বদরের জিহাদ ছিল হক্ব ও বাতিলের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালাকালী যুদ্ধ। নবী করীম [ﷺ]-এঁর অসংখ্য মো’জেযা এতে প্রকাশ পায়। এই যুদ্ধ সংগঠিত হয় বদরের ময়দানে ১৭ই রমযান দ্বিতীয় হিজরীতে। বদর মদীনা শরীফ হতে সোজাপথে ৮০ মাইল পশ্চিম দক্ষিণে অবস্থিত। এক ব্যক্তির নাম ছিল বদর। সে একটি কূপ খনন করেছিল। তার নামানুসারে ঐ এলাকা ও কূপের নাম রাখা হয় বদর। ঘটনাক্রমে পরিকল্পনা ছাড়াই এই যুদ্ধ ঘটে যায়। ঘটনাটি নিম্নরূপঃ
নবী করীম [ﷺ]-এঁর হিজরত করে মদীনায় গমন এবং তথায় ইসলামের প্রসার দেখে মক্কার কোরাইশগণ জ্বলে পুড়ে মরে যাচ্ছিল। কিভাবে ইসলামের প্রসার রোধ করা যায় এবং কিভাবে মুসলমানদের শেষ করা যায়- এই ভাবনা তাদের পেয়ে বসে। তারা পরামর্শ করে স্থির করলো, যুদ্ধই ইসলামকে খতম করার একমাত্র উপায়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা প্রথমে অস্ত্র সংগ্রহ করার দিকে মনোযোগ দিল। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়ায় গমন করলো। মক্কার কোরাইশরা সোনা-চান্দি, গহনাপত্র ও অন্যান্য মাল-সামানা সিরিয়ায় প্রেরণ করলো। বিক্রয়লবদ্ধ অর্থ দ্বারা যুদ্ধাস্ত্র খরিদ করে আবু সুফিয়ানের কাফেলা মক্কার দিকে রওয়ানা দিলো। উক্ত কাফেলার নিরাপত্তার জন্য ৪০ জন অশ্বারোহী সাথে রাখলো।
তারা মদীনার কাছাকাছি পৌঁছলে হযরত জিব্রাইল عَلَیۡہِ السَّلَام নবী করীম [ﷺ]-কে উক্ত কাফেলার গতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বের হতে আরয করলেন। নবী করীম [ﷺ] মোহাজির ও আনসার মিলিয়ে মোট ৩১৩ জনের একটি দল নিয়ে আবু সুফিয়ানের অস্ত্র কাফেলার গতিরোধ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। আবু সুফিয়ান গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে লোহিত সাগরের উপকূল ধরে অন্য পথে দ্রুতগতিতে বিপজ্জনক স্থান অতিক্রম করে চলে গেলো। সে পূর্বেই গুপ্তচর মারফত মক্কায় আবু জাহলকে নবী করীম [ﷺ]-এঁর আগমনের খবর পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। নবী করীম [ﷺ] রাওহা নামক স্থানে পৌঁছে খবর পেলেন, আবু সুফিয়ানের অস্ত্র কাফেলা নিরাপদে উপকূল ধরে চলে গেছে। এ সময়ে আল্লাহ্ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-কে মক্কা থেকে আগত আবু জাহল বাহিনীর কথা জানিয়ে দিলেন এবং মোকাবেলার নির্দেশ দিলেন। বিজয়ের শুভ সংবাদও প্রদান করলেন। আল্লাহ পাক জিব্রাইল মারফত একথাও বলে পাঠালেন যে, “দু’টি দলের মধ্যে একটিতে তোমাদের বিজয় হবে।" (সুরা আনফাল, আয়াত-৭)। (প্রথম দল আবু সুফিয়ান এবং দ্বিতীয় দল আবু জাহল।)
এদিকে আবু জাহল আবু সুফিয়ানের কাফেলার সাহায্যার্থে এক হাজার লোকের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে রওয়না দিল। তার কাফেলায় ছিল ৭০০ উট এবং একশত ঘোড়া ও প্রচুর রসদ। যুদ্ধ কাফেলা প্রস্তুতকালে আবু জাহল উক্ত বাহিনীতে নবী করীম [ﷺ]-এঁর চাচা আব্বাস, দুই চাচাতো ভাই আকিল ও নওফেল এবং জামাতা আবুল আছকেও যোগদান করতে বাধ্য করলো। আব্বাসের নিকট থেকে চাঁদাস্বরূপ বিশ উকিয়া স্বর্ণ আদায় করা হলো। (এক উকিয়া তৎকালীন ৪০ দিনার ও বর্তমানে কয়েক লক্ষ টাকা)।
এ সময় শয়তান মানুষের রূপ ধারণ করে আবু জাহলকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহ দিতে লাগলো এবং বললো- “আমি মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী কেনানী গোত্রের লোক। আমার নাম সুরাকা বিন মালেক কেনানী। আমার এলাকা দিয়ে যাতায়াতকালে আপনার বাহিনীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং আমার গোত্রের লোকজন দিয়েও আপনাদের সাহায্য করা হবে।" (হিজরতের সময় এই সুরাকা কেনানী হুযুর [ﷺ]-কে ধরতে গিয়েছিলো) সুরা আনফাল ৪৮ নং আয়াতে শয়তানের এই কুমন্ত্রণা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবেঃ
وَاِذْ زَيَّنْ لَهُمُ الشَيْطَانَ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَاِنِّىْ جَارٌ لَكُم -
