রয়োজন। আপনি মেহেরবানী করে আমার চোখটি ভাল করে দেন।" নবী করীম [ﷺ] ইরশাদ করলেন - “চোখ চাও, না বেহেস্ত চাও? চোখ শহীদ হলে বেহেস্ত পাবে।" হযরত কাতাদাহ (رضي الله عنه) আরয করলেন - “চোখও চাই, বেহেস্তও চাই।" বেহেস্ত দেবেন আল্লাহ, আর চোখটি ঠিক করে দেবেন আপনি।" (বেদায়া ও যিকরে জামীন)
নবী করীম [ﷺ] তার আবেদনে খুশী হয়ে গেলেন। তিনি সামান্য থুথু মোবারক লাগিয়ে ঝুলন্ত চোখটি যথাস্থানে বসিয়ে দিলেন, আর এই বলে দোয়া করলেনঃ اللهم اكسه جمالا “হে আল্লাহ! তার চোখটি সুন্দরভাবে ফিট করে বসিয়ে দিন।" সাথে সাথেই চোখটি জোড়া লেগে গেলো। উভয় চোখের মধ্যে এই চোখটি উত্তম ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। কেননা, আল্লাহর কুদরত তথা প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে নবী করীম [ﷺ]-এঁর মো’জেযা সংযুক্ত হলে তা দ্বিগুণ সম্পন্ন হয়।
তৃতীয় ঘটনাটি হলো- হযরত হানযালা (رضي الله عنه), যিনি নব বিবাহিত ছিলেন। শেষ রাত্রে যুদ্ধের ঘোষণা শুনেই তিনি বে-খেয়ালে নাপাক অবস্থায় যুদ্ধে বের হয়ে গেলেন। নবী প্রেমের আকর্ষণে তিনি সব মোহ ভুলে গেলেন। এই অবস্থায় তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। তাঁর নব পরিণীতা স্ত্রী যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নবী করীম [ﷺ]-কে ঘটনা খুলে বললেন এবং তাঁকে ফরয গোসল দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। শহীদগণকে রক্তমাখা অবস্থায়ই বিনা গোসলে কাফন-দাফন করতে হয়। গোসল দেয়ার নিয়ম নেই। এ অবস্থায়ই তাঁরা হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন। লোকেরা হযরত হানযালার লাশ মোবারক তালাশ করে পেলেন না। নবী করীম [ﷺ] ইরশাদ করলেনঃ “হানযালাকে ফেরেশতারা আকাশে নিয়ে বেহেস্তের পানি দ্বারা গোসল দিয়ে পুনঃফিরত নিয়ে আসছে।" সোবহানাল্লাহ!
নবীর প্রকৃত আশেকগণ এমনিভাবেই সম্মানিত হয়ে থাকেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর সাহাবীগণ এবং আশেকগণের জন্য কাল হাসরের দিনে পুলছিরাতের উপরে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দিবেন। আল্লাহ বলেছেন-
هذا لمن صحبك وأهل محبتك
“জিব্রাইলের পাখার উপর দিয়ে গমন করার এই সম্মান আপনার আশেকান ও সাহাবীগণকে দান করা হবে" (আল হাদীসুল কুদসী - মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া ও আনোয়ারে মোহাম্মাদীয়া)।
নবী করীম [ﷺ] যখন ৭০ জন শহীদকে দেখলেন, তখন তিনি কেঁদে ফেললেন এবং ভাব গদগদ কন্ঠে ইরশাদ করলেনঃ “আমি কাল রোজ হাশরে এঁদের জন্য সাক্ষ্য দেবো। যারা আল্লাহর জন্য রক্ত দান করে শহীদ হয়, তাঁরা হাশরের ময়দানে রক্তঝরা অবস্থায় উত্থিত হবে। ঐ রক্তের রং হবে লাল - কিন্তু সুগন্ধ হবে মেশক-আম্বরের চেয়েও অধিক।"
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) নবী করীম[ﷺ] থেকে বর্ণনা করেন- তোমাদের ভাইয়েরা যখন ওহোদের ময়দানে শহীদ হলেন, তাঁদের রুহ মোবারক সবুজ পাখীর সুরতে বেহেস্তের নহরের কুলে কুলে বেড়াতে লাগলো এবং বেহেস্তের ফল ভক্ষণ করতে লাগলো। আরশের তলে স্বর্ণের ঝালরবাতির নীচে তারা আশ্রয় গ্রহণ করলো। তাঁরা তাঁদের জন্য সংরক্ষিত এই উত্তম খানা-পিনা ও অবস্থান দর্শন করে বলতে লাগলোঃ “আমাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা যে ব্যবহার করলেন- এটা যদি আমাদের দুনিয়ার ভাইয়েরা জানতো, তাহলে তাঁরাও আল্লাহর পথে জেহাদ করতে কুন্ঠিত হতোনা।" আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ আমি তোমাদের এই সংবাদ আমার হাবীবের মাধ্যমে তোমাদের ভাইদের নিকট পৌঁছিয়ে দিচ্ছি। এই পটভূমিকায় আল্লাহ তায়ালা সুরা আলে-ইমরানের ১৭০ নং আয়াত নাযিল করেনঃ
وَلَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِيۡنَ قُتِلُوۡا فِىۡ سَبِيۡلِ اللّٰهِ اَمۡوَاتًاؕ بَلۡ اَحۡيَآءٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ يُرۡزَقُوۡنَۙ -
অর্থাৎ- “যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলে মনে মনে ধারণাও করোনা, বরং তাঁরা জীবিত এবং আল্লাহর নিকট তাঁর রিযিক প্রাপ্ত।" (আলে ইমরান-১৭০) সুরা বাক্কারাতে আছে অর্থাৎ শহীদগণকে মুখে মৃত বলো না। আর অত্র আয়াতে বলেছেন - মনে মনেও ধারণা করতে পারবে না।
বিঃ দ্রঃ নবীগণকে মৃত বলে ধারণা করাও কুফরী। কেননা, তাঁরা শহীদগণের চেয়েও উত্তম জীবনের অধিকারী। (আক্কায়েদ গ্রন্থসমূহ)। এটাই সঠিক ইসলামী আক্কিদা। কিন্তু ওয়াহাবীরা বলে- “নবীজী মরে পচে গলে মাটির সাথে মিশে গিয়েছেন" (তাকভিয়াতুল ঈমান ও ফতোয়ায়ে রশিদিয়া) নাউযুবিল্লাহ।