অর্থঃ- “হে রাসূল! স্মরণ করুন ঐ সময়ের কথা, যখন শয়তান আবু জাহলের বাহিনীকে এই বলে উৎসাহিত করছিলো যে, এই যুদ্ধে তোমাদের বিরুদ্ধে কেউ জয়লাভ করতে পারবে না, বরং তোমরাই হবে বিজয়ী এবং আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।" (সুরা আনফাল ৪৮ নং আয়াত)
শয়তান এভাবে প্ররোচনা দিয়ে আবু জাহলকে তার বাহিনীসহ তাদের মরণ ফাঁদ স্বরূপ বদর ময়দানে পৌঁছাতে সাহায্য করলো। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হলো এবং আসমান থেকে পাঁচ হাজার ফেরেশতা সৈন্য হিসেবে নেমে এসে নবী করীম [ﷺ]-এঁর সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিল, তখন শয়তান পিছু হঠতে আরম্ভ করলো। আবু জাহল বললো, কি ভাই! আমাদেরকে একা ফেলে তুমি কোথায় যাচ্ছো? তখন শয়তান বললো-
اِنِّىْ بَرِيْىِ مِّنْكُمْ اِنِّىْ اَرى مَا لَا تَرونَ اَخَافَ اللهُ وَاللهُ شَدِيْدَ الْعِقَابِ-
অর্থঃ- “আমি তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ালাম। কেননা, আমি যা দেখতে পাচ্ছি (ফেরেশতা দলকে) তোমরা তা দেখতে পাচ্ছ না। আমার অন্তরে খোদার ভীষণ ভয়। আর আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।"(সুরা আনফাল ৪৮ আয়াত)
এভাবে কুপরামর্শ দিয়ে শয়তান আবু জাহলকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিল। মানুষ শয়তানরাও এভাবে অন্যকে উসকানী দিয়ে পরে সরে দাঁড়ায়।
আবু জাহল সসৈন্যে রওয়ানা দিয়ে পথিমধ্যে গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেলো আবু সুফিয়ানের অস্ত্র কাফেলা সাগরের উপকূল ধরে নিরাপদে চলে এসেছে। আবু জাহলের দলের লোকজন বললো, এবার আর অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন নেই, মক্কায় প্রত্যাবর্তন করাই উত্তম। কিন্তু আবু জাহল নাছোড়বান্দা। সে বললো- আমরা বদর ময়দানে গিয়ে আনন্দ ফূর্তি করবো, শরাব পান করবো, গায়িকাদের গান শুনবো এবং বিরাট যিয়াপত দিয়ে তারপর মক্কায় প্রত্যাবর্তন করবো। (রুহুল বয়ান) একথা বলে সে বদর ময়দানের দক্ষিণ প্রান্তে মক্কার দিকে নিম্নভূমিতে সুবিধামত স্থানে তাঁবু স্থাপন করলো এবং আনন্দ ফূর্তিতে মেতে উঠলো। সে জানতোনা মুসলিম বাহিনী পূর্ব থেকেই রাওহায় অবস্থান করছেন।
আবু জাহলের বাহিনীর সংবাদ পেয়ে নবী করীম [ﷺ] ৩১৩ জন সাহাবা নিয়ে বদর ময়দানে মদীনার দিকের উত্তরাংশে উঁচু ভূমিতে এসে তাঁবু ফেললেন। কোরাইশদের বিরাট বাহিনী দেখে প্রথমতঃ মুসলমানদের মনে কিছুটা দূর্বলতা দেখা দিলো। কিন্তু নবী করীম [ﷺ] তাঁদেরকে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে বিজয়ের আশ্বাস দিয়েছেন। আমি কুরাইশদের ৭০ জন সর্দারের নিহত হওয়ার স্থানও দেখতে পাচ্ছি। একথা বলে নবী করীম [ﷺ] হাতের লাঠি দিয়ে এক একটি জায়গা চিহ্নিত করে বলতে লাগলেন- এটি আবু জাহেলের ভূলুন্ঠিত হওয়ার জায়গা, এটি উতবার, ঐটি অলিদের, অমুক জায়গা শায়বার বধ্যভূমি হবে ইত্যাদি।
যুদ্ধ শেষে সাহাবায়ে কেরাম عَلَیۡہِم الرِّضۡوَان নবী করীম [ﷺ]-এঁর গায়েবী সংবাদের সত্যতা বাস্তবে দেখার জন্য অনুসন্ধান করে দেখতে পেলেন, হুযুর আকরাম [ﷺ] যেখানে যার নাম ধরে জায়গা চিহ্নিত করেছিলেন, ঠিক সে জায়গাতেই তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল। নবী করীম [ﷺ]-এঁর আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েব দেখে সাহাবায়ে কেরামের ঈমান আরও দৃঢ় হয়ে গেলো। [মুসলিমঃ ২৮৭৩ এবং ৪৪৭০]
[কোরআনে আছে-(নবী ব্যতীত)“কোন মানুষই নিজে নিজে জানেনা-সে কোন্ স্থানে মারা যাবে"। এটা আল্লাহর ইলমে গায়েব যাতী সম্পর্কিত আয়াত। এটার সাথে রাসুলে পাকের [ﷺ] ইলমে গায়েব আতায়ীর কোন বিরোধ নেই। নবীজীর এ সম্পর্কিত ইলমে গায়েব সুরা নিসা ও সুরা জ্বীন-এ উল্লেখ করা হয়েছে।]
বদর ময়দানের যে অংশে নবী করীম [ﷺ] অবস্থান গ্রহণ করেন - সেটি ছিল যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত স্থান। কেননা, জায়গাটি ছিল বালুময় এবং পানিশূন্য। অপর দিকে, আবু জাহলের অংশ ছিল নিম্মভুমি এবং তাতে পানির সুবিধাও ছিল। আল্লাহর হুকুমে রাত্রে প্রচুর বৃষ্টি হলো। ফলে উচু ভুমির বালু হলো শক্ত এবং মুসলমানগণ গর্ত করে প্রয়োজনীয় পানি আটকে রাখলেন।
রমযানের ১৭ তারিখ যুদ্ধ শুরু হলো। নবী করীম [ﷺ] একটি তাঁবুতে নামাযের সিজদায় পড়ে এ বলে কাঁদতে লাগলেন-“হে আল্লাহ! আমার এই সল্প সংখ্যক সাহাবী যদি শহীদ হয়ে যায়- তবে তোমার নাম কে নেবে? আমি তোমার নামের উছিলা ধরে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি।" (হাদীস)
এই অসহায়ত্ব প্রকাশ করা উম্মতের শিক্ষার জন্য ছিল। নতুবা তিনি তো পূর্বেই বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। নবী [ﷺ] নামায অবস্থায় মুহুর্তের জন্য তন্দ্রাময় হয়ে পড়েন। তিনি দেখতে পেলেন- সাদা পাগড়ী পরিহিত এক হাজার ফেরেশতা মুজাহিদগণের সাহায্যার্থে অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর ফেরেশতাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে তিন হাজার ও পাচ হাজারে উন্নীত হলো। কোরআন মজিদের সুরা আল-ইমরানের ১২৩, ১২৪ ও ১২৫ আয়াতে ৫০০০ হাজার অশ্বারোহী ফেরেশতা অবতরনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বদরের যুদ্ধে ফেরেশতাগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কিভাবে শত্রু নিধন করতে হয়- তা তাঁদের জানা ছিলো না। আল্লাহ তায়ালা সুরা আনফাল ১২নং আয়াতে তাঁদেরকে শত্রুর উপর আঘাত হানার কৌশল শিক্ষা দিয়ে ইরশাদ করেন-
- فَاضْرِبُواْ فَوْقَ الأَعْنَاقِ وَاضْرِبُواْ مِنْهُمْ كُلَّ بَنَان
অর্থঃ-“আল্লাহ বললেন- হে ফেরেশতাগণ, তোমরা শত্রুদের গর্দানের উপরিভাগে আঘাত হানো; আরো আঘাত হানো প্রত্যেক গিরায়" (আনফালঃ ১২)।
ফেরেশতাগণ কর্তৃক শত্রু নিধনের আলামত ছিল- গলায় কালো দাগ। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আমরা তরবারী দ্বারা আঘাত করার পূর্বেই কাফেরদের মস্তক দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়তো- এভাবে ৭০ জনের মধ্যে ৬৪ জনই ছিল ফেরেশতার আঘাতে নিহত। আমাদের হাতে মাত্র ৬ জন নিহত হয়েছে (তাফসীর রহুল বয়ান)
পরবর্তী তিনটি যুদ্ধে ফেরেস্তগণ সাহায্যার্থে আগমন করেছিলেন- কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। ঐ তিনটি যুদ্ধ ছিল- খন্দক, মক্কা বিজয় ও হোনাইন। ঐ সময় ফেরেশতাদের পাগড়ী ছিল যথাক্রমে কাল এবং সবুজ। সুতরাং মানুষের পাগড়ী সাদা, কালো অথবা সবুজ হওয়া উত্তম। ফেরেশতাদের অনুসরনের নামও ইবাদত - যদি নবীজীর অনুমোদন থাকে।
যুদ্ধে দুই কিশোরের অংশগ্রহণঃ
বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মোআয ও মোআওয়ায নামক দু’জন বালক আগ্রহ প্রকাশ করলে নবী করীম [ﷺ] তাদের শান্ত্বনা দিয়ে পরবর্তী কোন এক যুদ্ধে তাদের নেয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তাঁদের একজন পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে লম্বা হয়ে দাঁড়ালো। নবী করীম [ﷺ] তাঁর আগ্রহ দেখে অভীভূত হয়ে তাঁকে সৈন্যদলে ভর্তি করে নিলেন। এ অবস্থা দেখে অপর সাথী বললো- “সে লম্বা হলে কি হবে, মল্লযুদ্ধে সে আমার সাথে পারবেনা।" এ বলে সে মল্লযুদ্ধে ওকে হারিয়ে দিলো। নবী করীম [ﷺ] তাকেও সৈন্যবাহিনীতে নিয়ে নিলেন। এ ছিল তৎকালীন কিশোর বালকদের নবীপ্রেমের নমুনা।
তাঁরা দু’জন যুদ্ধক্ষেত্রে দাড়িঁয়ে নবীজীর দুশমন আবু জাহলকে অনুসন্ধান করতে লাগলো। একজন সাহাবীর মাধ্যমে তাঁরা আবু জাহলকে চিনে নিলো। আবু জাহল ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধের তদারকী করছিলো। বালকদ্বয় বাজপাখীর ন্যায় আবু জাহলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তার ঘোড়ার পা কেটে ফেললো। আবু জাহল ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেলো। তারা আবু জাহলকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেললো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এসে আবু জাহলের শিরোচ্ছেদ করে ফেললেন। এভাবে নবীজীর বড়শত্রু আবু জাহল ছোট দুই বালকের হাতে নিতত হলো। একেই বলে কাঁদায় পড়ে হাতীর মৃত্যু- একেই বলে বালকদের নবীপ্রেম (রুহুল বয়ান)!
[নবীজীর দুশমনের বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন করাই সত্যিকার ঈমানের পরিচায়ক ]
যুদ্ধ শুরুঃ
বদরে প্রথমে মল্লযুদ্ধ শুরু হলো। কোরাইশদের পক্ষে ওতবা, তাঁর ভাই শায়বা এবং ছেলে ওলীদ। এই তিনজন ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে মুসলমানদেরকে মল্লযুদ্ধে আহবান করলো। আনসারগণের মধ্য হতে তিনজন অগ্রসর হলে কোরাইশরা বললো- তোমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা চাই আমাদের সমকক্ষ কোরাইশ বীর। নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইঙ্গিতে হযরত ওবায়দা (رضي الله عنه), হযরত হামযা (رضي الله عنه) ও হযরত আলী (رضي الله عنه) মল্লযুদ্ধে এগিয়ে আসলেন। হযরত হামযা (رضي الله عنه) এক আঘাতেই শায়বাকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। হযরত আলী (رضي الله عنه) অলীদকে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। হযরত ওবায়দা (رضي الله عنه) ওতবার সাথে মল্লযুদ্ধে পেরে উঠছিলেন না। হযরত হামযা ও আলী (رضي الله عنه) অগ্রসর হয়ে ওতবার উপর হামলা চালালেন এবং তাকে নিহত করলেন। ওতবার কন্যা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা পরবর্তী বছর ওহোদ যুদ্ধে এই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলো। সে হযরত হামযা (رضي الله عنه)-এঁর কলিজা বের করে চিবিয়ে খেয়েছিল এবং অন্যান্য অঙ্গ পতঙ্গ ছেদন করে মালা বানিয়ে গলায় পরেছিল। ফতেহ মক্কায় সে মুসলমান হয়।
তিন বীরের ধরাশায়ী হওয়ার দৃশ্য দেখে কোরাইশ বাহিনী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রচন্ড যুদ্ধ আরম্ভ হলো। একদিকে এক হাজার দূর্ধর্ষ যোদ্ধা, অপরদিকে ৩১৩ জন নিরস্ত্র-প্রায় মুসলিম বাহিনী।
খেজুরের ডাল তলোয়ার হয়ে গেলঃ
উক্ত যুদ্ধে হযরত ওকাশা (رضي الله عنه) নামক জনৈক সাহাবীর তরবারী ভেঙ্গে যায়। নবী করীম [ﷺ] তাঁকে খেজুরের একটি শুকনো ডাল দিয়ে বললেন- তুমি এটা দিয়ে যুদ্ধ করো। আল্লাহর কুদরতে খেজুরের ডাল ইস্পাতের তলোয়ারে পরিণত হয়ে গেলো। এই তলোয়ারের নাম রাখা হয় ‘আউন’ বা আল্লাহর সাহায্যা। হযরত ওকাশা (رضي الله عنه) সাড়া জীবন উক্ত তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!
[হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর হাতের লাঠি হয়েছিল অজগর, আর নবী করীম[ﷺ]-এর হাতের পরশে খেজুরের ডাল হলো ইস্পাতের তালোয়ার। এর চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় ছিল- নবীজীর পরশে ঈমানশূন্য হৃদয়গুলোও আল্লাহর আরশে পরিণত হয়েছিল।]
ভাঙ্গা হাত জোড়া লাগলঃ
বদরের যুদ্ধে হযরত মুয়ায ইবনে আমর (رضي الله عنه)-এঁর একটি হাত আবু জাহলের পুত্র ইকরামার তরবারীর আঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। মুয়ায (رضي الله عنه) হাতের খন্ডিত অংশসহ নবী করীম[ﷺ]-এঁর খেদমতে উপস্থিত হলেন। হুযুর পাক [ﷺ] একটু থুথু মোবারক লাগিয়ে খন্ডিত অংশ সংযুক্ত করে দিলেন। সাথে সাথে হাত জোড়া লেগে গেলো। হযরত মুয়ায (رضي الله عنه) উক্ত হাত নিয়ে সুস্থ অবস্থায় হযরত ওসমান (رضي الله عنه)-এঁর খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
[সাহাবায়ে কেরামের আক্বিদা ছিল নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর প্রতিনিধি। তাঁর মধ্যে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য আপন শক্তি প্রদান করেছেন। তিনি দ্বিখন্ডিত হাত ভাল করতে পারেন। সামান্য খেজুরের ডালকে তলোয়ারে পরিণত করতে পারেন। যারা এই বিশ্বাস রাখে- তারাই আহলে সুন্নাত।]
যুদ্ধের ফলাফলঃ
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে ১৪ জন শহীদ হন। তন্মধ্যে ৬ জন মোহাজির এবং আটজন আনসার। অপরপক্ষে কোরাইশ বাহিনীর মধ্যে ৭০ জন নেতৃস্থানীয় লোক নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দী হয়। নিহতদের মধ্যে ছিল আবু জাহল, ওতবা, অলিদ, শায়বা-প্রমুখ নেতা। বন্দী ৭০ জনের মধ্যে নবী করীম [ﷺ]-এঁর চাচা আব্বাস, বড় জামাতা আবুল আ’ছ, চাচাত ভাই আকিল এবং নওফেল- এই চারজন ছিলেন নবী করীম [ﷺ]-এর আপনজন। বদরের যুদ্ধে কোরাইশরা পর্যূদস্ত হয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে ধন-দৌলত ও রসদপত্র এবং অস্ত্র-সস্ত্র ফেলে তারা পলায়ন করে। তাদের মাল-সামান ও ইজ্জত আবরু ধূলায় ভূলুন্ঠিত হয়ে যায়। তাদের শোচনীয় পরাজয়ে ইসলাম বিজয় ও শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আল্লাহ তায়ালা বদর দিবসকে “ইয়ামুল ফোরকান“ বা "হক ও বাতিলের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী দিবস" হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
নবীজীর হাতই আল্লাহর হাতঃ
এই যুদ্ধের শুরুতে নবী করীম [ﷺ] এক মু্ষ্টি কঙ্কর নিয়ে ঐগুলোতে ফুঁক দিয়ে দূর থেকে শত্রুদের দিকে নিক্ষেপ করেন। উক্ত কঙ্কর প্রত্যেক শত্রুসেনার চোখে গিয়ে পড়ে। এতে তারা দিশেহারা হয়ে যায় এবং তাদের দৃষ্টিবিভ্রাট ঘটে। আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা বর্ণনাকালে এরশাদ করেন- وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللّهَ رَمَى
“হে রাসূল, আপনি যখন কঙ্কর নিক্ষেপ করছিলেন - তখন আপনি নিক্ষেপ করেন নি- মূলতঃ আল্লাহ তায়ালাই নিক্ষেপ করেছেন।" (সুরা আনফাল, আয়াত ১৭)।
[এখানে নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাতকে আল্লাহ তায়ালা নিজের হাত এবং নবী করীম [ﷺ]-এঁর কঙ্কর নিক্ষেপকে আল্লাহর নিজের নিক্ষেপ বলেছেন। প্রকৃত পক্ষে- নবী করীম [ﷺ] ছিলেন আল্লাহ তায়ালার যাত ও সিফাতের প্রকাশস্থল বা মাযহাব। নবী করীম [ﷺ]-এঁর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আপন শক্তি ও কুদরত প্রকাশ করেছেন। “নবীর কথা আল্লাহর কথা, নবীর কাজ আল্লাহর কাজ, নবীর মায়া আল্লাহর মায়া, নবীর নারাযী আল্লাহর নারাযী এবং নবীর সন্তুষ্টি আল্লাহর সন্তুষ্টি বলে বিবেচিত।" তিনি তো আল্লাহর অতি ঘনিষ্ট বন্ধু।
এই পর্যায়কে তরিকতের ভাষায় ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ্ (আল্লাহতে লীন হয়ে আল্লাহতে অস্তিত্ববান) বলা হয়। যাহেরী অবস্থা বান্দা সৃষ্টি জগতে মোতাছাররিফ বা কর্তৃত্ববান হয়ে যান। যাহেরী অবস্থা মানুষের হলেও বাতেনী অবস্থা খোদায়ী গুণে গুণান্বিত হয়ে যায়। (যিয়াউল কুলুব -হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজির মককী- পৃষ্ঠা ২৯-৩০ দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য-হাজী এমদাদুল্লাহ সাহেব ছিলেন আশ্রাফ আলী থানবীর পীর। পীর বলেন কী, আর মুরীদরা বলে কী!]
যুদ্ধ শেষে নবী করীম [ﷺ]-এঁর নির্দেশে ৭০ জন নিহত কোরাইশ নেতার লাশ একটি গর্তে নিক্ষেপ করা হয়। ঐ গর্তকে ‘কালীর বদর’ বলা হয়। সমস্ত লাশ নিক্ষেপ করার তিনদিন পর নবী করীম [ﷺ] উক্ত কূপ বা গর্তের মূখে দাড়িয়ে প্রত্যেক লাশের নাম ধরে ডাক দিলেন এবং বললেনঃ
يا فلان بن فلان ويا فلان بن فلان هل وجدتم ما وعدكم الله ورسوله حقا؟ فأنى وجدت ما وعدني الله حقا -
অর্থঃ- “হে অমুকের পুত্র অমুক -হে অমুকের পুত্র অমুক! আল্লাহ ও তার রাসূল [ﷺ] তোমাদের পরিণতি সম্পর্কে যে ওয়াদা করেছিলেন- তা কি তোমরা সত্য পেয়েছো? আমার সাথে আল্লাহ যে ওয়াদা করেছিলেন - তা আমি সত্য পেয়েছি।" [মুসলিমঃ জান্নাত পর্ব, জান্নাতে মৃতের স্থান পেশ করা অধ্যায়, ২:৩৮৭, হাদিস: ২৮৭৩, ৬৯৫৯]
তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে আরও বললেনঃ يا أهل القلب بئس العشيرة كنتم كذبتمونى وصدقنى الناس -
অর্থঃ- “হে গর্তবাসীগণ! তোমাদের বর্তমান জীবন কতই না নিকৃষ্ট। যখন অন্যান্য লোকেরা আমাকে সত্য নবী বলে গ্রহণ করেছিল, তখন তোমরা আমাকে মিথ্যা মনে করতে।" (তারীখে তাবারীঃ হাঃ নং ৫৬০ তাফসীরে ইবনে কাসির, ৩/৪৪৪, সূরা মায়েদা, ৭৯ নং আয়াতের তাফসীর; আর রাওদ্বুল আনফ, ৫/১৪৭)
মৃতদের শ্রবণ শক্তিঃ
হযরত ওমর (رضي الله عنه) পাশেই দন্ডায়মান ছিলেন। তিনি আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি রূহবিহীন মৃত লাশের সাথে কিভাবে কথা বলেছেন? তারা কি আপনার কথা শুনে? নবী করীম [ﷺ]এরশাদ করলেন-
ما أنتم ما أقول منهم غير أنهم لا يستطيعون أن يردوا شيئا
অর্থ -“ আমি যা বলছি - তোমরা তাদের চেয়ে বেশী শুনতে পাচ্ছ না। কিন্তু কোন জবাব দেয়ার শক্তি এদের নেই" (বুখারী শরীফের পূর্বোক্ত হাদিসটি দ্রষ্টব্য; সহীহ বুখারী, জানাজা অধ্যায়, হাঃ নং ১৩০৭; তাফসীরে ইবনে কাসির, ৩/৪৪৪, সূরা মায়েদা, ৭৯ নং আয়াতের তাফসীর; সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, ৭/৪১৬)। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তিদের শ্রবণ শক্তি জীবিতদের চেয়ে বেশী, কিন্তু জবাব দেবার ক্ষমতা তাদের দেয়া হয়নি। এরূপ আক্বিদা পোষণ করি হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত।
[এই হাদীসখানা সহিহ্ বুখারীতে বর্ণিত। এই হাদীসের দ্বারাই মৃত ব্যক্তিগণ কর্তৃক জীবিত ব্যক্তিদের কথাবার্তা শ্রবণের প্রামানিক দলিল পাওয়া যায়। মৃত কাফেরগণকে যদি এই শ্রবণ শক্তি দেয়া হয়। তাহলে মুসলমান ওলী, গাউছ ও কুতুবগণের শ্রবণ শক্তি যে আরো কত বেশী - তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ইমামা গাযালী (رحمة الله علبه), মোল্লা আলী ক্বারী এবং আল্লামা মানাভী তাদের নিজ নিজ গ্রন্থ - যথাক্রমে ইহইয়াউল উলুম, মিরকাত ও তাইছির- এ বর্ণানা করেছেন-
إذا تجردت النفوس القدسية عن العلائق البدنية اتصلت إلى الملأ الأعلى وتسير فى أقطار السموات والأرض حيث تشاء وترى وتسمع الكل كالمشاهد -
অর্থ - পবিত্র আত্মাসমূহ (ওলী আল্লাহ) যখন দেহ পিঞ্জরমুক্ত হয়ে যান। তখন উর্দ্ধজগতের ফেরেশতাদের সাথে মিশে যায় এবং আসমান -জমিনের বিভিন্ন স্থানে যেখানে ইচ্ছা - তারা ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত ব্যক্তিদের ন্যায়ই তাঁরা সব কিছু দেখতে ও শুনতে পান।" (তাইসীরু বিশারহিল জামিয়িছ ছগীর, ইমাম মানাভী, ২/১৭৯; শরহে মিশকাত, ইমাম তীবী, সুনানে তিরমিজী'র ৯২৭ নং হাদীসের ব্যাখ্যা, ৩/১০৪৪)
পাখীরা খাঁচার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যেভাবে মুক্ত বিহঙ্গের মত যথায় ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারে, তদ্রূপ পবিত্র আত্মাগণও মুক্ত বিহঙ্গের মতই দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অধিক শক্তি নিয়ে যথায় ইচ্ছা চলাচল করতে পারেন। এর বিস্তারিত বিবরণ আল্লামা জালালুদ্দীন ছুয়ুতি কৃত "শরহে সুদূর" এবং ইমাম কুরতুবীর “আত -তাযকিরাহ" গ্রন্থে দেখুন।
[আমার লিখিত নূতন কিতাব “ হায়াত মউত ও কবর হাশর" -এ কবরী যিন্দেগী বিস্তিরিত আলোচনা করেছি।]
রমযান মাসের ১৭ তারিখেই যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধের ১৩ দিন পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে নবী করীম [ﷺ] নিজ পালিত পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه)-কে যুদ্ধজয়ের সু-সংবাদসহ মদীনায় প্রেরণ করেন। যায়েদ (رضي الله عنه) মদীনায় এসে দেখেন, নবী তনয়া হযরত রোকাইয়া (رضي الله عنه)-কে দাফন করে লোকেরা হাত মুখ ধূয়ে সবেমাত্র ঘরে ফিরেছেন। হযরত ওসমান (رضي الله عنه)-কে নবী করীম [ﷺ] মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন- অসুস্থ কন্যাকে সেবা সুশ্রুষা করার জন্য। এছাড়া আরো সাত জনকে মদীনায় থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তাঁরা সবাই বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসাবে গণ্য হন এবং গণিমতের মালের অংশ লাভ করেন।
যুদ্ধবন্দীদের সাথে ব্যবহার - নবীজীর ইলমে গায়েব প্রকাশঃ
নবী করীম [ﷺ] যুদ্ধবন্দীসহ মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। যুদ্ধবন্দীগণকে মসজিদে নববী সংলগ্ন স্থানে খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। নবী করীম [ﷺ]-এঁর চাচা হযরত আব্বাস-এঁর গায়ে জামা ছিলো না। তিনি শীতে কাঁপছিলেন। মোনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিজস্ব লম্বা জামা হযরত আব্বাসকে পরিধানের জন্য দান করে। এর বিনিময়ে নবী করীম [ﷺ] তার মৃত্যুর পর নিজের জামা মোবারক তার কাফনের জন্য দান করে দেনা পরিশোধ করেন। এটা ছিল সৌজন্যমূলক। যদি তাবাররুক হিসাবে নবী করীম [ﷺ]-এঁর কোন পবিত্র জিনিস কাফনের সাথে নিয়ে যান- তবে অবশ্যই তা নাজাতের উছিলা হিসাবে গণ্য হবে। অনেক সাহাবীকে হুযুরের কিছু নিদর্শন তাঁদের কাফনের ভিতর দিয়ে দাফন করা হয়েছিল।
তখনও পর্যন্ত যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তাই নবী করীম [ﷺ] পরামর্শ সভা আহ্বান করেন এবং সাহাবাগণের মতামত জানতে চান। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন -“নবী ও ইসলামের দুশমনদের কতল করা বাঞ্ছনীয় এবং আমাদের নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে নিজের হাতে কতল করা উচিৎ। আমার নিজ মামা হেশামকে আমার নিজ হাতে কতল করতে চাই। আলী তার ভাই আকিলকে হত্যা করুক। হামযা তাঁর ভাই আব্বাসকে কতল করুক।" হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) আরয করলেন- “যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক -এতে মানবিক উদারতা ও যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ- উভয় দিকই রক্ষা পাবে।"
নবী করীম [ﷺ] হযরত আবু বকরের (رضي الله عنه) মতামত পছন্দ করে সামর্থবান বন্দীদের নিকট থেকে ২০ উকিয়া-মতান্তরে ৪০ উকিয়া করে জনপ্রতি ক্ষতিপূরণ আদায় করে ছেড়ে দেন এবং অসমর্থ যুদ্ধবন্দীদেরকে মুসলমানদের গৃহ -শিক্ষক নিযুক্ত করেন। পৃথিবীর মানুষ হতবাক হয়ে যুদ্ধের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষ করলো - “নবী করীম [ﷺ] যুদ্ধবন্দীদেরকে ওস্তাদের সম্মান প্রদান করেছেন।" এই উদারতার নযির একমাত্র ইসলামেই পাওয়া যায। [ওহী নাযিলের পূর্বে এই পরামর্শ নেয়া হয়েছিল। কেননা, যুদ্ধবন্দীর ব্যাপারে শরিয়তের বিধান বদর যুদ্ধের পরে নাযিল হয়। আল্লাহ তায়ালা এ ঘটনায় হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এঁর কঠোরতাকে পছন্দ করেছিলেন এবং অন্য সাহাবীদের পরামর্শের খারাপ পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু নবীজীর খাতিরে পরবর্তী সময়ে ছুরা মুহাম্মদ ৪নং আয়াত দ্বারা মুক্তিপণ গ্রহণকে বৈধ ঘোষণা করেছেন।
পূর্ণ আয়াতটি হলো-
فَاِذَا لَقِيۡتُمُ الَّذِيۡنَ كَفَرُوۡا فَضَرۡبَ الرِّقَابِ ؕ حَتّٰٓى اِذَاۤ اَثۡخَنۡتُمُوۡهُمۡ فَشُدُّوۡا الۡوَثَاقَ َاِمَّا مَنًّۢا بَعۡدُ وَاِمَّا فِدَآءً حَتّٰى تَضَعَ الۡحَرۡبُ اَوۡزَارَهَا -
অর্থঃ-“অতঃপর তোমরা যখন কাফেরদের বিরুদ্দে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও- তখন তাদের গর্দানে মারো। অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত করবে -তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেলো। অতঃপর যুদ্ধ শেষে হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের নিকট থেকে মুক্তিপণ লও।" (ছুরা মুহাম্মদ ৪ আয়াত)
নবীবিদ্ধেষীরা সুরা আনফালের ৬৭ নম্বর সর্তককারী রহিতকৃত আয়াতকে পুঁজি করে নবীজির শানে আঘাত করে থাকে।
প্রথমেই হযরত আব্বাছের ওপর মুক্তিপণ ধার্যঃ
এবার মুক্তিপণ আদায়ের পালা। নবী করীম [ﷺ] প্রথমে আপন চাচা আব্বাস (رضي الله عنه), জমাতা আবুল আছ, চাচাতো ভাই আকিল ও নওফেল -এই চারজন দিয়ে শুরু করেন।
নবী করীম [ﷺ]-এঁর নিজ কন্যা হযরত জয়নাব তাঁর মা হযরত খাদিজার (رضي الله عنها) কর্তৃক উপঢৌকন স্বরূপ প্রদত্ত গলার হারখানা স্বামীর মুক্তির জন্য পাঠিয়ে দিলেন। নবী করীম [ﷺ] অশ্রুস্বজল নেত্রে হারখানা উলটিয়ে পালটিয়ে দেখছিলেন এবং বিবি খদিজার (رضي الله عنها) কথা স্মরণ করে কাঁদছিলেন। সাহাবাগণ বিবি খদিজার (رضي الله عنها) -এঁর সম্মানে বিনা পণে আবুল আছকে মুক্তিপণ স্বরূপ হযরত জয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়ার শর্তে জামাতাকে মুক্তি দেন। অপর দু’জন আকিল ও নওফেল -এঁর উপর মাথাপিছু ২০ উকিয়া করে ৪০ উকিয়া- মতান্তরে ৪০ উকিয়া করে ৮০ উকিয়া এবং আব্বাসের একার উপর ৮০ উকিয়া ধার্য্য করে মোট ১৬০ উকিয়া স্বর্ণমুদ্রা মুক্তিপণ ধার্য করেন এবং হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-এঁর উপর এই মুক্তিপণ আদায়ের নির্দেশ দান করেন। (এক উকিয়া ৪০ দীনারের সমান -প্রতি দিনার সাড়ে বার টাকার সমান - যার (এক উকিয়া) মূল্যা তৎকালীন ৫০০ টাকা)। এই হিসাবমতে ১৬০ উকিয়ার মূল্যমান দাড়ায় তৎকালীন ৫০০* ১৬০= ৮০, ০০০/- আশি হাজার টাকা)
হযরত আব্বাছ এই বিরাট অংকের কথা শুনে মাথায়া হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তিনি বললেন- “আমি পূর্বে বিশ উকিয়া স্বর্ণ (৮০ দীনার বা এক হাজার টাকা) চাঁদা বাবদ আবু জাহলকে দিয়েছি -যা গণিমতের মাল হিসাবে বর্তমানে আপনার অধিকারে এসেছে। এছাড়া আমার আর কোন সম্পদ নেই- যার দ্বারা ৮০, ০০০/- (আশি হাজার) টাকার এত বিরাট অংকের মুক্তিপণ আদায় করতে পারি। নবী করীম [ﷺ] বললেন-
فقال رسول الله فأين المال الذى دفنته أنت وأم الفضل تحت اسكفه الباب وقلت لها أن قتلت فهو للصبية فقال والله يا رسول الله أن هذا شيئ لم يطلع عليه غيرى وغير أم الفضل إلا الله عز وجل الأخ (بداية نهاية)
অর্থঃ- "নবী করীম [ﷺ] বললেন- চাচাজান, আপনি মক্কা থেকে আসবার সময় আমার চাচী উম্মুল ফযলের নিকট আশি হাজার টাকা বা ১৬০ উকিয়া স্বর্ণমুদ্রা গচ্ছিত রেখে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন - যদি আমি যুদ্ধে মারা যাই, তাহলে এগুলো আমার সন্তানদের ভরণ-পোষনের জন্য ব্যয় করবে। আমার চাচী এবং আপনি জানেন উক্ত স্বর্ণ মুদ্রাগুলো কোথায়।" তখন হযরত আব্বাছ ( رضي الله عنه) বললেন- “ঐ মালের খবর আল্লাহর পরে আমি ও আমার স্ত্রী উম্মুল ফযল ছাড়া আর কেউ জানেনা- আপনি অন্ধকার রাত্রির এই ঘটনা জানলেন কী করে?" হুযুর [ﷺ] বললেন, "এই গায়েবী খবর আল্লাহ আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই আমি ঐ গচ্ছিত পরিমাণ মালই চেয়েছি-এর বেশী চাইনি।" [তাফসীরে ইবনে কাসির, সূরা আনফাল, ৭০ নং আয়াতের তাফসীর; বেদায়া ও নেহায়া, ইবনে কাসির, ৫/১৬৯-১৭০; দালাইলুন নবুওয়ত, ইমাম বায়হাকী, ৩/১৪৩]
হযরত আব্বাছ (رضي الله عنه) নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েবের প্রমাণ পেয়ে হতবাক হয়ে গেলেন এবং সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করলেন। কিন্তু ৮ম হিজরীতে ফতেহ মক্কা পর্যন্ত তাঁর ইসলাম গ্রহণ গোপন রাখলেন। তিনি মক্কা শরীফ থেকে গোপন তথ্য মদীনায় পাঠাতেন এবং মোশরেকদের সাথে মিলে মিশে থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন। ( শীফা শরীফ ও বেদায়া)। ( শাইখ সাদী (رحمة الله عليه) ৫ বছর সোমনাথ মন্দিরে ব্রাহ্মণবেশে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সুলতান মাহমুদ গজনবীকে দিয়েছিলেন। এরূপ করা ইসলামী জিহাদের জন্য জায়েয।)
নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েব এর প্রমাণ পেয়ে এবং স্বীকৃতি দিয়ে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-এঁর ঈমান নসীব হলো আর বর্তমানের ওহাবী মওদুদীবাদীরা ইলমে গায়েব অস্বীকার করে ঈমানহারা হচ্ছে। মানার নামই তো ঈমান। শুধু জানার নাম ঈমান নয়। কোরাইশ নেতাগণ কোথায় কখন মারা পড়বে, এর অগ্রীম সংবাদ প্রদান করা এবং সুদূর মক্কার অন্ধকার ঘরে লুক্কায়িত মালের সন্ধান দেয়া নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েবের প্রকৃষ্ট দলিল।
[ইবনে কাছির ও কাযী আয়ায নবীজীর এই ইলমে গায়েব কে স্বীকার করেছেন- অথচ আমাদের দেশের জঘন্য জ্ঞানপাপীরা তা স্বীকার করতে কুন্ঠিত। দারুস সালামের কথিত ভন্ডপীর আবদুল কাহহার ১৯৯৪ সালে প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ঘোষণা দিয়েছিল- “যারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েব আছে বলে বিশ্বাস করবে- তারা কাফির"। আমি ১৯৯৫ সালে এপ্রিল মাসের ১লা তারিখে দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্টায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এই জাহেল পীরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম- কিন্তু সে মোকাবেলা করেনি। নবীর ইলমে গায়েব অস্বীকার করে সে কুফরির ফতোয়া মাথায় নিয়ে বর্তমানে কবরে আছে। তার ঘোষণামতে- হযরত আব্বাস (رضي الله عنه), ইবনে কাছির ও কাযী আয়ায নবীজীর ইলমে গায়েব অস্বীকার করে কি হয়েছিলেন? নাউযুবিল্লাহ! বে-এলেম পীর সাজলে এমনিভাবেই মানুষকে গোমরাহ করে। আল্লাহ বে-এলেম পীর থেকে আমাদের ঈমান, আক্বীদা ও আমললে হেফাজত করুন। কোন পীর নবীজীর শানে বেয়াদবীমূলক উক্তি করলে সাথে সাথে থাকে ত্যাগ করা ফরয। শরীয়তমতে তাকে কতল করা ওয়াজিব। (ফতোয়া শামী)
ইমামে রাব্বানীর ফতোয়া
হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (رحمة الله عليه) তাঁর মাকতুবাত শরীফের প্রথম খন্ড ৩১০ নম্বর মকতুবে লিখেন, “যে ইলমে গায়েব আল্লাহ তায়ালার জন্যে খাছ- তৎসম্পর্কে তিনি তাঁর বিশেষ বিশেষ রাসূলগণকে অবহিত করে থাকেন।" উল্লেক্ষ্য যে, আল্লাহর খাছ ইলমে গায়েব ৫টি। যথাঃ কেয়ামত কবে হবে, কখন বৃষ্টি হবে, মায়ের পেটে কি সন্তান আছে, কার রিযিক কোথায় এবং কার মৃত্যু কোথায়? উক্ত ৫টি ইলমে গায়েব সম্পর্কেও আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ] অবহিত রয়েছেন (ছুরা জ্বীন)। অথচ আব্দুল কাহহার ফতোয়া দিলেন- “যারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েব বিশ্বাস করে-তারা কাফের।" তার ফতোয়ামতেই তার তরিকার ইমামে রাব্বানী (رحمة الله عليه) কাফের সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। (নাউযুবিল্লাহ!) সূত্রঃ শর্ষিনার তাবলীগ পত্রিকা ১৯৭০ইং মে সংখ্যা। আল্লাহ প্রদত্ত নবীজীর ইলমে গায়েব স্বীকার করে না একমাত্র মউদূদী ও দেওবন্দপন্থীরা।]